লোকক্রীড়া
এমন নারীর সংখ্যা খুবই কম যারা শৈশবে পতুল খেলা খেলেনি। শৈশব থেকে কৈশোর সময়টা পুতুল খেলার বয়স। পুতুলের মধ্যে থাকে বৎস পুতুল, কৈশোর পুতুল, যুবক- যুবতী পুতুল, দম্পতি পুতুল, মা-বাবা পুতুল ও শ্বশুর-শাশুড়ি পুতুল।
পুতুলগুলো অধিকাংশই মাটির নির্মিত। কাপড়ের পুতুলও দেখা যায়। পুতুল খেলায় স্থান পেয়েছে পুতুলের জন্মদিন, পুতুলের বিয়া, পুতুলের মেলানি, পুতুলের সাধ- ভক্ষণ প্রভৃতি। তবে পুতুলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এই খেলায় স্থান পেতে দেখা যায় না। অচেতন পুতুলগুলোর সাথে ছোট ছোট শিশুরা কথা বলে। মনে হয় সত্যিই যেন পুতুলগুলো তাদের সাথে কথা বলছে। সমাজে পুতুল খেলাটাকে অভিভাবকরাও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। প্রায় সব শিশু মেলায় গিয়ে হাজারও আকর্ষণীয় দ্রব্যের মধ্যে পুতুল কিনে দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি দাবি জানায়। না দিলে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়। এই শিশুতোষ সংস্কৃতি গ্রাম বাংলায় জোরেসোরে বয়ে চলেছে। রাজা যেমন রাজ্য জয় করে আনন্দ লাভ করে শিশুরাও হাতে একটি পুতুল পেয়ে তেমন আনন্দ পেয়ে থাকে। তাই পুতুল খেলার গুরুত্বকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
এটিও একটি শিশুতোষ ক্রীড়া। আচিয়া খুটি খেলার মধ্যে শিশুরা যে আনন্দ উপভোগ করে তা পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ জড়ো করলে তৎসম হবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। মা বাবা শিশুকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও শিশুরা তাদের ক্রীড়ার ধ্যান ভাঙায় না। তবে ক্ষুধায় যখন কচি শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন সে ধূলিমাখা গায়ে ছুটে যায় মায়ের কোলে। এই খেলার উপকরণ হলো চোখ মেলে দেখা সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী। হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে তৈরি করে নেয় হাড়ি- পাতিল-থালা-ঘটি-বাটি ইত্যাদি। কেউ ঘোমটা মাথায় বউ সাজে, কেউ বাটনা বাটে, কেউ উনুনে ভাত চড়ায়, কেউ মিথ্যা ধোয়ায় চোখ ডলে, কেউ অভিমান করে বসে থাকে, আবার কাউকে দেখা যায় বাজার সদায় করে ফিরছে। সব মিলেয়ে এ এক চমৎকার দৃশ্য। তাদের এই আয়োজন মিথ্যা হলেও হৃদয়ে যে আনন্দ বয়ে যায় সেটা মিথ্যা নয়। কার্টুনিস্ট, কবি ও ছড়াকারেরা শিশুদের মন জয় করতে কত না কার্টুন, হাসির গল্প, মজার মজার ছড়া রচনা করে যাচ্ছেন, তবুও শিশুতোষ সাহিত্যে পূর্ণাঙ্গতা এনে দেওয়া সম্ভব হয় না।
শিশুরা কেন এই রকম খেলায় মেতে থাকে তা পর্যালোচনা করলে হয়তো দেখা যাবে প্রকৃতিই তাকে এভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে বয়সে যে জিনিসটা প্রয়োজন প্রকৃতি তা সরবরাহ করতে ভুল করে না। শৈশবে এটা না করলে হয়তো জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাই শিশুদের কচি দেহের কচিমনে বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলা অবশ্যই প্রয়োজন।
এই খেলাটি জলের মধ্য খেলতে হয়। পরিষ্কার জলে এ খেলা সম্ভব নয়। ঘোলাজল খেলাটির জন্য উপযোগী। এতে খেলোয়াড় ডুব দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। অন্যান্য খেলোয়াড়রা তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা চালায়। যারা স্পর্শ করতে চেষ্টা চালায় তারা ডুব দিয়ে কিংবা জেগে বা ভাসমান থেকে যেকোনোভাবে তাকে তল্লাস করতে পারবে। যে স্পর্শ করতে পারবে সে আবার ডুব দিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে। অন্যান্য খেলোয়াড় আগের মতো তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এভাবে এ খেলা চলে। আঞ্চলিক ভাষায় একে নোল নোল খেলা বলে। খেলতে খেলতে যে হেরে যাবে তার একটি সাজা হয়। সাজাটি হলো—গালে জল ভরে কুলে এসে গোবরের উপর সেই জল ঢেলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে হবে।
সেকালে এবং একালে কোটালীপাড়ার লাঠিখেলা গোপালগঞ্জ জেলা ও জেলার বাইরে দারুণভাবে জনপ্রিয়। কোটালীপাড়ায় লাঠিখেলার স্থানীয় নাম পাইটখেলা।
লাঠিখেলা
এই খেলার প্রধান উপকরণ শুধু বাঁশের লাঠি নয়, ঝাঁঝর বাদ্যি বাজিয়ে তাল সৃষ্টি করা হয় এবং লাঠির মাধ্যমে নানা ধরনের খেলা দেখানো হয়। লাঠি খেলায় কখনও কখনও ঢাল-সড়কির ব্যবস্থা করা হয়। দুইপক্ষ দুদিকে অবস্থান নিয়ে বাদ্যির সাথে অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করে, একসময় পরাজিত হয় এক পক্ষ।
হাতে লাঠি ধারণ করে লেঠেল যখন শরীর উল্টিয়ে কসরৎ দেখান, তখন লাঠিতে জাদু সৃষ্টি হয়। লাঠিখেলার কলাকৌশল না জানলে খেলায় কেউ অংশ নিতে পারে না, এবং যে কেউ লেঠেল হতে পারে না। ঐতিহ্যবাহী এই লাঠিখেলা শক্তি প্রদর্শন এবং শক্তিশালী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়।
কোটালীপাড়ায় সেকালে লেঠেলবাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারা মারামারি নয়, লাঠিখেলা প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করতো। তবে ঝগড়া বিবাদে যে লেঠেল বাহিনী ভাড়া খাটেনি, তা কিন্তু বলা যাবে না।
কোটালীপাড়ার মধ্যে সোনাটিয়া, কাগডাঙ্গা, গোপালপুর, কোনেরবাড়ি, কুরপালা, চিত্রাপাড়া, পূর্ণবর্তী ও উত্তরপাড়ার লেঠেল বাহিনীর সুনাম এখনও সুবিদিত। এদের মধ্যে সোনাটিয়ার বাঙালি মোল্লা, আফসারউদ্দীন শাহ, জালাল উদদীন, বাগডাঙ্গা গোপালপুরের ধলা মিয়া, সাদেকুর রহমান, কচুয়ালির খলিল, কাদের, ফয়জর হালদার, পূর্ণবর্তীর মুসা সরকার, মোসলেম সরদার, ইশা হাওলাদার এবং চিত্রাপাড়ার লেহাজউদ্দীন ও মেনাজউদ্দীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এরা ছিলেন দলপতি বা দলের সরদার। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এই লাঠিখেলা বা পাইটখেলা আগের মতো প্রদর্শিত হয় না। বিলুপ্ত না হলেও কোনো রকমে টিকে আছে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে।
পোলাপুলি খেলাটি মাঘ-ফাল্গুন মাসে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা খেলে থাকে। বিশেষ করে বাড়িতে যখন রবিশস্য উত্তোলন করা হয়। ৪-৫ জনে মিলে শুরু করে এই পোলাপুলি খেলা। একজন পালিয়ে থাকবে সুবিধা মতো স্থানে। অন্যরা তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবে। তাকে খুঁজে বের না করতে পারলে পলাতক খেলোয়াড়ের পক্ষের একজন তাকে একটু সংকেত দিতে বলে। তখন সে বলে উঠে কুল্লুক ভক্কা। বিপক্ষের খেলোয়াড়েরা ওই শব্দের উৎপত্তিস্থল বের করতে চেষ্টা চালায়। তারপরও খুঁজে বের করতে না পারলে অনুসন্ধানকারী দল হেরে যাবে।
এই খেলাটি কিশোরীরা খেলে থাকে। কখনও গোলাকৃতি, কখনও আয়তক্ষেত্রের মতো, আবার কখনও বর্গক্ষেত্রের মতো মাটিতে খোট অংকন করে নেয়। ওই খোটগুলোকে ৫-৬টি, খণ্ডে বিভক্ত করতে হয়। তারপর এক-পা পিছন দিকে ভাঁজ করে এক টুকরা চাড়া খোটে ছুড়ে মেরে কুৎ কুৎ বলতে বলতে এক পা দিয়ে লাফাতে লাফাতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খেলাটি বেশ কঠিন। নিশ্বাস বন্ধ করে কুৎ কুৎ বলতে হবে। নিশ্বাস গ্রহণ করলে আর হলো না। এক-পা দিয়ে চাড়া খণ্ডটিকে ধাক্কা মেরে সামনে দিকে নিয়ে যেতে হয়।
এই বাগুন ঢ্যাবঢেবি খেলাটি কিশোর বালকেরা খেলে থাকে। ৭-৮ জন মিলে এ খেলা খেলতে দেখা যায়। গামছা ভালো করে পাকিয়ে একধারে গিট করে নিতে হয়। এক জনের হাতে থাকে সেই গিটওয়ালা গামছা। বাকিরা গোল হয়ে গায়ে গায়ে মিশে বসে থাকে। যার হাতে গামছা সে তাদেরকে ঘিরে দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে। তবে গামছা সে খুব সাবধানে রাখে। হাঁটার ভিতর দিয়ে কোনো একজনের পিছনে রেখে যাবে। যার পিছনে গামছাটা রেখেছে সে যদি টের না পায় তবে তারা কপালে থাকে দুর্গতি। যে ঘুরছিল সে ঘুরে এসে ওই গামছা ধরে তাকে বেদমভাবে পিটাতে শুরু করে। দৌড়ে ঘুরে এসে আবার সেই স্থানে না বসা পর্যন্ত সে শুধু মারই খেতে থাকবে। আর যদি কেউ দেখতে বা বুঝতে পারে যে আমার পিছে গামছা আছে তবে সে দ্রুত উঠে ওই গামছা ধরে যার হাতে গামছা ছিল তাকে পিটাতে শুরু করে। যতক্ষণ সেও ঘুরে দৌড়ে এসে না বসবে ততক্ষণ চলবে বাগুন ঢ্যাবঢেবির পিটানি। এই হচ্ছে এই খেলাটির বৈশিষ্ট্য
এই খেলাটি রাখাল বালকদের। ৪-৫ জন রাখাল বালক মিলে এই খেলা খেলে থাকে। যে লাঠি দ্বারা গরু পিটায় তাকে বলে নড়ি। নড়ি হচ্ছে এই খেলার প্রধান উপকরণ। ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা একটি কাটের বা বাঁশের খণ্ডও লাগে এতে। নির্দিষ্ট স্থানে একটি নড়ি তারা পুতে রাখে। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন ঐ কাঠের বা বাঁশের খণ্ডটিকে উপরে ছুড়ে মেরে নড়ি দ্বারা সজোরে বাড়ি দেয়। বাড়ি লাগালে খণ্ডটি ভোম ভোম করে বহুদূরে গিয়ে পড়ে। সেখান থেকে বিপক্ষের একজন তা ধরে ঐ পুতে রাখা নড়িকে তাক করে ছুড়ে মারবে। নড়ি স্পর্শ করলে সে বাদ পড়বে। আর যদি খণ্ডটিকে বাড়ি মেরে ফিরাতে পারে তবে যেখান গিয়ে খণ্ডটি পড়েছে সেখান থেকে নড়ি মেপে মেপে কেন্দ্রের দিকে ফিরে আসবে। এই ভাবে খেলতে যে বা যারা বেশি দূরত্ব আদায় করতে পারবে তারা জয়ী হবে। এ খেলাটি অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতো।
এই খেলাটিও রাখাল বালকদের। এ খেলায় মাঠ লাগে না। রাস্তার পাশে, নদীর পাড়ে বা কোনো সুবিধামতো জায়গায় গরু রাখার অবসরে রাখাল বালকেরা সুবিধামতো কিছু খেলা তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে। তাই এই খেলাগুলোকে রাখালি খেলা বলা হয়। খেলার নামকরণ অবশ্য তাদেরই নির্ধারণ করা। এককালে গ্রাম বাংলায় এসব খেলার খুব চাহিদা ছিল। রাখাল বালক ছাড়াও সবাই এ খেলাগুলো খেলতো। সাধারণত তিনটি খেলাই রাখালি খেলা নামে পরিচিত : পুথিবাড়ি, গোবর্ধন ও লাটি সস্বড়ি। তারা গাছের পাতা দিয়ে টস ধরে। টসে যে হেরে যায় তাকে সবাই ধাওয়া করে। তার হাতে থাকে একটি নড়ি। দৌড়ানো অবস্থায় যদি কোথাও এক টুকরা গোবর পায় তবে সাথে সাথে নড়ি দ্বারা ওই গোবর স্পর্শ করে। তখন আর কারোর অধিকার থাকে না তাকে ধাওয়া করার বা স্পর্শ করার। কিন্তু গোবর স্পর্শ করা অবস্থায় ভুলক্রমে যদি কেউ তাকে স্পর্শ করে তবে তাকেই দৌড়াতে হয়। গোবরকে নিয়ে এই খেলা, সম্ভবত এই কারণে এর নাম হয়েছে গোবর্ধন খেলা। এটি কদাচিৎ চোখে পড়ে।
এই খেলাটি খেলতেও নড়ি লাগে। ৭-৮ জন পরস্পর মিলে একটি চুক্তিতে অবদ্ধ হয়— এই খেলায় যে জিতবে সে কি পুরস্কার পাবে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিজয়ী বালক রাখাল রাজার মর্যাদা পাবে। নির্দিষ্ট একটি সীমা থেকে আনুমানিক দশ হাত দূরে একটি নড়ি আড়াআড়িভাবে বিছায়ে রাখা হয়। তারপর একে একে নড়ি মাটি ঘেষে সামনের দিকে ছুড়ে মারবে। তবে নড়িটিকে অবশ্যই স্পর্শ করে যেতে হবে। যার লাটি সবথেকে বেশিদূরে যাবে সেই জিতবে এ খেলায়। তারপর অন্যরা সবাই একত্রিত হয়ে সকল লাঠি বা নড়ি জড়ো করে ধরে রাখবে। বিজয়ী বালককে তাতে বসায়ে রাখাল রাজা সাজে চারিদিক বয়ে নিয়ে বেড়াবে। এ হলো লাঠি সস্বড়ি বা রাখাল রাজা খেলার তাৎপর্য।
বাইগ্যার বিলের নৌকা বাইচ : গোপালগঞ্জ জেলার বাইগ্যার বিল সকলের কাছে সুপরিচিত। চলন বিলের পরই এর স্থান। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপড়া, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর এবং মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলায় এ বিলের অবস্থান। তবে অধিকাংশ বিল কোটালীপাড়া উপজেলায় অবস্থিত। এই বিলের দক্ষিণে কোটালীপাড়া, উত্তরে মুকসুদপুর, পশ্চিমে কাশিয়ানী ও পূর্বে রাজৈর। সেকালে বাইগ্যার বিলের দৈর্ঘ ছিল ৬০ কিলোমিটারের বেশি। কালের আবর্তে বিলের মাঝে মাঝে বসতি গড়ে ওঠায় দৈর্ঘ প্রস্থ কমেছে। কিন্তু এখনও বিলটির অবকাঠামো ঠিকই রয়েছে। অর্ধশতাধিক বছর আগে এই বিলে কোনো চাষাবাদ হতো না। কারণ বিলের জমি পানিতে ডুবে থাকতো। কখনও জমি শুকাতো না। বিলে সারা বছর পানি থাকাতে মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত ছিলো। ঐতিহ্যবাহী এই বিলটি লোক সংস্কৃতির অঙ্গনেও নানা কারণে বিখ্যাত। এই বিলে অনুষ্ঠিত হয় শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ। বাইগ্যার বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি বিরাট নদী। এই নদীটি আড়িয়াল খার শাখা নদী।
নৌকা বাইচ
কোটালীপাড়া সীমানায় প্রবেশকালে অর্থাৎ কদমবাড়ি এলে এর নাম হয়েছে কালিঞ্জিরী কালিঞ্জিরী দক্ষিণে ঘাঘোর নামে পরিচিত। পুরো নদীটি বাইগ্যার বিলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। প্রতিবছর ১লা কার্তিক এই বিলের রামনগর থেকে কালিঞ্জিরী পর্যন্ত বয়ে যাওয়া নদীতে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক লোক নদীর দুইকূলে ভাসমান নৌকায় চড়ে বাইচ প্রদর্শন করে। দুপুরের পর থেকেই বাইচ শুরু হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই বাইচ দেখতে আসে। শুধু গোপালগঞ্জ জেলার লোকই নয়, মাদারীপুর ও বরিশাল জেলার অনেক লোক এই বাইচ প্রদর্শন করেন। বাইচের নৌকাগুলো হয় নানা রঙের। সাজিয়ে গুছিয়ে ঐদিন আনা হয়। বাদ্য বাজনা এবং সারিগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। সে কি অভূতপূর্ব দৃশ্য। এর শুরুটা কবে তা কেউই বলতে পারে না। বর্তমানে পানির স্রোত নেই, ক্ষীণগতি, কোথাও মরা মরা ভাব এই নদীটির। তবুও পুরোনো ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে। পহেলা কার্তিক নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয়।
বৌলতলী, সাতপাড় ও সানপুকুরিয়ার নৌকা বাইচ : লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে সম্প্রতি বৌলতলীর মেলাটি এলাকাবাসীর দৃষ্টি নন্দনে এসেছে। অবশ্য জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি সুদৃঢ় স্থান করে নিয়েছে এখানকার শারদীয়া দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে। এই জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র না করে লক্ষ্মীপূজায় কেন এই মেলার আয়োজন? সম্ভবত প্রাচীনকালে এই জনপদটি ছিল লক্ষ্মীপূজার জন্য অধিকতর আকর্ষণীয়। সঙ্গত কারণে মেলাটি লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মেলাটির বিশেষ আকর্ষণ নৌকা বাইচ। বিভিন্ন আকৃতির বাচাড়ি নৌকা এসে বাইচের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তদুপলক্ষে বিজয়ীদের জন্য পূজা উদ্যাপন পর্ষদও ভালো ভালো পুরস্কার বিতরণের আয়োজন করে থাকেন। নদীর দুই পাড়ের জায়গা ভরাট হয়ে যায় রঙ-বেরঙের দোকান, পসরা ও আপামর জনসাধারণের ভিড়ে। বাণিজ্যিক এই বৌলতলী বাজারের উত্তরপাশের কেকানিয়া থেকে নৌকা বাইচের পাল্লা শুরু হয়ে দক্ষিণের পদ্মবিলা পর্যন্ত যেয়ে শেষ হয়।
যতদূর জানা যায় ২০১১ সালে প্রথম সংস্কৃতিসেবী নারীরা মেলাটিতে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। মাদারীপুর বিলরুট ক্যানালের তীরে এই জনসভ্যতায় বিশেষ ৪টি স্থানে সাড়ম্বরে আজঅবধি নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে : জলির পাড়ের দুর্গাপূজার নৌকা বাইচ, সাতপাড়ে দুর্গাপূজার ও কালীপূজার নৌকা বাইচ ও সানপুকুরিয়ায় কার্তিক পূজার নৌকা বাইচ। প্রতিটি মেলায়ই কর্তৃপক্ষ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করে থাকেন। এলাকাবাসী পরম উৎসাহে অপেক্ষা করতে থাকে বর্ষ পরিক্রমায় কবে অনুষ্ঠিত হবে তাদের এই প্রাণের মেলা, মিলন মেলা।
ঘাঘর নদীর নৌকা বাইচ : পদ্মা নদীর অনেক স্রোতধারা শাখা নদীতে পরিণত হয়েছে এবং ফরিদপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ হয়ে দক্ষিণে বয়ে চলেছে। এদের মধ্যে মধুমতী, ঘাঘর ও আড়িয়াল খাঁ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঘাঘর ৫০০ বছর আগের পুরোনো নদী। কবি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য পদ্মাপুরাণে এই নদীটির বর্ণনা রয়েছে। ঘাগর নদীর স্রোতধারা সরাসরি মাদারীপুর জেলার রাজৈর হয়ে কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রবেশ করেছে। রাজৈরে এর নাম কালিঞ্জিরী। কালিঞ্জিরী থেকে এই স্রোতধারা বিভিন্ন জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে দক্ষিণে টুঙ্গীপাড়ার পাটগাতীর মধুমতীর মোহনায় মিশেছে। রাজৈর থেকে পাটগাতী পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কিলোমিটার।
কোটালীপাড়ার ঘাঘর নামক স্থানে এটি ঘাগর নদী নামে পরিচিত। এই নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে ৫০০ বছরের ঘাগর বন্দর। কোটালীপাড়া বিল বাওড়ের এলাকা। দু-তিনশো বছর আগে এখানে জাহাজ ভিড়তো। নীহাররঞ্জন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, নিৰ্মল সেন প্রমুখের লেখায় এসব তথ্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। কোটালীপাড়া হিন্দু প্রধান এলাকা। এখনও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেকালে উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা দুর্গাপূজা মহাসমারোহে উদ্যাপন করতো। কলকাতা থেকে হিন্দুরা আসতো গ্রামের বাড়িতে পূজা উদ্যাপনের জন্য। দুর্গাপূজা উপলক্ষেই ঘাগর নদীতে অনুষ্ঠিত হতো নৌকা বাইচ। সাজানো শত নৌকা এতে অংশ নিতো। দুপুর থেকে নদীতে নৌকা আসা শুরু হতো। আবার কোনো কোনো নৌকায় থাকতো বিসর্জনের দেবী দুর্গা। নৌকা বাইচের পর চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো মা ‘দুর্গা এবং তাদের সন্তানদের। আনন্দের মাঝে বিসর্জনের বেদনা একাকার হয়ে যেত। ঘাগর নদীর নৌকা বাইচ এখনও অনুষ্ঠিত হয়। জোয়ার-ভাটার গতি কমে গেলেও নদীটি এখনও মরে যায়নি। তবে নৌকার সংখ্যা কমেছে। সেকালের লম্বা নৌকাগুলো আর নেই। এখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাইচ অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে আড়ং শব্দটি এখনও পরিচিত। বাংলার আদি লোক সংস্কৃতিতে আড়ং-এর ভূমিকা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। সেকালে এই আড়ং উপলক্ষেই ষাঁড়ের লড়াইয়ের আয়োজন করা হতো। পুরো গোপালগঞ্জ জেলা ছিল কৃষি প্রধান। বছরে মাত্র দুটি ফসল উৎপাদন করতো কৃষকরা। আষাঢ়-শ্রাবণে আউশ ধান আর অগ্রহায়ণ-পৌষে আমন ধান।
আমন ধান কাটার পরে জেলার নির্ধারিত স্থানসমূহে বসতো আড়ং। অভিধানে আড়ংয়ের অর্থ গোলা, গঞ্জ ও হাট করা হলেও লোকায়ত সংস্কৃতিতে বিশেষ করে জেলার সাধারণ মানুষের কাছে এর অর্থ ষাঁড়ের লড়াইয়ের একটি দিন। এদিন সাজানো হতো মাঠ। মাঠের চারপাশে বসতো ছোট খাটো দোকান। ষাঁড়ের লড়াই দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসতো। লড়াই শুরু হতো অপরাহ্নে। যেকোনো ষাঁড়ের মালিক এতে অংশ নিতেন। এ ছিল এক মহা আনন্দের ব্যাপার। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই আনন্দের ভাগীদার হতেন। সর্বজনীন এই আনন্দ লোকজীবনের ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ যেন কৃষিজীবী সমাজের ঐক্য-একাত্মতার লোকাচার। যা বছরের একটি দিনে সবার জন্য অপেক্ষা করে।
ষাঁড়ের লড়াই
সেকালে চাষাবাদের প্রধান উপকরণ ছিল গরু। গরুর মধ্যে গাভী ও ষাঁড় ভিন্ন ধরনের। গাভী বা গাই স্ত্রী জাতীয়; আর যে গরু বয়ষ্ক হবার আগে অন্ডকোষ ফেলে দিয়ে বড় করা হয়, সেগুলো পুরুষ জাতীয় গরু। যে সকল গরুর অন্ডকোষ ফেলে দেওয়া হয় না, সেগুলোই ষাঁড় নামে পরিচিত। তাই ষাঁড়ের লড়াইয়ে ষাঁড়-গরুই অংশ নেয়। কোষ ফেলে দেওয়া কোনো গরু এতে অংশ নিতে পারে না শারীরিক অসমর্থতার কারণে। বলদ গরু কমশক্তিশালী থাকে। লড়াইয়ে শক্তিশালী বলবান ষাঁড়ই প্রয়োজন হয় এবং অংশ নিয়ে থাকে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, লড়াইয়ে যেকোনো ষাঁড়-গরু অংশ নেবার উপযুক্ত হয় না। এজন্য একটি ষাঁড়কে আলাদা করে আলাদাভাবে দুইতিন মাস লালন পালন করতে হয়। কখনও অন্ধকার ঘরে ষাঁড় রাখা হয় এবং উপযুক্ত ঘাস বিচুলি নিয়মিত দিতে হয় এবং যে আড়ং-এর লড়াইয়ে অংশ নেবে, সেই আড়ং-এর দিন তাকে ঘর থেকে বের করে গোসল করিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে শক্ত দড়িতে বেঁধে লড়াইয়ের মাঠে নেওয়া হয়।
কোটালীপাড়ার কুরপালা কাজীবাড়ির সামনের মাঠে এক সময় বসতো আড়ং। এই আড়ং উপলক্ষে জমজমাট ষাঁড়ের লড়াই হতো। শত শত সাজানো ষাঁড় আসতো উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে। লড়াই শেষে পুরস্কার প্রদান করা হতো ষাঁড়ের মালিককে। হাজার হাজার মানুষ ষাঁড়ের লড়াই দেখতে গিয়ে মেলার আনন্দ উপভোগ করতো। আধুনিক চাষাবাদ শুরু হবার কারণে গরুর লালন-পালন কমেছে। শক্তিশালী ষাঁড় গরুর দেখা মেলা ভার। তাই ষাঁড়ের লড়াই এখন আর আগের মতো অনুষ্ঠিত হয় না।
ঘোড়াদৌড় ও গরুদৌড়ের জন্য এককালে গোপালঞ্জের হাটবাড়িয়া, পিঠাবাড়ি, টুঠামান্দ্রা, কুমরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের ছিল খুব সুনাম। লোকসংস্কৃতির অনুরাগী এমন একজন ব্যক্তিত্ব শুকদেব বিশ্বাস (৬২) জানালেন বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ, বাড়িঘর বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে এই লোকজসংস্কৃতির এখন খুব দৈন্য দশা। তবে অনিয়মিতভাবে অত্র অঞ্চলে ঘোড়াদৌড় হয়ে থাকে। নির্ধারিত কোনো স্থান বা পার্বণকে ঘিরে এই প্রতিযোগিতা হয় না। বিশেষ করে পিঠাবাড়ি গ্রামটির নাম এখনও মানুষ স্মরণ করে ঘোড়াদৌড় ও গরুদৌড়ের জন্য। তিনি আরও জানালেন সাতপাড় সূর্য তরুণ ক্লাবের উদ্যোগে শীতের মৌসুমে সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে দক্ষ সাইকেল চালকগণ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে।
ঘুড়ি উড়ান সংস্কৃতি নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল কিংবা দেশে সীমাবদ্ধ নেই। বিভিন্ন দেশে এই সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায়। চীন জাপানের ছেলেমেয়েরা খুব সখ করে ঘুড়ি উড়ায়। আমাদের দেশে ঘুড়ি উড়ানোর মৌসুম হলো চৈত্র বৈশাখ মাস। এখানে দেখা যায় উন্মুক্ত ধান ক্ষেতে যখন কঁচি ধানগাছ হেলে-দুলে নাচে তখন তারমধ্যে ছেলেরা ঘুড়ি উড়ায়। যেসকল ঘুড়ি এই নীল আকাশে দেখা যায় তারমধ্যে ত্যালপতেঙ্গা ঘুড়ি, জের ঘুড়ি ও ঢ্যাপস ঘুড়ি উল্লেখযোগ্য। ঘুড়ির মাথায় এক ধররের যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। একে ভেরি বলে। তাতে বাতাস লেগে রি….রি….একটা শব্দ হয়। সুতার কাছে কান রাখলে তা সুস্পষ্ট অনুভব করা যায়। আড়ুয়াকংশুরের সুধন্য চৌধুরী ছিলেন এই ঘুড়ি নির্মাণের একজন দক্ষ কারিগর।
চুলের জড়তা খুলতে আগের দিনের মানুষ প্রায়ই লাল মাটি গুলিয়ে মাথায় লেপ দিয়ে রাখত। এখনও মানুষ অল্প-স্বল্প হলেও তা ব্যবহার করে থাকে। তবে সব মৌসুমে এটির ব্যবহার প্রচলিত নয়। বিশেষ করে চৈত্র বৈশাখ মাসে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে মাথায় লাল মাটির লেপ দিয়ে রাখে। চুলের জটলা খুলতে ও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে এই পদ্ধতিটা খুবই উপকারী। এরসাথে তারা তিলের পাতা মিশায়ে নিত। তিলের পাতা মিশালে চুল খুব ঝুরঝুরে হয়। ডিটারজেন্ট বা সাবানের পরিবর্তে মাটির ব্যবহার গ্রাম্য লোকেরা অধিকতর নিরাপদ মনে করত। পূর্বে পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার করতে অনেকে ছাই ব্যবহার করতো। তবে সব ধরনের জ্বালানির ছাই থেকে নয়। বিশেষ করে তিল গাছের ছাই ও বাদাম গাছের ছাই, এতে খারের গুণাগুণ বেশি। তাই তারা এগুলোর ছাই সংরক্ষণ করে রাখত।
১. মো. লিয়াকত আলী মোল্লা, গ্রাম-সোনাটিয়া, কোটালীপাড়া।
২. অ্যাডভোকেট আবদুল হালিম ফকির, সিতাইকুণ্ড, কোটালীপাড়া।
৩. শেখ বুলবুল এ জাফর, গ্রাম : সিতাইকুণ্ড, উপজেলা : কোটালীপাড়া।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন