লোকাচার (Ritual )

লোকাচার

১. বাল্য শিক্ষায় পৌরাণিক পদ্ধতি

গ্রাম্য পাঠশালায় পৌরাণিক শিক্ষা পদ্ধতি মুছে যাওয়ার এই ক্রান্তিলগ্নে কোথাও কোথাও একটু নিদর্শন মাত্র আছে। সেই পুরাতন শিক্ষা পদ্ধতি হলো তালপাতায় লেখা। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় আড়ুয়াকংশুর গ্রামে সুনীল মহাশয়ের পাঠশালায় তার কিছু নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। তালপাতায় লেখা সমাপন করে প্রথম শ্রেণিতে পদার্পণে যে ব্যবস্থা আছে তা বেশ চমৎকার। আগে সব পাঠশালাতেই ওই ব্যবস্থা চালু ছিল। শিক্ষক মহাশয়কে তদ্বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বেশ সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝালেন-”বাল্যকালে শিক্ষার্থীদের বর্ণ পরিচয়ের শুরু হয় তালপাতায় কঞ্চির কলমের আচড়ের মাধ্যমে। এতে আবার ব্যবহার হয় কড়াইয়ের কালি। ছোট শিশুরা ওই উন্মুক্ত কালি দ্বারা লিখতে লিখতে তালপাতা ডিঙ্গিয়ে অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছাপ লাগিয়ে দেয়। ছুটির পরে মায়ের কোলে তারা যখন ফিরে যায় তখন মা বলে, বাঃ বাঃ বেশ লিখেছ, একেবারে হনুমান হয়ে ফিরেছ। মা আদর করে গতরের কালি মুছে দেয়। বাহবা দেয় প্রশংসা করে। মনে হয় এই প্রতিটি কাজের মধ্যে গভীর সংস্কৃতি লুকানো আছে। সে যাই হোক, এবার আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করি। তালপাতায় লেখা শেষে প্রথম শ্রেণিতে পদার্পণ করতে গ্রাম বাংলায় আগে বিশেষ এক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হতো। আমার এই পাঠশালায় তার কিছু নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে। ছাত্রটি সেদিন এক গামলা মুড়ি, কিছু মিষ্টি, কাগজ, কলম, একটি কাঁচা টাকা ও একটু সিঁদুর নিয়ে আসবে। সাথে অভিভাবকও থাকবেন। কাগজে লিখে দেওয়া হয় :

মন দিয়ে কর সবে বিদ্যা উপার্জন
সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন
এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে
যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।

সকল ধন চুরি হওয়ার ভয় থাকে, কিন্তু বিদ্যাধন কেউ চুরি করতে পারে না। এইজন্য বিদ্যাকে মহাধন বলা হয়ে থাকে। ওই লেখা দেখে দেখে ছাত্র/ছাত্রীরা কাগজে লিখতে শুরু করবে। এ থেকে শুরু হলো তাদের কাগজে লেখা। এটাই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম লেখা। লেখা পর্বটি শেষ হলে কাঁচা টাকায় সিঁদুর ভরায়ে লেখায় ছাপ দিবে। শিক্ষা জীবন শেষে কর্ম জীবনে সৎভাবে অর্থ উপার্জনের এ এক প্রতীকী ব্যবস্থা। পাঠশালার সকলে তার ঐ মুড়ি মিষ্টি আনন্দ করে খাবে এবং তার শুভ কামনা করবে। এটি একটি সুন্দর পদ্ধতি বলে আমার মনে হয়। আধুনিকতার চাপে গ্রামাঞ্চলে এখন আর তালপাতায় লেখার প্রচলন তেমন একটা দেখা যায় না। তালপাতায় লেখার আরও একটি গুণ হলো এতে হাতের লেখা সুন্দর ও স্পষ্ট হয়। এতে সাধারণত শিক্ষার্থীরা মাটিতে ছালার চট বিছায়ে লেখালেখি করে থাকে। তালপাতায় নতুন ছাত্রদেরকে শিক্ষক মহোদয় জিনারী বা পেরেক দিয়ে অক্ষর উৎকীর্ণ করে দেন। একে খাড়া পাতা বলে। ছাত্ররা ঐ লেখার উপরে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে অক্ষর লেখা শেখে।

২. কাঁসার পাত্রের ব্যবহার

গোপালগঞ্জ জেলার প্রায় প্রতিটি পরিবারে কাঁসার বাসনাদির ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ করে হিন্দু পরিবারগুলোতে। সংসারের সৌন্দর্য বর্ধনে এই ধাবত পাত্রের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলে এলাকাবাসীর বিশ্বাস। অতিথি আপ্যায়নে কাঁসার থালার ব্যবহার আভিজাত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। এই ধাতব পাত্রে খাবার খাওয়া বা পরিবেশন অত্র এলাকার একটি প্রাচীন প্রথা হিসেবে গণ্য। অবশ্য এর যথেষ্ট গুণাবলিও আছে। কাঁসা হচ্ছে তামা ও রাং এর একটি উপধাতু। তামা, পাণ্ডু, অর্শ্ব, জ্বর, কুষ্ঠ, অম্ল, পিত্ত ও শুল প্রশমক। রাং-এর গুণাবলি হলো প্রমেহ, কফ ও ক্রিমি নাশক। এসব রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে প্রাচীনেরা এই ধাতব পদার্থটি ব্যবহারের বিধান রেখেছেন। এসব গুণাগুণের উপস্থিতিতে প্রত্যেক পরিবারে কাঁসার বাসনাদি ব্যবহার করা দরকার। বিভিন্ন ধরনের কাজেও এই ধাতব পাত্রটি ব্যবহার হতে দেখা যায়। চৈত্র বৈশাখ মাসে কারুর গরম লাগলে পায়ে কাঁসার পাত্র ঘষতে দেখা যায়। এতে তারা সুস্থ বোধ করে। কাউকে পোকা-মাকড় বা কুকুরে কামড়ালে চিকিৎসা হিসেবে এই ধাতব পাত্রের ব্যবহার দেখা যায়। কবিরাজ কাঁসার থালায় তন্ত্র-মন্ত্রের তদবির করে রুগির পিঠে লাগিয়ে দেয়। এতে রুগি ভালো হয় বলে এলাকাবাসী মত প্রকাশ করেন।

৩. পিঁড়িতে বসে খাবার খাওয়া

গ্রাম্য এলাকায় এখনও অনেক পরিবারের ভোজন শালায় ডাইনিং টেবিল ঢোকেনি। তারপরেও দেখা যায় অনেকে ভদ্রতার খাতিরে পিঁড়িতে বসে ভাত খেতে সংশয় বোধ করেন। কৃষক পরিবারের শোভা হিসেবে কাঠের পিঁড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। আগে বড় পরিবারগুলোতে দেখা যেত সকল সদস্য বৃত্তাকারে পিঁড়িতে বসে ভাত খাচ্ছে। গৃহিণী ঘুরে ঘুরে খাবার পরিবেশন করছে। এ দৃশ্য দেখতে কার না মন চায়। অনেকে কাঠের পিঁড়িতে বসে খাবার খাওয়ার গুণাগুণ সম্পর্কে অবহিত নয়। এভাবে ভাত খেলে পরিপাক যন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যেভাবে পিড়িতে বসে ভাত খাওয়া হয় তাতে মাটি থেকে একটু উঁচুতে বসতে হচ্ছে। থালা থেকে ভাত তুলে মুখে দিতে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। আবার হাতে ভাত তুলে মুখে দিতে সোজা হতে হচ্ছে। যতক্ষণ খাওয়া না হবে ততক্ষণ সামনের দিকে ঝুঁকতে ও সোজা হতে হচ্ছে। এতে মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়। পেটের উপর মৃদু চাপ পড়াতে পেটের পেশী সবল হয়। এই প্রক্রিয়া ক্ষুদ্রান্তের ও বৃহদান্তের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়। পেটে মেদ জমতে বাঁধা সৃষ্টি করে। মেরুদণ্ড নমনীয়তার জন্য জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পায়। মাটিতে বসতে গেলে পায়ে যাদের খিল ধরে এতে তাদেরও বেশ উপকার হয়। এসব কারণে খাবার খেতে পিঁড়ি ব্যবহার হয়েছে বলে বিজ্ঞ মহল মনে করেন। অনেক স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা আজ আমরা এড়িয়ে চলছি। হয়তো এমন একদিন আসবে ইউরোপ আমেরিকার মানুষ পিঁড়িতে খাবে আর আমরা ডাইনিং টেবিলে খাব।

৪. ধূপের ধূনা

সকালে-বিকালে পরিবারের পরিষ্কারজনিত কাজের মধ্যে ধূপের ধূনার ব্যবহার বহু আগে থেকে বয়ে চলেছে। এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও এই ধূপের ধূনার ব্যবহার দেখা যায়। পাইন নামক গাছের আঠাই ধূপ। দেখতে ঈষৎ হলুদ বর্ণের। এই জমাট বাঁধা আঠা আগুনে পোড়ালে যে গন্ধ বের হয় তাই-ই ধূপের ধূনা। এটি জীবাণুনাশক। বায়ু বাহিত জীবাণুকে ধ্বংস করে। বর্তমান যুগের মতো আগে বায়ু বিশুদ্ধকরণ বা এয়ার ফ্রেসনার ছিল না তখন এই ধূপের ধূনার সাহায্যে বায়ু বিশুদ্ধ করা হতো। প্রত্যেক পরিবারে সকালে বিকালে এই ধূপের ধূনা দিয়ে থাকে। যে পাত্রে রেখে এই ধূপ পোড়ান হয় তার নাম ধূপতি। পূজা পার্বণে ধূপতিতে ধূপ পোড়ায়ে ভক্তরা আলতি দিয়ে থাকে। এর অর্থ হলো মঙ্গলময় কোনো অনুষ্ঠানকে জীবাণুমুক্ত রাখা। সমবেত জনতার কারুর দেহ থেকে জীবাণু সংক্রমিক হতে পারে তা প্রতিরোধ করার বিধান হিসেবে এই ব্যবস্থা!

৫. আপ্যায়ন

এ দেশের অতিথিপরায়ণতা বহির্বিশ্বে খুবই প্রশংসা কুড়িয়েছে। অতিথি সেবায় দক্ষিণ বাংলা যেমন-ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ি ও কুষ্টিয়া—এসব অঞ্চলের রয়েছে দীর্ঘ দিনের সুখ্যাতি। গোপালগঞ্জ তারমধ্যে অন্যতম। গোপালগঞ্জ, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, কোটালীপাড়া ও টুঙ্গীপাড়া পরিদর্শন করলে তা সহজে উপলব্ধি করা যায়। একজন গৃহস্বামী জিতেন্দ্রনাথ সরকার (৬৮) এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান—’হ কথাটা সত্যি। যহন দেহি বাড়ি কুটুম্বু আইছে তহন ভাল্লাগে। মনে হয় নিজি না খাইয়্যা তাগো খাওয়াই। চল্লিয়্যার ভালো আনাজ, ভালো মাছ, দুধ-টুদ যা যা ভালো জিনিস আছে সব তাগো খাওয়াতে ইচ্ছা করে। তারা যহন বাড়িত্যা চোলিয়া যায় তহন পোরানডা পুড়িয়া যায়। ঘোনো ঘোনো বেড়াতি আসলি তাগে সাথে সাথে আমরাও ভালো ভালো খাতি পারি। আমরা যদি তাগে বাড়ি যাই তারাও ওরোকম করে। অত্র অঞ্চলে তদ্বিষয়ে একটি প্রবাদও প্রচলিত আছে। তা হলো-’অতিথ রূপে নারায়ণ’। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানো এই জনপদের একটি বৈশিষ্ট্য। নিজে কষ্ট করে অপরকে খাওয়ানোর এই সংস্কৃতির মধ্যে আত্মত্যাগের শিক্ষা আছে। আত্মত্যাগের ফলে মানুষ ভোগ বিলাস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে অভ্যস্ত হয়। ঈদুল ফিতর, পূজা-পার্বণ, পিতামাতার শ্রদ্ধাদি, বিবাহ কিংবা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে আলোচ্য বিষয়ে আরও গভীর ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এখানকার পরিবারগুলো পঞ্চম ব্যঞ্জনে সুস্বাদু খাবারের আয়োজন করে থাকলেও গৃহকর্তা গলে বস্ত্র ধারণ করে যেভাবে দৈন্যতা প্রকাশ করে তা না দেখলে ভাষায় বুঝানো সত্যিই দূরূহ। নিশিছদ্র পরিবেশেও অশ্রু সজল চোখে শত ভুল ত্রুটি অকপটে স্বীকার করতে তারা ভুল করে না। তদুপলক্ষে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোতে খাবার শেষে ভোজন দক্ষিণা দেওয়ার প্রচলন আছে। অন্নদান সর্বোত্তম পুণ্য কাজ বলে এলাকাবাসীর বিশ্বাস। মানুষকে অন্নদান করলে স্রষ্টা তুষ্ট হন এই বিশ্বাস প্রকট। সবেবরাতের রুটি মুসলমানের ঘর ডিঙিয়ে হিন্দুর বাড়িতে আসে, আবার পূজার প্রসাদ হিন্দুর উঠান ডিঙিয়ে মুসলমানের ঘরে স্থান পায়। এই সৌহার্দপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের ধরে রাখা খুবই জরুরি।

৬. এ্যাচড়া ব্রত

জনশ্রুতি আছে রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে যখন পঞ্চবটি বনে নির্বাসিত ছিলেন তখন লঙ্কাধিপতি রাবন ছায়া সীতাকে হরণ করে অশোকবনে রাখেন। সেখানে সীতা চেড়িগণ নিয়ে ফাল্গুন মাসে এক ব্রত পালন করেন। একে আশোক ব্রত বা এ্যাচড়া ব্রত বলে। এরই মধ্যে রাবনের এক চেড়ি সীতার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন। সীতাকে বললেন, মা সীতা আর ভয় নেই প্রভু আর লক্ষণ ভল্লুক বানরগণ নিয়ে তোমাকে উদ্ধার করতে আসছে। সীতা চেড়ির মুখে এই অভয় বাণী শুনে আনন্দে বিহবল হয়ে পড়েন। সেই চেড়িকে তিনি একটি বর দিতে চাইলেন। চেড়ি করজোড়ে বলেছিল হে মা সীতা তুমি আমাকে এই বর দাও যেন আমি প্রভুর চরণ সেবা করতে পারি। সীতা বললেন আমি তোমাকে এই বর দিচ্ছি যে দ্বাপর যুগে কংসের রাজ সভায় প্রভুর সাথে তোমার মিলন হবে। তখন কংস তোমার নাম রাখবে কুব্জা। তখন শ্রীকৃষ্ণের সংস্পর্শে কুজা ষোলো বছরের অপরূপা যুবতী হলো।

চেড়ির পিঠে একটা কদাকার মাংসের পিণ্ড থাকত। শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গের ছোঁয়ায় ওই ঘৃণিত অর্বুদ আর থাকল না। কুব্জা শ্রীকৃষ্ণের দাসী হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ তাকে কুব্জা সুন্দরী বলে ডাকতেন। তাই মা সীতার বর যারা এই ব্রত পালন করবে তাদের কোনো চর্মরোগ পাঁচড়া বা কোনো প্রকার অর্বুদ হবে না। সে থেকে গ্রামাঞ্চলে কিশোরীরা একটি বেদীতে গাছের শাখা স্থাপন করে ফুল দিয়ে এ্যাচড়া বা আশোক ব্রত পালন করে থাকে। তারপর এ্যাচড়া ঠাকুরের উদ্দেশ্যে তারা গান করে। গানগুলো এই রকম—

১.

এ্যাচড়া মা গো লো তোর প্যাচড়াই চুল
তাইতে লাগিয়া গেলো বন্যিয়ার ফুল।
বন্যিয়ার ফুলেতে ফুলেতে না লাগিল মন
আমারে আনিয়া দাও কুমড়ার ফুল।
কুমড়ার ফুলেতে ফুলেতে না লাগিল মন
আমারে আনিয়া দাও ধুতরার ফুল।
ধুতরার ফুলেতে ফুলেতে না লাগিল মন
আমারে আনিয়া দায় রক্ত জবার ফুল।

২.

ডাল ভেঙ না ডাল ভেঙ না
ডালে চড়ে যাব এ্যা
চড়া ঠাকুর চাইছে ফুল
সাজি ভরে দিব।
সাজির ভিতর এ্যাংড়া কাঁটা ব্যাংড়া কাঁটা
ঝুমুর ঝুমুর পড়ে
অযথা বন্যিয়ার ফুল ঝরিয়া ঝরিয়া পড়ে।

৩.

কুমড়ার ফুল তুলতে গেলাম নায়-নায়-নায়
সে-ও ফুল উড়ায় নেলো দক্ষিণা বায়
দক্ষিণা মালী এলো জাগো হে
কাঁখে আমাক কাঁখ কলসি হাতে আমার ডালা
কেমন করে গাঁথব বসে বকুল ফুলের মালা।

8.

আগে যায় ধনের নাও
পাছে যায় ফুলের নাও
ফুল টক টক করে
ফুলের উপর ট দিলে
জলে জুয়ড় পড়ে।

৫.

হরি ঠাকুরের বাড়ির ধারে রাঙা ঘোড়া যায়
তেউ নারে হরি ঠাকুর চ্যাতন হয়।
হরি ঠাকুরের বাড়ির ধারে সাদা ঘোড়া যায়
তেউ নারে হরি ঠাকুর চ্যাতন হয়।

৭. অন্নপ্রাশন

বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান এই অন্নপ্রাশন। বাঙালির এটি যেন এক গৌরবময় কৃষ্টি। বাচ্চার মুখে ভাত তুলে দেওয়ার দিন নব আনন্দে মেতে ওঠে তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব। বিভিন্ন প্রকার নাচ-গান ও বাদ্য বাজনার মধ্যে দিয়ে সূচিত হয় দিনটি। পুত্রের ষষ্ঠ মাসে কন্যার পঞ্চম, অষ্ঠম ও দশম মাসে পূজাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সন্তানের প্রথম অন্ন ভোজনের নাম অন্নপ্রাশন। অবশ্য এই অন্ন হয় মিষ্টান্ন। প্রথম মায়ের হাত দিয়ে বা বাবার হাত দিয়ে শিশুর মুখে মিষ্টান্ন তুলে দেওয়া হয়। এ সময় তার নিটকটতম আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও জ্ঞাতি গোত্রের তথা নিমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকেন। বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক বাক্য উচ্চারণ করে তাকে আশীর্বাদ করা হয়। আত্মীয়-স্বজন যার-যার সাধ্য অনুসারে জিনিস দিয়ে আশীর্বাদ করেন।

৮. ভাগ্যপরীক্ষা

সুন্দরভাবে বিছানা পেতে আত্মীয় স্বজনরা বৃত্তাকারে বসেন। মাঝখানে টাকা, কলম ও ধর্মগ্রন্থ রাখা হয়। পরে বাচ্চাটাকে ওই বিছানায় বসানো হয়। বাচ্চাটি যদি প্রথম টাকাটা ধরে নেয় তাহলে বাচ্চাটি ধনশালী হবে। আর যদি কলম ধরে তাহলে সে বিদ্বান হবে। সে যদি ধর্মগ্রন্থ ধরে তাহলে সে ধার্মিক হবে।

৯. নামকরণ

বাচ্চাটি কোন মাসে কোন তারিখে কত সনে, কি বারে, কোন তিথিতে, কোন রাশিতে জন্মগ্রহণ করেছে সবকিছু গৃহকর্তা ঠিক করে রাখেন। অন্নপ্রাশনের দিন হিন্দুরা একটা ভালো তেলের প্রদীপ বিছানায় স্থাপন করে সাতটি সলতে রাখে। সাতটি সলতের সাতটি নামও থাকে। যেমন-সন্তান যদি মিথুন রাশিতে জন্মগ্রহণ করে তাহলে ধরা যাক নামের আদ্যাক্ষর ক বা ম হবে। ক দিয়ে যেমন-কমলেশ, কানন, কপিল, কৃপা, কিশোর, কান্তি, কল্পনা ইত্যাদি। এখন সাতটি সলতেরই নাম ওইভাবে রেখে ওই প্রদীপে স্থাপন করে প্রদীপে তেল দেওয়া হয় এবং পরে ওই সলতেতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। যে সলতেটি বেশি প্রজ্বলিত হয় সেই সলতের নাম যদি কৃপা হয় তাহলে বাচ্চাটির নাম হবে কৃপা।

১০. মলং

মলং হচ্ছে গরুর মাধ্যমে ধান গাছ থেকে ধান ঝরানোর বিশেষ এক সনাতনী পদ্ধতি। উঠানের চারদিক দিয়ে বৃত্তাকারে ধানের আটি ছড়িয়ে তার উপর চার থেকে পাঁচটি গরু পরস্পর বেঁধে বৃত্তাকারে ঘুরানো হয়। এটাই মলং। প্রথম যে গরুটি বাঁধা হয় তাকে মেউয়া বলে। মেউয়া সাধারণত শান্ত স্বভাবের হয়। কিছু সময় ঘোরার পরে উপরের গুলো নীচে আর নীচেরগুলো উপরে উল্টায়ে দিতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে তলা উল্টানি বলে। এই হলো মলংয়ের সর্বশেষ বিবরণ। যখনই দেখা যাবে ধান গাছ থেকে সম্পূর্ণ ধান ঝরে গেছে তখন খড় থেকে ধান সরিয়ে নেওয়া হয়। একে মলং ঝাড়া বলে।

১১. রূদ্রাক্ষের মালা

দেখা যায় রুদ্রাক্ষের মালা শুধু সন্ন্যাসের গলায় ও বাহুতে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু শুধু সাধুরা বা সন্ন্যাসীরা রূদ্রাক্ষের মালা ব্যবহার করবে এমন নয়। এটা কোনোভাবেই সাধু ও সন্ন্যাসীর সাজ নয়। অনেকে এর গুণ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। তাই তারা মনে করে রূদ্রাক্ষ শুধু সাধুরাই ব্যবহার করবে। তাদের এ ধারণা যথার্থ নয়। প্রকৃতপক্ষে রূদ্রাক্ষ হৃদযন্ত্রকে সবল রাখে। শরীরকে কর্মক্ষম রাখার জন্য রূদ্রাক্ষের ব্যবহার হয়ে আসছে পূর্ব থেকে। তুলসীর মঞ্জুরীর সাথে রূদ্রাক্ষ ঘসে খেলে প্রাথমিক পর্যায়ে যক্ষ্মা রোগ ভালো হয় এবং বাচ্চাদের খাওয়ালে তাদের কাশি কমে যায়। রূদ্রাক্ষ কোনো সম্প্রদায় ভিত্তিক সাজ নয়।

১২. দাওয়া ওঠানো

দাওয়া এমন একটি প্রথা যা আজও বাঙালির কষ্টির সঙ্গে মিশে আছে। ধান কাটা মৌসুমে ঘরে ফসল তোলা শেষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলার কৃষককুল। গৃহকর্তা তার জমির পাকা ধান ঘরে তোলার জন্য পূর্বেই নির্ধারণ করে রাখেন কয়েকজন বহিরাগত কৃষাণ। তারা দাওয়াল বলেই খ্যাত। গৃহকর্তা ঘরে ধান তোলা শেষে এই দাওয়াল বিদায় করার সময় যে অনুষ্ঠান করে থাকে, তাকে দাওয়া উঠানো অনুষ্ঠান বলে।

ধান কেটে ঘরে তুলে দেয় এজন্য তাদেরকে সাধারণত দাওয়াল বা লক্ষ্মীর পুত্রও বলে। দাওয়া অনুষ্ঠানে চলে খাদ্যের প্রতিযোগিতা। এতে থাকে নানা ধরনের পিঠা, যেমন-চিতই পিঠা, ভাপা পুলি, পাটিসাপ্টা, কলার বড়া, চাঁন্দোসা পিঠা, তকতি পিঠা, পান পিঠা, ভাপাপিঠা ইত্যাদি। মাছ, মাংসও কিন্তু বাদ পড়ে না এই অনুষ্ঠান থেকে। মেতে ওঠে গ্রামবাসী নতুন আনন্দে। কৃষককুল গড়ে তোলে এক অনাবিল আনন্দঘন পরিবেশের। পরিশেষে আসে দাওয়াল বিদায় পালা। গৃহকর্তারা যে শর্তে দাওয়াল কৃষাণ ঠিক করে আনে, তা থেকে দুমুঠো ধান বেশি দিয়েই বিদায় করে দাওয়ালদের। কারুর ভিতর থাকে না কোনো ব্যথা-বেদনা। ফলে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক নতুন সম্পর্ক। এভাবে প্রতি বছরই ধান মৌসুমে আসে তারা। এই হলো দাওয়া ওঠানো।

১৩. বি-লু ছাওয়া

পল্লিবালারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশেষ এক প্রক্রিয়ায় মাথা থেকে উকুন ধরে আনে। একে বি-লু ছাওয়া বলে। গাও গেরামে প্রবেশ করলে এমনটি প্রায়ই চোখে পড়ে। প্রক্রিয়াটি এমন-৪/৫ জন নারী একজনের পিছে একজন পরস্পর বসে নেয়, মাথার ঘোমটা ফেলে শুরু করে প্রত্যেকে তার সামনের জনের মাথা থেকে উকুন ধরা। একেবারে নতুন বধূরা এতে অংশ নিতে সংশয়বোধ করে। কারণ শ্বশুর বাড়িতে মাথায় ঘোমটা রাখা নারীদের একটি চিরন্তনী প্রথা। কেউ মুখ বুজে থাকতে অভ্যস্ত নয়। শুরু করে কোথায় কী ঘটনা ঘটছে তাকে এনিয়ে বেনিয়ে প্রকাশ করতে। এতে কুলবধূরা খুব আনন্দ পায়। বিভিন্ন ধরনের উকুনকে তারা বিভিন্নভাবে নামকরণ করেছে। যেমন-বড়টিকে বলে বুড়ুয়া, মাঝারি আকারের টিকে বলে ফুজোল এবং উকুনের ডিমকে নেক বলে। ঐ গুলোকে ধরে ধরে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখদ্বারা চেপে মেরে ফেলে। এতে উকুনগুলোর শরীর ফেটে টাস করে একটি শব্দ হয়। প্রতিটি উকুন মারার সময় তারা উফ করে মুখে শব্দ তোলে। বৃদ্ধাদের তুলনামূলকভাবে চোখের দৃষ্টি কম। তাই তারা মাথায় আঙ্গুল চালনা করে অনুভূতির মাধ্যমে উকুন ধরে আনে। একে আঞ্চলিক ভাষায় ‘ঠ বাওয়া’ বলে।

১৪. ডাক

গ্রাম বাংলায় একজন আরেকজনকে যেভাবে ডাকে তা বেশ মজার ঘটনা। ‘এ’ আর ‘ও’ এই দুটি স্বরবর্ণ তারা ব্যবহার করে অন্যকে ডাকার জন্য। কাছের কউকে ডাকতে ‘এ’ এবং দূরের কাউকে ডাকতে ‘ও’ শব্দটা ব্যবহার করে। যেমন এ-নিমাই। কিন্তু দূরের লোকজন ডাকতে অনেক্ষণ ‘ও’ শব্দটা উচ্চারণ করে তারপর কোনোমতে নামটা একটু উচ্চারণ করে। যেমন : ও…..নিমাই। ও…..করিম ইত্যদি।

১৫. কুড়ি

এই যন্ত্র সভ্যতার যুগে কম্পিউটারের মাধ্যমে যেমন ১ ও ০ এই দুটি অংক দিয়ে সকল গাণিতিক সম্যসার সমাধান করা হয়ে থাকে ঠিক তদ্রুপ আমাদের মা, চাচিরা ২০ সংখ্যা দিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করে নিতেন। ৬৫ বোঝাতে বলতেন তিন কুড়ি পাঁচ। ৮৭ কে বলতেন চারকুড়ি সাত। ৪২ কে বলতেন দুই কুড়ি দুই ইত্যাদি। এই রকম গণনা পদ্ধতি এখনও অনেক প্রাচীন মহিলা ব্যবহার করেন।

১৬. আলাধরা ও খাদিয়া কোঁপান

রাতে আলোর মাধ্যমে মাছ শিকারকে আলাধরা বলা হয়। এই পদ্ধতিতে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে এ্যড়া, ঝুপি, বল্লম, সড়কি, কোচ উল্লেখযোগ্য। গোপালগঞ্জ জেলায় যেসব এলাকায় আলাধরার মাধ্যমে মাছ শিকার করা হয় তার মধ্যে বিদ্যাধর, নাড়িকেলবাড়ি, রাতপাড়া, নিজামকান্দি, জ্যোতকুরা, যদুপুর, পুইশুর, ঘৃতকান্দি, রাউত্থামার, সীতারামপুর, নড়াইল উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক এই কয় মাস আলাধরার জন্য উপযুক্ত মৌসুম। আলাধরাতে দুই জন লোক লাগে। একজন নৌকা চালক অন্যজন শিকারি। যে নৌকা চালায় তাকে বলে কাড়ালিয়া। সে পিছন থেকে নৌকা চালাবে। যে মাছ কোঁপাবে তাকে বলে শিকারি। শিকারি থাকবে অস্ত্র হাতে সামনে দাঁড়িয়ে। নৌকার অগ্রভাগে গলইতে মশাল বা যে কোনো ধরনের আলো ভালো করে বেঁধে নেয়। যে এলাকায় ঘোলা জল সে এলাকায় এভাবে মাছ শিকার করা যায় না। ঘোলা জলে যে প্রক্রিয়ায় মাছ ধরা হয় তাকে বলে খুটনি। যা-ই হোক ওই আলোতে যেসব মাছ দেখা যাবে তা ওইসব অস্ত্র দ্বারা কোঁপায়ে নৌকায় রাখা হয়। প্রায় রাতভর চলে এভাবে মাছ শিকার। সারা বিল জুড়ে আলো জ্বলতে দেখা যাবে। অপেক্ষাকৃত ছোট ধরনের মাছ এই শিকারের আওতায় পড়ে না। বড় বড় মাছ যেমন-শোল, গজার, বোয়াল, বাইন, রুই, কাতলা, চিতল এগুলোই শিকার করা হয়। এই মৌসুমে মৎস্যজীবীরা অনেক অর্থ উপার্জন করে থাকে।

খাদিয়া কোঁপান প্রক্রিয়া চলে ভাদ্র মাসের গুমোট পরিবেশে। চারদিকে যখন কোনো বাতাস থাকবে না এমনতর পরিবেশকে এলাকাবাসী নিরি বলে। এই নিরি পরিবেশে বিলের বড় বড় রুই-কাতলা শেওলা খেতে খেতে উপরের দিকে ভেসে আসতে থাকে। তখন শিকারিরা সুবিধামতো জায়গায় জুতি বল্লম বসিয়ে দেয়। একে খাদিয়া কোঁপান বলে। শিকারিরা মাছগুলোকে খাবার খাওয়া অবস্থায় শিকার করে বলে একে খাদিয়া কোঁপান বলা হয়। এভাবে মাছ শিকার করতে শিকারিকে বিশেষ সতর্ক অবস্থায় থাকা দরকার। পাকা শিকারিরা পুকুর বা নদী থেকে এভাবে বড় বড় চিতল মাছ শিকার করে থাকে। অনেক শিকারি আছে যারা নদী থেকে কচ্ছপও শিকার করে। কচ্ছপ মাথা তুলে জাগলেই তারা নিরিখ করে অস্ত্র ছুড়ে মারে। যে অস্ত্র দিয়ে কচ্ছপ শিকার করা হয় তার নাম ‘ঠ্যাটা’।

১৭. ঢেরা

জনগণের কাছে অনুষ্ঠানসূচি জানানোর পৌরাণিক পদ্ধতি ঢেরা নামে পরিচিত। এই পৌরাণিক পদ্ধতি এখনও মুছে যায়নি। এ যুগে মোবাইল, টেলিফোন, লিফলেট ও বিভিন্ন প্রকার প্রচার মাধ্যমের দ্বারা ঘরে ঘরে অনুষ্ঠানসূচি অতি সহজে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। আগে এরকম কোনো সহজ পদ্ধতি ছিল না। ঢেরা ছিল একমাত্র অবলম্বন। টিনের জের বা অন্য কোনো ধাতব পাত্র কিংবা ঢোল পিটায়ে বলা হতো অমুক জায়গায়, অমুক সময়ে, অমুক অনুষ্ঠান হবে। আপনারা দলে দলে যোগদান করবেন ইত্যাদি। এই ঢেরা পিটানোর উপযুক্ত স্থান হচ্ছে হাট-বাজার বা কোনো জনকীর্ণ স্থান। জনগণও কান পেতে থাকে—ঢেরাওয়ালা কী ধরনের অনুষ্ঠান জানিয়ে দিচ্ছে। নতুন অনুষ্ঠান শুরু হতে গেলে এই পদ্ধতি ছিল আগেকার দিনে বহুল প্রচলিত। আজও হাটে- বাজারে ঢেরা পিটানো সংস্কৃতি মোটামুটি বহাল আছে।

১৮. খোয়াড়

গরু-ছাগলের অত্যাচার থেকে ফসল সুরক্ষা করার এটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি। বলতে গেলে খোয়াড় পদ্ধতি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খোয়াড় হলো পশু পালনকারীর অসাবধানতাবশত উক্ত পশুতে অন্যের ফসলের ক্ষতি করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোনো পশু বন্দিশালায় ক্ষতিসাধনকারী পশুকে বন্দি করে রাখা। খোয়াড়ওয়ালাকে সরকারের কাছ থেকে নির্ধারিত একটি সময় পর্যন্ত পশু বন্দি করে রখার জন্য অনুমতিপত্র আনতে হতো। তা না হলে প্রভাবশালীদের পশু বন্দি করার সাহস তার হতো না। উক্ত খোয়াড় থেকে পশুপালনকারীকে পশুকে মুক্ত করে আনতে আর্থিক দণ্ড গুণতে হতো। নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে পশুর মালিককে অধিক হারে টাকা জরিমানা দিতে হতো। আগের দিনে কৃষকেরা এই প্রক্রিয়ায় ফসল রক্ষা করত। তবে দুর্বলেরা সবলদের গরু খোয়াড়ে দিতে ইতস্ততবোধ করত।

১৯. পাত্র হিসেবে কলার পাতা ও সুপারি গাছের ডোঙা

অতিথি আপ্যায়নে আধুনিক যুগের মতো আগে ডেকরেশন পদ্ধতি ছিল না। মহোৎসব বা যেকোনো ভূরিভোজ অনুষ্ঠানে অতীতে বৃক্ষের পত্রাদি বা গাছের বাকল ব্যবহার করা হতো। তারমধ্যে কলার পাতা ও সুপারি গছের ডোঙা উল্লেখযোগ্য। পত্রযুক্ত কলার ডগা প্রায় একহাত পরিমাণ দৈর্ঘ করে কেটে চিরে দ্বিখণ্ডিত করতে হতো। একটি ভালো ও একটি ছিন্নপত্র জোড়ে জোড়ে পরস্পর তারা সাজিয়ে নিত। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে ঐ রকম একজোড়া পাতা পেয়ে প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমাণ ভাঁজ করে একটার পর একটা সাজিয়ে থালা সদৃশ করে তাতে খাবার খাওয়ার উপযোগী করে নিত। এই কলার পাতায় খাবার খাওয়া নিয়ে এলাকায় একটি প্রবাদও চালু আছে। তাহলো ‘পাতা বড় করে ভাঁজালে কী হবে দেওইয়ার বরাদ্দ আছে’। ঐরকম অন্য আরেকটি পদ্ধতি হলো সুপারি গাছের ডোঙা যা মানুষ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ করে খাবার কাজে ওই ডোঙা আগে ব্যবহৃত হতো। আজকের এই আধুনিক যুগের মানুষ অমনতর পাত্রে খাবার খেতে লজ্জাবোধ করলেও সে যুগের মানুষ গর্ববোধ করত। তবে এই পদ্ধতি আর্থিক সাশ্রয়ের দিক থেকে ভালো পদ্ধতি।

২০. ভারা ভানা

ঢেঁকির মাধ্যমে ধান থেকে চাল বের করে আনার পৌরাণিক পদ্ধতি হচ্ছে ভারা ভানা। কাতলা, মোনাই, শাইল্যা ও প্রায় চার হাত লম্বা কাঠের যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে ঢেঁকি তৈরি হয়। ঢেঁকির মোনাই যে গর্তটিতে আঘাত হানে তার নাম নোট। ঢেঁকির পিছন অংশে দাঁড়ায়ে যারা ভারা ভানবে তারা পরিমাণ মতো লম্বা একটি দণ্ড দ্বারা ধানগুলো বার বার নোটে ঠেলে দেয়। সেই দণ্ডটির নাম আলই। স্বল্প সময়ে মেশিনে ধান ভাঙানোর কারণে অনেক এলাকা থেকে ঢেঁকি বিদায় নিয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু এলাকায় এর ব্যবহার চোখে পড়ে। ঢেঁকি ব্যবহারকারীণী ছবি পাণ্ডের (৪৪) কাছ থেকে ভারা ভানা সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে তিনি যা বলেন-’ঢেহিতি ধান ভানতে মেলা সময় লাগে। কষ্টও হয়। তারপরেও ইচ্ছা অয় এট্টু ভারা ভানি। ভারা ভানার সাথে সাথে চাল অইয়া আসে না। ফেত্তম অল্প কিছু চাল বারয়। এরে কয় ফাল্টা। তারপরে প্রায় সবচাল বারয়। তারে কয় দোফাল্টা। সব চাল বারনোর পরে চালের রোং থায়ে লাল। এভাবে কিছু সময় ফারাতে হয়, এগরে কয় শাইল্যা। এহেবারে শ্যাষে চালের গা থেকে কুড়ুয়া বাইর করাকে কাড়া বলে। সেই চাল রান্না করে খাতি অয়। এই ঢেহির ভানা চাল খাতি খুব স্বাদ। এই চাল ধোয়া জল খালি মাথা ঠাণ্ডা থায়ে। সব চাইয়্যা ঢেহিতে চাল কুটতি আরাম বেশি। ভাদ্দোর মাসে, পোষ মাসে, ঢেহিআলা বাড়িতে চাল কোটার সাড়া পড়িয়া যায়।’ ঢেঁকিতে ভারা ভানার সংস্কৃতি হারিয়ে গেলেও বর্তমানে কোনো কোনো পরিবার সখের বসে হোক বা প্রয়োজনের তাগিদে হোক ঢেঁকি বানাতে শুরু করেছে। পাকঘরে ঢেঁকি, গোয়ালে গরু, গোলায় ধান, পুকুরে মাছ এগুলো বাঙালি পরিবারের একটি আদর্শিক দিক।

২১. জন্ম থেকে মৃত্যু

লোকাচার, পৌরাণিক কৃত্য, পার্বণ, ব্রত, নৃত্য-গীত, অভিনয়, বেদনার অভিব্যক্তি ও আনন্দোচ্ছাস এরকম অসংখ্য লোকজসংস্কৃতি উদযাপনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সামাজিক জীবন প্রবাহ। পাশাপাশি ব্যক্তি কেন্দ্রিক জীবনকৃত্য এতে অসামান্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। জীব মানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনটি পর্ব; তারমধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে : (১) জন্মদিন ও শিশু কৃত্য, (২) বিবাহ, (৩) ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। বাগাড়ম্বরে হোক আর অল্প-স্বল্প করেই হোক প্রায় প্রত্যেকের জীবনে এই তিনটি জীবনকৃত্য উদ্‌যাপন করতে দেখা যায়।

২২. আকিকা

এটি একটি মুসলমানি পর্ব। আকিকা অনুষ্ঠান করতে বাঁধা-ধরা কোনো দিনক্ষণের বিধান নেই। তবে জাতকের শৈশবকালে আকিকা অনুষ্ঠান করতে বেশি দেখা যায়। এতে কিছুটা ধৰ্মীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কোরবানির ভাবাদর্শের মতো এই আকিকা অনুষ্ঠান দৃষ্ট হয়। কন্যা সন্তানের জন্য একটি খাসি ও ছেলে সন্তানের জন্য দুটি খাসি জবাই করার রেওয়াজ আছে। গোস্তকে তিন অংশে ভাগ করে এক ভাগ গরীবদের জন্য, একভাগ আত্মীয়দের, বাকি অংশ নিজেদের জন্য নেওয়া হয়। জাতকের নামে উৎসর্গকৃত সেই পশুর মাংস স্বজনদের সাথে ভোজন করে আকিকা অনুষ্ঠান পালন করা হয়। মূলত পারিবারিক মিলাদই আকিকা অনুষ্ঠানে আশীষ পর্ব।

২৩. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

জন্মদিন, সাটুরিয়া বা ছয়ছিটা, অন্নপ্রাশন ও আকিকা ডিঙায়ে এলো বিবাহ পর্ব। জীবনে সেটিও শেষ হয়ে গেলো। যে জীবন এত অভিনয় করে চলেছে সেই জীবন অভিনেতা জীবনযুদ্ধে অনড়, অচল, অচেতন হয়ে পড়ে রবে। মনে হয় যা কিছু করেছি এইতো সেদিন, তাই বাউল কবির ভাষায় বলতে হয়-

ও তোর দন্ত পড়িবে চুল পাকিবে
যৈবনে লাইগা যাবে ভাটি
ও তোর দিনার দিনে খসিয়া পড়িবে
রঙিলা দালানের মাটি।

প্রাণাধিক পুত্র সে দিবে মুখে আগুন ধরিয়ে। প্রাণ-প্রেয়সী পিছে পিছে ছিটাবে গোবর ছড়া। চিতায় দাউদাউ করে জ্বলবে আগুন। দেখতে দেখতে আতর মাখা সোনার অঙ্গ হবে ভস্মিভূত। মুসলমানরা মৃতকে গোসল করিয়ে, আতর মাখিয়ে মাটির নীচে চিরনিদ্রায় শায়িত করে রেখে দিবে। এইতো জীবন। বিদেহী আত্মার সদগতি কামনা করে যেসব করণ-ক্রিয়া আছে তাকে বলে জিয়াফত, হিন্দু মতে গুরুদশা। মৃত্যুর তিন দিন পর মুসলিম পরিবারে মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়। আবার চল্লিশ দিনের দিন পাড়া প্রতিবেশী ও দূর-দূরন্তের মেহমানদেরকে দাওয়াত করে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। একে চল্লিশা বলে। হিন্দুমতে বিদেহী আত্মার মঙ্গল কামনার্থে দশদিন গুরুদশা পালন করার বিধান আছে, মাছ-মাংস খাওয়া নিষেধ। এমনকি ভাতও না। ফলমূল মিষ্টি খেয়ে দশ দিন কাটাতে হবে। স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ। থাকতে হবে থান কাপড় পরিধান করে। স্নান করেও ওই কাপড়ে থাকতে হবে। গলায় ঝুলানো থাকে ধড়া। লোহার যেকোনো বস্তু তাতে থাকা আবশ্যক। এভাবে দশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পুত্র সন্তানেরা মস্তক মুণ্ডন করে শ্রাদ্ধ তর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এ দায় থেকে মুক্ত হয়।

বারো দিন অতিক্রম না করে ভূরিভোজের ব্যবস্থা করা বিধেয় নয়। তাই তের দিন থেকে শুরু করে যে যার সুবিধা মতো সময়ে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে ভূরিভোজের ব্যবস্থা করে থাকে। একে খরচ বলে।

২৪. জন্মদিন ও শিশু কৃত্য

যেদিন একজন নবাগত অতিথি এই ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করল সেদিন থেকে তার জীবনকৃত্যের অভিষেক সূচিত হয়। মা-বাবা পরিবার-পরিজনদের অন্তরে বয়ে যায় আনন্দধারা। মুখ ভরে যায় মিষ্টি মণ্ডায়। শুরু হয় মেয়েলি গীত। পান-সুপারি চিবায় আর রসের কথার ফুলঝুরি ছড়ায় দাদা দাদিরা। হিন্দু পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তিন ঝাঁক উলুধ্বনি আর পুত্র সন্তান জন্ম নিলে সাত ঝাঁক উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেয় নবজাতককে। সধবা মহিলারা কাদামাটি করেও আনন্দ ফূর্তি করে থাকে। নবজাতকের জন্য এই দিনটি সারা জীবনের জন্য সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। বছরান্তে শুরু হয় সেই জন্ম দিন পালনের পারিবারিক উৎসব। রকমারি সুস্বাদু খাবারের তালিকায় থাকে ক্ষীর, পায়েস, পিঠা, মিষ্টি ইত্যদি। আহূতরা কেউ মিষ্টি, কেউ পোশাক, কেউবা সোনা-রূপার অলংকারাদি নিয়ে যোগদান করে এই জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে। নৃত্যগীতও চলতে থাকে এই অনুষ্ঠানমালায়। শুভাকাঙ্ক্ষী ও আহূত মেহমানরা জাতকের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করে ও আশীর্বাদ জানায়। অনুষ্ঠানে আগত সকলে জাতকের মুখে মিষ্টি তুলে দেয়। এভাবে শেষ হয় জন্ম দিন পালন অনুষ্ঠান।

২৫. সাটুরিয়া বা ছয়ছিটা

ভূমিষ্ঠ হওয়ার ষষ্ঠ দিনে নামকরণ সংক্রান্ত বিষয়ে যে অনুষ্ঠান হয় তা সাটুরিয়া বা ছয়ছিটা নামে পরিচিত। অশৌচ থেকে শুচি হয়ে আয়োজন করতে হয় এই অনুষ্ঠানের করণ ক্রিয়া। পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার, ঘর-দরজা পরিষ্কার, নবজাতকের মস্তক মুণ্ডনকরণ এগুলো সাটুরিয়া অনুষ্ঠানের প্রাথমিক কাজ। অতপর শিশুটিকে পশ্চিম দিকে মাথা রেখে শোয়াতে দেখা যায়। শিয়রে রাখা হয় ধর্মীয় গ্রন্থাদি। কাগজ কলম রাখতেও দেখা যায়। ধর্মপ্রাণ কোনো ব্যক্তিত্ব ও সধবারা এই সাটুরিয়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। আয়োজন করা হয় পারিবারিক মিলাদের। দাদা, দাদি কিংবা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ সুন্দর নাম নির্ধারণের অনুরোধ জানানো হয়। তারা পছন্দ মতো ভালো নাম নির্ধারণ করে দেন। ওই নামেই শিশুটি নামাঙ্কিত হয়। তবে হিন্দুদের ক্ষেত্রে মস্তক মুণ্ডন করার ধরা-বাঁধা কোনো রীতিনীতি নেই। তারা সাধারণত দক্ষিণ বা পূর্ব দিকে মাথা রেখে শিশুদের শোয়ায়ে নেয়। শিয়রে রাখে ধর্মীয় গ্রন্থ, কলম-খাতা ইত্যাদি। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য বিছানে রাখতে দেখা যায় আশকলি গাছের ডাল, মুড়ো পিছা, লোহা, পশুচর্ম কিংবা পশুচর্ম নির্মিত জুতা। ধূপ- দীপ জ্বেলে তার পাশে বসে ধর্ম গ্রন্থ পাঠ করার বিধান আছে। কলার পাতায় এক একজনে এক একটি নাম লিখে দেয়। তারমধ্যে যে নামটি পিতার নামের আদ্যক্ষরের সাথে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই নামেই তাকে নামকরণ করা হয়। এ হলো ছয়ছিটার তাৎপর্য।

২৬. বৃষ্টি নামানোর ব্রত

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপলাভ করেছে। কোনো দেশ নগরকেন্দ্রিক, কোনো দেশ সওদাগরী ভিত্তিক, আবার কোনো দেশ স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে কৃষিকর্মকে ধারণ করে। গ্রাম্য প্রধান আমাদের এই জনপদের জীবনালেখ্য রচিত হয়েছে কৃষিকে নির্ভর করে। কৃষি প্রধান দেশের কৃষিকর্ম মূলত সেচ প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল আমাদের দেশের কৃষিকর্ম যন্ত্রগত না হওয়ায় অতীত থেকেই বৃষ্টির উপযোগিতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টিই ছিল এই জনপদের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। ফসল ফলানোর মৌসুমে যথাসময়ে বৃষ্টি না হলে কৃষকদের সরল অবয়বে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠত। সবুজ-শ্যামল ফসলের ডালি ভরে দিতে আজও তারা আয়োজন করে থাকে বৃষ্টি নামানোর ব্রত। সাধারণত গ্রাম্য নারী ও কিশোরীরা এই ব্রতে অংশগ্রহণ করে থাকে। ৪-৫ জন নারী দলবেঁধে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তোলে এই ব্রতের মাহাত্ম্য। একজনের মাথায় থাকে নতুন কুলা। কুলায় দেখতে পাওয়া যাবে তিল, তুলসী, দূর্বা, ধান ও একটি কুনো ব্যাঙ। অন্য আরেক জনের হাতে থাকে জল পাত্র। বাকিরা হয় তাদের সহযাত্রী। প্রতিটি ঘরের আঙিনায় যেয়ে ঘরের চালে জল ঢেলে দেয়। মস্তকে কুলা ধারণকারিণী নারী ও অন্যান্যরা সেই জলে ভিজে ভিজে এক ধরনের গীত গেয়ে থাকে। গীতগুলো নিম্নরূপ :

১.

কলা বাগানে গলা জল
কচু বাগানে হাঁটু জল
কলা বাগানে গলা জল
ও-লো ম্যাগারানী
শাক ধুইয়া ফেলা পানি
নোন্দে জামাই ভগবান
গাব গুবইয়া বৃষ্টি আন।

২.

আইলাম্বর আইলাম্বর
চাউল করি বাইর কর
চাউল দিবে দিবে করি
বড় বৌ গো তাড়াতাড়ি
ছোট বৌ গো তাড়াতাড়ি
আমি তো মাগিয়া খাই
বাড়ি বাড়ি বয়াৎ গাই।

৩.

কালো মেঘা নামো
ফুল তোলা মেঘ নামো
ধূলট মেঘা তুলট মেঘা
তোমরা সবাই নামো
কালো মেঘা টলমল
বারো মেঘার ভাই
আরও ফুটিক পানি দিলে
চিনার ভাত খাই।
কালো মেঘা নামো নামো
চোখের কাজল দিয়া
তোমার কপালে টিপ দিব
মোদের হলে বিয়া।
আড়িয়া মেঘা হাড়িয়া মেঘা
কুড়িয়া মেঘার নাতি
নাকের নোলক বেচ্যা দিবাম
তোমার মাথার ছাতি।
কৌটা ভরা সিন্দুর দিবাম
সিন্দুর মেঘার গায়
আইজ যেন রে দেয়ার ডাকে
মাঠ ডুবিয়া যায়।

এই ব্রত পালন করার পর সন্ধ্যার আঁধারে নারীরা ত্রি-পথের সঙ্গম স্থলে একত্রিত হয়ে সমস্বরে সুর সেধে নিম্নবর্ণিত গানটি গেয়ে থাকে :

হলদি কুটি মরিচ কুটি
জয় পুতুলের বিয়া
ওই যে আইছে নাতি জামাই
গামছা মুড়ি দিয়া।
গামছা নেলো সোতে
জামাই বসে কোঁতে
কোঁতরে জামাই কোঁত
নিল্যার মার ঠিলা ভরে মোত।

এই ব্রতপালনকারিণী একজন কুলবধূ শিবানী রায় (২৮)-এর কাছে জানতে চাওয়া হয় আপনারা কোন ঋতুতে এই বৃষ্টি নামানোর ব্রত পালন করেন। তথ্যদাত্রী বললেন-‘যহন বিষ্টি হয় না তহন আমরা এই ব্রত করে থায়ি। চোত্তির বোশ্যাক মাসে বিষ্টির দরকার হলে ৫-৬ জন বিটিরা পাড়ায় পাড়ায় গীত গাইয়া মাঙন কুড়াই। তারপর তেমাথার আলি সোন্দিয়া রাত্তিরি ভোগ দিই। এতে দেহা যায় বিষ্টি অয়। কিষাণরা জমিতি যায়, ফসল বোনায়।

২৭. ধানকাটার শেষ খাওন

গোপালগঞ্জ জেলা বিল-বাওড়ে বেষ্টিত। উপজেলা সদর, জেলা সদর এবং পাড়বাঁধা গ্রামগুলো ছাড়া সবটুকু এলাকাই জলে ভরা বিল। একসময় এই বিলে মাত্র দুটি ফসল হতো— আউশ ও আমন ধান। কাশিয়ানী ও মুকসুদপুর উপজেলায় কার্তিকমাসে কার্তিক শাইল বা দীঘা ধানের চাষ হতো। ধান কাটতো পরবাসীরা অর্থাৎ অন্য জেলা বা উপজেলার কৃষাণেরা। তারা ধানকাটার সময় হলেই মালিকের বাড়ি এসে বাসা তৈরি করে থাকতো এবং একমাসব্যাপী বা এক মাসের অধিক সময় ধরে ধান কেটে গেরস্তের বাড়িতে এনে দিতো। বিনিময়ে পেতো ভাগাধান বা ব্যরণ।

আমন মৌসুমের কৃষাণেরা আসতো দল বেঁধে। তারা নিজেরাই রান্নাবান্না করতো। তবে কখনও জমির মালিক তাদের নতুন ধানের চিতই পিঠে ভেজে খাওয়াতো। মহাসমারোহে চলতো ধানকাটা, ধান মলন ও ঘরে তোলা। তবে ধানকাটার শেষদিন প্রতিটি ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। ধানের মালিক ওইদিন কৃষাণদের শেষ খাওনের ব্যবস্থা করতেন এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন। ধানকাটা দলে গায়েন থাকলে গান শোনাতেন। বাড়ির সবাই তা শুনতেন। তবে খাবারের আয়োজনটি হতো জাঁকজমকপূর্ণ। কৃষাণরা পেট ভরে যা যা খেতে চায়, তা আনতেন জমির মালিক। মিষ্টিদ্রব্য ছাড়া ধানকাটার খাওন কোনোভাবেই সম্পন্ন হতো না। সময় বসে নেই। পুরোনো ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে ধানী জমির মালিকদের ঘরে। এখনও বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর ও মাদারীপুরের কৃষাণেরা ধান কাটার মৌসুমে গোপালগঞ্জে আমন ধান কাটতে আসে।

২৮. বলন সংস্কৃতি

বলন একটি আঞ্চলিক শব্দ। গোপালগঞ্জ জেলার বাইরে বরিশালের উত্তরাঞ্চল বিশেষকরে গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর এবং মাদারীপুরের পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষভাবে শব্দটি পরিচিত। বলন শব্দটির অর্থ যাই হোক না কেন, এটি উচ্চারণের সাথে সাথে জিহ্বায় জল আসে অর্থাৎ এটি যে একটি সুস্বাদু খাদ্যবস্তু, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় লৌকিক আচরণ মেনে এটি তৈরি করা হয়। এই খাদ্যবস্তুটি তৈরি করতে সরষে, হলুদ ও তেঁতুলের প্রয়োজন হয়।

তবে যে কেউ বলন তৈরি করতে পারেন না। এজন্য আইরো অধিকারভুক্ত কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের লোকই বলন তৈরি করতে পারে। তবে খাবার হিসেবে যে কেউ খেতে পারেন। আইরো লৌকিক শব্দ। শব্দটির অর্থ যাই বোঝাক না কেন, এখানে আইরো বলতে বোঝায় কোনোকিছু করার একক উত্তরাধিকারী। বংশানুক্রমে বিশেষ কাজ গ্রাম বা এলাকায় ঐ আইরোধারী ব্যক্তিরাই সম্পন্ন করতে পারবেন পূজার পুরোহিতদের মতো।

বলন তৈরির জন্য আইরো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের লোকেরাই স্বীকৃত। এই বিশ্বাসটি অন্য কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের লোকেরাও যুগ যুগ ধরে মানছে। এভাবে বলন তৈরির লৌকিক আচরণ টিকে আছে গোপালগঞ্জে সাধারণ পরিবারে।

বলন তৈরির প্রক্রিয়া খুবই কঠিন। প্রথমে একটি নতুন গামছায় প্রয়োজন মতো সরিষা ও আস্ত হলুদ ভাটি ও জোয়ার-ভাটা লাগা খালের নির্মল জলে ধুয়ে নিতে হবে। আর ধোয়ার কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে মাসিক রক্তস্রাব হয়নি এমন আইরো কুমারীরা। সরষে-হলুদ ধোয়ার পরে ভালোমতো পরিষ্কার করে নতুন পাত্রে শুকাতে হবে। শুকানোর পরে এগুলো আলাদা আলাদাভাবে ঢেঁকিতে কুটে নিতে হবে। কোটার কাজে কুমারী মেয়েরাই অংশ নিতে পারবে। এরপর পরিবারের যেকোনো পুরুষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে একটি নতুন পাত্রে হলুদ ও সরিষা ভালোমতো মেশাবেন। প্রয়োজনমতো তেঁতুল দিয়ে পুনরায় মাখাবেন। মাখানো শেষ হলে পাত্রটি লেপামোছা একটি রৌদ্রস্নাত পরিষ্কার জায়গায় রেখে খাবার উপযোগী করার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করবেন। রৌদ্রে রাখার কাজটি সাবধানে করতে হবে। এসময় কেউই পাত্রের ভেতর থেকে বলন সংগ্রহ বা খেতে পারবেন না। প্রস্তুত প্রক্রিয়া শেষ হলে পরিষ্কার ও নতুন চামচ বা চামচ জাতীয় হাতল দিয়ে তোলা যাবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বলন তৈরির মূল পাত্রটি হবে মাটির এবং তা হতে হবে সম্পূর্ণ নতুন।

বলন যেকোনো খাবারের সাথে বেশ মানানসই। মুখরোচক এই খাবারটি যত্ন করে রাখলে প্রায় এক বছর ধরে খাওয়া যায়। তবে মাঝে-মাঝে রোদে রেখে খাবারটিকে সতেজ রাখতে হবে।

অনেকে বলনকে কাসুন্দি বলে ভুল করেন। আসলে কাসুন্দি আর বলন এক জিনিস নয়। কাসুন্দি তৈরি করতে হলুদ ও সরষে প্রয়োজন হয়। কখনও কখনও ঝাল হিসেবে মরিচ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বলনের প্রধান উপকরণ তেঁতুল, কিন্তু কাসুন্দিতে তেঁতুল আদৌ ব্যবহার করা হয় না। কাসুন্দি ক্ষণস্থায়ী। বলন দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং স্বাদও আলাদা।

২৯. বেগারখাটা

বেগার হলো উপাদেয় খ্যাদের বিনিময়ে বৃহৎ কাজ উদ্ধার করা। এখানে শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে অর্থের কোনো যোগান থাকে না। গ্রাম অঞ্চলে এর বহুল প্রচলন দেখা যায়। যদি কোনো গৃহকর্তা ঘরে পাকা ধান তুলতে পারছে না, জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না কিংবা পাকা ধান মাঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এমন সব জায়গায়ই বেগার ক্রিয়া সম্পাদন হতে দেখা যায়।

৩০. মতুয়া দলপতির হাতে থাকা ছোটা তত্ত্ব

মতুয়াদের দলপতির হাতে গাছের তৈরি একখানা দণ্ড থাকে, যাকে মতুয়ারা ছোটা বলে। এর দৈর্ঘ্য সোয়া হাত পরিমাণ। ছোটাটি বৃত্তে অন্তত ৩ ইঞ্চি পরিমাণ। শাস্ত্রে প্রমাণ নিতাই যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তখন তিনি সবকিছু ত্যাগ করে গ্রহণ করেন একখানা দণ্ড, নারকেলের আঁচিয়া দিয়া তৈরি কমন্ডুলী এবং কৌপিন। প্রভুর সন্ন্যাস বেশ দেখে ভক্ত চুড়ামনি নিত্যানন্দ সহ্য করতে না পেরে দণ্ডকে পাষণ্ড বলে গালি দিয়ে বললেন ব্রহ্ম, বিষ্ণু শুলীন্দ্র যাঁর আজ্ঞাবাহী, সে আবার কোনো দণ্ড বহন করবে। তাই গৌরাঙ্গের হাতের দণ্ড ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড করে ফেলেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বাহ্যে ক্রধান্বিত হলেন। কিন্তু নিগূঢ় ভক্ত প্রেমে গৌরাঙ্গের হৃদয় বিগলিত হয়। যে ভাবের জন্য প্রভু দণ্ড হাতে নিয়েছিলেন তা বাকি থেকে গেলো। একারণে পুণ্য অবগাহনের প্রয়োজন হলো। তাই তো গৌরাঙ্গ প্রভুই এলেন হরিলীলায়। হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর লীলায় ভক্তদের মাঝে সোয়া হাত করে তিনখণ্ড ছোটা তুলে দিলেন। পূর্বের অপ্রকাশিত ভাব প্রকাশিতে একখণ্ড ভক্ত হৃদয়ে, একখণ্ড ভক্তের হাতে, আরেক খণ্ড ঠাকুর বাড়িতে রাখার নির্দেশ দিলেন তিনি। সেইখান থেকে মতুয়া দলপতির হাতে সোয়া হাত করে থাকে দণ্ড বা ছোটা।

৩১. মতুয়া ভক্তের গলে আঁচিয়ার মালা

মহাপ্রভুর মনে প্রশ্ন জাগল নিত্যানন্দ দণ্ড ভাঙ্গল, কিন্তু আঁচিয়ার কমন্ডুল কেন ভাঙ্গল না? যে নিগূঢ়ভাব জেগে নিত্যানন্দ কমন্ডুল ভাঙ্গেনি সে ভাবও জাগল মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের হৃদয়ে। গুরু-শিষ্যের ভাবের আদান-প্রদান হলো অন্তরালে। প্রেম বন্যা বয়ে গেলো হৃদয়ে হৃদয়ে। গৌরাঙ্গদেব মনে ভাবলেন, যে আঁচিয়ার কমন্ডুলী বেশে আমি সন্ন্যাস নিলাম আমার শেষ লীলায় ঐ আঁচিয়ার কমন্ডুলী ভেঙ্গে হবে ভক্তের গলার মালা। আর ঐ মালাই ভক্তদের হরিবোল বলাবে। আরও বললেন, লক্ষ্মীকে ত্যাগ করে কমন্ডুলী সঙ্গে নিয়েছিলাম। শেষ লীলায় লক্ষ্মী নিজেই কমন্ডুলী ভেঙ্গে মালা তৈরি করবে। আর সেই মালা দুলতে থাকবে আমার ভক্তদের গলায়। হরিচাঁদ লীলার সময়ও ব্যবহার হতো নারিকেলের খোল দ্বারা তৈরি কমন্ডুলী। সে সময় পিতলের ব্যবহার ছিল। কমন্ডুলী ভেঙ্গে ভেঙ্গে শান্তি মাতা ঘরে বসে মালা বানাতেন। আর ঐ মালা ভক্তের গলে পরিয়ে দিয়ে ভক্ত সাজাতেন শান্তি মাতা (হরিচাঁদ ঠাকুরের স্ত্রী)।

আঁচিয়ার মালা ব্যবহার করলে ত্বক মসৃন হয় এবং ত্বকের লাবণ্যতা ফিরে আসে। সাধুদের যেমন হয়ে থাকে। প্রকাশ পেতে থাকে সাধুত্ব।

তথ্যসহায়ক

১. নরেন্দ্রনাথ রায়, পেশা : শিক্ষক, বয়স : ৫৫, গ্রাম : দেবাশুর, থানা : কাশিয়ানী।

২. বিভূতি ব্যানার্জি, বয়স- ৫৫, মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ।

৩. সুপ্রিয়া বিশ্বাস (৪০), পেশা- চাকুরিজীবী, মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ।

৪. মনোরঞ্জন মজুমদার, পেশা : চাকুরিজীবী, থানা : কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন