কত অজানারে – ৫

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

আইনপাড়ায় জীবনটা মন্দ কাটছিল না। কয়েকমাসের ভিতর কত লোকের সঙ্গে চেনা জানা হলো। এটর্নিদের পরিচয় এখন আমার মুখস্থ, তাঁদের নাম শুনলেই বলে দিতে পারি ক’ নম্বরে আপিস। ছোকাদার সাহায্য না পেলে এত সহজে নিশ্চয়ই পোক্ত হয়ে উঠতে পারতাম না।

ছোকাদা প্রশ্ন করতেন, “বলো দিকিনি মুখুজ্যে-বিশ্বাস।” উত্তর দিতে একটু দেরি হলে তিনি বলেন, “এর মধ্যে ভুলে গেলে, কাল বলে দিয়েছি, দশ নম্বর।”

ব্যারিস্টার সুব্রত রায়ের বাবু পাঁচুগোপাল ব্যস্ত লোক আমাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব শুনছিলেন মন দিয়ে। তিনি বলে দিলেন, “কতক জিনিস, বিশেষ করে এটর্নিদের নাম-ঠিকানাটা নামতার মতো মুখস্থ করে ফেলো; কাজে লাগবে।”

মুখস্থ করতে আমার মোটেই আপত্তি নেই। সুতরাং প্রচুর আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে ব্যারিস্টারের বাবু হওয়ার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা চলতে লাগলো।

চেম্বারের সায়েব-ভীতিটাও ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। বিলিতি উচ্চারণ এখন আর অবোধ্য ঠেকে না। কয়েকদিন কোর্টে সায়েবকে কেস্ করতেও দেখে এসেছি। বেশিরভাগ মামলা আইনের জটিলতায় কণ্টকিত। কিছু বুঝিনি, এবং বোঝার চেষ্টাও বিশেষ করিনি। বেয়ারা মোহনচাঁদ আমার থেকে হাইকোর্টের খবর অনেক বেশি জানে। পণ্ডিতের মতো ঘাড় নেড়ে সে আমাকে জানিয়ে যেত, আজকের কেসে সায়েবের জিত হয়েছে, কিংবা কেস এখনও শেষ হয়নি, আগামীকাল চলবে।

কোর্টে কাজ না থাকলে সায়েব ভিতরে বসে পড়াশুনা করেন। আমি তাঁর ঘরের বাইরে বসে টাইপ করি। সায়েবের সঙ্গে কারুর দেখা করতে হলে আমার সামনে দিয়ে যেতে হয়।

ভয়ঙ্কর গরম পড়েছিল ক’দিন। পুরোদমে পাখা চালিয়ে দিয়ে টাইপ করে যাচ্ছিলাম। এমন সময় কে যেন জিজ্ঞাসা করলে, “সায়েব ভিতরে আছেন নাকি?”

আগন্তুকের দিকে চেয়ে দেখলাম। এমন বিচিত্র বেশভূষা সচরাচর চোখে পড়ে না। বিলিতি আদবকায়দা, কিন্তু প্যান্টে অন্তত ডজনখানেক তালি। শার্টের কলার ফেটে প্রায় জামা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। জামাটি শেষ কবে কাচা হয়েছে ভগবান জানেন। তেল ও ঘামে টাইটা যে রঙ ধারণ করেছে তা বর্ণনা করার মতো ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না। জুতো ক‍্যাম্বিশের হলেও অসংখ্য চামড়ার তালিতে প্রায় চামড়ার জুতোর রূপ নিয়েছে।

এমন লোককে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবছি। সাধারণত ভিক্ষার জন্য এই ধরনের লোক আপিসে আপিসে হানা দেয়।

আগন্তুকের মুখের দিকে আবার তাকালাম। শরীরে কোথাও মাংসের লেশমাত্র নেই। একটা দীর্ঘ কঙ্কাল যেন চামড়া দিয়ে ঢাকা। কিন্তু এই শ্রীহীনতার মধ্যেও দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো।

হাতের জীর্ণ এটাচি কেসটা খুলতে খুলতে আগন্তুক বললে, “আমি সায়েবের বন্ধু।”

অতি কষ্টে হাসি সংবরণ করতে হলো।

আমাকে নির্বাক দেখে লোকটা তীব্র দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সামনের চেয়ারে বসলো। এটাচি কেসের ভিতর বিরক্তভাবে হাত চালিয়ে একটা কার্ড বার করলো। কার্ডটিও মালিকের মতো বহু ব্যবহারে মলিন।

কার্ড পড়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। তাতে লেখা—

“বি. কে. বোস, বি.এ. (ক্যান্টাব),
ব্যারিস্টার-এট-ল”

ইনি ব্যারিস্টার? অসম্ভব! চৌরঙ্গী অঞ্চলের সিনেমা হাউসগুলির সামনে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভিখারির গোষ্ঠীভুক্ত বলে যাকে আন্দাজ করেছিলাম তিনি কিনা ব্যারিস্টার! ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে কাজ করতে এসে বহু ব্যারিস্টার দেখেছি, অনেকের সঙ্গে ইতিমধ্যে পরিচয় হয়েছে। তাঁদের অনেকের ভালো পসার, দু’হাতে টাকা রোজগার করেন; আবার কেউ হয়তো ছ’মাসে একবার গাউন পরেন। তবু সকলেরই চালচলনে, বেশবাসে আভিজাত্যের ছাপ লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ব্যারিস্টার বোসের এরি রূপ!

আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করে ব্যারিস্টার বোস ভিতরে ঢুকে গেলেন।

“এই যে বোস, অনেকদিন কোন খবর নেই কেন?” চেয়ার থেকে উঠে যখন সায়েব বোসকে অভ্যর্থনা করলেন, তখন আমার সন্দেহ নিরসন হলো, লোকটা সত্যই তাঁর পরিচিত।

“নানা কাজে ব্যস্ত থাকি, আসা হয়ে ওঠে না।” বোস উত্তর দিলেন।

আমাকে ডেকে সায়েব চায়ের ব্যবস্থা করতে বললেন।

“শরীর কেমন?”

বোস উত্তর দিলেন, “বেশ ভালোই আছি। শরীরে মেদ থাকলেই সুস্থ এবং না থাকলেই অসুস্থ, এমন কোন নিয়ম নেই।”

দু’জনের আলাপ-আলোচনা অনেকক্ষণ চলল। আমার চেয়ার থেকে সে- সব স্পষ্ট শোনা না গেলেও, মিস্টার বোসের ইংরেজি কথনের অপূর্ব ভঙ্গিমায় বেশ আশ্চর্য বোধ করলাম।

সায়েবের ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার বোস আমার কাছে এলেন। সামনের বেঞ্চিতে পা তুলে ক্যাম্বিসের জুতোর ফিতেটা আঁট করে নিলেন। তারপর এটাচি কেস্ নিয়ে বিদায় নিলেন।

“বোসকে দেখলে?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ”।

কথার ভঙ্গিতে হয়তো সায়েব আমার মনের কথা বুঝলেন। তাই বললেন, তোমাদের শাস্ত্রেই বলে পুরুষের ভাগ্য স্বয়ং দেবতার অজ্ঞাত, মানুষ তো ছার। এমন এক দিন ছিল যখন আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না বোসকে এই বেশে দেখতে হবে কোনোদিন।”

আর কিছু বললেন না তিনি। একটা চিঠি টাইপ করতে দিয়ে বোসের প্রসঙ্গ চাপা দিলেন।

ব্যারিস্টার বোসের দারিদ্র্যক্লিষ্ট কঙ্কালসার চেহারাটি ক্রমশ আমার খুব পরিচিত হয়ে উঠল। এটাচি কেস্ হাতে তিনি চেম্বারে আসেন। সেই তালিমারা প্যান্ট, তেল চিটচিটে শার্ট ও টাই; সেই ক্যাম্বিসের জুতো, সেই একই ভঙ্গিতে এটাচি কেস্ ও ব্রীফের বান্ডিল নামিয়ে জিজ্ঞাসা—”সায়েব ভিতরে আছেন?” এবং ভিতরে প্রবেশ ও সায়েবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা ও প্রস্থান।

ইদানীং প্রায়ই চেম্বারে আসছিলেন তিনি। আগে মাসে একবারের বেশি দেখা হতো না। কিন্তু সময়ের ব্যবধান কমতে কমতে সপ্তাহে দু’তিনবার হাজিরা দিতে লাগলেন ব্যারিস্টার বোস।

ফলে সায়েবের কাজে ক্ষতি হয়। গল্পে বসলে মিস্টার বোস সহজে উঠতে চান না। কেসের কাগজপত্র ফেলে সায়েবকেও কথা বলতে হয়। আড়ালে অস্বস্তি অনুভব করেন তিনি। দুপুরবেলায় সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে যাঁর একঘণ্টার মূল্য বেশ কয়েক মোহর।

“বোসের কি কোনো কাজকর্ম নেই?” একদিন সায়েবকে জিজ্ঞাসা করলাম।

ম্লান হেসে তিনি বললেন, “বেচারা ব্রীফ পায় না।”

“কিন্তু ওঁর হাতে তো সর্বদাই ব্রীফের বান্ডিল থাকে।”

সায়েব আবার হাসলেন। “ওগুলো বাসি ব্রীফ। পড়লে দেখবে একটারও বয়স কুড়ি বছরের কম নয়। ডাক্তারদের স্টেথিস্কোপের মতো ব্যারিস্টারদের ব্রীফ হাতে রাখতেই হয়, মক্কেল থাক আর না থাক।”

ব্রীফ রহস্য আমার জানা ছিল না। নতুন জ্ঞান সঞ্চয়ে তাই মনে মনে বেশ ধাক্কা খেলাম।

আর একদিন বোস এটাচি কেস্ ও ব্রীফের বান্ডিলটা আমার টেবিলে রেখে সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। একটু পরে সুইং ডোরের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, বোস কয়েকটা নোট পকেটে রাখছেন। বলছেন, “মেনি থ্যাঙ্কস। এখন উঠি, অনেক কাজ পড়ে আছে।”

“কাজ থাকলে এখানে সময় নষ্ট করতে বলতে পারি না।” সায়েবের উত্তর কানে এল।

ভারিক্কি চালে গটমট করে বোস বেরিয়ে গেলেন।

টাকার পরিমাণটা জানতাম না, সায়েবও বলেননি আমাকে। কিন্তু বোসের ঘন-ঘন আবির্ভাবে, অর্থনৈতিক দিক থেকে সায়েব যে লজ্জিত হচ্ছেন তা বুঝতে পারি। বোস এসেই চাপা গলায় কিছুক্ষণ কথা বলেন, এবং সায়েব পকেট থেকে টাকা বার করে দেন। মুখে কিছু বলতে পারেন না।

শেষে একদিন আমি বললাম, “বোস এবার এলে আভাসে খানিকটা বুঝিয়ে দেব।” নিজের পক্ষে সেটি সম্ভব নয় বলেই সায়েব প্রথমে কিছুতে রাজী হন না, কিন্তু পরে নিতান্ত অনিচ্ছা সহকারে মত দিলেন।

একদিন সকালে বোস এলেন। এটাচি কেস্টা নামিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, “সায়েব আছেন?”

কথাটা কিভাবে পাড়বো, পূর্বাহ্ণেই মনে-মনে রিহার্সাল দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বোসের চালচলন ও ব্যবহারে এমন একটা প্রখর ব্যক্তিত্ব আছে যে, ঘটনাস্থলে

সব গোলমাল হয়ে গেল। সঙ্কোচ বোধ করতে লাগলাম।

যথাসম্ভব মনোবল সঞ্চয় করে বললাম, “হ্যাঁ আছেন, তবে কাজে ব্যস্ত। যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কী প্রয়োজন এই স্লিপটিতে লিখে দিন।”

চমকে উঠলেন বোস। উত্তেজনায় থর-থর করে তাঁর দেহ কাঁপতে লাগল। “কি বললেন? স্লিপ? স্লিপ দিয়ে দেখা করতে হবে!”

প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। আকস্মিক আঘাতে তাঁর সুপ্ত আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠেছে। তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, চোখ নামিয়ে নিলাম। মনে হলো যেন অসংখ্য রঞ্জনরশ্মির তরঙ্গ আমার ভিতরে প্রবেশ করে সবকিছু দেখে নিচ্ছে। প্রস্তুত হয়ে রইলাম, অপ্রীতিকর কথা শুনতেই হবে তাঁর কাছে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই পরিবর্তন। শান্ত হয়ে গিয়েছে তাঁর মুখমণ্ডল। চোখের আগুন দপ করে জ্বলে উঠেই নিবে গিয়েছে।

কোনো কথা নয়। এটাচি কেস্ ও ব্রীফের বান্ডিলটা হাতে তুলে তিমি দরজার দিকে পা বাড়ালেন। লজ্জিতকণ্ঠে বললাম, “চলে যাচ্ছেন কেন?”

মুখ ফিরিয়ে তিনি আর একবার তাকালেন। চোখ কুঞ্চিত করলেন, কিন্তু উত্তর দিলেন না। শুধু তাঁর দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যাওয়ার, শব্দ কানে বাজতে লাগলো।

আমি বিমূঢ়! সম্বিত ফিরে এলে বেদনা বোধ করলাম। ব্যারিস্টার বোসকে অপমানের উদ্দেশ্য আমার ছিল না।

যথাসময়ে সায়েবকে সব বললাম। শুনে তিনি নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মনের গোপন কোণে তিনি আঘাত পেয়েছেন, লজ্জিত হয়েছেন। সামনের একখানা মোটা আইন বই-এর দিকে শূন্য দৃষ্টিপাত করে তিনি বললেন, “ বোস চলে গেল? নাঃ, খুব অন্যায় করেছি।”

আমি বললাম, “কোন রূঢ় কথা বলিনি তাঁকে।”

সায়েব আমার মুখের দিকে তাকালেন। “সে-কথা বলছি না। অপরাধ আমারই।”

তাঁর মনের আকাশে বিষণ্ণ মেঘ ক্রমে-ক্রমে জমে উঠছিল। বোধ করি তাই তিনি ধীরে ধীরে ব্যক্ত করলেন বোসের কাহিনী। হাতে কাজ ছিল, সেগুলো পাশে সরিয়ে রেখে বললেন, “এসব তো রোজই আছে।”

“তোমাকে আগে বলিনি, বোস আমার বহুদিনের পরিচিত, সে আমার সহপাঠী।”

“আপনার সহপাঠী?” ধিক্কারে মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল আমার।

“হ্যাঁ।”

“আশ্চর্যভাবে পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে। ছাত্রজীবনের কথা। বেশ ছিল দিনগুলো।”

আমি শুনছি, সায়েব বলছেন—

তখন আমরা কেমব্রিজে পড়ি। ওখানকার কয়েকজন দুষ্টু ছাত্র বুলডগ নামে যত রাজ্যের গোলমেলে খবরে বোঝাই এক পত্রিকা বার করত। কাগজটিকে ভয় করত না, এমন লোক কেমব্রিজে ছিল না। মাসের তিন তারিখে ছাত্র শিক্ষক সকলে তটস্থ; বুলডগ কাকে কামড় দিয়েছে, কে জানে।

আমাদের নিজেদের ছোট্ট একটি সাহিত্য আসর ছিল। বুলডগের নজর সেটির উপরও পড়ল। আসরের কীর্তিকাহিনী ব্যঙ্গ করে বুলডগে যে লেখা প্রকাশিত হল তাতে ছাত্রসমাজে আমাদের মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠল। এমন কি আসর ভাঙবার দাখিল। ভয়ঙ্কর রেগে একদিন সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে চললাম। সম্পাদক জন ক্রফোর্ড আমাদের পাশের কিংস কলেজের ছাত্র। উত্তেজনার মাথায় বেশ কিছু শুনিয়ে দিলাম তাকে। ক্রফোর্ড হেসে বললে, “প্রবন্ধটি বিশেষ – প্রতিনিধি লিখিত। একটু অপেক্ষা করলেই লেখকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।”

কিছুক্ষন পরে এক সুদর্শন যুবক ঘরে প্রবেশ করল। মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানি ভরে আছে। গৌরকান্তি। কালো কুচকুচে চুল। নিখুঁত বেশবাস। হাতের চওড়া কব্জি দেখলেই বোঝা যায় স্পোর্টসম্যান।

ক্রফোর্ড পরিচয় করিয়ে দিলে, “এই নিন আপনার লেখক। যা-কিছু বলার একেই বলুন। মিস্টার বোস, সেন্ট জনের ছাত্র। ইন্ডিয়া থেকে পড়তে এসেছেন।” আমি স্তম্ভিত। ইংরেজি যার মাতৃভাষা নয়, সে এমন সুন্দর লিখতে পারে। বিদেশে পড়তে এসে মাথায় এত দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে!

রাগ দেখানোর সুযোগই দিলে না বোস। বললে, “বন্ধ ঘরের মধ্যে ঝগড়া করা আমার পোষায় না। এসব খোলা মাঠে জমে ভালো।”

সম্মোহনী শক্তি আছে বোসের। প্রতিবাদ করতে পারলাম না। ক্রফোর্ডের ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ‘বায়রনস্ পুলে’র ধারে হাজির হলাম আমরা। কতদিনের প্রাচীন স্মৃতি। ছাত্রাবস্থায় লর্ড বায়রন এই পুকুরের সামনে বসতেন, কখনো ছেলেমানুষের মতো ক্রীড়াচ্ছলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন জলে।

পুকুরপাড়ে বসে আমরা বায়রনের দিনের কথা ভাবছিলাম। বোস বক্তা, আমি শ্রোতা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আমরা উঠে পড়লাম। হঠাৎ মনে পড়লো ঝগড়া করার জন্য এসেছিলাম আমরা।

বোস নিজেই বললে, “বাক্যুদ্ধটা আজ হলো না। ঠিক আছে, তোলা রইল। আর একদিন আসুন, সুদে আসলে ঝগড়া করা যাবে।”

ঝগড়ার দিনটা ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত তামাদি। হাতাহাতি করতে এসে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। বোসের আড্ডা-সভার আমি অন্যতম মেম্বার।

বাবার একমাত্র সন্তান বীরেন বোস, বন্ধুবান্ধবের পিছনে দু’হাতে টাকা খরচ করে। একা কিছু খাওয়া, একা থিয়েটারে যাওয়া বোসের কল্পনার অতীত। কোথাও পিকনিক হবে, খাবারের দায়িত্ব সে জোর করে নিজের উপর নেবে। পাঁচটা কি দশটা টাকা আজ তার কাছে কত মূল্যবান অথচ একদিন কথায়-কথায় সে দু- তিন পাউন্ড খরচ করেছে।

বোস ছবি আঁকে, ঘোড়ায় চড়ে। ছুটির দিনে বন্দুক কাঁধে শিকারে বার হয়। অব্যর্থ তার লক্ষ্য। সারাদিন জলা-জঙ্গলে ঘুরে সন্ধ্যার আগে যখন সে ফেরে, তার ঝুলিতে তখন বেশ কয়েকটা বন্য পাখি। গুন-গুন করে সে নিজের ভাষায় গান গাইতো। আমরা বুঝতাম না, তবু ভালো লাগতো। বোসের ইস্টেলে ঘরের এক কোণে একটা ছোট্ট কটেজ-পিয়ানো ছিল। কত সন্ধ্যায় তার বাজনা শুনেছি। সে উঠে এসেছে, আমি বাজাতে আরম্ভ করেছি। বাজনায় বিভোর হয়ে সময় ভুলে গিয়েছি। তারপর হঠাৎ দূরে ট্রিনিটি কলেজের ভারী পুরুষালী স্বরের ঘণ্টা শুনে চমকে উঠেছি, রাত অনেক। বোস তখনো বিভোর, সুরের মূর্ছনায় সম্পূর্ণ মগ্ন। কোনোদিন বা কাব্যচর্চা—বায়রন, শেলী কিংবা কীটস্।

বীরেন বোসের আর এক রূপ ছিল। কলেজের পড়াশুনোর বাইরের যত রাজ্যের দুষ্টুমি বুদ্ধি তার মাথায় খেলে যায়। কোনো মতলবের প্রয়োজন হলে বন্ধুবান্ধবরা তার পরামর্শ নিতে ছুটে আসে। বোস বলতো, “ভেবেছিলাম বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি শিখে দেশে প্র্যাকটিস করবো। এখন দেখছি ইচ্ছে করলে এখানেই ব্যবসা ফাঁদতে পারি।”

বোসের বহু কীর্তির মধ্যে একটি আজও বেশ মনে পড়ে। ডক্টর ডেভিস ছিলেন ল্যাটিনের প্রধান অধ্যাপক। তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি জগৎ-জোড়া। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে যা হয়, অধ্যাপক হিসেবে তিনি একেবারে ব্যর্থ। মানুষ হিসাবে কিন্তু তাঁর তুলনা হয় না। অবিবাহিত অধ্যাপকের সংসারে কোনো আকর্ষণ নেই। ছাত্রদের কিসে উপকার হয়, কিভাবে তাদের সাহায্য করা যায়, এই চিন্তায় তিনি ডুবে থাকেন। ছাত্রমঙ্গলের অদম্য আগ্রহে অধ্যাপক ডেভিস মাঝে মাঝে উদ্ভট কিছু করে বসতেন।

একবার ডক্টর ডেভিসের মাথায় ঢুকলো যে, তাঁর ছাত্রদের জ্যাম ও জেলির পিছনে অনেক খরচ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির! সুলভ মূল্যে জেলি তৈরি করতে হবে। ল্যাটিনের অধ্যাপক আহার নিদ্রা ত্যাগ করে জেলি তৈরির বিভিন্ন মসলা নিয়ে রান্নাঘরে রাতের পর রাত কাটাতে লাগলেন। কটু গন্ধে চার দিক ভরপুর হয়ে উঠল। অধ্যাপকের কিন্তু খেয়াল নেই। মোটা মোটা বই নিয়ে তিনি রান্নাঘরে বসে আছেন, আর সামনের কড়াইয়ে জেলি তৈরি হচ্ছে। কোনো বাধা তিনি মানবেন না। বাজারে জেলির পিছনে ছাত্রদের অপচয় বন্ধ করতেই হবে।

অবশেষে অধ্যাপক ডেভিসের জেলি আন্ডার গ্রাজুয়েট বাজারে বেরুলো। অতি সুলভ মূল্য মাত্র এক পেনিতে এক শিশি। তিনি নিজে প্রত্যেক হস্টেল ঘুরে দেখতে লাগলেন, ছাত্ররা এখনও অন্য জেলি কিনে পয়সা নষ্ট করছে কিনা।

অধ্যাপক ডেভিসের জেলি স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। মুখে দিলে বমি হওয়ার উপক্রম। প্রতিবাদে ফল নেই, কারণ অধ্যাপক ডেভিসের জেলি ‘হাইজিনিক’, রসনা তৃপ্ত না হলেও আখেরে ফল দেবে।

জেলির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কয়েকজন ছাত্র অবশেষে বোসের শরণাপন্ন হলো।

মন্ত্রণাপরিষদের বৈঠক বসতো গোপনে। আমরা কিছু জানতে পারিনি।

দিন দশেক পরে সমস্ত কেমব্রিজ শহর সেদিনের প্রভাতী সংবাদ-পত্রে অবাক হয়ে এই বিজ্ঞাপনটি পড়লো :

“কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাটিনের প্রধান অধ্যাপক আমি, ডক্টর জন ডেভিস এতদ্বারা সর্বসমক্ষে বিখ্যাত জেলি প্রস্তুতকারক মেসার্স কাইলার এন্ড কোম্পানীর নিকট উক্ত কোম্পানীর ছাপামারা শিশিতে নকল জেলি বিক্রয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি ও অঙ্গীকার করিতেছি যে, ভবিষ্যতে কখনও এরূপ কাজ করিব না।”

পরে অনুসন্ধান করে সমস্ত জানলাম। অধ্যাপক ডেভিস জেলি তৈরির পর খেয়াল করলেন যে, জেলি রাখার জন্য কোনো শিশি আনা হয়নি। তাঁর ঝি তখন কাছাকাছি হস্টেলে যত খালি শিশি ছিল নিয়ে আসে। দুর্ভাগ্যক্রমে শিশিগুলো কাইলার এন্ড কোম্পানীর নামাঙ্কিত। এই খবরটুকুই কাইলার এন্ড কোম্পানীকে জানিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি বোস সেদিন দিয়েছিল।

কেমব্রিজের পাঠ শেষ করে আমরা দু’জনেই ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে এলাম। আমি গেলাম ইনার টেম্পলে, বোস লিঙ্কনস্ ইনে। বেশিরভাগ ভারতীয় ছাত্র লিঙ্কনস্ ইনে যেত সেই সময়।

বোসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কমে এল, তবে একেবারে সম্পর্কচ্ছেদ নয়। পত্রালাপ তো ছিলই, তাছাড়া ছুটি-ছাটায় সে আমার ফ্ল্যাটে আসতো। আমিও মাঝে-মাঝে তার কাছে যেতাম। বোস আতিথ্যের কোনো ত্রুটি রাখতো না। খাওয়া-দাওয়া, এমন কি প্রায়ই থিয়েটারের টিকিট কাটা। কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি— সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যময় আনন্দের প্রস্রবণ। আমরা গল্প করেছি, কবিতা পড়েছি, আর শুনেছি সুন্দরবনের জঙ্গলে বোসের বাবার শিকার কাহিনী।

ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধির কাজ পেয়ে এক ছুটির সময় আমাকে জার্মানি যেতে হলো। সমস্ত জার্মানি পরিভ্রমণ করে মাস কয়েক পরে লন্ডনে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে বোসের সংবাদ রাখতে পারিনি, তাই সুযোগ পেয়েই দেখা করতে গেলাম। প্রথম দর্শনেই চমকে উঠলাম। বোসকে একেবারে অন্য মানুষ মনে হচ্ছে! আগেকার মতো আমাকে দেখে সে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো না। মুখে চোখে অত্যধিক গাম্ভীর্যের ছাপ। বেশ অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। মামুলি কথাবার্তার পর সেদিনের মতো বিদায় নিলাম।

সপ্তাহখানেক পরেই এক সন্ধ্যায় বোস আমার ফ্ল্যাটে দর্শন দিলো। রাতের মতো তাকে থেকে যেতে বললাম। বোস আপত্তি করল না।

ইতিমধ্যে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় দু’জনেই সাফল্য লাভ করেছি। ডিনার সেরে আমরা ফায়ার প্লেসের সামনে এসে বসলাম। দু’জনের মুখে পাইপ। প্ৰথমে কোনো কথা নেই। শুধু পাইপের ধোঁয়ায় ড্রইং রুমের আলোটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। বাইরে বেজায় শীত, ফায়ার প্লেসে আগুন গন গন করছে। বোস অবশেষে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করলে, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি কী প্ল্যান করছি। বললাম, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি, খুব সম্ভবত ব্যারিস্টারি করবো না।

আলোচনা জমে উঠলো। বিষয় অনেক—কেমব্রিজের ছাত্রজীবন, আমার জার্মানি ভ্রমণ, ইত্যাদি। হঠাৎ বোস বলে উঠল, “আজ কেন এলাম জানো?”

“না, কেন?”

বোস গম্ভীর হয়ে উঠলো। একটু থেমে বুকপকেট থেকে একটা ছবি বার করে আমার সামনে ধরলো, “চিনতে পারো?”

চিনতে না পারার কারণ নেই। বোস যাঁদের বাড়িতে পেইং গেস্ট সেই মিস্টার এন্ড মিসেস ডেবেনহামের মেয়ে এমিলি।

বোসের পকেটে এমিলি ডেবেনহামের ছবি! আমি অবাক।

আরও অবাক হলাম, যখন আমার পিঠে একটা হাত রেখে বোস বলল, “এমিলিকে বিয়ে করছি।”

“কংগ্রাচুলেশনস্। এই তো বীরোচিত কার্য। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম।

নিতান্ত ঠাণ্ডাভাবে বোস তার হাতটা এগিয়ে দিলো। পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “আমাদের দেশে বাপ-মায়ের অমতে বিয়ে করাটা রীতি নয়। হয়তো অনেক গঞ্জনা সইতে হবে। মা বেঁচে থাকলে কান্নাকাটি করতেন, কিন্তু তিনি অনেককাল চোখ বুজেছেন। বাবা? সে যা হয় হবে।”

“হোস্টের মেয়েকে ভালোবাসার মধ্যে থ্রিল আছে।” আমি বোসকে উৎসাহ দিলাম।

“সত্য কথা।” এক মুখ ধোঁয়া ছাড়লো বোস। “আমাদের মতো গোঁড়া দেশেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।”

সেদিন বোসের মুখে তোমাদের কচ ও দেবযানীর গল্প শুনেছিলাম। সুন্দর কাহিনী। সর্বদেশের শিষ্য ও গুরুকন্যাদের কাহিনী। গুরুগৃহে শিক্ষা সমাপ্ত করে বিদায় নেবার কাল সমাগত। কচ গুরুকন্যা দেবযানীর সঙ্গে শেষ দেখা করতে এলেন। “দেবযানী আমার যাবার সময় হয়েছে, তাই দেখা করতে এলাম।” মধুকণ্ঠে দেবযানী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার সকল অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে তো?” প্রশ্নের ইঙ্গিত কচ ধরতে পারলেন না। তাই বললেন, “হ্যাঁ সুন্দরী, আমার জীবন কৃতার্থ আমার সকল আশা চরিতার্থ।” অভিমানিনী গুরুকন্যা তখন মনে করিয়ে দিলেন, “হে উদারদর্শন যুবক, ভেবে দেখো কত ঊষায়, কত জ্যোৎস্নায়, কত অমানিশায় এই পুষ্পগন্ধঘন বনে তুমি আমার প্রতি সলজ্জ দৃষ্টি হেনেছে। সে কি আমি দেখিনি? আমার হৃদয়ও কি সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠেনি?”

পৃথিবীর সকল কচ ও দেবযানীর উপাখ্যান অভিশাপ বর্ষণে শেষ হয় না। কচের প্রশস্ত ও উষ্ণ বক্ষে ব্রীড়াবিধুরা দেবযানীরা অনেক সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্তত বীরেন বোস ও এমিলি ডেবেনহামের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

তবুও আমার কেমন আশ্চর্য মনে হয়েছে। এমিলি ডেবেনহাম কুৎসিত না হলেও সুন্দরী নন। একদা কেমব্রিজে এই বীরেন বোস অনেক সুন্দরী ইংরেজ তরুণীর জীবনে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে এসেছে। আমি অন্তত দুজনের কথা নিশ্চিত জানি। নিউনহাম কলেজের বেরিল ও ভেরনিকার পাশে এমিলি সৌন্দর্য ও বংশ-গৌরব কোনোটাতেই দাঁড়াতে পারে না। আগুনের দিকে পতঙ্গের মতো তারা দু’জনেই বোসের দিকে ছুটে এসেছে। বোস বাধা দেয়নি। একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে, কাফেতে মুখোমুখি বসে গল্প করেছে, বড় বড় চিঠি লিখেছে। তারপর বেরিল হিউম তাকে মনের কথা জানিয়েছে। বীরেন নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভেরনিকা সাদারল্যান্ডও একই ভুল করেছিল। মরমে আঘাত পেয়েছে সে বীরেনের কাছে। চোখের জলে রুমাল সিক্ত করেছে ভেরনিকা। নির্বিকার চিত্তে বীরেন বলেছে, জীবনটা স্পোর্টসম্যানের মতো নিতে হবে, সেন্টিমেন্টাল হয়ে লাভ নেই।

কেমব্রিজের প্রত্যাখ্যান ও আজকের আকস্মিক আত্মসমর্পণের কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনি। কারণ অনুসন্ধান ছেড়ে দিয়েছি ব্যর্থ হয়ে। প্রবোধ দিয়েছি মনকে, বোসের ভালো লেগেছে এমিলিকে, সেই যথেষ্ট। গিয়েছি বীরেন বোস ও এমিলি ডেবেনহামের বিয়েতে।

কিছুদিন পরেই সস্ত্রীক বীরেন বোস ভারতবর্ষের পথে রওনা হলো।

বোম্বাই থেকে বীরেন আমাকে শেষ চিঠি লিখেছিল, জানিয়েছিল কলকাতায় পৌঁছে আবার চিঠি লিখবে।

ব্যারিস্টারি ও সাংবাদিকতার মধ্যে টানা-পোড়েন চলছিল, কোন পথে যাব তখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। পাকাপাকি কোনো ব্যবস্থার আগেই মহাযুদ্ধ

বেধে গেল। অন্য অনেকের মতো কলম ছেড়ে বন্দুক ধরতে হলো আমাকে। ফলে বোসের কোনো সংবাদ নেওয়া হয়নি।

যুদ্ধজীবনের অনেক কথা। কিন্তু সে-সব এখন থাক। যুদ্ধ শেষে অক্সফোর্ড ও বাকিংহামশায়ার রেজিমেন্টের কর্নেল রূপে ভারতবর্ষ পাড়ি দেবার হুকুম হলো। এক সপ্তাহের নোটিশে লন্ডন থেকে বোম্বাই।

টিলবেরী ডক থেকে যে জাহাজে চড়েছিলাম সেটি আমাদের একদিন বোম্বাইয়ে নামিয়ে দিল।

তারপর বোম্বাই থেকে ফৈজাবাদ। কয়েক বছর সেখানে কাটিয়ে কলকাতা। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে হাইকোর্ট এমন কিছু দূর নয়। মাঝে মাঝে আসতাম এই পাড়ায়, দর্শক হিসেবে। ভাগ্যের লিখন, কয়েকজন বিচারক বন্ধুর উপদেশে সৈন্যবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে, ব্যারিস্টারি আরম্ভ করলাম এখানে।

ভুলেই গিয়েছিলাম বোসকে।

হাইকোর্টের করিডরে একদিন কে যেন আমার নাম ধরে ডাকলো, “হ্যাল্লো কেমন আছো? সারপ্রাইজিং তোমার আবির্ভাব!” চেহারা দেখে চিনতে পারিনি, গলার স্বরে বুঝতে পারলাম, বীরেন বোস। আমার দোষ নেই। কেমব্রিজের বীরেনের সঙ্গে আজকের বীরেনের একটুও সাদৃশ্য নেই। শরীর শুকিয়ে কাঠ, কাঁচা সোনার রঙ তামার মতো ম্যাড়ম্যাড় করছে। অস্বাভাবিক ক্লান্তিময় মুখচ্ছবি।

আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম বোসকে। “হ্যাল্লো, সত্যি সারপ্রাইজিং! কলকাতা থেকে চিঠি লেখার প্রতিশ্রুতি রাখোনি তুমি। কেমন আছো? এমিলি কেমন? অসুখ হয়েছিল নাকি?” এক ঝাঁক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম তার দিকে।

“না, অসুখ করেনি।” অন্য প্রশ্নের উত্তর দিল না সে। কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বললে, “আজ খুব ব্যস্ত আছি, চললাম।”

পুরনো বন্ধু, কতদিন পরে দেখা। এমন কী তাড়াতাড়ি থাকতে পারে যে পাঁচ মিনিট কথা বলা চলে না। ভালো লাগলো না আমার। সত্যি বলতে আপত্তি নেই, নিজেকে অপমানিত মনে হচ্ছিল।

সময়মতো খোঁজ নিলাম বোস সম্বন্ধে। কিন্তু যা শুনলাম তাতে আমার রাগ করবার কিছু রইল না। একটা পয়সা রোজগার করতে পারে না বোস। কোনো পসার নেই তার। তোমরা যাকে বলো ব্রীফহীন ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টার বোসের নাম শুনলে এটর্নিরা মুখ টিপে হাসে।

বোসের মতো প্রতিভাবান ছাত্র আদালতে ব্যর্থ। এ এক রহস্য। রহস্যমোচনের উপায় খুঁজে পেলাম না। লোককে জিজ্ঞাসা করলে বলে, “বীরেন বোস? রাবিশ! অকম্মা!”

চিঠি লিখলাম বোসকে। একদিন ডিনারে এসো। কোনো উত্তর দিল না। অসৌজন্যে, আঘাত পেলেও, কিছুদিন পরে আবার চিঠি লিখেছি। উত্তর নেই।

একদিন বিকেলে টাউন হলের সামনে হঠাৎ বোসকে দেখতে পেলাম। ধরলাম তাকে। “আজ ছাড়ছি না। সঙ্গে চলো।”

বোস বললে, “কাজ আছে। এখন যেতে পারবো না।”

প্রতিবাদে কান না দিয়ে একপ্রকার জোর করেই তাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। “ডিনারের আগে ছাড়ছি না”, বোসকে বলে দিলাম।

চা পর্ব শেষ না হতেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘরে কেবল আমরা দুটি প্রাণী বেতের চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছি। কোনো কথা নেই। মনে পড়ছিল অনেকদিন আগে লন্ডনের এমনি এক সন্ধ্যার কথা। সেদিন আমাদের আলোচনায় প্রাণ ছিল। প্রাণের আনন্দে দু’জনের কথা চলেছিল। আজ আমাকে জেরা করে উত্তর বার করতে হচ্ছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বোস কিছুই বলবে না।

ডিনার শেষে আমরা খোলা বারান্দায় এসে বসলাম। আধো অন্ধকারে সামনের টবের ফুলগাছগুলো ভালো দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের স্তিমিত আলো এসে পড়েছে বারান্দার এক কোণে। বোস বায়রন থেকে আবৃত্তি করছিল। তারপর ধীরে ধীরে তার জীবনের অনধীত অধ্যায়টি আমাকে শোনাতে আরম্ভ করলো।

বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন অধ্যায়, কয়েকঘণ্টা লেগেছিল শুনতে।

.

বিলাতফেরত মেম-বিয়ে-করা ছেলেকে বীরেন বোসের বাবা বাড়িতে স্থান দেননি, তবে বলেছিলেন, “অন্য কোথাও থাকো, যা খরচ লাগে দেব।”

বুঝেসুঝে চলতে হয় বীরেন বোসকে। তার বাবা খরচ দিতে প্ৰতিশ্ৰুত হলেও, পরিমাণটা বেঁধে দিয়েছেন। মোটেই ভালো লাগছে না এমিলির। টাকা আনা পাই-এর সূক্ষ্ম হিসেব করে জীবনটাকে নষ্ট করার জন্য সে লন্ডন ছেড়ে আসেনি।

এর নাম কলকাতা। লন্ডনের এমিলি কলকাতা দেখে একেবারে হতাশ। রঙিন স্বপ্নজাল বুনেছিল সে ইন্ডিয়ার জীবন সম্বন্ধে। এমিলি ভেবেছিল স্বামী তাকে রাজপ্রাসাদে রাখবেন, দামী মোটরে রোজ রেড রোডে হাওয়া খেতে নিয়ে যাবেন, ছুটিতে কলকাতা ছেড়ে গোপালপুরে সমুদ্রতীরে তারা রঙিন ছাতার তলায় শুয়ে থাকবে, কিংবা লুকোচুরি খেলবে মুসৌরী ও ডালহৌসি পাহাড়ের কোণে কোণে।

স্বপ্নভঙ্গজনিত আঘাতটা কাটাবার জন্যই ক্লাবে যেত এমিলি। প্রথমদিকে আটটার মধ্যে এমিলি বাড়ি ফিরতো। একঘণ্টা এগিয়ে ফেরার সময় ন’টায় দাঁড়ালো। তারপর দশটা। এগারোটা। অনেকরাতে যখন সে ক্লাব থেকে ফেরে মদে বেহুঁশ, শিথিল বস্ত্রবাসে ট্যাক্সি থেকে ঘর পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা থাকে না।

উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছে এমিলি। বোস বাধা দিতে অনেক চেষ্টা করে। আদর করে বুঝিয়ে বলে, “ক্লাবে যেও না, আর গেলেও সকাল সকাল ফিরবে।” এমিলি মুখ বেঁকায়—”আমি কি তোমার হিন্দু ওয়াইফ যে, ঘরের কোণে প্যাকিং বাক্সের মতো পড়ে থাকবো?”

তবুও বোস হতাশ হয় না; এমিলির কটূক্তি অসুস্থ প্রিয়জনের প্রলাপ মনে করার চেষ্টা করে।

দিন কাটে। বোসেরও জীবনের শ্যামলতা, সরসতা শুকিয়ে আসে। বোসের মনে হয় সব মেকি, সর নিরর্থক। এমিলির ক্লাব-বিল ও ফ্ল্যাশের টাকা মেটাতেই তার শোচনীয় অবস্থা। এমিলি আরও টাকা চায়। টাকা ছাড়া অন্য কোনো সম্বন্ধ নেই স্বামীর সঙ্গে।

গল্প উপন্যাসে যা পড়া যায়, এক্ষেত্রেও প্রায় সেইরকম ঘটলো। অশান্তিক্লিষ্ট বীরেন বোসও অন্য পাঁচজনের মতো ধ্বংসের পথে পা বাড়ালো। নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা না পেয়ে সে মিতালি পাতালো মদের পেয়ালার সঙ্গে।

বড় ব্যারিস্টার হবার সকল গুণই ছিল তার। তবুও কিছু হলো না। সিদ্ধির জন্য প্রয়োজন একাগ্র সাধনা, একনিষ্ঠ পরিশ্রম। সেই কারণেই সংসারে শান্তি পুরুষের পক্ষে অপরিহার্য। বাইরে জীবনদেবতার সঙ্গে যুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও উদ্যম অন্দরমহল থেকে আসা চাই, নচেৎ বীরেন বোসের মতো অবস্থা। নিম্নতর প্রতিভা নিয়ে বোসের সমসাময়িক অনেকে কোর্টে সুনাম ও অর্থের অধিকারী হলেন। তাঁরা যখন মক্কেলের মামলা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য ব্রীফের পাতায় লাল ও নীল পেন্সিলের দাগ দেন, বোস তখন মদের ঝোঁকে লাল ও নীল রঙের খেলা দেখে। তাঁরা যখন প্রয়োজনীয় নজিরের সন্ধানে কিংসবেঞ্চ, কুইন্সবেঞ্চ ও এ-আই-আরের পাতা তল্লাশী করেন, রোস তখন বায়রনের পাতা ওল্টায়।

প্রথমদিকে বোস ব্রীফ পায়নি এমন নয়। কিন্তু সেদিকে মোটেই খেয়াল ছিল না তার। কোর্টেই যায় না অর্ধেক দিন। এটর্নিরা ঠেকে শিখেছেন। কোর্টে ডাক হয়েছে অথচ ব্যারিস্টার বোসের দেখা নেই। এটর্নি মহলে এসব খবর চাপা থাকে না। অন্য এটর্নিরা সাবধান হয়ে গিয়েছেন।

থোড়াই তোয়াক্কা করে বোস, মদ নিয়ে ব্যস্ত সে। এমিলির অন্তরে সামান্যতম দায়িত্বজ্ঞানের উদয় বোসকে নিশ্চিত পতন থেকে রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু তা হবার নয়। বোসের বাবা ভাগ্যবান, ছেলের অধঃপতন চোখে দেখার আগেই তিনি চোখ বুজেছেন।

এমিলি ও বীরেন কেউ কারুর খবর রাখে না। লাট্টুর মতো এমিলি ও বীরেন নিজেকে কেন্দ্র করেই পাক খাচ্ছে। এমিলি কখনও ফেরে গভীর রাতে, কখনও বা রাত কাটিয়ে ভোরবেলায়। বীরেন বোস ড্রইংরুমের সোফায় পড়ে থাকে। খালি মদের বোতল মেঝেতে গড়াগড়ি যায়।

অনেক আগে যা ঘটা উচিত ছিল তা ঘটলো দেরিতে। কলকাতার কাছাকাছি এক পাটকলের জনৈক ইংরেজ-নন্দনের কণ্ঠলগ্না হলো এমিলি। এবং যথাসময়ে তারই অঙ্কশায়িনী হয়ে প্রস্থান করলো স্বদেশে।

সময়ের গতিতে বোসও একদিন সম্বিত ফিরে পেলো। নেশার ঘোর কেটে গিয়েছে। চোখ খুলে দেখলো, সর্বস্বান্ত সে। পৈতৃক বাড়িটি ছাড়া সবই লোকসানের অঙ্কে। কেবল লাভ হয়েছে যকৃতের ব্যাধি। অনুতপ্ত বোস নতুন জীবনযাপন করতে মনস্থ করলো। পূর্ণ উদ্দীপনা নিয়ে ব্যারিস্টারি করার সঙ্কল্প এবার। কিন্তু ইতিমধ্যে সঙ্কল্প ও সিদ্ধির মধ্যে অনতিক্রম্য ব্যবধান রচিত হয়েছে। ব্রীফবিহীন ব্যারিস্টারদের পাকা খাতায় বীরেন বোসের নাম ইতিপূর্বেই লেখা হয়ে গিয়েছে। অপ্রকৃতিস্থ মদ্যপকে কোনো এটর্নি কেস দিতে চান না। মক্কেলের স্বার্থ তাঁকে দেখতে হবে তো! ফলে এগারোটা থেকে চারটা পর্যন্ত বার লাইব্রেরীতে দিবানিদ্রা ছাড়া বোসের আর কিছু করার রইলো না। বন্ধ্যা নারীর সন্তানলাভের মতো বীরেন বোসের ব্রীফ লাভ স্বপ্নেই রয়ে গেল।

পত্রপুষ্পেভরা বৃক্ষে শীতের আগমনে ক্ষয় শুরু হয়, একে একে ঝরে পড়ে প্রতিটি পাতা। শুধু শাখাপ্রশাখার দল কঙ্কালের মতো বীভৎস রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বীরেন বোসেরও তাই। তার জীবনযাত্রার ব্যারোমিটারের পারা ক্রমশ নিচের দিকে নামতে লাগলো। র‍্যাঙ্কিনের তৈরি স্যুট ছাড়া পরতো না বীরেন। র‍্যাঙ্কিন ছেড়ে ওয়াছেল মোল্লা। সেখান থেকে হাওড়া হাটের জামা। সে জামাতেও তালি পড়তে লাগলো একের পর এক। মোটর ছেড়ে ট্যাক্সি ধরলো বীরেন বোস। ট্যাক্সি ছেড়ে বাস্।

একটানা বলে যাচ্ছিলেন সায়েব। আমি শুনে যাচ্ছিলাম নীরবে। একটা প্রশ্ন পর্যন্ত করিনি। ডুবেছিলাম কাহিনীর অতলে। সায়েব থামতে, আমিও যেন জেগে উঠে নড়ে চড়ে বসলাম। মাথার ভিতর অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা তালগোল পাকাচ্ছে। জানতে পেরেছি একটা বিচিত্র জীবনকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বীরেন বোস যেন একটা নয়। ছেঁড়া ও নোংরা জামাকাপড় পরা বীরেন বোস, কেমব্রিজের বীরেন বোস একটা সারির দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যিখানে আরও অনেকগুলো বীরেন বোস, বিভিন্ন রূপ ও বয়স তাদের।

সায়েব আবার বললেন, “বোস কিন্তু কখনও আমার কাছে হাত পাতেনি। প্রকারান্তরে বুঝতে পেরে আমিই কিছু কিছু দিয়েছি।”

“তাই নাকি? ভিক্ষা চায়নি বীরেন বোস!”

“বোসকে আমি জানি। আর কখনও সে আসবে না।” সায়েব উঠে পড়লেন।

বেশ মনে আছে, সেদিন বিকেলে চেম্বার থেকে ডালহৌসি যাচ্ছিলাম, ওখান থেকে বাড়ি ফিরবার বাস মিলবে। কাউন্সিল হাউস স্ট্রীটে পড়েই দেখি যে, আমার কয়েকগজ সামনে বোস শালপাতার ঠোঙা হাতে ছোলামটরসিদ্ধ চিবোতে চিবোতে চলেছেন। ভাবলাম, ছুটে গিয়ে ক্ষমা চাই। বলি, আমাকে ভুল বুঝবেন না।

না যাবো না। হয়তো লজ্জা পাবেন! চলার বেগ কমিয়ে দিয়ে দু’জনের দূরত্ব আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলাম। একমনে ছোলা চিবোচ্ছেন তিনি, আমি পিছন থেকে দেখছি। ডালহৌসির মোড়ে হাজির হলাম আমরা; সেখানে শালপাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ব্রীফের বান্ডিল বাঁ বগলে চেপে ধরে একটা চলন্ত ধর্মতলামুখো সেকেন্ড ক্লাস ট্রামের কামরায় উঠে পড়লেন ব্যারিষ্টার বোস।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন