মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। নিজের ব্যক্তিত্ব, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, সমাজের প্রতি কর্তব্য ও দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এসব বিষয়ে যার সচেতন বোধ আছে তিনিই সামাজিক ব্যক্তিত্ব। এ বিষয়ে বোধাবোধ সবার মধ্যে কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়। অত্র অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা অনুরূপ পরিলক্ষিত হয়। তারমধ্যে কোনো কোনো অঞ্চলে অতীতকালের কিছু ভাবধারা চোখে পড়ে। ইতিহাস প্রমাণ দেয় জমিদারগণ বা প্রভাবশালীরা নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কিছু পারিষদবৃন্দ জোটাতেন। সেই পারিষদ ওইসব কুলীন ব্যক্তিবর্গের আজ্ঞাবাহী দাস হয়ে থাকত। সমাজে নিজেরা মাথাতুলে দাঁড়াবে, কিংবা নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে এই সচেতন বোধ তাদের মধ্যে ছিল না। সম্পূর্ণভাবে তারা তাদের মনিবদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এমনকি প্রভুদের অনুগত বলে প্রকাশ করে তারা গর্ভবোধ করতো। অতীত থেকে বয়ে আসা এরকম কিছু রীতিনীতি কোথাও কোথাও ভীত গেড়ে বসে আছে। যেমন একটি গ্রামে যদি দশটি বংশ থাকে দেখা যায় সেসব বংশের মধ্যে দুটি বংশের নামে সমাজ বয়ে চলেছে। বাকি বংশধরেরা কোনো না কোনোভাবে ঐ বংশীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় আপনি কোন সমাজের লোক, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় আমি অমুক সমাজের লোক। অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে এতে সে কিছুমাত্র সংশয় বোধ করছে না। দু’টি সমাজ মানে দু’টি পক্ষ। প্রায়ই গ্রামে দু’টি করে সমাজ আছে। ভাইতে ভাইতে, বংশে বংশে, পাড়ায় পাড়ায় সংঘর্ষ হানাহানি এতে লেগেই আছে। এই সমাজ ব্যবস্থায় একাত্মতা প্রকাশ পায় না। অনেকের সাথে এসব বিষয় তথ্য নিয়ে জানা গেছে এই সমাজ ব্যবস্থা শুভফলপ্রদ নয়। কংশুরের গৌরাঙ্গ দাস জানালেন—’এই বংশগত সমাজ ব্যবস্থা অচিরেই বিলোপ সাধন হওয়া দরকার। নিজের খাব নিজের পরব, নিজে শিক্ষিত হয়ে আমি অন্যের নামে পরিচিত হব এটা কোনো সচেতন মানুষ চায় না। এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলনের প্রয়োজন। বিশেষ করে গোপালগঞ্জ উপজেলার সাহাপুর পরগণার আড়ুয়াকংশুর, কংশুর, খাটিয়াগড়, হাটবাড়িয়া, পানাইল ও আশপাশের গ্রামগুলো বেশি আক্রান্ত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি আজ হোক, কাল হোক এই বংশগত সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয় ঘটবে।’ তিনি আরও বললেন, পৃথিবীতে শত শত কোটি মানুষ বাস করে। কোথাও এই বংশগত সমাজ ব্যবস্থা নেই। কই তারাতো সুন্দর স্বাবলীল জীবন যাপন করছে
জীব-জন্তু, পাখ-পাখালি, কীট-পতঙ্গ কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করে না, প্রকৃতি তার নিজের প্রয়োজনে ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গ থেকে শুরু করে বৃহদাকৃতির প্রাণী পর্যন্ত সৃষ্টি করেছে। তবে ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন জায়গায় আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু দেখতে পাওয়া যায়। এই জনপদের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী যে ধরনের জীবজন্তু থাকার কথা তা আছে বটে, তবে বনবাদাড় ঝোপঝাড় নিতি নিতি বিলুপ্তির ফলে বেশকিছু প্রজাতি হারিয়ে গেছে।
চতুষ্পদ প্রাণী : গরু, ছাগল, ঘোড়া, মহিষ, মেষ, কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, খেঁকশিয়াল, বনবিড়াল, খাটাস, খচ্চর, বেজি, ছুচো, ইঁদুর ব্যাঙ ইত্যাদি।
সরিসৃপ প্রাণী : কাছিম, গুইসাপ, গোখরা, কেউটিয়া, শানিসাপ ও বিভিন্ন প্রজাতি সাপ।
পাখি : দোয়েল, শ্যামা, কোকিল, কবুতর, ঘুঘু, শালিক, চড়ুই, পেঁচা, হলদে পাখি, বউ কথা কও, তালচড়া, বাবুই, টুনটুনি, গুঁইগোদা, ফিঙে, চিল, কাক, হাস, মুরগী, ক্যাচকেচিয়া, চ্যাগা, ভিলভিলা, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, তোতাপাখি, চিল, বাদুড়, চামচিকা, গগন ধাওয়া, শীতের পাখি ইত্যাদি।
পোকামাকড় : বিছা, কেল্লুয়া (কেন্নো), প্রজাপতি, ভীমরুল, মৌমাছি, বল্লা, ক্ষুদে বল্লা, মশা, মাছি, ঝিঁঝি পোকা, জুনিপোকা, চাটুয়া, জোঁক, উইপোকা, পিঁপড়া, ওল্লা, মাইঝাল, টিকটিকি, ছিটকা পোকা, লেদাপোকা, চেলা, মাকড়সা, তুতপোকা ইত্যাদি। জলজ প্রাণী : শুশুক, মেছো কুমির, রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, বোয়াল, আইড়, শোল, গজার, বেলে টাকি, বাথুয়া টাকি, তেলুয়া টাকি, ভাইমরা টাকি, পাবদা, ইলিশ, ফলি, কৈ, শিং, মাগুর, বাইন, ট্যাংরা, পুঁটি, খয়রা (খলিসা), ইচিয়া (চিংড়ি) কাইল্যা, খল্লা, টাটকেনি, গুতিয়া, কুচিয়া, এলাং, পাতাসি, গাবপাতা, নাপিত কৈ, বাচা, ঘাগরা, ফুলট্যাংরা, বুজুরিয়া ট্যাংরা, কালিবোস, নান্দিয়াল, রয়না, ট্যাপটেপিয়া, গ্যানগেনিয়া, চেলা, চুচড়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি।
অনুকূল জলবায়ু ও দো-আঁশ মাটির জন্য অঞ্চলটি কৃষি প্রধান। ফসলী জমিতে ফসল আর বন বাদাড়, রাস্তার ও বাড়ির আশপাশে জন্ম নিয়েছে নাম জানা অজানা হরেক রকমের উদ্ভিদ। নিম্নবর্ণিত ফসল ও উদ্ভিদ কৃষক পরিবারগুলোর একমাত্র ভরসা। ‘আগের মতো আমাদের দেশে আউশ ধান, দিঘা ধান ও আমন ধানের চাষ হয় না। বোরো ধান তো প্রায় উঠেই গেছে। ব্লকের চাষ আসায় সেসব আর কেউ চাষ করে না। আগে কত আউশ ধান দিঘা ধান ও আমন ধানের চাষ হতো।
আউশ ধান : লক্ষ্মীলতা, শ্রীবলিয়ান, পরাঙ্গী, কচ্চামুড়ি কোসমারী, চৌদ্দমুগুর, ষাটিয়া, নোড়ৈ, শিয়াল পরাঙ্গী, কটকতারা ইত্যাদি।
দিঘা ধান : লক্ষ্মী দিঘা, কনক দিঘা, ভাওয়ালী দিঘা, মানিক দিঘা, খাড়া দিঘা, লাল দিঘা, সস্বরি দিগা, সোনা দিঘা ইত্যাদি।
আমন ধান : ছত্রভোগ, দুধমণি, গাজীভোগ, পৃথিরাজ, কাচকলম, গৌরকাজল, খৈয়ামটর, শিয়াল নেজি, ন্যাতপাশা, জাবড়া, দলকচু, বান্দরজটা, জয়না, বীরপালা, ব্যতক, রায়েন্দা, মালভোগ, কালামনা, মাটচাল প্রভৃতি।’
অন্যান্য ফসল বা তরিতরকারি : সরিষা, পাট, গম, কলাই, বাদাম, সয়াবিন, তিষি, মোষনে, তিল, লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা, ধনে, পিঠাজন, তামাক (বিলুপ্তপ্রায়), পান, গোলআলু, মিষ্টি আলু, শশা, কপি, মুলা, পালংশাক, হেলেঞ্চা, পুঁইশাক, লাউ, কুমড়া, উচ্ছে, কচু, কচুরলতি, বেগুন, চালকুমড়া, কুশি, কাঁচাঝাল, ঢেঁড়স ইত্যাদি।
ফুল : শাপলা, পদ্ম, জবা, গাঁদা, বেলীফুল, কৃষ্ণচূড়া, যুথি, মালতি, মল্লিকা, হাসনা হেনা, কাচড়াফুল, জুঁই, শেফালী, কামিনী, দুপুরে ফুল, লিলিফুল, কেতকী, টগর, ধুতরা ফুল, বর্ণিফুল, নীলকণ্ঠ, মোরগ ফুল, সূর্যমুখী, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ ইত্যাদি।
ফল : আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, খেজুর, কলা, পেঁপে, লিচু, লেবু, বাতাবী লেবু, সফেদা, আতা, বেল, কুল, বাঙ্গি, তরমুজ, (শ্যাওড়া বাড়ি, বড় ডোমরাশুর) কামরাঙ্গা, করমচা ইত্যাদি।
আগাছা শুকনো মৌসুমে : ভাদলা, আদাগাঠিয়া, ভিটাচাটা, গুচ্ছঘাস, গুন্দিঘাস, বালিয়াবন, কাটা গাছ, চেউচি, কলবন, কাঁটানটে ইত্যাদি।
আগাছা বর্ষা মৌসুমে : কচুরিপানা, পদ্ম, কাঁটা শেওলা, ভাসা শেওলা, চুনো শেওলা, মালঞ্চ, শাপলা, মামাকলা, কলমি, শালুক, ঘেচু, উড়ি, কলবন, ঝরা ইত্যাদি।
পর গাছা : স্বর্ণলতা।
নেশা জাতীয় উদ্ভিদ : তামাক, গাঁজা, ভাং, সুপারি, ধুতরা ইত্যাদি।
বনজ বৃক্ষ : অর্জুন, মেহগনি, শিরিষ, বাঁশ, কড়াই, শিশুগাছ, গাবগাছ, হিজল গাছ, শ্যাওড়া গাছ, কালি কড়াই ইত্যাদি
ফলজ বৃক্ষ : আম, জাম, কাঁঠাল, খেজুর, কলা, জামরুল, আতা, পেয়ারা, সফেদা, লিচু, কামরাঙ্গা, জলপাই, আমড়া, বিলাতি গাব, তাল, জাম্মুরা, লেবু, সুপারি, তেঁতুল, বেল গাছ ইত্যাদি।
ঔষধি বৃক্ষ : নিম, নিসিন্দা, উলট কম্বল, হরিতকী, বহেড়া, আমলকি, বাশোক, নিশ্চিন্ত, ভিটা ছাড়ার লতা, দূর্বা, থানকুনি, কালোমেঘ, আশকলি গাছ, শেওড়াগাছ, আমগুরুজেয় লতা, পিঠাজন, আকন্দ, ধুতরা, কৈয়াড়া, বিশ কাটালি, বিশল্যকরণী ইত্যাদি।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন