লোকচিকিৎসা (Folk Medicine) ও তন্ত্রমন্ত্ৰ (Chant)

লোকচিকিৎসা ও তন্ত্রমন্ত্র

১. গাছ-গাছড়া ও আয়ুর্বেদ ভিত্তিক চিকিৎসা

লোকচিকিৎসা বলতে মূলত ভক্তি, বিশ্বাস, তন্ত্র-মন্ত্র ও গাছ-গাছড়ার চিকিৎসাকে বুঝিয়ে থাকে। প্রগাঢ় ভক্তি বিশ্বাস হলো লোকচিকিৎসার আরোগ্যের উপায়। যা অসুস্থ দেহকে সুস্থ করে তাই ওষুধ। যদি আপনার উপদেশে কারোর ব্যাধি সেরে যায় তবে উপদেশকে ওষুধ বলা যেতে পারে। হাসলে যদি কোনো রোগের উপশম হয় তবে হাসিকে কেন ওষুধ বলা যাবে না। গান শুনলে যদি ব্যাধিগ্রস্ত দেহে সুস্থতা এনে দেয়, তবে গান কি ওষুধ নয়? হাঁটলে যদি বড় একটি ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তবে হাঁটা কেন ওষুধ হবে না। সাঁতার কাটলে দেহ যদি সুস্থ ও সবল থাকে তবে সাঁতারকে ওষুধ বলতে আপত্তি কোথায়? লোকচিকিৎসা এমন একটা বিষয় যা মন থেকে রোগ দূরীভূত করতে সাহায্য করে। আর মন থেকে যে রোগ সারাতে পারে তার আর দৈহিক রোগ বলে কিছু থাকে না। একজন অসুস্থ ব্যক্তির মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, অমুক পাড়ার অমুক কবিরাজের কাছে গেলে আমি নিশ্চয় ভালো হবে। তার এই যে আত্মবিশ্বাস এটাই তাকে রোগমুক্ত করে দেয়। এই চিকিৎসায় মানসিক বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই অঞ্চলে অনুসন্ধান করে দেখা দেছে লোকচিকিৎসা বেশ কয়েকটা পদ্ধতির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। যেমন :

এক. গাছ-গাছড়া ও আয়ুর্বেদ ভিত্তিক চিকিৎসা।

দুই. তন্ত্রমন্ত্র ও ওঝার চিকিৎসা।

তিন. সিদ্ধ পুরুষের বাক্যদান চিকিৎসা।

সার্বিকভাবে গবেষণা করে দেখা গেছে লোকচিকিৎসা অনেকটা আয়ুর্বেদ ভিত্তিক এবং এখানে এই চিকিৎসার প্রচলন বেশি। আয়ুর্বেদ মতে বাত, পিত্ত ও কফ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই তিনের সমতা শরীরে সুস্থতা আনে। আর এগুলোর পারস্পরিক ভারসাম্য হারিয়ে গেলে শরীরে বিভিন্ন রোগের উৎপত্তি ঘটায়। তবে এই আয়ুর্বেদ জিনিসটা কি? সে বিষয়ে সম্যক ধারণা নেওয়া যেতে পারে। মহর্ষি সুশ্রুত লিখেছেন, ‘আয়ুরস্মির বিদ্যতে অনেন বা আয়ুর্বিন্দত্যায়ুৰ্ব্বে।’ অর্থাৎ যা দ্বারা আয়ু লাভ করা যায় বা আয়ুকে জানা যায় তাকে আয়ুর্বেদ বলে। ব্রহ্মা প্রথমে হাজার অধ্যায় লক্ষ শ্লোক নিয়ে আয়ুর্বেদ প্রকাশ করেন। তাঁর নিকট থেকে প্রজাপতি; প্রজাপতির নিকট থেকে অশ্বিনী কুমারদ্বয়, তাদের নিকট থেকে ইন্দ্র, ইন্দ্রের নিকট থেকে ধন্বন্তরী আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শেখেন। তারপর সুশ্রুত এই আয়ুর্বেদ শিক্ষা লাভ করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকে ৮ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা :

(১) শল্যতন্ত্র, (২) শালক্যতন্ত্র, (৩) কায়াচিকিৎসাতন্ত্র, (৪) ভূতবিদ্যাতন্ত্র, (৫) কৌমার ভূত্যতন্ত্র, (৬) অগদতন্ত্র, (৭) রসায়নতন্ত্র, (৮) বাজীকরণতন্ত্র। শল্যতন্ত্র : শল্যচিকিৎসা বা অস্ত্রপ্রয়োগ করার প্রণালি এতে বিধৃত আছে।

শালক্যতন্ত্র : স্কন্ধের উপরে যেমন- চক্ষু, কর্ণ, মুখ, নাসিকা, জিহ্বা, ওষ্ঠ, অধর ও গণ্ডতালু প্রভৃতি স্থানের ব্যাধি এতে লিখিত আছে।

কায়াচিকিৎসাতন্ত্র : এতে জ্বর, অতিসার, রক্ত, পিত্ত, কুষ্ঠ ও মেহ প্রভৃতি সর্বাঙ্গব্যাপী চিকিৎসার বিধান আছে।

ভূতবিদ্যাতন্ত্ৰ : এতে দৈত্য, ভূত, পেত্নী, নাগ, পিশাচ, যক্ষ, রক্ষ ও গ্রহাদির দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের আরোগ্যের উপায়স্বরূপ শান্তিকর্ম ও বলিদানাদির বিষয় লিখিত আছে।

কৌমার ভূত্যতন্ত্র : এতে শিশু পালন, দুগ্ধের দোষ সংশোধন, স্তনদোষ ও গ্রহদোষ হতে উৎপন্ন ব্যাধির চিকিৎসার বর্ণনা আছে।

অগদতন্ত্র : এই চিকিৎসায় সর্প, কীট, বৃশ্চিক, মুষিকদিগের দংশনজনিত বিষ ও অন্যান্য বিষের লক্ষণ প্রতিবিধানের উপায় লিখিত আছে।

রসায়নতন্ত্র : এতে নিরোগ ও বলিষ্ঠ হওয়ার উপায়, পরমায়ু, মেধা ও বল ইত্যাদি বৃদ্ধি এবং দেহ রোগমুক্ত করার উপায় আছে।

বাজীকরণতন্ত্র : এতে অল্প অথবা শুষ্ক শুক্রের বৃদ্ধি করার নিয়ম, বিকৃত শত্রুকে স্বাভাবিককরণ, ক্ষয়প্রাপ্ত শুক্রের উৎপত্তি, ক্ষীণ শরীরের বল বৃদ্ধি এবং মনকে প্রফুল্ল করার বিধান লিখিত আছে।

আয়ুর্বেদের এই যে পদ্ধতিসমূহ তার অনেক বিধানই লোকচিকিৎসার মধ্যে বিদ্যমান। কেবলমাত্র শল্যতন্ত্র ও বলিদান পদ্ধতির যথাযথ ব্যবহার দেখা যায় না। লোকচিকিৎসা একটি পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই গাছ-গাছড়া ও নানাবিধ দ্রব্যের ব্যবহার এই চিকিৎসায় দেখা যায়। কবিরাজদের পাশাপাশি সাধারণ লোকও তদ্বিষয়ে টুকিটাকি ধারণা রাখে। কোনো দ্রব্যের কি গুণ ও কোনো তিথিতে শরীরের কি তারতম্য হয় এ বিষয়টিও বেশ স্থান পেয়েছে। কবিরাজ গোপাল বিশ্বাস (৪৮), গ্রাম-রঘুনাথপুর, তিনি জানান, ‘কচি কলাপাতায় দগ্ধ ক্ষত ভালো হয়। এর মূলের রস কৃমিনাশক। কাঁচাকলা সিদ্ধ করে মলম করে লাগালে বংশগত সিফিলিসজনিত চুলকানি ভালো হয় এবং কলার শিকড় মুত্রযন্ত্র হতে নির্গত রক্ত রোধ করে। মানকচু অর্শ্ব ও কোষ্ঠবদ্ধতায় বেশ ফলপ্রদ। মানকচুর ডাটা আগুনে ছেকে নিংড়ে সেই রস কানে দিলে পূঁজপড়া বন্ধ হয়। গরুর গলাফোলা রোগ চিকিৎসার জন্য পঁচা মানকচুর ডাটা বেশ অল্প গরম করে গলায় লাগালে গলাফোলা ভালো হয়।’

এলাকা ঘুরে অনুসন্ধান করে জানা গেছে ধান গাছ আয়ুর্বেদে বহুল ব্যবহৃত। ১০- ১৫ গ্রাম আতপ চাল রাত্রে এককাপ জলে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে ভালোভাবে চটকে খালিপেটে খেলে শ্বেতপ্রদর ভালো হয়। ২৫ গ্রাম শালিধান ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে খেলে মুত্রকৃচ্ছতা কমে। আশুধানকে অন্তর্মুমে পুড়িয়ে ছাই করে পিষে অল্পজলে মিশিয়ে সকাল-বিকাল সেবন করলে অজীর্ণ ভালো হয়।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ পদ্মবিলার ব্রজেন্দ্রনাথ ভদ্র (৫৫) বলেন—’হলুদ আমাদের রন্ধনাদিতে মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়। এর ভেষজগুণের কারণে হয়তো এটিকে প্রতিদিন ব্যবহারের বিধান করা হয়েছে মসলা হিসেবে। প্রতিদিন তরিতরকারির সহিত সেবনে আমরা বহুবিধ রোগ হতে মুক্তি পাই। হলুদের সবচাইতে বড়গুণ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রোধ করা। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে চুলকানি, খোস-পাচড়া হয়ে থাকে। পূর্বে শিশুদের তেল হলুদ মাখিয়ে স্নান করানোর উদ্দেশ্য ছিল যাতে তাদের পাচড়া বা চুলকানি না হয়। প্রমেহ রোগে কাঁচা হলুদের রস এক চামচ মধু বা চিনি মিশিয়ে খালি পেটে রোগীদের খেতে দিলে উপকার হয়। জন্ডিস রোগে কাঁচা হলুদের ৫-১০ ফোটা রসের সাথে চিনি মিশিয়ে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। তোতলামী রোগে কাঁচা হলুদ শুকিয়ে গুঁড়া করে তা ২/৩ গ্রামের সাথে এক চা চামচ ঘি মিশিয়ে রোজ ২/৩ বার অল্প অল্প করে বেটে খেলে তোতলামী ভালো হয়। ফাইলেরিয়া রোগে কাঁচা হলুদের এক চামচ রসে অল্প গুড় ও এক চামচ গো-মূত্র মিশিয়ে খেতে দেওয়ার বিধান আছে। কাঁচা হলুদ শুকিয়ে গুঁড়া করে তার সাথে উচ্ছে পাতার রস ও অল্প মধু মিশিয়ে খেলে হামজ্বর ভালো হয়। নিমপাতার গুঁড়ার সাথে শুকনা হলুদের গুঁড়া এবং শুষ্ক আমলকির গুঁড়া মিশিয়ে সকালে খালিপেটে সেবন করলে এলার্জির উপকার পাওয়া যায়। কার্বঙ্কল জাতীয় ফোড়ায় কাঁচা হলুদ বেটে তার সাথে গো-মুত্র মিশিয়ে অল্প গরম করে দিনি রাতে লাগালে পূঁজপড়া বন্ধ হয়।’

নারিকেল বাড়ির বিখ্যাত ধীরেন কবিরাজ বলতেন—যাদের গা থেকে দুর্গন্ধ বের হয় তাদেরকে বেলপাতার রস জলে মিশিয়ে গা মুছে দিলে দুর্গন্ধ দূর হয়। যৌবনের উদ্দীপনা রোধে বেলের কচিপাতা খাওয়ার প্রয়োজন আছে। বেলের মূলের ছাল চূর্ণ ৬- ১২ গ্রেন মাত্রায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হৃদয় দৌর্বল্য দূর হয়। বিল্বমূলের ছাল ১২- ১৪ গ্রেন ও জিরা ৬ গ্রেন মাত্রায় একসাথে বেটে গাওয়া ঘি’য়ের সাথে মিশিয়ে খেলে শুক্র তারল্য ভালো হয়।

কবিরাজ ও বালা ক্ষীরোদ পোদ্দারের মতে-ডালিমের খোসার চূর্ণ, ছাগলের দুধের সাথে খেলে অতিসার, রক্তাতিসার ও অজীর্ণ রোগ ভালো হয়। ডালিম গাছের ছাল সিদ্ধ করে খেলে আমাশয় ভালো হয়। এর পাতা ভেজে খেলেও আমাশয় থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়। ডালিমের ফুল বেটে মধুসহ খেলে রক্তপ্রদর ভালো হয়। যাদের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে তারা যদি ডালিমের ফুলের রস নাক দিয়ে টানে তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। সর্দির চাপে যাদের নাক বন্ধ হয়ে মাথা ভারি থাকে তাদেরকে সকালে জয়ন্তী পাতার রস খেতে দিলে তাড়াতাড়ি উপশম হয়। বোলতা বিছে বা ভিমরুলে কামড়ালে জয়ন্তীর বীজ বেটে ক্ষতস্থানে দিলে বেদনা উপশম হয়। কালাজ্বরে জয়ন্তীর শিকড় মাথায় বাঁধলে উপকার হয়। নারী ঋতুবতী হলে প্রথম তিনদিন জয়ন্তী পাতা বেটে পুরোনো গুড়ের সাথে সকালে খেলে গর্ভ নিরোধ হয়। মুর্ছা রোগে আক্রান্ত হলে অপরাজিতার মূল, গাছ ও পাতা থেতো করে ছেঁকে এক চা চামচ আন্দাজ রস রাগীকে খাইয়ে দিলে মুর্ছারোগ ভালো হয়। ভূতোন্মাদ এটা মেয়েদেরই হয়। মূলত কামজ উন্মাদনা হেতু এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই রোগে অপরাজিতার মূলের ছাল ৩-৬ গ্রাম পরিমাণে ঘিয়ের সাথে পিষে দিনে দুইবার আতপচাল ধোয়া জল দিয়ে রোগীকে খেতে দিলে ঐ কামজ উন্মাদনা ভালো হয়।

যে সমস্ত মেয়েরা মৃত সন্তান প্রসব করে বা যারা গর্ভ ধারণ করতে পারে না তারা ১৪/১৫ গ্রাম অশোক ছাল ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ২৬/২৭ দিন খেলে উপকার পাওয়া যায়। অশোক বীজ বেটে হলুদের সাথে গায়ে মাখলে চর্মের রুক্ষতা কমে যায়। বিষাক্ত কীটের দংশনে অশোক ছালের ক্বাথ লাগালে দ্রুত উপশম হয়।

কংশুরের বিখ্যাত জণ্ডিস চিকিৎসক হরসিৎ কবিরাজ (৫৮) ইতোমধ্যে লোকচিকিৎসক হিসেবে দেশ-বিদেশে খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। অসংখ্য জণ্ডিস রোগী তার হাতে আরোগ্য লাভ করে যাচ্ছে। তার চিকিৎসার ধরণই আঁচড়ার শিকড় ও কাঁচা হলুদ পিষে সামান্য আখের গুড় মিশিয়ে বাসি পেটে সেবন করা। এটাই তার শ্রেষ্ঠ পথ্য। তিন দিন পর্যন্ত চলে এসব ভেষজ দ্রব্যের ব্যবহার। উক্ত গ্রামের অখিল বালা (৪০) অর্শ্ব চিকিৎসায় তেলাকুচ পাতার সাথে দূর্বার আগা বেটে এক কাপ পরিমাণ রস সাতদিন বাসি পেটে খাওয়ার ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন। এতে রক্তপড়া দ্রুত বন্ধ হয়।

কবিরাজ জঙ্গল ফকির (৫০) জানালেন-’কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে নারিকেলি শাকের পাতা বেটে গুহ্যদ্বারে প্রবেশ করালে সঙ্গে সঙ্গে পায়খানা হয়ে যায়। বাত-ব্যথায় ধুতরা বা বিষকাঠালি বা বিশল্যকরণীর পাতা খুবই উপকারী। নদীর পাড়ে বা রাস্তাঘাটে এক ধরনের লতা দেখতে পাওয়া যায়, যাকে কৈয়াড়া বলে। ঐ কৈয়াড়ার লতা ব্যথা কমাতে আজও গ্রাম-বাংলায় প্রচুর ব্যবহার হয়। ভাঙ-সিদ্ধির পাতা বেটে প্রলেপ লাগিয়ে ব্যাথা দূর করতে এটা আমরা ব্যবহার করি।’এসব কবিরাজী চিকিৎসা ছাড়াও বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধের নিমিত্তে প্রায় প্রত্যেক পরিবারে খাদ্যাদি বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়।

কবিরাজী চিকিৎসায় তাবিজের স্থানও কম না। রকমারি গাছের মূল, জীব-জন্তুর হাড় ও অন্যান্য দ্রব্য তাবিজে ভরে গলায় বা ডান হাতের বাহুতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শিশুদের গলায় হরকাঠি রূপার ঠুলিতে লাগিয়ে ঝুলানো হয়। এতে তাদের উপর কোনো কু-দৃষ্টি পড়ে না বলে জনগণের বিশ্বাস।

২. তন্ত্র মন্ত্র ও ওঝার চিকিৎসা

তন্ত্রমন্ত্রের চিকিৎসা লোকচিকিৎসার অন্য আরেকটি পদ্ধতি। এতে কোনো ভেষজ দ্রব্য বা কোনো গাছ-গাছড়া ব্যবহার হতে দেখা যায় না। ঝাড়-ফুঁকুর দিয়ে অসুস্থ্য মানুষকে সুস্থ্য করে তুলতে দেখা যায়। অনিল বালা একজন তান্ত্রিক চিকিৎসক। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় যেসব মন্ত্র ব্যবহার করেন সেগুলোর মধ্যে ব্যথা পাওয়ার মন্ত্রটি নিম্নরূপ :

নুন থুইয়া লবণ পড়ি
ক্ষীর শব্দ পানি
(অমুকের) বিষ বেদনা কর ক্ষয়।

ভয় পেলে নিম্ন মন্ত্রটি তিনি ব্যবহার করে থাকেন-

কালা কালা ছত্রিশ অন্তে কালা
(অমুকের) জ্বরজ্বারি নিয়ে যাও
দোহাই কালা (৩ বার)।

স্তনের দুধ পড়তে থাকলে দুধ পড়া প্রতিরোধের মন্ত্রটি এরকম-

থুম্বা থুম্বা রসের ঝি
পথে পেয়ে করলে কি
আট আঙুল বেগুনের ডাল কেটে
থুম্বার কপালে মারলেম লাথি।

ছোট শিশুরা হঠাৎ শিউরে উঠলে যে মন্ত্রটি কবিরাজরা ব্যবহার করে সেটি নিম্নরূপ-

আল্লাহ গদাধর
মোহাম্মদের নাম সরা
শঙ্খ চক্র করিয়া সার
(অমুকের) শরীরে নাই কোনো ভয় ডর জ্বর।

এই মন্ত্রটি সুতা হাতে নিয়ে পড়তে দেখা যায়। মন্ত্রের ফাঁকে ফাঁকে ফুঁ দিয়ে সুতায় গিট দিতে থাকে। সেই সুতা রোগীর গলায় পরিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। রঘুনাথপুর নিবাসী গোপাল কবিরাজ তিনি তান্ত্রিক চিকিৎসা মতে যেসব তন্ত্র-মন্ত্র ব্যবহার করেন সেগুলো নিম্নরূপ :

ধাতুর ব্যথায় ব্যবহৃত মন্ত্রটি তিনি যেভাবে বললেন-

অষ্ট ধাতু অষ্ট পানি
হাড়ের শরীর রোগীর বাতি
(অমুকের) অষ্টধাতু করলাম পানি।

চোখে জল পড়লে নিম্নলিখিত মন্ত্রটি তিনি ব্যবহার করে থাকেন-

নদীর কূলে আল্লাহপাক
চোখের কণা মা শীতলা
সকল কর পানি
দোহাই মা শীতলা (৩ বার)।

তার ভয় পাওয়া ঝাড়াটি বা মন্ত্রটি নিম্নরূপ-

আল্লাহ সরোয়ার
আজরাইল বরখাস্ত কর
আল্লাহ (অমুকের) অসুখ বরখাস্ত কর (৩ বার)।

লোকচিকিৎসার মধ্যে ওঝাদের সাপে দংশন রোগীর চিকিৎসা এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা বলে পরিচিত। এলাকাটির পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য সাপ জাতীয় সরীসৃপ প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় এখানে যে পদ্ধতি বয়ে চলেছে তাতে দেখা গেছে ওঝারা কোনো তন্ত্রমন্ত্র বা গাছ-গাছড়া ব্যবহার করে না। যে স্থানে সাপে দংশন করে সেখানে পান চিবায়ে মুখ দিয়ে বিষ চুষে রোগীদের ভালো করে তোলে। বৃহত্তর ফরিদপুরের বিখ্যাত ওঝা ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার নিজামকান্দি নিবাসী সুরধনী দেবী। রাধার বরে তিনি এই চিকিৎসায় রত হন বলে তাকে সকলে রাধিকা বলে ডাকতেন। তাকে নিয়ে এমনও কিংবদন্তি শোনা যায় কাউকে সাপে দংশন করলে রাধিকার নাম নিয়ে ডোর দিলে বিষ আর উপরে ওঠে না। এছাড়া এলাকায় আরও অনেক ওঝা আছেন তাদের মধ্যে শানপুকুরিয়ার রবীন বাগচী (৪২), খাটিয়াগড়ের বিবেক বালা (৪৩) উল্লেখযোগ্য।

হাড়ভাঙা চিকিৎসায় এখানকার কবিরাজরা অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। হাড়ভাঙা কবিরাজদের মধ্যে যারা বিখ্যাত তারা হলেন- কামাল শেখ (৪৫), তিলছড়া কাশিয়ানী, ঠাকুর সিকদার (৫৫), তিলছড়া কাশিয়ানী, জহুর সরদার (৬২), করপাড়া গোপালগঞ্জ। ভাঙা হাড় জোড়া লাগার চিকিৎসার ধরণ এরকম—প্রথমে তারা আড়োসের গাছ, কালা ধৃতরার শিকড়, ইলসা গাছের পাতা, খেলানো ঝালের গাছ, বর্ণির পাতা, আলাচালের গুঁড়া, কৈ মাছের মাথা লবণ দিয়ে মিশিয়ে মণ্ডা তৈরি করে নেয়। তারপর ঐ মণ্ডা নিয়ে হাড়ভাঙা স্থানে লাগায়। অতপর ন্যাকড়া দিয়ে পেচিয়ে চটার বানা দ্বারা ভালো করে বেঁধে রাখে। ২৪ ঘণ্টা পরে ঐ বাঁধন খুলে দেয়। এতে হাড় জোড়া লাগে। বেশ কয়েকদিন ঐ স্থানে তেল মালিশ করতে বলেন কবিরাজরা। সব ধরনের তেল ব্যবহার করার বিধান দেন না চিকিৎসকেরা। কবিরাজরা সরিষার তেল, এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ, পিপল গাছের ফল, তারপিন একত্রে জ্বেলে যে তেল তৈরি করেন কেবলমাত্র সেই তেল ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।

অন্য আরেক পদ্ধতিতেও অন্যান্য হাড় ভাঙার কবিরাজরা এর চিকিৎসা করে থাকেন। তা হলো-সদ্য দোহানো দুধের সাথে সড়া গাছের ছাল বা পাতার গুঁড়ি মিশিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দই তৈরি করে নেয়। ঐ দই হাড় ভাঙা স্থানে লাগিয়ে দেয়। ভেন্নার পাতা বা বটের পাতা দ্বারা ঢেকে চটার তৈরি বানা দিয়ে ভালো করে বেঁধে রাখে। এই ডোরও ২৪ ঘণ্টা পর খুলতে হয়। তারপর ঐ তেল মালিশ করতে দেওয়া হয়। এতেই হাড়ভাঙা রোগী ভালো হয়ে যায়। কোটালীপাড়ার সিতাইকুণ্ড গ্রামনিবাসী সিরাজুল ইসলাম সিপাহী ছিলেন এলাকার খ্যাতনামা চিকিৎসক। তিনি হাড়ভাঙা জোড়া দিতেন তেলপড়া দিয়ে। অন্যদিকে পূর্বপাড়ার ভাগ্যধর বিশ্বাস (শিক্ষক) ও চিত্রাপাড়ার তাসেম ফকির লোক চিকিৎসায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁরা গাছ-গাছড়া ব্যবহার করতেন। ফুঁ- ফাঁ দিতেন না।

৩. সিদ্ধপুরুষের বাক্যদান চিকিৎসা

গাছ-গাছড়া, তন্ত্রমন্ত্র চিকিৎসার বাইরে আরোগ্য লাভের আরও একটি পদ্ধতি এখানে বয়ে চলেছে, তা হলো-ফকির, দরবেশ, সাধু-গুরু-বৈষ্ণব বা মহাপুরুষদের বাক্যদান চিকিৎসা। এরা কোনো গাছ-গাছড়া বা তন্ত্রমন্ত্র ব্যবহার করেন না। তাদের মুখের কথায় অনেক রোগী ভালো হয়ে গেছে বলে এলাকায় জনশ্রুতি আছে। হরিচাঁদ ঠাকুর, গনেশ পাগল, পরশউল্লাহ ফকির ও হাজার চাঁদ ফকিরকে নিয়ে এ ধরনের লোকচিকিৎসার অসংখ্য কিংবদন্তি আছে। বর্তমানে সানপুকুরিয়ার মরু ঠাকুর (৮২) ও আন্ধারকোঠার হরি ঠাকুর (৫০) এই ধরনের বাক্যদান চিকিৎসা করে থাকেন।

তাই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধারার লোকচিকিৎসা গ্রাম বাংলায় বয়ে চলেছে। আধুনিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভাবনীয় সফলতা বয়ে আনার পরও লোকচিকিৎসা বিলিন হয়ে যায়নি। এই চিকিৎসায় কোনো না কোনোভাবে সফলতা বয়ে আনে বিধায় সেই আদিকাল থেকে শুরু করে আজও সমাজে শক্ত ভীত আঁকড়ে আছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন