লোকবিশ্বাস (Folk Belief) ও লোকসংস্কার (Folk Superstition )

লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার

১. পুণ্যস্নান

গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার একটি প্রসিদ্ধ নদীবন্দর হলো রাধাগঞ্জ। বন্দরটি ঘাঘর নদীর বাবুর খাল নামক (বর্তমান সৈন্ধ) স্থানে অবস্থিত। এর অপর পাড়ে প্রসিদ্ধ ধার্মিক ব্যক্তিত্বের আশ্রম। যিনি শুক গোসাঁই নামে সুপরিচিত। তাঁর আশ্রমটি গড়ে উঠেছে নদীর পাড় ঘেঁষেই। আনুমানিক ৯০ বছর যাবৎ এখানে তাঁর স্মরণে পৌষ মাসের শেষ দিনে একটি পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা তার ভক্তবৃন্দ এই পুণ্যস্নানে জড়ো হয়। তারা এই মহান ব্রহ্মচার্য্যের সান্নিধ্যে ও আশীর্বাদ কামনার পাশাপাশি পরস্পরের মধ্যে প্রেমের সেতুবন্ধনের উপলক্ষে এদিনটিতে সমবেত হয়। এ ছাড়া চৈত্র মাসে ব্রহ্মপুত্র নদে যে সনাতন তীর্থস্থান অনুষ্ঠিত হয় সেই উপলক্ষে আশ্রমে আরও একটি পুণ্যস্নানের আয়োজন করা হয়। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্রহ্মপুত্রের তীর্থ স্থানের দূরত্বের কথা বিবেচনায় রেখে বিকল্প এই স্নানের আনুষ্ঠানিকতা। শুক গোসাঁই এই পরিকল্পনার অনুমতি দিয়েছেন। এই স্নান উপলক্ষে আশ্রমে মেলা বসে। প্রচুর জনসমাগমে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে এলাকাটি।

২. পেত্নী ছাড়ানো

গ্রাম বাংলায় এখনও পেত্নী নামক অ-শরীরী একটা কল্পিত বস্তু নর-নারীর দেহে আবিষ্ট হয় বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। সাধারণত দশ থেকে বাইশ বছরের মেয়েরাই বেশি আক্রান্ত হয় এই রোগে। এতে সে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। কোনো শাসন-বারণ মানে না। মানুষ মনে করে কোনো পেত্নী বা অশরীরী তার শরীরে ভর করেছে। ‘তখন লোকে বলে ওকে পেত্নীতে ধরেছে। পেত্নী সাধারণত কাঁচা মাংস খায়, তাই তাকেও ঐসব খেতে দেওয়া হয়। কবিরাজ ডেকে এনে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। কবিরাজ এসে চালায় তার কবিরাজি। ঝাটা, পিছা, জুতা, লাঠি ইত্যাদি দ্বারা করে অত্যাচার। কিন্তু তারা চিন্তা করে না যে এটা Sextual বিক্ষেপও হতে পারে। প্রসঙ্গত বলতে হবে, আমি (কৃষ্ণপদ সরকার) একবার শুনলাম যে আমার এক বন্ধুর স্ত্রীকে পেত্নীতে ধরেছে। খবর পেয়ে কর্তব্য পালনে সেখানে যাই। মেয়েটি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম, সেও বসে আছে। জানলাম বন্ধুটি বাড়িতে নেই। কি সমস্যা! আমি তার দিকে বার বার তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকায়, কিন্তু কথা বলে না। আমিও বলি না। বেশকিছু সময় পরে সে আমাকে চিনল এবং বলল বস। দেখলাম তার চোখ দুটো লাল, যেন জবাফুল। রক্ত ঝরে পড়ে পড়ে। অবাক হলাম একি! ধীরে ধীরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম শারীরিক কোনো সমস্যা? সে মিষ্টি করে হেসে দিল। সে এমনভাবে হাসিটা দিল যাতে আমার বুঝতে ভুল না হয়। বুঝে নিলাম অবশ্যই Sextual বিক্ষেপ। একটু পরেই সে আবার অস্বাভাবিক হয়ে পড়ল। এখন যেন সে আমাকে আর চিনতে পারছে না।

এরকম অবস্থা দেখলেই গ্রামবাংলার মানুষ মনে করে পেত্নী বা কোনো অশরীরীর কিছু আবিষ্ট হয়েছে। ডেকে আনে কাবিরাজ। আরম্ভ করে অমানবিক নির্যাতন। প্রথমে সে উঠানে চারকোণা বর্গাকৃতি করে একটা খোট আঁকে। খোটের পাশে কবিরাজ একটা লাঠি নিয়ে বসে। খোটের পাশে রাখা হয় ভালো তেলের প্রদীপ ও ধূপপাত্র। মাঝে মাঝে কবিরাজ বিড় বিড় করে মন্ত্র পাঠ করে আর লাঠি দিয়ে খোটের মধ্যে বাড়ি মারে। বলে আয় আয় খোটে আয়, দেখা যায় মেয়েটা ধীরে ধীরে হেঁটে আসে খোটের কাছে। কবিরাজ বলে বয়-বয়, বসেও মেয়েটি। কবিরাজ জিজ্ঞাসা করে, এ-তুই থাকিস কোথায়? কেন এলি? মেয়েটি জবাব দেয় ঐ গ্রামের শড়া গাছে। ও আমার বন্ধু তাই আমি আসি। আজ হতে চলে যাবি। যাব না। অমনি লাগায় বাড়ি। ঝাটা, পিছা, ছেড়াজুতা ইত্যাদি দিয়ে মারধর করা হয় তাকে। অনেক সময় গরুর মাথা তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কাঁচা মাংস, মাছ খেতে হয় তাকে। উপায়ান্তর না পেয়ে মেয়েটি কবিরাজের কথা মতো সবই করে। আর চোখের পানিও পড়তে দেখা গেছে। মেয়েটিকে বলে এখন ঐ গুলো নিয়ে চলে যা। মেয়েটি তাই করে। দূরে গিয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে। পরে ঐ কবিরাজ কেরামতি করে বলে পেত্নী চলে গেছে। দেও দেও পাওনা বুঝে দেও। বিদায় হই। দেখা গেছে ঐ মেয়েটি পুনঃ পুনঃ জ্ঞান হারাচ্ছে। আমার বন্ধুর স্ত্রীকে কিন্তু কোনো কবিরাজ না দেখায়েই ভালো হয়ে গেছে। এই হলো পেত্নী ছাড়ানোর ইতিকথা।

৩. ভাই ভাতের ব্রত

এই ব্রতটি কোনো ঋতুভিত্তিক নয়। নেই কোনো নির্ধারিত সময়ও। ব্রতটি শুরু হয়েছিল নব্বই দশকের প্রথম দিকে। সারা এলাকায় ব্রতটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কী সধবা কী বিধবা কিছুদিন পূর্বেও তারা যথারীতি ব্রতটি পালন করত। ‘ভাই ভাত’ ব্রতটি হচ্ছে ভাইয়ের বাড়ি যেয়ে ভাত খাওয়া। শুধু ভাত খেলে চলবে না। কোনো মতে সেদিন ভাইয়ের বাড়িতে রাত যাপন করা যাবে না। ভাত খেয়ে দিনের মধ্যেই স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসতে হবে। এমনকি পথে কোথাও দেরি করলে এই ব্রত পালনে বিঘ্ন ঘটবে। ব্রতটি পালন করলে ভাইয়ের সংসারের আয় উন্নতি বৃদ্ধি পায়, দুঃখ থাকে না। ভাই বোনের সম্পর্ক কোনোদিন নষ্ট হয় না। এতে স্বামীর পরিবারেও মঙ্গল হয়। এখন এই ব্রত পালন করতে দেখা যায় না।

৪. ভাগ্নে ভোজন

ভাগ্নে ভোজনের মাধ্যমে আত্মীয়দের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশনা ফুটে ওঠে। দেবতার সামনে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তরা যেরকম শ্রদ্ধা নিবেদন করে ঠিক তেমনি ভাবে ভাগ্নেদেরকে ভোজন করাতে দেখা যায়। এতে কোনো ঋতু বা সময় নির্ধারণ থাকে না। তবে শারদীয়া দুর্গোৎসবের মধ্যে এই অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় বেশি গোপালগঞ্জের বিশেষ বিশেষ কয়েকটি স্থানে এই অনুষ্ঠান পালনের রেওয়াজ আছে। যেমন-শেওড়াবাড়ি, টুঠামান্দ্রা, পাটিকেলবাড়ি, বড় ডোমরাশুর তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই অনুষ্ঠান পালনকারী একজন গৃহকর্তা সমীর হালদার (৫০) এ বিষয়ে যা বললেন-’ভাগ্নেদের ভক্তি সহকারে খাবার পরিবেশন করলে অশেষ পুণ্য লাভ হয়।

এলাকায় এ বিষয়ে একটি প্রবাদও আছে। তাহলো–দশজন ব্রাহ্মণ ভোজন দিলে যে পুণ্য লাভ হয় একজন ভাগ্নে ভোজন করালে সেই পুণ্য লাভ করা যায়। আমরা সাধারণত শারদীয়া দুর্গোৎসবে এই ভাগ্নে ভোজন অনুষ্ঠান পালন করে থাকি। ভাগ্নেদের স্নান করায়ে পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেকের সামনে নৈবেদ্য সদৃশ সুস্বাদু খাবার রেখে ধূপ-দীপ জেলে গলায় বস্ত্র নিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে প্রণাম করতে হয়। তারপর ভাগ্নেরা খেতে শুরু করবে। এমনকি জলের গ্লাস পর্যন্ত তাদেরকে ধরতে দেওয়া হয় না। জলপান করিয়ে দিই। ভোজন শেষে তাদেরকে ভোজন দক্ষিণা দিতে হয়। এ হলো ভাগ্নে ভোজন।’ এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে এই ভাগ্নে ভোজন আগের মতো হয় না। স্থানীয় জনগণ বললেন গ্রামে আধুনিকতার বাতাস লাগায় অনেক পুরোনো ঐতিহ্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

৫. নষ্টচন্দ্র বা হরিতালিকা

গ্রামের যুবক ছেলেরা ভাদ্রমাসে নষ্টচন্দ্র বা হরিতালিকা লোকাচারটি পালন করে থাকে। মজার ঘটনা হলো যেসব যুবক ছেলেরা এটি উদ্‌যাপন করবে তা অন্য কেউ জানবে না। পাড়ায় পাড়ায় গুপ্তভাবে চলে নষ্টচন্দ্রের ক্রিয়া। মজা করে তারা অন্য পরিবারের অনিষ্ট সাধন করে উপভোগ করে এটি। একে এক ধরনের গুপ্ত বনভোজন বলা যেতে পারে। অন্য গৃহস্থের পালান থেকে যেকোনো তরকারি বা ফল গোপনে অর্ধেক কেটে এনে মজা করে পাক করে খায়। তেমন একজন ব্যক্তি রঞ্জন মজুমদার (৪৭) এ বিষয়ে বললেন—‘ধুর। ছোটবেলায় তো মজা করে এ্যা খাইছি। ফল-মুল, তরি-তরকারি ছাড়াও অন্যের হাঁস, মুরগি, খাসি আনছি। একবার এক গেরস্তের খাসি আনতি যাইয়া ঘটালাম এক মজার কাণ্ড। খাসি ভেবে অন্ধকারে ধরে বসলাম কুকুরের হোল (অণ্ডকোষ)। বাপরে কি ঘেউ ঘেউ! জান নৈয়া দৌড়িয়া পলালাম। এরকম অনেক দুষ্টমী করছি এই নষ্টচন্দ্ৰ খাতি যাইয়া। এই বয়সে তা মনে পড়লে এখনও হাসি আসে।’

৬. ল্যাংটার চিনি

জনগণের বিশ্বাস ছোট শিশুরা নিষ্পাপ ও সহজ সরল। তাদেরকে ভালোবাসলে স্ৰষ্টা খুশি হন। তাই তাদেরকে নিয়ে প্রচলিত আছে নানারকম অনুষ্ঠান। ল্যাংটার চিনি তারমধ্যে অন্যতম। কেউ কোনো বিপদগ্রস্ত হলে এই ল্যাংটার চিনি মানত করে থাকেন। তা ছাড়া অনেক পরিবার আছে কারণে অকারণে মাঝে মধ্যে এই ল্যাংটার চিনির আয়োজন করে থাকেন। ‘এ অনুষ্ঠানের আয়োজন খুব সহজ। চিনি, ফুল, পাতা, ধূপ-দীপ ও একঘট জল। এটি সাধারণত উঠানে করতে হয়। তাও ঠিক সন্ধ্যায়। উঠানের কিছু অংশ লেপে মুছে পরিষ্কার করে নিতে হয়। সবকিছু সাজায়ে শুরু করা হয় এই ল্যাংটার চিনির অনুষ্ঠান। বাড়ির ল্যাংটা শিশুদের নিমন্ত্রণ করে জড়ো করা হয় সেখানে। তাদেরকে স্রষ্টার নামে নাচতে গাইতে অনুরোধ করা হয়। তারা যে যার মতো করে নাচ গান করে। এতে কোনো বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। কিছু সময় এভাবে চলার পর ‘ল্যাংটা প্রীতে হরিধ্বনি বল মন হরি বল’ বলে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়।’ এই ল্যাংটার চিনির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্নেহ, ভালোবাসা গভীরভাবে ফুটে ওঠার শিক্ষা আছে।

৭. ওজনের চিনি

দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির দেহের ওজনের সমপরিমাণ মানতকৃত মিষ্টিদ্রব্য ধর্মীয় রীতিতে পরিশোধ করার প্রক্রিয়া হলো ওজনের চিনির বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করেন এমন একজন ব্যক্তি সুমন্ত দাস (৬১) ওজনের চিনির এরকম ব্যাখ্যা করলেন-’যারা বিপদগ্রস্ত হন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওজনের চিনি মানত করে থাকে। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়াও তার আপনজনেরা এ ধরনের মানত করতে পারেন। হরিসভা কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিপদগ্রস্তরা দায়মুক্ত হয়। তবে ওজনের চিনি নামেও তা অনুষ্ঠিত হতে পারে। যত সময় অনুষ্ঠান চলবে ততক্ষণ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির উপস্থিত থাকতে হবে। এমনকি তিনি অনুষ্ঠানে দাঁড়ায়ে আত্ম বিনয়ের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানে যোগদানরত সকলের প্রতি বিনম্র বচনে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে থাকেন। সভার পক্ষ থেকে একজন তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন। অনুষ্ঠানে যোগদানকারী গায়করা বিভিন্ন ধরনের ভক্তিমূলক গান পরিবেশনের মাধ্যমে উক্ত মিষ্টিদ্রব্য সকলকে বণ্টন করে দেন।’

৮. শিরলি

চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোরো ধানকে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষাকারী তান্ত্রিক ব্যক্তিত্বকে শিরলি বলে। বোরো ধান রক্ষা করার জন্য প্রায় প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন শর্তে একজন শিরলি নিয়োগ করতেন। শিরলিকে একধরনের গুনিন বলা যেতে পারে। শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধ করার জন্য শিরলিরা সাধারণত পশুশৃঙ্গ ব্যবহার করতেন। মহিষ শৃঙ্গ তার মধ্যে অন্যতম। শিলাবৃষ্টি শুরু হলে শিরলি তখন ঐ পশুশৃঙ্গে ফুঁ দিয়ে শিল পড়া ঠেকাতেন। এমনও কিংবদন্তি আছে শিরলিরা পশুশৃঙ্গের মাধ্যমে শিলপড়া প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলে তারা জমিনের আইলে চিৎ হয়ে শুয়ে শিল পড়া রোধ করতেন। এখন এই পদ্ধতি প্রায় দেখা যায় না। যেসব এলাকায় এই পদ্ধতিটা বেশি রকম প্রচলিত ছিল তারমধ্যে হাটবাড়িয়া, মোল্লাকান্দি, নিজামকান্দি উল্লেখযোগ্য। তবে এই শিল পড়া ঠেকানোর জন্য আজও কোনো কোনো অঞ্চলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা মহোৎসব করার রীতি নীতি আছে। এই শিলাবৃষ্টি রোধ করা নিয়ে নিজড়া গ্রামের একজন গৃহস্বামী সন্তোষ মণ্ডল (৬৪) যা ব্যাখ্যা করলেন-’প্রতিবছর আষাঢ় মাসের প্রথম বুধবার নিজড়া বালা বাড়িতে কবি রসরাজ শ্রীমৎ তারক চন্দ্র সরকারের স্মৃতিচারণে জাঁকজমক সহকারে একটি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মূলত শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। যেদিন থেকে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে সেদিন থেকে এতদঞ্চলে আর বোরো ফসল মৌসুমে শিলাবৃষ্টি হয় না।’ এই অনুষ্ঠানের ধরন জানতে চাইলে গ্রামের আরেক ব্যক্তি অবতীর্ণ বালা এভাবে ব্যাখ্যা দিলেন-’আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শিলাবৃষ্টির হাত থেকে বোর-ইরি ধানকে রক্ষা করার জন্য এই মহোৎসবের সূত্রপাত করেন। শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্থের রচয়িতা কবি রসরাজ শ্রীমৎ তারেকচন্দ্র সরকারের স্মরণে একটি ত্রিভুজাকৃতির লাল নিশান পুতে রাখা হয়। সেই থেকে ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।’

৯. পাঁঠাবলি

পাঁঠাবলি হচ্ছে শাক্ত ভক্তদের কালীপূজাতে পাশবিক প্রবৃত্তি নিবৃতি করার একটা প্রতীকী ব্যবস্থা। পাঁঠাকে কামুক পশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কালীপূজায় উক্ত পশুকে বধ করলে কাম রিপু দমন হয় বলে মূর্তি পূজায় বিশ্বাসভাজনদের বিশ্বাস। মূর্তি পূজার অনুষ্ঠানে হাড়িকাঠার মধ্যে পাঁঠার মস্তক ঢুকায়ে বড় রাম দা দ্বারা এক কোঁপে শিরশ্ছেদ করে বলিদান করতে দেখা যায়। অবশ্য কালীপূজা ছাড়াও দুর্গাপূজায়, চণ্ডীপূজায় এই বলি দান পদ্ধতি থাকলেও আগের তুলনায় অনেক কম। পূজার সময় মূর্তির সামনে যেসব পশু বলি দেওয়া হয় তার করুণ আওয়াজ ও রুধির ধারা দেখে চারণ কবি রাজেন্দ্রনাথ সরকার ব্যথিত হয়ে নিম্নবর্ণিত গানটি রচনা করেন :

‘বৃথা শক্তি পূজায় পশু বলি আমাদের দেশে
যদি মহিষ বলি (মা) কালী খায়
গরু খায় না কোন কথায়?
ভাব একবার একতায় বসে’
যদি মুসলমানের কাছে
হিন্দুরা গরু বেচে
কোরবানিতে করলে খুন
মহাপাপ হয় সেই দরুণ
স্মৃতি শাস্ত্রে লেখা তার দোষ গুণ।
তাইতো হিন্দুগণকে ডেকে বলি
পূজায় দিতে গরু বলি
বেঁচে থাকুক মহিষগুলি
তাতে কাজ কর্মে (মহিষ) পাবে দ্বিগুণ।

সুর-সুধাকর রাজেন্দ্রনাথ সরকারের গানে কৌলিন্যরাও মোহিত হতেন। তবে লৌকিকতায় তারা রাজেন্দ্রনাথকে সৌজন্য দেখাতো না। পূজায় পশু বলির মতো অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যেরও প্রতিবাদ করতেন। সেই প্রতিবাদ কথা দিয়ে নয়, সুর ও ছন্দের মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।

যেমন-

মদের নেশায় বদের আশায়
ব্রাহ্মণে খায় বেশ্যাবাড়ির ভাত;
তাতে হয় না জাতি পাত
বেশ্যালয় কি ঠাকুর জগন্নাথ?
নটির হুক্কায় তামাক খেলে
হুক্কার জল মরে নমঃ ছুলে
এসব ব্রাহ্মণে না প্ৰণাম দিয়ে
নটির পদে কোটি প্রনিপাত।
মদের নেশায় বদের আশায়
ব্রাহ্মণে খায় বেশ্যাবাড়ির ভাত।

১০. ব্যবারী বুড়ি

যে বুড়িকে ব্যবহার করা হয় তাকে ব্যবারী বুড়ি বলে। বিয়ের পরে নব বধূ যখন শ্বশুর বাড়ি যায় তখন শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ সম্পূর্ণ অজানা অচেনা লাগে। নতুন বৌ কাকে কী বলবে কী করবে এ নিয়ে তাকে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এজন্য প্রাথমিকভাবে তার একজন সহায়িকা দরকার। সেই সহায়িকা হচ্ছে ব্যবারী বুড়ি। গ্রাম বাংলায় এই ব্যবারী বুড়ির প্রচলন আগের মতোই আছে। সম্পর্কের দিক থেকে ব্যবারী বুড়িকে হতে হবে ভাবি, দাদি, নানি বা তৎসমতুল্য অন্য কেউ। যাকে সে অতি সহজে তার সমস্যার কথা বলতে পারে। স্বামী সহবাসজনিত কোনো সমস্যাও যাতে দ্বিধাহীনভাবে খুলে বলতে পারে। নবদম্পতি কেমন আছে তা জানতে কনের বাড়ি থেকে তিন দিনের দিন বরের বাড়ি লোক যায়। একে মেলানি বলে। মেলানিতে মাছ বাতাসা নিয়ে যাওয়ার প্রথাও আগের মতো আছে। দশদিন পরে বর কনেকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যায়। এমনও জনশ্রুতি আছে যে, কনের মা যদি ভোর বেলায় দেখতে পায় যে মেয়ের মাথার চুল এলোমেলো তবে তিনি খুব খুশি হন। ভাবে কন্যাকে বর সোহাগ করেছে।

১১. রাখাল পোড়া

ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষি কাঠামো মূলত পশুর কর্মের উপর ভর করে গড়ে উঠেছে। গরু, মহিষ তারমধ্যে অন্যতম। দক্ষিণ বাংলার বিশেষ করে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, নড়াইল-এই সমস্ত জেলায় মহিষ তেমন একটা দেখা যায় না। গো পালনকারী পরিবারের সংখ্যা বেশি। ট্রাক্টর আসার আগে হালচাষ ভিন্ন জমি আবাদ করার অন্য কোনো গত্যান্তর ছিল না। হালচাষ করতে গরু, ঘোড়া ও মহিষ এই তিনটি পশু ব্যবহার হয়। গোয়াল ঘরে গরু না থাকলে কৃষক পরিবারগুলোকে কেমন যেন শ্রীহীন মনে হতো। তখন প্রত্যেক পরিবারে একজন করে গরু চারণকারী থাকত। যাদেরকে বলা হয় রাখাল। বিভিন্ন শর্তে রাখাল বালকেরা গৃহস্থদের গরু চরাত। কেউ মাসিক বেতনে আবার কেউ পেটে ভাতে। রাখাল বালকেরা সকালবেলা সারি বেঁধে গরুর পাল নিয়ে ছুটতো গরু চরাতে। তাদের কোমরে গামছা বাঁধা থাকত। হাতে থাকত একটি লাঠি যাকে নড়ি বলা হয়। এই নড়ি হলো গরু শাসনের হাতিয়ার। রাখাল বালকেরা গরু চরাতে বিভিন্ন ধরনের শব্দ উচ্চারণ করত। যেমন-ট্রিখায়, ঢাটা, ভুম, ভ্রুম, টি ইত্যাদি। আরো কিছু শব্দ আছে যেগুলোর উচ্চারণ লিখে প্রকাশ করা যায় না। তারা বিভিন্ন ধরনের খেলাও খেলতো যেমন গোবর্ধন, পুথিবাড়ি ইত্যাদি। সবচেয়ে তারা বেশি আনন্দ উপভোগ করত নাড়ার আগুনে ফসল পোড়ায়ে খেতে। বৃত্তাকারে বসে তারা ঐ পোড়ানো ফসল খেত। একেই বলে রাখাল পোড়া। রাস্তা ঘাটে এমন কিছু বন্য ফল ফলতো যাদের নাম ছিল অজানা। রাখাল বালকেরা সেসব ফল আনন্দ করে খেত বলে ফলগুলোর নামকরণ হয়েছে রাখাল ফল। রাখাল বালকদের সেই স্বর্ণ যুগ আর নেই। আধুনিক চাষাবাদ এসে এই সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্ত। তেমন একজন গৃহস্বামী আলমগীর ফকির (৫০) অতীত দিন সম্পর্কে বললেন, ‘আগে দেশে অভাব ছিল তবে অভাবের সাথে শান্তিও ছিল। এখন অভাব নাই শান্তিও নাই। লক্ষ করে দেখা গেছে ট্রাক্টর চাষের জমিতে যে পরিমাণে ফসল ফলে তারচেয়ে বেশি ফসল ফলে হাল চাষওয়ালা জমিতে। কারণ ট্রাক্টরের ফলা মাটির নির্দিষ্ট একটা গভীরতা পর্যন্ত যায়। কিন্তু লাঙলের ফলা কোথাও বেশি মাটির তালে যায় কোথাও অল্প মাটি ভেদ করে। এতে মাটিতে জো ঠিক থাকে। তাই এতে ফসল ভালো হয়। এখন আগের মতো গরু নাই, রাখাল নাই, চোতের রাতে সেই গল্পও আর শোনা যায় না। আগের সহজ সরল দিন এর থেকে অনেক ভালো ছিল।’

১২. বৃক্ষপূজা ও বৃক্ষ বিবাহ

জল, মাটি ও গাছ এই তিনটি উপাদানের সমন্বয় সাধন ঘটলে পৃথিবী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। স্বস্তি পায়। তন্মধ্যে গাছ সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। গাছ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে, অক্সিজেন দেয়, উত্তপ্ত পৃথিবীতে শীতল ছায়া দান করে। হাজার হাজার বছর পূর্ব হতে শুরু হয়েছিল বৃক্ষোৎসব। মৎস্য পুরানের ৪৯তম অধ্যায়ে বৃক্ষপূজার বর্ণনা দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি একটি মাত্র বৃক্ষ রোপণ করিবেন, তিনি তিন অযুত কাল ইন্দ্রের স্থিতিকাল পর্যন্ত স্বর্গে অবস্থান করিবেন।’ আগের মানুষ বৃক্ষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে দেখে এসেছে। কারণ তখনকার দিনের জীবনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ আয়ুর্বেদ ভিত্তিক। কারণ প্রতিটি বৃক্ষ লতাগুল্মের মধ্যে রয়েছে কোনো না কোনো ভেষজ গুণ। তাছাড়া পরিবেশ রক্ষায় বিশাল ভূমিকা তো এর রয়েছেই। বৃক্ষের জীবন আছে এই অনুভূতি পৌরাণিক শাস্ত্রাদিতেও সাক্ষ্য দেয়। মনুসংহিতার ১ম অধ্যায়ের ৪৮ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘ইহারা বহুবিধ অসৎ কর্মফলে আচ্ছন্ন। ইহাদের অন্তরে চৈতন্য আছে এবং ইহারা সুখ-দুঃখও অনুভব করিয়াছে।’ এই সত্যকে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করে বিশ্ববাসীকে চমক লাগিয়ে দিয়েছেন। বৃক্ষকে তারা শুধু পূজাই করত না, তাদের মধ্যে বিবাহ প্রথাও প্রতিষ্ঠা করেছিল। সাধারণত বট ও অশ্বত্থ এই দুই বৃক্ষের মধ্যে বিবাহ বিধান স্থাপন করেছিল। এদের মধ্যে বিবাহ সংগঠনের যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। দুটি বৃক্ষই আমাদেরকে নানাবিধ ব্যধি থেকে মুক্ত রাখতে অত্যন্ত সহায়ক। বটের বাল্কলের রস রক্তপ্রদর, শ্বেত প্রদর, শুক্র তারল্য ও স্বপ্নদোষ ইত্যাদি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে চিহ্নিত। অশ্বত্থের ছাল, মূল ও ফল গর্ভস্থাপন ও বাজীকরণের ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রদ। তা ছাড়া অশ্বত্থ গাছ যতই বড় হয় ততই এর শিকড় শূন্য হতে থাকে। তখন বটই হয় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। বট তার শত সহস্র শিকড় দিয়ে অশ্বত্থ গাছকে আবদ্ধ করে রাখে। শিকড় শূন্যতার কারণে এই প্রজাতির উপকারী বৃক্ষ যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য বোধ হয় এই ব্যবস্থা। বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যাবে একই সঙ্গে বটগাছ ও অশ্বত্থ গাছ জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠে শাখা প্রশাখা মেলে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় আড়য়াকংশুর গ্রামে তেমন একটি বৃক্ষযুগল দেখতে পাওয়া যাবে। বহুপূর্বে গ্রামস্থ কার্তিক মজুমদার ও মনোহর বালা এই বৃক্ষ দম্পতির বিবাহ দিয়েছিলেন। বৃক্ষটির নীচে একটি কালীমন্দির আছে। মুসলমানরাও সাপের ভয়ে মনসাদেবীকে দুধকলা দেওয়ার জন্য এই মন্দিরে সমবেত হন। বিভিন্ন জনে বিভিন্ন সময়ে উক্ত বৃক্ষদম্পতিকে তেল সিঁদুর দিয়ে পুজে থাকে। এই বৃক্ষকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তিও শোনা যায়। এই বৃক্ষগুলো অনেক গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি ও রক্ষা করে। এসব বৃক্ষকে বিভিন্ন কারণহেতু কেউ অত্যাচার করতে সাহস পায় না। এই এলাকাটি কোনো এক সময় গাছের জন্য বিখ্যাত ছিল তার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন গ্রামে নামকরণ থেকে। অনেক গ্রাম আছে গাছের নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন-হিজলবাড়ি, ভেন্নাবাড়ি, নারিকেলবাড়ি, বটবাড়ি, মান্দ্রা, বরইভিটা, কদমবাড়ি, আমতলী, জামতলী ইত্যাদি।

১৩. তুলসী গাছের মাহাত্ম্য

নানাবিধ ভেষজগুণে সমৃদ্ধ তুলসী বৃক্ষ। যা তুলনাহীন তা-ই তুলসী। জীবাণু সংক্রমন প্রতিরোধ করা তুলসীর অন্যতম গুণ। প্রায় বাড়িতে তুলসী গাছের কদর দেখা যায়। অনেকে সকাল সন্ধ্যায় ঘর ও ঘরের আঙিনায় তুলসী জলের ছিটা দিয়ে থাকেন। তুলসী তলায় প্রণাম করারও বিধান আছে। প্রণাম করার অর্থ হলো কিছু সময় তুলসী গাছের সাহচর্যে থাকা। পূজা পার্বণের নৈবেদ্যেও তুলসী পাতা দেওয়া হয়। এর অর্থ দেবতার প্রসাদকে জীবাণুমুক্ত রাখা। ভক্তরা সেই প্রসাদ খেয়ে যাতে রোগাক্রান্ত না হয় সেজন্যই বোধ হয় এই ব্যবস্থা। তাছাড়া মানুষ মারা গেলে মৃতের চোখে, মুখে, নাকে তুলসী পাতা রাখা হয়। এতে মৃতদেহ হতে জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে না। একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ও কবিরাজ ক্ষিরোদ পোদ্দার তুলসীর ভেষজগুণ সম্পর্কে যা তুলে ধরলেন-’তুলসী পাতা খেলে হৃদরোগ ভালো হয়। এই পাতার রস লবণ মিশিয়ে দাদে লাগালে উপকার পাওয়া যায়। হাম বসন্তের গুটি গায়ে ভেসে উঠতে বাধাগ্রস্ত হলে তুলসী পাতা গায়ে মেখে দিলে তাড়াতাড়ি হাম বসন্তের গুটি বেরিয়ে আসে। তুলসী পাতা গুড়া করে নস্যের মতো নাকে টানলে সর্দি ভালো হয়। এর পাতা পুটলি করে নাকে টানলে নাক রোগ ভালো হয়। বোলতা বিছা বা পোকামাকড়ে কামড়ালে তুলসী পাতার রস খুব উপকারী, এতে আমবাত ও ব্লাড সুগারের উপকার হয়। বাচ্চাদের সর্দি কাশিতে তুলসী রস মধু দিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।

১৪. কালিভাঙা

কালিভাঙা পার্বণটি কার্তিক সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয়। কালিভাঙার অর্থ হলো রান্নাঘর, বাসগৃহ ও আসবাবপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা। কার্তিক সংক্রান্তিতে কেন এই বিধানটি প্রাচীনেরা দিয়েছেন এর তথ্যদাতা বসুদেব বিশ্বাস (৫৮), টুঙ্গীপাড়া, বর্ণনাটি এভাবে দিয়েছেন—‘কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে যম পূজা হয়। যম মৃত্যুর দেবতা। যমের বাহন মহিষ। মহিষের রং কালো। কালো শোক বা মলিনতার প্রতীক। মৃত্যুকে আমরা অসুন্দর মনে করি। শরৎ ঋতুর শেষে হেমন্তের আগমনে অনেক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অনেকে মারাও যায়। আগে কার্তিক মাসে মহামারীর ছিল ভীষণ ভয়। যমকে তুষ্ট করতে পারলে মৃত্যুকে জয় করা যাবে বা অকাল মৃত্যু ঘটবে না। এই কারণে কার্তিক মাসে যম পূজার প্রচলন করা হয়েছিল। বর্ষাভেজা শরীরে শরতের সূর্যরশ্মি বিভিন্ন রোগের উদ্ভব ঘটায়। পিত্তের প্রকোপ তারমধ্যে অন্যতম। আয়ুর্বেদ মতে পিত্ত জ্বর, দাহ, অগ্নিমন্দা, অতিসার, কৃমি, প্লীহা এসব রোগের কারণ। ওল, কালকাসুন্দি, জয়ন্তী, পুদিনা পাতা এই ঋতুতে খাওয়া ভালো বলে প্রাচীনেরা আজও বলে থাকেন। ভেষজগুণ সম্পন্ন এইসব উদ্ভিদ ওইসকল রোগসমূহের উত্তম প্রতিষেধক আগেকার মানুষ বলতেন, কার্তিক মাস গেলে একটি বছর বাঁচব। এই সময়টা যমের দক্ষিণ দুয়ার বলেও অনেকের বিশ্বাস। তাই কার্তিক সংক্রান্তিতে কালিভাঙার অর্থ হচ্ছে রোগ-ব্যাধি, দুঃখ-দুর্দশা ও মরণভীতি দূর করার একটি প্রতীকী ব্যবস্থা। আজকাল অনেকে এই পৌরাণিক আচরণটিকে এড়িয়ে চলেছেন।’

১৫. গোফাগুনা

সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন লোকজসংস্কৃতি সুদূর অতীত থেকে বয়ে এসেছে। গোফাগুনা তারই একটি অনুসর্গ। এটি রাখাল বালকদের একটি ব্রত। তাও আবার সব রাখালদের নয়। গাভী পালনকারী গৃহস্থের গোশালায় রাখাল বালকেরা কিংবা গৃহকর্তারা এটি পালন করে থাকেন। কেন, কবে থেকে এই ব্রত শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও নীলপূজার বালা খিরোদ পোদ্দার-এর কাছ থেকে এরকম জানা যায় যে, ‘সত্য যুগে অসুর ও দেবতাদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়। পরাক্রমশালী অসুরদের সাথে দেবতারা কোনোক্রমে পেরে ওঠে না। বারবার পরাজয়ের পর দেবতারা এর প্রতিকার খুঁজতে লাগলেন। তাদের এই মর্মপীড়ায় গোলকবিহারী হরি দৈব বাণীতে বলেছিলেন এতে তোমরা ভয় পেও না। এ যুদ্ধে বিজয় তোমাদের হবেই। এই অভয়বাণী শুনে দেবতাসকল বুকভরা আশা নিয়ে গোলাকবিহারী নারায়ণের কৃপা পানে চেয়ে থাকেন। পরমেশ্বরের কৃপায় এক অপরূপা জ্যোতির্ময়ী সুন্দরী আবির্ভূতা হন। সেই পরমা সুন্দরী বলেছিলেন, হে দেবতাগণ তোমাদের আর ভয় নেই। তাঁর এই অভয় বাণীতে সকল দেবতা তাদের সর্বশক্তি জ্যোতির্ময়ীকে দান করলেন। বীরাঙ্গনা বেশে তিনি অসুরদের সাথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই দুর্বৃত্তের সাথে মোটেই পেরে উঠতে পারছিলেন না। তাই সেই পরমাসুন্দরী মহামায়া ক্ষণিকের জন্য গাভীরূপ পরিগ্রহ করে বিশ্রাম করছিলেন। ক্লান্তি দূর করে যখন তিনি গাভীরূপ ত্যাগ করে পুনরায় জ্যোতির্ময়ীরূপ ধারণ করেন তখন গাভী বলেছিলেন হে মহামায়া আমায় ত্যাগ করলেন কেন? আমার এখন কী উপায় হবে? একথা শুনে তিনি বলেছিলেন এই মুহূর্তে তুমি মর্তে গিয়ে আবির্ভূতা হও, ঘরে ঘরে তোমার পূজা হবে। ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তি তোমার সেই শুভদিন, তার নাম হবে গোফাগুনা। এই প্রেক্ষাপটে আনন্দ-উল্লাসে এলাকায় বিশেষ করে গাভী পালনকারীর গৃহে অনুষ্ঠানটি পালন হয়ে থাকে। এখানে ব্রাহ্মণ বা তন্ত্রমন্ত্রের দরকার হয় না। রাখাল বালকেরা এতে মুখ্যম ভূমিকা পালন করে। দুগ্ধজাত বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবারের আয়োজন থাকে। গাভীস্নান করায়ে গোয়াল ঘরে নিয়ে ধূপ-দীপ জ্বেলে অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়। সেখানে থাকে এক ঘটি জল। রাখাল বালক ওই জল গাভীর গায়ে ঢেলে দেয়। তারপর নানা প্রকার সুস্বাদু খাবার একত্রিত করে সকলকে বণ্টন করে দেওয়া হয়। প্রতি ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তির দিনে এলাকাবাসী দলে দলে সেই খাবার খেতে গাভী পালনকারীদের ভবনে উপস্থিত হয়।

১৬. দ্বৈতবিয়া

মাতৃত্ব লাভের যোগ্যতার আগে যদি কোনো নারীর বিবাহ হয় এবং সেই যোগ্যতা যদি স্বামীর বাড়িতে দেখা দেয়, তবে তাকে ঘিরে একটি অনুষ্ঠান হয়, একে দোতুব্বিয়া বা দ্বৈতবিয়া বলে। এই অনুষ্ঠানে সাধারণত গ্রাম্য নারীরা অংশ নিয়ে থাকে। তাকে ঘিরে নাচ গান হয়। কাঁদামাটি করে। এভাবে কিছু সময় চলার পর সবাই মিলে নদীতে স্নান করে পুত পবিত্র হয়ে নববধূকে নতুন কাপড় পরিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে নতুন বউকে আশীর্বাদ জানিয়ে এই পর্ব শেষ করে। এখন এই দোতুব্বিয়া বা দ্বৈতবিয়া প্রায়ই দেখা যায় না। কারণ আগের মতো মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় না। বাল্যবিবাহ জনিত কারণে এই দোতুব্বিয়ার অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়েছে বলে সবার ধারণা।

১৭. তিন তেঁতুলে

লিঙ্গভেদে সন্তান জন্ম সংক্রান্ত বিষয়ে এটি একটি আঞ্চলিক প্রথা। কোনো দম্পতির পর পর তিনটি ছেলে সন্তানের পর একটি কন্যা সন্তান বা পর পর তিনটি কন্যা সন্তানের পর একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়াকে বুঝায়। যদি কারুর এই প্রকারের সন্তান জন্ম নেয় তবে তার সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে বলে জনশ্রুতি আছে। সংসারের আয় উন্নতি বৃদ্ধি পায়। তবে এজন্য কিছু করণ ক্রিয়ার প্রচলন আছে। ওই দম্পতিকে বিশেষ করে বধূকে পার্শ্ববর্তী পরিবারগুলোকে লবণ ও মাছ বিতরণ করতে হয়। লোকাচার পালন করতে কেউ বিমুখ হয় না। সব সময় একটা ভীতি কাজ করে—না জানি এটা পালন না করলে কখন কী বিপদ ঘটে। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উক্ত নারী মাছ ও লবণ বিতরণ করে বেড়ায়। এসব কারণে দেখা যায় অনেক লোকাচার অনেকের কাছে বাধ্যতামূলক হয়ে ধরা দেয়। লোকজসংস্কৃতি বিকাশে এই ধরনের বিষয়াদি বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

১৮. বাটি চালান

বাটি চালান হলো হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার একটি পৌরাণিক পদ্ধতি। প্রথমে একটি কাঁসার বাটি নেওয়া হয়। বাটিটা এমন হবে যাতে একজন লোকের হাত বাটির মধ্যে স্থাপন করা যায়। যে লোকটির হাত বাটিতে স্থাপন করানো হয়, তাকে অবশ্যই তুলারাশির লোক হতে হবে। যেদিন হারানো জিনিস পাবার জন্য বাটি চালানোর দিন ধার্য হয় তার আগের দিন সারা গ্রামে বা পাড়ায় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার জন্য সকলকে নিমন্ত্রণ করা হয়। তুলারাশির লোকটিকে যথাস্থানে উপস্থিত করে তার সামনে একটি পরিষ্কার কাঁসার বাটি আনা হয়। প্রথমে লোকটি একখানা গামছা বাটির মধ্যে সুন্দরভাবে স্থাপন করে। বাটির মধ্যে ওই গামছার উপরে তার ডান হাত স্থাপন করে নেয়। পরে গণক এসে হাজির হয়। গণকের হাতে থাকে কিছু ইঁদুরের মাটি, অনেক সময় গাছ গাছড়াও ব্যবহার করে। তুলারাশির লোকটির হাতের উপর কিছু মাটি ছাড়ে আর মন্ত্র পাঠ করে। কিছু সময় যেতে না যেতেই বাটিটা নড়তে থাকে। প্রথমে বাটিটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে। পরে আরম্ভ করে দ্রুত বেগে ছুটতে। হারানো জিনিস যেখানে লুকানো থাকে, সেই পর্যন্ত বাটি গিয়ে থেমে যায়। তুলা রাশির সেই লোকটিরও বাটির সঙ্গে যেতে হয়। কেননা তুলারাশির লোকটি ইচ্ছা করলেই বাটি থেকে হাত তুলতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, যে লোকটি এই জিনিস চুরি করেছে তার পায়ের কাছে গিয়ে বাটি থেমে যায় এবং তাকে চোর বলে সনাক্ত করা হয়। গ্রাম বাংলায় হারানো জিনিস বা চুরি যাওয়া জিনিস ফিরে পেতে এই ধরনের একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা যায়। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই ভাবেই তারা তাদের হারানো বা চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাবে। গ্রাম বাংলায় আজও এই পদ্ধতি চালু আছে। এই হলো বাটি চালান।

১৯. চটা চালান

হারানো জিনিস ফিরে পেতে বা চোর ধরতে আরেকটি অভিনব কৌশল হলো চটা চালান। প্রথমে ৭-৮ ফুট লম্বা দুটো বাঁশের চটা নেওয়া হয়। চটা দুটো অন্তত দেড় ইঞ্চি পরিমাণ চওড়া থাকে। চটা দু’টির একপ্রান্ত একজনের দুই হাতে বেঁধে দেওয়া হয়। আবার চটা দু’টির দুই প্রান্ত দুইজনে ধরে রাখার প্রচলনও আছে।

প্রথম পদ্ধতিতে গণক চটা দুটোকে মন্ত্রপুত করায় চলতে থাকে। চটা যেদিকে যাবে, লোকটিও সে দিকে যেতে বাধ্য। সারা পাড়া মহল্লায় ঘুরে বেড়ায়। চটা মাঝে মাঝে বাড়ি খেয়ে প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টি করে। হঠাৎ দেখা যায় কোনো এক লোকের গলা ঐ চটায় চেপে ধরেছে। সে চোর বলে গণ্য হয়।

দ্বিতীয় পদ্ধতিতে চটায় মন্ত্রপুত করার সঙ্গে সঙ্গে চটা দৌড় আরম্ভ করে। চটা বহন কারী দুজনও চটার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে থাকে। এমন এক সময় দেখা যায় ঐ চটা কোনো একজনকে গোপের মতো আটকিয়ে ফেলে এবং তাকেই চোর বলে সনাক্ত করা হয়। এইভাবে চটা চালানোর মাধ্যমে চোর ধরার রেওয়াজ বা পদ্ধতি গ্রাম বাংলায় বহুল প্রচলন আছে।

২০. আয়না তপ্পন

আয়না তপ্পন চোর ধরার আরেক পদ্ধতি। গণকের হাতে স্বচ্ছ একখানা কাচ বা আয়না থাকে, তার উপর তেল ঢেলে বিড়বিড়ি করে তার ভাষায় যন্ত্র পাঠ করে যায়। কিছু সময় পরে গণক চোরের চেহারা কেমন, তার মুখে দাড়ি আছে কিনা, গায়ে রং কি, লম্বা কি বেটে, মাথায় কেমন ধরনের চুল, তার গায়ে কি পরিধান আছে ইত্যাদি বলতে থাকে। তখন গ্রামের মাতব্বররা মন্তব্য করেন কে হতে পারে। এসব পদ্ধতিতে কোনো কোনো সময় মতভেদ দেখা দেয়, সৃষ্টি হয় রেষারেষি। তবুও বিশ্বাসী জনগণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যাচ্ছে। আরেক পদ্ধতিতে গণক একখানা স্বচ্ছ আয়না নিয়ে বসে এবং আয়নার উপর সরিষার তেল ঢেলে দেয়। অবশ্য এর আগে সন্দেহভাজন কয়েজনের নাম লিখে গণকের হাতে দেওয়া হয়। গণক মন্ত্র উচ্চারণ করেন এবং লিখিত নামের মধ্যে যেকোনো একজন চোরের অবয়ব ভেসে ওঠে। এভাবে গণক আয়না তপ্পনের মাধ্যমে চোর নির্ণয় করে থাকে।

২১. স্বপ্ন

স্বপ্ন জিনিসটা কি এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করা দূরূহ ব্যাপার। তবে অচেতন অবস্থায় মনেন্দ্রিয়ার যে শিল্পকর্ম তাই স্বপ্ন বলে মোটামুটি একটা ধারণা করা যেতে পারে। স্বপ্ন না দেখে কে? সবাই স্বপ্ন দেখে। শরীর অসুস্থ অবস্থায় মানুষ অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখে। আবার কারো কারো কাছে ভবিষ্যতের ইশারা স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় কিংবা মানুষ যা কল্পনা করে তাও স্বপ্নে দেখে। লোকাচারেও স্বপ্ন বেশ জায়গা করে নিয়েছে। স্বপ্নে সাধারণত আগুন, মৃত ব্যক্তি, হিংস্র পশুর আক্রমণ, রক্ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা গেলে বিপদের পূর্বাভাস বলে তারা সতর্ক হয়ে যায়। আবার স্বপ্নে ফকির, দরবেশ, দেবালয়, মসজিদ, ফুল দেখলে শুভ লক্ষণ বলে সাধারণ মানুষ আশায় বুক বাঁধে

২২. বার নিয়ে লোকাচার

সাত দিনের মধ্যে শনি ও মঙ্গলবার শুভপ্রদ নয় বলে অনেকের বিশ্বাস। তারা শনিবারটিকে খুব সতর্ক হয়ে অতিবাহিত করে। বিবাহ, ঘর নির্মাণ, বীজবোনা বা কোনো ধরনের শুভ কাজ শনিবারে সম্পাদন করে না। তারা অশুভকে শনি বলে জানে। তবে বুধবারকে ভালো বলে মেনে নিয়েছে। মঙ্গলজনক কোনো কাজ করতে হলে ঐ বুধবারটিকে বেছে নেয়। বার সংক্রান্ত সুবিধাদি বিবাহ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বর কনের অভিভাবকগণ কোনোক্রমেই শনিবারে বিয়ে সম্পাদন করেন না।

২৩. আহ্নিক কৃত্য

পল্লিবাসীরা রাত দিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা এই তিনটি সময়ে বিশেষ বিশেষ কৃত্য পালন করে থাকে। প্রত্যেকে যে যার ইষ্ট মন্ত্র জপ করে গাত্রোত্থান করে। ফজরের আজানের মাধ্যমে দিবসের সূচনা ঘটে। হিন্দু বাড়িগুলোতে বৈষ্ণবরা কৃষ্ণ নামের টহল দিতে থাকে। ঘুম থেকে উঠে অনেকে সূর্যকে প্রণাম জানায়। বাড়ির আশে পাশে কুলবধূরা গোবর ছড়া দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। পরিষ্কারজনিত কাজগুলোকে তারা বাসি কাজ বলে থাকে। ভরা দুপুরের মুহূর্তটা সবাই সতর্ক হয়ে কাটায়। এই ক্ষণে অনেক অপদেবতা চলাফেরা করে বলে অনেকের বিশ্বাস। অসাবধান হলে সেসব অশরীরী অপদেবতাদের কোপদৃষ্টি পড়তে পারে বলে তাদের ধারণা। নারীদের ক্ষেত্রে এই বাধা নিষেধ বেশি প্রযোজ্য। তেমন একজন নারী রেণু রাণী (৪২) যা বললেন——লোহা হলো ভূত-পেত্নীর ভাশুর। লোহা কাছে থাকলে ওরা ধারে কাছে আসতি পারে না। দুফরে ও সোন্দিয়ায় একা একা চলতি গেলি লোহার জিনিস রাখতি হয়। শড়া আর হিজল গাছতলা দিয়া হাঁটলি আর রেহাই নাই। তাছাড়া আমরা কাপড়ের আঁচলে গিড়িয়া দিয়া রাহি। এতে অপদোউত আসতি পারে না।’

মাগরিবের আজানের আহ্বানে সন্ধ্যা নেমে আসে। সন্ধ্যায় ধূপ-দীপ জ্বেলে তুলসী তলায় প্রণাম করতে আগের মতো আর দেখা যায় না। সন্ধ্যায় পিতা-মাতা ও গুরুজনদের প্রণাম করার রীতি একেবারে মুছে যায়নি। তবে উলুধ্বনি আগের মতো কানে ভেসে আসে। উপাসনালয়ে ও পারিবারিক আসনে সন্ধ্যাকৃত্যে আগের থেকে অনেকটা ভাটি পড়ে গেছে। ধর্মীয় কাজ ভিন্ন অন্য যেকোনো কাজ সন্ধ্যায় নিষিদ্ধ। এই গোধূলি লগ্নে অনেককে সন্ধ্যা তারাকেও প্রণাম করতে দেখা যায়। তিন তিথি এক হলে তাকে বলে এ্যস্পর্শ। এ্যস্পর্শের দিনে আজও প্রাচীনেরা সন্ধ্যার আগে খাওয়া শেষ করে থাকেন।

২৪. যাত্রা নিরূপণ

লোকজন বাড়ি থেকে কোথাও যাত্রাকালে এখনও বেশ কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলে। ঘর থেকে বের হবার সময় সাধারণত তারা ডান পা আগে চালনা করেন। তারপর যে নাক দিয়ে শ্বাস প্রবাহিত হয সেই পদ আগে বাড়ায়। বাম পদে ঘা দিয়েও অনেকে যাত্রা করেন। যাত্রার সময় মস্তকে আঘাত লাগলে তারা যাত্রা বিরতি করে। যাত্রার সময় সামনে বিড়াল বাধলে তাতেও যাত্রা বিরতি হয়। মায়েরা আজও সন্তানের পিছু পিছু কিছুদূর হেঁটে গিয়ে সন্তানের যাত্রা শুভ করে দিয়ে আসে। খনার বচনের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রামের লোকজন আজও দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছে। যেমন-

আগে হতে পিছে ভালো
যদি ডাকে মায়
ভরা হতে শূন্য ভালো
যদি ভরতে যায়।

তাই দেখা যায় সন্তানের যাত্রা পথে বিনা প্রয়োজনে মা পিছন থেকে ডাক পাড়ে। বলে ঠিকমতো চলাফেরা করিস। তারপর যাত্রাকালে সামনে শূন্য কলস দেখলে যাত্রা শুভ হয় না। যদি কলস ভরতে যাচ্ছে এমনতর দেখা যায় তাহলে যাত্রা ভালো। যাত্রাকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দৃষ্ট হলে যাত্রা শুভ বলে তারা বিশ্বাস করে। কারণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে মহাযজ্ঞ বলা হয়। সামনে নাপিত বাধলে তার গা ঘেষে যাওয়া হয়। এতে যাত্রা শুভ হয় বলে মানুষের বিশ্বাস।

২৫. গঙ্গাপূজা বা নদীর ঘাটের ব্রত

ব্রত, পার্বণ, লোকাচার এই সমস্ত লোকসংস্কৃতি বস্তুত ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর ভর করে গড়ে উঠেছে। যেমন বরফে ঢাকা সাইবেরিয়ার লোকসংস্কৃতিতে যে আদর্শ ফুটে উঠেছে তার বিপরীতধর্মী আদর্শ দেখতে পাওয়া যাবে সাহারা মরুভূমির কিনার ঘেঁষা লোকজ উপাদানে। আবার নদী মাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশের জনজীবনে লোকগাথার তাৎপর্য আরেক রকমের। জলজনিত দুর্গতি থেকে পরিত্রাণের জন্য-এ আঞ্চলে একটি ব্রত পালন করতে দেখা যায়। তাহলো গঙ্গাপূজা বা নদীর ঘাটের ব্রত। বর্ষার আগমনে বালিকা-বধূরা তা পালন করে থাকে। দিন তারিখ সময় এতে প্রয়োজন হয় না। যত পার্বণ, ব্রত, লোকাচার আছে তার বেশির ভাগই নারী ও কিশোরীরা পালন করে থাকে। আবহমান লোকজসংস্কৃতি ধরে রাখতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গঙ্গাপূজার উপাচারে বাগাড়ম্বরতা নেই। গঙ্গা শিবঠাকুরের পত্নী, শিবঠাকুর অল্পতে তুষ্ট। তাই তার এক নাম অশুতোষ। শিব ঠাকুরের পত্নী হিসেবে অল্পে-স্বল্পে তুষ্ট থাকার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যেও আছে বলে ভক্তদের বিশ্বাস। গঙ্গাপূজার প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র পান-সুপারি ও সিঁদুর, ধূপদীপ। নারীরা স্নান সমাপন করে আবক্ষ জলে দণ্ডায়মান হয়ে ওইসব উপাচার ভক্তিসহকারে জলে নিবেদন করে। কিনারে জলতে থাকে ধূপদীপ। তারা গঙ্গাস্তব পাঠ করে কূলে এসে উলুধ্বনি দিয়ে এই ব্রত শেষ করে। বিষয় সম্পত্তি রক্ষার উদ্দেশ্য ছাড়াও অন্য কারণও আছে। যেমন-ছোট শিশুরা সাঁতার জানে না, তারা যেন জলে তলিয়ে না যায় তারও নিবেদন আছে এই ব্রতে। এমন কিছু নারী আছে যারা জলে নামা মাত্রই বুদবুদ করে কী যেন তাদের দিকে ধেয়ে আসে। ভয়ে তারা জলে নামতে পারে না। কূলে বসে ঘটিতে জল ভরে স্নান করে। শুধু নারী কেন অনেক পুরুষ আছে যারা একা একা জলে নামতে ভয় পায়। তাই এইসব জলভীতি ও দুর্ঘটনা না ঘটে এই কারণে গঙ্গাপূজা বা নদীর ঘাটের ব্রত পালন করা হয়।’

২৬. ক্ষেতে কচু ও মানুষের প্রতিকৃতি

ক্ষেতে ফলবে ফসল কিন্তু সেখানে কচু ঝুলানো ও মানুষের প্রতিকৃতি দেখে কার না কৌতূহল জাগে। একজন কৃষক নটবর পাণ্ডে (৬৮) তিনি তা এভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেন—’কচু যোগে দেশে একটি ভালো খাবার। মানকচুকে তরকারির রাজা বলা হয়। আবার হেই কচু গালি হিসেবেও ব্যবয়ার অয়। গায়ের রক্ত জল কইরা মোরা ক্ষেতে ফসল ফলাই। কিছু লোক আছে বুদ্ধি শুদ্ধি মোডেই নাই। ক্ষেতের ফসল মারাইগা পথ বানায়। দেহাদেহি বেয়াকরা ঐ পথে হাড়ে। এসব পথের মাথায় মোরা কচু ঝুলাইয়া রাখি। এ দ্বারা পথিকদেরকে ঐ পথে হাড়া মানা করা বুঝায়। যদি কেউ হাড়ে তবে কচু গালড্যা তার উপর পরবে। এই ব্যবস্থা করলে দেখা যায় আর কোনো পথিক ওখান দিয়া হাড়ে না।’ অন্যের জমিতে চাষ করে এমন একজন বর্গা চাষি মজিবর মোল্যা জমিতে খড় দ্বারা বানানো মানুষের প্রতিকৃতি রাখার কারণ বললেন,–’ঝড়বাদলতো ফসলের ক্ষতি করেই। জীব-জন্তুরাও ফসলের ক্ষতি কম করে না। ইন্দুর ফসলের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। ফসলেত্তিয়া ইন্দুর খেদানির জন্যি খ্যাড় দিয়া মানুষ বানাইয়্যা ইন্দুরের গানার ধারে রাহা অয়। গলায় দিতে অয় শামুকির মালা। বাতাসে মালা দোলবে আর মালায় ঝম ঝম শব্দ অবে। ইন্দুর ভাববে এই মানুষটি আমারে ধরতি আসছে। সে ভয়ে আবার গানায় ঢোকপে। এতে আমরা উপগার পাই। এছাড়াও জমিতে ইন্দুরির গানার কাছে গাছের ডাল পুতিয়া রাহা-অয়। পেঁচা ও টিটিপক্ষ নামের এই ফায়ি দুড্যা ইন্দুর খায়। এদের বসার জন্যি গাছের ডাল পুঁতিয়া রাহা-অয়। তারা ঐ ডালে বসে ইন্দুর ধইরা খায়।’

তথ্যসহায়ক

১. বিপুল বিশ্বাস, গ্রাম : রাজিন্দ্রার পাড়া, কোটালীপাড়া।

২. জাহাঙ্গীর আলম, খান্দার পাড়, উপজেলা : মুকসুদপুর।

৩. বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, গ্রাম : ইন্দুহাটি, উপজেলা : মুকসুদপুর।

৪ . গণপতি বিশ্বাস, বয়স-৬৯. পেশা : শিক্ষক, উপজেলা : কাশিয়ানী।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন