লোকপ্ৰযুক্তি (Folk Technology)

লোকপ্ৰযুক্তি

১. নৌকা

নৌকা লোকপ্রযুক্তির অন্যতম আরেকটি নিদর্শন। জলাময় এই জনপদের একদা যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল নৌকা। এই নৌকা নির্মাণে তাদের মনন মেধা যেভাবে ফুটে উঠেছে তা যেনতেনভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। জলে টেকসই এমনতর গাছ দিয়ে তৈরি করে নেয় বিভিন্ন ধরনের নৌকা। গলৈ, গুরা, চরাট, মাচাল, বৈঠা, হাল, চৌড় এগুলো নৌকার উপকরণ। পাতাম দিয়ে নৌকা মিস্ত্রিরা একটার পর একটা তক্তা লাগিয়ে তৈরি করে নৌকা। পানসি, খোসা, করফাই, ব্যাপারী নৌকা এরকম নানাবিধ নৌকা গ্রাম্য দারু প্রকৌশলীরা তৈরি করে। বাচাড়ি নামক এক প্রকার লম্বা নৌকা এখানে বানাতে দেখা যায়। এই নৌকাগুলো মূলত ধনী পরিবারগুলোর এক প্রকার পারিবারিক সাজ। লক্ষ্মীপূজা, দুর্গাপূজা ও কালীপূজার মেলায় সেসব বাচাড়ি নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। নৌকা বানানোর এখানেই শেষ কথা নয়। আরও দেখা যায় তাল গাছের ডোঙা। এই ডোঙা বানানো খুব কঠিন কাজ। ভিতরকার লম্বা আশ তুলে নৌকা সদৃশ ডোঙা বানাতে প্রকৌশলীদের ঘর্ম ঝরাতে হয়। যে কেউ এই ডোঙা বানাতে পারে না। এ নিয়ে এখানে একটি প্রবাদও প্রচলিত আছে। তাহলো-

শুনছ তাল গাছে ডোঙা হয়
বানায়ে দেখছ?

কাঠের তৈরি ডোঙা নাও

২. পাটবান

এখানে দারু শিল্পের মধ্যে আছে বসত ঘর, পাটবান বা শিবাসন, ঢেঁকি, ঘানি, লাঙল ইত্যাদি।

বসতঘরগুলো দেখতে খুব চমৎকার। টিনের ঘরগুলো দেড়তালা ও দোতালার। কাঠ খুঁটির কাঠামোর উপর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয় এই ঘরগুলো। বাতা, গোলবাতা, আড়া, পাড়, দড়ি, কাঠ এসব ঘরের প্রাণস্বরূপ।

পাটবান বা শিবাসন লোকপ্রযুক্তির মধ্যে খুবই প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিন ধরনের গাছ দিয়ে তৈরি করা হয় এই শিবাসন। নিম, বেল ও চন্দন বৃক্ষ। দশ অবতার সংযোজিত এই শিল্পকর্ম দেখলে নয়ন জুড়ায়। রথযাত্রার ঠুটো জগন্নাথের মূর্তিও এখানে ফুটিয়ে তুলতে দেখা যায়।

ঢেঁকি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লোকপ্রযুক্তির নিদর্শন। ধান ভানতে এই লোকপ্রযুক্তিটির কোনো একসময় খুব কদর ছিল। বেশ কয়েকটি অংশের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই লোকপ্রযুক্তিটি। মোনাই, শাইল্যা ও কাতলা তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢেঁকির মাথার দিকের যে অংশের মাধ্যমে নোটে আঘাত হানা হয় তার নাম মোনাই। ঢেঁকির পিছনের দিকে দুই ধারে যে দু’টি কাষ্ঠ খণ্ড মাটির মধ্যে পোতা থাকে তার নাম কাতলা। ঢেঁকির নির্ধারিত স্থানে ছিদ্র করে যে যন্ত্রটি ঢুকানো হয় তার নাম শাইল্যা। এই শাইল্যার দুই প্রান্ত কাতলার উপর থাকে। এই হলো ঢেঁকির বিভিন্ন যন্ত্রের মোটামুটি অবস্থান। এই ঢেঁকি গ্রাম বাংলার একটি পৌরাণিক ঐতিহ্য।

ঘানি হলো শস্য বীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের একটি অন্যতম লোকপ্রযুক্তি। এর অর্ধেকটা মাটির মধ্যে পুতে রাখা হয়। উপরের অংশ থাকে কিছুদূর পর্যন্ত খোলা। এর ভিতর ঢেলে দেওয়া হয় তিল, তিষি, মোষণে, সরিষা ইত্যাদি তৈলবীজ শস্য। ঐ গর্তে ঢুকানো থাকে আরেকটি কাষ্ঠ খণ্ড (বান্দর) যার উপরের অংশ সংযুক্ত থাকে মোটা একটি তক্তার সাথে। সেই তক্তার একপ্রান্ত কৌশলগতভাবে লাগান থাকে পোতা কাষ্ঠ খণ্ডটির সাথে যা অনায়াসে বৃত্তাকারে ঘষে ঘষে ঘুরতে পারে। তক্তাটির অপর প্রান্ত আর এক অভিনব কৌশলে গরু বা ঘোড়ার কাঁধে জুড়ে দেওয়া হয়। মোটা তক্তাটির উপর পাথর বা ভার জাতীয় কোনো কিছু থাকা আবশ্যক। বৃত্তাকারে পশুরা ঘোরে আর বান্দর চাপে তৈলবীজ পিষ্ট হয়ে তেল বের হয়ে আসে। তেল নিষ্কাশনের পর তৈলবীজ চাপে জমাট বেঁধে যে রূপটি ধারণ করে তাকে খৈল বলে।

৩. লাঙ্গল নির্মাণ

ভূমির বক্ষ বিদীর্ণ করে ফসল ফলানো সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে। আর এ কাজে শ্রেষ্ঠতম চাষি প্রযুক্তি হলো লাঙল। অবশ্য এরও আগে লাঙলের ব্যবহার দৃষ্ট হয়। ভূমি কর্ষণকালে জনক রাজা লাঙলের ফলায় সীতাকে পেয়েছিলেন শাস্ত্রে তাও উল্লেখ আছে। আদিম মানুষ ছিল কৃষিনির্ভর। তাই ভূমি কর্ষণ কাজে লাঙলের যে কতটা কদর তা বলাই বাহুল্য। কৃষক পরিবারগুলো এখনও লাঙলকে ঢের সম্মান দেখিয়ে থাকে। এর প্রযুক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গরুর কাঁধে থাকে জোঙ্গাল বা জোয়াল। লাঙলের যে অংশ কৃষকরা ধরে থাকে তার নাম হলো গুটি। লোহার ফলা যুক্ত নিম্নাংশ ভূমি বক্ষ বিদীর্ণ করে চলে। ঈষের কৌণিক মাপ এত সূক্ষ্ম যে গরুর কাঁধের জোয়ালের সাথে সাদৃশ্য রেখে সমান্তরালভাবে তা এগিয়ে যায়। এই প্রযুক্তি কৃষককুলের অগ্রসর মননের পরিচয় দেয়।

আগাছা ফসল উৎপাদনে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঐ সকল আগাছা নিধনে লোকপ্রযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। কাঁচি, ট্যাঙারি, কোটা, বককোটা, আচড়া তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। কাঁচি ফসল কাটতে বেশি ব্যবহার হয়। কাঁচির বৃত্তাকারের ভিতরের অংশে থাকে অসংখ্য আল। এই কুচি কুচি আল ফসল কেটে ঘরে আনতে খুবই সহায়ক। ট্যাঙারির গঠন ছোট কোদালের মতো। ফসল নিড়াতে এই লোকপ্রযুক্তিটি খুবই দরকার। কোটা হচ্ছে ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা পরিমাপের লোহার শলাকা চিকন গাছ খণ্ডে ঢুকানো এক প্রকার যন্ত্র। ফসলের ক্ষেতে মাটি আলগা করতে এর খুব কদর। বককোটাও ওইরকম। তবে এই বককোটা যন্ত্রের গলাটা বকের মতো বলে এর নামকরণ করা হয়েছে বককোটা। আচড়া হলো ৩-৪ ফুট লম্বা কাষ্ঠ গাত্রে সারিবদ্ধভাবে লোহার শলাকা বিধানো যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে ফসলের জমাট বাঁধা মাটিকে আলগা করা হয়। তারপর আছে থোড়া বাঁশ। চিকন বাঁশের এক প্রান্তে গাছের দো ডালা শাখা লাগিয়ে হুক সদৃশ করা হয়। ভূমির আগাছা যেমন কচুড়ি বা নাড়া পরিষ্কার করতে এই যন্ত্রটি সর্বাধিক প্রয়োগ হয়। তারপর বাড়ির কাছের আলান পালানের কাজ করতে খোন্তা, কোদাল, শাবল, দা ইত্যাদি ব্যবহার হয়ে থাকে। কৃষকরা রোদ বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য যে প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে তারমধ্যে মাথাল ও জোঙড়া উল্লেখযোগ্য। এই দু’টি প্রযুক্তিকর্মের উপকরণ হলো বাঁশ। বাঁশ শিল্পীরা এই বুননকে একটি ভিন্নমাত্রা সংযোজন করে দেয়। এর উপরিভাগ থাকে সুচালো নিম্নভাগ বিস্তীর্ণ যা রোদ বৃষ্টিকে বাঁধা দেয়। পাট কাটতে তারা ব্যবহার করে হাসুয়া। এই যন্ত্রটিতে কাঁচির মতো আল থাকে না। আকারে কাঁচির মতো হলেও পরিমাপে বড়। শীতকালে খেজুর গাছের বাকল ছেঁচে রস বের করতে গাছিরা ছ্যান ব্যবহার করে থাকে।

গরু মহিষ দ্বারা ফসল মাড়াই করা এ আরেক কৌশলী পদ্ধতি বটে। উঠানে ধানের আঁটি বা অনান্য ফসল ছড়িয়ে তার উপর ৪-৫টি গরু পরস্পর বেঁধে বৃত্তাকারে ঘুরালে সুন্দর ফসল মাড়াই হয়। প্রথম যে গরুটি বাঁধা হয় সেটি সাধারণত শান্ত স্বভাবের। একেবারে চঞ্চল স্বভাবের গরুটি বাঁধা হয় শেষ প্রান্তে।

উনুন প্রযুক্তির গুরুত্বও কম না। উনুনের গঠনশৈলী বেশ প্রযুক্তি নির্ভর। উপরের দিকে আছে তিনটি ঢিবি। একে ঝিক বলা হয়। ঐ তিনটি ঝিকের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গাটুকু থাকে সেখান দিয়ে বাতাস ঢোকে এবং ধোয়া বের হয়। এই পদ্ধতির জন্য সুন্দর আগুন জ্বলে। আরও থাকে উনুনে মহোন। এ মহোন দিয়ে দাহ্য পদার্থ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বাতাসের প্রবেশ দ্বার হিসেবেও মহোনের ভূমিকা রয়েছে।

৪. মৃৎশিল্প

গৃহকর্মের সরঞ্জামাদিতে লোকপ্রযুক্তির ঠাঁই বহুল আলোচিত। গৃহকর্মে ব্যবহৃত যেসব উপকরণ চোখে পড়ে তারমধ্যে মাটি, বেত ও বাঁশের তৈরি দ্রব্য সামগ্রী বেশি এখানকার এঁটেল ও দোআঁশ মাটি এই সুবিধাকে বেশি প্রভাবিত করেছে। মাটির পাত্রের মধ্যে প্রথমে ভাতের হাড়ির কথা বলে রাখা ভালো। কারণ গ্রাম বাংলায় আজও মাটির হাড়িতে ভাত রাঁধতে দেখা যায়। সরা কিন্তু হাড়ির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই মাটির হাড়ির ভাত খেতে খুবই সুস্বাদু এবং নিরাপদ। চাল ধুতেও মাটির তৈরি বাসন আছে। এর নাম ঝাঁঝর। শত ছিদ্রের সমন্বয়ে তৈরি এই ঝাঁঝর যন্ত্রটি। মুড়ি চিড়া ভাজতে প্রয়োজন হয় খোলা পালিয়া, বালিয়ান, ছাবনা ও ঝাঁঝর। উত্তপ্ত এসব পাত্র ধরার জন্য কাপড়ের তৈরি এক ধরনের জিনিস ব্যবহার করে। আঞ্চলিক ভাষায় একে পাটুয়া বলে। ভাজার কাঠি বানিয়ে নেয় নারিকেল পাতার শলাকা দিয়ে। তারপর আছে বড় বড় কোলা। এই কোলায় আগেরকার মানুষ মুড়ি রাখতো। এতে মুড়ি তরতাজা থাকে। এমনও শোনা যায় ঐসব কোলায় ঘি মেখে শুকায়ে নিত। এতে মুড়ি খুব সুস্বাদু হয়। আছে কলস, খোরা, কুনো, ঘট, তাওয়া, জালা ইত্যাদি। এর সবই মাটির তৈরি তৈজষপত্র। কুমারেরা বিশেষ এক পদ্ধতিতে এই গৃহকর্মের প্রসাধনী তৈরি করে থাকে। মাউ তারমধ্যে অন্যতম কুমারীয় যন্ত্র। এই মাউ নিয়ে এখানে ছড়াও প্রচলিত আছে। যেমন-

ভাণুরাম কুমোরেরা
সাতে পাঁচে ভাই
মাউ খানি ছেনিয়া
করলেন এক ঠাঁই
মাউ খানি ছেনিয়া
তুলে দিলেন চাকে
সুবর্ণ ধূপতি হলো
আড়াইটি পাকে।
রবি দিলে শুকিয়ে
ব্রহ্মা দিলেন পুড়িয়ে
গুরু দিলেন বর
আজ এই ধূপতি শুদ্ধকর
ভোলা মহেশ্বর।

মৃত্তিকা প্রযুক্তির মধ্যে পুতুল, মূর্তি ও অন্যান্য খেলনা সামগ্রী যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। ভাস্করদের মাটির মূর্তি লোকপ্রযুক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হয়ে থাকে। তাদের নিখুঁত মূর্তি দর্শকদের মন কেড়ে নেয়। অধিকাংশ পালেরা হাতে মূর্তি গড়ে থাকেন।

৫. মাছ শিকারে লোকপ্ৰযুক্তি

গোপালগঞ্জ জেলাটি জলাভূমি হওয়াতে মাছ শিকারের জন্য যেসব লোকপ্ৰযুক্তি সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও অম্লান। জাল দিয়ে মাছ ধরা তারমধ্যে অন্যতম। কয়েক প্রকার জাল এখানকার জনগণ ব্যবহার করে থাকে যেমন, পাশ খেওলাজাল, ঝাঁকিজাল, মৈয়াজাল, ওচাজাল, ধম্বজাল, ভ্যাসালজাল, ভুরিজাল কৈয়াজাল, পুঁটিয়াজাল, সরপুটিয়াজাল, খুটনিজাল ও ইলশাজাল ইত্যাদি। এই জাল তৈরিতে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে থুড়িয়া, চটা ও কাফুয়া গুরুত্বপূর্ণ।

বাঁশের তৈরি মাছ শিকারের যন্ত্রের মধ্যে দুঘোড়, বানা, খারা, সাগরা, ঘুনিয়া, চাচড়া উল্লেখযোগ্য। ফুলকুচি, অ্যাড়া, ঠ্যাটা, ঝুপি, এইসব যন্ত্র দিয়ে বড় বড় মাছ কোঁপাতে দেখা যায়। রাতে আলোর মাধ্যমে মাছ শিকারকে আলাধরা বলে। ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাস এই আলাধরার জন্য উপযুক্ত মৌসুম। হাজারি বড়শি দিয়েও জেলেরা নদীর বড় বড় আইড়, বোয়াল ও কাছিম শিকার করে থাকে।

৬. পাখি ও পশু শিকারে লোকপ্রযুক্তি

এই এলাকাটি বন-বাদাড়ের জন্য বিখ্যাত নয় তাই পশু শিকারে এখানকার প্রযুক্তি তেমন অগ্রসর হয়নি। সড়কি, ভ্যালা, দিয়ে মাঝে মধ্যে দু’একটি শিয়াল ও বন বিড়াল শিকার করতে দেখা যায়। তবে পাখি শিকারে এখানকার লোকপ্রযুক্তি একেবারে অনগ্রসর একথা বলা যাবে না। চৈত্র-বৈশাখ মাসে পাহাড় থেকে নেমে আসা বাবুই পাখি ধরতে এলাকায় ধূম পড়ে যায়। যে জাল দিয়ে বাবুই পাখি শিকার করতে দেখা যায় তার নাম সাট জাল। শীতের দিনে বিভিন্ন প্রকার পাখি শিকারও করা হয় ঐ সাট জালের মাধমে। চ্যাগা ও অন্যান্য পাখি শিকার করতে রাতে শিকারীরা টানা জাল ব্যবহার করে। বিভিন্ন প্রজাতির বক শিকার করতে বাঁশের তৈরি ফাঁদ চোখে পড়ে। মাড়ৈ ও ছিটকা তার মধ্যে নাম করা। কোড়া, ঘুঘু ও অন্যান্য পাখি শিকার করতে এখানে রয়েছে নানা ধরনের গোঁফ।

৭. চিত্তবিনোদনে লোকপ্রযুক্তি

চিত্ত বিনোদনের কথা বলতে গেলে প্রথমে ঘুড়ির কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এখানে যেসব ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায় তারমধ্যে, পতেঙ্গা, ত্যাল পতেঙ্গা, ঢ্যাপস ও জের ঘুড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে মাঠে প্রান্তরে কিশোর বালকেরা মেতে ওঠে এই লোকপ্রযুক্তির প্রতিযোগিতায়। ঘুড়ির মাথায় ভেরি নামক একপ্রকার যন্ত্র তারা ব্যবহার করে। ঐ ভেরিতে যুক্ত চিকন সুতার সাথে বাতাস লেগে এক সুরেলা ধ্বনি সৃষ্টি করে। লাটাইয়ের কাছে সুতায় কান পাতালে তা বেশ শোনা যায়।

ঘরের সজ্জায় লোকপ্রযুক্তির মধ্যে পড়েছে শিকা, নকশিকাঁথা, চেলা দেওয়া কাঁথা, তাল পাখা, রুমাল, খেজুর পাতার মাদুর, গৃহলক্ষ্মীর আসন ইত্যাদি। মাটির প্রদীপও কিন্তু কম গৌরবের না। সন্ধ্যাবেলায় প্রতিটি ঘরে মিটমিট করে জ্বলতে দেখা যায় সেই প্রদীপগুলোকে। ঘরের ডোহা কুলবধূরা দক্ষতার সাথে গড়ে থাকে। ঘরের চতুর্দিকে ঐ ডোহা ঘরগুলোকে নবীন করে তোলে। তারপর আছে পাক ঘরের সাজনা। পাক ঘরে কলসি রাখার জন্য তারা মাটি দিয়ে উঁচু করে যে জিনিসটা তৈরি করে তার নাম ওটা। ঢেঁকির নোট তৈরি বেশ মজার। ইট, পাথর ও চাড়া ঢেঁকিতে টুকরো টুকরো করে অভিনব কৌশলে একটু গর্ত করে আস্তে আস্তে পিটায়ে নোট তৈরি করে নেয়। বেশ কয়েকদিন আগুন জ্বেলে তারা নোট শুকানোর ব্যবস্থা করে। এটিকে বলে সাজাল। নোটেই চলে ঢেঁকির ভারাভানার কাজ।

প্রায়ই পরিবারে দেখা যায় পিড়ি ও জলচৌকি। এই পিড়ি ও জলচৌকি বাংলার ঐতিহ্য বলে পরিবারগুলো বিশ্বাস করে। মেহমানদেরকে মেহমানদারী করতে পিড়ির কদর অনস্বীকার্য। নতুন কুটুমদের সম্মান দেখাতে বড় বড় পিড়ির আসলে জুড়ি হয় না। মেহমানদের পা ধুইতে জলচৌকিতে বসতে দেওয়া হয়। জলচৌকি ও জলপাত্রের সাথে থাকে একটি গামছা। ঐ গামছা দ্বারা অতিথিরা পা মুছে গৃহকর্তাদের সম্মান রক্ষা করে থাকেন।

৮. ঘানি

তিল, তিষি ও সরিষা থেকে খাঁটি তৈল পাওয়ার জন্য কাষ্ঠ নির্মিত এক প্রকার পেষণ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যার নাম ঘানি। অবশ্য যান্ত্রিক যুগ আরম্ভ হওয়ায় এর কদর বলতে গেলে একেবারেই কমে গেছে। এই ঘানি মোটা একটা কাষ্ঠ খণ্ড দ্বারা নির্মিত। ওই গুড়িটাকে প্রায় অর্ধেক পরিমাণে খাড়া করে মাটিতে পোঁতা হয়। মাটির উপরের অংশ প্রায় এক হাত পরিমাণ খোলা হয়। যেন একটা ঢোলের বেড়। তার নীচে করা হয় একটা গর্ত। গর্তের মধ্যে বসানো হয় একটা কাষ্ঠ দণ্ড, যার দৈর্ঘ প্রায় দুই থেকে চার ইঞ্চি বেড়ে। একে জাঠ বলে। ওই জাঠের সঙ্গে কৌশলগতভাবে সংযুক্ত করা হয় আর একটা কাষ্ঠ দণ্ড, যার নাম বান্দর। বান্দরের উপরের অংশ সংযুক্তি থাকে মোটা ও চওড়া একটা তক্তার সঙ্গে যা ঘষে ঘষে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। তক্তার অপর প্রান্ত আর এক অভিনব কৌশলে গরু বা ঘোড়ার কাঁধে জুড়ে দেওয়া হয়।

ঘানি

মোটা তক্তাটির উপর অবশ্যই পাথর বা ভারা দেওয়ার জন্য অন্য কিছু থাকে। বৃত্তাকারে পশু ঘোরে আর দণ্ডের চাপে তৈল বীজ থেকে তৈল বেরিয়ে আসে। যেসকল গরু বা ঘোড়া ব্যবহার করা হয় তাদের চোখ ঠুলি বা ঢাকনা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। গরুগুলোকে সাধারণত কলুর বলদ বলা হয়। তৈল নিষ্কাশনের পর জাঠের চাপে তৈল বীজ জমাট বেঁধে যে রূপটি ধারণ করে তাকে খৈল বলে। ওই খৈল বিভিন্ন প্রকার সার ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত পানের বরজের এটি একটি উৎকৃষ্ট সার।

৯. জাহৈ

এটি একটি কৃষি কর্মের আঞ্চলিক নাম। জমির চারা ধানগুলো যখন অপেক্ষাকৃত চিকন ও রং করাটে হয় তখন কৃষকগণ এর কারণ খুঁজে বের করে। সাধারণত ধানের চারার গোড়ার মাটি জমাট বেঁধে গেলে এমন হয়। তখন বাশ নির্মিত মই ধানের চারার উপর দিয়ে টানা হয়। এতে ধানের চারার গোড়ার মাটি আলগা হয় এবং দেখা যায় কয়েকদিনের মধ্যে গাছ সতেজ হয়ে নতুন নতুন চারা বের হচ্ছে। একে জাহৈ বলে। যারা আদর্শ কৃষক তারা কিন্তু এ পদ্ধতিটা ব্যবহার করেই যায়। চারার বয়স যখন ২০- ২২ দিন হয় তখনই এই পদ্ধতি উপযোগী।

জাহৈ যদিও সামন্ত যুগের পদ্ধতি তবুও এর গুণাগুণ যথেষ্ট থাকায় কৃষক বর্তমান সময়ও এর যথোচিত ব্যবহার করে আসছে। দেখা যায় ইরি ধানের ক্ষেতেও এর বহুল ব্যবহার আছে। কেননা এতে রোপা চারার গোড়ার মাটি ওলোট পালট হয় এবং গোড়া দিয়ে নতুন চারা বের হয়ে অধিক ফলনে সহায়তা করে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন