শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
এ এক আশ্চর্য যোগাযোগ। আমার সায়েব নাকি কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। এ-কথা বিভূতিদাই বলেছিলেন। শুধু এই নয়, আরও অনেক কথা বলেছিলেন।
সে কোন্ আদ্যিকালের কথা, সুপ্রীম কোর্টের সৃষ্টি হলো লর্ড নর্থের রেগুলেটিং অ্যাক্টে। চাঁদপাল ঘাটের কাছে জাহাজ থেকে জজসায়েবরা প্ৰথম কলকাতার মাটিতে পা দিলেন। খাস বিলেত থেকে যাঁরা বাঙলা মুলুকে এলেন, তাদের প্রধান স্যার ইলায়জা ইম্পে। রাস্তায় কাতারে কাতারে দর্শনার্থী কৌতূহলী দেশী লোকের ভিড়। ইম্পে চমকে উঠলেন। বেশির ভাগ লোকের খালি গা ও খালি পা। অন্য জজদের ডেকে তিনি বললেন, “ব্রাদার্স দেখেছো, এদেশের লোকের গায়ে কাপড় নেই! পায়ে মোজা পর্যন্ত জোটে না! আমরা কিন্তু ছ’মাসের মধ্যে প্রত্যেককে জুতো আর মোজা পরিয়ে ছাড়বো!”
তারপর কত ছ’মাস কেটে গিয়েছে। এদেশের লোকদের মোজা পরাবার কথা ইম্পে সায়েব একেবারে ভুলে গেলেন। মোজা তো দূরের কথা, পেটপুরে খাবার ব্যবস্থাও হলো না। ইম্পে তখন পুল তৈরির কন্ট্রাক্ট বাগাবার আশায় বাল্যবন্ধু হেস্টিংস-এর পিছনে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। দুষ্টজনে তাঁর নতুন নাম দিলে ‘পুলবাঁধা ইম্পে’। মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পুলবাঁধা ইম্পে ইতিহাসে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করলেন।
ইম্পের পিছন পিছন বিলেত থেকে আর এক দল লোক এসে হাজির। সুপ্রীম কোর্টের আশেপাশে তাঁরা ঘাঁটি বসালেন। এঁরা এটর্নি। এঁরা ব্যারিস্টার। বিলেতের আইনব্যবস্থাকে এদেশে চালু করার মতো কোনো মহান উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল কিনা জানি না, হয়তো কেবল অর্থের আকর্ষণেই তাঁদের বাঙলা দেশে আগমন। কিন্তু ধীরে ধীরে এক গৌরবময় ট্র্যাডিশনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো তাঁদের দ্বারা। গড়ে উঠলো কলকাতা বারের গর্বের ইতিহাস।
সে-যুগে আইনের কাজ আজকের মতো সোজা ছিল না। লোকে তখন আদালতকে মান্য করতে শেখেনি। তখন জোর যার মুলুক তার। কোর্টে মামলা করে লাভ নেই। কারণ মামলায় জিতলেও অপর পক্ষ আদালতের রায় মানে না। বলে, লাঠি থাকতে আদালত কি? আইনজ্ঞরা বুঝলেন, একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। লোকে যদি আদালতের আদেশই না মানলো, তাহলে কোর্ট খুলে লাভ কী? সেকালে ডাকসাইটে সায়েবদের আইন অমান্যের উৎসাহ নেটিভদের থেকে একটুও কম ছিল না। প্রয়োজন মত এদেশী লোকদের কাছে কলাটা-মুলোটা ছাড়াও সায়েব-সুবোরা টাকাপত্তর নিতেন। নিজের এলাকায় তাঁরা এক-একটি খুঁদে হিজ হাইনেস। স্বদেশের সুবোধ সুশীল বালকদের এমন নবাবী মেজাজ দেখে জজরা অবাক।
রামচন্দ্র বাঁড়ুজ্যে নামে এক ভদ্রলোক এসে জানালেন, “ধর্মাবতার, বিহারের আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি সাঁইত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছিলেন অনেকদিন আগে, কিন্তু এখন দেনা শোধ দিতে রাজী নন।”
বিচার করে সুপ্রীম কোর্ট ডিক্রি দিলেন ম্যাকেঞ্জিকে টাকা ফেরত দিতে হবে।
ম্যাকেঞ্জি যে সে লোক নন, তিনি বিহারের ম্যাজিস্ট্রেট। খবর শুনে বললেন, এত বড় আস্পর্ধা, আমার নামে ডিক্রি? একটি পয়সাও মিলবে না!
সুপ্রীম কোর্টের শেরিফ চললেন বিহারে। ম্যাকেঞ্জিকে ধরে আনতে। কিন্তু পথিমধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধের ব্যবস্থা। ম্যাকেঞ্জি সায়েবের বরকন্দাজরা তীর-ধনুক, ঢাল-তলোয়ার, বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত। শেরিফের দলবলের উপর তারা যখন হা- রে-রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়লো, তখন যে যেদিকে পারে পালালো।
সুপ্রীম কোর্টও ছাড়বার পাত্র নন। সম্মানে আঘাত লেগেছে তাঁদের। সুতরাং শেরিফকে আবার বিহারে পাঠানো হলো, সঙ্গে এবার পুরো সৈন্যবাহিনী। জেনারেল উড্ ও তাঁর আর্মি প্রয়োজন হলে ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। গতিক সুবিধে নয় দেখে, ম্যাকেঞ্জি রামচন্দ্র বাঁড়ুজ্যের টাকা কড়ায় গণ্ডায় ফেরত দিলেন।
গোরা পাঠিয়ে ডিক্রি জারির প্রয়োজন অবশ্য বেশি দিন রইল না। লোকে ক্রমশ বুঝতে পারলো আদালতকে মান্য করলে লাভ ছাড়া লোকসান নেই। টাকাপয়সা, জমিজমা নিয়ে লাঠালাঠি, হাতাহাতি ছেড়ে তারা কোর্টে আসতে শুরু করলো। দেশে খুন জখমের সংখ্যা অনেক কমলো। ফলে লেঠেলদের ব্যবসায় মন্দা পড়লো বটে, কিন্তু সৃষ্টি হলো এক নতুন বুদ্ধিজীবী লেঠেল সম্প্রদায়ের, যাঁরা আইনের লাঠি চালিয়ে জীবন ধারণ করেন। বিলেত থেকে অসংখ্য জজ, ব্যারিস্টার ও এটর্নি এসে কলকাতার আইন জগতে যোগ দিলেন।
তারপর ইতিহাসের রথচক্র কতবার না আবর্তিত হলো। কোথায় গেলেন ওয়ারেন হেস্টিংস আর ইলায়জা ইম্পে! কোথায় গেলেন কর্নওয়ালিস আর ওয়েলেসলি! শেষ পর্যন্ত যারা রাজত্বের পত্তন করলে, সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও রইল না। দিন মজুরের গাঁইতির আঘাতে একদিন সুপ্রীম কোর্টের পুরনো বাড়িটাও কলকাতার বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটের ধারে নতুন হাইকোর্ট তৈরি হলো। কিন্তু পুরনো ট্র্যাডিশনের স্রোতে বাধা পড়লো না।
বাঘা বাঘা ব্যারিস্টার এলেন হাইকোর্টে। এলেন প্রখ্যাত এটর্নির দল। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে মাথা তুলে দাঁড়ালো বড় বড় বাড়ি —টেম্পল চেম্বার, লিন্ডলি চেম্বার। অনেক মামলা, অনেক মক্কেল। একশ’ বছর ধরে গমগম করছে আইনপাড়া।
“এ পাড়াটি এক আজব জায়গা,” বিভূতিদা বলছিলেন। “মক্কেল, জজসায়েব, উকিল, ব্যারিস্টার ও এটর্নি ছাড়াও কতরকম লোকের আনাগোনা এখানে।”
“খানিকটা হয়তো জানো। তবু বলে রাখি। বিশেষ করে এটর্নি-ব্যারিস্টারের সম্পর্কটা বাইরের অনেকের জানা নেই। ডুয়াল সীস্টেম বা ওই ধরনের কি একটা নামও আছে। আদিম বিভাগে মক্কেলের সঙ্গে এটর্নির প্রথম সম্বন্ধ। হাইকোর্টে মামলা করতে এলে এটর্নির কাছে যেতেই হবে। এটর্নি কেসটা ঠিকঠাক করে কোর্টে ফাইল করবেন এবং ব্যারিস্টারকে ব্রীফ পাঠাবেন জজের সামনে মামলা করার জন্য। ব্যারিস্টার মক্কেলের সঙ্গে সোজাসুজি সম্পর্ক রাখতে পারেন না, সব কাজ এটর্নির মাধ্যমে করতে হবে।”
বিভূতিদা আরও বললেন, “অনেকে ভাবে এ-পাড়ায় আইনের নামে যত রাজ্যের বেআইনি কাজ হয়। উকিলরা মিথ্যে কথা বলে, এটর্নিরা সুযোগ পেলেই মক্কেলকে শোষে। ভাই-এ ভাই-এ মোকদ্দমায় দু’জনেই পথে বসে, মাঝখান থেকে এটর্নিরা কলকাতায় বাড়ি তোলে। কথাগুলো যে সবসময় মিথ্যা তা নয়, কিন্তু সবাই এখানে কিছু চোর ডাকাত নয়। এখানে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা জীবনে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। সততাই তাঁদের জীবনের একমাত্র মূলধন।”
বিভূতিদা সায়েবের কথায় ফিরে এলেন। বললেন, “উফ, স্যর গ্রিফিথ ইভান্স, উইলিয়ম জ্যাক্সনের মতো আইনবিদ্রা যে কীর্তি রেখে গিয়েছেন, আমাদের সায়েব তার শেষ বর্তিকাবাহী। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যার শুরু, বিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে তার অবসান।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন