পোশাক-পরিচ্ছদ (Ware & Ornaments)

লোকপোশাক-পরিচ্ছদ

ধুতি, পাজামা, পাঞ্জাবি, শাড়ি, লুঙ্গি, শায়া, ব্লাউজ, সালোয়ার, কামিজ ও প্যান্ট, শার্ট দেশবাসীর সাধারণ পোশাক। এসবের মাঝেও অঞ্চল ভেদে কিংবা পেশাদারিত্ব ও জীবনাদর্শের ভিত্তিতে কিছু ব্যতিক্রমী পোশাক দেখতে পাওয়া যায়। এ অঞ্চলটিও এর ব্যতিক্রম নয়। তার কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো।

১. ধর্মীয় জীবনাদর্শে আলেম-ওলামাদের পোশাক পাজামা, আলখেল্লা ও টুপি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের এই পোশাক সাদা রঙের হয়ে থাকে। হাতে তজবি ও কাঁধে একটি রুমাল দেখতে পাওয়া যয়। কিন্তু মারফতপন্থিদের পোশাক ভিন্নতর। মাথায় বাবরী চুল, অনেকে দাড়ি গোঁফ রেখে থাকেন। পাজামার পরিবর্তে অনেক মারফতপন্থি লুঙ্গি ব্যবহার করেন। গামছা তাদের নিত্যসঙ্গী। সাধু সন্ন্যাসীরা আদল গায়ে থাকতে পছন্দ করেন। চুল, দাড়ি ও গোঁফ রেখে থাকেন। গলায় ঝুলানো থাকে রুদ্রাক্ষ, তুলসী ও আচিয়ার মালা। কারও কারও বাহুতে রুদ্রাক্ষের বেড়ি দেখতে পাওয়া যায়। গলে গামছা ঝুলতেও দেখা যায়। কোনো কোনো সাধুর মাথায় দেখা যায় লম্বা ও ঝাটালো জট। পদভূষণ তাদের খড়ম। অবশ্য খড়মের ব্যবহার আগের থেকে কম। অনেক সাধু মাছ, মাংস পরিত্যাগ করেছেন। কেউবা শুধু বুধবারে নিরামিশ খান। আবার কেউ খাবার সময় কথা বলেন না। ভক্তরা সাধু বৈষ্ণবদের জন্য সুস্বাদু খাবারের আয়োজন করে থাকেন। ওড়াকান্দি হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তদের মতুয়া বলা হয়। তাদের পোশাক প্রায় একই রকম। তবে এই মতাবলম্বী দলনেতাদের হাতে সোয়া হাত পরিমাপের একটি লাঠি দেখতে পাওয়া যায়। একে ছোটা বলা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে হাতে ধাতব নির্মিত বয়লা ধারণ করে থাকেন। আবার অনেক সন্ন্যাসী আছেন যারা শুধু ল্যাংটি ব্যবহার করেন। কেউবা একেবারে দিগম্বর। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কিছু সাধু ফকিরদের দেখতে পাওয়া যায় গায়ে শিকল পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেক সাধুর কাঁধে ঝোলা স্থান পেয়েছে। শৈব্য ভক্তদের বেশভূষা ভিন্ন। তারা প্রায়ই লাল বা গৈরিক পোশাক ব্যবহার করেন। এবং হাতে থাকে ত্রিশূল। বৈষ্ণব ভক্তরা বেশ স্বতন্ত্র। তারা মাথায় চৈতন্য বা শিখি বা টিক্কি ধারণ করেন। গায়ে জড়িয়ে রাখেন নামাবলি।

২. কৃষকরা কৃষি কাজের জন্য ঢিলেঢালা অতি সাধারণ পোশাক ব্যবহার করে। গামছা তাদের প্রিয় পোশাক। হাল চালাতে গামছা, ধান কাটতে গামছা, বোঝা বইতে গামছা, স্নান করতে গামছা, খাবার শেষে হাত মুছতে গামছা, দৈ পাতাতে গামছা, গরমে বাতাস করতে গামছা। গামছা কৃষক পরিবারে নিত্য দিনে হরেক কাজের একটি প্রয়োজনীয় পোশাক। পুরুষের শরীর ডিঙায়েও নারীর কোমল অঙ্গ গামছা স্থান করে নিয়েছে। তারা ভিজা চুলের জল নিষ্কাশনে গামছা মুড়িয়ে রাখে। যুবতীদের বক্ষপরেও ওড়না হিসেবে গামছাকে ঠাঁই পেতে দেখা যায়।

৩. এখানে আছে বিভিন্ন ধরনের গানের দল। যেমন-রামায়ণ, পদাবলি কীর্তন, নামযজ্ঞ, রামযাত্রা, হরিযাত্রা, গুরুযাত্রা ও সাগরভাসা যাত্রার দল। প্রত্যেক দলে এক এক ধরনের পোশাক দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত লাল, হলুদ ও গৈরিক রঙের পোশাক তারা ব্যবহার করে থাকেন। এটা নির্ভর করে দলনেতার পছন্দ-অপছন্দের উপর।

হিন্দু ধর্মে পিতা-মাতা কিংবা তৎসমতুল্য কেউ পরলোক গমন করলে তার পুত্র সন্তানেরা পরলোকগত ব্যক্তির মঙ্গল কামনার্থে একটি ব্রত পালন করে। নাম গুরুদশা। এই গুরুদশা পালন করতে তারা এক ধরনের পোশাক ব্যবহার করে। বিশেষ করে দশদিন তাদেরকে সাদা থান কাপড় বা ধুতি পরিধান করতে হয়। স্নান করার সময়ও সে পোশাক বদলানো যাবে না। সিক্ত বসন গায়ের তাপে শুকিয়ে নিতে হয়। গলায় ঝুলানো থাকে ঐ পরিধেয় বস্ত্রের কাপড়ের পাড় দ্বারা তৈরি দড়ির মতো বস্তু। এটির নাম ধড়া। তাতে ঝুলানো থাকবে তাবিজ বা লোহা নির্মিত কোনো বস্তু। কেশ বিন্যাস করা যাবে না। মাছ-মাংস পরিহার করতে হবে। স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ। অন্ন গ্রহণ না করে ফলমুল খেয়ে ওই দশদিন অতিবাহিত করার পৌরাণিক প্রথা এখনও বয়ে চলেছে।

ছোট শিশুদের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় হরকাঠি। আঞ্চলিক ভাষায় একে হক্কার কাঠি বলে। তারপর শিশুদের কপালে বড় একটি কালির ফোটা মায়েরা দিয়ে থাকে। এতে কারুর কোপদৃষ্টি লাগবে না বলে বুড়া বুড়িরা বলে গেছেন।

দেখা যায় অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা হাতে একটি ছড়ি ব্যবহার করে। এটি তারা আভিজাত্যের নমুনা বলে জানে। কবিরাজদের পোশাকেও অনেকটা ভিন্নতা আছে। কাঁধে ঝোলা, হাতে ধাতব বয়লা, মাথায় চুল, গলায় মালা। ঝোলায় থাকে হরেক রকমের গাছ-গাছড়া, জীব জন্তুর কঙ্কাল বা অস্থি। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নারিকেল বাড়ি গ্রামে ধীরেন কবিরাজ ছিলেন খুবই বিখ্যাত। বার্ধক্য শরীরেও গাছ- গাছড়ার বড় এক বোঝা সবসময় কাঁধে ঝুলিয়ে কবিরাজি ব্যবসা করতেন।

ফেরিওয়ালাদের পোশাক চমকপ্রদ। রঙ-বেরঙের কাপড় দিয়ে বানিয়ে নেয় পোশাক। পুরাদস্তুর জোকার সেজে নেমে পড়ে বাণিজ্যে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য এটি ফেরিয়ালাদের সহজাত প্রবৃত্তি। ভিক্ষুকদের পোশাক সবচেয়ে জীর্ণ শীর্ণ। মলিন দেহে ওই শীর্ণ পোশাক তাদেরকে একেবারে দৈন্য বানিয়ে দেয়। অনেক ভিক্ষুক ইচ্ছে করে কাঙাল বেশ ধারণ করে থাকে।

শবযাত্রীদের বিশেষ করে হিন্দু শবযাত্রীদের পোশাক ভিন্ন। প্রত্যেকে গামছা পরা। একেবারে সাধারণ পোশাক বা আগলা গা। মাথায় থাকে গামছা বাধা। হরি হরি বল, হরি বল—এই ধ্বনি উচ্চারণ করে তারা চিতায় শব অবস্থান করায়। তারপর দাউদাউ আগুনে শবদাহ করে আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গান গায়। যেমন :

(১)

আমার বিয়ার যাত্রী যারা
তারা সবে গামছা পরা
লোকপোশাক-পরিচ্ছদ

(২)

নৌকা ডুবল বালু চরে রে
ওরে আমার সাধের নৌকা রে

৪. মেয়েলি পোশাকের মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায় বোরখা ব্যবহার করে থাকে। তাদের অঙ্গসৌষ্ঠব আবৃত করে রাখার এটি একটি ধর্মীয় রীতি। বর্তমান থেকে অতীতে এটির ব্যবহার ছিল বহুল প্রচলিত। ‘গোপালগঞ্জ শহরের ইতিকথা’ গ্রন্থে আবুল হোসেন ভূঁইয়া সেকালের গোপালগঞ্জের মুসলমান জীবনের একটি পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে উল্লেখ করেন-’সে যুগে সকল মুসলিম মহিলা বোরখা পরিহিত অবস্থায় রাস্তাঘাট বা অন্যত্র চলাফেরা করতেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও সেকালে বিত্তহীন পরিবারের ধর্মভীরু মহিলারা পর্দা প্রথাকে বজায় রাখার জন্য লুঙ্গির একপ্রান্তে গিট দিয়ে ওটা বোরখা হিসেবে ব্যবহার করতো। এতে তাদের কোনো লজ্জাবোধ বা লেশমাত্র বিড়ম্বনা ছিল না, বরং ধর্মীয় বিধান মানাটাই ছিল তাদের কাছে মুখ্য।’

নারীরা সাধারণত সৌন্দর্য বিলাসী। অঙ্গাভারণে বাহারী বেশ ভূষায় সর্বযুগে তা ফুটে উঠেছে। চুলে চুলকাটা, কপালে টিপ, কানে দুল, নাকে নাকচাপা, গলায় হার, বুকে ওড়না, হাতে চুড়ি, আঙ্গুলে অঙ্গরী, কোমরে কোমর বন্ধ, পায়ে আলতা, নখে কুমকুম ইত্যাদি। কান, নাক এসব অঙ্গ ছেদন করে বিলাসী হওয়ার পিছনে তাৎপর্য আছে। নিজেদেরকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে পুরুষদের মনাকর্ষণ নারীদের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। এটা মোটেই দোষাকর নয়। প্রকৃতির সৃষ্টিকে বিকাশশীল রাখতে নারীর অন্তরে কামনারূপে বিকশিত হয়।

বিধবা মহিলাদের পোশাক-আশাক ভিন্ন। বিশেষ করে হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রে। তারা শাখা সিঁদুর ব্যবহার করতে পারে না। সিঁদুর সীসার একটি উপধাতু। যা নারীদেরকে কামকেলীতে উৎসাহিত করে। শঙ্খ হতে শাখা তৈরি হয়। শিব কামের দেবতা। এজন্য শিব শঙ্খ প্রিয়। শিবের আশিস লাভ করতে হিন্দু নারীরা শাখা ব্যবহার করে থাকেন। বিধবা অবস্থায় কামনা নিবৃত্তি করার সামাজিক স্বীকৃতি নেই। তাই বিধবাদের ওই দুটি কামোত্তেজক পদার্থ ব্যবহারে বৈধ্যতা নেই। স্বামী গ্রহণ করার পর আবার তারা ওইগুলো ব্যবহার করতে পারবে। শাখা সিঁদুরের গুণাগুণ সম্পর্কে প্রাচীনেরা এই আয়ুর্বেদিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। বস্ত্র ব্যবহারেও বিধবারা পৌরাণিক সংযমী নীতি অনুসরণ করে থাকে। নকশি করা কাপড় তারা ব্যবহার করে না। লাল পাড়ের কাপড়ও না। এক রঙের কাপড় তাদেরকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। সাধারণত সাদা ধুসর গৈরিক এই ধরনের শাড়ি ব্যবহার করে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন