লোকউৎসব (Folk Festival )

লোকউৎসব

১. নববর্ষ

নববর্ষ অর্থ নতুন বছর। বাঙালির জীবন নির্বাহের ক্ষেত্রে নববর্ষ বলতে বোঝায় ১লা বৈশাখকে। আমরা অনেকেই জানি এদেশে তিনটি বর্ষ প্রচলিত আছে। আর এগুলো প্রচলিত ছিল সেই মোগল ও ইংরেজ আমলে। তারও আগে শকাব্দ সন চালু ছিল এই অঞ্চলে। এদেশে মুসলমানরা চালু করেন হিজরি সন, যার উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্যে। ইংরেজরা চালু করেন খ্রিষ্টাব্দ।

সম্রাট আকবর ছিলেন ভারতবর্ষের জনপ্রিয় শাসক। তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তার মন্ত্রীরা সদস্য আমির ফতেহ উল্লাহ সরাজীর মাধ্যমে বাংলা সন চালু করেন এবং বৈশাখকে প্রথম মাস নির্ধারণ করেন সেই ১৫৫৬ সালের ১১ই এপ্রিল। আর বাংলা নববর্ষ শুরু হয় ১৫৮৫ সালে। পয়লা বৈশাখ মানে বাংলা সনের বৈশাখ মাসের প্রথম দিন। এ দিনটি নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে আমাদের দেশে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে পালন করা হয়। জেলার সর্বত্র বাংলা নববর্ষ আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।

বাংলা সনের প্রাচীন উৎসব অনুষ্ঠান : বাংলা নববর্ষের সাথে কতকগুলো সর্বজনীন এবং কিছু আঞ্চলিক উৎসবের যোগ রয়েছে। সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে আছে মেলা। গ্রামবাংলায় চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখে প্রাচীনকাল থেকেই অনেকে মেলা থেকে সারা বছরে সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতো। এসব দ্রব্যের মধ্যে ছিল শখের জিনিস যেমন-পুতির মালা, সুগন্ধী তেল, সাবান, আলতা, খেলনা, খাদ্যদ্রব্য, হাঁড়ি- পাতিল, দা-কুড়াল, বটি ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল বিনোদনের আয়োজন নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বায়স্কোপ, যাত্রা ইত্যাদি।

পুণ্যাহ : জমিদার বাড়িতে এই অনুষ্ঠন হতো। প্রজারা জমিদার বাড়িতে যেয়ে ওই দিন খাজনা দিত এবং জমিদার বাড়িতে মিষ্টিমুখ ও আদর-আপ্যায়নের সুযোগ পেত। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর বাংলাদেশ থেকে এ উৎসব উঠে গেছে। তবে এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই প্রথা চালু আছে।

হালখাতা : হালখাতাও একটি সর্বজনীন উৎসব। এটা প্রধানত ব্যবসায়ীদের অনুষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা সেদিন পুরনো বছরের হিসাব নিকাশ সমাপ্ত করে এবং নতুন বছরের জন্য হিসেবের খাতা খোলে। সেদিন তারা ক্রেতাদের আপ্যায়ন করে থাকে।

আমানী : কৃষকের নববর্ষের সুপ্রাচীন আচারমূলক অনুষ্ঠান। চৈত্র সংক্রান্তির রাতে বাড়ির গিন্নি একটি ঘটে আতব চাল এবং আমের কচি ডালের গোড়া ভিজিয়ে রাখতেন। সকালে বাড়ির সকলের গায়ে সেই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। লোকবিশ্বাস নববর্ষে এতে বাড়ির সকলের সুখ-শান্তি বজায় থাকবে।

২. নবান্ন

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলের এই বঙ্গদেশে ফসল পার্বণের মধ্যে নবান্ন উৎসব অগ্রগণ্য। বহুপূর্বে অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। অগ্র মানে প্রথম বা আগ, আর হায়ন মানে বছর। বছরের প্রথম মাস বলে অগ্রহায়ণ মাস নামকরণ করা হয়েছিল। অন্যান্য মাস থেকে এই মাসের ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। নবাগত শীতের আমেজের এই ঋতুটি নতুন ধান ও নানাবিধ সুখাদ্যের জন্য ছিল প্রসিদ্ধ। সদ্য তোলা কাঁচা ধানের গতর থেকে মৌ মৌ সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো। কৃষক পরিবারগুলোতে বয়ে যেত অনাবিল আনন্দ। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলো জেগে উঠতো নবান্ন উৎসবের পসরা নিয়ে। এই নবান্ন উৎসবটি সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমান সেচ প্রকল্প ও বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের ফলে আমন ধানের চাষ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ কারণে এই জনপদে আগের মতো ধুমধামের সহিত নবান্ন উৎসব পালিত হয় না। বিশেষ করে এটি একটি পারিবারিক উৎসব। নবান্ন উৎসব পালনকারী একজন গৃহকর্তা কংশুরের গৌরাঙ্গ দাস বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করলেন-’এই নবান্ন পার্বণটি পিতৃপুরুষদের পার্বণ হিসেবে আমরা গণ্য করে থাকি। যদিও এর কলেবরে আগের থেকে অনেক ভাটির চিহ্ন লেগেছে। আজও ঐ দিনে আমরা পূর্ব পুরুষদের শ্রদ্ধা-অর্পণে স্মরণ করে থাকি। ব্রাহ্মণদেরকে উপস্থিত রেখে জাঁকজমক সহকারে ছোট বেলায় আমরা এই পার্বণ করতে দেখেছি। এখনও মাঝে মাঝে এই উৎসবটি পালন করি বটে, আগের মতো আর হয় না। নতুন ধানের শীষ থেকে ধান ছাড়ায়ে পৃথক করে রাখতে হয়। সেই ধানের চাউল গুঁড়া করে দুধ ও মিষ্টি দ্রব্যের সাহায্যে তৈরি করা হয় নবান্ন। চিড়া-মুড়ি ফলমুল এগুলোও থাকে। পাড়া- পড়শি উপভোগ করে এই নবঘন পার্বণটি। তদুপরি প্রত্যেক গেরস্ত সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন করে থাকতো। বাংলায় এসব ঐতিহ্য ধীরে ধীরে যেন মুছে যাচ্ছে। এগুলো ধরে রাখার জন্য মানুষ কই?’

৩. ফল্গু-উৎসব

ফাল্গুনী পূর্ণিমা ও প্রতিপদের সন্ধিক্ষণে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা উৎসব হয়। অনুষ্ঠানের আগের দিনে হয় বহ্নুৎসব। এই বহ্নুৎসব খুব আনন্দ সহকারে কিশোর বালকরা উপভোগ করে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ যখন সখিদের নিয়ে এই আনন্দঘন উৎসবের আয়োজন করলেন তখন বাধ সাধলেন কুটিলা। হোলিখেলার আগের দিন কুটিলা বুড়ি একটি পর্ণ কুটিরে বসে তাদের অমঙ্গল কামনা করতে থাকেন। কৃষ্ণের সাথিরা তা জানতে পেরে কুটিলা বুড়ির সেই পর্ণ কুটির আগুন ধরিয়ে ভস্মিভূত করে দেয়। সেই থেকে দোলের আগের দিন কিশোর বালকরা রাশীকৃত খড় ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ সংগ্রহ করে একটি কুড়ে ঘর বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এটি হলো বহ্নুৎসব। দোলের দিনে রাধাগোবিন্দের দোলার সঙ্গে হোলিগান গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা বের হয়। সাতপাড় বৌলতলী, কুষ্ণপুর এলাকায় কৃষ্ণভক্তরা এই হোলি খেলায় অংশ নেয়। রাস্তাঘাটে দেখা যায় রঙের ছড়াছড়ি।

৪. গায়ে হলুদ

বিয়ের আগের দিনে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান খুবই আকর্ষণীয়। এই অনুষ্ঠান উভয় পক্ষের স্ব-স্ব বাড়িতে হয়। পাড়ার বৌ-ঝিরা আসে গায়ে হলুদ লাগাতে। রান্না করা হয় ক্ষীর- পায়েস। তিল-তুলসী-দূর্বা-ধান কপালে ছোঁয়ায়ে হিন্দু পরিবারগুলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পাদন করে। যেসকল সধবার সন্তান-সন্ততি অক্ষত ও জীবীত আছে কেবলমাত্র তারাই বর ও কনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানাদির কর্ম ক্রিয়া করে থাকে। হাতে মেহেদি, গায়ে হলুদ ও পায়ে আলতা দিয়ে কনেকে করে তোলে সৌন্দর্যময়ী। তেমন একজন সধবা নারী মঞ্জু রাণী দাস (৫২) বললেন, ‘এই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আমরা গানও গেয়ে থাকি।’ যেমন-

কওছে কওছে কওছে অলদি
তোমার জন্ম কাহার লাগি রে অলদি
আমার জন্ম বাঁশ বাগানে
নবীনা নয়নার গায়ে লাগি
ওরে সখি নবিনা নয়নার গায়ে লাগি।
কওছে কওছে কওছে অলদি
তোমার জন্ম কাহার লাগিরে অলদি
আমার জন্ম ঘরের কানছি
কামিনীর গতরে লাগি
ওরে সখি কামিনীর গতরে লাগি।

৫. বিবাহ

বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে চলে বর-কনে দেখা দেখির পর্ব। সর্বাগ্রে কনে দেখার পর্ব। ছেলের অভিভাবকগণ ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি পূর্ব নির্ধারিত দিনে কনে দেখতে যান। কনে দেখার অনুষ্ঠানে কনের পক্ষ নামী দামী খাবারের আয়োজন করে বর পক্ষকে দুর্বল করতে চেষ্টা করে। কনে দেখার পর্বটি বেশ চমৎকার। বর পক্ষ গোলাকৃতি হয়ে নকশিকাঁথায় বসে। কনে পানের থালা নিয়ে এসে ভক্তি করে ওই আসরের এক কোণে আশ্রয় নেয়। অন্তর তার থর-থর করে কাঁপতে থাকে। না জানি কি বলে আর কি বলি। বরের পক্ষ থেকে টুকি-টাকি প্রশ্ন ছুটে আসে। তার ভিতর প্রথম থাকে ‘তোমার নাম পরিচয়’ বল। সব থেকে মজার ঘটনা হলো- বাড়ির অন্যান্য বালিকারা ও মহিলারা দরজার ফাঁক, বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনুষ্ঠান দেখে আর ফ্যাশ ফ্যাশ করে কন্যাকে উত্তর দানে সহায়তা করে। বরপক্ষ মেয়ের রূপ-গুণ, বাড়ির পরিবেশ, বংশ মর্যাদা, আপ্যায়ন সব যাচাই করে পছন্দ অপছন্দ নির্ধারণ করেন। মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে মেয়ের সম্মানার্থে নগদ টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়।

ছেলে দেখার পর্বটি ঐরকম। কনের অভিভাবকবৃন্দ ছেলের বাড়ি গিয়ে পরিবেশ, আর্থিক অবস্থা, ছেলের চরিত্র সবকিছু দেখে পছন্দ হলে উভয় পক্ষ পঞ্জিকা দেখে ভালো দিনক্ষণ ঠিক করে বিয়ের দিন ধার্য করেন। তবে বিয়ের আগে বরপক্ষ কনের বাড়িতে গহনা, কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্যাদি নিয়ে আশীর্বাদ করে আসে। এতে থাকে সোনার আংটি, বড় রুই মাছ, পান-সুপারি, মিষ্টি ইত্যাদি। অতঃপর বর কনে অপেক্ষা করতে থাকে কবে আসবে সেই বিয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।

বিয়ে : গায়ে হলুদের পরে প্রতীক্ষার চাওয়া সেই বিয়ে অনষ্ঠান, সবাই এক পলক দেখতে চায়। কনের বাড়িতেই সেই বিয়ে পর্ব সু-সম্পন্ন হয়। নওশা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় টোপর পরে বরযাত্রীদের প্রধান আকর্ষণ ও মধ্যমনি হয়ে উপস্থিত হয় কনের বাড়ির সিংহ দরজায়। অনেকে শেরওয়ানি পরেও জামাই সাজে, পায়ে থাকে নাগরা জুতা। এক্কেবারে শাহেন শাহ্। বরযাত্রীর প্রবেশ দ্বারে সুসজ্জিত করে বানানো হয় গেট। ওই গেটে কনের পক্ষের যুবক যুবতীরা চিনি, বাতাসা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। এ দিকে বরের শুভাগমন সংবাদ পেয়ে কনে দুধ পানিতে হাত ভিজিয়ে রাখে। যতক্ষণ পর্যন্ত কাবিন রেজিস্ট্রি না হবে, ততক্ষণ কনেকে দুধ পানিতে হাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। এর অর্থ হলো দাম্পত্য জীবনে বরের মেজাজ ও মর্জি দুধ পানির মতোই ঠান্ডা থাকবে। সেই প্রবেশ দ্বারে অবস্থানরত যুবক-যুবতীদের প্রবেশ মূল্য না চুকিয়ে ওই ভবসমুদ্র পার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অনেক সময় উভয় পক্ষের মধ্যে চলতে থাকে বাকবিতণ্ডা। নানা ধরনের প্রশ্নও ছুঁড়ে মারা হয় বর পক্ষের দিকে। যেমন-

‘আসসালামু আলাইকুম অ্যান
নওশা আইছে শাদী করতে
তোমরা আইছ ক্যান’।

বরের পক্ষ এর উত্তর দিচ্ছে এমনভাবে-

ওয়ালাইকুম সালাম ওভা
নওশা আইছে শাদী করতে
আমরা তার শোভা।

অবশেষে কথা কাটাকাটি শেষ করে বরকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় বিবাহ অনুষ্ঠানে। বিয়ে শেষে কন্যা বিদায় পর্ব আসলে হৃদয় বিদারক এক দৃশ্য। মা-বাবা-ভাই-বোন তাদের এত দিনের পালিত ধন আজ সে আপন ঘরপানে চলে যাচ্ছে। তাদের দাম্পত্য জীবন কেমন কাটবে, কীরকম হবে ভবিষ্যৎ জীবন। সকলে অশ্রু-সজল চোখে বিদায় দেয় নব দম্পতিকে।

হিন্দুদের বিয়ে সধারণত রাতে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিয়েতেও গেটে প্রবেশ মূল্য না দিয়ে ঢোকার কোনো সুযোগ থাকে না। বিয়েতে উঠানে সুসজ্জিত করে বসার ব্যবস্থা করা হয়। মুখোমুখি হয়ে কনের পক্ষ ও বরপক্ষ বসে। গ্রামবাসী প্রথমে জানতে চায় বর কে? তার পর বরযাত্রীদের মাঝখানে থেকে বড় উঠে এসে প্রণাম করে সামনে পিড়িতে এসে বসে। বরকে রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্ন শেষে কনের পক্ষ বা গ্রামবাসী বরপক্ষের কাছে আর্থিক সাহায্য চায়। ওই আর্থিক সাহায্য গ্রামের সার্বজনীন কোনো কাজে ব্যয় করা হয়। পরিশেষে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে একজন দাঁড়িয়ে বরকে আশীর্বাদ করে থাকেন। তারপর বরকে নিয়ে যাওয়া হয় বিয়ের পিড়িতে। হিন্দুমতে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিবাহ হয় না। চন্দ্র, সূর্য, আগুন, জল সাক্ষী রেখে পিতা, পিতার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কন্যা দান করে থাকেন।

৬. চড়কপূজা বা চণ্ডীপূজা

চড়কপূজা বা চণ্ডীপূজা গ্রাম বাংলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। চড়কপূজার মাধ্যমেই শিবাসন বা নীলপূজার সমাপ্তি ঘটে থাকে। চড়কপূজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক মেলা। পূর্বপাড়া গ্রামে অনুষ্ঠিত চড়ক উৎসব সর্বজনবিদিত। শত শত বছর বয়স এই চড়ক উৎসবের। পূর্বপাড়া চড়ক উৎসবের আকর্ষণীয় দিক হলো শত বছরের পুরোনো চড়কগাছটি পুকুর থেকে তুলে চড়ক মন্দিরের দক্ষিণ মাঠে পোতা এবং মানতকারী বানফোড়া মানুষগুলোকে চড়কগাছে ঘোরানো। এ উপলক্ষে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয় তাকে বলা হয় চড়কের মেলা। হিন্দু-মুসলমান এই অনুষ্ঠানে সমবেত হয়ে উপভোগ করে চড়কের চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠানমালা। চড়কপূজার দিন একটি পাত্রে শিবের বিগ্রহ রাখা হয়। এই পূজার আনুষঙ্গিক বানফোড়া, চড়কগাছে ঝোলানো, হাতে, জিহ্বায় ও পিঠে লোহার শিক বিদ্ধ করা এবং জলন্ত শিক শরীরে ফোড়া হয়। এ উপলক্ষে মেয়েরা শিবের গাজন গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়ায়। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকার এ পূজার কিছু নিয়ম বন্ধ করলেও পূর্বপাড়ার চড়ক উৎসবে এসব দেখা যায়। সাতপাড়, টুঠামান্দ্রা, হাইশুর, রাউৎপাড়া ও অন্যান্য স্থানে এই চড়ক মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

চড়কপূজা বা চণ্ডীপূজা

এই চড়ক সম্পর্কেও গায়ক খোকন বিশ্বাসের বর্ণনাটি ছিল এরকম-’শ্রীকৃষ্ণ সখিদের নিয়ে একদা রাসলীলা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। শিবঠাকুর ভাবলেন আমি যাব ওই রাসলীলা দেখতে। তাই নিজরূপ গুপ্ত করে নারী রূপ ধারণ করে তিনি যোগ দিলেন ঐ লীলা অনুষ্ঠানে। দেখা গেলো রাস চলছে না। শ্রীকৃষ্ণ বললেন হয়তো এখানে কোনো কামুক এসেছে। তাই তিনি একে একে পরীক্ষা করতে লাগলেন, দেখি সে কে। সত্যিই শিবঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন এখান থেকে ওই কামুক ভোলাকে বের করে দাও। এতে ভোলানাথ খুব ক্রোধান্বিত হলেন। ভীষণভাবে লজ্জিত হলেন। রাগে ভোলা মহেশ্বর নিজের মাথার জট ছিড়ে ফেলে দিলেন। কী ভয়ানক দৃশ্য! এতেও শিবঠাকুরের রাগ সম্বরণ হলো না। তাই তিনি নিজের লিঙ্গ ধরে ছিড়ে ফেললেন। ছিন্ন লিঙ্গ ভূ-পৃষ্ঠে থরথরি কম্পে লাফাতে শুরু করে। পৃথিবী থরথর কাঁপছে। ধরা প্রায় রসাতলে যায়। দেবতারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ছুটে গেলেন গোলাকবিহারী নারায়ণের নিকট। বললেন প্রভু এখন কী করা। শিবঠাকুর নিজ লিঙ্গ ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন। ছিন্ন লিঙ্গের কম্পনে ধরা যে রসাতলে যেতে বসেছে। প্রভু নারায়ণ বললেন, ভয় নেই শিব লিঙ্গের পূজা কর। এতে ধরা রক্ষা পাবে। সেই থেকে শুরু হয় শিবলিঙ্গ পূজা। এই শিবলিঙ্গের পূজায় অনেক লোমহর্ষক করণ ক্রিয়া স্থান পেয়েছে। যেমন : পিঠে বড়শি ফুঁড়ে চণ্ডীতে ঘুরানো, খেজুর সান্ন্যাসী ইত্যাদি। খেজুর সন্ন্যাসী চৈত্র সংক্রান্তির দিন বা তার আগেও যেকোনো দিন হতে পারে। খেজুর সন্ন্যাসী হলো খেজুর গাছের মাথায় উঠে কাঁটাযুক্ত ডগা মাড়িয়ে হেঁটে বেড়ানো। এতে সাধারণত শিবাসন বা লিঙ্গপূজায় যারা শাং হিসেবে নিযুক্ত থাকে তারাই অংশ নেয়। তারপর খড়গের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এবং দাঁড়ানো অবস্থায় অন্যরা তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। তবে চড়ক ঘোরা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এক পলক চড়ক ঘোরা দেখতে। পিঠে খালি বড়শি বিধে কীভাবে একটা মানুষকে ঘুরানো হয় বা সে স্বেচ্ছায় ঘোরে তা অনেক দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

৭. জন্মাষ্টমী

জন্মাষ্টমী তিথিতে পূজিত হয় কৃষ্ণের বালগোপাল মূর্তি। এর অপর নাম জন্মাষ্টমী। পালনকারীরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারিখ বা তিথি ভাদ্র কৃষ্ণাঅষ্টমী। পালনের ধরন হচ্ছে উপবাস, কৃষ্ণপূজা, ভক্তিমূলক গান, আলোচনা সভা ইত্যাদি। সম্পর্ক কেবল শ্রীকৃষ্ণের লীলা মাহাত্ম্য।

জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণাষ্টমী হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। এটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিনী ও শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী ইত্যাদি।

হিন্দু পঞ্জিকা মতে সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিনী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয় তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। উৎসবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতিবছর মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময় পড়ে। অনুষ্ঠানটি রাধাকৃষ্ণ, গোবিন্দ, বালকৃষ্ণ, জগন্নাথ, শ্রীনাথজি এবং অন্যান্য নামেও পরিচিত। কৃষ্ণ ভক্ত ও বৈষ্ণব ভক্তরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। এই উৎসবে যেসকল ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয় তারমধ্যে ভগবত গীতা, পুরাণ, গীতগোবিন্দ, মহাভারত ও ব্রহ্মসংহিতা উল্লেখযোগ্য। গোপালগঞ্জের প্রায় প্রতিটি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে এই জন্মাষ্টমী ব্রত পালন হতে দেখা যায়। শ্রীকৃষ্ণ বন্দনা ও পারণ শেষে পরদিন ভক্তরা মহা প্রসাদ গ্রহণ করে থাকে। গোপালগঞ্জের সদর উপজেলায় কংশুর গ্রামে গৌরাঙ্গ দাসের বাড়িতে প্রতিবছর মহা ধুমধামের সাথে এই অনুষ্ঠানটি পালন হয়ে থাকে।

৮. পৌষ সংক্রান্তি

১.

ও-ওরে ঘোষ গেলো বাথানে সইরে যশোদা গেলো ঘাটে
ও-ওরে শূন্যগৃহ পাইয়া কৃষ্ণ সকল ননী লোটে।
ও-ওরে ননী খাইছে কেরে কৃষ্ণ ননী খাইছে কে
ও-ওরে আমি কৃষ্ণ খাই নাই ননী দাদা খেয়েছে।
ও-ওরে আমি যদি খাইতাম ননী থুইতাম আধাআধি
ও-ওরে ভাই বলরাম খাইছে ননী ভাণ্ড করছে খালি।
ও-ওরে ছাটি হাতে নন্দরাণী পিছে পিছে ধায়
ও-ওরে লম্ফদিয়া উঠল কৃষ্ণ কদমের শাখায়।
ও-ওরে নামো নামো ওরে কৃষ্ণ পেড়ে দেব ফুল
ও-ওরে ডাল ভাঙিয়া পড়বা কৃষ্ণ মাজা ভাঙার কুল।
ও-ওরে ডালে ডালে হাঁটে কৃষ্ণ পাতায় দিয়া পাও
ও-ওরে তাই দেখিয়া নন্দরাণীর চমকে উঠে গাও।
ও-ওরে একে সত্য দুইয়ো সত্য তিনো সত্য কর
ও-ওরে নন্দ হয় তোমার পিতা আমায় যদি মার।
ও-ওরে নেউলিয়া উচুঁলায়ে রাণী কৃষ্ণকে নামাল
ও-ওরে গাভী ছান্দা দড়ি দিয়া কৃষ্ণকে বান্ধিল।
ও-ওরে মেরো না মেরো না মাগো বন্ধন জ্বালায় মরি
ও-ওরে মাতুলোরও ধেনু রেখে দেব ননীর কড়ি।
ও-ওরে চেন না চেন না মাগো আমি কৃষ্ণ কে
ও-ওরে এমন সাধ্য নাইরে কের আমায় বাঁধতে পারে।
ও-ওরে পূর্ব জন্মের ছিলে মাগো নামে ধরাসতী
ও-ওরে কাটাস্তনের দুগ্ধ খেয়ে মাগো আমায় বান্ধিলি।

২.

যে দেবে সরায়
তান্নক্ষ্মী খরায়
যে দেবে মুঠি মুঠি
তার আঙুল কুটি কুটি
যে দেবে আচ্যায়
তান্নক্ষ্মী ছ্যাচায়
যে দেবে স্যারে
তান্নাক্ষ্মী ঘরে, ইত্যাদি।

এভাবে যুবকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল বা অর্থ সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নেয় বাস্তুপূজার। সংক্রান্তির দিনে নদীর কূলে বা পুকুর পাড়ে কিংবা কোনো জলাশয়ের তীরে মাটি দিয়ে বেদি তৈরি করে বাস্তুভিটা কল্পনা করা হয়। বাস্তপূজা মানে মাতৃভূমিকে পূজা করা। মাতৃভূমিকে স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ আসন দেওয়া হয়েছে। শাস্ত্রে এর উল্লেখ আছে–’জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়ষী’। বেদীর কোনো এক ধারে এমনভাবে একটি কুমীর বানায়, মনে হয় যেন বাস্তু ভিটাকে গ্রাস করতে ছুটে আসছে। পূজা শেষে পূজারীগণ কুমীরকে বহিঃশত্রু কল্পনা করে দা বা অন্য কোনো অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে।’ এদিকে বাড়িতে বাড়িতে কুলবধূরা বিভিন্ন রংয়ের মাটি বা রং গুলিয়ে উঠানে নানা প্রকার লতাপাতা, পদ্ম ও ছবির আল্পনায় মনোমুগ্ধকর করে তোলে। শুরু হয় চিড়া- মুড়ি খাওয়ার মহা আয়োজন। খাওয়ার এ আনন্দে থাকে না কোনো জাতি ভেদাভেদ। দল বেঁধে এ ঘর থেকে অন্য ঘরে, এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি চলে মুড়ি খাওয়ার মহোৎসব।

৯. রথযাত্রা

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে উৎসবটি উদযাপিত হয়ে থাকে। জগন্নাথ দেবের রথ-ভ্রমণ উৎসব বলেও এটি খ্যাত। ভারতীয় রাজ্য ওড়িশা বা উৎকল দেশ ও পশ্চিমবঙ্গে মহাধুমধামের সাথে রথযাত্রা উৎসব ভক্তরা পালন করে থাকে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। এই উপমহাদেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের মহিষাদল ও বাংলাদেশের ধামরাই জগন্নাথ রথ ও ইসকনের রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ। গোপালগঞ্জেও এই রথযাত্রা উৎসবটি বিশেষভাবে পালিত হতে দেখা যায়। এই উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

রথযাত্রার ধরন : রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরসহ এই উপমহাদেশ জুড়ে সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শন চক্রমূর্তি মন্দিরের বাইরে সর্ব সমক্ষে বাহির করা হয়। তারপর তিনটি সুসজ্জিত রথে (কোনো কোনো স্থানে একটি সুসজ্জিত বৃহৎ রথে) বসিয়ে দেবতাদের পূজা সম্পন্নপূর্বক রথ টানা হয়। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। এই তিথিতে গোপালগঞ্জ জেলায়ও বহু জগন্নাথ ভক্ত এক আনন্দঘন পরিবেশে রথ টেনে থাকে। পুরীতে বছরে এই একদিনই অহিন্দু ও বিদেশিদের মন্দির চত্বরে এসে দেবদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। পুরীতে যে রথগুলো নির্মিত হয় তাদের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। টেলিভিশন চ্যানেলে এই রথযাত্রা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

১০. গার্সি

গার্সি শব্দের কোনো আভিধানিক অর্থ পাওয়া যায় না। সঙ্গত কারণে কিংবদন্তি ও কথকথাকারদের ব্যাখ্যা বিবরণী নিয়ে অদ্যবধি গোপালগঞ্জ, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, কোটালীপাড়া, টুঙ্গীপাড়া, মাদারীপুর ও এর আশপাশ এলাকাগুলোতে মহাধুমধামে দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে। কিংবদন্তি হতে এই পার্বণটি সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা এরকম-একদা গোলকে বসে মহাপ্রভু নিরঞ্জন সকল দেবতাকে স্মরণ করেন। আমন্ত্রিত দেবতাগণ গোলকে উপস্থিত হয়ে প্রভুকে বললেন, প্রভু আমাদেরকে কী জন্য স্মরণ করেছেন? মহাপ্রভু বললেন, যার যার শক্তি অনুযায়ী এখানে বসে সাধনা কর। দেবতারা এর কারণ জানতে চাইলেন। প্রভু নিরঞ্জন বললেন, ‘বর্ষ পরিক্রমায় এটি একটি উত্তম তিথি। এই মুহূর্তের সাধনার চেয়ে বড় কোনো সাধনা ত্রিভূবনে নেই। তা শুনে দেবতারা যার যার শক্তি অনুযায়ী সাধনা শুরু করেন। তিথিটি হচ্ছে আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন। এতে যার যার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। মহাপ্রভু আরও বললেন, মর্তে আমার অনেক ভক্ত আছে তাদের দ্বারে এ তত্ত্ব পাঠাতে হবে। গোলক থেকে ওই পরমতত্ত্ব দেব-দূতেরা মর্তে নিয়ে আসেন। সেই থেকে এই তিথিকে সবাই যোগ তিথি বলে গণ্য করে থাকেন। সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-আউলিয়া এই রাতে যার যার ইস্ট মন্ত্র জপ করেন। গৌরী ডাকিনী বিহারী শিবকে এই রাতটি ভরে বিভিন্ন যোগতত্ত্বের ব্যাখ্যা জানতে প্রশ্ন করেছিলেন। শিবও প্রতিটি যোগতত্ত্বের ব্যাখা শুনিয়েছিলেন। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, শিব শ্মশানবাসী গাঁজাখোর, কদাকারময় ও কুচনি পাড়ায় যেতে অভ্যস্ত। দেবী দুর্গা আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন পড়ন্ত বিকেলে রন্ধন কর্ম শেষ করে স্বামী শিবকে খাওয়ানোর জন্য পতির নিকটস্থ হলেন। মহামায়া দুর্গা তার হাব-ভাব দেখে বুঝতে পারলেন যে, আজ নিশীথে ডাকিনী বিহারের জন্য শিব প্রস্তুত হচ্ছেন। দেবী দুর্গা তাকে ওই পথ থেকে ফেরানোর জন্য বিনয় বচনে এক এক যোগতত্ত্বের ব্যাখ্যা জানতে থাকেন। রাত গভীর হচ্ছে তবুও দুর্গার প্রশ্ন করা শেষ হচ্ছে না। সারারাত চলল দু’জনের মধ্যে যোগতত্ত্বের প্রশ্নোত্তর পর্ব। আধার কেটে গেলো, পাখিরা ভোরের গীত গাইতে শুরু করল। দুর্গা ভাবলেন এখন দিন হয়েছে শিব আর কুচনি পাড়ায় যেতে পারবেন না। তাই তিনি স্বামীকে বললেন, এসো ভাত ব্যাঞ্জন পাক করেছিলাম এবার পেট ভরে খেয়ে নাও। সে থেকে আজও মানুষ আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিনে রান্না করে ১লা কার্তিক খায়। এমনও প্রবাদ আছে-

আশ্বিবে রান্দে বাড়ে কার্তিকে খায়
যে বর চায় বুড়ি সেই বর দেয়।

ছাত্র-ছাত্রীরা সারা রাত জেগে বই পড়ে। যার যে বিদ্যা জানা আছে তা সে এই রাতে তরজমা করতে থাকেন। ধর্ম প্রাণ মানুষগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় দেহতত্ত্বমূলক গান পরিবেশন করে থাকেন। ধর্মীয় আবেশে মুসলমানদের শবেবরাতের আদলে এলাকার হিন্দু অধিবাসীরা এটা পালন করে থাকে। সৌহার্দ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে এটি খ্রিস্টান-মুসলমানদের মধ্যেও চলে এসেছে। মুসলমানদের মধ্যে এই গার্সি পালনের চিত্র যেভাবে ফুটে উঠেছে তা গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা বনগ্রামে হাজার চাঁদ ফকিরের মাজারে গেলে সহজে বুঝতে পারা যাবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভক্তরা ওই গার্সির রাতে যোগদান করে থাকেন। অনেক হিন্দুরাও সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করে হাজার চাঁদ ফকিরের গুণগান করেন। দেখা যায় হিন্দু-মুসলমান ভাবের ঘরে একাকার হয়ে আধ্যাত্মিক গান করে যাচ্ছে।

‘দেল কোরান ঠিক না করে আয়াত কোরান কেউ পড় না
মানব দেহের ভেদ জেনে কর সাধনা
আলেফ লাম নাসিকা খানি শেরে দুই কণ্ঠে জানি
জিমে হয় জিকিরের ধ্বনি হেতে হাড়ের গঠনা।
ফেতে ফ্যাপসা পানি পোরা কাপেতে কলেজা ঘেরা
বড় কাপ নাভিতে ঘেরা যেথায় দোমের ঠিকানা।
মুণ্ডুতে মিম হরফ এলো হেজে মগজে ছিল
তে যে দুই কান জানা গেলো, আইন গাইন দুই নয়ন
অধর যুগলে লাম মিম, সর্বঅঙ্গে আলেফের চিন
দুই বাহুতে আছে সিন শিন মুখেতে বের গঠনা
তৈ যে তিল্লতে ছিল, ছদৎ হৃদয় রাখিল
নফছোতে হরফ এলো মুখেতে বের যায় জানা
জিম জিম হামজারে জানগা মুর্শিদের ধারে
দাল জাল দুই জানুর পরে দলিলেতে যায় জানা।
দশ হরফ সাধনার গতি, সাধনে জ্বলে জ্ঞাতের বাতি
নিষ্ঠা রেখে রাতমতি গুরু কর ভজনা।
লাহুদ লাছুদ মালকুত জোবরুৎ, মোকাম আর মোকাম হাউৎ
মেছের কয় দিয়েছে মাবুদ সেথায় কেন খোঁজনা।’

এই গার্সি রাতের শেষ ভাগে দেখা যায় আলোর মিছিল। প্রত্যেক গেরস্ত ছোট ছোট মাটির প্রদীপ জ্বেলে পথে, ঘরের কোণে, দেবালয়ে সাজিয়ে দেয়। গার্সির রাতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ উপভোগ করে কিশোর বালকেরা। তারা দল বেঁধে কলাগাছের ডগা নিয়ে প্রত্যেক ঘরের বেড়ায় সম্মিলিতভাবে পিটায়ে পিটায়ে বলতে থাকে-

ইন্দুর বান্দর দূর যা
পাগলার মা’র নোট খুচে খা
ইন্দুর বান্দর দূর যা
ফটিকের মা’র নোট খুচে খা
ইন্দুর বান্দর দূর যা
কেনার মা’র নোট খুচে খা।

.

এই বাড়ির ইন্দুর-বান্দর ওই বাড়ি যায়
ওই বাড়ির শিব ঠাকুর এই বাড়ি আয়।

.

এই বাড়ির ইন্দুর বান্দর ওই বাড়ি যায়
ওই বাড়ির অমর আল্লাহ, এই বাড়ি আয়।

এখানে ইন্দুর-বান্দর বলতে অশুভ উপকরণের কথা ও অসুখ-বিসুখ, রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদ দূর করার কথা বলা হয়েছে। বিপরীতভাবে অন্যবাড়ি বা প্রকৃতির কাছ থেকে শুভফলপ্রদ উপকরণকে গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুসলমানের এলাকায়ও এই গার্সির আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে। আশ্বিনের শেষের দিন সূর্য ডোবার আগে মহিলারা নিমপাতা, বেলপাতা, কাঁচা হলুদ, তেঁতুল ইত্যাদি যোগাড় করে রাখে। ভোরে সেসব পাটায় পিষে গায়ে মেখে স্নান করার রেওয়াজ এখনও প্রচলিত। এটি হলো শীতের দিনে গায়ের মলিনতা দূর করার পূর্ব প্রস্তুতি। মুখে তেঁতুল পোড়া লাগানোরও রীতি আছে। শীতের দিনে ত্বককে লাবণ্য রাখার এটি একটি সুন্দর পদ্ধতি।

১১. লাল নিশান তত্ত্ব

হরিচাঁদের যোগ্য ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর সর্বপ্রথম ১৮৮০ সাল থেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রয়াসে মহাবারুণী উৎসব শুরু করেন। এই অধ্যাত্ম পুরুষ ও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা প্রথমেই সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারের দিক লক্ষ্য দিলেন। তিনি প্রথম নজর দিলেন নির্যাতিত, নিপীড়িত, শিক্ষা বঞ্চিত জাতির দিকে। তাইতো তাঁর মতুয়াদের মধ্যে সিংহভাগ মতুয়াভক্ত নিম্নবর্ণের লোক।

আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান এই মহামানব, অন্ধকারাচ্ছন্ন, অক্ষরজ্ঞানশূন্য জাতিকে ধর্মজ্ঞান সৃষ্টির জন্য, জাতিকে জাগ্রত করার জন্য তিনি প্রতীক চিহ্নস্বরূপ লাল রঙের তিন কোনো বিশিষ্ট লাল নিশান এবং নিশানের সাদা কাপড়ের ঝুলন সংযুক্তির বিধান রেখেছেন।

প্রত্যুষের উদীয়মান সূর্য লাল হয়ে উদিত হয় পূর্ব আকাশে। কোনো বাধা মানে না সে। এগিয়ে চলে সামনের দিকে। আলো ছড়িয়ে দেয় সারা পৃথিবীতে। তদ্রুপ এ অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিকে সূর্যের ন্যায় অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। প্রত্যুষের লাল সূর্যের রঙে লাল নিশান তুলে দিয়েছে মাতুয়া ভক্তদের হাতে। জাতির অগ্রযাত্রার এক নিদর্শন মাত্র। আর নিশানের সাদা পাড়ের অর্থ হলো শান্তির প্রতীক

১২. মহাবারুণী উপলক্ষে অনুষ্ঠান

ঘৃতকান্দী

জনশ্রুতি আছে যে, এই গ্রামে পূর্বে বিরাট গোচারণ ভূমি ছিল। গরু-মহিষ পালনের উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় এখানকার বেশিরভাগ লোকে গাভী পালন করত এবং দুধ থেকে ঘৃত তৈরিতে পারদর্শী ছিল। উন্নতমানের ঘৃতের চাহিদাও বেড়ে যায় চারদিকে। গ্রামের মাঝখানে বিরাট পুকুর ছিল। যার নিদর্শন আজও দেখা যায়। এই পুকুর পাড়ে সপ্তাহে একদিন করে বসতো ঘৃত বাজার। সেখান থেকে এর নাম হয় ঘৃত বাজার; তা থেকে ঘৃতকান্দী।

শ্রীধাম ওড়াকান্দী গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত এই গ্রামটি। পূর্ব থেকেই হিন্দুদের বসত এই গ্রামে। শিক্ষায় বেশ উন্নত। অর্থ সম্পদেও পিছিয়ে নেই এরা। আদর্শ গ্রাম চৈত্র মাসের মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম ও মৃত্যু তিথিতে শ্রীধাম ওড়াকান্দি অনুষ্ঠিত হয় মহাবারুণীস্নান। স্নান উপলক্ষে বারুণীর দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম পাশ থেকে যত মতুয়া ভক্তের আগমন ঘটে, তাদের প্রত্যেককেই খিচুড়ি খাবারের ব্যবস্থা করে এই গ্রামবাসী। প্রায় ৩ একর জমি নিয়ে তৈরি করে প্যান্ডেল। থাকার ব্যবস্থাও এখানে থাকে। অন্তত এক হাজার লোক একই সঙ্গে বসে খেতে পারবে, এমন ব্যবস্থা এখানে রাখা হয়। প্রায় একশত পরিবার এই খাবার পরিবেশন করে। খাবার পরিবেশনে প্রায় অর্ধেক যুবকই থাকে মুসলমান। জাতপাতের কোনো বালাই নেই এখানে। সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন মেলা।

১৩. অন্যান্য উৎসব

ক. ঈদ-উৎসব

ঈদ উৎসব মুসলমানদের কাছে অতি প্রিয়। দুটি ঈদেই জেলার সর্বত্র এই উৎসব আনন্দ হৈ হুল্লোড়ের মাধ্যমে পালন করা হয়। তবে ঈদুল ফিতর, যা ত্রিশ রোজার শেষে পালিত হয় তা কোরবানি ঈদের চেয়ে অনেক আনন্দের ও খুশির আমেজ বয়ে আনে।

ঈদ উৎসব

ঈদ উৎসব এলেও এর বাহ্যিক আচরণ অনেক বদলেছে। সেকালে গোপালগঞ্জের সমগ্র এলাকার সাধারণ মানুষ সাধারণভাবে ঈদ উৎসব পালন করতো। এমনিতেই গোপালগঞ্জের সমগ্র এলাকার মানুষ কৃষিজীবী এবং হত দরিদ্র। তখন দুটো ফসল ফলতো। অনেক বছর ধানি মাঠ পানির তলে ডুবে থাকতো। কর্মজীবী মানুষেরা আবাদ করতে পারতো না। ফলে অভাব লেগেই থাকতো সারাবছর। এই উৎসব বলতে যা বোঝায়, তা কখনও দেখা যায়নি গোপালগঞ্জের শহর ও তখনকার থানা এলাকায়। সাধারণ মানুষ ঈদের দিন ঈদের নামাজ আদায় করতো। যারা একটু স্বচ্ছল, তারা আখের গুড়ে শিন্নি রান্না করে খেতো। সকালে সামিয়ানা টাঙিয়ে খোলা মাঠে বা বটগাছের ছায়ায় ঈদের নামাজ আদায় করা হতো। শিক্ষিত ঘরের ছোট সন্তানেরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করতো। শুকনো মৌসুমে ঈদ এলে ছোটরা আকাশে ঘুড়ি ওড়াতো। কোথাও ঘোড়দৌড় বা ষাঁড়ের লড়াই হতো। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে খানাপিনার বাড়তি আয়োজন থাকতো। পরিবারে শিন্নির চালই জোটাতে পারতো না বলা যায়। ঈদের এই বর্ণনা ৫০ বছর পূর্বের। বর্তমানে সেকালের ছবি আর দেখা যায় না গোপালগঞ্জের কোনো এলাকায়। দিন পালটেছে, মানুষের জীবনাচরণ বদলেছে। সেকালের অর্থাভাব এখন আর নেই। এলাকার কৃষিজীবী মানুষ ক্ষেতে দুই/তিন ফসল ফলায়। শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ চাকরি করছে। এখন সমগ্র গোপালগঞ্জের আনন্দের আমেজ নিয়ে ঈদ উৎসব পালিত হয়। আর এই আনন্দে দেখা যায় আধুনিকতার ছোঁয়া। ঈদের চিরাচরিত আচারণগুলোর মধ্যে যোগ হয়েছে খানাপিনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আমোদ-আনন্দে গানবাজানার ধুমধাড়াক্কা। মিডিয়ার মাধ্যমে সে আনন্দ পৌঁছে যায় গ্রামের সাধারণ মানুষের ঘরে।

খ. দুর্গোৎসব

শারদীয়া দুর্গোৎসব এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। এর বিশেষ বিবরণ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। একমাস বা দুই মাস পূর্ব থেকে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন আরম্ভ হয়। মৃৎভাস্করগণ যখন প্রথম মূর্তি বানাতে আসে সেদিন থেকে শুরু হয় এই আনন্দঘন অনুষ্ঠানের দিন গোনা। বালক-বালিকার এক অনির্বচনীয় আহ্লাদে ডুবে থাকে। গোপালগঞ্জ জেলায় শত শত মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। পাঁচ দিনব্যাপী ব্যয়বহুল দুর্গাপূজা চালানো এককভাবে অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখা যায় বিভিন্ন এলাকায় পাড়া প্রতিবেশী যৌথভাবে এ পূজার আয়োজন করে থাকে। যারা বিত্তবান তারা এককভাবে এই পূজা চালিয়ে যান। দিবসের প্রথমভাগে এ পূজা সংঘটিত হয়ে থাকে। কলা বৌয়ের পূজার মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু হয়। এই পূজার বিশেষ আকর্ষণ মহানবমীর কুমারী পূজা। প্রায় প্রতিটি পূজা মণ্ডপে দিবসের পূজা শেষে রাতভর চলে নাচগানের মহড়া। কোথাও কোথাও যাত্রাগানও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

দূর্গা প্রতিমা

গোপালগঞ্জ জেলা শহরে কেন্দ্রীয় মন্দিরে ও গৌহাটিতে যে পূজা হয় তা বেশ আকর্ষণীয়। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শকরা ছুটে আসে মা দুর্গাকে প্রণাম জানাতে ও অনুষ্ঠান উপভোগ করতে। সম্প্রতি সদর উপজেলার আড়ুয়াকংশুর গ্রামে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা অ অঞ্চলের জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে। মুসলসান অধ্যুষিত এলাকায় এত জাঁকজমক সহকারে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালিত হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন আরও সুদৃঢ় করেছে।

বনগ্রামের সহৃদয় মুসলমানরা এই পূজার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। যেমন-নওয়াব আলী ফকির (৬৮), রুঙ্গু মোল্লা (৬৭), ফিরোজ ফকির (৪৭), মহসিন ফকির (৪৩) সাহাবুদ্দিন মোল্লা (৫৭), শান্ত মোল্লা (৫৫), কাওছার ফকির (৬৩), মহসীন মোল্লা (৩২) উল্লেখযোগ্য। পূজা সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের সার্বিক সহযোগিতা স্মরণযোগ্য।

এখানকার মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অন্য কোনো পূজামণ্ডপে দেখা যায় না। এমনকি শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীও পূজামণ্ডপে সুন্দর সুন্দর সংগীত পরিবেশন করে থাকেন। এই শারদীয়া দুর্গোৎসবের প্রতিষ্ঠাতা লোকসাহিত্য গবেষক দীনেশ চন্দ্র পাণ্ডে। বিজয়া দশমীর দিন নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের ফলে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিসর্জন শেষে ভক্তরা পরস্পরের সাথে প্রণাম ও কোলাকুলি করে থাকে। দুর্গোৎসবের এই বৃহৎ আনন্দ বিয়োগের ধাক্কা হঠাৎ সামলানো কষ্ট বিধায় ৪ দিন পরে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার বিধান করা হয়েছে বলে প্রাচীনেরা বলে থাকেন। কোটালীপাড়ার দুর্গাপূজার সেকালে খ্যাতি ছিল। কোটালীপাড়ার উনশিয়া গ্রামকে কেন্দ্ৰ করে চতুর্দিকের গ্রামগুলোয় অনুষ্ঠিত হতো দুর্গাপূজা। ধনী পরিবারের লোকেরাই এ পূজা করতেন। উনশিয়া-পশ্চিমপাড়া ছাড়া পরগণার গ্রামগুলোর যেখানে সাধারণ হিন্দুদের বসবাস, তারা কখনও পূজা করতো না। এরা ছিল জেলে, বাড়ৈ ও সাধারণ কৃষক। পূজার ব্যয়ভার তাদের বহন করা সম্ভব ছিল না।

অন্যদিকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও চাইতো নিম্নবর্ণের হিন্দুরা না করুক। ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক পূজা সেকালে অনুষ্ঠিত হতো। এসময় পূজায় মুসলমানেরাও নেমতন্ন পেত। তাদের জন্য আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। পূজার সময় সমগ্র কোটালীপাড়াকে মনে হতো উপশহর। রাতে হ্যাজাকের আলোয় কোটালীপাড়ার গ্রামগুলো ভাসতো।

এসব পূজার মধ্যে সিকিরবাজারের রাইচরণ বাবুর বাড়ির পূজা, পশ্চিমপাড়ার পাচু চৌধুরীর বাড়ির পূজা ও উনশিয়ার রামধন সাহার বাড়ির পূজা ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠিত হতো। পূজা উপলক্ষে কোনো কোনো মণ্ডপে মুসলমান বয়াতিরা দলবেধে গান পরিবেশন করত। রাখি বন্ধন অনুষ্ঠিত হতো দুর্গা পূজায়। বর্তমানে পূজার সংখ্যা বেড়েছে। সাহা, বণিক ও চৌধুরীদের দুর্গা সাধারণ হিন্দু কর্তৃত্বের ঘরে ঠাঁই নিয়েছে। হয়তো সে আনন্দ নেই, কিন্তু আছে প্রাচীন রীতি-নীতি ও ভালোবাসার বন্ধন। জনশ্রুতি আছে, একবার দুর্গাপূজায় নরবলি হয়েছিল। নরবলি হয়েছিল সত্যি, তবে ইচ্ছে করে, না অনিচ্ছায় তা আদৌ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

মানুষের কাছে শোনা যায় কোটালীপাড়ার পশ্চিম পাড়া গ্রামের নিবাস পাচু চৌধুরীর বাড়িতে সেকালে আনন্দ হৈ-হুল্লেড়ে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। এই চৌধুরী পরিবার ছিল ধনে-মানে অভিজাত। বাড়ির সবাই ছিল শিক্ষিত এবং চাকুরে। পূজার সময় গম গম করতো বাড়ি। বাড়ির প্রাঙ্গণে ছিল স্থায়ী পূজা মন্দির। এই মন্দিরে হতো দুর্গাপূজা। মান্দিরের সামনে ছিল আটচালা টিনের ঘর। অদূরে বালির বেদি বা কাঠগড়া কিংবা ধুপকাষ্ঠ।

দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্দিরের সামনে স্থাপিত বলির বেদিতে প্রতি বছর মহিষ বলি দেওয়া হতো। সাধারণত সপ্তমী থেকে নবমীর দিনে মহিষ বলি দেওয়া হতো। একবার বলি দেওয়ার জন্য একটি বিরাট মহিষ ‘চান’ (স্নান) করে সাজিয়ে আনা হলো বেদীর কাছে। আগেই ধার্য করা হয়েছিল পাচু চৌধুরীর বড় জামাতা মহিষ বলি দেবেন। তিনি শক্তিশালী খড়গ চালাতে ওস্তাদ ছিলেন। সেবার তার এককোপে বলি হয়েছিল একটি মহিষ ও তার পুত্র। পাচু চৌধুরী ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। বলির খবরটি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। ঢাক-ঢোলের আওয়াজে হত্যার খবরটি অনেকের কাছে অজানা থেকে যায়। পূজার আনন্দের মধ্যে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয় অজ্ঞাতে। কিছুদিন পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি আইন-আদালতে গড়াতে পারেনি। তারপর থেকে ওই মন্দিরে পূজা হয়েছে ঠিকই কিন্তু মহিষ বলি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এখনও অনেকে বলাবলি করেন যে, আসলে পাচু চৌধুরীর ভুলের কারণে তার ছেলের গলা কাটা যায়। ছেলেটি কোপ দেবার সময় মহিষ ধরতে গিয়ে সামনে পড়ে। ঘটনা যাই হোক না কেন, নরবলি যে হয়েছিল তা একদম সত্য।

পাচু চৌধুরীর বাড়ির সেই দুর্গাপূজা এখনও অনুষ্ঠিত হয়। তবে বাড়িতে নয়, এটি অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় উপজেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে, যা সর্বজনীন রূপ পেয়েছে।

গ. শ্যামাপূজা বা কালীপূজা

কালী প্রতিমা

কালীপূজা দুর্গাপূজার মতো ব্যয়বহুল নয়। এ কারণে শ্যামাপূজা প্রায়ই এককভাবে করতে দেখা যায়। যে বাড়িতে দুর্গাপূজা হয় বেশির ভাগ সে বাড়িতে শ্যামাপূজাও হয়ে থাকে। দুর্গাপূজার পরবর্তী অমাবস্যাতে কালীপূজা হয়। অমাবস্যার গভীর নিশীথে এই পূজা হওয়ার কারণে বালক-বালিকার বেশি আনন্দ উল্লাস করতে পারে না। তবে পূজার দিন ভূত চতুর্দশীতে কিশোর-কিশোরীরা খুব উৎসাহ উদ্দীপনায় দীপমালার আয়োজন করে থাকে। এই কারণে শ্যামা পূজাকে দীপাবলি পূজাও বলা হয়। উক্ত তিথি ছাড়াও অনেক এলাকা আছে সেখানে মাঘ মাসের অমাবস্যায় বা তাদের সুবিধামতো দিন তারিখে এই কালীপূজার আয়োজন হতে দেখা যায়। তবে দিনটি হতে হবে অমাবস্যা তিথিতে। টুঠামান্দ্রা, সাতপাড় ও নিজড়া শ্যামপূজার জন্য বিখ্যাত।

পূর্বপাড়ার ঐতিহ্যবাহী কালীপূজা

কোটালীপাড়ার পূর্বপাড়া একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এ গ্রামের সবাই হিন্দু। এই গ্রামের কালিমন্দিরটি আগে ছিল গ্রামের পশ্চিম পাশে আনন্দ পুকুরের পাড়ে। তিনশত বছর ধরে এই মন্দিরে কালীর পূজা হচ্ছে। প্রতি বছর দুর্গাপূাজার পর এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গত কয়েক বছর হলো মন্দিরটি স্থানান্তর করে গ্রামের মধ্যখানে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানেই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

পূর্বপাড়ার এই কালিপূজাকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে লোকাচার ও লোকসংস্কৃতি। প্রতি বছর অর্থাৎ গত ৩০০ বছর ধরে ৯ই পৌষ এখানে আয়োজন করা হয় কবিগানের। পূর্বে তিনদিন ধরে এই আসর আয়োজন করা হতো। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতো এই গান শুনতে। এখানের কবির লড়াই ছিল সকলের কাছে প্রিয়। এই আসরে কবিগান পরিবেশন করেছেন জাতীয় পর্যায়ের কবিয়ালরা। এসব কবিরা হলেন—কবিয়াল বিজয় সরকার, কবিয়াল নিশি সরকার, কবিয়াল মকুল দত্ত, কবিয়াল রাজেন্দ্রনাথ সরকার, রবি সরকার, রসিক সরকার, কালিপদ সরকার এবং দ্বিতীয় নিশি ও দ্বিতীয় রাজেন্দ্রনাথ

পূর্বপাড়া কালীমূর্তি

ঘ. সূর্যপূজা

মাঘমাসের মকর সপ্তমী তিথিতে সূর্যপূজা হয়। নারীরা এ পূজার আয়োজন করে থাকে। এই সূর্যপূজা সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে-’দ্রৌপদী যখন পঞ্চস্বামী নিয়ে বনবাসে যান তখন তাকে মাত্র ছয় সের চাল দেওয়া হয়েছিল। কীভাবে এ অল্প পরিমাণ চালে বনবাসে তাদের জীবন কাটবে? এই চিন্তা করতে করতে দ্রৌপদী তার শাশুড়ি কুন্তীর কাছে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেছিলেন কীভাবে আমরা বেঁচে থাকব! কুন্তী এর উত্তরে বলেছিলেন যে, সূর্য দেবের সাধনা কর। এর উপায় তিনি করে দিতে পারবেন। দ্রৌপদী সূর্য দেবের সাধনা করেন। সূর্যদেব তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে তাকে একটি স্বর্ণের থালা দেন এবং বলেন প্রত্যুষে স্নান সম্পন্ন করে ভাত রান্নার সময় ঐ ছ’ সের চাল থেকে পরিমাণ মতো চাল গ্রহণ করে এক মুষ্টি চাল পাত্রে রেখে দিবে। দেখবে কোনোদিন আর তোমার চালের কষ্ট হবে না। রন্ধন শেষে ওই স্বর্ণের থালায় রেখে খাবার পরিবেশন করবে। শত শত লোক আসলেও সকলকে পেট ভরে খেতে দিতে পারবে। এতে কোনোদিন তাদের অন্নকষ্ট হয়নি। গ্রাম্য নারীরা অতিকষ্টে ও শ্রদ্ধার সাথে ব্রতটি পালন করে থাকে। ১লা মাঘ থেকে মকর সপ্তমী পর্যন্ত সূর্য ওঠার আগে স্নান করে এই ব্রত তারা পালন করে। স্নান করার আগে ও পরে তারা উলুধ্বনি দেয়। পৌরাণিক কৃষ্টিকে ধরে রাখার জন্য জীবননাশী শীতকে উপেক্ষা করে গ্রাম বাংলায় পালিত হয় এই ব্রত। সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে পূজার নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তি করে। অন্নকষ্ট থেকে পরিত্রাণের জন্য এবং সিঁথির সিঁদুর অটুট রাখতে তাদের এই কষ্টের ব্রত।

ঙ. দুর্গাসুর গ্রামে ৫১ হাত কালীপূজা

দুর্গাসুর নিবাসী হারান চন্দ্র মণ্ডল ১৪ বছর আগে কালী কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হন যে, হারান তুমি আমার মূর্তি গড়ে অর্চনার ব্যবস্থা কর। তোমাকে টাকার জন্য ভাবতে হবে না। আমার ভক্তরাই তোমার টাকার ব্যবস্থা করবে। স্বপ্নে দেখার পর তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকাল বেলা হারান মণ্ডল পাড়ার সবাইকে ডেকে জানায় তার স্বপ্নের বিবরণ। পাড়ার সবার মত নিয়ে নিজ বাড়িতে আরম্ভ করেন পূজার ব্যবস্থা। ভাস্কর আরম্ভ করে মূর্তি গড়তে। আশ্চর্য যে ভাস্কর মূর্তি গড়তে গড়তে প্রথম বছর ৫১ হাত দৈর্ঘ মূর্তি গড়ে তোলেন, চেষ্টা করেও নাকি সে ছোট করে গড়তে পারলেন না। ৫১ হাত দৈর্ঘ্য কালীমূর্তির কথা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পূজার দিন হাজার হাজার দর্শকের আগমন ঘটে পূজা মন্দিরে। প্রত্যেকেই অবাক হয় মন্দিরে এসে। যে যা পারে সাহায্য করতে থাকে। দেখা গেলো পূজার সমস্ত ব্যয় সংকুলন হয়েও প্রচুর টাকা থেকে যায়। থেকে যাওয়া টাকা দিয়ে আজও সেখানে হয়ে আসছে এই পূজা। কালীপূজাকে শক্তিপূজাও বলে হিন্দু শাস্ত্রে। পৃথিবীতে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যিনি শক্তিকে অস্বীকার করেন বা বলেন শক্তি নেই। আমাদের দর্শনশক্তি আছে বলেই দেখছি। চলার শক্তি আছে বলেই চলতে পারি। শ্রবণশক্তি আছে বলেই শুনতে পাই। সকল কর্মকাণ্ড শক্তির অভাব হলে বন্ধ হয়ে যায়।

এই শক্তিপূজা উপলক্ষে দুর্গাসুর গ্রামে তিন দিন ধরে মেলা হয়।

চ. শিবাসন বা নীলপূজা

নীলপূজা ও চড়কপূজা এই দুটি অনুষ্ঠান মূলত অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নীলপূজার শেষে পর্বই হচ্ছে চড়ক পূজা। বলা যায় চড়ক পূজার শুভ সূচনা হয় শিবাসন বা নীলপূজার মধ্য দিয়ে। শৈব্যভক্তরা এই পূজার বিধিবিধান পরিচালনা করে থাকেন। নীলপূজা শুরুর আগে তারা শ্মশানে বা শিব মন্দিরে ভোগ সাজিয়ে স্তবস্তুতি করে ভোলানাথকে সন্তুষ্ট করে নেয়। মহেশ্বরের আশীষ নিয়ে ভালো দিনক্ষণ বেছে শুরু করে নীলপূজা। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে এই নীলপূজার প্রচলন আছে তবে চৈত্রমাসের অনুষ্ঠানেই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। প্রায় একমাসব্যাপী চলে পাড়ায় পাড়ায় শিবাসন নিয়ে এই কৃত্য। যিনি এই দলের নেতৃত্ব দেন তাকে বালা বলা হয়। সাধারণত অবলারে বালা বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অবলা কে? যার বাকশক্তি রহিত। দেহ-মন-প্রাণ স্রষ্টার পদে সপে দিয়ে যিনি হৃদয়ে তাঁকে আসীন করে উপসনা করেন তিনিই বালা। প্রায় ৮/১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় নীলপূজার দল। একজন বালা, যিনি অনুষ্ঠান বা দলকে দেখভাল করেন। কয়েকজন শাং থাকে। তাদের কাজ হলো শিবাসন বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি বহন করে বেড়ানো। কয়েকজন গায়ক, যারা অনুষ্ঠানে নৃত্যগীত করেন। এসব গানগুলো শিব-গৌরী জীবনালেখ্য সংক্রান্ত হয়ে থাকে। একে শ্লোক গানও বলা হয়। গানগুলো এরকম—

দেবী দক্ষযজ্ঞে প্রাণ ত্যাগ করি      জন্ম নিলেন গিরিপুরী
জন্মিলেনও মেনকার উদরে
ও তার রূপের ছটায় ভূবন আলো      উমা শশি গৃহে এল
বাপ ও মায়ে পালে সমাদরে।
একদিন পুষ্প তুলতে ভবানী      বনে চলল একাকিনী
নূপুরেরও ধ্বনি শোনা যায়
আছে অক্ষয় বটবৃক্ষমূলে      শিব রয়েছে শান কুলে
ভবানীকে দেখিবারে পায়।
দেবী দক্ষযজ্ঞে গেছে মারা       প্রাণ প্রেয়সী হয়ে হারা
অঙ্গজ্বারা ভোলানাথ গোঁসাই
তাতে ফাল্গুন অষ্টমী তিথি      ত্রিনয়নী ভগবতী
রূপ দেখিয়া ছাড়ে দুঃখের হাই।
তখন ডেকে বলে শূলপাণি      তুমি হও কার নন্দিনী
একাকিনী এসেছ এই বনে
তোমার গলে দোলে চন্দ্র হার      কোথায় বাড়ি কোথায় ঘর
বিবাহ হয়েছে কাহার সনে।
তখন হাস্য মুখে কয় ভবানী      মেনোকা হয় মোর জননী
আমি হই সেই গিরিরাজার মেয়ে
আছে হিমালয়ে আমার ঘর    শিব হবে মোর বিয়ের বর
তাইতে বাপ মায় না দিয়েছে বিয়ে।
শুনিয়া ভবানীর বাণী      হাস্য মুখে শূলপাণি
ভবানীকে ধরিবারে যায়
বলে কৈলাশেতে আমার ঘর      আমি তোমার বিয়ের বর
বনে এলাম তোমারই জ্বালায়।
তখন গৌরী বলে একি কাজ      বুড়ো তোমার নাইকো লাজ
দিবা নিশি শ্মশানেতে রও
দেখি লম্বা জটা মাথার পরে      ছুঁইও না ছুঁইও না মোরে
কোন লাজেতে বিয়ে করতে চাও।
তখন শিব বলে শ্মশান ছাড়ি      নবীন কুমার আমি হতে পারি
তুমি একবার ফিরে চাও সুন্দরী
আমি দেখে তোমার চন্দ্র মুখ      পাসরিলাম সর্বদুঃখ
তোমার জ্বালায় হব দেশান্তরী।
গৌরী বলে করি মানা      ও কথা আর মুখে আন না
আমার বিয়ে দিবে বাপ ও মায়
জানি পুরুষ জাতির এমনি ধারা      পরের নারী দেখলে তারা
পাগল হয়ে ধরে গিয়ে পায়।
শুনিয়া গৌরীর বাণী      মনোদুখে শূলপাণি
অনিমেষে চতুর্দিকে চায়।
গৌরীকে ভুলাবার তরে          অঙ্গের বসন গুপ্ত করে
নটবর রূপ হলো শিবের গায়ে।
যেমন শুকনো লতায় ফোটে ফুল       বিরহিনীর প্রাণ হয় আকুল
চম্পকেরই মালা দোলে গলে
বাজে স্বর্ণ নূপুর শিবের পায়      গৌরী তখন ফিরে চায়
করজোড়ে শিবের প্রতি বলে।
ছিল মাথায় সর্প ফণি ধরা      অঙ্গের ভূষণ বাঘছাল পরা
সে বেশ প্রভু লুকালে কোথায়
একদিন স্বপন মাঝে দেখি আমি       তুমি হবা মোর গুণের স্বামী
মিছে কেন ছল কর আমায়।
দেবী নাহি মানে লজ্জা ভয়       শিবের পানে সদা চায়
পাগলিনী ধরল গিয়ে গলে
এ দীন কালীচরণ কেন্দে কয়      ওই রূপেতে দয়াময়
দিও দেখা জীবনান্ত কালে।

শিবাসন বা নীলপূজার বালাগিরি করেন এমন একজন বালা সিঙ্গা নিবাসী খোকন বিশ্বাস (৫০) এতদ্‌সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিতভাবে যা বললেন-’প্রথমে বাণ রাজা এই শিবাসন বা লীঙ্গপূজা প্রচলন করেন। একদিন বিষ্ণুদেব বিশ্বকর্মাকে ডেকে বললেন সব দেবতার আসন আছে, কেবলমাত্র শিব ঠাকুরের আসন নেই। তিনি শ্মশানে-মশানে পড়ে থাকেন। তাই তুমি শিবের জন্য একটা সুন্দর আসন তৈরি করে দাও। বিশ্বকর্মা বললেন, প্রভু কীভাবে আমি আসন তৈরি করব। আমার কাছে কোনো যন্ত্রপাতি নেই। লোহা কোথায় পাওয়া যাবে। দেবতারা চিন্তা করতে লাগলেন এখন কী করা। এদিকে প্রসূতি নামে এক মুনির কুমারীর গর্ভে লোহাসুরের জন্ম হয়। দেবতারা ছুটে গেলেন লোহাসুরের নিকট। লোহাসুর সর্বশেষ জানতে পেরে দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে দেবতারা হেরে যায়। পরে গেলেন শিবঠাকুর। শিবঠাকুর ও লোহাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। এতে শিবও লোহাসুরের কাছে পরাজয় বরণ করলেন। শুধু পরাজয় না, শিবঠাকুরকে বন্দি করে রেখে দিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি লোহাসুরের কাছে মুক্তি দাবি করেন। লোহাসুর বললেন, মুক্তি দিতে পারি এক শর্তে। শিব বললেন কী শর্ত? লোহাসুর প্রত্যুত্তরে বললেন, যদি গৌরীকে আমার কাছে তুলে দাও তবে তোমাকে মুক্তি দিতে পারি। মনে মনে শিবঠাকুর খুব ক্রোধান্বিত হলেন। কত বড় স্পর্ধা! কত বড় ধৃষ্টতা! আবার ভাবলেন আগে রাজি হই পরে দেখা যাবে কি করা যায়। তাই শিবঠাকুর রাজি হলেন। মুক্তি পেয়ে গৌরীর কাছে বিমর্ষ বদনে বসে আছেন। গৌরী বললেন, প্রভু তোমার কি হয়েছে? তিনি পূর্বাপর সব ঘটনা খুলে বললেন। গৌরী বললেন, চিন্তা করো না আমি লোহাসুরকে বধ করব।

এদিকে দেবতারা সভাকরে লোহাসুরকে নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে থাকেন। গৌরী বললেন, আর কোনো চিন্তা নয়, আমিই ওকে বধ করে ফিরব। এদিকে গৌরীর আগমনে কালক্ষেপণ হচ্ছে দেখে লোহাসুর আবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছে। গৌরী এরইমধ্যে ভুবনমোহিনী রূপ ধারণ করে লোহাসুরের দিকে যাত্রা করলেন। লোহাসুরও গৌরীর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। উভয়ের মুখোমুখি সাক্ষাৎ। লোহাসুর গৌরীকে বলতে লাগলেন, এতক্ষণ আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। বাহ্ তোমার কি ভুবনমোহিনী রূপ। তোমাকে আমি আপন করে পেতে চাই। গৌরী বললেন, তোমাকে বরণ করতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তুমি যদি আমার মতো সুন্দর হতে, তবে চিরদিন তোমার চরণ সেবা করতাম। লোহাসুর বলল, কীভাবে আমি তোমার মতো হতে পারি? কীভাবে তুমি এত সুন্দরী হলে? গৌরী বললেন, আমি আগুনে পুড়ে এত সুন্দরী হয়েছি। লোহাসুর বলল ঠিক আছে আমিও আগুনে পুড়ব। গৌরী আয়োজন করলেন অগ্নিকুণ্ডের। যে ভাতি দিয়ে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হলো সেই ভাতির মুখ গৌরীর যোনি দিয়ে আর শিবের জট দিয়ে তৈরি করা হয় ভাতির ছাউনি। লোহাসুর বুঝতে পারছে আমি গৌরীর ছলনা জালে বন্দি হয়ে পড়েছি। হ্যাঁ গৌরী তুমি শোনো আমি এখনই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ব, তবে শর্ত তুমি কি আমার উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করবে? গৌরী এতে রাজি হলেন। সেই থেকে দুর্গাপূজায় ফলফলাদি লোহার অস্ত্র দ্বারা কেটে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। তারপর গৌরী সেই নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। এবার ওই লোহা নিয়ে বিশ্বকর্মা দশ অবতার সংযোজিত শিবাসন নির্মাণ করলেন। এটিই হলো শিবাসনের বর্ণনা। তবে সব গাছ দিয়ে এই শিবাসন নির্মাণ করা হয় না। নিমগাছ, বেলগাছ ও চন্দন গাছ দিয়ে শিবাসন বানাতে হয়।’ এই শিবাসন নির্মাণে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ডেমাকৈড় গ্রামের গয়ালি বিশ্বাস, গান্ধিয়াশুরের অনিল ভাস্কর এবং রাউৎপাড়ার মন্টু মণ্ডল যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন