লোকমেলা (Folk Fair)

লোকমেলা

১. বৈশাখি মেলা

বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন অনুষ্ঠানের মধ্যে বৈশাখি মেলার আয়োজন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের নানাস্থানে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে পয়লা বৈশাখে, উপরন্তু, সারা বৈশাখ মাস ধরে ছোট-বড় নানারকম মেলা বসে। স্থানীয় লোকেরাই এসব মেলার আয়োজন করে থাকে। মেলাগুলোর স্থায়িত্বকাল তিন থেকে সাতদিন। গ্রাম বাংলায় এ মেলা হয় কোনো বিশাল বটগাছের নীচে কিংবা খোলা মাঠে। অনেক ক্ষেত্রেই মেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয় কোনো না কোনো নদীর তীরে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে পণ্য আর পসরা নিয়ে। বাঁশি আর ঢোলের শব্দে মুখরিত হয় চারদিক। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পিতামাতার হাত ধরে মেলায় আসে। তারা পুতুল কিংবা বাঁশি কেনার জন্য বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে। কোথাও চলে কবিগান, কোথাও চলে নাগরদোলা। বিরাট মাঠ জুড়ে বসে গ্রাম্যমেলা।

লোকেরা কেউ আনে তরমুজ, বিক্রি হয় মাটির হাঁড়ি, পুতুল, পাখি, কোথাও বা বিক্রি হয় খই-মুড়ি, বাতাসা, কদমা। কামার আসে তার ছুরি, কাঁচি, দা নিয়ে। মেলা থেকে বহুদূরে শোনা যায় হাজার মানুষের কলগুঞ্জন। নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখে রয়েছে একটি সর্বজনীন প্রতীক। এরমধ্যে রয়েছে পুরনোর মাঝে নতুনের উত্থান। জীবনের একটি চিরন্তন অনিবার্য নিয়ম-শৃঙ্খলা এরমধ্যে ক্রিয়াশীল বলেই নববর্ষ মানুষকে এত সচেতন ও উদ্বেলিত করে।

অতীতে বৈশাখি মেলার ক্ষেত্র ছিল গ্রামবাংলা। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটেছে। শহরভিত্তিক জীবনযাপন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, ফলে মেলার স্থানও গ্রাম থেকে শহরে সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের সর্বত্র শহরে- বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বৈশাখি মেলার আয়োজন করা হয়। রাজধানী ঢাকায়ও অনেক জাঁকজমক সহকারেই বৈশাখি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে নববর্ষের প্রথম দিন, বঙ্গাব্দ শুরুর প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। স্বাধীন বাংলাদেশে দিনটির মর্যাদা জাতীয়ভাবে স্বীকৃত হয়েছে। দিনটি এখন সরকারি ছুটির দিন। এদেশে আরও দুটি নববর্ষ পালিত হয় একটি ইংরেজি নববর্ষ, অপরটি আরবি নববর্ষ। কিন্তু এদেশে বাংলা নববর্ষেরই প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি জাতিসত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে এবং সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বাংলা নববর্ষের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তার প্রবল প্রলয় রূপ। প্রায় সময়ই এদিনটি তার নিজ অস্তিত্ব ঘোষণা করে ঝড়ো হাওয়ার সাথে। তাই নববর্ষের প্রথম দিনটি আসে আমাদের জীবনে সগৌরবে ও প্রবলভাবে। এ যেন সবাইকে জানিয়ে দেয় জীবনসংগ্রামে সচেতন সংগ্রামী ও পরিশ্রমী হতে যাতে মানুষ জীবন গড়ার সত্যিকারের অনুপ্রেরণা লাভ করে। জীবনের পথে এগিয়ে চলার জন্য সে প্রভাব প্রেরণার সঞ্চার করে। আমাদের সমস্যাসংকুল নিরানন্দ জীবনে নববর্ষ নতুন আশার সম্ভার নিয়ে দেখা দেয়। নববর্ষ তাই আনন্দের বার্তাবাহক। বর্তমান যুগেও নববর্ষ জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নতুন বছর উপলক্ষে সারাবছরের পরিকল্পনা প্রণয়নের শুরু বছরের প্রথমদিন থেকেই। কারণ জীবনে চলার পথে অতীতের মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যতের শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন পরিকল্পনা একান্ত প্রয়োজন।

পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক উৎসব। গোটা জাতির আবহমান ঐতিহ্যেরই এক ধারাবাহিকতা বাংলা নববর্ষের উৎসবের মধ্যে প্রতিফলিত। আমাদের গানে, কবিতায়, শিল্পকলায় নববর্ষ উৎসব নানাভাবে উচ্চারিত এবং উৎকীর্ণ। আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নববর্ষের পয়লা বৈশাখ।

গোপালগঞ্জ জেলার সর্বত্র নববর্ষ উদযাপন করা হয় ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে নববর্ষের কর্মসূচি শুরু। প্রতিটি এলাকায় বসে মেলা। ১ দিন, ৩ দিন ও ৭ দিন ধরে মেলা বসে। এই মেলা বৈশাখি মেলা নামে আজকাল বেশি পরিচিত। লোকজ সংস্কৃতির এই ধারাটি পূর্বের চেয়ে সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয়।

২. জলিরপাড়ের মেলা

গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জেলার মধ্যে মুকসুদপুর উপজেলার জলিরপাড়ের দুর্গাপূজার মেলা অন্যতম। বিজয়া দশমীর দিন এক বর্ণাঢ্য পরিবেশে এই মেলাটি উদ্‌যাপন হতে দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের বাচাড়ি নৌকা এসে বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এক এক নৌকার পরিবেশ এক এক ধরনের। লাল, নীল, সাদা, হলুদ বর্ণিল পোশাকে সাজ্জিত হয়ে বাছিয়ার তালে তালে বৈঠা টানে। এ এক মনোরম দৃশ্য। নৌকার সামনে থাকে দলনেতা বা নৌকার মালিক। নৌকার তালে তালে সামনের দিকে ঝুঁকে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই নৌকা বাইচের সময় মাত্র দুটি যন্ত্রের ব্যবহার হতে দেখা যায়। তাহলো কাশি ও নাকাড়া। মাদারীপুর বিলরুট ক্যানাল নামের এই নদীটি তখন মনে হয় যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বাচাড়ি নৌকার পাশাপাশি হরেক রকমের জলযানে দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে দর্শন করে থাকে এই ঐতিহ্যবাহী মেলার দৃশ্য। স্থানীয় প্রশাসন ট্রলারে ভেসে ভেসে নিরাপত্তা ও শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। দুই পাড়ে অসংখ্য লোকজন জড়ো হয়ে উপভোগ করে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য। শিশুদের খেলনা থেকে শুরু করে ঘরের প্রসাধনী ও সবধরনের খাদ্যবস্তু এই মেলায় বেচা-কেনা হয়।

৩. রামদিয়া দুর্গাপূজার মেলা

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা। পূজা শেষে রামাদিয়াতে এক বর্ণাঢ্য মেলা হয়। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটা দুর্গা পূজার আড়ং নামে খ্যাত। হাজার হাজার দর্শনার্থী উপভোগ করে এই মেলার আনন্দ। চলে নৌকা বাইচ। বাইচ শেষে প্রতি নৌকায় চলে লাঠি খেলা। মেলায় শাঁখা, খেলার পুতুল, কাঠের বিভিন্ন প্রকার তৈজস পাত্র, ঝিনুকের মালা, ছাচে তৈরি মাটির খেলনা, এর পাশাপাশি ওঠে মনোহারি মালামাল ও মিষ্টি দ্রব্য। মেলা শেষে প্রতিটি হিন্দু বাড়ি গিয়ে ছোটরা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে। আর তারা ধান, দূর্বা, তিল, তুলসী ও মিষ্টি দিয়ে আশীর্বাদ করে থাকেন।

৪. দেবাশুর কালীপূজার মেলা

কালী হলেন শক্তির প্রতীক। এই দেবীর মন্দির নেই, এমন জনপদ বাংলাদেশে বিরল। শ্মশান কালী, ভাদ্রাকালী, চামুন্ডা কালী ইত্যাদি নামে তিনি সারা দেশে বিভিন্ন রূপে পূজিতা হচ্ছেন। সারা বছরই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন তিথিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি হলো কালীপূজার সবচেয়ে উত্তম তিথি। তাই এই তিথিতে সমগ্র শাক্ত ভক্তরা কালীপূজা করে থাকেন। দেবাশুর গ্রামে কাশিয়ানী থানার পূজাটি একটু ব্যতিক্রমী ও জাঁকজমকপূর্ণ। পূজার বেশ কয়েকদিন আগে থেকে আরম্ভ হয় আনন্দ ফূর্তি। সারা গ্রামের লোক যোগদান করে এই পূজায়। পূজাতে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখে সারা ইউনিয়নের হিন্দু-মুসলমান। পূজা শেষে এখানে মেলা হয়। মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে নৌকা বাইচ ও লাঠি খেলা। পুরস্কারের বিশেষ প্রস্তুতি থাকে এখানে। সারাদিন চলে মেলার আনন্দ। মেলার দায়িত্বে থাকেন, বিশেষ করে, বর্তমান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গাউছ সিকদার, মো. পানা মোল্লা প্রমুখ। মেলাই হলো এমন এক স্থান যেখানে সামাজিক কোনো বিভাজন থাকে না। মেলার অমোঘ আকর্ষণ থেকে তাই কেউই নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। এসব বিবেচনা করে বলাই যায়, শতবর্ষী মেলার মতো শতশত লোকমেলা যতদিন সমাজে বহমান থাকবে ততদিন আমাদের সামাজিক বৈষম্য, মানসিক ভেদাভেদ অনেক দূরে সরে যাবে।

৫. বড়দল ও ভাঙারহাটের মেলা

কোটালীপাড়ায় যতগুলো বৈশাখিমেলা বসে তারমধ্যে বড়দলের মেলা ও ভাঙারহাটের মেলা দুটি অন্যতম। এ দুটি মেলা বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষ ঐতিহ্য এবং গুরুত্ব বহন করে। অবস্থানগতভাবে ভাঙারহাটটি উপজেলার উত্তর অংশের বৃহত্তম হাট। ধীরে ধীরে এই হাটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর চারপাশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ ব্যবসায়ের অনুষঙ্গ শিল্প-সমিতি-সংঘ ইত্যাদি গড়ে উঠতে থাকে। সাপ্তাহিক এ হাটটি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে বসে। এর ঠিক পশ্চিমে রাধাগঞ্জ হাটটির দূরত্ব প্রায় পাঁচ কি.মি. এবং এটি সপ্তাহের শনিবার ও বুধবারে বসে। আয়তনে ভাঙারহাটের মতো বড় নয় এটি। তবে বহু পুরনো এ হাটটি নদীবন্দর হিসেবে বেশ ব্যস্ত এবং সমৃদ্ধ ছিল। জলপথ কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমে দক্ষিণ দিকে সরে যায়। অর্থাৎ ঘাগর বাজারকে কেন্দ্র করে কোটালীপাড়ার ব্যবসা- বাণিজ্য গড়ে ওঠে এবং রাধাগঞ্জের ব্যস্ততা হ্রাস পায়। এদিকে কালক্রমে বর্তমান ভাঙারহাটে রাধাগঞ্জ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রগুলো ভেঙে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই নতুন জমে ওঠা হাটটির নাম হয়ে যায় ভাঙারহাট, যা পূর্ব থেকেই কৃষি ও মৎস্য বাজার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল।

এই হাট দুটির মাঝামাঝি তবে ভাঙারহাট থেকে অপেক্ষাকৃত নিকটে, প্রায় এক কি.মি. দূরে, কোটালীপাড়ার একমাত্র চৈত্র সংক্রান্তি মেলাটি মেলে। চৈত্রের শেষ দিনে মেলাটির আয়োজন করা হয় বড় দল নামক স্থানে। এক দিনের পার্থক্যে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে বড়দল মেলার সব দোকানপাটসহ সকল আয়োজন ভাঙারহাটের বৈশাখি মেলায় স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া ভাঙারহাটের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সেনাইল বাড়ি নামক স্থানে একটি মেলা বসে। জানা যায় এটি কোটালীপড়ার সবচেয়ে পুরোনো চড়কগাছের মেলা। ভাঙারহাটের উত্তর দিকে হাজরা বাড়ির কাছাকাছি এক ভিটায় পাগলের মেলা নামে আর একটি মেলা বসে। স্থানীয়ভাবে উঁচু-টিলা জাতীয় স্থানগুলো ভিটা বলে পরিচিত। স্থানীয় সন্ন্যাসীরা এখানে জড়ো হয়ে বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানার মধ্যে থাকেন। তাদের ভক্তবৃন্দের অংশগ্রহণে মেলাটি প্রচণ্ড জনাকীর্ণ হয়ে থাকে। এসব পাগলের মুখ থেকে এদিন এ- অঞ্চলের ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যায়। এছাড়া তারা ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করার উদ্দেশ্যে স্ব-স্ব পন্থায় ধর্মকর্মে মগ্ন হয়ে থাকেন। এই মেলা উপলক্ষে একসাথে এত ধর্মগুরুর সমাগম সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

এদিকে চৈত্রসংক্রান্তির বড়দলের মেলা থেকেই উৎসবপ্রিয় কোটালীপাড়াবাসী বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠে। বড়দলের মেলার স্থায়িত্ব এক দিন। এরপর এ মেলার আয়োজন অর্থাৎ দোকানপাট ভাঙারহাটসহ আশপাশের বিভিন্ন বৈশাখি মেলায় স্থানান্তর করা হয়।

বড়দল নামটি নিয়ে দুই ধরনের মত প্রচলিত। অনেকেই মনে করেন শুরু থেকেই মেলার জনসমাগম ও এই অঞ্চলের সবচেয়ে আয়তন বহুল হওয়ায় বড়দলের মেলা নামে এটি পরিচিতি পায়।

কেউকেউ আবার বলেন শুরু থেকেই স্থানটি বড়দল নামে পরিচিত ছিল। তাদের মতে, অনাবাদি খাস জমি ছিল জায়গাটি। বর্ষকালে সাধারণত প্লাবিত হয়ে ভাসমান জলজ উদ্ভিদ ও ঘাস জাতীয় লতাগুল্মে আকীর্ণ থাকে। স্থানীয় কৃষকরা এসব উদ্ভিদকে দল বলে থাকে এবং নানা কাজে যেমন : পচিয়ে সার তৈরি, নীচু স্থান ভরাট, ভাসমান শাক-সবজি বাগান তৈরি ইত্যাদিতে ব্যবহার করে থাকেন। আশপাশে এর মতো বিস্তীর্ণ আয়তনের এবং এত বড় ও ঘন দল সমৃদ্ধ জমি চোখে পড়েনি বলে বড়দল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে জায়গাটি।

সাধারণত মেলা অনুষ্ঠান স্থানীয় হাট-বাজার, মন্দির-আশ্রম, রাস্তার পাশের বড় বটবৃক্ষের নীচে অথবা কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় বসে। কিন্তু বড়দলের মতো খোলা মাঠে মেলা আয়োজন রহস্যজনক বটে! জমিটার মাঝের খানিকটা অংশ কিছুটা উঁচু ছিল এবং এখনও আছে, যেখানে একটি অতি পুরোনো বটবৃক্ষ দেখা যায়। জনশ্রুতি রয়েছে স্থানীয় ব্রাহ্মণরা স্থানটিকে গুপ্তধন সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। শুরুর দিকে অনেকেই সেসব দেখেছেন বলে শোনা যেত। সাতটি ঢাকনায় পেচানো সাপ। প্রথম হাড়িটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং তার উপরে একটি ময়না পাখি বসে আছে। জনশ্রুতি রয়েছে লোভী লোকেরা এই গুপ্তধন কুক্ষিগত করতে অনেক অপচেষ্টা চালাতো। এর ফলশ্রুতি তারা কেউ পাগল অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়। তখন তারা কেবল এই গুপ্তধন সম্পর্কিত আলাপ করতে থাকত, কখনও একা একা বিড় বিড় করতে থাকত। কোনো এক সময় অধর্মের কর্মফলের পরিণতিতে সেই গুপ্তধন উধাও হয়ে যায়। এতে ধর্মগুরুরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ভবিষ্যতে গুপ্তধন ফিরে পেতে এবং ভাবী ধ্বংসলীলা বিশেষ করে গুপ্তধন সংক্রান্ত অভিশাপের আশঙ্কা থেকে এ অঞ্চলকে রক্ষা করতে এই স্থানটিতে মেলা বসানো হয়। তবে এসব গুপ্তধন পূর্বস্থানে ফিরে এসেছে কিনা জানা যায়নি। এখনও স্বপ্নের মাধ্যমে অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে গুপ্তধন দেখতে পান। বিশ্বাস করা হয় এসব গুপ্তধন জড় নয় বরং জীবিত। এটি স্থান পরিবর্তন করে। স্বপ্নে বিভিন্ন প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে এখনও অনেকের মস্তিষ্ক বিকৃতির ঘটনা শোনা যায়। কারো কারো কাছে স্বপ্নযোগে এসব গুপ্তধন বিভিন্ন জিনিস চায়। বিনিময়ে তাদের প্রচুর ধনরত্ন দেওয়ার আশ্বাস দেয়। শোনা যায় কারও কাছে ডাব-নারিকেল দাবি করে। এর অর্থ ধরে নেওয়া হয় অল্প বয়স্ক সন্তান। কখনও চাওয়া হয় পাকা নারিকেল। প্রাচীনেরা যার অর্থ বলেন বয়স্ক মা-বাবা। এসব অসম্ভব লেনদেন কেউ করেছে বলে শোনা যায়নি। তবে কেউ কেউ গুপ্তধনের কাছে বিভিন্ন ওয়াদা করে, যেমন-গুপ্তধন পেলে সে এ থেকে এত অংশ দান করবে। অথবা নিজ ধর্ম অনুযায়ী মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি উন্নয়নে ব্যয় করবে। এসব স্বপ্নে কেউ কেউ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেরও আদেশ পায়। গুপ্তধনের আশায় সেসব অনুষ্ঠান বিচিত্র হয়ে থাকে। এমনও ধারণা করা হয় ধর্মগুরুরা বড়দলে মেলা বসানোর ব্যপারে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছিলেন এবং এভাবেই কোনো এক সময় মেলা বসানোর পরামর্শ দেন তারা।

তবে ঠিক কখন থেকে এই মেলার আয়োজন করা হয় তার কোনো লিখিত ইতিহাস বা সর্বজন স্বীকৃত নির্দিষ্ট কোনো সময় জানা যায় না। বয়োবৃদ্ধরা মেলার আদি ইতিহাস তাদের বাপ দাদাদের কাছে শুনেছেন। তারাও শুনেছেন তাদের বাপ-দাদাদের কাছে। এমনও ধারণা করা হয় এ মেলার ইতিহাস বৈশাখি মেলার চেয়েও পুরোনো যারা মেলাটি এখনও আয়োজনের সাথে জড়িত সেই দিঘলিয়া গ্রামের কালীবাড়ির ব্রাহ্মণরাও কেবল তাদের পরম্পরা অনুসরণ করে আসছেন। এর বাইরে কোনো ইতিহাস তারাও জানেন না।

বর্তমানে এই মেলায় বৈশাখি মেলার চেয়ে আলাদা তেমন কিছু চোখে পড়ে না। বয়সীরা দেখেছেন এখানে পূর্বে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের মানত সম্পন্ন করত। তবে এখানে কখনও চড়ক গাছের আয়োজন হতো কিনা জানা যায় না। এখনও পর্যন্ত এখানে কোনো ধর্মশালাও নির্মিত হয়নি। আগের চেয়েও ঘন জনবসতি দেখা যায় এবং বড় দলের মূল মাঠটিও দিন দিন আবাদি জমির আওতায় চলে যাচ্ছে। এককালে এখানে ঘোড়া দৌড়, নৌকা বাইচের আয়োজন করা হতো। কোনো কোনো বছর মেলায় সার্কাস খেলার আয়োজন থাকতো।

ভাঙারহাটের মেলার আলোচিত বিষয় মিষ্টি প্রস্তুতকারীদের প্রতিযোগিতা। এখানকার মিষ্টি বরিশাল ও ফরিদপুরে সমাদৃত ছিল। এ-ছাড়া মেলায় ফরিদপুরের খেজুর গুড়ও পাওয়া যেত।

মেলায় কোটালীপাড়ার সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমাগম ঘটে। স্থানীয় কুমোরদের তৈরি খেলনা শিশু-কিশোরদের এখনও প্রধান আকর্ষণের বিষয়। কিছুদিন আগেও গৃহিণীদের সিংহভাগ প্রয়োজন মেটাতো এই মেলার জিনিসপত্র। গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় হাড়ি, কলসি, বড় পাত্র, মুড়ি-চিড়া ভাজার সরঞ্জাম, পিঠার সাজ ইত্যাদি এখনও কুমোরেরা যত্নের সাথে তৈরি করে। তবে দিন দিন মাটির তৈরি তৈজসপত্রের স্থান দখল করছে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ইত্যাদি। মেলায় পূর্বে যেসব তামা-কাঁসার থালাবাসন, ঘটি ইত্যাদি দেখা যেত সেসব কেবলই ঐতিহ্য হয়ে স্মৃতিতে গাঁথা। তবে মেলাকে কেন্দ্র করে এখনও কাঠের আসবাব, বাঁশ-বেতের তৈজসপত্র এবং পেশাজীবীদের জিনিসপত্রের বিশেষ জোগান লক্ষ করা যায়।

ছোটদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক শো ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। এসব স্থানে উপচেপড়া ভিড় লেগে থাকে। কোনো এক সময় তারা ভীড় করে মাটির তৈরি খেলনার দোকানে। পরম আগ্রহের সাথে বেছে নেয় পছন্দের খেলনা—মাটির তৈরি রঙ বে-রঙের পুতুল, নৌকা, জাহাজ, পাখি, গরু, ঘোড়া, হাতি, ব্যাংক, ছোট-ছোট হাড়ি, কলস, কড়াই, চুলা, রঙিন ফলমুল ইত্যাদি। এসব খেলনা এখন প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামেও তৈরি হয়। মেলার এক পাশে থাকে কিশোরীদের সাজগোজের সামগ্রী।

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে তালের পাখার দোকানগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। পাখায় ফুটে ওঠা নকশা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের চিহ্ন। অতিরিক্ত জটলা দেখা যায় বাঁশের তৈরি বাঁশি আর অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলোতে। এসব দোকানগুলোর পাশ ঘেঁষে দেখা যায় বিভিন্ন খেলাধুলার সরঞ্জামের দোকান। সেসব দোকানে পোস্টার, ক্যালেন্ডার, বইপত্র ইত্যাদি মনহারী দ্রব্যাদি বিক্রি করা হয়।

মিষ্টির দোকানগুলোতে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা জমিয়ে তোলে অতিথিপরায়ণ বাঙালি। এ ছাড়া ঝালমুড়ি, আচার, আইসক্রিম, চটপটি, চকলেট, চা-সিগারেট, মিষ্টি জর্দার পান ইত্যাদি দোকানের পাশাপাশি হকারদের হাতেও দেখা যায় এবং হকারদের সাথে পাল্লা দিয়ে স্থানীয় কিশোররাও এসব দোকান নিয়ে বসে।

সন্ধ্যার পরে যাত্রাপালা, নাচ-গান ইত্যাদির আসর বসে এবং চলতে থাকে মাঝরাত পর্যন্ত। কখনও প্রায় সারা রাত। শিশু-কিশোররা সারাদিন হৈ-হুল্লোড় শেষে দলে দলে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরতে থাকে। সবার হাতে হাতে বিচিত্র সব জিনিসপত্র। কেউ বাঁশি বাজাতে বাজাতে, কেউ ঘুড়ি দোলাতে দোলাতে, কেউ খেলনা নাচাতে নাচাতে মহা আনন্দে ফিরে যায় গৃহপানে। মনে হয় মেলা থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ছুটে যাচ্ছে চারদিকে।

মেলায় ভাঙারহাটের সবদিকের গ্রাম থেকে জনসমাগম ঘটে। হাটের পূর্ব দিকের গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে-হাসুয়া, পিড়ার বাড়ি, নাইয়ার বাড়ি, ভূতের বাড়ি, কাফুলা বাড়ি, জহরের কান্দি, বান্দাবাড়ি; উত্তরের দিকে-হাজরা বাড়ি, লাটেঙ্গা ভিটা, লকন্ডা, তুলসি বাড়ি, পোলোটানা, মুসুরিয়া, ঝুটিয়া, ফনাবাড়ি, কালিগঞ্জ ও মাছপাড়া; পশ্চিম দিকে-দিঘলিয়া, রাধাগঞ্জ, মান্দ্রা, খেজুরবাড়ি, লাখিরপাড়, রামনগড়, শ্রীফল বাড়ি এবং দক্ষিণ দিকের গ্রামগুলোর মধ্যে নারিকেলবাড়ি, ডগলাস গাববাড়ি, ভূতুরিয়া, বটবাড়ি, মাদারবাড়ি, দেবগ্রাম, পিত্তলপাড়া, সিতাইকুণ্ড, উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া হরিনাহাটি, চিত্রাপাড়া, উনশিয়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়াসহ সমস্ত দক্ষিণ কোটালীপাড়া অঞ্চল।

মেলায় বয়স্করা বা বড়দের দল বিশেষভাবে বিকেলের দিকে জড়ো হতে থাকে। তারা মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, মিষ্টি ইত্যাদি তাদের বাড়ি ফেরা উদ্যোগী ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দেয়। রাতে জমে ওঠে গানের আসর। উৎসবে প্রিয় বাঙালিরা নারী- বুড়োদের সাথে নিয়ে উপভোগ করতে থাকে অনিন্দ্য উৎসব-ঐতিহ্যে ও স্পন্দনে ভরিয়ে দেয় বাংলার আকাশ-বাতাস-পথ-ঘাট।

৬. ফুলগাছার মেলা

প্রায় দুইশত বছর পূর্বে যতীন্দ্রনাথ মণ্ডলের পূর্বপুরুষ গৌরহরি মন্ডল মহাশয়ের ব্যবসা ছিল. বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বাদায় কাঠ সংগ্রহ করা। একদা তিনি বাদায় গিয়েছিলেন কাছ সংগ্রহ করতে। শ্বাপদ হিংস্র জন্তু জানোয়ারের অভাব ছিল না। একবার বিপদ বুঝতে পেরে প্রায় সারারাত করুণ সুরে কেঁদে কেঁদে ‘হে মা তুমি রক্ষা কর’ বলে প্রার্থনা জানান, আর এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েন। বনমাতা স্বপ্নযোগে বলে, গৌর এই লাঠিখানা নে। এই লাঠিখানা পেয়ে একেবারে সোজা করে দাঁড় করিয়ে আস্তে ছেড়ে দিবি। লাঠি খানা যে দিকে হেলে পড়বে, ঐ দিকে কাঠ সংগ্রহ করতে যাবি না। তোর কোনো বিপদ হবে না। আরও বলে, লাঠিখানা বাড়ি নিয়ে তোদের বাড়ির কাছে যে বড় পুকুর আছে, ঐ পুকুর পাড়ে যে হিজল গাছটা আছে ওখানে রাখবি। আমি প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় শনিবারে ওখানে যাব। ওইদিন গাছটাতে ফুলদিয়ে সুন্দর করে সাজাবি আর পূজা দিবি। আমাকে যে ভক্তিভরে স্মরণ করবে আমি তার মনোবাসনা পূর্ণ করব। যতীন মণ্ডল নিজেই দেখেছেন সে লাঠিটা লাঠিখানা ছিল পৌনে তিন হাত লম্বা এবং আঙুল পরিমাণ মোটা। লাঠিখানা গাছের গোড়ায়ই থাকতো। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় লাঠিখানা কোথায় হারিয়ে গেছে আর পাওয়া যায়নি।

প্রকাশ থাক যে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গ্রামবাসী কেউই এদেশে ছিল না। বন্যাও হয়েছিল মারাত্মক। তখন থেকেই এই গাছতলায় পূজা হতে থাকে। আর এখনও তা বহমান আছে। গাছটি বুড়ামার গাছতলা নামে খ্যাত। এই উপলক্ষে এখানে দুইদিনব্যাপী মেলা বসে। ভক্তরা দলে দলে যোগদান করে এই পূজার দিন। কেউ যদি বিপদে পড়ে কায়মনে বুড়ামার কাছে মানত করে, তার ফলও পায়। প্রতি বছর মায়ের কাছে মানত করে ধান বা অন্য কিছু। ওইদিন সে মানত পরিশোধ করে। এতে প্রায় ৫০-৬০ মন ধান পড়ে। চিনির তো কোনো কথাই নেই। চিনি তখনই ভক্তদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। ধান পরে বিক্রি করা হয় এবং ওই টাকা দিয়ে মায়ের মন্দিরের উন্নয়ন কাজ করা হয়। মেলা শেষে চলে নানা ধরনের খাবারের ব্যবস্থা। জামাই-মেয়ে ও বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন এসে থাকে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে।

মেলাকে সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে পরিচালনার দায়িত্ব থাকে অত্র এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ থানা প্রশাসন।

৭. ওড়াকান্দি র মেলা

শ্রীধাম ওড়াকান্দি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অন্যতম তীর্থস্থান। হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিকে উপলক্ষ করে প্রায় সপ্তাহব্যাপী এখানে যে মেলা হয় তা মহাবারুণীর মেলা নামে খ্যাত।

এই জনপদের অনেক মেলা কালের অতলে হারিয়ে গেছে। কিন্তু মহাবারুণীর মেলাটি যেন দিন দিন আরও প্রসার লাভ করছে। বলতে গেলে হিন্দু সম্প্রদায়সহ দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য ধর্মের লোক পুণ্য লাভের আশায় পুণ্যস্নানের এই মহাবারুণীতে যোগদান করে থাকে। হরিচাঁদ ঠাকুরের মতাবলম্বীদের ‘মতুয়া’ বলা হয়। তারা লাল নিশান ধারণ করে জয়ডঙ্কা, কাঁসার ও পশুশৃঙ্গের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ‘হরিবল’ বলতে বলতে পদব্রজে যোগদান করে এই পুণ্যতীর্থে। ওড়াকান্দিতে নারীপুরুষ সম্বলিত মতুয়ার দল প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে ঠাকুর বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে। মতুয়াদের সেবা যত্ন করলে অশেষ পুণ্য লাভ হয় বলে পথে পথে প্রতিটি এলাকার গৃহস্বামীরা মতুয়াভক্তদের যে যার সাধ্যমতো আপ্যায়ন করে থাকে। তদুপলক্ষে যেসব খাবারের আয়োজন করা হয় তা মহাপ্রসাদ নামে পরিচিত। এতে সাধারণত নিরামিষ বা খিচুড়ির আয়োজন করতে দেখা যায়। এরপর ঠাকুরের জন্মতিথি অর্থাৎ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে শুরু হয় পুণ্যস্নান। হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরিরা শ্রী শচীপতি ঠাকুর, শ্রী হিমাংশুপাতি ঠাকুর ও শ্রী পদ্মনাভ ঠাকুর প্রথমে স্নান করে শুভ উদ্বোধন শুরু করেন এই বারুণীস্নানের। তারপর ভক্তরা হরি মন্দিরকে প্রদক্ষিণ করে উক্ত মন্দিরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত কামনা সাগরে স্নান শুরু করেন। হরিবল, হরিবল রব ও জয়ডঙ্কার তানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিদেশ থেকেও অনেক হরিভক্ত যোগদান করে এই মহাবারুণীর মেলায়। দেখা যায় প্রায় প্রতিবছরই স্থানীয় প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা, রাষ্ট্র প্রধান ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা এই ঐতিহাসিক মেলা উপভোগ করতে ছুটে আসেন। লক্ষাধিক হরিভক্তের এই মেলায় স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে নিরাপত্তার বিধান ও সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন।

পূজা-পার্বণ

‘বারো মাসে তেরো পূজা’ এই কথাটি কোটালীপাড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে প্রতিমাসেই পূজা অনুষ্ঠিত হতো। এলাকার সিংহভাগ মানুষ হিন্দু হওয়াতে এমনটি হতো। আবার পাকিস্তানি এবং ব্রিটিশ আমলে কোটালীপাড়া ছিল বনেদী হিন্দু পরিবারের বাস। বৈদিক ব্রাহ্মণের অভাব ছিল না। আবার ধনী পরিবারের অধিকাংশ লোক বসবাস করতো কলকাতায়। পূজার সময় হলেই জন্মস্থানে ফিরে আসতেন এবং পূজার কাজটি সেরে কর্মস্থলে চলে যেতেন।

তথ্যসহায়ক

১. নীরোদ মজুমদার, বয়স-৬১, পেশা : ব্যবসা, গ্রাম : রামদিয়া, উপজেলা : কাশিয়ানী, জেলা : গোপালগঞ্জ।

২. সুরেশ্বর বিশ্বাস, বয়স-৭১, পেশা : অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, গ্রাম : দেবাশুর, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ। এ জাফর আহমদ, গ্রাম : সিতাইকুণ্ড, কোটালীপাড়া। মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, গ্রাম : শীঙ্গলবাড়ি, কোটালীপাড়া

৩. যতীন্দ্রনাথ মন্ডল, বয়স : ৯২ বছর, গ্রাম : বারখান্দিয়া, গোপালগঞ্জ।

৪. বিমল বিশ্বাস, পেশা : শিক্ষক, খান্দারপাড়, ইন্দুহাটি ইউনিয়ন হলধর উচ্চ বিদ্যালয়, মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ।

৫. জগদীশ, গ্রাম : পূর্বপাড়া, কোটালীপাড়া।

৬. হায়দার আহম্মেদ, গ্রাম : পূর্ণবতী, কোটালীপাড়া।

৭. বেলা ভাবুক, স্বামী : অমূল্য ভাবুক,পূর্বপাড়া, কোটালীপাড়া (কালিমন্দিরের পূজারিণী)। রামানন্দ বালা, পূর্বপাড়া, কোটালীপাড়া।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন