শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
মুখ গম্ভীর করে ছোকাদা বসেছিলেন। অনেকদিন পরে বাবুদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, অথচ কারুর যেন কথা বলবার ইচ্ছা নেই। অর্জুনবাবু, হারুবাবু, সুনীলবাবু সকলেই বিমর্ষ হয়ে বসে রয়েছেন। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ছোকাদাও উদাসভাবে বার-লাইব্রেরীর দরজার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছেন। কতক্ষণ আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায়, চলে যাবো কিনা চিন্তা করছিলাম। ছোকাদা এবার আমাকে দেখতে পেলেন। বসতে জায়গা দিয়ে, একটা বিড়ি বার করলেন।
“বলো দেখি, ব্যারিস্টারদের মধ্যে সবচেয়ে বোকা কারা?” ছোকাদা আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন।
প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে না পেরে তাঁর মুখের দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছোকাদা ম্লান হাসলেন। “বলতে পারলে না! যারা সবচেয়ে বোকা তারাই ব্যারিস্টারি ছেড়ে জজিয়তি করতে যায়।”
আমি মৃদু প্রতিবাদ করলাম। “সে কী! জজ হওয়া থেকে বড়ো সম্মান কী থাকতে পারে?”
ছোকাদা রেগে উঠলেন। “জজ হয়ে বাপু ক’টাকা রোজগার করবে? সম্মান তো আর ভাতে দিয়ে খাওয়া যায় না। আর বাপু, যতো সম্মান কি জজদের? ব্যারিস্টাররা কি বানের জলে ভেসে এসেছে?”
ব্যাপারটা আমি জানতাম না। ছোকাদার সাহেব মিস্টার মুখার্জি জজ হয়ে যাচ্ছেন। আজ খবর এসেছে। ছোকাদা স্তম্ভিত। প্রথম যে-দিন মামার সঙ্গে ছোকাদা এ-পাড়ায় এসেছিলেন, তিনি ঠিক বলেছিলেন, বাবু হতে গেলে কপাল চাই। কিন্তু কপাল নিয়ে আসেননি তিনি। না হলে দু’-দুবার এমন হবে কেন? বনোয়ারীবাবুর মতো হবার জন্য সেনসায়েবকে কেন্দ্র করে ছোকাদা স্বপ্ন দেখেছিলেন। তা হয়নি। অনেক বৎসর পরিশ্রম করে যে সময় সবে পশার জমতে আরম্ভ করছে, ঠিক সেই সময়ে সেন সাহেব জজ হয়ে গেলেন। ছোকাদা অনেক বুঝিয়েছিলেন, জজ হয়ে লাভ নেই, কিন্তু সেন সায়েব শোনেননি। তবে যাবার আগে মুখার্জি সাহেবের কাছে ছোকাদাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।
ছোকাদা বলতেন, “এক সায়েব ছেড়ে অন্য সায়েবের কাজ করা অনেকটা দ্বিতীয় পক্ষের সংসারের মতো। মুখে যতোই সোহাগ দেখাই প্রাণ আর বসতে চায় না।”
মুখার্জি সায়েব লোক খারাপ নন। নিজের পশার জমার সঙ্গে সঙ্গে ছোকাদার মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছেন। পুজোর সময় বোনাস দিয়েছেন। এ-লাইনে ছোকাদা কম পয়সা রোজগার করেননি। কাসুন্দেতে টিনের বাড়ি ভেঙে কোঠাবাড়ি তুলেছেন। বাড়িতে ফ্যান হয়েছে, রেডিও এসেছে। ছেলেরা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মেয়েটার বিয়েটা দিয়েই এবার শান্তি পাবেন ভাবছিলেন। কিন্তু তা হবার নয়। জজিয়তি পেয়ে মুখার্জি সাহেব লাফিয়ে উঠেছেন।
ছোকাদা বললেন, “ফুটবল খেলা ছেড়ে উনি এবার রেফারিগিরি করবেন।”
চল্লিশ বছর আগে ছোকাদা যে জীবন শুরু করেছিলেন, এবার তার শেষ। মুখার্জি সাহেব বলেছেন, “কানাই, তোমার বয়স হয়েছে, এবার অবসর নাও। নাতি-নাতনীদের সঙ্গে খেলা করে শেষ ক’টা দিন জীবনকে উপভোগ করো। আমি যতোদিন আছি ততোদিন পুরো মাইনে মিলবে।”
আমাদের সামনে ছোকাদা কাঁদছিলেন। “এবার যেতে হবে। চল্লিশ বছর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই তো সেদিনের ব্যাপার। সবুজ রঙের চাদর গায়ে দিয়ে সেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলাম। বনোয়ারীবাবু বসে রয়েছেন।”
ছোকাদা উঠে গেলেন। আমদের চোখের কোণ ভিজে উঠেছে।
.
ছোকাদা না থাকলে, হাইকোর্টের অনেক কিছুই আমার অজানা রয়ে যেতো। তাঁর গল্পের ভাণ্ডার অক্ষয়। বার-লাইব্রেরীর সামনে বেঞ্চিতে বসে চল্লিশ বছর ধরে তিনি আইনপাড়াকে দেখে আসছেন। এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আইনবিদদের কাকে দেখেননি তিনি? এই তো সেদিনের কথা, লর্ড সিংহ বাগ্মিতায় নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। চিত্তরঞ্জন দাশ তখনও দেশবন্ধু হননি, কোর্টে কেস্ করছেন।
আর রাসবিহারী ঘোষ? ছোকাদা অসংখ্যবার দেখেছেন তাঁকে। তিনি ব্যারিস্টার নন, উকিল। কিন্তু কি বাগ্মিতায়, কি আইনজ্ঞানে এমন প্রতিভা আর একটিও বুঝি হাইকোর্টে দেখা যায়নি। ছোকাদার কাছে শুনেছি, জজরা তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। “আরে বাপু, রাসবিহারীর মুখে আইনের ব্যাখ্যা শোনাও যা আর বেদব্যাসের মুখে মহাভারত শোনাও তা।”
একজন জজের সঙ্গে রাসবিহারীর মোটেই বনিবনা ছিল না। সেই নিয়ে একবার ভারি মজা হয়েছিল, ছোকাদা বলেছিলেন। বড়ো বড়ো আইনজ্ঞদের মাঝে- মাঝে দুই কোর্টে একই সময়ে ডাক পড়ে। সে-ক্ষেত্রে এক কোর্টের জজ সাধারণত মামলা স্থগিত রাখেন। একবার রাসবিহারী প্রধান বিচারপতির কোর্টে মামলা করছিলেন। এমন সময় জানা গেল, পরদিন প্রথমোক্ত জজের কোর্টে আর একটি মামলা শুরু হবে। বাধ্য হয়ে তিনি জুনিয়রকে মামলাটি একদিনের জন্য স্থগিত রাখার জন্য আবেদন করতে পাঠালেন।
জুনিয়র কোর্টে গিয়ে বললেন, “ধর্মাবতার, স্যার রাসবিহারী প্রধান বিচারপতির আদালতে এক জটিল মামলায় ব্যস্ত রয়েছেন। অনুগ্রহ করে আগামী সকালের মামলাটি একদিন স্থগিত রাখলে, তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।”
জজসায়েব খাঁটি ইংরেজ। রাসবিহারীকে অপমান করার এমন সুযোগ তিনি ছাড়তে চাইলেন না। গম্ভীরভাবে বললেন, “মামলা স্থগিত রেখে কি হবে? রাসবিহারীর অনুপস্থিতিতে তুমিই মামলা করতে পারো। After all one man is always as good as another man.”
অপদস্থ জুনিয়র রাসবিহারীকে সব জানালেন। ব্যাপার শুনে প্রধান বিচারপতি নিজের মামলাটি পরদিনের জন্য স্থগিত রাখলেন।
পরের দিন সকালে নিজের কোর্টে রাসবিহারীকে উপস্থিত দেখে জজসায়েব মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। রাসবিহারীর অসুবিধা সৃষ্টি করতে পেরে তাঁর আনন্দ হয়েছে। রাসবিহারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “যতোদূর শুনেছিলাম আপনি অন্য আদালতে ব্যস্ত থাকবেন। তবুও এখানে কেমন করে এলেন?”
রাসবিহারীও এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বললেন, “ধর্মাবতার, এই আদালত এক মজার জায়গা। এখানে one man is not always as bad as another man। তাই প্রধান বিচারপতি আমাকে ছেড়ে দিলেন।” তারপর নির্বিকারভাবে তাঁর মামলা শুরু করলেন। জজসায়েবের মুখের অবস্থা বর্ণনা করার দরকার নেই। তবে দিনের শেষে স্যার রাসবিহারীকে নিজের ঘরে ডেকে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।
এই রাসবিহারীর ছাত্র ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আইনের দিকপাল। শিক্ষা সমাপ্ত করে ছাত্র একদিন জজ হয়ে বসলেন। শিষ্য বিচারক এবং গুরু তাঁর কাছে বিচার ভিক্ষা করছেন। কিন্তু সেজন্য কোনো অসুবিধা হয়নি। শিষ্য গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও বিচারের সময় নিস্পৃহ
যথেষ্ট চিন্তা ও পরিশ্রম করে আশুতোষ রায় লিখতেন। একজন বৃদ্ধ জজ একবার তাঁকে বলেছিলেন, “এখন বয়স কম তাই, পরে কিন্তু এতো পরিশ্রম করে রায় লিখতে পারবে না।” আশুতোষ তার যথাযোগ্য উত্তর দিয়েছিলেন। “যতোদিন পরিশ্রম করতে পারবো, ততোদিন জজিয়তি করবো। যখন বুঝবো আর পারছি না, তখন কাজে ইস্তফা দেবো।”
.
ছোকাদার কাছে আরো যেসব গল্প শুনেছি, বিদায়দিনে সেগুলো মনে পড়ছিল। আমরা কয়েকজন বাবু মিলে তাঁকে বিদায় অভিনন্দন জানালাম। পাঞ্জাবীর দোকানে চা ও দু’খানা সিঙাড়া খেয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো। বিদায় জানাতে গিয়ে আমরা কেঁদে ফেললাম। ছোকাদাও কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে লাগলেন। ট্রাম- লাইন পর্যন্ত আমরা তাঁকে এগিয়ে দিয়ে এলাম।
কিন্তু কয়েকদিন পরে দেখি তিনি আবার কোর্টে আসছেন। বাবুদের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে থাকেন। বললেন, “বাড়িতে বসে থাকতে মোটেই ভালো লাগে না।” দশটা বাজলেই কি এক আকর্ষণে মন আকুল হয়ে ওঠে। ব্রীফ, এফিডেভিট, অরিজিনেটিং সামনস, জাজমেন্ট-আপন-এওয়ার্ড, প্লেন্ট, রিট্ স্টেটমেন্ট এরা একসঙ্গে তাকে হাতছানি দেয়—বেলা যে পড়ে এল জলকে চল!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন