লোকনৃত্য (Folk Dance )

লোকনৃত্য

সন্তুষ্টি বিধানের প্রয়াস হতেই মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয়েছে। সেই সন্তুষ্টি নিজের হোক বা অপরের হোক। প্রাচীনকালে অসহায় অরণ্যচারী, বৃক্ষচারী ও গুহাবাসী মানুষের অসহায়ত্ব হতে ধর্ম বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে, সে কথা ইতিহাসবিদরাও বলে থাকেন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, প্লাবন, অগ্নুৎপাত, দাবানল, তাছাড়াও রোগব্যাধি, হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ প্রভৃতি যখন মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিল, তখন একদিন হয়তো আদিম মানুষের মনে ধারণা হয়েছিল ঐ সমস্ত ঘটনার পিছনে কোনো না কোনো অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। আর সেই শক্তিকে সন্তুষ্ট করতে পারলে বিভিন্ন বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেই চিন্তা থেকেই আদিম মানুষ তার কল্পনার অদৃশ্য শক্তিকে বিভিন্ন রূপে রূপায়িত করতে থাকে। বাংলায় কৃষ্টি শব্দটির মধ্যে এর তাৎপর্য পাওয়া যায়। কৃষ্টি শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা Culture। যার অর্থ সংস্কৃতি, কর্ষণ, চাষ বা চর্চা প্রভৃতি।

Culture শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে Latin Coleve শব্দ থেকে। Coleve শব্দের অর্থ হলো Worship বা আরাধনা বা অর্চনা করা। কাজেই পূজা/অর্চনা হতে জ্ঞান বিকাশের সূচনা হয়েছে তা বলা যায়। দেব-দেবীকে ভালো খাবার দিলে তারা সন্তুষ্ট হতে পারে। তাই ভালো খাবার প্রস্তুতের প্রচেষ্টা হতে ধীরে ধীরে খাবারের মান উন্নত হতে থাকল। তাদের ভালো জায়গায় রাখলে তারা সন্তুষ্ট হতে পারে। তাই ভালো স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। তাদের সামনে নাচলে গাইলে তারা সন্তুষ্ট হতে পারে। সেই চিন্তা থেকে সংগীত ও নৃত্য শৈলীর বিকাশ ঘটতে থাকে। তাদেরকে বিভিন্ন সজ্জায় সাজালে তারা সন্তুষ্ট হতে পারে। তাই কারু শিল্পের উন্নতি ঘটতে থাকে। তাদেরকে ভালো কথায় বা ভাষায় স্তুতি করলে তারা তুষ্ট হতে পারে। সেই থেকে ভালো শব্দ চয়ন ও ছন্দময় সাহিত্য রচনা হয়েছে। এ পর্যায়ে নৃত্য একটি অন্যতম বিষয়।

লোকসংস্কৃতির যত ধারা বা শ্রেণি বিন্যাস আছে প্রত্যেকটির উৎসের পিছনে ঐ রকম কোনো না কোনো কারণ নিহিত রয়েছে। বংশ পরম্পরায় সমাজ জীবনে তা শক্ত ভীত করে নিয়েছে। নৃত্য হলো বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মের অধীনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। এই অঙ্গ সঞ্চালনের আজকের দিনের রূপ অতীত রূপের রূপান্তর মাত্র। বিভিন্ন বদ্যযন্ত্র সংযোজন হয়ে এমনই একটা জায়গা করে নিয়েছে যা আজ বাণিজ্যিকভাবে রূপলাভ করেছে। দেখা যায় বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন নৃত্য বয়ে চলেছে। যেমন—কথক নৃত্য, ভরত নৃত্য, নাট্যম নৃত্য, লোকনৃত্য ইত্যদি। এসব নৃত্য খ্যাত সম্পন্ন হলেও গোপালগঞ্জ জেলাটি আঞ্চলিক নৃত্যে মোটেই পিছিয়ে নেই। শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে যথেষ্ট অগ্রসর। যুগ যুগ ধরে অঙ্গনে অঙ্গনে সমাদৃত হয়ে আসছে এখানকার আঞ্চলিক নৃত্যগুলো। তার মধ্যে অষ্টক নৃত্য, বরণ নৃত্য, বেহারা নৃত্য ও নীল নৃত্য উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি নৃত্যের একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। লোকসংস্কৃতিতে নৃত্য একটি বিশেষ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত।

১. বেহারা নৃত্য

দক্ষিণ গোপালগঞ্জে এই নৃত্যের প্রভাব বেশি ঘটেছে। বিশেষ করে ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারে বিয়ে অনুষ্ঠানে নব দম্পতিকে পালকিতে আরোহনপূর্বক এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে। যারা কাহার (শিবিকা বা পালকি বাহক) তারা ভাঙা ভাঙা সুরে গান গেয়ে এই নৃত্য করে থাকেন। তাই কাহাররা যে সুরে গান গায় তাকে বলে কাহারবা রাগ। পালকির বেহারারা একহাতে পালকির বর্ধিত কাষ্ঠখণ্ড ধরে অন্যহাত সবাই একসাথে তালে তালে ঝুলাতে থাকে। সামনে থাকে নৃত্যকারেরা। রূপশয্যা করে তারা নয়নাভিরাম নৃত্য করে থাকে। ভাঙা ভাঙা গান ভিন্ন তারা এ নৃত্য পরিবেশন করতে পারে না। এই নৃত্যে বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। ভাঙা ভাঙা সুরই তাদেরকে নৃত্য করতে সহায়তা করে থাকে। একটি গান এ রকম—

হুমনা রে হুমনা, হুমনা রে হুমনা
ওহো — ওহো — ওয়ো — ওয়ো — ওয়ো — হো
আজ মারব তোরে রে মোরোগা
কাল মারব তোরে।
ওহো — ওহো — ওয়ো — ওয়ো — ওয়ো — হো
নিশীথে জাগিয়া ওঠ রে মন ডাকিয়া
মনতো রয় না ঘরে রে মোরোগা
আজ মারব তোরে রে মোরোগা
কাল মারব তোরে।
ওহো — ওহো — ওয়ো — ওয়ো — ওয়ো — হো
বাড়ির কাছে আগড়ার বগান রে
জড়িয়া ধরিছে আমার চুল রে মোরোগা
আজ মারব তোরে রে মোরোগা
কাল মারব তোরে।

২. বরণ নৃত্য

বরণ নৃত্য এই অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত। সাধারণত পূজা-অর্চনা, দেবালয়ে কিংবা স্মরণীয়-বরণীয় অনুষ্ঠানগুলোতে এই নৃত্য পরিবেশন হতে দেখা যায়। এই নৃত্যে বাদ্যযন্ত্রের আবশ্যকতা আছে। বসে সম্মুখপানে সমান্তরাল ভাবে হস্তদ্বয় প্রসারিত করে বদ্যযন্ত্রের তালে তালে সুন্দর করে দোলাতে থাকে। ধীরে ধীরে নৃত্যরত অবস্থায় দাঁড়াতে শুরু করে। নৃত্যমঞ্চ ঘুরে ঘুরে নৃত্যকারেরা নৃত্য করে দর্শকদের মনে আনন্দ দান করে। বরণ নৃত্যের মধ্যে আরেকটি নৃত্য আছে, আঞ্চলিক ভাষায় একে আলতি বলে।

আলতি নৃত্যের সময় হাতে বিশেষ কিছু ধারণ করার বিধান আছে। যেমন- -ধূপতি, থালা, পাখা, রুমাল ইত্যাদি। এই আলতি নৃত্যের মধ্যে বিস্ময়কর কিছু আয়োজন নৃত্যকারেরা করে থাকে। মাথায় কল্কি রেখে তার উপর জলপূর্ণ একটি কলসি স্থাপন করে তারা নৃত্য করতে অভ্যস্ত। এই নৃত্য নারী পুরুষ উভয়েই পরিবেশন করে থাকে। এতে কোনো গানের প্রয়োজন হয় না। গোপালগঞ্জ জেলার সব উপজেলায় এই বরণ নৃত্য বেশি পরিবেশন হতে দেখা যায়। অনেকে বাণিজ্যিকভাবেও এই নৃত্যকে বেছে নিয়েছে।

৩. অষ্টক নৃত্য

এই অষ্টক নৃত্য গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রচলন বেশি। সাধারণত চৈত্র বৈশাখ মাসে এই নৃত্য করতে দেখা যায়। সম্ভবত আটজন নৃত্যকার মিলে এই নৃত্য করে বলে এর নামকরণ করা হয়েছে অষ্টক নৃত্য। তবে আটজন মিলেই এ নৃত্য পরিবেশন কারতে হবে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা এখানে নেই। দলে ছোট ছোট দুজন কিশোর-কিশোরী থাকে। তাদেরকে হর-পার্বতী কিংবা রাধা-কৃষ্ণ সাজিয়ে নিতে হয়। তারা নৃত্য করার পরপরই অন্যরা তাদেরকে ঘিরে স্বতন্ত্র সুরে এক প্রকার গান পরিবেশন করে। প্রত্যেক গৃহস্থের দ্বারে যেয়ে নৃত্য করে চাল বা অর্থ তোলে। এভাবে ৭-৮ দিন নৃত্য করার পর এক প্রকার ব্রত পালন করে থাকে। একে বৈশাখি ব্রত বলা হয়। এই নৃত্যের কয়েকটি গান নিম্নে দেওয়া হলো :

এলো সুখ বসন্ত প্রাণকান্ত এলো না ফিরে
কী দিয়া বুঝায়ে রাখি একাকিনী গৃহে থাকি
সহে না আর এ যৌবন জ্বালা।
আমি নারী অভাগিনী বন্ধু হারা হয়ে
কথা আছে মনে প্রাণে খুলিয়া কইব কারে
কেমন করে ধৈর্য ধরে থাকি।
শুনলো সই তোমারে কই মনের দুঃখের কথা
সারা নিশি জেগে থাকি
বন্ধুর জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরি।
অধম হরেণ কেঁদে ভাসে নয়ন জলে
অন্তিম কালে দিও দেখা
বৃন্দাবনের কোলে সোনা
তোমায় হেরে পাপ প্রাণ জুড়াব।

.

ধন্য পূর্ববঙ্গ ধন্য, ধন্য সোনার বাংলাদেশ
ধন্য বঙ্গবন্ধু ধন্য বাংলাদেশ পাই যাহার জন্য
জন্মভূমি ছেড়ে যাব ক্যান।
পায়ে ধরি বিনয় করি ঐ বঙ্গে যেও না
যাও যদি কেউ বাস্তু ছাড়ি
সত্তর যাবা যমের বাড়ি
জীবন গেলে জীবন আর পাবা না।
খালে বিলে নৌকা চলে দেখলাম খুলনার বাড়ি
পুত্র পেলে চড়ে গাড়ি মা বাপে যায় বনগাঁর বাড়ি
মা-মা বলে ধূলায় যায় গড়াগড়ি।
পুত্র হারা হয়ে তারা কাঁদে দিবারাতি
পুত্র শোকে তনু জ্বারা আন্দামানে গেলো তারা
ননীতালে তাদেরও বসতি,
আলসে কুঁড়ে গেলো ছেড়ে পরের টাকার আশে
যেমন কর্ম তেমন ফল ফলে তাহার কর্মফল
জ্বলে পুড়ে মরে হা হুতাশে।
এ মিনতি করি স্তুতি দশের শ্রীচরণে
অধম ক্ষেত্র বলে আমার ওই অন্তিম কালে
দাস বলিয়া রেখ চরণ তলে।

বারখাদিয়ার ক্ষেত্র মহাশয় ছিলেন এই অষ্টক গান রচনায় খুব পারদর্শী। তার রচিত এই গানগুলো আজও অষ্টক দলেরা গেয়ে থাকেন।

৪. নীলনৃত্য

নীলনৃত্য বা শিবাসন নৃত্য সারা গোপালগঞ্জ জেলার একটি পুরোনো ঐতিহ্য। এখানকার আঞ্চলিক নৃত্যের মধ্যে এটি একটি বিস্ময়কর নৃত্য। এই নৃত্য সবাই পরিবেশন করতে পারে না। যারা পারে তাদের মধ্যে কাশিয়ানী উপজেলার নিজামকান্দির গোসাই মল্লিক ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রাতপাড়া নিবাসী মন্টু মণ্ডল উল্লেখযোগ্য। নিম্ব ও বিল্ব কাষ্ঠগাত্রে হর-পার্বতীর পবিত্র আসনকে পাটবান বা শিবাসন বলে। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬-৭ ফুট, ওজন প্রায় এক মন। এই পাটবান বা শিবাসনকে মাথায় নিয়ে হাত দ্বারা স্পর্শ না করে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নৃত্য করতে থাকে। কোনো এক সময় দেখতে পাওয়া যাবে ভীষণভাবে ঘুরছে। তবুও ঐ শিবাসনকে নৃত্যকারেরা হাত দ্বারা স্পর্শ করে না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন