কত অজানারে – ৩

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

টেম্পল চেম্বারে ঠিক দশটায় যাই। সাড়ে দশটায় কোর্টে যাবার আগে সায়েব টাইপের কাজকর্ম দিয়ে যান। লাঞ্চের সময় ফিরে এসে সেগুলি তিনি দেখবেন। দুটোর সময় আবার কোর্টে যাবেন, ফিরবেন ঠিক চারটেয়। মোহনচাঁদ তৎক্ষণাৎ এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে তাঁর দিকে এগিয়ে দেবে। জল খেয়ে আমাকে ডাক দেবেন তিনি—

“কেমন লাগছে, মাই সন? কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবে। আমি কেস থাকলে তবে কোর্টে যাই। অন্য সময় এখানে বসে কাজ করি।”

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।

“উঁহু, কথা বলতে হবে। না বললে ছাড়বো না। প্রথমে দু’চারটে ভুল সবারই হয়। ইংরেজি ভাষাটা সোজা নয়।” সায়েব হাসতে হাসতে বলেন।

সাহস পেয়ে শেষপর্যন্ত আমিও একদিন কথা বলতে আরম্ভ করলাম। প্রায় চীনাবাজারের ইংরেজি।

সায়েব তাতেই খুশি। বললেন, “দেখো, যদিও আমার মাথায় মস্ত টাক, বুড়োদের আমি মোটেই দেখতে পারি না। ইয়ংম্যানদের সঙ্গেই আমার যত মনের কথা হয়। তাই না মিস্টার মোহনচাঁদ?”

মোহনচাঁদ বেয়ারা হলেও আমার থেকে একশ’গুণ ভালো ইংরেজি বোঝে। সে ব্যাগের ভিতর কাগজপত্র গুছোতে গুছোতে সায়েবের কথা শুনে মুখ টিপে হাসে, কিছুই বলে না।

ওর হাসি দেখে আমার বুকের বল আরও বেড়ে যায়। বেপরোয়া হয়ে সায়েবের সঙ্গে গল্পগুজব আরম্ভ করে দিই। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, মনের ভাব প্রকাশ করতে এমন কিছু অসুবিধা হয় না।

এত বড় ব্যারিস্টার, কিন্তু শিশুর মতো মন। সময় পেলে কত গল্প করেন। অথচ কাজের সময় ভয়ানক গম্ভীর। চোখে চশমা লাগিয়ে যখন বই পড়েন, তখন কে বলবে ইনিই আমার সঙ্গে টাকের গল্প করেন। তখন কোনো শব্দ সহ্য করেন না। বই কিংবা কাগজ এগিয়ে দিতে সামান্য দেরি হলে রেগে ওঠেন। কাজ ফুরোলে কিন্তু আবার সেই পুরনো মানুষটি। কাছে ডেকে গল্প করেন। জিজ্ঞাসা করেন, এটা জানো, ওটা জানো? যদি বলি না, তাহলে তখনই সরলভাবে বুঝিয়ে দেন।

সায়েব এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের এক নামকরা হোটেলে থাকেন। তাঁর গাড়িতে ছুটির পর রোজ সেখানে যাই। চা পানান্তে সামান্য বিশ্রাম। তারপর দু’একটা চিঠি টাইপ করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ি।

হোটেল নয়তো যেন রাজপ্রাসাদ। ঘরের সংখ্যা তিনশ’র কাছাকাছি। আর তকমাপরা চাকরবাকর—তাদের গুণতে গেলে সেন্সাস আপিস বসাতে হবে। ইংরেজ, ফরাসী, আমেরিকান, চীনা, জাপানী সর্বজাতির এই মিলনতীর্থে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গের প্রতিনিধিরাও আছেন। তবে তাঁরা এখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

আমার ধারণা ছিল হোটেল মানে যেখানে খেতে পাওয়া যায় এবং প্রয়োজন হলে থাকার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এখানে থাকা বা খাওয়ার ব্যাপারটি যেন নিতান্ত নগণ্য। কোটপ্যান্টের দরকার টেলরিং ডিপার্টমেন্টে স্লিপ পাঠিয়ে দিন। সিনেমা? দোতলার হল-এ চলে যান। সিনেমা দেখে স্নানের আগে চুল কি দাড়িটা ঠিক করে নিতে পারেন—দেশী নাপিত নয়, খাস চীন থেকে আমদানী।

এখানে লাঞ্চের সময় হাল্কা সুরে বাজনা বাজে, বিকেলে চায়ের সময়েও বাজনা, তবে ভিন্ন সুর। রাতের ডিনারে কিন্তু কেবল নিরামিষ বাজনা নয়। কন্টিনেন্টের প্রখ্যাত সিনেমা ও টি. ভি. অপ্সরীরা তখন রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূতা হন। এবং তাদের সংগীত ঝঙ্কারে ও নৃত্য ছন্দে আগন্তুকদের প্রথমে মুগ্ধ এবং অবশেষে মন্ত্রমুগ্ধ হতে দেখা যায়। আমার দৌড় তো আমাদের গলির মোড়ের বিনোদিনী কাফে পর্যন্ত। সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে এসে মনে হলো যেন একেবারে আবু হোসেনের রাজত্বে হাজির হয়েছি।

গেট পেরিয়ে হোটেলের ভিতর ঢোকার প্রথম অভিজ্ঞতা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া। এর পরে চোখ ঝলসানো লাউঞ্জ। পুরু কার্পেটে ঢাকা মেঝের উপর কতকগুলো সোফা। পাশেই ছোট-ছোট টিপয়ের উপর একরাশ বিলিতি ছবিওয়ালা ম্যাগাজিন। সন্ধ্যার পর দেওয়ালের মধ্যে লুকোনো নীলাভ আলোগুলো জ্বলে উঠে সেখানে এক অস্পষ্ট স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।

আমার দৃষ্টি ইদানীং রোজই লাউঞ্জের কোণের দিকে বসা একটি মেয়ের দিকে পড়ে যেত। ভদ্রমহিলার বেশের পারিপাট্য বিচিত্র ধরনের। প্রসাধন বৈশিষ্ট্যও অদ্ভুত। মুখটি আড়ালে থাকলে দেহের অবশিষ্ট অংশের দিকে তাকিয়ে কে বলবে তাঁর বয়স একুশ কিংবা বাইশের বেশি! লন্ডন ও প্যারিসের প্রসাধন প্রস্তুতকারকদের কিন্তু এক জায়গায় পরাজয় হয়েছে। বিভিন্ন বিউটি প্রডাক্টের সযত প্রলেপও মুখমণ্ডলের চলে যাওয়া যৌবনের চিহ্নগুলি ঢাকতে পারে নি। বুঝতে কষ্ট হয় না, বসন্ত নেই। তবে সে বসন্তের বিদায়-উৎসব দশ না কুড়ি বছর আগে সম্পন্ন হয়েছে, অনভ্যস্ত চোখ নিয়ে হিসেব করতে পারিনি।

পিছনের দেওয়ালে অজন্তা-স্টাইলে আঁকা শকুন্তলার ছবি। অস্তমিত সূর্যের পটভূমিকায় মৃগশিশুদের সঙ্গে ক্রীড়ামত্তা তপোবনবাসিনী শকুন্তলা। আশেপাশে পিতলের টবে রাখা নানান জাতের লতাপাতা। শকুন্তলার এই ছবির সঙ্গে মেয়েটির উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকার দৃশ্যটি মিশে গিয়ে যেন আর একটি স্বতন্ত্র ছবির সৃষ্টি হতো।

প্রতি সন্ধ্যায় দোতলায় যাবার পথে তাঁকে দেখেছি। কাজের শেষে ফেরার পথেও লাউঞ্জ খালি নয়। ভদ্রমহিলা বসে রয়েছেন একাকিনী আসর জাগায়ে।

জনৈক ভদ্রলোককে একদিন বলতে শুনলাম, “লাউঞ্জ সাজানোর জন্য নানান মরসুমী ফুলের মতো হোটেল কোম্পানি এঁকেও আমদানী করেছেন। দাদা, শুধু নিরামিষ ফুল আর ফ্রেস্কো-ছবিতে অনেকের যে মন ভরে না!”

ভদ্রমহিলার পরিধানে এক-একদিন এক-এক রঙের শাড়ি কখনও লাল, কখনও সবুজ, কখনও গোলাপী। এক পায়ের উপর আর একটি পা চড়িয়ে, সোফায় হেলান দিয়ে তিনি একমুখ ধোঁয়া শূন্যে ছুঁড়ে দেন। নিতান্ত অনিচ্ছা সহকারে অলস গতিতে সেই ধোঁয়া দূরে মৃগশিশুদের দিকে অগ্রসর হয়। মেয়েদের মুখে—সে যে- দেশের মেয়েই হোক— সিগারেট আমার কেমন দৃষ্টিকটু ঠেকে। কিন্তু আরও অশোভন তাঁর সোনালী রঙের গ্রীসিয়ান জুতো নাড়ানোর ভঙ্গি। হোটেল-বাসিনী আধুনিক শকুন্তলার ওইখানেই ছন্দপতন।

কিছুদিনের মধ্যে লাউঞ্জে এক যুবকের আবির্ভাব হলো।

ছোকরার বয়স চব্বিশ কিংবা পঁচিশ। হুডখোলা এক বিরাট বুইক গাড়ি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্রেস্কো-ছবির শকুন্তলাকে পিছনে রেখে ওঁরা দু’জনেই মৃদুগুঞ্জনে সময় কাটান। নিরালা আলাপ যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, আলো জ্বলে ওঠে, কিন্তু গুঞ্জন চলে। পাশে দুটি পানীয়ের গ্লাস, তাতে কোল্ড-ড্রিঙ্ক না দ্রাক্ষা রস বলতে পারবো না। খুব সম্ভব শেষেরটি। কেননা, অরেঞ্জ বা লাইম স্কোয়াশ মানুষকে অত ঢুলু ঢুলু করে তুলতে পারে মনে হয় না।

হোটেলে ঢোকার পথে হুডখোলা বুইক গাড়িটা মাঝে মাঝে আমার নজরে পড়েছে। ড্রাইভারের আসনে সেই ছোকরা, আর পাশে ভদ্রমহিলা। চোখে নীল চশমা।

এঁরা দু’জন ক্রমশ হোটেলের চাকর-বাকরদের নানা রসালো গল্পের নায়ক- নায়িকা হয়ে দাঁড়ালেন। রিসেপশনিস্ট শৈলেন বোসের সঙ্গে আমার খানিকটা আলাপ আছে। সে একদিন জিজ্ঞাসা করলে, “কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ চূড়ে, দেখেছেন কি?” প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, “বৃক্ষচূড়া কোথায় পেলেন?” “ওইটুকুই বাকি আছে, তাহলে গাছে তুলে মই কেড়ে নেবার কোনো অসুবিধা থাকে না”, বোস হেসে উত্তর দিলে।

লাউঞ্জের প্রণয়-দৃশ্যটি সায়েবের নজর এড়ায়নি। হাইকোর্ট থেকে ফিরে আমরা লিফটে উপরে উঠছিলাম একদিন। ওঁরা দু’জনে লাউঞ্জ আলো করে বসেছিলেন। মুখ কুঁচকে সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “লাউঞ্জে বাঘ-ভালুক-হাতি- ঘোড়া মার্কা ছোকরাটিকে দেখেছ?” (বুইক গাড়ির মালিক যুবকটি সর্বদা কিম্ভূতকিমাকার জানোয়ারের ছবিওয়ালা বুশশার্ট পরেন।) সায়েব আরও মুখ কুঞ্চিত করে বললেন, “ছেলেটি ভদ্রমহিলাকে দিদিমা না বলুক—সহজেই মাতৃস্থানীয়া কোনো সম্বোধন করতে পারে।”

দু’জনের বয়সের অসমতা সত্যই অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। তাঁদের প্রকাশ্য প্রেমালাপও প্রায়ই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে। সোফায় দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমতে কমতে শূন্যে এসে ঠেকে। ফিস-ফিস করে কথা চলে। ভদ্রমহিলা যেন ক্লান্ত হয়ে নিজের মাথাটি বুশশার্ট-পরা ছোকরাটির দিকে এগিয়ে দেন। তারপর কোন সময় হঠাৎ লাফিয়ে উঠে পড়ে অবিন্যস্ত বেশবাস ঠিক করে নেন। তারপর হাতে হাত দিয়ে দু’জনকে বার-এর দিকে যেতে দেখা যায়। আমার অশোভন কৌতূহল দমনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। সংযমের লাগাম প্রাণপণে টেনে রেখেও প্রতিবার দোতলায় যাবার পথে লাউঞ্জের দিকে দৃষ্টিপাতের লোভ সংবরণ করতে পারিনি।

“মেমসায়েব আপনাকে ডাকছেন।” লাউঞ্জ পেরিয়ে লিফটে উঠতে যাচ্ছি, হঠাৎ বাধা পড়লো। সামনে বেয়ারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশ্চর্য হয়ে বললাম, “তুমি বুঝতে ভুল করছো, নিশ্চয়ই আমাকে নয়!”

বেয়ারা ঘাড় নেড়ে বললে, “আজ্ঞে আপনাকেই ডাকছেন।”

বাধ্য হয়েই লাউঞ্জে ফিরতে হলো। শকুন্তলার ছবির সামনে তিনি বসে আছেন। সামনে এসে দাঁড়ালাম। এত নিকটে থেকে পূর্বে তাঁকে দেখিনি। দূর থেকে যাঁকে এত উজ্জ্বল দেখায়, কাছে এসে তাঁকে কিন্তু বড় নিষ্প্রভ মনে হলো। ডান হাতের আঙুলের বিশাল আংটি সমেত সিগারেটটা তিনি ছাইদানিতে ঝাড়লেন। আংটির লাল পাথর জ্বলজ্বল করে উঠলো।

সিগারেটে আর একটা লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে দৃষ্টি হানলেন ভদ্রমহিলা। সায়েবের নাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তাঁর কাছে কাজ করি কিনা। স্বরে অদ্ভুত মিষ্টতা। অনেক মহিলার মুখে ইংরেজি শুনেছি, কিন্তু স্বরের মধ্যে এমন সুরের উপস্থিতি সচরাচর কানে আসে না।

উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ।”

“আপনি কি খুব ব্যস্ত আছেন?”

বললাম, “না না, আপনার কোনো উপকারে লাগলে আনন্দিত হবো।”

সিগারেট ছাইদানে নিক্ষেপ করে ভদ্রমহিলা প্রথমে সন্ত্রস্তভাবে চারিদিকে তাকিয়ে নিলেন এবং যথাসম্ভব আস্তে বললেন, “দেখুন, আমি একটু বিপদে পড়েছি, আপনার সায়েবের সঙ্গে দেখা করা বিশেষ প্রয়োজন। কখন তাঁর সঙ্গে দেখা হতে পারে?”

সেদিন দেখা হওয়া কোনোক্রমে সম্ভব নয়। অন্য একটা কেসে সায়েব ব্যস্ত থাকবেন, তাই ওঁকে পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় সায়েবের ঘরে আসতে বললাম।

শর্টহ্যান্ডের খাতা নিয়ে সায়েবের পাশে বসে আছি আমি। সামনের চেয়ারে ভদ্রমহিলা। মেঝের দিকে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে রয়েছেন। বোধ করি লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। সায়েবের ঠোটে একটুকরো হাসি দেখতে পেলাম। প্রথম দর্শনে কোনো মক্কেলই সঙ্কোচের বাধা কাটিয়ে উঠতে পারে না। টেম্পল চেম্বারে এ-দৃশ্য তাঁকে বহুবার দেখতে হয়েছে।

যথারীতি অভিবাদন বিনিময়ের পর সায়েব বললেন, “দেখুন, ডাক্তার আর উকিলের কাছে রোগ গোপন করতে নেই।” তারপর আমাকে দেখিয়ে বললেন,

“ইনি আমার স্টেনোগ্রাফার। এঁর সামনে নিঃসঙ্কোচে আপনার বক্তব্য বলতে পারেন।”

“না-না, সে তো বটেই।” ঘরের চারিদিকে দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আধো আধো স্বরে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন। “একেবারে গোড়া থেকে বলাই বোধ হয় ভালো।”

তিনি আবার থামলেন।

“নিশ্চয়।”

“সে এক বিরাট কাহিনী…”

“তার আগে আপনার নাম বলুন, আমার স্টেনোগ্রাফার লিখে নেবে।”

“নাম? পরে হবে, আগে আমার কাহিনী…”

নোট বই-এর অনেকগুলি পাতা সেদিন ভরে গিয়েছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম এক বেদনাবিধুর পঙ্কিল জীবনের ইতিবৃত্ত।

বলতে বলতে কখনো তাঁর গলা কেঁপে উঠলো, কখনো লজ্জায় দুটো হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলেন। আবার কখনো নিজের আবেগ সংযত রাখতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি।

ভারতবর্ষে নয় লেবাননের এক খ্রীস্টান পরিবারে মেরিয়ন স্টুয়ার্টের জন্ম। বাবাকে মনে পড়ে না। খুব ছোটবেলায় তিনি মারা গিয়েছেন, মা-ই সব। মেয়েকে মানুষ করার জন্য মাকে রোজগার করতে নামতে হয়েছিল এবং বহুক্ষেত্রে যা হয়, সেই জীবিকা, যা কোনো সমাজে কোনো সময়েই সম্মানজনক পরিগণিত হয়নি। কিন্তু মেয়েকে তিনি সে পথে আসতে দিতে চাননি। মেয়ে তাঁর দেখতে শুনতে খারাপ নয়, তাই আশা ছিল ভালো জামাই নিশ্চয় জুটে যাবে এবং তিনি ঝাড়া হাত-পা হয়ে বাঁচবেন।

মেরিয়নের মা মেয়ের বর যোগাড়ের কাজ যত সহজ মনে করেছিলেন, আসলে সেটি তত সহজ নয়। মেয়ের সঙ্গে ঘোরবার, সিনেমা বা কাফেতে নিয়ে যাবার ছেলে ছোকরার অভাব হচ্ছিলো না। কিন্তু তাই বলে যে তাদের মধ্যে কেউ খামকা বিয়ের প্রস্তাব করে বসবে, এমন সেন্টিমেন্টাল লোক ওদেশে জন্মায়নি। মেয়ে এদিকে তেইশ ছাড়িয়ে চব্বিশে পা দিয়েছে। স্বজাতি পাত্রের আশা ত্যাগ করে মেরিয়নের মা শেষপর্যন্ত বাইরের পাত্র সন্ধান করতে মনস্থ করলেন।

ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড নামে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর এক ছোকরাকে অবশেষে মেরিয়নের মা জামাই করতে পারলেন। বিয়ের পর বছরখানেক মন্দ কাটলো না। এ-শহর থেকে ও-শহর মেরিয়ন হাওয়ার্ড স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড আদর করে বলেন, “মেরী, আর্মিতে চাকরি নিয়ে সারা দুনিয়া ঘুরেছি, কিন্তু কোনো মেয়েই আমার চোখে রঙের পরশ লাগাতে পারলো না। পারবে কি করে? আমার বরাত যে বাঁধা রয়েছে লেবাননের এক ভারি দুষ্টু মেয়ের সঙ্গে।”

কপট রাগে মেরিয়ন মুখ ফিরিয়ে নেয়। “খুব হয়েছে, অমন করে আর নিজের দাম বাড়াতে হবে না। তোমার তুলনায় আমি যে কিছুই নই, তা আমার জানা আছে।” হাওয়ার্ডের পেশীবহুল হাতটিকে সে নিজের কাছে টেনে নিয়ে খেলা করে।

দিনগুলি বেশ কেটে যায়। স্বামীগরবে গরবিনী মেয়ের দিন কি আর খারাপ কাটে? হাওয়ার্ডের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মেরিয়নের সদাই চিন্তা। চাকরদের উপর নির্ভর না করে স্বামীর অনেক কাজ সে নিজে করে।

হাওয়ার্ড বলে, “নিজে এত পরিশ্রম করো কেন? আর একটা চাকর রাখো।”

“অনর্থক খরচ বাড়িয়ে লাভ নেই।” মেরিয়ন উত্তর দেয়।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দিন সেটা। সূর্য ডোবার কিছু আগে লনে বসে ওরা দু’জন চা খাচ্ছিল। এমন সময় ক্যাপ্টেনের নামে এক টেলিগ্রাম হাজির। খাম ছিঁড়ে, টেলিগ্রামের উপর একবার দৃষ্টিপাত করে সেটা পকেটে মুড়ে রাখলো হাওয়ার্ড।

হাসির ফোয়ারায় বাধা পড়ে। ক্যাপ্টেন গম্ভীর হয়ে উঠলেন।

“কি লিখেছে? নিশ্চয় দুঃসংবাদ!”

একরকম জোর করেই মেরিয়ন টেলিগ্রামটা ছিনিয়ে নেয়। বিলেতে বদলির হুকুম এসেছে।

“এ তো সুখবর। ইংলন্ড কিন্তু আমার খুব ভালো লাগবে, তুমি দেখে নিও।” মেরিয়নের আনন্দ উছলে উঠছিল।

কিন্তু হাওয়ার্ডের মুখ আরও কালো হয়ে উঠল। উত্তর না দিয়েই ক্যাপ্টেন সায়েব চেয়ার ছেড়ে ভিতরে চলে গেল।

হাওয়ার্ডের দুশ্চিন্তার কারণ তখনো মেরিয়নের কাছে অজ্ঞাত থাকলেও প্রকাশ হতে দেরি লাগলো না। মেরিয়নের পাসপোর্ট মিলবে না। আইনের চোখে সে বিবাহিতা স্ত্রী নয়। আসল মিসেস হাওয়ার্ড যে এক গণ্ডা ছেলেপুলে নিয়ে নটিংহামশায়ারে ঘরকন্না করছেন।

চমকে উঠেছিল মেরিয়ন। বিস্ময়ে হাওয়ার্ডের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও সে কোনো কথা বলতে পারেনি।

বন্ধুবান্ধবরা উপদেশ দিলেন—জোচ্চোর, মিথ্যাবাদী শয়তানটাকে সহজে ছেড়ো না। ইংরেজদের আইনে এক স্ত্রী বর্তমানে আর এক বিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। বাছাধন ভেবেছে কী! ওকে জেলে পাঠাও, আর সঙ্গে সঙ্গে আদালতে একটা ক্ষতিপূরণের মামলা লাগাও।

কিন্তু রাজী হলো না মেরিয়ন। যে ক্ষতি তার হয়েছে, তা কেউ পূরণ করতে পারবে না। কোর্টে গিয়ে কী হবে?

মেরিয়নের জীবননাট্য থেকে ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড বিদায় নিল। এখন আর ক্যাপ্টেনের স্ত্রী রূপে তার পরিচয় নেই। অনেকে আড়ালে তাকে অমুক ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ডের প্রাক্তন “ইয়ে” বলে ডাকে।

এদিকে পেট চলা দায় হয়ে উঠেছে। লোকের ধারণা যে, বেশ কিছু হস্তগত না করে ক্যাপ্টেনকে ছেড়ে দেবার পাত্রী মেরিয়ন নয়। আসলে কিছুই নেয়নি সে। হাওয়ার্ডের অর্থ স্পর্শ করতে সে ঘৃণা বোধ করেছে।

বছরখানেক মেরিয়ন কিভাবে পয়সা রোজগার করেছিল আমাদের বলেনি। সায়েবও জিজ্ঞাসা করেননি। তবে সেটা আন্দাজ করতে খুব বড়দরের কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয় না।

আন্তর্জাতিক বিয়ের বাজারের খবর রাখেন এমন একজন হিতৈষী বন্ধু শেষপর্যন্ত মেরিয়নকে ইন্ডিয়াতে যেতে উপদেশ দিলেন। বললেন, ভাগ্য বিমুখ না হলে ওখানে কিছু যোগাড় করা শক্ত হবে না।

ভারতবর্ষের ভিসা সংগ্রহ করা নিতান্ত সহজ নয়, অন্তত মেয়েদের পক্ষে। ভিসা দেবার আগে দেখা হয় কি ধরনের মেয়ে; স্বামী বহাল তবিয়ত কি না; স্বামী অবর্তমানে জীবনধারণের সঙ্গতি আছে কি না। কিন্তু যে মেয়ের স্বামী বা সঙ্গতি কিছুই নেই ভিসা কর্তৃপক্ষ তাকে ভারতবর্ষে স্বাগতম জানাতে বিশেষ উৎসুক নন। তাঁদের ইচ্ছা থাকলেও কলকাতা, বোম্বাই বা দিল্লীর সিকিউরিটি পুলিশ রাজী হন না। এই ধরনের মেয়েদের গতিবিধির উপর নজর রাখতে তাঁদের হিমশিম খেতে হয়।

পাসপোর্ট আপিসের পর্বত ডিঙিয়ে, ভিসা আপিসের সাগর পেরিয়ে, মেরিয়ন কিভাবে শেষপর্যন্ত বোম্বাইতে এসে হাজির হলো, তা এখানে না বললেও চলবে। শুধু এইটুকু বলে রাখি যে, বোম্বাইয়ের এই নতুন আগন্তুকটির নাম মেরিয়ন রইল না, তার নতুন নাম আভা স্টুয়ার্ট। শহরের বিরাট জনারণ্যে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অপরিচয়ের অকূল জলধিতে মনে হয় দেশত্যাগ অনুচিত হয়েছে।

কিন্তু যুদ্ধ তখনও থামেনি। তাই দু’-এক রাত্রের অতিথিদের নিয়ে মিস আভা স্টুয়ার্ট এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে, বিয়ে করে ঘরবাঁধার চিন্তার অবসর রইল না।

কিছুদিন পরের কথা। পূর্বাঞ্চলের এক দেশীয় রাজ্যের নবাব বোম্বাইতে বেড়াতে এসেছেন। রাজরাজড়ারা কখনও একা আসেন না। পাত্র, মিত্র অমাত্যের দল ছায়ার মতো তাঁদের অনুসরণ করেন।

তাজ হোটেলে এক ককটেল পার্টিতে নবাবের তরুণ এ.ডি.সি-র সঙ্গে আভার পরিচয় হলো। এ. ডি. সি. ভারি আমুদে মানুষ, তাই আলাপ জমতে বেশি সময় লাগেনি। নোটবুকে তিনি নতুন বান্ধবীর ঠিকানা লিখে নিলেন।

আভা স্টুয়ার্টের ঘরে তাঁর পদধূলি প্রায়ই পড়তে আরম্ভ করল। তরুণ এ. ডি. সি. হৃদয় দিয়ে ফেললেন লেবাননের এই মেয়েটিকে। বয়সে আভা সামান্য বড়-ই হবে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? বাধা আছে, তবে অন্য ধরনের।

নিজের নখগুলোর দিকে সযত্ন নজর দিতে দিতে ক্যাপ্টেন মহীউদ্দিন একদিন বললেন, “আভা, আমরা যে মুসলমান। বাপ-পিতামহের ধর্ম; তা ছাড়া মুসলমানের রাজ্যে চাকরি করি।”

“কী হয়েছে তাতে? পর্বত মহম্মদের কাছে এল না বলে মহম্মদ পর্বতের কাছে যাবে না? তুমি আমার এত আদরের আর তোমার জন্য খ্রীস্টান থেকে মুসলমান হতে পারবো না?” আভা আবেগভরা কণ্ঠে বলে উঠলো।

বোম্বাইয়ের এক মসজিদে আভা স্টুয়ার্টের নতুন নামকরণ কি হয়েছিল খাতায় লিখে রাখিনি। জেবউন্নিসা না মেহেরউন্নিসা, ঠিক স্মরণ করতে পারছি না।

নবপরিণীতা বধূ নিয়ে এ. ডি. সি. নবাবের রাজধানীতে ফিরে এলেন। এ. ডি. সি.-র বাংলো একটা ছোটখাট প্রাসাদ, পরিপাটি করে সাজানো। মহীউদ্দিন মৃদু হেসে বললেন, “এই তোমার রাজত্ব বেগম সাহেবা। এখানকার সর্বময় কর্তৃত্ব তোমার।”

নববধূর সলজ্জ হাসিতে মহীউদ্দিন ধন্য মনে করেন নিজেকে। নতুন পরিবেশ ভারি ভালো লাগছে আভার। ভালো লাগবে না? এ যে তার নিজের সংসার। হোটেলের ভাড়া-করা ঘর নয় যে, ক’দিন আছি জানি না, নিজের মতো গুছিয়ে লাভ নেই।

সংসারে বিশেষ কিছু করবার নেই। সরকারী বেতনে চাকর আছে অনেক। পরিচর্যার জন্য দুজন দাসী সর্বদা মোতায়েন। দুপুরে খাওয়ার পর আভা মহীউদ্দিনের ছবির এলবামটা দেখতে বসে। নানা রাজকীয় উৎসবে এ. ডি. সি. – র বেশে মহীউদ্দিন; তারও পূর্বের ছাত্রজীবনে মহীউদ্দিন—স্বামীর অজ্ঞাত অতীত জীবনের নিদর্শনগুলো আভার মনে পুলকের সঞ্চার করে। অপরাহ্ণে স্নান সমাপন করে সে প্রসাধনে বসে। তারপর সযত্ন সজ্জিত তনুদেহটি আয়নার সামনে মেলে ধরে। কোনোদিন মহীউদ্দিন হঠাৎ এসে পড়লে অবাক হয়ে যান। মৃদু হেসে বলেন, “শাড়ি তোমাদের দেশে চলে না, তবুও শাড়ি পরলে কি সুন্দর দেখায় তোমাকে!”

কখনো বা বাইরের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে স্বামীর প্রতীক্ষায় আভা সময় গোনে। পাশের চেয়ার খালি। নবাবের প্রাসাদ থেকে মহীউদ্দিনের ফিরতে দেরী হয়। দূরের আকাশ একেবারে নির্মল, কোনো অজ্ঞাত শিল্পী যেন ছবি আঁকার আগে ক্যানভাসটা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে রেখেছেন। সেই নির্মেঘ আকাশের পটে ক্রমশ তারা জেগে উঠতে থাকে। শিল্পী যেন একের পর এক তুলির আঁচড় টেনে যাচ্ছেন। নববধূর মনের পটেও চিন্তার তারারা এবার উঁকি দেয়। এক আধটা নয়, অনেক অনেক চিন্তা। সাজানো-গোছানো নয়, এলোমেলো অবিন্যস্ত। লাইন বেঁধে মার্চ করা সৈন্যদলের মতো তারা আসে না, আসে দিবাবসানে ঘরমুখো একঝাঁক পাখির মতো। ছ’দিন আগে যে পৃথিবীকে নিষ্ফল নিষ্করুণ মনে হয়েছে, আজ তার অন্য রূপ। জীবনে সে দুঃখ পেয়েছে সত্য। বিশ্বাসের বদলে প্রিয়তম হাওয়ার্ডের কাছে পেয়েছে প্রতারণা, সে-ও সত্য। কিন্তু, নববধূ ভাবে, ঘর ভেঙে ভগবান ঘর গড়েও দিলেন।

মহীউদ্দিন নিজের বিবাহের কথা নবাবকে জানাননি। আসলে জানাতে সাহস হয়নি। কিন্তু খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। নবাব এ. ডি. সি.-কে ডেকে পাঠালেন।

“দেখো ক্যাপ্টেন সায়েব, বিয়ে যদি করলে খানদানী বংশ দেখে করলে না কেন?” নবাব মহীউদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করছিলেন। “আমেরিকানদের একটা এঁটোকে বিয়ে করতে তোমার রুচিতে বাধলো না? যা হোক, মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। খানদানী বংশের খুবসুরত জেনানার সঙ্গে তোমার সাদির ব্যবস্থা আমি নিজেই করে দেবো, ওই ডাইনী স্পাইকে তুমি বিদায় করো।”

মহীউদ্দিন নবাবকে বোঝাবার যথেষ্ট চেষ্টা করলেন—”আমার জেনানা স্পাই নয়, খুব ভালো মেয়ে, বিশ্বাস করুন।”

নবাব গম্ভীরভাবে বললেন, “তোমাকে বলা হয়নি। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে মেয়েটির স্টেট ছেড়ে যাবার আদেশপত্রে আজ সকালে আমি সই করেছি। যদি চাও তোমার নামও তাতে ঢুকিয়ে দিতে পারি।”

বেচারা ক্যাপ্টেন মহীউদ্দিন গভীর আঘাত পেলেন। কিন্তু এ-জগতে সবাই অষ্টম এডওয়ার্ড বা তাঁর ভাবশিষ্য চারুদত্ত আধারকার নন। মহীউদ্দিন ভাবলেন, এক জেনানা গেলে আর এক জেনানা হবে। কিন্তু এক নোকরি হারালে, আর এক নোকরি এ-জন্মে নাও মিলতে পারে।

বাড়ি ফিরে মহীউদ্দিন স্ত্রীকে ডেকে বললেন, “ডার্লিং মনটা ভালো নয়। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবো, নবাব কিন্তু সব ভেস্তে দিলেন।”

নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন মহীউদ্দিন। “অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিছুই হলো না।” ঢোক গিললেন তিনি। “কিন্তু ভেবে দেখলাম, নোকরি ছাড়া চলে না।”

একটু থেমে দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন মহীউদ্দিন। “ডার্লিং, যেখানেই থাকো, আমার দিল-এ শুকতারার মতো তুমি সর্বদা জেগে থাকবে।”

সেদিন রাত্রে মহীউদ্দিন স্টেশন পর্যন্ত আসতে সাহস করেননি। কিন্তু চাকর মারফত দুটো খাম পাঠিয়েছিলেন। একটাতে একখানি উকিলের চিঠি

“মহাশয়া, এতদ্বারা আপনাকে জানাইতেছি যে, আমার মক্কেল ক্যাপ্টেন মহীউদ্দিন খাঁ দু’জন গণ্যমান্য সাক্ষীর উপস্থিতিতে পবিত্র ইসলামের অনুশাসন অনুযায়ী তিনবার তালাক উচ্চারণ করিয়া আপনাকে তালাক দিয়াছেন। ইতি……”  

অন্য খামে পঞ্চাশখানা দশটাকার নোট। সঙ্গে এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা “পাথেয়রূপে পাঠালাম।”

এবার কেন্দ্র কলকাতা। লেবাননের একটি মেয়ে কলকাতায় এসে দাঁড়ালো। চোখে তার ঘর বাঁধার স্বপ্ন।

কলকাতার জীবনের দীর্ঘ বিবরণ দিয়ে লাভ নেই। হোটেলের লাউঞ্জে তাকে আমরা পূর্বেই দেখেছি।

বর্তমানে একটি বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। পাণিপ্রার্থী আর কেউ নয়, ঐ জংলা বুশ-শার্ট পরা ছোকরাটি। ছোকরার পরিচয় জানা ছিল না। কোনো ধনী ব্যবসায়ীর বিপথগামী পুত্র-সন্তান ভেবেছিলাম। জানলাম, উনি একটি বিখ্যাত দেশীয় রাজ্যের রাজপুত্র। ধরুন, রাজ্যটির নাম চন্দ্রগড়।

“যুবরাজ আমাকে বিয়ে করতে চান,” আভা থামলো। সলজ্জদৃষ্টি হেনে সে আবার বললো, “আমিও যুবরাজকে পেতে চাই।”

তার কথা কেমন বেসুরো মনে হলেও সে স্বরে ছিল অদম্য আত্মপ্রত্যয়। জীবনখেলায় বারবার যারা প্রবঞ্চিত ও পরাজিত হয়, বোধ করি ভগবান তাদেরই এমন মনোবল দিয়ে থাকেন।

.

এতক্ষণ এক নিঃশ্বাসে শুনে যাচ্ছিলাম আভা স্টুয়ার্টের কাহিনী। সত্যি বলে বিশ্বাস হয় না। ভালো করে চেয়ে দেখলাম ওর মুখের দিকে। বাগদত্তাসুলভ নম্র আভা ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত মুখটিতে। মেঘের আড়াল থেকে সূর্য যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য দর্শন দিচ্ছেন।

“আসছে শনিবার এক মিশন আমাকে হিন্দুধর্মে দীক্ষা দেবে। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমাদের বিয়ে।”

চোখ থেকে চশমা খুলে রাখতে রাখতে সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার কাছে আসবার উদ্দেশ্য কী এবার বলুন।”

“যুবরাজের বাবার এই বিয়েতে মত নেই। অবশ্য তিনি এখনও জানেন না যে, আসছে শনিবার আমাদের বিয়ে। কাউকে আজকাল সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু… কিছুদিন পরে বাবার চাপে যুবরাজ যদি বিয়ে অস্বীকার করেন, তখন…….। এখন থেকে তার জন্য কী করতে পারি? আর একটা কথা। যুবরাজ আমাকে খ্রীস্টান বলে জানেন। কিন্তু বর্তমানে আমি খ্রীস্টান না মুসলমান?” আভা স্টুয়ার্টের স্বর কি রকম বেসুরো শোনালো।

আইনজ্ঞের কাছে এগুলি এমন কিছু কঠিন প্রশ্ন নয়। সায়েব বললেন, “প্রথমত বিয়ের পর মিশনের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে ভুলবেন না। বিবাহ প্রমাণের জন্য ভবিষ্যতে সেটি হবে আপনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল। আর আপনি যখন হিন্দুধর্ম গ্রহণ করছেন তখন আসলে আপনি খ্রীস্টান না মুসলমান কিছু আসে যায় না। আপাতত এই আমার উপদেশ। ভবিষ্যতে নতুন কিছু ঘটলে আমার সাহায্য সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ থাকতে পারেন।”

আভা স্টুয়ার্ট বেরিয়ে যাবার পরও সায়েব কিছুক্ষণ নির্বাক রইলেন। অভিজ্ঞতার দপ্তরখানায় যে নতুন ঘটনাটি জমা হলো সেটিকে খুব সম্ভব, মনের দপ্তরখানায় সাজিয়ে রাখছিলেন।

সামান্য হেসে আমার কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে তিনি বললেন, “আশ্চর্য লাগছে তোমার, তাই না?” একটু থেমে আবার বললেন, “তোমার জীবনের এই তো শুরু। চোখ আর কান দুটোকে একটু সজাগ রেখো, দুনিয়ার অনেক বিচিত্র পদার্থের দেখা পাবে।”

হ্যাঁ না, কিছু না বলে স্থির হয়ে বসে রইলাম।

“তোমাদের পরিবারে বিয়ের কয়েকদিন আগেই মেয়েকে নিয়ে নানান উৎসব পড়ে যায়। আমাদের দেশেও তাই”–কি যেন চিন্তা করতে করতে সায়েব বলে যাচ্ছিলেন। “মেয়ে তখন ভাবে কত ভাগ্যবতী সে, তাকে কেন্দ্র করেই যত কিছু উৎসব। কিন্তু যে মেয়েকে নিজের বিয়ের যোগাড় নিজেকেই করতে হয়, আইনের পরামর্শ নিতে আমাদের কাছে ছুটে আসতে হয়, সে?”

পরের রবিবার বেশি কাজ থাকায় আমাকে হোটেলে আসতে হয়েছিল। ছুটির দিন সায়েব অন্য প্রকৃতির হয়ে যান। ব্যারিস্টারের কালো গাউনের ভিতর লুকানো সদা-হাস্যময় রসিক মনটা রবিবার সুযোগ বুঝে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সেদিন যত না কাজ তার অনেক বেশি গল্প হয়। ইংরেজের কাছে কাজ আর আড্ডার ভাসুর-ভাদ্দরবৌ সম্পর্ক। সায়েব রসিকতা করে বলছিলেন, “ইংরেজ যেখানে আপিস খোলে, তার পাঁচ মাইলের মধ্যে কোন ক্লাবের নামগন্ধ থাকে না। রবিবারে আমি কিন্তু পুরো ফরাসী! ওদের যে ঘরে আপিস, সেই ঘরেই আধখানা পর্দা টাঙিয়ে আড্ডা জমাবার ব্যবস্থা।”

বিকালে চা-এর টেবিলে সায়েব গল্প বলছিলেন, আমি শুনছিলাম। এমন সময় বেয়ারা হাতে স্লিপ দিয়ে জানালো, রানী মীরা আদিত্যনারায়ণ সায়েবের দর্শনপ্রার্থী।

এমন অদ্ভুত নাম কখনো শুনিনি। এদেশের মানুষ না হলেও ভারতীয় নামের কূট-কচালিতে সায়েব অভ্যস্ত। মুখুজ্যে কি ধরনের কুলীন, উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ীর তফাৎ কোথায়, গোয়েল উপাধির উৎপত্তি সিন্ধুদেশ, না রাজপুতানায়, ইত্যাদি প্রশ্নে প্রয়োজন হলে ডজনখানেক ভটচার্যিকে তিনি কাবু করতে পারেন। তিনিও এই নামের কিছু বুঝতে পারছিলেন না।

সকল ঔৎসুক্য দূর করে যে মহিলাটি ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের যুবরাজপ্রিয়া। গেরুয়া রঙের সিল্কের শাড়ি তাঁর দেহকে বেষ্টন করে উঠেছে। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুরের রেখা। এমন স্নিগ্ধ ও সৌম্যরূপে আভা স্টুয়ার্টকে কোনোদিন দেখিনি।

“মীরা নামটি আপনার কেমন লাগে?” চেয়ারে বসে তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন।

“বেশ সুন্দর নাম।” সায়েব ঘাড় নেড়ে উত্তর দিলেন।

“অনেক ভেবে এই নাম পছন্দ করেছি; আর আদিত্যনারায়ণ আমার স্বামীর বংশগত উপাধি।”

“মোস্ট ইন্টারেস্টিং!” সায়েব বেয়ারাকে একটা কাপ আনতে নির্দেশ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “নতুন কোনো খবর আছে নাকি রানী-সাহেবা?”

রানী নিস্তব্ধ রইলেন। ধীরে ধীরে তাঁর মুখের প্রশান্তি বিদায় নিল। হঠাৎ রানীকে বেশ ক্লান্ত মনে হতে লাগলো। চা-এর কাপ দূরে ঠেলে দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “চিন্তায় আছি। আপনাকে বলেছিলাম, আমার শ্বশুর এই বিয়েতে মত দেননি। এখন তিনি আমাকে ইন্ডিয়া থেকে বার করে দেবার চেষ্টা করছেন। এখানকার সিকিউরিটি পুলিশকে তিনি….”

গম্ভীরভাবে সায়েব উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, তাহলে চিন্তার ব্যাপার। সিকিউরিটি পুলিশ ইচ্ছে করলে যে কোনো বিদেশীকে এখান থেকে বহিষ্কৃত করতে পারে।” “তা হলে কী হবে? আপনিই এই বিদেশে আমার একমাত্র বন্ধু।” রানীর উদ্বেগকম্পিত কণ্ঠ থেমে গেল।

গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন সায়েব। এক অসহায় নারীকে সাহায্য করার জন্য আইনের অস্ত্রগুলি পরীক্ষা করে দেখছেন। রানীর মুখের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে সায়েব আবার চিন্তামগ্ন হলেন।

একটু পরে তিনি বললেন, “না আইন আপনার দিকেই। আপনি এখন বিদেশিনী নন। ভারতীয় নাগরিককে বিয়ে করায় আপনিও একজন ভারতীয়। সুতরাং বিয়ের সার্টিফিকেটটা যতক্ষণ আপনার কাছে আছে, বিশেষ ভয়ের কারণ নেই।”

আনন্দিত হলেন না রানী, বরং চমকে উঠলেন। শীতের সন্ধ্যায় তাঁর কপালে ঘামের ফোঁটা দেখা দিল।—সার্টিফিকেট নিয়েই যত গোলমাল। মিশনের কর্তারা দু’দিক থেকে অর্থ উপার্জন করছেন। যুবরাজের বাবা তাঁদের টাকার লোভ দেখিয়েছেন, সার্টিফিকেট দিতে চাইছেন না তাঁরা।

রানী বলেন, “কাল সারাদিন সেখানে বসেছিলাম। কত অনুনয় বিনয় করলাম, কিছু হলো না। আর টাকা দেওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যুবরাজের টাকা ফুরিয়ে এসেছে। আমার শ্বশুর সব সাহায্য, এমনকি মাসোহারা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন।”

একটু ইতস্তত করে রানী মীরা বললেন, “আমার কাছে সামান্য যা ছিল, তাই দিয়ে ক’দিন দু’জনের খরচ চালাচ্ছি।”

সায়েব বললেন, “কাল দুপুরের দিকে ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে আমার চেম্বারে আসবেন। ইতিমধ্যে ভেবে দেখবো কী করা যেতে পারে।”

অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে রানী মীরা সেদিনের মতো বিদায় নিলেন। রানীর যাত্রাপথে কতক্ষণ চেয়েছিলাম জানি না, সায়েবের কথায় ফিরে তাকালাম। বেশ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে প্রায় সাতটা। কোন সকালে এসেছি, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু সমস্ত দেহ ও মন যেন ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

চশমাটা খাপে পুরে সায়েব আমাকে বললেন, “তোমাদের দেশের রূপকথার গল্পগুলো কেমন মনে হচ্ছে।” (আমাদের পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্তুরের গল্প মাঝে মাঝে সায়েবকে বলেছি।) “রূপকথার রাজপুত্রই শুধু সাত-সমুদ্র তেরো নদীর পারে কুঁচবরণ রাজকন্যার খোঁজে বার হয়েছে। পথে নানা কষ্ট, কিন্তু রাজপুত্রের জীবনমরণ পণ। আজকের পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাজকন্যাই নদী, পাহাড়, বাধাবিপত্তি তুচ্ছ করে রাজপুত্রের সন্ধানে বেরিয়েছে।” সায়েব সামান্য হেসে অন্তঃসলিলা বেদনার প্রবাহ ঢাকবার চেষ্টা করলেন।

পরের দিন রানীর অপেক্ষায় চেম্বারে অনেকক্ষণ ছিলাম। কিন্তু তিনি এলেন না। সায়েব একটু চিন্তিত রইলেন।

একদিন গেল, দু’দিন গেল, এক সপ্তাহ গেল। রানীর কোনো সংবাদ মিলল না। হোটেলের কর্মচারীরাও কোনো হদিস দিতে পারলো না।

সায়েব সন্দেহ করলেন সিকিউরিটি পুলিশ রানীকে জোর করে দমদমের কোনো উড়োজাহাজে তুলে দিয়ে ভারতবর্ষ থেকে বহিষ্কৃত করেছে। এর আগেও দু’-একবার সিকিউরিটি পুলিশকে এইরকম করতে শুনেছেন তিনি।

কোনো খবর না পেলেও রানীর শেষ পরিণতি জানার অদম্য আগ্রহকে মন থেকে সহজে বিতাড়িত করতে পারিনি। কোনো কোনো অলস অবসরে তাঁর ম্লান ছবিখানি চোখের সামনে জেগে উঠেছে। পাষাণপুরীতে বন্দিনী রাজকন্যা দুরন্ত রাক্ষসের চোখ এড়িয়ে দুর্গম গিরি কান্তার, দুস্তর-মরু-পারাবারে রাজপুত্রের সন্ধান করছেন। কিন্তু কোনো বেঙ্গমা-বেঙ্গমী তাঁকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে না।

এক-এক সময় মনে হয়েছে, আমাদের দেশের মেয়েদের সঙ্গে রানীর কোনো তফাত নেই। তাঁদের মতো রানীও কি স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করতে পারলে সুখী হতেন না? পরের মুহূর্তে অন্য রকম ভেবেছি। চোখের সামনে দেখেছি, রূপের পসরা সাজিয়ে রানী লাউঞ্জে বসে আছেন, অশোভনভাবে সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাচ্ছেন। তাঁর পায়ের সোনালী গ্রীসিয়ান জুতো পুরুষালী ঢঙে নাচছে। তবুও রানীর জীবন-নাটকের আকস্মিক পরিসমাপ্তিতে প্রকৃত দুঃখবোধ করেছি।

.

সময়ের স্রোতে স্মৃতিপটের সকল লিখন অস্পষ্ট হয়ে আসে। রানী মীরাকে আমিও ক্রমশ প্রায় বিস্মৃত হলাম। হাইকোর্টের ছায়ায় গড়া ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে প্রতিদিন জীবন-নাট্যের কত খেলা চলছে। স্যাকরার দোকানের ধুলো বাছলেও যেমন সোনা পাওয়া যায়, এখানকার এক-একটি ছোট্ট খুপরির দেওয়ালের ঝুল ঝাড়লেও বহু চাঞ্চল্যকর উপন্যাসের উপকরণ পাওয়া যেতে পারে। কত বিচিত্ৰ মানুষের আনাগোনা এখানে, কত বিচিত্র সমস্যা তাদের! কেউ বিয়ে ভাঙতে, কেউ বিয়ে করতে চায়। কেউ নতুন জমিতে প্রাসাদ তুলতে, কেউ বা পয়সার অভাবে নিজের বাসস্থানটুকু বন্ধক রাখতে চায়।

.

এসবের মধ্যে রানীকে মনে রাখার সময় কোথায়?

কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে আঁকাবাঁকা অক্ষরে ঠিকানা লেখা একটা চিঠি রানীকে আবার মনে করিয়ে দিলো। পড়া শেষ করে সায়েব চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

চিঠিতে লেখা ছিল—

চন্দ্ৰগড়

প্রিয় মিস্টার ‘—-’

এই চিঠি পেয়ে আপনি হয়তো অবাক হবেন। হয়তো এর আগে ভেবেছেন, আমি হঠাৎ কলকাতা থেকে উবে গেলাম নাকি! কিন্তু বিশ্বাস করুন, নানান ঝঞ্ঝাটে খবর দিয়ে আসতে পারিনি।

একটা কথা লিখতে বসে বার বার মনে জাগছে। আমি আর যাই হই, অকৃতজ্ঞ নই। সেদিন এক অসহায় মেয়েকে বিনা পারিশ্রমিকে আপনি যে সাহায্য করেছিলেন, কোনোদিন তা ভুলবো না।

আপনার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর ভেবে দেখলাম যুবরাজকে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারি না। এক ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিলাম। ঠিক করলাম, আমার শ্বশুরের সঙ্গে সামনা-সামনি বোঝাপড়া করবো।

কী ভাবে এই চন্দ্রগড়ে এলাম, আমার শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করলাম এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করলাম, সে এক বিরাট কাহিনী। যদি কখনও সাক্ষাৎ হয় বলবো। আপাতত জেনে সুখী হবেন, হারেমে থাকবার অনুমতি পেয়েছি। যুবরাজের ছ’ নম্বর স্ত্রী আমি। তাতে কিছু এসে যায় না। জীবনের শেষ কটা দিন এইভাবে একটু শান্তিতে কাটাতে পারলেই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করবো। জীবনে কোনোদিন খারাপ পথে আসতে হবে বুঝতে পারিনি। আর সবার মতো স্বামী- পুত্র নিয়ে ঘর করার ইচ্ছে আমারও ছিল। কিন্তু ঈশ্বর বিরূপ। তাই পঁয়ত্রিশটা বছর ছন্নছাড়া হয়ে কেটে গেল।

হিমালয়ের বুকের মধ্যে এই চন্দ্রগড় রাজ্যে সভ্যতার হাওয়া এখনো পৌঁছয়নি। আজব দেশ। হারেমের আইন-কানুন আরও আজব। মেয়েরা অসূর্যস্পশ্যা। আমি অবশ্য লক্ষ্মী মেয়ের মতো নতুন পরিবেশে নিজেকে মানাবার চেষ্টা করছি।

না করেও উপায় নেই। গত রবিবার আমার এক সতীনের সঙ্গে যুবরাজের কথা-কাটাকাটি হয়। পরের দিন থেকে তাকে আর দেখিনি। আমার পরিচারিকার মুখে শুনলাম, তার খবর আর কোনোদিন পাওয়া যাবে না।

এখানে চিঠি লেখা একেবারে নিষিদ্ধ। এক বিশ্বস্ত পরিচারিকার হাতে চিঠিটা ফেলতে পাঠাচ্ছি। সুতরাং উত্তর দেবার চেষ্টা করবেন না।

ঈশ্বরের ইচ্ছা থাকলে আমাদের আবার দেখা হবে।

ইতি—

চিরকৃতজ্ঞা

রানী মীরা আদিত্যনারায়ণ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন