বস্তুগত লোকসংস্কৃতি – লোকশিল্প
মেয়েলি এই চিত্রকলাটি দেখলে নয়ন জুড়ায়। পৌষ সংক্রান্তির দিনে তাদের সেই আলপনা দেখলে বোঝা যায় চিত্রাঙ্কনে তারা কতো পারদর্শী। বিভিন্ন রঙের মাটি গুলে ঘরের ডোহা, ঘরের দরজা ও উঠানে দক্ষ হাতে তারা ফুটিয়ে তোলে রকমারি বৈচিত্র্যময় চিত্র। ফুল, ফল, মাছ, নদী, পশু-পাখি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য যে যার মতো করে ফুটিয়ে তুলতে প্রতিযোগিতায় নামে। এতে দরকার হয় না কোনো তুলির। যা দ্বারা নারীরা ঘর লেপে তাকে পোচ বলে। সেই পোচ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করে তাদের কর্মক্ষমতা। পৌষ সংক্রান্তির এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শ্রীহীন বাড়িগুলোকেও শ্রীধর করে তোলে। বাড়ির দৈন্য দশা একেবারে হারিয়ে যায়। এ রকম করার কারণ ও তাৎপর্য জানতে চাইলে তেমন একজন নারী রেণুকা বিশ্বাস যা বললেন–পৌষ সারান মানে বাস্তু পূজা। বাড়িঘরে আমরা থায়ি। ঝড় বিষ্টির দিনে ঘর আমাদের রক্ষা করে। তাকে কি পূজা না কল্লে হয়। তাই বসত ভিটাকে ভালোবাসতি আমরা এত কিছু করি। এ কল্পে বাড়ি আনন্দ পায়।’ আগের থেকে এটি তুলনামূলকভাবে কমে গেলেও কোনো কোনো অঞ্চলে বরং আগের থেকে যেন ভালোই হচ্ছে। যেমন : হাটবাড়িয়া, কৃষ্ণপুর, করপাড়া, আড়ুয়াকংশুর, পদ্মবিলা তারমধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে।
লক্ষ্মীপূজার আলপনা আরও যে কতো মনোমুগ্ধকর তা কেবল একপলক দেখার মাধ্যমে বুঝতে পারা যায়। তবে একটু দেখলে চোখের তৃষ্ণা মিটবে না। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে। এই আলপনায় নারীরা মাটি ব্যবহার করে না। এমনকি ঘর লেপা পোচও না।। যেহেতু আলপনাটি লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে সেহেতু চালের গুড়া গুলে দুই হাত মুষ্টি করে ওই গুড়া লাগিয়ে একবার ডান মুষ্টির ছাপ, আরেকবার বাম মুষ্টির ছাপ-এভাবে ডোহার উপর দিয়ে আলপনাটি নিয়ে যায় লক্ষ্মীপূজার আসন পর্যন্ত। উঠান থেকেও এই আলপনা শুরু হতে দেখা যায়। গুড়াযুক্ত মুষ্টির সামনে ৫টি ফোটা দেওয়া হয়। দেখলে অবিকল মনে হবে একটি শিশু গুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ঢুকছে। অলোকা বিশ্বাস (৩৮), গোপালগঞ্জ, লক্ষ্মীপূজারিণী এই নারীকে এ বিষয়ে কিছু বলতে অনুরোধ করলে তিনি যা বলেন— ‘আমরা কৃষিকর্ম করি, গলা ভরে ধান থুই। সারা বছর চলি ফসলের উপর ভর করে। ফসলই আমাদের মুখে হাসি ফোটায়। মা লক্ষ্মীর কৃপায় আমরা ছেলেপিলে নিয়ে বেঁচে থাকে। তাই আমরা মা লক্ষ্মীকে এভাবে বরণ করে তাকে খুশি করি।’ এই লক্ষ্মীপূজায় তারা গানও গেয়ে থাকে। যেমন-
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।
শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি
সুগন্ধে ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি
প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে।
আলপনা এঁকে তোমার সাজিয়ে দিলাম ঘর
আমের পল্লব দিলাম জল ভরা ঘট
পান সুপারী দিলাম দু’হাত ভরে
জনম জনম থাকো আমার এ ঘরে
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।
তাই দেখা যায় হিন্দু বাড়িগুলোতে লক্ষ্মীপূজার দিনে চারদিকে আনন্দের ধুম পড়ে যায়।
সাজের হাড়ির আলপনা কেবল বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য। কনেকে যখন সাজিয়ে স্বামীর হাত ধরিয়ে স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন ঐ বহরে একটি চোখ ধাঁধানো হাড়িও জায়গা করে নেয়। হাড়িটিকে আগে খড়ি মাটির লেপ দিয়ে সাদা করে নিতে হয়। তারপর চিত্র শিল্পীরা বিভিন্ন রং দিয়ে এমন সুন্দর আলপনা করে যে হাড়ি আর হাড়ি থাকে না। ওই বহরে বর-কনের পরই এর গুরুত্ব থাকে। একে বলে সাজের হাড়ি। হাড়িটির গায়ে বিভিন্ন ধরনের ছন্দও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন-
দাদাবাবু কমলা লেবু
একা খাইও না
আমার দিদি ছোট্ট মানুষ
কিচ্ছু বোঝে না।
হাড়িতে থাকে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি দ্রব্য যেমন লাড়ু, চিড়া, মুড়ি, সাজ, বাতাসা ইত্যাদি। সাধারণত দেখা যায় ঐ বহরের দুষ্ট লোকেরা হাড়িটি বহন করার জন্য টানা হেচড়া শুরু করে দেয়। কারণ কাগজে মোড়া ঢাকনা ছিড়ে তারা চুপি চুপি খায় আর হাঁটে। এমনও দেখা গেছে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হাড়ির পেট খালি।
কাঁথা শিল্পে এখানকার কুলবধূরা অনেক দূর এগিয়ে আছে। আজও কৃষক পরিবারগুলোতে প্রসাধনী দ্রব্যের খুব কদর। যদিও বাবুয়ানির ফাঁক-ফোকড় দিয়ে কিছু আধুনিকতা ঢুকে পড়েছে। গোপালগঞ্জের কাঁথার বিশেষত্ব হলো ঘন ও চিকন ফোঁড়ের গাঁথুনী। রঙিন সুতা দিয়ে যে দক্ষতা তারা ফুটিয়ে তোলে তা আসাধারণই বলতে হবে। এই দক্ষ বুননকে আঞ্চলিক ভাষায় চেলা বলে। দুই ধরনের কাঁথা এরা তৈরি করে থাকে। একটি আট পৌরে কাঁথা যা সবসময় তারা ব্যবহার করে। অন্যপ্রকার হলো নকশিকাঁথা।
নকশিকাঁথা
নকশিকাঁথা সেলাই
এগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা হয়। নিজেরা এগুলো ব্যবহার করে না। কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা মেহমানদারিতে এগুলো বিছায়ে দিয়ে নারীরা সীমাহীন আনন্দ পায়। নিজেদের গুণ গৌরব ও দক্ষতা এই কাঁথার মাধ্যমেই তারা বেশি প্রকাশ করতে আগ্রহী। তারা ছোট ছোট একধরনের কাঁথা সেলাই করে যা বালশির কাথা বলে চিহ্নিত। দেব দেবীর আসনও তারা সেলাই করে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার আড়কংশুর গ্রামের দুলুরাণী পাণ্ডে (৪৫) নকশিকাঁথা শিল্পে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। বাণিজ্যিকভাবেও তিনি এই শিল্পকর্মটি করে যাচ্ছেন। তাছাড়া একই উপজেলার সাতপাড় নিবাসী ঝর্ণা কীৰ্ত্তনীয় (৪২) বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন নকশিকাঁথা সেলাইয়ে।
কুটির শিল্পে শিকার তুলনা হয় না। গ্রাম্য পরিবারগুলোতে এককালে শিকার খুব কদর ছিল। মিটসেফ, শোকেচ এসে সেই কৃষ্টিকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। সবধরনের তৈজসপত্র শিকায় শোভা করে না। মাটির হাড়ি সবচেয়ে বেশি শোভনীয়। তাও আবার খালি হাড়ি নয়। থাকা চাই চিড়া, খই, লাড়ু এধরনের ঐতিহ্য নন্দিত খাবার। আধুনিক মেয়েরা অনেকে শিকা বানানোর কৌশল জানে না। বেশ কিছু ঘরে পুরাতন শিকা দেখা গেছে।
নকশি করা রুমাল আজও আগের মতো বুনন হয়। বাঁশের ফ্রেমে রুমাল গেঁথে মেয়েরা নানা ধরনের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। গাছের পাতা, ফুল, টিয়া পাখি তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। যে সুতা দিয়ে এই শিল্পকর্মটি করে তাকে বলা হয় ড্যান্সের সুতা। অনেকে প্রিয়জনকে এই রুমাল উপহার দিয়ে থাকেন।
ধাতব শিল্প ও প্লাস্টিক শিল্প মৃৎ শিল্পকে কোণঠাসা করে রাখলেও একেবারে বিসর্জন দিতে পারেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য তৈজস পাত্রের মধ্যে মৃৎ পাত্র যতটা চোখে পড়ে তা মোটামুটি মন্দ না। যেমন, কোলা, তাগারি, ছাবনা, বালিয়ান, জ্বালা, খোরা, হাড়ি, কুনো ও ঘট বিভিন্ন পার্বণের আড়ংয়ে কুমরেরা যা কিছু উপস্থাপন করে তাও নেহাৎ কম না। যেমন—গরু, ঘোড়া, হাতি, মাছ, ব্যাংক, আম, কাঁঠাল, তরমুজ, বাঙ্গি এসকল মৃৎ নির্মিত দ্রব্যসামগ্রীতে বাজার এখনও সরগরম থাকে। কোটালীপাড়া উপজেলার হিরন, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বাজুনিয়া ও খেলনা গ্রামগুলো মৃৎ শিল্পের জন্য বিখ্যাত। তারপর পূজা অর্চনায় সে সকল দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করা হয় তা মৃৎ শিল্পের ভীতকে শক্তিশালী করেছে বলে মনে করা যেতে পারে। সদর উপজেলার বড় ডোমরাশুরের শিল্পীরা মাটির মূর্তি নির্মাণে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শকরা ছুটে আসে এদের শিল্পকর্ম উপভোগ করতে। মৃৎ শিল্পে গোপালগঞ্জ জেলার সুনাম কোথাও কমতি নেই।
সম্প্রতি দারুশিল্পে দারুশিল্পীরা যেভাবে সূক্ষ্ম কারুকার্য ফুটিয়ে তুলছেন সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোটালীপাড়ার কালিকাবাড়ি গ্রামের বাদল পাণ্ডের (২২) শিল্পকর্ম অতি চমৎকার। বৃক্ষের কাণ্ডে তিনি সিদ্ধহস্তে খোদাই করে যেকোনো প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলতে বলতে গেলে তুলনাহীন। সদর উপজেলার ডেমাকইড় নিবাসী গয়ালী বিশ্বাস (৭০), গান্ধিয়াশুর নিবাসী অনিল ভাস্কর (৬৮) ও রাউৎপাড়ার মন্টু মন্ডল (৪৩) শিবাসন বা পাটবান নির্মাণে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। এলাকাবাসী তাদের এই শিল্প কর্মের জন্য গর্ববোধ করে।
তারপর বাঁশ ও বেতস শিল্পে বৌলতলীর নিখিল বিশ্বাস ও কংশুরের শংকর বিশ্বাস খুব সুনাম কুড়িয়েছেন। ধামা, পৈয়া, সের-পাল্লা, কুলা, ডোল, চালন, খালুই, ডালা তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের লোক কমবেশি বসবাস করে।
মুকসুদপুর উপজেলার জালিরপাড় বাজারটি ইমিটেশন শিল্পের জন্য বিখ্যাত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি ইমিটেশন ব্যবসায়ীরা এখান থেকে মালামাল আমদানি করে থাকে। এখানে আংটি, রিং, বয়লা, বেইজ, তাবিজ, চেইন এসব অলংকার তৈরি করতে দেখা যায়, তবে আগের থেকে বর্তমানে ব্যবসা কম। বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক্স আমদানি হওয়ার দরুন ব্যবসায় অনেকটা ভাটা পড়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায় এই এলাকাটি চিত্রকলায় যথেষ্ট অগ্রসর। কৃষি প্রধান এলাকা হিসেবে জেলার পরিচিতি থাকা সত্ত্বেও অনেক পরিবার আছে যারা এই চিত্রকলাকে বাঁচা-বাড়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন