লোকবাদ্যযন্ত্র
আধুনিক যুগে বাদ্যযন্ত্রের বহুমাত্রিকতা সত্ত্বেও লোকবাদ্যযন্ত্র আগের মতো অটুট আছে। লোকবাদ্যযন্ত্রে গভীরতা ও সরসতা অন্য বাদ্যযন্ত্র থেকে আলাদা একথা বলতে কোথাও বাধা নেই। যেজন্য প্রাচীনকাল থেকেই লোকবাদ্যযন্ত্রের আহ্বান সমুন্নত রয়েছে লোকসমাজে। এখানকার লোকবাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে একতারা, দোতারা, খোল, করতাল, মৃদঙ্গ, সারিন্দা, পাকোয়াজ, ঢাক, জয়ডঙ্কা, কাশি, বাঁশের বাঁশি, খোমক, নাকাড়া, ডুগডুগি, নূপুর ঝুমুর, প্রেম জুড়ি ইত্যাদি। এই সকল বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সুরের ভূবন মোহিত করে রাখা হয়।
গোপালগঞ্জ অঞ্চলের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ বাঁশির সুর ভালোবাসে। এক সময় রাখাল মাত্রই বাঁশি বাজাতো। বর্তমানে মাছ চাষের কারণে আগের মতো গরুর পাল নেই, রাখালও নেই। তাই রাখালের হাতে বাঁশিও এখন আর শোভা পায় না। তবে যাত্রাপালা, কবিগান, বাউলগান, কীর্তনের আসরে গায়ক ও শিল্পীরা বাঁশি ব্যবহার করে। বাঁশির জন্য তল্লা বাঁশের মাথার অংশ বা চিকন সোজা প্রকৃতির বাঁশ বা মোটা কঞ্চি কেটে পানির মধ্যে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সেটা পরিচ্ছন্ন করে ভালো করে রোদে শুকানো হয়। অতঃপর আগুনে লোহার শিক পুড়িয়ে এর তাল লয়ের জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে ছিদ্র করা হয়। এভাবে বাঁশিতে ছয়টি ছিদ্র থাকে।
একতারের বাদ্যযন্ত্র হলো একতারা। গ্রামে-গঞ্জে বাউল-ফকিরদের হাতে সহজে একতারা চোখে পড়ে। এর গঠনপ্রণালী যেমন সহজ, নির্মাণ উপকরণও সাধারণ। পাকা লাউয়ের খোলের তলায় শুকনো চামড়া মোড়ানোর পর বাঁশের ডাটি লাগানো হয়। তলার চামড়া থেকে কাঠির মাথা পর্যন্ত একটি কাঠিতে তার বেঁধে নেওয়া হয়। ডাটির মাথায় একটি শক্ত কাঠি সংযুক্ত করা হয়। এর সাহায্যে তার টান টান রাখা হয়, যাতে বাজনার উপযুক্ত থাকে। বাউল, বৈরাগী, ফকিররা একতারা বাজিয়ে গান গায়।
এ অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র দোতারা। পেশাদার বাউল গায়করা প্রায় সবাই দোতারা বাজিয়ে গান গায়। কাঠের খোলের উপর শুকনো চামড়া আবৃত করা হয়। খোলের গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত দুটি তার বেঁধে দেওয়া হয়। মাথায় দুটি কাঠি পেঁচানো থাকে। এর সাহায্যে তার বাজনার উপযোগী করে রাখা হয়।
নানা অনুষ্ঠানে ঢোলের ব্যবহার অপরিহার্য। গান, নাচ, বিয়ে-অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা, পূজাপার্বণ, হরেক লোকজ খেলায় ঢোলের ব্যবহার হয়ে থাকে। মাটি বা কাঠের লম্বা খোলের দুই মুখ ফাঁকা রাখা হয়। শুকনো চামড়া দিয়ে খোলা মুখ দুটি ঢেকে দেওয়া হয়। মোটা সুতো দিয়ে দুই মুখের চামড়া টেনে বেঁধে রাখা হয়, যাতে করে যথাযথভাবে বাজানো সম্ভব হয়।
মূলত ঢোলের বৃহৎ আকারের সংস্করণ হলো ঢাক। পূজা-পার্বণ উৎসবে ঢাক বাজানো হয়। বড় ধরনের অনেক উৎসবের সূচনা হয় ঢাকে বাড়ি দিয়ে অর্থাৎ ঢাক বাজানোর মধ্য দিয়ে। ঢাকের আওয়াজ খুব তীক্ষ্ণ এবং বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
এটি একটি সুপ্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। হারমোনিয়াম সকল ধরনের গানের সাথে মেলানো যায়।
কর্ণেট এক ধরনের বাঁশি হিসেবেই এলাকায় পরিচিত। কর্ণেটের আওয়াজ না হলে যাত্রাপালা হয়ই না। এ অঞ্চলে যাত্রাপালা, সার্কাস, বিয়ে, বরযাত্রা, পূজা-পার্বণে কর্ণে ব্যবহৃত হয়।
গোপালগঞ্জ অঞ্চলে ডুগডুগির ব্যবহার বেশ দৃষ্টিগোচর হয়। এটিকে গুরুত্বপূর্ণ একটি লোকবাদ্য বলা যায়। সাধারণত সাপুড়ে, বেদে, বিভিন্ন পেশার ফেরিওয়ালারা ডুগডুগি বাজিয়ে মানুষকে বিশেষ করে বাচ্চাদের আকৃষ্ট করে। সাপখেলা, বানরখেলা দেখানোর সময় সাপুড়ে ও বেদেরা ডুগডুগি বাজায়। এর নির্মাণ কৌশল সহজ এবং উপকরণও সহজলভ্য। সাধারণত কাঠের খোলের দুপাশে চামড়ার ছাউনি দিয়ে ডুগডুগি তৈরি করা হয়।
উপরোক্ত লোকজ বাদ্যযন্ত্রগুলোর বহুল ব্যবহারের বাইরে আরও কিছু লোকবাদ্যের অল্পবিস্তর ব্যবহার চোখে পড়ে। এগুলোর মধ্যে শঙ্খ, খোমক, সারিন্দা, কাঁসি, মন্দিরা, করতাল, বেহালা, চাকি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন