লোকসাহিত্য (Folk Literature)

ক. লোকগল্প/কাহিনি/রূপকথা/উপকথা

দুই চতুরের চাতুরি

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় বনগ্রামে গেন্দু ফকির নামে একজন সুচতুর ব্যক্তি ছিলেন। পদকার হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল অনেক। বিচক্ষণতায় তিনি যে একেবারে পিছিয়ে ছিলেন একথা সত্য নয়। একটি দু’টি নয় এরকম বহু নিদর্শনই রেখে গেছেন তার ক্রিয়া কর্মে। গ্রাম বলি কেন সমগ্র এলাকাবাসী সেই গেন্দু ফকিরকে নিয়ে আজও গল্প করে থাকে। অন্যদিকে নারিকেলবাড়ি গ্রামের আরেকজন অতীব চতুর ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব নাম তার বলাকাওরা। উদ্ভট কর্মে তার তুলনা মেলা ভার। এমন এমন কাণ্ড ঘটায়ে গেছেন যা কিংবদন্তিতে রূপ নিয়েছে। তার উপরে কেউ মাথা তুলে দাঁড়াবে এমন যোগ্যতা তৎকালে কারও ছিল না। ঐ এলাকার জনগণও বলাকাওরাকে নিয়ে ঢের মাতামাতি করতো।

একদা বৌলতলী হাটে বসে উভয় অঞ্চলবাসীর মধ্যে গেন্দু ফকির ও বলাকাওরাকে নিয়ে চাটাম ছোড়াছড়ি হচ্ছে। বনগ্রামবাসী বলছে, আরে গেন্দু ফকির বাপের বেটা বটে। কোনো যোগ্যতার মাপ কাঠিতে তিনি খাটো নয়। নারিকেলবাড়ি গ্রামবাসী বলছে, ধূ…র বলাকাওরার কাছে গেন্দু ফকির কিছুই না। সারা বিকেলে চলল উভয় পক্ষের মধ্যে বামহড়া। এ ঘটনা কান বদলিয়ে পৌঁছে গেলো আসল দু’জনার কাছে। গেন্দু ফকির ভাবল এর একটা বিহিত করতে হয়। এলাকাবাসীর সম্মান রক্ষার্থে বলাকাওরাকে ভালো একটা ঠক দেওয়া দরকার। ওদিকে বলাকাওরারও ঐ একই ভাবনা। বলাকাওরা ভাবছে গেন্দু বেটাকে এমন ঠক দেব যাতে আমার এলাকাবাসীর বড় গলা বজায় থাকে। তিনি ভাবলেন ব্যবসার মাধ্যমে গেন্দু ফকিরকে ঠকায়ে আসব। তাই তিনি বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণ দেশ হতে ভালো ভালো পানিকচু কিনে আনলেন। নৌকায় সেগুলো সাজিয়ে যাত্রা করলেন গেন্দু ফকিরের গ্রামের দিকে। ব্যবসায় লাভ লোকসান যা হয় হোক আসল কথা গেন্দু ফকিরকে ঠকাতে হবে। অমন সুন্দর কচু দেখে বাড়ির মহিলারা বেপারীকে ডেকে ডেকে ঘাটে ভিড়াচ্ছে আর কচু কিনছে। বিশেষ করে গ্রাম্য নারীরা সবজির উপর নজর একটু বেশি দেয়। এটি একটি সুস্বাদু তরকারি। আবার কুৎসিৎ গালি হিসেবে কচু শব্দ ঢের প্রচলিত আছে। সব বাড়ির মহিলাদের নিকট কচু বিক্রি করে মনের আনন্দে তাইরে নাইরে গান গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। ইত্যবসরে গেন্দু ফকির নিত্যদিনের মতো কাজকর্ম সেরে নিজগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কিছুদূর যেতে না যেতেই বলাকাওরার সাথে দেখা। বললেন, ভাই কোথায় কি জন্য গিয়েছিলেন?

বলাকাওরা বললেন, ভাই গিয়েছিলাম কচুর বাণিজ্য করতে। বিভিন্ন গ্রামে বেশ কিছু কচু বিক্রি করেছি কিন্তু আপনার গ্রামে এমন কোনো মহিলা নেই যাদের কচু দেইনি। গেন্দু ফকির ক্ষোভে দুঃখে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে লাগলেন। এত বড় সাহস! আমার গ্রামের সব মহিলাদের কচু দিয়ে এসেছে। যাক ভালোই হয়েছে। বিচক্ষণতা দিয়ে আমি এর প্রতিশোধ তুলে আনবই।

পরিকল্পনা করতে লাগলেন কীভাবে এর দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া যায়। পেয়েও গেলেন সুন্দর কৌশল। গেন্দু ফকির বিভিন্ন এলাকা থেকে ভালো ভালো কাঁচা সুপারী সংগ্রহ করলেন। ভাবলেন বলাকাওরা আমার নাম শুনেছ, কাণ্ড দেখনি। এবার দেখতে পাবে গেন্দুর কেমন উল্টো কৌশল। গেন্দু ফকির ঝুড়িতে সুপারী নিয়ে যাত্রা করলেন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলেন বলাকাওরার গ্রাম নারিকেলবাড়িতে। এ অঞ্চলে ১০টি সুপারীকে ১ ঘা বলা হয়। এত সুন্দর সুপারী দেখে গ্রামের নারীরা গেন্দু ফকিরকে ঘিরে ধরলেন। কেউ বললেন ব্যাপারী ভাই আমাকে এক ঘা দেন। কেউ বললেন আমারে দু’ঘা দেন আবার কেউ বললেন আমারে চার-পাঁচ ঘা দেন। এভাবে গেন্দু ফকির যার যার চাহিদা মতো গুণে গুণে ঘা দিয়ে বাড়ি ফিরছেন। এমন সময় পথে দেখা বলাকাওরার সাথে। কাওরা মশাই বললেন, ফকির ভাই কোথায় গিয়েছিলেন। উত্তরে গেন্দু ফকির বললেন, ভাই গিয়েছিলাম সুপারীর বাণিজ্য করতে। কি আর বলব আপনার গ্রামের এমন কোনো মহিলা নেই যাকে দুই-এক ঘা দিইনি প্রত্যেকের চাহিদা মতো ঘা দিয়ে বাড়ি ফিরছি। বলাকাওরা বুঝলেন এ যে কচুর প্রতিশোধ। চতুরেরও চতুর থাকে তাই প্রমাণ করে গেলেন গেন্দু ফকির

চরণ সেবা

বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা জানাতে চরণে প্রণতি করা বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি। এই চরণ সেবাকে কেন্দ্র করে কখনও কখনও সংস্কার ডিঙিয়ে কুসংস্কারেও রূপ নিতে দেখা গেছে। নিম্নের লোক কাহিনিতে তার নিদর্শন ফুটে উঠেছে।

অনেক দিন আগের কথা। পূর্ব কোটালীপাড়ায় এই চরণ সেবা নিয়ে ঘটেছিল একটি মজার ঘটনা। তা আজ কিংবদন্তিতে রূপ নিয়েছে। এক গৃহস্বামী পুত্রধনকে বিবাহ দিয়ে ঘরে তুললেন নব পুত্রবধূ। তাও আবার বাল্য বিবাহ। ছেলের বয়স দশ আর মেয়ের বয়স আট। তখনকার দিনে পাত্রীর বয়স ষোলো বছর অতিক্রম করলে মা- বাপের ঘুম হারাম হয়ে যেত। ঊনিশ-কুড়ি বছর হলেই মেয়েকে বলা হতো আইবুড়ি। সংগত কারণে সেসময়ে বাল্য বিবাহ বেশি ঘটতো। যেই মেয়েটি ঐ গৃহস্বামীর গৃহে বাল্য বিবাহ বরণ করে প্রবেশ করল তখনই তার শুরু হলো গতর কাঁপা। কখন কি করবে, কাকে কি বলবে এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতায় দেখা দিত এক গাদা ঘাটতি। ভয় ও অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে দিন কাটিয়ে রাত আর রাত কাটিয়ে দিন অতিবাহিত করতে লাগল। কারণে অকারণে শাশুড়িও খুঁজে বেড়াতো বৌয়ের দোষ। কখনও অল্প সুরে কভুবা বেশি সুরে, আবার কখনও চাপা সুরে ঝাড়ি মারতো পুত্রবধূর উপর। গৃহকর্তা মানে বৌয়ের শ্বশুর শুয়ে আছেন কাছারি ঘরের খাটে। সময়টি সন্ধ্যে। বড় বড় করে চোখ পাকিয়েও ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শাশুড়ি পুত্রবধূকে বলল, যাও ঐ কাছারি ঘরের চাং থেকে কিছু নালতের (শুকনা পাট শাক) পাতা পেড়ে নিয়ে এসো। শাশুড়ি মাতার কথামতো পুত্রবধূ ছুটল কাছারি ঘরের দিকে। চাং থেকে কোনো কিছু পাড়তে হলে চেয়ার টেবিল বা অন্য কিছুতে না উঠে আনা সম্ভব না। নেই কোনো কিছুই, কীভাবে স্পর্শ করবে উপরের চাংটি। তাই নববধূ ভাবল শ্বশুরের খাটে উঠে কাজ সমাধা করব। যেই ভাবা সেই কাজ। শ্বশুর খাটে শুয়ে আছে তা জানে বটে কিন্তু কোন দিকে মাথা আর কোন দিকে পা তা সে নির্ণয় করতে পারল না। অতি সাবধানে উঠে নালতের পাতা নিয়ে যখন নামতে শুরু করল তখন অসাবধানতাবশত পা ফসকে শ্বশুরের মাথার উপর গিয়ে পড়ল। শ্বশুর বলল কে…রে কি হয়েছে। পুত্রবধূ দেখল পা শ্বশুরের মাথায় পড়েছে, তাই বধূটি বলল বাপরে বাঁচলাম। ভাগ্যিস আমার পা শ্বশুরের পায়ের উপর পড়েনি। পায়ের উপর পড়লে নিশ্চয়ই মহা পাপের ভাগী হতাম।

কানাঘুল্লি

কানাঘুল্লি হলো পথিককে দিকভ্রষ্ট করার একটি অশরীরীর আক্রমণ (লোককাহিনি মতে)। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় কংশুর ও করপাড়ার মধ্যে যে ফাঁকা বিলটি দেখা যায় তার নাম কামনি ডাঙা। এই কামনি ডাঙার কিনার ঘেঁষে ‘কানাঘুল্লি’ নামক একটি অশরীরী প্রেতাত্মা বস করতো (এখনও তা আছে বলে অনেকের ধারণা)। যদি কোনো পথিক সন্ধ্যার পর ঐ স্থানটির কিনার ঘেঁষে যাতায়াত করে তার কপালে দুর্গতি নেমে আসত। দুর্গতিটি এমন—যাকে কানাঘুল্লিতে ধরবে সে শুধু হাঁটতে থাকবে। পথিকটি দেখতে পাবে ঐ তো আমার গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আলোও মিটমিট করে জ্বলছে। তাই সে ঐ আলোকে লক্ষ্যবস্তু ধরে হাঁটতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো ঐ হাঁটা তার রাতের মধ্যে আর ফুরাবে না। এ এক মরুচারীর মরীচিকার মতো মিথ্যে ছলনা। কংত্তরের নীলকান্ত নামে এক সংসারী লোক ঐ কামনি ডাঙার কানাঘুল্লি নিয়ে প্রায়ই তামাশা করতো। যদি কেউ সেই কানাঘুল্লির খপ্পরে পড়তো তাকে নিয়ে শুরু করতো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। এতে কানাঘুল্লির খুব রাগ হলো। ভাবল সব শালারে আমি সোজা করি আর তুই আমার সাথে তামাশা শুরু করছিস? দেখাচ্ছি তোর বাঁদরামি। এদিকে নীলকান্ত এক রাতে স্বপ্ন দেখল যে তাকে সত্যি কানাঘুল্লিতে ধরে বসেছে। কি যে কষ্ট তা আর বলবার না। তাই নীলকান্তের মন খানিকটা দুর্বল হলো। না জানি ঐ রিপুর পাল্লায় কবে পড়ে বসি। তবে কোনো দিন একা একা ঐ কামনি ডাঙার কাছে যাব না। সন্ধ্যা থাক দূরের কথা। দিনেও না। এদিকে কানাঘুল্লি তো প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে নীলকান্ত শালাকে ফাঁদে ফেলবই। শালা কানাঘুল্লির নাম শুনেছিস ঘুল্লির পাল্লায় এখনও পড়িসনি। বুদ্ধি জোগাতে লাগল নীলকান্তকে বাগে আনতে। বুদ্ধি পেয়ে গেলো। নীলকান্তের আশৈশব বন্ধু নাম তার গুরুপদ। এমনই তারা জোড়ের–ভাই লক্ষণ গুরুপদের জ্বর হলে নীলকান্তেরও জ্বর হয়। আবার নীলকান্তের কাশি হলে গুরুপদ’রও কাশি হয়। দু’জনের একসাথে ক্ষুধা লাগে আবার দু’জনে একই সময় ঘুমায়, একই সময় গাত্রোত্থান করে। যে দিকে যায় দু’জনে জোড় বেঁধে যায়। কানাঘুল্লি ভাবল আমি গুরুপদের বেশ ধারণ করে ওকে নিয়ে আসব আমার মহল্লায়। তারপর শুরু করব ওকে কলুর বলদের মতো ঘুরান। একদিন বিকাল বেলায় কানাঘুল্লি গুরুপদ’র বেশ ধারণ করে ছুটে এলে নীলকান্তর কাছে। তারপর বলল, চল বন্ধু আমরা একটু বিকেলে ভ্রমণ করে আসি। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা শুরু। সূর্য প্রায় পাটে বসেছে। ভ্রমণ শেষে তারা ছুটল বাড়ির দিকে। সন্ধ্যে হাজির। ঐ কামনি ডাঙা বিলের কাছে ফুস করে একটা শব্দ হলো। নীলকান্ত পিছন দিকে ফিরে দেখে বন্ধু গুরুপদ নেই। কি হলো বন্ধু গেলো কোথায়? ও গুরুপদ বন্ধু ও গুরুপদ বন্ধু বলে কয়েকবার ডাক পাড়ল। বন্ধুর সাড়া আর মেলল না। বুঝে নিল ও বন্ধু নয়, শালা কানাঘুল্লি। আমাকে পেয়ে বসেছে। তাই ভয়ে ভয়ে নীলকান্ত দৌড়াতে লাগল বাড়ির দিকে। দৌড় আর দৌড়। সারারাত চলল দৌড়ের পালা তবুও বাড়ির নাগাল পেল না বন্ধু নীলকান্ত।

নন্দ কবিরাজ

অত্র এলাকায় যত গল্প বা লোককাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারমধ্যে নন্দ কবিরাজ ও ভূতকে নিয়ে গল্প সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আমরা ছোটবেলায় সে গল্প শুনেছি আজকের ছোটরাও প্রাণভরে উপভোগ করে থাকে ঐ নন্দ কবিরাজের সেই গল্প। নন্দ কবিরাজ ছিলেন ভূতদের গুরু। চাচর ভট্ট, বাণ ভট্ট ও চিকুর ভট্ট এরা ভূতদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত। সাধারণ ভূত থাক দূরের কথা ঐ সকল সম্ভ্রান্ত ভূতেরাও নন্দ কবিরাজকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে বেড়াত। তার মতো প্রভাবশালী কবিরাজ আজ অব্দি কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। হাজারো রকমের ভূতুড়ে মন্ত্র তার মুখস্ত ছিল। কখন কোন মন্ত্র যপ করলে ভূতরা বশে থাকে তা ছিল তার নখদর্পণে। শুধু তাকে ভূতরা বয়ে নিয়েই বেড়াত না ভূতদের দিয়ে অনেক কাজও করাতেন তিনি। পুকুর খনন, জল সেচ, ফসল বহন—এসব কাজ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। লোকমুখে শোনা যায় তিনি ভূতদের বশে আনার পূর্বে মন্ত্র পাঠ করে হাতে মাটি তুলে আঁচাল ভাঙায়ে নিতেন। এর কারণ হলো আঁচাল ভাঙানোর পরে ভূতদের কোনো সাধ্য থাকতো না নন্দ কবিরাজকে কিছু বলার বা করার। যদি কোনো কবিরাজ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে আসত তিনি তাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্ৰতন্ত্ৰ শিখিয়ে দিতেন। এবং বলতেন যদি তোমরা ভূতদের বিকট কাণ্ড কারখানায় ভয় পাও তবে এই ভূতুড়ে মন্ত্র পরিত্যাগ করে চলবে। তা না হলে সমূহ বিপদ ঘটবে। মন্ত্র-তন্ত্র মন থেকে ইচ্ছে করে দূর করার জিনিস নয় তাই তিনি উপদেশ দিতেন তোমাকে যে মন্ত্র- তন্ত্র শিখালাম তা কালো রঙের গরুর কানে কানে বলে দিবে, তাহলে ঐ মন্ত্রের আর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। ভূতদের এই মহাগুরু একদিন ভুলক্রমে আঁচাল ভাঙাতে ভুল করলেন। ঐ দিন তিনি চাচর ভট্ট ও চিকুর ভট্ট দুই ভূতের কাঁধে চড়ে বসলেন। হঠাৎ নন্দ কবিরাজের গা ছমছম করতে লাগল। তিনি বললেন তোরা আমাকে একটু মাটিতে নামিয়ে দে। ভূতদ্বয় বলল গুরু আর না। সারাজীবন তোমাকে বহন করে বেড়াচ্ছি। আজ তুমি আঁচাল ভাঙাওনি। আজ তোমার গুরুগীরি দেখাব। এই বলে ভূতদ্বয় নন্দ কবিরাজের দুই ঠ্যাং ধরে চিরে ফেলল।

খ. কিংবদন্তি

ফেলারাম পাগলের দোয়া

সদর উপজেলায় কাটরবাড়ি গ্রামে বহুপূর্বে ফেলারাম পাগল নামে একজন সাধক পুরুষ আস্তানা গড়ে তোলেন। এই পাগলকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। তন্মধ্যে গোপালগঞ্জ শহরে থানা সংলগ্ন পূর্ব পার্শ্বে ফেলারাম পাগলের দোয়া নামের কিংবদন্তি সর্বাধিক আলোচিত। এ বিষয়ে যে জনশ্রুতি আছে তা এরকম—ফেলারাম পাগল একদা থানার পূর্ব পার্শ্বে পুকুর পাড়ে বসে ছিলেন। এমন সময় দারোগার স্ত্রী পুকুরে গিয়েছিলেন। স্নান করতে। পাগল সহসা খিলখিল করে হেসে পড়লেন। দারোগার স্ত্রী মনে মনে ভাবলেন আমাকে দেখে ওই পাগলটি হেসেছে। স্ত্রী রাগান্বিত হয়ে দারোগাকে বললেন পুকুর পাড়ের ওই পাগল আমাকে দেখে খিলখিল করে হেসেছে। শয়তানটির উপযুক্ত বিচার না করলে আজ থেকে তোমার সংসার আমি করব না। দারোগা ক্রুদ্ধ হয়ে ছড়ি নিয়ে ছুটে গেলেন পাগলটির কাছে। কোনো কিছু না বলেই বেদমভাবে পাগলকে পিটাতে শুরু করেন। ফেলারাম পাগল বললেন আমাকে তো মারলি না জায়গাটিতে দোয়া ফেললি। দেখতে দেখতে দারোগার ভাগ্যের বিড়ম্বনা দেখা দিল। পুত্র কন্যা আপনজনেরা একে একে মরতে শুরু করল। এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, যে পাগলকে তিনি পুকুর পাড়ে বসে প্রহার করেছিলেন তাঁর ক্ষমার ভিতর এ দুর্দশার মুক্তি আছে। তাই তিনি ওই পাগলকে খুঁজে পেতে পথে পথে ঘুরতে লাগলেন। বহুদিন পর সত্যিই সেই পাগলের সন্ধান পেলেন। করজোড়ে তিনি পাগলের কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন আপনি কেন হেসেছিলেন তার আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। উত্তরে পাগল বলেছিলেন-আমি পুকুর পাড় থেকে সেদিন দেখতে ছিলাম বৃন্দাবনের রাসলীলা। হঠাৎ রাসের দড়ি ছিড়ে গেলে সখিরা একের পর এক গড়িয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে আমি আর হাসি সম্বরণ করতে পারিনি। আর তুমি ভেবেছিলে আমি তোমার স্ত্রীকে দেখে হেসেছি। একথা শুনে দারোগা পাগলের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। পাগল বললেন, ক্ষমা ঠিক করলাম তবে ওই জায়গায় আর কোনো দিন ভরাট হবে না। কোনো মতে সেই দোয়াটি আজও ভরাট হয়নি। এটি ফেলারাম পাগলের দোয়া বলে পরিচিত। ওই গোপালগঞ্জ শহরের কোনো মিষ্টিদ্রব্য কাটরবাড়ি ফেলারাম পাগলের আশ্রমে নিয়ে গেলে পাগল তা গ্রহণ করেন না। অনেকে পরীক্ষা স্বরূপ এ কাজটি করতে গিয়ে ভীষণভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। যে কেউ গোপালগঞ্জ শহর থেকে কিছু কিনে আশ্রমের দিকে রওনা হলে এ সত্যের প্রমাণ মিলবে বলে এলাকাবাসী বলে থাকেন।

তালতলা গ্রামে বারের হিজল গাছ

তালতলা নিবাসী নেহাল বিশ্বাসকে প্রায় দুইশ বছর পূর্বে বনবিবি হিন্দুমতে বনদেবী স্বপ্নাদেশ করেন যে, নেহাল আমি বাদা থেকে আসছি। এই হিজল গাছের চারাটি নে, হিজল গাছ আমি বড় ভালোবাসি। আমার এই গাছটি বড় ভালো। তুই তোর যেকোনো একটি জমিতে রোপণ করিস। আমি প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার আসব। ঐ দিন গাছটিকে ফুল দিয়ে সাজাবি, আমি আসব। কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ঐ দিন গছের কাছে মানত করলে, তার বিপদ কেটে যাবে। মানতের ফল পাবে। বুড়োর ঘুম ভেঙ্গে যায়, আর ঘুমোতে যেতে পারেনি। সকালবেলা মাঠের দিকে কাজ করতে যাচ্ছে। হঠাৎ পথিমধ্যে দেখতে পায় একটা তরতাজা হিজল গাছের চারা। মনে পড়ে যায় রাতে বুড়োর স্বপ্নাদেশের কথা। ঐ অবস্থায় চারাটি নিয়ে রোপণ করে। আস্তে আস্তে গাছটির লাবণ্যতা আসতে থাকে। গাছটিকে রক্ষার জন্য বেষ্টনীও দিয়ে দেয় নেহাল বিশ্বাস। নেহাল বিশ্বাস বনমাতার কথামতো পরের বছর চৈত্রমাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে গাছটিকে নানারকম ফুল দিয়ে সাজায়। সেখানে ধ্যানস্থ হতে দেখা যায় নেহাল বিশ্বাসকে। গাছ বেশ বড় হয়ে ওঠে। গ্রামের ২-১ জন করে ভিড় করতে দেখা যায় গাছের কাছে। এভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ভিড় জমাতে থাকে হাজার হাজার লোক। সৃষ্টি হয় মেলার। মানত করতে থাকে গাছের কাছে, ফলও পেতে থাকে তারা। বেড়ে যায় মেলার পরিধি। আজও বয়ে চলেছে গাছপূজা ও মেলা। গাছটির বিশেষত্ব এখানেই যে, শুকনো মৌসুমে গাছের প্রতিটি শাখা ভূমির সঙ্গে প্রায় মিশে যায়। গাছের তলা বা নীচ দিয়ে মানুষের চলাফেরা দুষ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু যত বড় বর্ষা হোক না কেন গাছের কোনো একটা পাতা বা ডাল জলের মধ্যে ডুবে যায় না। এমনকি ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে যে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছে তাতে গাছের একটা ডাল বা পাতা জলে ডুবে যায়নি। আশ্চর্যের বিষয়, অনেকে ‘মনসা’ দেবীর নামে দুধ-কলা দিয়েছে তারা স্বচোখে দেখেছে সাপরূপী মনসা দেবীকে। অত্র এলাকার বাসিন্দারা মেলাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে আসছেন।

উদয়দের দিঘি

১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় কোটালীপাড়ার এবং গোপালগঞ্জের কিছু অংশ যশোর জেলার অধীন ছিল। তখন কোটালীপাড়ার স্থানীয় জমিদাররা ছাড়া নড়াইলের জমিদার মনীন্দ্রনাথ রায়ের পূর্ব পুরুষেরা কোটালীপাড়ার উত্তর এলাকার স্বত্ব লাভ করেন এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তারা কোটালীপাড়া উত্তর-পূর্ব অংশের বান্ধাবাড়িতে একটি খাজনা আদায়ী কার্যালয় স্থাপন করেন, যা বর্তমানে বান্ধাবাড়ি কোটালীপাড়ার একটি প্রাচীন মৌজা। এই মৌজা মাদারীপুর মহকুমা সৃষ্টির সময় বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং নড়াইলের জমিদারদের জমিদারি আগের মতোই বহাল থাকে। বান্ধাবাড়ির দক্ষিণ সীমান্তে এবং ভূয়ারপাড়া গ্রামের পূর্ব সীমান্তে দুশো বছর পূর্বে খনন করা হয় ‘উদয়দের দিঘি’ নামের একটি বিরাট জলাশয়। এই জলাশয়ের খননকার্য নিয়েই সেখানে নড়াইলের জমিদার ও কোটালীপাড়ার স্থানীয় জমিদার অর্থাৎ গচাপাড়ার জমিদার বিহারীলাল চৌধুরী, রাইচরণ চৌধুরী ও হরলাল চৌধুরীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৪ জনের মৃত্যু ঘটে। একজনের নাম কালিপদ। এরা ছিল নড়াইলের জমিদারদের পক্ষের লোক। বরিশাল কোর্টে যথারীতি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে ২৭ জনের জেল হয়। আন্দামানে নির্বাসিত হন বেশ ক’জন।

ভুয়ারপাড় ও বান্ধাবাড়ির সীমান্তে উদয়দের দিঘি

বান্ধাবাড়ি মৌজায় জমিদারি ক্রয় করে নড়াইলের জমিদার গচাপাড়া মৌজা ও বান্ধাবাড়ি মৌজার সীমান্তে একটি দিঘি খননের কাজ শুরু করেন। খবর পেয়ে স্থানীয় জমিদার রাইচরণের বাবা হরলাল চৌধুরী চিত্রাপাড়া, পূর্বপাড়া, গচাপাড়া, উত্তরপাড়া ও সিতাইকুণ্ড নিবাসী হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের নিয়ে (লেঠেল বাহিনী) খনন কার্যে বাধা দেন। কিন্তু নড়াইলের জমিদার বাধার প্রতিবাদে খাগবাড়ি, রাজাপুর ও জহরের কান্দির হিন্দুদের নিয়ে লাঠালাঠি শুরু করেন। যাকে আমরা যুদ্ধ বলতে পারি। চারদিন ধরে এই যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে নড়াইলের জমিদার পরাজিত হন। তাঁর পক্ষের ৪ জন লাঠিয়াল মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে দিঘির খনন কার্য প্রায় সমাপ্ত হয়। যুদ্ধের পর নড়াইলের জমিদার বরিশাল জেলা আদালতে মামলা ঠুকে দেন। তখন হরলাল চৌধুরীর ছেলে রাইচরণ পটুয়াখালীতে ওকালতি করতেন। তারাও মামলায় লড়ে যান, কিন্তু সাজা হয় তার দলের ২৭ জনের। আসামীদের বেশ কয়েকজন আন্দামানে (কালাপানি) নির্বাসিত হয়। কারও হয় যাবজ্জীবন জেল। আবার কারও কারও হয় বিভিন্ন মেয়াদী সাজা। জানা যায় এই চাঞ্চল্যকর দিঘি খনন মামলায় সিতাইকুণ্ড গ্রাম থেকে ৪ জন, পূর্বপাড়া গ্রামের (মহারাজ বাগচী ও ডেঙ্গু বাড়ৈ) ২ জন, ভূয়ারপাড়া গ্রামের ১২ জন, উত্তরপাড়া গ্রামের ২ জন এবং চিত্রাপাড়া গ্রামের ৩ জনের (আলীম উদ্দিন, বদু শেখ, পাড়ু উল্লা) বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমান লেখক উল্লেখিত আলীমউদ্দীনের ৫ম উত্তরসূরি। জানা গেছে আলীমউদ্দীনসহ অন্যান্যদের বরিশাল জেলে নির্মম নির্যাতন করা হতো। সশ্রম ছিল তাদের দণ্ডভোগ। আলীমউদ্দীনকে তেলের ঘানি টানতে হতো। তার কাঁধে ঘা হয়ে গিয়েছিল। এক সময় জেল কর্তৃপক্ষ তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় মুক্তি দিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেন। তিনি বাড়ি এসেই প্রাণ ত্যাগ করেন। মামলা চলাকালে এবং পরে ‘উদয়দের দিঘির ধারে কাছেও কোনো মানুষ ঘেঁষতো না। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধের ওই মামলাটির কথা ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশালের মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত ছিল। এখন দীঘি আছে ঠিকই, কিন্তু দিঘি খননের যুদ্ধের কথা অনেকেই জানে না।

পোনা গ্রামে দেওয়ানের আবির্ভাব

গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার অন্তর্গত পোনা গ্রামে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন দেওয়ান নামে এই মহান লোকটি। কোথায় তার জন্ম, কার ছেলে, বাড়ি কোথায় কেউ জানে না। জীবনে কোনোদিন মাথার চুল, দাড়ি, হাতের ও পায়ের নখ পর্যন্ত কাটেনি। হাতের আঙ্গুলের নখ বেড়ে বেড়ে কোড়া হয়ে কব্জি পর্যন্ত মিশে গিয়েছিল। পায়ের অবস্থাও তাই। হঠাৎ এই লোকটি এসে বললেন, আরে ধামা দে ধামা দে নাও ডুবে গেলো। পোনা গ্রাম থেকে একটা ধামা নিয়ে হাঁটু গেড়ে ধামা দিয়ে জল ফেলত থাকেন। কিছু সময় পরে দেওয়ানজী বলে ওঠে, নে নৌকা জাগছে। মাঠের কৃষকরা এই কাণ্ড দেখে ছুটে আসে ঘটনাস্থলে এবং দাঁড়িয়ে দেখে দেওয়ানজীর কাণ্ড। হাঁটু এবং ধামার ঘর্ষণে দুটো গর্ত হয়ে গেছে। ঠিক যেন দুটো কুয়া। আজও তা দৃশ্যমান। আর ঐ কুয়ার পাশেই বসে থাকতেন দেওয়ানজী। পরে গ্রামবাসী মিলিতভাবে ঐ কুয়ার পাশে যে স্থানে দেওয়ানজী বসে থাকতেন সেখানে চালা বেঁধে ঘর করে দেয়। দেওয়ানজী সেখানেই থাকতেন। আশ্চর্যের বিষয় দেওয়ানজীর ডান হাতের মুঠির ভিতর রাখতেন এক হাত পরিমাণ লম্বা ৪ খানা বাশের কঞ্চির লাঠি। মুঠ পাকিয়ে একখানা কঞ্চি ধরে রাখতেন। মুঠির ভিতরের কঞ্চি থাকতো নীল বর্ণের, কিন্তু মুঠির বাইরের অংশটুকু শুকনো দেখাতো। যতোদিন পর্যন্ত দেওয়ানজী বেঁচে ছিলেন, ততোদিন পর্যন্ত এটা লক্ষ করা গেছে।

দেওয়ান সাহেবকে সেই গর্তের পাশেই কবরস্থ করা হয়। মাজারটি সংরক্ষিত আছে। হাঁটু এবং ধামার ঘর্ষণে যে কুয়া হয়েছিল তাও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। তাঁর মৃত্যু

দিবস উপলক্ষে এখানে তিনদিনব্যাপী মেলা বসে। মেলায় আউল, বাউল, দরবেশ ও সাধু সন্ন্যাসী এসে থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চে তিনি নিত্যধামে গমন করেন।

পাঁচকড়ি দেওয়ানের কেরামতি

কোটালীপাড়া থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে মধুরনাগর গ্রামে পাঁচকড়ি দেওয়ান নামে একজন ফকিরের সমাধি বিদ্যমান। কথিত আছে, তিনি আজ থেকে দুশো/আড়াইশো বছর আগে এই গ্রামে এক আস্তানা গাড়েন। তার পিতার নাম কালু হাজরা। যৌবনের শুরুতে তিনি গান-বাজনা করতেন। বিশেষ করে গাজীর গীত গেয়ে সুনাম অর্জন করেন। এ কারণেই পিতৃভূমি ত্যাগ করে মধুরনাগরায় চলে আসেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। কথিত আছে, তিনি নাকি কামিলিয়াত অর্জন করেন। শোনা যায়, তার কাছে কোনো সমস্যা নিয়ে মানুষ এলে তিনি আল্লাহর দোহাই দিতেন |

পাঁচকড়ি দেওয়ানের মাজারে প্রতি বছর ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। এই ওরশে তারই অনুরাগীরা বিভিন্ন মানত নিয়ে অংশগ্রহণ করে। যে গাভী দুধ দেয় না এবং যে গাছে ফল ধরে না, পাঁচকড়ি দেওয়ানের নামে মানত করা হলে সুফল পাওয়া যায়। এরকম অনেক কেরামতি তার নামে চালু রয়েছে। অনেকে বলেন, ‘তিনি নাকি অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। বর্তমানে দেওয়ানের পঞ্চম উত্তরাধিকারী দেখাশোনা করেন। তিনি

বিদ্যাধর গ্রামের পৌরাণিক বিরাট পুকুর

প্রায় দুই একর জমির উপর বুকভরা জল নিয়ে আজও টিকে আছে পুকুরটি। কে, কবে, কখন খনন করেছে তার কোনো হদিস নেই। পুকুরটি উত্তর দক্ষিণে দীঘল। ভাবতে অবাক লাগে যে পুকুরটির চারটি কোণে চারটি ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে। পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে ১১০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। উত্তর-পশ্চিম কোণে কালীমন্দির, যার বয়স ১০৫ বছর। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে আছে বটগাছ, যার বয়স ৬০ বছর এবং পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা মসজিদ। যার যার ধর্ম পালনে কোনো বাধা হয় না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বয়ে চলে এই গ্রাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে আছে বহু পূর্বের একটি শ্মশান। পুকুরে উত্তর পাড়ে একটি বাঁধানো ঘাট। অবশ্য তা এখন সামান্য মাটির নীচে। ঘাটলাটি বর্তমান ইটের তৈরি নয়। চুন-সুরকি দিয়ে সিঁড়ি করা।

জনশ্রুত যে, এই পুকুরে সোনার নাও পবনের বৈঠা ছিল। গভীর রাতে নাকি গ্রামবাসী ঝুমুর ঝুমুর তালে নৌকা বাইচের শব্দ শুনেছে। এখন আর তা নেই। একটি পাড় ভেঙে নাকি নৌকাটি চলে গেছে।

গ. লোকপুরাণ

প্রয়োজনেই অবতার পুরুষ আসেন এই ধরাধামে। প্রয়োজনীয় কর্ম শেষ করে আবার তারা চলে যান নিত্যধামে। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই বয়ে চলেছে এ নিয়ম। এসেছেন প্রভু রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য, এসেছেন প্রেরিত পুরুষ পয়গম্বর হযরত মুহম্মদ (সাঃ)। শ্রীচৈতন্য দেবের অসমাপ্ত লীলা সমাপ্ত করার জন্য নমশূদ্র কন্যার গর্ভে জন্ম নিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর শাফলীডাঙ্গা গ্রামে। সাদৃশ্য এখানেই যে, ত্রেতাযুগে প্রভু রামচন্দ্ৰ দেবী দুর্গার পূজা করার জন্য দেবীদহ হতে যে নীলোৎপল চয়ন করেছিলেন, মর্তে এসে সে ফুল কস্তুরী ফুল অর্থাৎ কচুরী ফুল নামে পরিচয় লাভ করে।

কালগুণে মহতেরা তাদের তেজ গোপন করে থাকেন। তাই বলে তো মহতের মান কমে যায় না। জহরে জহরি পেলে চিনে নেয়। তাই তো হরিচাঁদ ঠাকুর বাল্যকালে ব্রজ, নাটু, বিশ্বনাথকে নিয়ে রত্নডাঙার বিলে গরু চরাতেন। আর সবাই এই কস্তুরী ফুল দিয়ে ঠাকুরকে সাজাতেন। কোনো কোনো সময়ে ওই কস্তুরী ফুল কর্ণেতে, কখনও কটিদেশে গুজে পায়ের উপর পা রেখে এমন ভঙ্গিমায় দাঁড়াতেন যেন সেই গোকুলের কানাই। দ্বাপরের সেই শ্রীকৃষ্ণ। শাস্ত্রে প্রমাণ রাধিকা এবং শ্রীকৃষ্ণ দুই দেহ এক হয়ে এলেন গৌরাঙ্গ অবতার হয়ে। যিনি শ্রী চৈতিন্যদেব। শ্রীকৃষ্ণ একবার রাধিকাকে বলেছিলেন, রাধা, তুমি আমার লীলাসঙ্গী হয়ে লীলায় থাকলে, কিন্তু আমি তোমার ঋণ কি দিয়ে শোধ করব? উত্তরে শ্রীরাধিকা বলেছিলেন তুমি আমার ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না। তবে পারবে, যদি তুমি ঘরে ঘরে হরিনাম বিলাতে পার তাহলে তুমি আমার ঋণ শোধ করতে পারবে। তাইতো শ্রীকৃষ্ণ নদীয়ায় শচীমাতার গর্ভে জন্ম নিলেন। কিন্তু তিনিও পারেননি ঘরে ঘরে নাম বিলাতে। যে জাতি বর্ণ বৈষম্যের স্বীকার, সে জাতি নমশূদ্র জাতি। রাজ রোষাণলে তারা স্কুল কলেজে যেতে পারেনি, তাদেরকে হাটে বাজারে যেতেও নিষেধ থাকতো। পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল এদেরকে। জাতিভেদে নিপীড়িত এই জাতি বনে, জঙ্গলে, বিল অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়। তাদেরকে স্পর্শ পর্যন্ত করতো না তখনকার তথাকথিত উচ্চবর্ণ নামধারী ব্যক্তিবর্গ, রাজন্যবর্গ। সে জাতিকে হরিনাম থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল, তাদেরই ঘরে জন্ম নিলেন শ্রীচৈতন্যদেব হরিচাঁদ ঠাকুর রূপে। বাংলা ১২১৮ সনে শাফলীডাঙা গ্রামে শ্রী যশোমন্ত ঠাকুরের ঘরে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে তিনি আবির্ভূত হন। চৈত্র মাসে অমাবস্যা তিথির আগে যে ত্রয়োদশী তা মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি নামে পরিচিত। আরও আশ্চর্য বিষয় যে, এই অবতার পুরুষটি যে তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই তিথিতেই তিনি নিত্যধামে চলে যান।

প্রথমেই আরম্ভ হয় ধর্ম আন্দোলন। সৃষ্টি হয় মতুয়া সম্প্রদায়। মতুয়া শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হরি নামে যারা মাতোয়ারা। হরিচাঁদ ঠাকুর হলেন এ সম্প্রদায়ের পথ প্রদর্শক। ভক্তদের কাছে দিনটি দুটি কারণে প্রসিদ্ধ। এক. হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম তিথি ও মৃত্যু তিথি; দুই. মহাবারুণীর পুণ্য তিথি। হিন্দু পুরাণে বারুণী তিথিতে স্নান করলে পুণ্য সঞ্চিত হয় বলে উল্লেখ আছে। তাই প্রতি বছর এই পুণ্য তিথিতে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, লড়াইল, বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, বরিশাল, সাতক্ষীরা, রামপাল, কয়রা, শ্যামনগর, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, যশোর প্রভৃতি জেলা থেকে লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভক্ত আসে পুণ্যভূমি শ্রীধাম ওড়াকান্দি হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলাভূমিতে। এখানে চারটি পুকুর আছে। বিশেষ করে কামনা সাগর ও দুধ সাগরে স্নান করে মতুয়ারা পুণ্য সঞ্চয় করে।

সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা এই তিনটি স্তম্ভের উপর মতুয়াদর্শ প্রতিষ্ঠিত। জাতিভেদ বা সম্প্রদায়ভেদ মতুয়াবাদে স্বীকৃত নয়। হরিচাঁদ ঠাকুর নিম্ন শ্রেণির নিম্নস্তরের লোকদেরই বেশি করে কাছে টেনেছেন। তাদের যথার্থ সামাজিক মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাই দেখা যায় তাঁর শিষ্যদের সিংহভাগই সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোক। প্রতিটি মতুয়া দলে একজন দলপতি থাকে। তিনি মতুয়া দলটিকে পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর পিছে পিছে ছুটে চলে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী। মতুয়া ভক্তদের মুখে শুধু হরিবোল। দলপতির হাতে থাকে সোয়া হাত লম্বা একটি দণ্ড। মতুয়াদের হাতে থাকে ত্রিকোণ বিশিষ্ট লাল নিশান, জয়ডঙ্কা, কাশী ও সিঙ্গা। তালে তালে হরিবোল, হরিবোল রব করতে করতে লাল নিশান নিয়ে পায়ে হেঁটে শহর, গ্রাম, মাঠ, ঘাট পেরিয়ে ছুটে চলে সবাই ওড়াকান্দি। এদের সকলের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। আর তা হলো শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে পুণ্য তিথিতে গঙ্গাস্নানের পুণ্যফল লাভ করা।

প্রথমে তারা হরি মন্দির প্রদক্ষিণ করে। পরে কামনা সাগর ও দুধ সাগরে স্নান করে।

হরিচাঁদ ঠাকুরের যোগ্য ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর একজন দ্রষ্টা পুরুষ। মুক্তিবারিধি গুরুচাঁদ ঠাকুর নিম্ন বর্ণের যারা অস্পৃশ্য, তাদেরকে উদ্ধারের জন্য তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। আধ্যাত্মিক জগতের এই পরমগুরু ছিলেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তাঁরই উদ্যোগে মতুয়াদের সম্মিলিত প্রয়াসে ১৮৮০ সালে সাড়ম্বরে শুরু হয় মহাবারুণী তথা গঙ্গাস্নানের উৎসব I

হরিচাঁদ ঠাকুর সন্ন্যাস জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সংসারী এবং সংসার ধর্ম পালন করেই তিনি প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন। তাঁর ধর্ম সাধনের মূল হলো :

গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়
সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।

তিনি এদেশের অবহেলিত সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।

ঘ. লোকছড়া

প্রত্যেক বাড়িতে নিত্য দিনের ভোরবেলার সাজ ও কাজ হলো গোবরের ছড়া। বিশেষ করে হিন্দু বাড়িগুলোতে এই আচার আচরিতে দেখা যায়। সেই গোবর ছড়ার ছন্দময় তান না শুনলে এর মাধুর্য ভাষায় বুঝানো দুষ্কর। কোনো কোনো লোকাচার হারিয়ে গেছে, কোনো কোনো লোকাচার হারিয়ে যেতে বসেছে, আবার কোনো কোনো লোকাচার আজও আগের মতো বয়ে চলেছে। যে লোকাচার হারিয়ে যায়নি গোবর ছড়া তার মধ্যে একটি। কুলবধূরা আজও বালতি বা অন্য কোনো পাত্রে গোবর গুলিয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বাড়ির আঙিনায় ছিটায়ে দেয়। ভোরের পাখির কলরব আর ঐ ছন্দময় গোবর ছড়ার শব্দে এখনও কৃষক পরিবারগুলোর ঘুম ভাঙে। কোনো কর্কশ বা অশুভ শব্দ শুনে ঘুম না ভাঙার জন্য এই সনাতনী পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে বলে প্রাচীনেরা মন্তব্য করে থাকেন। গোবরের আরেকটি বিশেষ গুণ হলো এটি জীবাণু নাশক। গু + বর = গোবর। গু মানে মল, আর বর মানে শ্রেষ্ঠ। বলা যায় গোবর মানে শ্রেষ্ঠ মল। জীবাণু নাশক এই পরিপ্রেক্ষিতে এটির ব্যবহার ছড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মঙ্গলজনক কাজেও এর ব্যবহার দেখা যায়। ঘরের দরজায় অর্ধ চন্দ্রাকারের ন্যায় গোবরের প্রলেপ দেখতে পাওয়া যায়। এর কারণ হলো বাইরে চলাফেলার ফলে পায়ে জড়িত রোগ জীবাণু গোবর মাড়িয়ে ঘরে যাওয়ার সময় তা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তাছাড়া মরদেহ ঘর থেকে শ্মশানে নেওয়ার সময় পিছে পিছে গোবর ছড়া দেওয়া হয় যাতে মরদেহ হতে কোনো জীবাণু সংক্রমিত হতে না পারে। প্রাচীনকালে এন্টিবায়োটিক ছিল না। তাই এইভাবে মানুষ রোগ জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করত। গোবর দ্বারা ঘষি ও কুচিয়া বানিয়ে পল্লিবাসীরা জ্বালানির অভাব পূরণ করে। যাইহোক, ওই ছন্দময় গোবর ছড়ার অনুকরণে প্রাচীন পাদকেরা ছন্দময় বাক্যগুলোকে ছড়া নামকরণ করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। যেমন—

নোটন নোটন পায়রাগুলো
ঝোটন বেঁধেছে
ও পারেতে ছেলেমেয়ে
নাইতে নেমেছে।

গোবর ছড়ার তাল আর বর্ণমালার গাঁথুনির ছড়ার তাল শুনতে প্রায় এই রকমের। লোকজসংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সত্যের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও যৌক্তিক ব্যাখ্যায় তা প্রায় কাছাকাছি। একজন কুলবধূ শান্তিদেবী (৫৩), তার কাছে গোরব ছড়া সম্পর্কে এর উপকারিতা ও ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি যা বললেন-’আমি এর ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে মা-চাচিদের ছড়া দিতে দেখেছি। বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়িও বললেন ভোরে ভোরে বাড়ির আঙিনায় গোবর ছড়া দিতে। শুধু ছড়া না, গোবর দ্বারা আমরা উঠানও লেপে থাকি। ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করি। হয়তো এর ভালো গুণ আছে। তা না হলে এর এত দাম ক্যান।’

লোকসংস্কৃতিতে লোকছড়ার মর্যাদা অমলিন। বৃষ্টি নামানীর ছড়া এখনও মা-বোন ও ছোটদের মুখে শোনা যায়।

চেগারাণী ভেগারাণী
কচুখোলা হাঁটুপানি
ধান দুব্বা গুয়াপান
আকাশ থেকে বৃষ্টি আন।

গ্রামের মেয়েরা প্রচণ্ড রৌদ্র তাপের দিনে কুলোতে ধান দুব্বা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বৃষ্টি নামানোর জন্য এই ছড়াটি কাটে। শুধু তাই নয় ছড়াকাটার বিনিময়ে গেরস্ত বধূদের প্রদত্ত চাল দিয়ে বনভোজন করে। এ রকম আরেকটি ছড়া-

আউশ ধান পউশ ধান
বউয়ের মুখের দুখের গান
ধান ভেসেছে বিষ্টি জলে
ছাগল ভেড়া গাছের তলে।

ছড়া

(১)

এক-দুই শুই শুই
চুপ কর খোকা তুই।
তিন-চার খাবে মার
দুষ্টুমি নয় আর!
পাঁচ-ছয় আর নয়
শুয়ে পড় রাত হয়।
সাত-আট পেতে খাট
খোকা মোর বড় লাট
নয়-দশ বস বস
নাক ডাকে ভস ভস।

(২)

ছাদি ছাদি ত্যাজপাতা
ছাদির বিয়া কলকাতা।
ছাদি যদি জানতো
পাটি বিছায়ে কানতো।
পাটির তলে রক্ত
ছাদি বড় শক্ত।

(৩)

ও মালী?
কি লো।
কার বিয়া?
রাজকন্যার রাজপুত্তুর সাথে
তোর কি তাতে?
মোরে দিবে মালা গাথে
পূর্ণিমা রাতে।

(৪)

কর্ম দশা কর্ম দশা
বিয়ে করছি শংকর পাশা।
কিনে আনছি রিঠার মুড়ো
খাই বসে ইচার গুড়ো।
ও ভাড়ে নাই ঘি
উপুড় করলে হবে কি।

(৫)

ঝুটকুলুরে ঝুটকুলু
কাপড় ধুয়ে দে
তোর বিয়াতে নাচতে যাব
ঢোলক কিন্যা দে।
ঢোলকের মধ্যে পচা পান
দেখলো কেমন অপমান।

(৬)

পদ্ম ফোটা পুকুরে
দেখে এলাম থুকুরে
খাচ্ছে বসে হাওয়া।
মাছ নেলো ঐ কুকুরে
দেখিস না মুখ মুকুরে
করল তারে ধাওয়া।
ডাকছে বসে খুড়োতে
চুল পাকা এক বুড়োতে
বাড়ি তাহার মাওয়া।

(৭)

মা কাকড়া বলছে ডেকে
বাবা কাকড়ার কাছে
ও মিনসে কি হইছে?
কাঁপছি বসে জ্বরে।
ওষুধ নাই পাতি নাই
বদ্যি ডেকে আন
তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে
শুনবো ট্যাপার গান।

(৮)

আকাশেতে এলোমেলো
আলোগুলো জ্বেলে দিল
নাম নাকি তারা
আমার মাটির ঘরে
মাটির প্রদীপ জ্বলে
হয়ে যায় হারা।

(৯)

শিকল শিকল কদ্দূর?
বহুদ্দূর
কার বিয়া?
হাসির বিয়া
কি বাজায়ে?
চুম বাজায়ে
চুম চুমা-চুম ঢুম।

(১০)

ধানের ক্ষেতে পোকানী
সন্ধে হলে ঝিঁঝি
জোনাই মোনাই যত
প্রজাপতি ফড়িংটা
লাফায়ে পড়ে আরেকটা
ফুল পরীদের মতো।

(১১)

কচি কচি চেহারা
কচি যখন পাকবে
রাস্তার মানুষ জাগবে
পুলিশ মামা টা-টা
আন্ডার প্যান্ট ফাটা।
টিয়ে খায় দুধ ভাত
দুধ হলো কাঁচা
টিয়ে ধরে নাচা।

(১২)

ব্যাঙের পাছের ঠ্যাং
কুকুরের ঘ্যাং
দেশকে বাঁচায়
নিজে বাঁচে
তাই বলে
কুনো ব্যাঙের না ঠ্যাং।

(১৩)

ঘুম আয় ঘুম আয়
ঘা মাছির পাতা
আহার পিঠে শুয়ে আছে
নলা মাছের মাথা।
কানছি ঘুমে পড়ছে
কালা কুহুর
ঘরের কোঠায় শুয়ে আছে
বলরাম ঠাকুর।

(১৪)

ও বৌ কি পড়?
আমি মোল্যাদের ঝি
আমি কলেমা পড়ি
দেওয়ান সাফ
তোমার তাতে কি?

(১৫)

পাওলে কি?
কাউয়ার ডিম
ভাঙছে কেডা
আন্না দি
কি হইছে
ছল হইছে
ছলের নাম কি?
গোপাল
ওরে আমার কপাল।

(১৬)

আপ্লুত কই গুগ-গু সই
তালফুত গেছে কোহানে
ঘর বানছে বেহানে
ইল্কি ধানের বিল্কি খৈ
নন্দের মাথায় দৈ।
পথে এট্টা ক্যাওমাও
ধরে রান্দে খাই
তেল নাই নুন নাই
তেলি বাড়ি যাই
তেলি দিল এক ফোঁটা তেল
তা নেলো সদা
সদারে বিয়ে দেলাম
ভট্ট রাজার দেশে
ইষ্টি কুটুম দেখলি তারা
গুদ ফিরইয়া বসে।

(১৭)

বুচি গেছে নাক ফুটতি
কলৈ ডাঙার মাঠে
সেই খবর শুনে এলাম
জামতলীর হাটে
জাম পাকছে থলি থলি
কাউয়ায় খুঁচিয়া খায়
আষাঢ় মাসে খাজনা দিতে
পরান ফাটিয়া যায়।

(১৮)

আইডু মাইডু কালিয়া জিরা
লক্ষণ গেলো ঠ্যাঙা নৈয়া
সেই ঠ্যাঙা খান ভাঙা
চারটি কড়ি রাঙা
বৌ-গাতোলো ঝি-গাতোলা
কুলু কুলু কুলু কুলু।[৭]

ঙ. গ‍ৎ  

প্রবাদ-প্রবচনে বিভিন্ন ঘটনার সমন্বয় ঘটে থাকে। কিন্তু গৎ-এ বহুধার তেমন ছড়াছড়ি নেই। আবার ছড়ার মতোও রূপ লাভ করেনি। চমৎকার এর গঠন প্রণালী। ছন্দ মেখে এটি আত্মপ্রকাশ করে। গ্রাম্য কিশোর কিশোরীরা এগুলো আবিষ্কার করে থাকে। এককভাবে কিংবা সমস্বরে খেলার মাধ্যমে তারা এগুলো আবৃত্তি করে যায়। যেমন-

১। ইচিং বিচিং চিচিং চা
প্রজাপতি উড়ে যায়।

২। তাল পাতায় কালি
তুই আমার শালি

৩। খয়রা মাছ আর তুত্তুরি
দাঁতে নাগে ফুরফুরি।

৪। উস্তো কাটি চাক চাক
জামাই আসে ঝাঁক ঝাঁক।

৫। আয় বিষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে
যা বিষ্টি ঝরে যা কচুর পাতায় কর্মচা।

৬। ছিঃ ছিঃ ছিঃ মচ্ছির বীচি
তোর কপালে আগুন দিছি।

৭। কলা গাছে বৈঁচি
বৌ নিতে আইছি।

৮। কলার পাতায় দই
তুই আমার সই।

৯। হাড়ির ভিতর চুচড়া
তুই আমার পুতরা।

১০। ছিঃ ছিঃ ছিঃ বোয়েম ভরা ঘি
আসমারে বিয়া দেবো দোতলা বাড়ি।

১১। শরৎ কালের দিন নাইরে নাথু
খাবলে খাবলে খাবা ছাতু।

১২। হনু গেছে বরই গাছে
হনুরে ধর মাঝে।

১৩। রানি গেছে পানি খাতি
বগায় দেছে ঠোক
রানি আমার কি দোষ।

১৪। ময়নার কাল বিয়া
জয়নার চাল দিয়া
আনাজ নাই পাতি নাই
কিসের এ্যাট্টা বিয়া।

১৫। তা তা তা মোয়া কিনে খা
মোয়া নেলো শিয়ালে
কি খাবানে বিয়ালে।

১৬। ঐ ঐ ঐ কাঁচি পাতা দই
কি দই দিয়া খাব দাদা
মট্টাস কলই।

১৭। এক দেশে এক রাজা
রাজার নাই ঠ্যাং
কুরুৎ ঢ্যাং ঢ্যাঙা ঢ্যাং ঢ্যাং।

১৮। ও বৌ মা ওঠো
কৈ মাছ কোটো।

১৯। ফটিক ফটিক দয়াকলা
ফটিক নাচে বেহান বেলা
ফটিকের বউ গিন্নি
ফটিক বিলয় শিন্নি।

২০। ফটিক ফটিক দয়াকলা
ফটিক নাচে বেহান বেলা
ওলো ফটিক ভাই
তোর কপালে বিয়া নাই।[৮]

তথ্যনির্দেশ

১. বিভূতিভূষণ বিশ্বাস অব. মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, বয়স-৭৫, গ্রাম : তালতলা, উপজেলা : কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।

২. আলহাজ্ব মো. জয়েনউদ্দীন, আলীমউদ্দীনের প্রপৌত্র, গ্রাম : চিত্রাপাড়া, কোটালীপাড়া। ৩. স্বপন কুমার বিশ্বাস, বয়স ৫২।

৪ . জালাল মোল্লা, প্রভাষক : পূর্ব-উত্তর কোটালীপাড়া, ফাজিল মাদ্রাসা, গ্রাম : মধুর নাগরা, কোটালীপাড়া।

৫. নির্মলেন্দু সরকার, বয়স ৫৯, পেশা : শিক্ষকতা, গ্রাম : ঘৃতকান্দী, কাশিয়ানী।

৬. বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, বয়স-৬৩, অব. প্রধান শিক্ষক, নড়াইল, কাশিয়ানী।

৭. প্রমথ রঞ্জন সরকার, মাখনলাল, নিরাপদ বিশ্বাস, সুধাংশু ভৌমিক, গ্রাম : বিদ্যাধর, উপজেলা : কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।

৮. গৌরাঙ্গ দাস (৬০), গ্রাম : কংশুর, গোপালগঞ্জ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন