লোকখাদ্য (Folk Food )

লোকখাদ্য

এদেশ নদীমাতৃক, এই যুক্তিযুক্ত কথাটির সাথে মাছে-ভাতে বাঙালি এই প্রবাদটিও বেশ মানিয়ে গেছে। মাছ-ভাত আমাদের প্রিয় খাবার। তারপরও বলতে হয় রসনা বিলাসী মানুষ রসনার তৃপ্তি মিটাতে খাদ্যে ভিন্নতা ও নতুনত্ব আনতে সর্বদা প্রয়াসী। এখানকার খাদ্য তালিকায় এমন কিছু উপকরণ আছে যাকে খাদ্যের বিশেষত্ব বলা যেতে পারে।

চৈত্র মাসের খরতাপে মানুষ জীর্ন শীর্ণ হয়ে পড়ে। শরীর ঠাণ্ডা রাখতে তারা প্রথাগত কিছু খাবার খেয়ে থাকে। জলাভাত এই গরম মৌসুমের একটি হিতকর খাবার। উত্তেজক খাবার এড়িয়ে তারা শরীর ঠাণ্ডা রাখতে এই ঠাণ্ডা খাবারটি খায় বেশি। মাটির সাথে মিশানো এক প্রকার চিকন পাতা বিশিষ্ট উদ্ভিদ জন্ম নেয়। এটি সাধারণত চৈত্র বৈশাখ মাসে বাড়ির আশপাশে জন্মে। আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে বলে ‘মাটিয়া আম্বলিয়া শাক’। গরম লাগলে এই টক শাকের অম্বল খুব উপকারী। প্রায় প্রতিটি পরিবার খাদ্য তালিকায় এটি রেখে থাকেন। পাকা দয়াকলা ও কচি আম গরম ঋতুর একটি হিতকরী ফল। গরম নিবারণের জন্য এও তারা খায়।

বৈশাখ মাসে পাড়ায় পাড়ায় কাসুন্দি বানানোর ধুম পড়ে যায়। গাছে গাছে যখন হলদে পাখিতে ডেকে ওঠে-’ও বৌ সর্ষে কোট’ তখন কুলবধূরা পূত পবিত্র হয়ে কাসুন্দি বানানো শুরু করে। সরিষা রৌদ্রে শুকায়ে ঢেঁকিতে কুটে গরম জলে ভিজিয়ে তৈরি করে কাসুন্দি। তরকারির সাথে এটি খেতে খুবই মজা। গরমের দিনে এটি খুব উপকার বলে এলাকাবাসী বিশ্বাস করে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে কিশোর-কিশোরীরা আম ঝালানো খেতে খুব পছন্দ করে। অপেক্ষাকৃত টক জাতীয় আম এই প্রক্রিয়ায় বেশি করে খেতে দেখা যায়। তা ছাড়া আম-দুধ এলাকাবাসীর একটি ঐতিহ্য খাবার। এই সময় পথেঘাটে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যাবে এক আত্মীয় আরেক আত্মীয়ের বাড়ি আম-দুধ নিয়ে ছুটছে। এমনও অনেকে আছেন মা-বাবা বা গুরুজনদের আম-দুধ না খাওয়ায়ে নিজে কখনও খায় না। জ্যৈষ্ঠ মাসে নব বিবাহিত দম্পতিদের নেওয়া-আনার হিড়িক পড়ে যায়। নতুন আত্মীয়দের আম-দুধ না খাওয়ালে অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি থেকে গেলো বলে এলাকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। তাই জ্যৈষ্ঠ মাসের বড় সম্মান হলো আম-দুধ।

আষাঢ় মাসে আমাবতী’র (অম্বুবাচী) জাউ এলাকার একটি পার্বণী খাবার। আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত এই তিন দিন আমাবতী পালন করে থাকে। বিশেষ করে কৃষক পরিবারগুলোতে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। এই তিনদিন কৃষকরা জমিনের কাজ করে না। এই সময় জমিনে কাজ করলে বসুমাতা ব্যথা পায় বলে কৃষকদের বিশ্বাস। এসময় লৌহ নির্মিত অস্ত্র তারা ব্যবহার করে না। এটি হচ্ছে আমাবতীর তাৎপর্য। এই তিনদিন চলে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খাওয়ার মহড়া। নানাবিধ ফল দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু জাউ যা আমাবতীর জাউ বলে পরিচিত। এ সময় সবরি কলা ও দুধ খাওয়ার রীতিও আছে। আমাবতীর মধ্যে দুধ-কলা খেলে সাপে দংশন করে না বলে জনগণ বিশ্বাস করে। এ ছাড়া এই ঝরো ঝরো বৃষ্টির দিনে মহিলারা বিভিন্ন ধরনের ফল ও শস্যের বীচি ভেজে কড়মড় কড়মড় করে চিবায়। বর্ষার দিনে এটি একটি চমৎকার খাবার। শ্রাবণ মাসে আগে অনেক পরিবার শখ করে বেলে টাকির ঝুরঝুরি রান্না করে খেত। কড়াইতে ভেঙে ঝুরঝুরে করে ভাজাকে ঝুরঝুরি বলে। কাটাযুক্ত থাকার জন্য তা খাওয়া তত সহজ না, তবে খুব সুস্বাদু। বেলে টাকির মূল্য বৃদ্ধির জন্য এই খাবারটি আগের থেকে অনেক কমে গেছে।

ভাদ্রমাসে তাল ও তাল পিঠা একটি উল্লেখযোগ্য খাদ্য। প্রথমে এক তাল এক দরে কিনে খাওয়ার প্রচলন একেবারে মুছে যায়নি। একটি তাল সকলে মিলেমিশে খেলে সংসারে কোনো কাজে বেতাল বাঁধে না। সবাই এক তালে চলতে পারবে। এরকম একটা জনশ্রুতি আছে বলে এক দরে এক তাল খাওয়ার আয়োজন দেখতে পাওয়া যায়। ভাদ্র মাসের সবচেয়ে মজার খাবার হলো তাল পিঠা ও বড়া পিঠা। তবে তাল পিঠা যেকোনো দিন বানানোর নিয়মনীতি এখানে নেই। বিশেষ একটি দিন তাল পিঠা বানাতে হয়। তা হলো শনি বা মঙ্গলবার। কলার পাতায় তাল পিঠা ভাজা হয়। একে পাতা পোড়ানো বলে।

আশ্বিন মাসের সংক্রান্তিতে তালের আঠির শাঁস একটি জনপ্রিয় খাদ্যবস্তু। আবাল- বৃদ্ধ-বণিতা সকলে এটি খেয়ে থাকে। আশ্বিন সংক্রান্তির এটি প্রধান খাদ্যবস্তু। সকলে ভোর বেলায় গায়ে নিমপাতা ও কাঁচা হলুদ মেখে স্নান করে তাল শাঁসের আঠি দিয়ে শুরু করে আশ্বিন সংক্রান্তির খাবার খাওয়া। পান্তা ভাতের সাথে শাকের ঘণ্ট বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। আশ্বিন মাসের শেষের দিনে সাত পদের শাক কুড়ায়ে ঘণ্ট রাধার প্রচলন এখনও অটুট আছে। পান্তা ভাতের সাথে ঐ ঘণ্ট আশ্বিন সংক্রান্তির শ্রেষ্ঠ উপহার। পাশাপাশি অন্যান্য খাবারেরও আয়োজন থাকে

পৌষ মাস বা শীতের দিনের জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত খাবার হচ্ছে কৈ মাছ ভাতে। লাউ শাকের সাথে মসলা মিশ্রিত কৈ মাছ ভাতের মধ্যে সিদ্ধ করে এটি প্রস্তুত করা হয়। শীতের দিনে গরম গরম এই খাবারটি আজও মানুষ খুব মজা করে খেয়ে থাকে। তারপর শোলমাছের সাথে লাউয়ের তরকারি একটি চমৎকার খাবার। অনেককে দেখা যায় হাতে একটা শোলমাছ ঝুলায়ে আত্মীয়ের বাড়ির দিক ছুটছে। আম-দুধের মতো কুটুম বাড়িতে শোলমাছ নেওয়ায় প্রচলনে এখনও ভাটা পড়েনি। শীতের দিনে আরেকটি মজার খাবার হলো কলই শাকের সাথে টাকি মাছের মুড়িঘণ্ট। এটিও গ্রাম্য এলাকায় ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

পৌষ সংক্রান্তির খাবারতো আরও বেশি নাম করা। এই খাবারে থাকে না কোনো জাতি ভেদাভেদ। এ ঘর থেকে ওঘরে, এবাড়ি থেকে ওবাড়িতে চলে চিড়া-মুড়ি খাওয়ার মহড়া। মুড়ি, চিড়া, দই, দোলি, পায়েস, ছাতু হরেক রকমের আয়োজন থাকে পৌষ সংক্রান্তির খাদ্য তালিকায়। এই পার্বণে কিছুটা ভাটি লেগেছে বলে এলাকাবাসী মনে করে।

মাঘ মাসে ছাত্র-ছাত্রীরা কুল/বরই খায় না। এই ব্রত চলে শ্রীপঞ্চমী পর্যন্ত। এই তিথির আগে বরই খেলে বিদ্যাদায়িনী মা সরস্বতী বিদ্যাদানে কৃপণতা করে বলে বুড়া- বুড়িদের কাছ থেকে জানতে পারা যায়। এই ভয়ে ছাত্র/ছাত্রীরা সরস্বতী পূজার আগে কুল খায় না। তবে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ইলিশ খাওয়ার ধুমধাম দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে যার সাধ্যমতো করে ইলিশ জোগাড় করে একমুঠো ভাত খাবার জন্য। ঋতুগত এসব খাবার ছাড়াও আরও কিছু খাবারের বেশ কদর রয়েছে। যেমন-

ক. টাকি পোড়া : সংসারে দুর্গতি দেখা দিলে বা ভবিষ্যতে দুর্গতি থেকে পরিত্রাণ পাবার উপলক্ষে এই খাবারটি এলাকাবাসী প্রায়ই খেয়ে থাকে। টাকি মাছ পোড়ায়ে ভালোমতো পরিষ্কার করে সরিষা ও অন্যান্য মসলা দিয়ে বেটে এটি তৈরি করতে হয়। সবদিন নয়, কেবলমাত্র শনিবারে এটি খাওয়ার বিধান। শনির দোষ এড়িয়ে চলতে শনিবারে এটি খাওয়া প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করে।

খ. সরিষা বাটা : সরিষা বাটা একটি জনপ্রিয় খাদ্যবস্তু। এই সরিষা বাটা দিয়ে এলাকায় একটি রীতি চালু আছে। যেসব মহিলারা রাগি ও বদমেজাজি সাধারণত তাদেরকে দিয়ে এই খাবারটি প্রস্তুত করা হয়। এতে এই খাবারটি বেশ ঝাঁঝালো ও মুখরোচক হয়ে থাকে। কাজেই ওইসকল মহিলাদের ডাক পড়ে সরিষা বাটার সময়। আর যাদের রাগ নেই ও শান্ত স্বভাবের সেসব মহিলা সরিষা বাটলে তা তিতা ও বে-স্বাদের হয়ে থাকে বলে এলাকায় মত প্রচলিত আছে।

গ. ডালপাক : গোপালগঞ্জ এলাকার ডালপাকের একটি বিশেষত্ব আছে তা বলে রাখা ভালো। বিশেষ করে হিন্দু বাড়িগুলোর ডাল রান্না অতি চমৎকার। প্রশংসা না করলে বড় একটি সত্যকে অস্বীকার করা হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দ্বিধাহীনভাবে এই সুস্বাদু ডালের গুণগান গায়। বেশ গাঢ় করে ইলিশ মাছ বা রুই মাছের মাথা দিয়ে তা পাক করতে দেখা যায়। খেসারি, মুগ, ছোলা ও ডাবরি তারমধ্যে উল্লেযোগ্য।

ঘ. থোড় : কলাগাছের অভ্যন্তরে লম্বা যে মোটা দণ্ড তা-ই থোড় নামে পরিচিত কোনো এক সময় এই থোড় তরকারির খুব কদর ছিল। মুড়িঘণ্ট ও ভাজিতে এর তুলনা হয় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকে এই হিতকরী তরকারিটি এড়িয়ে চলেন। তাই বলে একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি।

ঙ. মরিচ পোড়া : খাবারের রুচি আনতে অনেকে মরিচ পোড়া খেয়ে থাকেন। এর ঘ্রাণ যদিও ঝাঁঝালো তবুও রসনা বিলাসী। পান্তা ভাতের সাথে পোড়া মরিচ গ্রাম্য এলাকায় একেবারে কম জনপ্রিয় নয়। খুদ সিদ্ধের সাথে মরিচ পোড়া খুবই মানানসই।

চ. লাবড়া : লাবড়া এই এলাকায় খাদ্য তালিকায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। হরেক রকমের তরকারি সিদ্ধর পরে জল নিষ্কাশন করে নিতে হয়। পরে এটি ঘুঁটে মণ্ডা করে সরিষা বাটাসহ বিভিন্ন প্রকার মসলা দিয়ে খাবারের উপযুক্ত করে তোলা হয়। মহোৎসবে এর কদর আগের মতোই আছে। আবার বাড়িতে অনেকে শখ করে খেয়ে থাকেন। শহরে খাবারের নতুনত্বে কৃত্রিমতা থাকতে পারে কিন্তু গ্রাম বাংলার রসনা বিলাসী বা যেকোনো খাবারে কোনো ভেজাল থাকে না। সবকিছু টাটকা ও সতেজ। পেটে দিলে পিঠে সয় এই প্রবাদকে তারা সার করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রচলিত খাবরের পাশাপাশি এলাকাবাসী বিভিন্ন পার্বণে, ঋতুতে কিংবা রসনার দাবিতে খাবারে নতুনত্ব নিয়ে আসে।

খাদ্যাখাদ্যে নারী : খাদ্যাখাদ্যে-বাছবিচার নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। যেমন—যমজ কলা বা যমজ কোনোকিছু তারা খায় না। এগুলো খেলে তাদের গর্ভে যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করতে পারে এমন একটা জনশ্রুতি আছে। তারপর গজানো নারকেলের মধ্যে যে গোলাকৃতি বস্তু জন্ম নেয় তার নাম ‘ফোল’। এই ফোল কোনো নারী খেতে রাজি নয়। এতে নারীঘঠিত অনেক রোগ হতে পারে বলে তাদের ধারণা। গর্ভাবস্থায় চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সময় তারা কিছু ভক্ষণ করে না। অবশ্য এই সময় কোনো নারী-পুরুষ কেউ কিছু খায় না। সাত মাসের গর্ভাবস্থায় সাধ ভক্ষণের রীতি প্রচলিত আছে। পিতৃগৃহে এই সময় অন্তঃসত্ত্বাকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার খাওয়ানো হয়। টক জাতীয় খাবার নারীরা বেশি খায়। এটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। নতুন নতুন খাবার নারীরা উদ্ভাবন করে থাকে। ক্ষীর, দোলি, কাসুন্দি বিভিন্ন ধরনের খাবার প্রস্তুত করতে নারীরা খুবই পারদর্শী।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন