লোক পেশাজীবী গ্রুপ (Folk Groups)

লোকপেশাজীবী গ্রুপ

এ জেলার জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা সর্বাধিক। আছে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধরাও। তবে বৌদ্ধদের সংখ্যা খুবই কম। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন গোত্রে বর্ণে বিভক্ত হয়ে রয়েছে এখানকার জনগণ। বলা যেতে পারে এই বিভক্ত ধর্ম ও পেশার কারণে।

১. পাল সম্প্রদায় : অভিধানে পাল শব্দের অর্থ যাই থাক না কেন, মূর্তি যারা তৈরি করেন, তারা পাল নামে পরিচিত। শত শত বছর আগে কোটালীপাড়ার মদনপাড়, পশ্চিমপাড় এবং তারাশিতে পাল সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিলো। বারো মাসে তেরো পূজার কারণে তারা সারা বছরই নানা মূর্তি তৈরি করত। সাতচল্লিশের পর হিন্দুরা ভারতে চলে যাবার কারণে পূজোর সংখ্যা কমে যাওয়ায় মূর্তি কারিগরদের সংখ্যাও কমে যায়। অনেকে পাড়ি জমান কলকাতায়।

হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হওয়ার কারণে এখনও সমগ্র কোটালীপাড়ায় হাজার হাজার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে এখনও কোটালীপাড়ায় এই সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা কম নয়। তবে তারা শুধু মূর্তি তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করে না, পূজা না থাকলে কৃষিকাজসহ অন্যকাজে দিন কাটায়। উল্লেখিত গ্রামগুলোর এখন আর পালপাড়া কথাটি শোনা যায় না। তবে তাদের পাশাপাশি বসবাসরত কুমার পাড়া কথাটি এখনও শোনা যায়। দুর্গাপূজার সময় তারা ব্যস্ত থাকেন মূর্তি তৈরির কাজে। এখন যারা অধিক সংখ্যায় মূর্তি তৈরি করেন তারা রত্নবাড়ি, মদনপাড়া ও মঠবাড়িতে বসবাস করেন। তাদের মধ্যে আদিপাল হলেন রত্নবাড়ির রতনপালের পরিবার। এই পরিবার ছাড়া কোটালীপাড়ার বিভিন্ন গ্রামের বেশকজন কারিগর মূর্তি তৈরি করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে গাছিয়াত্তরের ধীরেন পাল, মদনপাড়ার মহাদেব সাহা, হিরনের তপনপাল, আমবাড়ির শ্রীবাস, তারাকানের মানিকপাল, রতালের পঞ্চানন্দ, রত্নবাড়ির রঞ্জিত পাল ও ঘাঘরের কামাল পাল উল্লেখযোগ্য।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য কামাল মূর্তি গড়ার কাজটি শিখেছেন এদের কারো কাছে। তার হাতের কাজ শিল্পমণ্ডিত। তবে ভাস্কর্য নির্মাণে তিনি পারদর্শী।

২. মৎস্যজীবী : মৎস্যজীবীদের বসতি গড়ে উঠেছে নদীর তীরে ও জলাশয় স্থানে। তেঁতুলিয়া ও গোলাবাড়িয়া গ্রামে এই পেশাজীবীদের সংখ্যা মোটামুটি চোখে পড়ে। বানিয়ারচরে মৎস্যজীবীদের বেশ কয়েকটি মৎস্য গুদাম আছে।

৩. নরসুন্দর : পরামানিক বা নরসুন্দরদের বসতি জেলার সব জায়গায় পরিলক্ষিত হয়।

৪. ব্রাহ্মণ : কোটালীপাড়ায় একদা ব্রাহ্মণদের বসতি ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় উলপুর গ্রামে বেশকিছু ব্রাহ্মণের বসতি দেখতে পাওয়া গেছে।

৫. দাই : উলপুর গ্রামে দু’এক ঘর দাইও বসবাস করে আসছে। পাটনীও এই গ্রামে বসতি স্থাপন গড়ে তুলেছে।

৬. তাঁত শিল্প : কংশুর গ্রামে তাঁত শিল্পীদের বসত অনেক আছে। তবে এখন ওই পেশা আর তাদেরকে অবলম্বন করতে দেখা যায় না।

৭. কামার : কামাররা সংঘবদ্ধভাবে কোথাও নেই। জেলার সবখানেই তারা বসবাস করছে।

৮. মিস্ত্রি ও সুতার মিস্ত্রি : মিস্ত্রি ও ছুতাররা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কুলু বা তৈল ব্যবসায়ীরা এখন আর কুলু পেশায় নিয়োজিত নেই। বিভিন্ন পেশায় তারা ঢুকে পড়েছে।

৯. গায়েন : গোপালগঞ্জ জেলায় গায়েনরা সাম্প্রতিক বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। সাতপাড়, শেওড়াবাড়ি, গান্ধিয়াশুর, শাফলীডাঙ্গা, কৃষ্ণপুর এসব অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের গানের দল সৃষ্টি হয়েছে।

১০. গাছি : গাছিরা এই এলাকার হারানো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। খেজুর গাছের গাত্র ছেঁচে শীতের দিনে রস বের করা গাছিদের চমৎকার একটি শিল্পকর্ম। তাল গাছ, খেজুর গাছ ও নারিকেল গাছের প্রাচুর্যের জন্য এই পেশাজীবীরাও এখনও বেশ সচল আছে। সব ধরনের পেশাজীবীরা গোপালগঞ্জ জেলায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।

১১. লাঠিয়াল : কাজিয়া সাধারণত পূর্বে সৃষ্ট জমিদার কর্তৃক গঠিত একটি বাহিনীর লাঠিয়াল কর্ম। তাদের নামকরণ করা হয়েছিল লাঠিয়াল। এদের কাজ ছিল প্রতিপক্ষের সঙ্গে মারামারি করা। জমিদার তার জমিদারি ঠিক রাখবার জন্য জমিদারভুক্ত গ্রামগুলি থেকে এমনকি বাইরে থেকেও সাহসী ও গোয়ার শ্রেণির লোক নিয়ে এই লাঠিয়াল দল সৃষ্টি করত। এতে স্বভাবত গরীব শ্রণির লোকদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হতো। হিন্দু, মুসলিম, সাঁওতাল ও বাগদিরাও থাকতো এই দলে। জমিদাররা তাদের বিপদজনক করে গড়ে তুলতো। যাতে যেকোনো সময়ে জমিদারের হুকুমমতো প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মানুষ খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। এদের মধ্যে সাহসী কাজিয়া করার জন্য কৌশল দেখে তাকে উপাধি দিতেন সর্দার বা বাঘা। এই সর্দার বা বাঘার কৌশল মতো হতো কাজিয়া। এরা আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করত বেতের তৈরি ঢাল। যা এখনও গ্রাম অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। লাঠিয়ালরা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার সময় ব্যবহার করত লোহার তৈরি বল্লম, ভেলা, রামদা, তীর ধনুক, কাতরা বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক মারাত্মক অস্ত্র।

১৭৫৭ সালে ২৩শে জুন তারিখে নেমে এলো বাংলার ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ছায়া। ডুবে গেলো বাংলার স্বাধীনতা সূর্য, উদয় হলো দানববেশী ব্রিটিশ শাসন। ছড়িয়ে পড়ল তারা সারা পাক ভারত উপমহাদেশে। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী কর আদায়ের জন্য আবিষ্কার করল এক অভিনব কৌশল। প্রথম তারা কর আদায় করত নবাবী আমলের হিসেব দৃষ্টে। কিন্তু সমস্ত বন্দোবস্তই ব্যর্থ হয়। পরে লর্ড কর্নওয়ালিশ ইংরেজ ঘেষা অভিজাত শ্রেণির হিন্দু ও মুসলমানদের ডেকে নিয়ে পরগণা বা জায়গীরদার করেন। তাদের মধ্যে লিজ দিয়ে দেয় এবং পরে তা পত্তনে রূপ নেয়, যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। আর এদের নাম দেওয়া হয় জমিদার বা/ও তালুকদার। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ছিল হিন্দুরাই। যেমন-উলপুরের কামদেব রায় চৌধুরী সাড়ে তিন আনি অংশ, রাম জীবন রায় চৌধুরী তিন আনি, কৃষ্ণ রাম রায় চৌধুরী সোয়া তিন আনি, রূপরাম রায় চৌধুরী তিন আনি, তারক চন্দ্র রায় তিন আনি, হরচরণ রায় তিন আনি অংশ। এই পরগণা বা জেলা বিভাগ সমস্তই রাজশক্তির প্রভাবে ছোট বা বড় হতো। প্রথমে পরগণা বা জেলার সীমা নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তনও দেখা দেয়। এর বড় কারণ ছিল ১৮৫৭ হতে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত ক্যাপ্টেন জে ই গেস্ট্রেল ও এনটি ভেলি সার্ভেয়ারের অদক্ষতায় যে সার্ভে হয় তা সীমানা নির্ধারণে বিবাদ থেকে যায়। ফলে জমিদার-জমিদারদের মধ্যে সীমানা নির্ধারণে বিবাদ হতে থাকে। যার কারণে প্রয়োজন হয় লাঠিয়াল দলের। এই জমিদাররাই সীমানা অতিক্রমণে পক্ষ প্রতিপক্ষ মেতে উঠতো তুমুল দাঙ্গায়। শত শত জীবননাশও হতো এই লাঠিয়ালদের হাতে। এভাবে পক্ষ-প্রতিপক্ষ দ্বারা সংঘঠিত হয় কাজিয়া। অবশ্য ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগস্ট দেশ ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয় এবং ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটে এবং জমি প্রজাস্বত্বে পরিণত হয়।

এখনও এই কাজিয়া প্রথার প্রচলন দেখা যায় গ্রাম বাংলায়। জমিদার কর্তৃক সৃষ্ট এই লাঠিয়ালদের কারণে অনেক সময় সৃষ্টি হতো সাম্প্রদায়িক রেষারেষি।

১২. অন্যান্য পেশাজীবী : কাটালীপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। এলাকার সিংহভাগ মানুষ কর্মজীবী হলেও এখানে পূর্বকালে ছিল স্বর্ণকার, জেলে, কুমোর, কামার, বাদ্যকার, ব্যবসায়িক, ঘরামি, বাড়ৈ, নাপিত, ধোপা, কর্মকার, তাঁতী, কাঠমিস্ত্রী, দাই, কাপদার (খতনাকারী) সম্প্রদায়। বর্তমানে এসব সম্প্রদায়ের কোনো লোকই স্ব-স্ব- পেশায় নিয়োজিত নেই।

কোটালীপাড়ায় তাঁতী সম্প্রদায়ের এখন আর কেউ কাপড় তৈরি করে না। বাড়ৈ ও বাদ্যকার সম্প্রদায়ও বিলুপ্তির পথে। এসব পেশায় একমাত্র তাঁতী ও বাদ্যকার ছাড়া অন্যরা সবাই হিন্দুধর্মাবলম্বী। তবে যুগের চাহিদা এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণার কারণে কোনো লোকই একক পেশায় নিয়োজিত থাকতে চান না। কোনো পেশাই কারও একক নয়। যে কাজে যে দক্ষ, সে কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে। কাজের ক্ষেত্রে জাত ও সম্প্রদায়ের কোনো ভেদাভেদ নেই। তবে যাদের জমি আছে এবং চাষাবাদের অভিজ্ঞতা প্রচুর, তারা এখনও কৃষিকাজ করে জীবীকা চালায়।

.

তথ্যনির্দেশ

১. ডা. রসময় বিশ্বাস, গ্রাম : বাগান উত্তর পাড়া, কোটালীপাড়।

২. সুধাংশু ভৌমিক (৫৫), গ্রাম : বিদ্যাধর, গোপালগঞ্জ সদর।

৩. নীলুফার ইয়াসমিন রেশমা, বান্ধাবাড়ি কোটালীপাড়া।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন