শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
ব্যারিস্টার পাড়া থেকে বিদায় নেবার আগে বিভূতিদা একদিন আমাকে হাইকোর্টে নিয়ে গিয়েছিলেন। গেটে ঢুকতে ঢুকতে তিনি বলছিলেন, “কেমন জব্বর বাড়িখান দেখছ তো? বাড়িটার অনেক হিস্ট্রি সায়েবের কাছে শুনেছিলাম। কোথাকার এক টাউন হল-এর অনুকরণে তৈরি, নামটা কিছুতেই মনে থাকে না।” উঁচু উঁচু সিঁড়ি বেয়ে আমরা প্রথমে দোতলায় গেলাম। কাঠের প্যানেল দেওয়া বড় বড় ঘর। প্রতি ঘরের বাইরে জজদের নাম লেখা। “মিস্টার জাস্টিস্ রণধীর সিংহ বাচাওয়াত, টেকিং ইন্টারলকুটারি অ্যাফেয়ারস।”
“এর মানে কি?”
বিভূতিদা পিছন ফিরে বললেন, “এখানে অনেক নতুন কথা শিখবে, একদিনে হবে না, সময় লাগবে।”
আমরা অন্য এক ঘরে ঢুকে পড়লাম। এখানে আবার দু’জন জজ। বিভূতিদা কানে কানে বললেন, “আপীল হচ্ছে। খুব সাবধান, কোনো আওয়াজ না হয়।”
কোর্টঘর দেখা শেষ করে বিভূতিদা আমাকে যেখানে নিয়ে গেলেন, সেখানে গাদা গাদা বই প্রায় মাথার ছাদ পর্যন্ত সাজানো। এক ভদ্রলোক হাতে কাগজ নিয়ে মই বেয়ে সরসর করে উপরে উঠে যাচ্ছেন। দেওয়াল থেকে একখানা বই টেনে নিয়ে তিনি আবার ইঁদুরের মতো দ্রুতগতিতে নেমে এসে অন্য আর এক জায়গায় মই লাগাচ্ছেন। “বার-লাইব্রেরী ব্যারিস্টারদের ক্লাব। এখান থেকে বই নিয়ে যেতে হবে মাঝে মাঝে”, বিভূতিদা বলে দিলেন।
“আরও অনেক দেখবার আছে, কিন্তু সময় নেই। ষোলোবছর এ পাড়ায় কাটিয়েও সব জানতে পারিনি, তুমি একদিনে কী করবে?”
হাইকোর্ট থেকে বেরিয়ে, আমরা আবার বৃন্দাবনের লিফটে চড়ে টেম্পল চেম্বারের চারতলায় ফিরে এলাম।
ক’দিন পরে আমাকে আবার হাইকোর্টে যেতে হলো। এবার একা একা। বিভূতিদা নেই। বার-লাইব্রেরী থেকে বই আনতে হবে। সশঙ্কচিত্তে এই অপরিচিত জগতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলাম। ব্যারিস্টারের বাবু হয়েও এখানকার কোনো আইন-কানুন আমার জানা নেই।
লাইব্রেরীর সামনে বারান্দায় পরপর সাজানো খানকয়েক বেঞ্চিতে আট দশজন লোক বসে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হঠাৎ বলে উঠলেন, – “এই যে স্যার, এদিকে একটু দেখা দিয়ে যান না স্যার।”
সলজ্জভাবে বেঞ্চির কাছে এগিয়ে গেলাম। “আমাকে কিছু বলছেন।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার,” রোগামতো এক ভদ্রলোক মুখভর্তি পানের পিক সামলাতে সামলাতে বললেন। “মহাশয়ের পরিচয়, নিবাস ইত্যাদি জানতে পারি কি?”
পাশের এক ভদ্রলোক আমাকে সে যাত্রা রক্ষা করলেন। রোগা-মতো লোকটিকে ভর্ৎসনা করে তিনি বলে উঠলেন, “আঃ অর্জুন, পেটে বোমা মারলেও তো ‘ক’ অক্ষর বেরোয় না। আর ছেলেমানুষটাকে নতুন পেয়ে বঙ্কিমী বাংলা চালাচ্ছ! ছি ছি!”
আমার পরিত্রাতার দিকে চেয়ে রইলাম। ভদ্রলোকের মাথার চুল প্রায় সাদা হয়ে এসেছে। গায়ে আধময়লা লঙ-ক্লথের পাঞ্জাবি, পায়ে রবারের নিউকাট জুতো, আর গলায় পাকানো একটা আধময়লা চাদর। খুব লম্বা টানের শেষে মুখের বিড়িটা মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে ঘষতে ঘষতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—
“তুমিই বুঝি বিভূতির জায়গায়—সায়েবের নতুন বাবু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আমরাও তোমার মতো ব্যারিস্টারদের বাবু। কিন্তু তোমার কপাল ভাল। এখানকার ক’জন বাবু আর তোমার মতো আপিসে বসতে পায়। অমন নইলে সায়েব! বিভূতিকে বড় ভালোবাসতো। নিজে থেকে বিলিতি আপিসে মস্ত চাকরি করে দিলো।
তা এই যে ক’খানা বেঞ্চি দেখছ সবক’টি বাবুদের জন্যে রিজার্ভ। যখন ইচ্ছে হয় আসবে এবং এখানে বসে থাকবে।”
অন্য একজন কথার মধ্যে বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “এ-পাড়ায় ক’দিন হলো?”
“সাতদিন,” আমি উত্তর দিলাম।
“এ্যাঁ, মাত্র সাতদিনের দুগ্ধপোষ্য শিশু! এখানকার হালচাল কিছুই জানা নেই নিশ্চয়। ছোকাদা, আপনি তো আমাদের ট্রেনর, একে ট্রেনিং দিয়ে দিন। নইলে কোন সময় বাবুদের প্রেস্টিজ ঢিলে করে ছেড়ে দেবে।”
ছোকাদা বললেন, “হ্যাঁ বাপু, মোস্ট ইম্পর্টেন্ট কথাটা শুনে রাখো। উকিলের মুহুরীদের কোনো পাত্তা দেবে না। তুমি ব্যারিস্টারের বাবু–সিপাইকা ঘোড়া, হাতিকা দাঁত, আর ব্যারিস্টারকা বাবু। আমাদের সায়েবদের বিলেত থেকে পাস দিয়ে আসতে হয়েছে, আর উকিলবাবুরা আজকাল ল’ কলেজে রাত্রে ক্লাস করে ব্যারিস্টারদের ডিঙিয়ে যেতে চান। এ যে বাপু জাম্পিং হর্স ইটিং গ্রাস।” আসলে ছোকাদা বলতে চাইলেন উকিলদের সঙ্গে ব্যারিস্টারদের যে তফাত, মুহুরী ও বাবুদের মধ্যে সেই একই পার্থক্য।
ছোকাদাকে থামিয়ে টাকমাথা এক ভদ্রলোক বললেন, “দেবতাদের বাহন বোঝো? আমরাও সেই রকম। কার্তিকের ময়ূর, গণেশের ইঁদুর, মহাদেবের ষাঁড়, আর ব্যারিস্টারের বাবু, সব এক কেলাসের।”
পিছনের বেঞ্চি থেকে অন্য এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “দাদা, তোমাদের হাই হাই টক্ রাখো। মাইরি বলছি, মেজাজ একদম বিগড়ে রয়েছে। কলিফ্লাওয়ারের মতো এনিম্যাল যে হ্যান্ডিকাপে ডোবাবে, কেমন করে জানবো!”
ওই বেঞ্চিতে ঘোড়ার আলোচনা পুরোদমে চলছে। মাঝে মাঝে দু’-একটা কথা কানে আসে— পুণা রেস, গভর্নর জেনারেলস প্লেট, হ্যান্ডিকাপ।
হাতে একটা ছাপানো কাগজ নিয়ে আর এক ভদ্রলোক বেঞ্চিতে এসে বসলেন। ঐ ছাপানো কাগজটি আমার জানা। বিভূতিদা বলে দিয়েছিলেন, “এর নাম ডেলি কজ্ লিস্ট। কোন কোর্টে কী মামলা ধরা হবে তার লিস্টি। রোজ সকালে এসে এই লিস্টি দেখবে, সায়েবের মামলা থাকলে লাল পেন্সিলে দাগ দিয়ে রাখবে।”
ভদ্রলোক ঠিক হয়ে বসার আগেই সমস্বরে সবাই জিজ্ঞাসা করে উঠল,– “এই যে দাদা, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “ ছ’ নম্বরে বাঁড়ুজ্যের কোর্ট ওয়াচ করছিলাম। সায়েব আবার মিত্তিরের কোর্টে রয়েছেন; সময়মতো খবর দিতে হবে। ব্যাটা এটর্নির আর কি, ব্রীফ দিয়ে তিনি ঘুম মারতে গেলেন। আর ছাই আমি তীর্থ-কাকের মতো কোর্টে হাঁ করে বসে থাকি!” কথা শেষ না করেই ভদ্রলোক আবার উঠলেন। “যাই, কেদারবাবুকে ধরিগে যাই। বই-এর লিস্টি তো অনেকক্ষণ দিয়ে এসেছি।” তারপর তিনি ব্যস্তভাবে বার-লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান কেদারবাবুর সন্ধানে বেরিয়ে গেলেন।
“হারুটা আর বাতাল্লা মারার জায়গা পেলে না। বেটা আমাদের কাছেও রাজা-উজির মারছে।” ছোকাদা বললেন।
“যা বলেছ ছোকাদা,” আর একজন ফোড়ন দিলে। “হারুটা তো হাজরা সাহেব বলতে অজ্ঞান। কিন্তু বাপু, বিজয় হাজরা মাসে ক’টা অ্যাপিয়ার হচ্ছে, সে কি আর আমরা দেখতে পাচ্ছি না! দুটো ব্রীফ এক সঙ্গে হাতে থাকে কিনা সন্দেহ। তাতেই হারু ধরাকে সরা জ্ঞান করছে।”
বার লাইব্রেরী থেকে গাউন হাতে একজন আমাদের বেঞ্চির কাছে এগিয়ে এসে ডাকলেন,”অর্জুন, এই ব্রীফটা সান্ডেল কোম্পানীর রমেনবাবুকে দিয়ে এসো আর বলে দিও আজ সাড়ে চারটায় কন্সালটেশন।”
অর্জুনবাবু ব্রীফ দিয়ে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন। ছোকাদা চিনিয়ে দিলেন, “ঘোষ সাহেব, কমার্সিয়াল ম্যাটারে ঝানু ব্যারিস্টার।”
ছোকাদা অন্যান্য বাবুদের সঙ্গে একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন—ব্যানার্জী সাহেবের বাবু, চৌধুরী সাহেবের বাবু, যেন বাবুদের কোনো নিজস্ব পরিচয় নেই। হারুবাবু, হারুবাবু নয়; তাঁর ডাকনাম ও পরিচয় ‘হাজরা সাহেবের বাবু’।
একেবারে শেষ বেঞ্চিটা একটু নড়বড়ে। সেখানে যে চার-পাঁচজন লোক বসে আছেন, ছোকাদা তাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন না। বললেন, “ওরা এখনও জুনিয়র। আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারবার স্ট্যান্ডার্ডে আসেনি।”
“আজ্ঞে আমিও তো জুনিয়র,” ছোকাদাকে বললাম।
জিব কেটে ছোকাদা বললেন, “ছি ছি, তুমি জুনিয়র নও। তুমি সিনিয়র।” জুনিয়র সিনিয়র রহস্য বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। সিনিয়র ব্যারিস্টারের বাবু আমি বয়সে যতই জুনিয়র হই না কেন, বাবু সমাজে আমি সিনিয়র। অথচ জুনিয়র ব্যারিস্টারের বাবু বয়সে সিনিয়র হলেও সমাজে তিনি জুনিয়র।
ছোকাদার স্নেহ লাভ করে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি। সময় পেলেই চেম্বারে মোহনচাঁদকে রেখে ছোকাদার কাছে যাই। প্রতিমিনিটে কত নতুন কথা, কত নতুন খবর জানতে পারি। যেমন এটর্নিদের সঙ্গে বাবুদের সম্পর্ক।
বাবুরা সায়েবের ব্রীফের জন্য এটর্নিদের আপিসে যান। কখনও বা পথে দেখা হলে নমস্কার জানিয়ে বলেন, “এই যে স্যার, ভালো তো? একটু মনে রাখবেন।” আবার মামলার শেষে এটর্নি আপিসে হাজির হতে হয়। “স্যার চেকটা হবে নাকি? সায়েব পাঠালেন।” এটর্নি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দার্শনিকের হাসি হাসেন। বলেন, “আরে একটু নিঃশ্বাস ফেলতে দাও। ক’দিন যাক। মক্কেলের গলায় তো ছুরি লাগাতে পারি না। সবুরে মেওয়া ফলে, বুঝেছ ভজহরি?”
ভজহরি এর জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। এটর্নি মহাপাত্রের হাতে জলই গলতে চায় না, তায় চেক! তবু যথাসম্ভব বিনয় প্রকাশ করে বলে, “আজ্ঞে সে কথা তো একশ’বার। তবে স্যার তিনমাস হলো। সব কিছু তো চালাতে হবে।”
মহাপাত্র যেন শুনতে পেলেন না এমনি ভাব করে টেলিফোন তুলে নম্বর চান। ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করার আগে বলেন, “আচ্ছা ভাই ভজহরি, আবার দেখা-সাক্ষাৎ হবে। তোমার সায়েবকে বোলো।”
বিফল মনোরথ ভজহরি রাস্তায় বেরিয়ে আসে। দশ নম্বরের (দশ নম্বর ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীট; এ পাড়ায় শুধু নম্বর ধরে কথাবার্তা হয়) দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে একটা বিড়ি ধরায়। সায়েব রেগে যাবেন। বিশ্বাস করবেন না। বলবেন—‘তুমি ভালো করে বলতে পারো না। মহাপাত্র নিজে আমাকে বলেছে বাবুকে পাঠালেই চেক দিয়ে দেবে।’
“সবই কপাল,” ছোকাদা আমাকে বলছিলেন। “ওই মহাপাত্র পাঁচুবাবুকে নিজে এসে চেক দিয়ে যায়। ব্যারিস্টার সুব্রত রায়ের বাবু যে! চেক আসতে একদিন দেরী হলে পাঁচু পরের বার হটিয়ে দেবে। সুব্রত রায় তো আর ব্রীফের তোয়াক্কা করেন না!”
ছোকাদার পাশে বসে বাবুদের কর্ম-তালিকা সম্বন্ধে অনেক কিছু ধীরে ধীরে জেনেছি। সায়েবের জন্য সব কিছু করেন তাঁরা। ব্রীফ নিয়ে সায়েবের পিছনে পিছনে ছোটেন, বার-লাইব্রেরী থেকে সায়েবের জন্য বই নিয়ে আসেন। সি-ডবলু-এন, অল- ই-আর, এ-আই-আর, ইত্যাদি শব্দ প্রথমে আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে। বাবুরা কিন্তু এসব জানেন। ১৯৩৬-এর অল-ই-আর বললেই বাবু জিজ্ঞাসা করবেন, ভল্যুম এক না দুই স্যার? চিনির বলদ বলতে পারেন। মোটা মোটা বই তাঁরা বয়ে নিয়ে যান, আবার ফেরত আনেন। সায়েবের নির্দেশ মতো এক-একটি বিশেষ পাতায় একটু করে কাগজ গুঁজে রাখেন। সায়েবরা একের পর এক সেগুলো দেখে মামলা তৈরি করেন, আইনের নতুন ব্যাখ্যা সৃষ্টি হয় বা বিশেষ কোনো ধারা বাতিল হয়ে যায়। বাবুরা অতশত বোঝেন না। ছোকাদা বলেন, “আমরা জীঞ্জার মার্চেন্ট; জাহাজের খোঁজ নিয়ে কী করবো? আমরা শুধু দেখবো এটর্নি কে, ক’দিন হিয়ারিং হবে, ক’-মোহর মিলবে।”
মোহর! অনেকে অবাক হতে পারেন। মোহর আবার কি? এ কি আলিবাবার দেশ যে, মোহর দিয়ে কেনা-বেচা হয়? সবিনয়ে বলব হাইকোর্টে সব কিছু হিসেব হয় মোহর দিয়ে। ব্যারিস্টারের ফীও মোহর হিসেবে দিতে হবে। একজন নতুন মক্কেল রেগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মশায় মোহর পাবো কোথায়? আপনার সায়েবের জন্য তো আর টাকশালের কর্তারা টাকা তৈরি ছেড়ে মোহর তৈরি করতে বসবেন না।
তাঁকে অনেক কষ্টে বোঝালাম—”আজ্ঞে সে আমিও জানি। আমরা শুধু হিসাব করি সোনার মোহরে, নেবার বেলায় নিই রুপো কিংবা কাগজের টাকা। সতেরো টাকায় এক মোহর। সায়েব তিরিশ মোহর চেয়েছেন। সুতরাং তিরিশকে সতেরো দিয়ে গুণ করে যা হয়, অর্থাৎ পাঁচশ’ দশটাকা দিলেই চলবে।”
মোহরের কথা শুনে ছোকাদা হেসেছিলেন। “এ-পাড়ায় প্রথম এসে আমরাই কত আবোল-তাবোল বকেছি, ভাবলে হাসি লাগে। কিন্তু সে-সব কথা থাক।” ছোকাদা থেমে গেলেন। নিজের মনে বিড়বিড় করে তিনি বলছিলেন, “কত ব্যারিস্টার এ-পাড়ায় এল গেল। কত বাবুকেও তো দেখলাম।
“হাইকোর্টে কতদিন আছেন ছোকাদা?”
“অনেকদিন হয়েছে। তখন তোমরা জন্মাওনি, বুঝেছ হে?”
স্মৃতির রোমন্থন ছোকাদার ভালো লাগে। বিড়িটাতে শেষ টান দিয়ে তিনি বললেন,”ওহে ছোকরা, ব্যারিস্টারের বাবু হওয়া সহজ নয়। এর জন্য সময় লাগে, বুদ্ধি লাগে, আর লাগে কপাল। বুঝেছ?”
বুঝতে না পেরে ছোকাদার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। ছোকাদার তখন বলার নেশা ধরেছে। বললেন, “বোঝা কি এতই সহজ! এতদিন ধরে চেষ্টা করে আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না।” ছোকাদা আরম্ভ করলেন—
ছোকাদার তখন বছর পনেরো বয়স। ছ’-নম্বরের চোংদার কোম্পানী বড় সলিসিটর, সেই আপিসের ম্যানেজিং ক্লার্ক দাশুবাবু তাঁর মামা।
কাসুন্দেতে বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে দাশুবাবু ভাগনেকে জিজ্ঞাসা করলেন,”কোন ক্লাস হচ্ছে?”
“আজ্ঞে ফোর্থ ক্লাস।”
“লেখাপড়া শিখে তো বাপ-মাকে রাজা করবে। তার থেকে চলো হাইকোর্টে, কোনো সায়েবের বাবু করে দেব। দু’হাতে কাঁচা পয়সা। তিনটে পাস দিয়েও অতো পয়সা রোজগার করতে পারবে না। শুধু একটু কপাল-জোর চাই। আর কিছু না। ব্যারিস্টার সেনের একজন বাবু দরকার।”
ডিসেম্বরের গোড়া। গায়ে সবুজ রঙের র্যাপার চড়িয়ে পনেরো বছরের ছেলে কানাই ঘোষ ব্যারিস্টার দেখতে এল। সে কি জিনিস! কাসুন্দের লোকেরা বললে, “এ যে-সে ছেলে নয়, বিলেতফেরত ব্যারিস্টারের সঙ্গে দিন-রাত কাজ করবে। মাসখানেকের মধ্যেই আমাদের কানাই গড়গড় করে ইংরিজি বলবে।”
সেন সায়েবের সঙ্গে দেখা হলো। প্রথম দৃষ্টিতে ছোকাদা অবাক। এই ব্যারিস্টার! মিস্টার সেনের মুখে পাইপ। বয়স খুব কম। ঠিক যেন লাল টুকটুকে আপেল। এ ছেলে যাদের জামাই হবে……
সেন সাহেব বিলেত থেকে নতুন এসেছেন। কিন্তু বাঙলাতেই কথা বললেন। কাজ হয়ে গেল। হবার কারণও আছে। চোংদার কোম্পানীর ম্যানেজিং ক্লার্ক দাশুবাবুর ভাগনে! দাশুবাবু নিজে কথা দিয়েছেন জুনিয়র ব্রীফ কিছুকিছু পাঠাবেন।
“বাবুদের জীবন অনেকটা জুয়ার মতো! সায়েব যদি উন্নতি করলেন, প্র্যাকটিস জমালেন, তাহলে বাবুরও দু’পয়সা হবে। চাই কি, কলকাতায় খানকয়েক বাড়িও উঠতে পারে। এটর্নিরা খাতির করবে, দেখা হলে হাত তুলে নমস্কার করবে। কিন্তু কপাল মন্দ হলে সায়েব বার-লাইব্রেরীর টেবিলে মাথা রেখে ঢুলবেন। আর তাঁর বাবু বাইরের বেঞ্চিতে ঝিমুতে ঝিমুতে পাশের লোকের কাছে বিড়ি চেয়ে খাবে।” ছোকাদা বলে যাচ্ছিলেন।
ব্যারিস্টার সেনের সঙ্গে ছোকাদারও সাধনা শুরু হলো। নতুন ব্যারিস্টার। এখন তো বেশ কিছুদিন জুনিয়রি করো, এটর্নিদের মন রেখে চলো, সিনিয়রের বাড়ি ডাক পড়লেই হাজির হও। সিনিয়র ব্যস্ত লোক, বেশি কথা বলার সময় নেই তিনি বলবেন, এই পয়েন্টে যত মামলা হয়েছে, তার তালিকা প্রস্তুত করো। রাত জেগে সেন সাহেব মামলার লিস্টি তৈরি করে যান। সিনিয়রের মন জয় করতে হবে, তাঁর নজরে পড়তে হবে। এমনি পরিশ্রম করতে করতে যদি ভাগ্যলক্ষ্মী কোনোদিন সদয়া হন।
কাসুন্দের কানাইলাল ঘোষ সলজ্জ নয়নে ও সভয়ে অন্য বাবুদের পাশে এই বেঞ্চিগুলোর কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো। বসতে সাহস হয় না, বড় বড় ব্যারিস্টারের বাবুরা গম্ভীরভাবে আসেন, বসেন। সেন সাহেবের মতো জুনিয়র ব্যারিস্টারের বাবুর সঙ্গে তাঁরা কথাও বলেন না। হাইকোর্টের বড় বড় ব্যাপারে সে কি বুঝবে, এমন একটা ভাব।
বনোয়ারীবাবুকে মনে পড়ছে। কি সুন্দর তাঁর চেহারা, ঠিক যেন বনেদী জমিদার বংশের ছেলে। লাল টুকটুকে রঙ, গাল দুটো যেন রক্তের চাপে ফেটে পড়বে। তাঁর পরনের আদ্দির পাঞ্জাবী এত ফিনফিনে যে, ভিতরে গেঞ্জি পর্যন্ত দেখা যায়। পাঞ্জাবীর হাতা গিলে করা, তার ভিতর থেকে সোনা দিয়ে মোড়া অষ্টধাতুর তাবিজ মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। পরিধানে জরিপাড় ফরাসডাঙার নম্বরী ধুতি, পায়ে লাল পাম্পশু, গলায় পাকানো সাদা উড়ুনি। রোজ ধোপভাঙা পাঞ্জাবী পরেন বনোয়ারীবাবু। কথা কইবার সময় নেই তাঁর। কত লোক তাঁর কাছে আসে! কত কাজ তাঁর!
বেঞ্চিতে বসে বনোয়ারীবাবু পকেট থেকে এক বিরাট রুপোর ডিবে বার করেন। মৃদু চাপে খুট করে ডিবের মুখ খুলে এক জোড়া পান তিনি মুখে পুরে দেন। ডিবের আর এক কোণ থেকে সামান্য একটু চুন আঙুলের ডগায় লাগিয়ে তিনি যখন জিবে ঠেকান, তখন তাঁর তিন আঙুলের তিনটে পাথর-বসানো আংটি চোখ ঝলসে দেয়। পানের খুশবাই চারিদিক আমোদিত করে তোলে।
আর ওই যে রুপোর ডিবে, ওটি যে-সে জিনিস নয়! খোদ হ্যামিল্টনের বাড়ির তৈরি। হ্যামিল্টন কোম্পানী— যারা লাট সায়েবের বৌদের গহনা তৈরি করে। রুপোর ডিবের উপর বাঁকা বাঁকা ইংরিজি অক্ষরে লেখা— বনোয়ারী। চিৎপুরের মল্লিকরা মস্ত জমিদার। তাঁদের মেজো তরফের চুনীবাবু সেবার পার্টিশন সুটে জিতে বনোয়ারীবাবুকে এই পানের ডিবে উপহার দিয়েছিলেন।
বনোয়ারীবাবুর সায়েবের পসার সবচেয়ে বেশি। অসংখ্য মামলা তাঁর হাতে। এটর্নিরা এসে ধরেন,”এই যে বনোয়ারীবাবু, সায়েবকে একটা ব্রীফ পাঠাবো, একটু দেখবেন।” বনোয়ারীবাবু গম্ভীরভাবে বলে দেন, “না না মশায়, সায়েবের কড়া হুকুম, আর ব্রীফ নিতে পারবো না। কাজের চাপে সায়েরের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।”
এটর্নি হেসে বলেন, “না না, চিন্তার কিছু নেই। শুধু ব্রীফটা দিয়ে যাব। কেস হিয়ারিং-এ আসতে অনেক দেরি।” বনোয়ারীবাবু তবু অবিচলিত। এটর্নির মুখের দিকে না তাকিয়ে তিনি বলে দেন, “পরে আসবেন, ভেবে দেখবো।”
অন্য বাবুরা অবাক হয়ে দেখে। ব্রীফ নিয়ে এটর্নি এলে তারা কত আদর আপ্যায়ন করে। ব্রীফের জন্য এটর্নি বাড়িতে ধর্না দিয়েও কিছু হয় না। এটর্নিরা মুখ বেঁকিয়ে বলেন, পরে দেখা যাবে। আর বনোয়ারীবাবু এটর্নিদেরই ফিরিয়ে দেন।
বনোয়ারীবাবু বলেন, “আমি তো নেহাত ভালো লোক। এটর্নিদের সঙ্গে যতটা নম্র হওয়া সম্ভব, ততটা হই। তোমরা তো কারসন সায়েবের গল্প জানো না।”
অন্য বাবুরা উৎকর্ণ হয়ে বনোয়ারীবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকেন—”আপনার সায়েব বলেছেন বুঝি?”
“হ্যাঁ-গো হ্যাঁ,” বনোয়ারীবাবু গলার চাদরটা ঠিক করে নিলেন।
“স্যর এডওয়ার্ড কারসন, মস্ত ব্যারিস্টার। তার ফীও তেমনি। ষাট মোহর শুনলেই তো এখানে এটর্নিদের চোখ বেরিয়ে আসার যোগাড়। আর কারসন সায়েব পাঁচশ মোহর হরবখত নেন। একবার এক এটর্নি এসে তাঁকে ধরলো একটা কেস- এ ফী কমাতে হবে। কারসন সায়েব রাজী নন, এটর্নি তবুও নাছোড়বান্দা। কারসন হঠাৎ এটর্নির হাত ধরে বার-লাইব্রেরীর কাছে নিয়ে গেলেন। লাইব্রেরীতে পঞ্চাশ- ষাটজন ব্যারিস্টার বসে আছেন। কারসন জিজ্ঞাসা করলেন, “এঁদের দেখতে পাচ্ছেন?”
এটর্নি বলল, “হ্যাঁ।”
কারসন গম্ভীরভাবে বললেন, “এঁদের কাউকে কেসটা দিন, অর্ধেক ফী-তে হবে।”
এটর্নি হাত কচলাতে কচলাতে বললে, “আজ্ঞে না, আপনাকেই আমি ব্রীফ দিতে চাই।”
কারসন আরও গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন, “আপনি যদি এতই বোকা হন, তা হলে আমার পুরো ফী-ই দিতে হবে।”
বনোয়ারীবাবুর সায়েবকে ছোকাদা অবাক হয়ে দেখতেন। দীর্ঘ দেহ, মোটা চশমার আড়ালে দুটি চিন্তামগ্ন চোখ, মাথায় এক থোকা সাদা ও পাকা চুলের বিচিত্র সংমিশ্রণ। পিছনের চুলগুলো খুব ছোট করে ছাঁটা। গায়ে গোলাপী রঙের আভা, সমস্ত শরীরে তীক্ষ্ণতার ছাপ। অথচ কী শান্ত, কী সৌম্য রূপ! অমন শরীরে কালো রঙের কোট ভারি ভালো লাগতো ছোকাদার।
বনোয়ারীবাবু ছায়ার মতো তাঁর সায়েবকে অনুসরণ করেন। যেখানে সায়েব সেখানেই বনোয়ারীবাবু। সকালবেলায় সায়েবকে বার লাইব্রেরীতে বসিয়ে এসেই তিনি হাঁক ছাড়েন, “ওরে কোথায় গেলি সব!” একটু পরে দেখা যায়, সামনে চলেছেন বনোয়ারীবাবু, পিছনে গোটাকয়েক চাপরাসী, কাঁধে তাদের বই-এর পাহাড়। লিস্ট দেখে সেগুলো পর পর কোর্টের টেবিলে সাজিয়ে রাখেন তিনি। ছোট ছোট কাগজের স্লিপ ঢুকিয়ে দেন এক-এক পাতায়। কিছু পরেই বনোয়ারীবাবুর সায়েব বার-লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর ধীর পদক্ষেপে কোর্টরুমের দিকে এগিয়ে যান। বনোয়ারীবাবু ছুটে এসে সায়েবকে আজানুলম্বিত কালো গাউনটা পরিয়ে দেন।
সুন্দর ইংরেজি বলেন বনোয়ারীবাবুর সায়েব। ছোকাদা তার কিছুই বোঝেন না, তবু খুব ভালো লাগে তাঁর ইংরেজি শুনতে। জজরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বনোয়ারীবাবুর সায়েবের বক্তৃতা শুনছেন। তাঁর দুটো চশমা। একটা চশমা টেবিলে, আর একটা চোখে। মাঝে মাঝে একটা চশমা খুলে অপর চশমা চোখে লাগিয়ে তিনি সামনে বই-এর সারি থেকে একটা মোটা বই টেনে নেন। ফর ফর করে পাতা উল্টিয়ে যেখানে বনোয়ারীবাবুর স্লিপ লাগানো সেই পাতা থেকে তিনি গড়গড় করে পড়তে শুরু করেন। পর মুহূর্তেই চশমাটা নামিয়ে টেবিল থেকে অন্য চশমা তুলে নেন। জজ সায়েবের দিকে তাকিয়ে হাত-মুখ নেড়ে ইংরেজিতে তিনি কি সব বলেন, ছোকাদা বুঝতে পারেন না। তবুও শুনতে ভালো লাগে। একটা শব্দ বারবার কানে আসতো——ওয়েলমেলুড়, ওয়েলমেলুড়’। সেদিন ছোকাদা বারবার শুনেও তার অর্থ অনুধাবন করতে পারেননি। পরে আসল কথাটি জেনে নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হেসেছেন। চল্লিশ বছরে লক্ষ-লক্ষবার তাঁর কানে এসেছে, ‘ওয়েল মাই লর্ড’।
বনোয়ারীবাবুর সায়েব এক কোর্টে বেশিক্ষণ থাকেন না। বক্তৃতা শেষ করে হাতের ব্রীফে কি সব লেখেন। লেখা শেষ করে কালো রঙের গাউন বাঁ হাতে জড়িয়ে তিনি অন্য কোর্টের দিকে এগিয়ে যান। সেখানে বনোয়ারীবাবু আর এক গাদা মোটা- মোটা বই সাজিয়ে রেখেছেন। ছোটছোট কাগজের টুকরোগুলো বই-এর ভিতর থেকে উঁকি মারছে। আবার সেই দৃশ্য শুরু হয়। বনোয়ারীবাবুর সায়েব চশমা খুলে অন্য চশমা পরতে থাকেন।
এই অবসরে বনোয়ারীবাবু বাবুদের বেঞ্চিতে চলে আসেন। সবাই সাগ্রহে তাঁর বসবার জায়গা করে দেয়। পকেট থেকে হ্যামিল্টনের বাড়ির রুপোর ডিবে যথারীতি বার হয়, তিনি একসঙ্গে দুটো পান মুখে পুরে দেন। চারিদিকে খুশবাই ছড়িয়ে পড়ে।
বনোয়ারীবাবু আর তাঁর সায়েবকে নিয়ে নানান গল্প হয়। কেউ বলে, “ওঁর সায়েবের রোজগার কুড়ি হাজার টাকা।” আর একজন বলে, “কুড়ি হাজার টাকা ওঁর হাতের ময়লা, শুধু অর-ডিগনাম কোম্পানী মাসে কুড়ি হাজার টাকা দেয়। নিদেন পঞ্চাশ হাজার টাকা রোজগার।” কাসুন্দের কানাই ঘোষ অবাক হয়ে যায়। “মাসে কুড়ি হাজার টাকা, তাও কিনা হাতের ময়লা। মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা!” এই বনোয়ারীবাবু পনেরো বছরের কানাই ঘোষকে দেখে বলেছিলেন, “দুগ্ধপোষ্য ছোকরাটিকে কে আনলো?”
বনোয়ারীবাবু কানাই ঘোষকে ‘ছোকরা’ বলে ডাকতেন। দেখাদেখি অন্য বাবুরাও ওই নামে ডাকা শুরু করলো। কাসুন্দের কানাই ঘোষ ক্রমশ সবার ছোকাবাবু হয়ে দাঁড়ালো। তারপর বহুদিন কেটে গিয়েছে এবং কোন্ ফাঁকে সকলের অলক্ষ্যে ছোকাবাবু ছোকাদাতে পরিণত হয়েছে।
বনোয়ারীবাবুকে ছোকাদা ভয় করতেন। বনোয়ারীবাবু বেঞ্চিতে বসলে তিনি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতেন, বসতে সাহস হতো না।
ছোকাদা মনে-মনে স্বপ্ন দেখেন, তিনিও বনোয়ারীবাবুর মতো হয়েছেন। এটর্নিরা বলছে, “এই যে ছোকাবাবু, সেন সাহেবকে একটা ব্রীফ পাঠাচ্ছি।” ছোকাদা নিস্পৃহভাবে রুপোর ডিবে থেকে পান বার করে খেতে-খেতে বলছেন, “না না এখন ব্রীফ নিতে পারবো না। সাহেব ভয়ঙ্কর ব্যস্ত।”
সেন সায়েব এক কোর্টে কেস শেষ করে অন্য কোর্টে যাচ্ছেন। একটুও অবসর নেই। দিন-রাত শুধু কাজ আর কাজ।
ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনায় ছোকাদার প্রতি লোমকূপ সজাগ হয়ে ওঠে। কিন্তু কল্পনার স্বর্গ হতে ছোকাদাকে আবার বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। তখন বনোয়ারীবাবুর ভাগ্যে হিংসা হয়।
কিন্তু বনোয়ারীবাবুর ভাগ্যে যে এই পরিণতি ছিল তা কে জানতো?
অন্যদিনের মতো বনোয়ারীবাবু সেদিনও সকালে বেঞ্চিতে বসে হ্যামিল্টনের বাড়ির রুপোর ডিবে থেকে পান বার করে খেলেন, চারিদিকে খুশবাই ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর সায়েব এখনও আসেননি। মামলা রয়েছে। মস্ত বড় মামলা—কুমার সত্যনারায়ণ সিংহ মহাপাত্র ভারসেস রাজমাতা অশ্রুলতা। অনেক বই লাগবে। গত কাল বাড়ি ফেরার আগে সায়েব লিস্টি দিয়ে গিয়েছেন। সমস্ত বই-এ স্লিপ লাগিয়ে কোর্টে রেখে এসেছেন বনোয়ারীবাবু—চল্লিশখানা মোটা মোটা বই। সায়েব এসেই যুদ্ধ শুরু করবেন। বইগুলো আসলে বই নয়, আইনযুদ্ধের গোলাগুলি। বনোয়ারীবাবুর সায়েব চশমা পরে এক-একটা বই থেকে গড়-গড় করে পড়ে যাবেন, রাজমাতা অশ্রুলতার স্বপক্ষে প্রতিটি নজির জজের সামনে অকাট্য হয়ে ফুটে উঠবে।
রাজমাতা অশ্রুলতা মোটরে বসে আছেন, চীনে কোটপরা তাঁর এস্টেট ম্যানেজার বনোয়ারীবাবুকে বলে গেলেন।
“এই যে বনোয়ারী সব ভালো তো?” দু’তিনজন এটর্নি কোর্টে যাবার পথে তাঁকে সুপ্রভাত জানিয়ে গেলেন।
বনোয়ারীবাবু ডিবে থেকে আবার পান বার করলেন। কিন্তু সায়েব আসছেন না কেন? এত দেরি তো হয় না। এমন সময় বার-লাইব্রেরী থেকে দু’-একজন ব্যারিস্টার হস্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।
টেলিফোনে খবর এসেছে। ভয়ঙ্কর খবর। সেকথা ভাবলে আজও ছোকাদার বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। বনোয়ারীবাবুর সায়েব আর নেই। হার্টফেল, বেলা সাড়ে দশটায়। দাবাগ্নির মতো খবর ছড়িয়ে পড়েছে, এত বড় ব্যারিস্টারের আকস্মিক মৃত্যু।
সেই দৃশ্য ছোকাদা আজও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। বনোয়ারীবাবুর বিশাল দেহটা কয়েক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল, ম্যালেরিয়া জ্বর আসার আগে রোগীর যেমন হয়। তিনি হঠাৎ গড়িয়ে পড়লেন মেঝেতে। মেঝের ধুলোয় তাঁর গিলেকরা পাঞ্জাবী লুটোতে লাগলো। সবাই ছুটে এল। বনোয়ারীবাবু সংজ্ঞাহীন।
ছোকাদা এই পর্যন্ত বলে থামলেন। অনেকদিন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজও ছোকাদা সে আঘাত যেন কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বেঞ্চির সামনে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছোকাদা কি যেন খুঁজছেন। ঠিক যেখানে পোড়া-বিড়ির টুকরোগুলো পড়ে রয়েছে, ওই জায়গায় বনোয়ারীবাবুর ধূলিলুণ্ঠিত দেহের চারিদিকে অগণিত লোক একদিন ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল।
“বনোয়ারীবাবুর তখনকার অবস্থা কেমন জানিস? রাজা মরলে রাণীর যেমন হয়। রাজার অবর্তমানে রাণীকে কে চিনবে? সোনার সিংহাসনে আর স্থান হবে না রাণীর।”
ছোকাদার উপমায় সূক্ষ্ম রসবোধ কিছু নেই নিশ্চয়। কিন্তু বহু চিন্তা করেও তার থেকে ভালো উপমা আজও খুঁজে পাইনি।
বনোয়ারীবাবুর সংজ্ঞাহীন দেহটা কোনোক্রমে গাড়িতে চড়িয়ে বাড়ি পাঠানো হলো। বিদায় বনোয়ারীবাবু, বিদায়! কাল থেকে হাইকোর্টে কে তোমায় চিনবে? কোন্ এটর্নি বলবে, ‘ব্রীফ পাঠাচ্ছি, দেখবেন।’ কোন্ বাবু ব্যস্ত হয়ে তোমার জন্যে বেঞ্চিতে জায়গা করে দেবে?
“সেদিন আমার মনে কিরকম ভয় হলো। শুধু মনে হতে লাগলো, সেন সাহেবও যদি………” ছোকাদা দোতলা থেকে উঠোনের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ফেলে আসা জীবনের বেদনা আজও যেন তাঁকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করছে।
সেদিনের কিশোর কানাই ঘোষ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, যে বনোয়ারীবাবুর সায়েব আর ফিরবেন না। তার মাথাটা যেন ঘুরছে। এক ভাঁড় গরম চা খেয়েও কিছু উন্নতি হলো না। যেদিকে তাকায় শুধু বনোয়ারীবাবুর সংজ্ঞাহীন দেহটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
কিশোর ছেলেটি আর বসে থাকতে পারলো না। নিজের অজান্তেই এক সময়ে সে বার-লাইব্রেরীর ভিতর ঢুকে পড়েছে। দূরে সেন সাহেব একমনে বই পড়ছেন। মোটা ফ্রেমের চশমায় সেন সাহেবকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে! তাঁর নিজের সেন সাহেব, বয়স খুব কম। এখনও অনেকদিন কাজ করবেন। তবু মন প্রবোধ মানে না। সে আরও এগিয়ে যায়।
তারপরের কথা ভাবতে ছোকাদার আজও লজ্জা হয়। সেন সাহেবের ঘাড়ে নীলাভ দুটি শিরা দপদপ করছে। ছোকাদার হাত নিজের অজান্তে সেন সাহেবের দেহ স্পর্শ করেছে। না ভয় নেই, উষ্ণ রক্ত সেন সাহেবের ধমনীতে বয়ে যাচ্ছে। সেন সাহেব চমকে উঠে পিছনে তাকালেন। “কি ব্যাপার, কানাই?”
লজ্জায় ছোকাদার মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছা করলো। কী উত্তর দেবেন? মুখ, চোখ, কান সব লাল হয়ে উঠেছে। হে ধরণী, দ্বিধা হও। কিন্তু ভগবান মুখে কথা যুগিয়ে দিলেন। “না স্যার, একটা পিঁপড়ে ঘুরছিল।”
সেন সাহেব বিশ্বাস করলেন। ছোটছেলের মতো হেসে বললেন, “আজকে তুমি চলে যাও, কোর্ট বন্ধ থাকবে। সকাল সকাল বাড়ি তো রোজ যেতে পারো না।”
“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, এবার বাড়ি ফিরতে হবে।” ছোকাদা চমকে বর্তমানে ফিরে এলেন। কখন চারটে বেজে গিয়েছে আমিও লক্ষ করিনি। তিনি পায়ে জুতো গলিয়ে উঠে পড়লেন।
আমিও চেম্বারের দিকে চললাম। এত দেরী করা উচিত হয়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন