মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা নিহিত আছে। মানুষের ক্ষমতা সম্বন্ধে বহুল প্রচারিত কথাটিই বলতে হয়—sky is the limit। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কার্যাবলী যদি আমরা একটু ধারণা করার চেষ্টা করি তবে এই কথার সত্যতা স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। শ্রীসুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটা চিঠিতে (চিঠিপত্র ষোড়শ খণ্ড—পৃ ২৬) কবি লিখেছিলেন—’আমার শরীরটাকে প্রায় সত্তর বৎসর নির্মমভাবে ব্যবহার করেচি—অন্তত দুটো জন্মের মতো কাজ এক জন্মে আদায় করা গেছে, সুতরাং আজ যদি তার চাকা আলগা হয়ে থাকে নালিশ চলবে না।’ এই কথাটিতে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই। সুবিপুল রবীন্দ্রসাহিত্য—কবি যেটা সৃষ্টি করেছেন, খুব কম মানুষই সেগুলো সারাজীবনে পড়ে ধারণা করতে পারে। তখনকার দিনে কমপিউটারের সুবিধা ছিল না। দোয়াতের কালিতে কলম ডুবিয়ে কবি নিজ হাতে সমস্ত কিছু লিখেছেন। খুঁতখুঁতে মানুষ তিনি—perfection এর দিকে ভীষণ নজর। খুব কম লেখাই তিনি একবারেই final করেছেন। বারবার বারবার তিনি কাটাকুটি করেছেন, সংশোধন করেছেন, পরিমার্জন করেছেন।
এটা যে কত পরিশ্রমসাধ্য এবং কত সময়সাপেক্ষ কাজ, যারা এখনকার দিনেও নিজ হাতে লেখালেখি করেন তাঁরা বুঝবেন। আর শুধু লেখালেখিই তো নয়—কত যে বিভিন্নরকম কাজের মধ্যে তাঁকে জড়িয়ে থাকতে হয়েছিল! জমিদারী দেখাশোনার কাজ (প্রজাদরদী জমিদার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল— প্রজাদের জন্য অনেক সময় তিনি দিতেন), শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীর কাজ (মাঝে মধ্যেই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তাঁকে বেরোতে হতো অর্থ সংগ্রহের চেষ্টায়), সভাসমিতি বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ও ভাষণ প্রদান করা (একটা বক্তৃতার জন্য তৈরী হওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার), পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা, বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা করা এবং সেগুলো টিঁকিয়ে রাখার জন্য লেখা তৈরী করা বা লেখা যোগাড় করা, দেশ-বিদেশ সফর ইত্যাদি অজস্র কাজ। আর চিঠিও যে তিনি নিজের হাতে কত লিখেছেন তার সংখ্যা নেই। সেসব চিঠি—আমি ভালো আছি, তোমরা কেমন আছো, এইসব লিখে শেষ করা নয়। অনেক সময়ই সেগুলো বেশ দীর্ঘ এবং সাহিত্যরসসিক্ত। বাংলা পত্রসাহিত্য তো তাঁর হাতেই পুষ্টি লাভ করেছে। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবীকে একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন—’তোকে আমি যে সমস্ত চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি।’ (ছিন্নপত্রাবলী পৃ ২৪২, বিশ্বভারতী প্রকাশিত)। কত মানুষ তাঁকে চিঠি লিখতো। যতদিন শরীরে কুলিয়েছে ততদিন নিজে হাতে লিখে সেইসমস্ত প্রায় সব চিঠিরই তিনি জবাব দিয়েছেন। বিশ্বভারতী ১৯টি খণ্ডে তাঁর চিঠিপত্র প্রকাশ করেছে। এ ছাড়াও আছে ছিন্নপত্র, ছিন্নপত্রাবলী এবং পথে ও পথের প্রান্তে। আর বহু চিঠি তো সংগ্রহও হয়নি। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয় কী করে তিনি এতসব কাজ করতেন। তাঁর পড়াশোনার কথাটাও স্মরণে রাখতে হবে। কত বিচিত্র বিষয়ে কত গ্রন্থ যে তিনি পড়েছেন সেটা ধারণা করাও অসম্ভব। বই পড়তে পড়তে মধ্যরাত্র পার করে দেওয়ার ঘটনা তাঁর জীবনে অসংখ্য। নিজের আগ্রহে বই পড়া ছাড়াও তাঁকে অনেক অপাঠ্য দুষ্পাঠ্য বইও পড়তে হতো। বহু লোক তাদের লেখা বই কবিকে পাঠাতো। সেসব পড়ে কবিকে মতামত জানাতে হতো।
চিঠিপত্রের চতুর্থ খণ্ড এবং পথে ও পথের প্রান্তে গ্রন্থদুটি আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। বিশ্বভারতীর কোলকাতাস্থিত দুটি গ্রন্থ বিক্রয়কেন্দ্রে আমি একাধিকবার গেছি কিন্তু বই দুটি পাইনি। চিঠিপত্রের বাকি আঠারোটি খণ্ড ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। যেগুলো আছে সেগুলো নিয়ে সেরকম বিশদ বা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নেই। পুনরাবৃত্তি আছে, যেমন, অভিমন্যুর কথা অনেক জায়গায় আছে। অর্জুনের গাণ্ডীব ব্যবহারে অক্ষমতার কথা কয়েক জায়গায় আছে—এইরকম সব ছোটো ছোটো উল্লেখ। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে এই সমস্ত বিষয়ের অধিকাংশেরই বিস্তৃত আলোচনা আছে। সেইজন্য এখানে আর বিশদ আলোচনার মধ্যে যাচ্ছি না—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কবির কথাগুলো শুধু উদ্ধৃত করবো। অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে একটু বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন হবে।
চিঠিপত্র—১ম খণ্ড : এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত পত্রগুলি হলো—কবিকর্তৃক স্ত্রী মৃণালিনীদেবীকে লিখিত ৩৬খানি পত্র; রবীন্দ্রনাথকে লিখিত দুইখানি চিঠিসহ মৃণালিনীদেবীর লিখিত মোট দশখানি চিঠি; কবি ব্যতীত অন্য কয়েকজনের লেখা কিছু চিঠি মৃণালিণীদেবীকে; এবং মৃণালিণীদেবীকে নিয়ে কিছু লেখা। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলিই আমাদের আলোচনার বিষয়।
শিলাইদহ থেকে ১৮৯৮ সালের জুন মাসে কবি পত্নী মৃণালিণী দেবীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। মনে হয় কবিপত্নী তখন মানসিক অশান্তিতে একটু বিপর্যস্ত ছিলেন। এই চিঠিতে কবি স্ত্রীকে অনেক সান্ত্বনাবাক্য বলেছেন—তুমি অনর্থক মনকে পীড়িত কোরো না। শান্ত স্থির সন্তুষ্টচিত্তে সমস্ত ঘটনাকে বরণ করে নেবার চেষ্টা কর। দীর্ঘপত্রের শেষে তিনি মহাভারতের শান্তিপর্ব থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন—
সুখং বা যদিবা দুঃখং প্রিয়ং বা যদিবাপ্রিয়ং
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়ে না পরাজিতা।
২৮ আগষ্ট, ১৮৯৯ তারিখের চিঠিটি পড়ে মনে হয় কবিপত্নী বোধহয় বৃহৎ ঠাকুর পরিবারের কারো কারো ব্যবহারে বিরক্ত বোধ করছিলেন। কবি এই চিঠিতে স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন—আমাদের শোক দুঃখ, বিরাগ অনুরাগ, ভাললাগা না লাগা, ক্ষুধাতৃষ্ণা, সংসারের কাজকর্ম, সমস্তই আমাদের বাইরে;—আমাদের যথার্থ ‘আমি’ এর মধ্যে নেই—এই বাইরের জিনিষকে বাইরের মত করে দেখতে পারলে তবেই আমাদের সাধনা সম্পূর্ণ হয়। গীতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেছেন—’গীতায় আছে, লোকে যাকে উদ্বেজিত করতে পারে না এবং লোককে যে উদ্বেজিত করে না—যে হর্ষ বিষাদভয় এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত সেই আমার প্রিয়।’ এই কথাগুলি শ্রীশ্রীগীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের ১৫ সংখ্যক শ্লোকটির অনুরূপ। মূল শ্লোকটি নিম্নরূপ—
যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ।
হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ।।
চিঠিপত্র—২য় খণ্ড : এই খণ্ডে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবির লিখিত ১৭৩টি চিঠি ও রথীন্দ্রনাথের লেখা ৮টি চিঠি মুদ্রিত হয়েছে। প্রতিটি খণ্ডেই কবি লিখিত চিঠির অতিরিক্ত আরো কিছু কিছু বিষয় আছে। আমাদের আলোচনার জন্য কবির চিঠিগুলিই প্রয়োজন।
১৯২৭ সালে কবি বালি, জাভা ইত্যাদি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কিছু স্থান ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানকার জনজীবনে রামায়ণ-মহাভারতের বিপুল প্রভাব লক্ষ করেছিলেন। ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ তারিখে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি লিখেছিলেন—’গ্রামে গ্রামে সর্বত্র চলচে নাচ, গান, অভিনয়; অভিনয়ের বিষয় প্রায়ই মহাভারত থেকে।’ কবি রাজবাড়ীতে একদিন নাচ দেখেছিলেন—’এই নাচ অভিনয়ের বিষয়টা হচ্ছে শাল্ব সত্যবতীর আখ্যান’। শাল্ব এবং সত্যবতী দু’জনেই মহাভারতের চরিত্র তবে তাঁদের কখনো দেখা-সাক্ষাতের কথা মহাভারতে নেই। দেশ-কালের ব্যবধানে মহাভারত কাহিনীর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
১৯শে সেপ্টেম্বরের চিঠিতে কবি আবার রামায়ণ-মহাভারতের কথা বলেছেন—’জাভায় কালীর কোনো পরিচয় নেই। কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলারও কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। পুতনাবধ প্রভৃতি অংশ আছে কিন্তু গোপীদের দেখতে পাইনে। এর থেকে সেই সময়কার ভারতের ইতিহাসের কিছু ছবি পাওয়া যায়। এখানে রামায়ণ মহাভারতের নানাবিধ গল্প আছে যা অন্তত সংস্কৃত মহাকাব্যে ও বাংলাদেশে অপ্রচলিত। এখানকার পণ্ডিতদের মত এই যে, জাভানীরা ভারতবর্ষে গিয়ে অথবা জাভায় সমাগত ভারতীয়দের কাছ থেকে লোকমুখে প্রচলিত নানা গল্প শুনেছিল, সেইগুলোই এখানে রয়ে গেছে। অর্থাৎ, সে সময়ে ভারতবর্ষের নানা স্থানে নানা গল্পের বৈচিত্র ছিল। আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের কোনো পণ্ডিতই রামায়ণ-মহাভারতের আলোচনা করেন নি। করতে গেলে ভারতের প্রদেশে প্রদেশে স্থানীয় ভাষায় যেসব কাব্য আছে মূলের সঙ্গে সেইগুলি মিলিয়ে দেখার দরকার হয়। কোনো একসময়ে কোনো এক জার্মান পণ্ডিত এই কাজ করবেন বলে অপেক্ষা করে আছি তার পরে তাঁর লেখার কিছু প্রতিবাদ কিছু সমর্থন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ডাক্তার উপাধি পাবো।’
চিঠিপত্র—৩য় খণ্ড : এই খণ্ডে পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে লেখা কবির ১১৫টি চিঠি সন্নিবেশিত হয়েছে। বালী দ্বীপ ভ্রমণকালে ৩০শে আগষ্ট, ১৯২৭ কবি প্রতিমাদেবীকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে মহাভারতের দুষ্মন্তের কথা মনে করেছেন। বালীদ্বীপে তখন রেলগাড়ী ছিল না—কবি মোটরে চলছিলেন। ‘এখানকার অরণ্য পর্বত লোকালয়ের মাঝখান দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলেছি আর কেবলি মনে হচ্ছে এখানে পায়ে হেঁটে চলা উচিত। …. পথের দুধারে যেখানে রূপের মেলা সেখানকার নিমন্ত্রণ সারতে গেলে গরজের মোটরটাকে গ্যারাজেই রেখে আসতে হয়। …. শিকার করতে দুষ্যন্ত যখন রথ ছুটিয়েছিলেন তখন তার বেগ কত …. কিন্তু তপোবনের সামনে এসে তাঁকে রথ ফেলে নামতে হোলো, লক্ষ্যসাধনের লোভে নয়, তৃপ্তিসাধনের আশায়।’
১৭ই সেপ্টেম্বরের চিঠিতে কবি জাভাদ্বীপের নাচের কথা লিখেছেন। কথা প্রসঙ্গে হনুমান, ইন্দ্রজিৎ, ঘটোৎকচ—এঁদের নাম এসেছে। ‘আহারে বসবার আগে নাচের একটা পালা আরম্ভ হল …. বিষয়টা হচ্ছে, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে হনুমানের লড়াই। …… হনুমান বনের জন্তু, ইন্দ্রজিৎ সুশিক্ষিত রাক্ষস, দুইজনের নাচের ভঙ্গীতে সেই ভাবের পার্থক্যটি বুঝিয়ে দেওয়া চাই, নইলে রসভঙ্গ হয়। ….. আমাদের যাত্রায় নাটকে হনুমানের হনুমানত্ব খুব বেশি করে ফুটিয়ে তুলে দর্শকদের কৌতুক উদ্রেক করবার চেষ্টা হয়। এখানে হনুমানের আভাসটুকু দেওয়াতে তার মনুষ্যত্ব আরও বেশী উজ্জ্বল হয়েছে। ….. সবশেষে এলেন রাজার ভাই। ….. তিনি ঘটোৎকচ। ….. এখানকার লোকচিত্তে ঘটোৎকচের খুব আদর। সেইজন্যেই মহাভারতের গল্প এদের হাতে আরও অনেকখানি বেড়ে গেল। এরা ঘটোৎকচের সঙ্গে ভার্গিবা (ভার্গবী) বলে এক মেয়ের ঘটালে বিয়ে। সে-মেয়েটি আবার অর্জুনের কন্যা। ….. ভার্গিবার গর্ভে ঘটোৎকচের একটি ছেলেও আছে, তার নাম শশিকিরণ। …. রামায়ণের মহাভারতের গল্প এ দেশের লোকের মনকে জীবনকে যে কিরকম গভীরভাবে অধিকার করেছে তা এই কদিনেই স্পষ্ট বোঝা গেল। …. বাইরের দিকে ভারতবর্ষের থেকে এরা বহু শতাব্দী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন; তবু এতকাল এই রামায়ণ মহাভারত নিবিড়ভাবে ভারতবর্ষের মধ্যেই এদের রক্ষা করে এসেছে। ওলন্দাজরা এই দ্বীপগুলিকে বলে ‘ডাচ ইণ্ডীস’, বস্তুত এদের বলা যেতে পারে ‘ব্যাস ইণ্ডীস’। …. সেদিন যে-রাজার বাড়ীতে গিয়েছিলুম …. তাঁরই এক ছেলের …. নাম অভিমন্যু। …. সেখানে মহাভারতের বিরাট পর্ব থেকে ছায়াভিনয়ের পালা চলছিল। …. একটা সাদা কাপড়ের পট টাঙানো, তার সামনে একটা মস্ত প্রদীপ উজ্জ্বল শিখা নিয়ে জ্বলছে; তার দুইধারে পাতলা চামড়ায় আঁকা মহাভারতের নানা চরিত্রের ছবি সাজানো, তাদের হাতপাগুলো দড়ির টানে নড়ানো যায় এমনভাবে গাঁথা। ….. একজন সুর করে গল্পটা আউড়ে যায়, আর সেই গল্প অনুসারে ছবিগুলিকে পটের উপরে নানা ভঙ্গীতে নাড়াতে দোলাতে চালাতে থাকে। ….. এই দেশের লোক ক্রমাগতই সুর ও নাচের সাহায্যে রামায়ণ মহাভারতের গল্পগুলিকে নিজের চৈতন্যের মধ্যে সর্বদাই দোলায়িত করে রেখেছে।’
২রা মার্চ ১৯২৯ তারিখের চিঠিতে মহাভারতের অল্প একটু উল্লেখ আছে। ‘সুরেনের মহাভারতখানা নিয়ে তার খাঁটি গল্পাংশটুকু চিহ্নিত করছিলুম। ….. আমার নিশ্চিত বিশ্বাস মহাভারতের অতিবিপুলতা থেকে আমি তার যে সারভাগ উদ্ধার করেছি সেটা অতি উত্তম হয়েছে।’ (এটি কুরুপাণ্ডব গ্রন্থটির সঙ্গে সম্পর্কিত—পরে বিশদ আলোচনা হবে)।
কবি ১৯২৯ সালে কানাডার National Council of Education নামক প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ সম্মিলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহূত হয়েছিলেন। এই যাত্রায় তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন অপূর্বকুমার চন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। একদিন ডিনারের আগে অপূর্বকুমার ও সুধীন্দ্রনাথ কেবিনে ঢুকেছেন—আর বেরোচ্ছেনই না। ডিনারের নির্ধারিত সময় হয়ে গেছে। কবি মজা করে লিখেছেন—’মনে পড়ল অভিমন্যুর কথা। এরা ক্যাবিনে প্রবেশ করার বিদ্যে শিখেচে বেরোবার বিদ্যে শেখেনি।’ ৩১শে মার্চের চিঠিতেও আবার অভিমন্যুর কথা। ইয়োকোহামা ছেড়ে জাহাজ ভ্যাঙ্কুভারের দিকে চলেছে। খুব শীত। কবি লিখলেন—’সূর্য্য যেন অভিমন্যুর মতো—কয়দিন আগে মেঘের ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করেচে কিছুতে আর বেরোতে পারচে না।’
৫ই মার্চ, ১৯৩৮ কবি শান্তিনিকেতন থেকে বৌমা প্রতিমাদেবীকে চিঠি লিখেছিলেন কোলকাতায়। সেখানে লিখেছেন—’মহাভারত লেখার ভার স্বীকার করে নিয়েছি—অবিলম্বে শুরু করতে হবে।’—এই মহাভারত লেখা প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের পত্র-পরিচয় অংশে একটু বিস্তৃত আলোচনা আছে (পৃ ২২২-২২৩)। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে কবি ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৮ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখেছিলেন—’সকলের চেয়ে বিরাট একটা তাগিদ আমার মাথার উপর ঝুলচে—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে স্বীকার করেছি মহাভারতের উপর একখানা বই লিখব।’ এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ মহাভারত সম্বন্ধে এক জায়গায় তাঁর খণ্ড চিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন—’গঙ্গা একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে মানবী ….. অলৌকিকে লৌকিক মিশাল’। মৈত্রেয়ী দেবীকে কবি মহাভারত সম্বন্ধে বলেছিলেন—’ও এক সমুদ্র। ওর মধ্যে যে কত কি আছে তার অন্ত নেই। একদিকে যেমন চিন্তা সুদূরপ্রসারী, গভীর, অন্যদিকে তেমনি অগাধ ছেলেমানুষী, ছেলেমানুষীর শেষ নেই—পাশাপাশি রয়েছে গীতা আর ঠাকুরমার ঝুলি।’ সুধীরচন্দ্র করকে কবি লিখেছিলেন—’চোখের দুর্বলতার জন্যে কোমর বেঁধে লিখতে পারছি নে—ছোটো অক্ষরের মহাভারত যেন কাঁকর বিছানো রাস্তা, তার উপর দিয়ে চোখ চালানো আরামের নয়।’ শারীরিক অসুবিধার জন্য এই বই কবি লিখে উঠতে পারেন নি।
৯৪ সংখ্যক পত্র—সম্ভবত জুন ১৯৩৮। কবি তখন মংপুতে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁর কালিম্পং যাবার ইচ্ছা (পৃ ২২৪)। বৌমাকে তিনি লিখলেন—’বৌমা দিন গণনা করচি। সীতাকে হনুমান উদ্ধার করেছিলেন আমি হনুমানের বাবার উপর নির্ভর করে আছি—অনিল আমাকে নিয়ে যাবেন এইরকম সংকল্প কিন্তু জানই তো কড়া পাহারা’—হনুমানের পিতা পবনদেব অর্থ বায়ু। অনিল কথার অর্থও বায়ু।
চিঠিপত্র—৫ম খণ্ড : এই খণ্ডে কবির লেখা অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা একটি পত্র; তদীয় পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে লিখিত একটি পত্র; অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখিত ৫টি পত্র এবং ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবীকে লিখিত ৮৪টি পত্র এবং প্রমথ চৌধুরীকে লেখা ১৩৪টি পত্র সংকলিত হয়েছে। কবির ইন্দিরাদেবীকে লেখা পত্রের সংখ্যা অনেক। ১৮৮৭-১৮৯৫ সালের মধ্যে কবি ইন্দিরাদেবীকে যে চিঠিগুলি লিখেছিলেন সেগুলি ছিন্নপত্র বা ছিন্নপত্রাবলীতে মুদ্রিত আছে। ১৯১৩ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে ইন্দিরাদেবীকে লেখা পত্রগুলি এই খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে।
ইন্দিরাদেবীকে লেখা ৩নং চিঠি (তাং ২ বৈশাখ, ১৩২৫—কবি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। মজা করে লিখেছেন—’ইনফ্লুয়েঞ্জা অনেকটা অভিমন্যুরই মত, ও প্রবেশ করতেই জানে প্রস্থান করতে নয়।’
৫নং চিঠিটিতে (পৃ ৩১-৩৩) ‘বিশ্ববীণারবে’ গানটির সুরের বিকৃতি বিষয়ে বলতে গিয়ে কবি মহাভারত বনপর্বের একটি শ্লোকাংশ উল্লেখ করেছেন— ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা’। এই শ্লোকটি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
ইন্দিরাদেবীকে লেখা ৮নং চিঠিটিতে কবি গীতার একটি শ্লোকের অংশ বিশেষ উল্লেখ করেছেন। ‘মনুষ্যলোকে দুই জাতের প্রাণী আছে,—কেজো আর অকেজো। এরা নিজের নিজের ধর্মরক্ষা করে চলবে এদের প্রতি বিধাতার এই অনুশাসন ছিল। কারণ, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মোভয়াবহঃ। কিন্তু সংসারে কাজের দাবী এত বেশী যে বেকার লোকে আপন বেকার-ধর্ম পালন করবার সুযোগ পায় না।’ সম্পূর্ণ শ্লোকটি আছে গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে—৩৫ সংখ্যক শ্লোক। পূর্বে আলোচিত।
স্বপ্নের বিশ্বভারতীতে অর্থসংকট এবং অন্যান্য কারণে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে কবি মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে পড়তেন। ১১ সংখ্যক পত্রে কবি ইন্দিরাদেবীকে লিখেছিলেন—’যখন মন শ্রান্ত হয়ে পড়ে তখন বিশ্বভারতীকে মরীচিকা বলে মনে হয় …. এ কি টিঁকবে? আইডিয়া জিনিষটা সজীব, কিন্তু কোনো ইনস্টিটুশনের লোহার সিন্ধুকে ত তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না—মানুষের চিত্তক্ষেত্রে যদি সে স্থান পায় তবেই সে বর্তে গেল। দেশের চিত্তের দিকে যখন তাকিয়ে দেখি তখন দেখতে পাই বিপুল কাঁটাবন ….? যাই হোক আমাদের শাস্ত্র বলেচেন বপন করতে, ফলের হিসেব করতে নিষেধ করেচেন।’ কবির উদ্দিষ্ট শাস্ত্রবচনটি মনে হয় গীতার ২য় অধ্যায়ের ৪৭ সংখ্যক শ্লোকটি:
‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।’
ইন্দিরাদেবীকে লিখিত ২৯ সংখ্যক পত্রে (বিজয়া দশমী ১৩৩৬) নিজের শরীরের কথা লিখেছেন—’বিধাতা তাঁর একটা বিশেষ উদ্দেশ্যেই আমাকে মজবুৎ করে বানিয়েচেন কিন্তু সেই উদ্দেশ্যের বাইরে আমি কাহিল—আমি গাণ্ডীব তুলতে পারি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, কিন্তু ডাকাত তাড়াবার সময় পাহারাওয়ালার কাজে নয়।’—মহাভারতের তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের ধনুকের নাম গাণ্ডীব। সুবৃহৎ এবং অত্যন্ত শক্তিশালী এই ধনুক দিয়েই অর্জুন কুরুক্ষেত্র এবং অন্যান্য যুদ্ধে শত্রুজয় করেছেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পাণ্ডবেরা ৩৬ বৎসর হস্তিনাপুরে রাজত্ব করেন। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র অপ্রকট হলে যাদবরমণী এবং যাদবশিশু ও বৃদ্ধদের সুরক্ষার জন্য অর্জুন তাদেরকে দ্বারকা থেকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসছিলেন। পথে পঞ্চনদবাসী দস্যুরা তাদের আক্রমণ করে। পৃথিবীবিখ্যাত মহাবীর গাণ্ডীবধন্বা অর্জুন দস্যুদের আক্রমণের মুখে গাণ্ডীব ঠিকমতো ব্যবহার করতেই পারলেন না। দস্যুরা তাঁদেরকে পরাজিত করলো ও লুণ্ঠন করলো।
ইন্দিরাদেবীকে লেখা ৬০ সংখ্যক পত্রে (২রা জুন, ১৯৩৬) রামায়ণের সীতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। গানের ব্যাপারে ইন্দিরাদেবীর পত্রের উত্তরে কবি লিখলেন—’দেখতে পাচ্চি আমার পরে এখনো তোর শ্রদ্ধা আছে—তার কারণ আমার উত্তরকাণ্ডে তোর পরিচয় অল্পই—তুই জানিসনে আমার মাথা থেকে গীতরূপিনী সীতা গেছেন বনবাসে।’—রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে সীতার বনবাস বর্ণিত হয়েছে।
১৩৪৫ বৈশাখ মাস। কবি ছিলেন কালিম্পঙে। সেখানে সমারোহের সঙ্গে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছে। ৭২ নম্বর চিঠিতে কবি ইন্দিরাদেবীকে লিখেছেন—’কাল আমার জন্মদিন ছিল সেটা দশে মিলে তারস্বরে আমাকে বুঝিয়ে ছেড়েছে। চারদিক থেকে স্তুতির স্বরবর্ষণ হয়েছিল—ভীষ্মের মতো মৃতকল্প হইনি কিন্তু লজ্জিত হয়েছিলুম।’
৮৪নং চিঠিতে (১৩ই মে, ১৯৪১) আবার অর্জুন ও গাণ্ডীবের কথা এসেছে। ‘আমার জন্মদিনে তুই যে মূর্তিটা পাঠিয়েছিস সে আমার খুব সান্ত্বনাজনক। শেষ দশায় অর্জুন গাণ্ডীব তুলতে পারেননি আমার সেই অবস্থা। আমার চিরদিনের কলম আজ পরের ঘাড়েই চাপাতে হচ্চে কিন্তু বকলমে তোকে লিখতে ভাল লাগল না—খোঁড়া কলমকে চাবুক লাগিয়ে কোনো মতে ক লাইন লিখিয়েছি—এখন সে ফিরে চলল পিঁজরাপোলে।’
১৯১৪ সালের ৮ই অক্টোবর প্রমথ চৌধুরীকে লেখা ৩৩ সংখ্যক চিঠিতে কবি সবুজপত্র পত্রিকার লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘যে পর্যন্ত না লেখক দুটি একটি তৈরী হয়ে ওঠে সে পর্যন্ত সবুজ পত্র তোমার লেখা দিয়েই ভরতে হবে। ….. আমি ত এই দীর্ঘকাল লিখে আসচি—….. তা ছাড়া আমারও সাহিত্যলীলা শেষ হয়ে এসেছে—এখন আমার গাণ্ডীব তোলবার শক্তি নেই।’—এই সময়ে তো কবির বয়স ৫৫ বৎসরও হয়নি। মনে হয় তখন তিনি কোনো কারণে সাময়িকভাবে হতাশ ও বিষাদগ্রস্ততার কবলে পড়েছিলেন। অল্প কিছুদিন আগেই তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তাঁর প্রতিভাসূর্য তখন প্রায় মধ্যগগনেই—অন্তত অস্তোন্মুখ যে নয় সেটা বলাই যায়।
প্রমথ চৌধুরীকে লেখা ৪৮ সংখ্যক পত্রটিতে মহাভারতের শিশুপালের নাম আছে। ‘ছাত্রশাসনটা ইংরেজী করা হয়েচে—Modern Review তে যাবে। Lord Carmichael কে পাঠিয়েছিলুম—তাতে কিছু ফল হয়েচে বলে খবর পেয়েচি। কিন্তু শুনচি আ….. বিশেষ কারণে বিরুদ্ধপক্ষ নিয়েছেন—তা যদি সত্য হয় তাহলে শিশুপালবধ হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না—দ্বাপরযুগে কৃষ্ণভক্তিতে সেটা ঘটেছিল কলিযুগে ঘটবে গোরার ভক্তিতে।’ —’আ…..’ নামের আড়ালে যিনি আছেন তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি এই গ্রন্থে।
প্রমথ চৌধুরীকে কবি আবার গাণ্ডীবের কথা বলেছেন (পত্রসংখ্যা ৫২; তাং ১৩ই এপ্রিল, ১৯১৭) বেশি লেখালেখিতে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে। ‘প্রমথ, অর্জুনের একটা সময় এসেছিল যখন সে নিজের গাণ্ডীব নিজে আর তুলতে পারেনি। আমার কি গাণ্ডীবের কারবার ছেড়ে দেবার দিন আসবে না মনে করচ? ….. এইবার নতুন লেখকদের খুব কষে নাড়া দাও।’
সবুজপত্রের উত্তরোত্তর প্রভাব বৃদ্ধি কামনা করে কবি প্রমথ চৌধুরীকে ৭৩নং পত্রটি (তাং ১৭ই বৈশাখ, ১৩২৬) লিখেছিলেন এবং কথাপ্রসঙ্গে মহাভারতের জরাসন্ধের কথা বলেছেন। মহাভারতের যুগে জরাসন্ধ ছিলেন পূর্বভারতে (মগধ) মহাপরাক্রান্ত এক অত্যাচারী রাজা। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল এবং শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধিতেই তিনি নিহত হন। এখন কবির কথাগুলো উদ্ধৃত করছি—
‘জরাসন্ধের দুর্গ ভয়ানক দুর্গ—সেখানে প্রকাণ্ড কারাগার, সেখানে লোহার শিকলের মালার আর অন্ত নেই। কিন্তু তার ভয়ঙ্কর কড়া পাহারার মধ্যেও পাণ্ডব এসে প্রবেশ করে, তার সৈন্য নেই সামন্ত নেই; সেই নিরস্ত্র তারুণ্য কত সহজে কত অল্প সময়ে জরাসন্ধকে ভূমিসাৎ করে দিয়ে তার কারাগারের দ্বার ভেঙে দেয়; সেখানে বন্দী ক্ষত্রিয়দের মুক্তিদান করে। আমাদের দেশেও জরাসন্ধের দুর্গের মধ্যে দেশের ক্ষত্রিয়েরাই বন্দী রয়েছে, যারা ক্ষত থেকে দেশকে ত্রাণ করবে, যারা দূরে দূরান্তরে আপন অধিকার বিস্তার করবে, যারা বিরাট প্রাণের ক্ষেত্রে দেশের জয়ধ্বজা বহন করে নিয়ে যাবে, আমাদের অশ্বমেধের ঘোড়ার রক্ষক হবে যারা। সেই যুবক ক্ষত্রিয়দের হাত পা থেকে জরার লোহার বেড়ি ঘুচিয়ে দেবার ব্রত নিয়েচ তোমরা; তোমাদের সংখ্যা বেশি নয়, তোমাদের সমাদর কেউ করবে না, তোমাদের গাল দেবে, কিন্তু জয়ী হবে তোমরাই—জরার জয়, মৃত্যুর জয় কখনই হবে না।’
চিঠিপত্র—৬ষ্ঠ খণ্ড : এই খণ্ডে কবি কর্তৃক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও শ্রীমতী অবলা বসু মহোদয়াকে লিখিত পত্র; জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ এবং অন্যান্য কিছু বিষয় সংকলিত হয়েছে।
জগদীশচন্দ্র বসুকে কবির লেখা একটি চিঠিতে (১২ ডিসেম্বর, ১৯০০) মহাভারতের দ্রৌপদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। —’আমার রচনালক্ষ্মীকে তুমি জগৎ-সমক্ষে বাহির করিতে উদ্যত হইয়াছ—কিন্তু তাহার বাঙ্গলা-ভাষা-বস্ত্রখানি টানিয়া লইলে দ্রৌপদীর মত সভাসমক্ষে তাহার অপমান হইবে না? সাহিত্যের ঐ বড় মুস্কিল—ভাষার অন্তঃপুরে আত্মীয়-পরিজনের কাছে সে যে ভাবে প্রকাশমান বাহিরে টানিয়া আনিতে গেলেই তাহার ভাবান্তর উপস্থিত হয়।’
রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই এরকম মত পোষণ করতেন যে জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনা বিদেশের অনুকূল পরিবেশেই ভালোভাবে বিকশিত হবে। অর্থাভাব বা অন্য কোন কারণে কাজ অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে এলে জগদীশচন্দ্রের সাধনা বিঘ্নিত হবে। ১২ নম্বর চিঠিতে (৪ জুন, ১৯০১) কবি লিখেছেন— ‘তোমাকে বারম্বার মিনতি করিতেছি—অসময়ে ভারতবর্ষে আসিবার চেষ্টা করিও না। তুমি তোমার তপস্যা শেষ কর—দৈত্যের সহিত লড়াই করিয়া অশোকবন হইতে সীতা-উদ্ধার তুমিই করিবে, আমি যদি কিঞ্চিৎ টাকা আহরণ করিয়া সেতু বাঁধিয়া দিতে পারি তবে আমিও ফাঁকি দিয়া স্বদেশের কৃতজ্ঞতা অর্জন করিব।’
চিঠিপত্র—৭ম খণ্ড : শ্রীমতী কাদম্বিনী দেবী (দত্ত) এবং শ্রীমতী নির্ঝরিণী সরকারকে কবি যে—-সমস্ত পত্র লিখেছিলেন সেগুলি এই খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে।
বিবাহের অল্পকাল পরেই স্বামীর মৃত্যুরূপ যে বিপর্য্যয়ের মধ্যে পড়েছিলেন, তা থেকে মুক্তি পেতে কাদম্বিনীদেবী রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৩ সংখ্যক চিঠিতে (তাং ৯মে ১৯০৬) কবি কাদম্বিনী দত্তের মানসিক শান্তির জন্য কিছু কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন—’মন যখনই অপ্রসন্ন হইতে চাহিবে তখনই তাহাকে তোমার সমস্ত শক্তিতে উর্দ্ধের দিকে টানিয়া তুলিবে, বলিবে—
সুখং বা যদিবা দুঃখং
প্রিয়ং বা যদিবাপ্রিয়ম
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত
হৃদয়েনা পরাজিতা—
সুখই হউক দুঃখই হউক, প্রিয়ই হউক অপ্রিয়ই হউক যাহাই প্রাপ্ত হইবে তাহাকে অপরাজিত চিত্তে উপাসনা করিবে।’—এটি মহাভারতের শান্তিপর্বের শ্লোক।
১৯ সংখ্যক পত্রে (তাং ৮ জুন, ১৯১১) কবি কাদম্বিনী দেবীকে অবসাদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন—’মনের মধ্যে অবসাদ আসিতে দিয়ো না। ‘নাত্মানমবসাদয়েৎ’ আত্মাকে অবসাদগ্রস্ত করিবে না শাস্ত্রের এই অনুশাসন আছে।’—সংস্কৃত শব্দটি গীতার একটি শ্লোকের অংশ—ষষ্ঠ অধ্যায় ধ্যানযোগঃ, ৫ম শ্লোক। সম্পূর্ণ শ্লোকটি নীচে লেখা হলো—
উদ্ধারেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।
৭৭ সংখ্যক পত্র (তাং ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯২২) প্রসঙ্গে গ্রন্থপরিচয় অংশে বলা হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী প্রবর্তিত অসহযোগ আন্দোলনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করতে পারেননি। এটা কবির অনেক অনুরাগীকেও বিচলিত করেছিল। কাদম্বিনী দেবীও হয়তো এই প্রসঙ্গ তার চিঠিতে অবতারণা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিতে লিখেছেন—’যে সব কাজে মনের সমস্ত শক্তির জাগরণ ও দীর্ঘকালের প্রাত্যহিক ত্যাগস্বীকার চাই সে কাজে যখন আমাদের ছেলেদের কোনো উৎসাহ দেখিনে যখন দেখি তারা নিরন্তর তীব্র হৃদয়াবেগের নেশায় মেতে থাকতে চায় ‘তদা ন সংশে বিজয়ায়, সঞ্জয়”।—সংস্কৃত শব্দ কয়টি মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের কথা, পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
চিঠিপত্র—৮ম খণ্ড : শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন কবির অকৃত্রিম সুহৃদ। চিঠিপত্রের এই খণ্ডে প্রিয়নাথ সেনকে লেখা কবির চিঠি এবং কবিকে লেখা প্রিয়নাথ সেনের চিঠি সন্নিবেশিত হয়েছে।
১১৫ সংখ্যক চিঠিতে (সম্ভবত ১৯০০ সালের আগষ্ট মাসে লেখা) কবি মহাভারতের শান্তিপর্বের একটি শ্লোকের উল্লেখ করেছেন—
সুখংবা যদিবা দুঃখং প্রিয়ংবা যদিবাপ্রিয়ং
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা।
কবি লিখেছেন—’এই মন্ত্রটি আমি সর্বদাই মনে রাখিতে চেষ্টা করি—কোনও ফল পাই নাই তাহা বলিতে পারি না। সংসারে যখন সুখ পাই তখন দুঃখের আবির্ভাবে বিস্মিত হইবার কোন কারণ নাই। যত রকম দুঃখ ও অপ্রিয় সংসারে সম্ভবপর আমি সমস্তই মাঝে মাঝে মনে মনে প্রত্যাশা করিয়া মনকে সকল অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখিতে চেষ্টা করি।’
১৪৮ সংখ্যক চিঠিতে (মার্চ ১৯০১) এক দৈত্য এবং তার মানুষ খাদ্যের কথা আছে। প্রিয়নাথ সেনকে কবি লিখছেন—’সেকালের দৈত্যকে যেমন পালাক্রমে এক একটি নর-খাদ্য দিতে হত—এ কালে মাসিক পত্রকেও সেইরকম এক একটি সাধের রচনা পর্যায়ক্রমে দিয়ে শোক করতে হয়।’ মহাভারতে এক বকরাক্ষসের কথা আছে। পাণ্ডবেরা তখন বারণাবত জতুগৃহ থেকে পালিয়ে ছদ্মবেশে বনে বনে ঘুরছিলেন। তারা যখন একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে ছিলেন তখন একদিন সেই ব্রাহ্মণের পালা পড়েছিল একজন মানুষকে বকরাক্ষসের কাছে খাদ্যরূপে প্রেরণ করবার জন্য। ভীম সেই রাক্ষসকে বধ করেন।
চিঠিপত্র—৯ম খণ্ড : ময়মনসিংহ গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা হেমন্তবালা দেবী। তাঁকে লেখা কবির চিঠির সংখ্যা বিপুল। চিঠিপত্রের এই খণ্ডে হেমন্তবালা দেবীকে লেখা ২৬৪ খানি চিঠি, হেমন্তবালার পুত্র বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীকে কবির লেখা ১২টি চিঠি, হেমন্তবালার কন্যা বাসন্তীদেবীকে কবি লিখিত ৩২ খানি চিঠি, বাসন্তীদেবীর স্বামী নিখিলচন্দ্র বাগচীকে লিখিত একখানি চিঠি, হেমন্তবালা দেবীর ভ্রাতা বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে লিখিত কবির ১০টি চিঠি এবং আরো কিছু লেখা এই খণ্ডে স্থান পেয়েছে।
হেমন্তবালা দেবীকে ২০ নম্বর চিঠিতে (তাং ১৮ জুন, ১৯৩১) কবি লিখেছেন—’অস্বীকার করতে পারব না যে আমি অনেক কথাই বলেছি যা দেশের লোকের কানে মধুর ঠেকে নি। রামচন্দ্র প্রজারঞ্জন করতে গিয়ে সীতাকে বনবাস দিয়েছিলেন, প্রজারা জয় জয় করেছিল, সোনার সীতা দিয়ে তিনি ক্ষতিপূরণ করতে চেয়েছিলেন। দশের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে যদি সত্যকে নির্বাসন দিতে পারতুম, তাহলে সান্ত্বনার প্রয়োজনে সোনার অভাব ঘটতো না।’—একথা সত্য যে কবির অনেক কথাই তখনকার দেশনায়কদের মতের সঙ্গে মেলেনি।
ধর্ম নিয়ে হেমন্তবালার মত বা বিশ্বাসকে কবি চিঠিতে প্রায়ই খণ্ডন করে নিজের মত বা বিশ্বাসকে দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরতেন। ৭ আশ্বিন ১৩৩৮ তারিখের চিঠিতে কবি লিখছেন—’আমি নরদেবতাকে বিশ্বাস করি বুদ্ধের মধ্যে, কেননা বুদ্ধ অনৈতিহাসিক গালগল্পমাত্র নয়। বিশ্বাস করি ভগবদগীতার কৃষ্ণের মধ্যে, সে কৃষ্ণও মর্ত মানুষের ঘরের লোক। বৃন্দাবনকে যদি বলো আনন্দধামের রূপক তাহলে কোনো কথা নেই, যদি বৃন্দাবনকে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বলো, তাহলে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দাবী করব, শাস্ত্রবাক্যমাত্রকেই শিরোধার্য্য করব না।’
১০৫ সংখ্যক চিঠিতে (১৪ নভেম্বর ১৯৩২) কবি গীতার কথা স্মরণ করেছেন। —’আমার দেশে আমি প্রায় একাই কাটিয়ে দিলুম জীবনের শেষ বেলা পর্য্যন্ত। আমার কাজ আমার হোলো বোঝা। তবু কর্মণ্যেবাধিকারস্তে। —সংস্কৃত শব্দটি গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ সংখ্যক শ্লোকের অংশ এবং আগে আলোচনা করা হয়েছে।
১০৬ সংখ্যক চিঠিতেও (২৩ নভেম্বর ১৯৩২) কবি হেমন্তবালাকে অনেক উপদেশ দিয়েছেন। সত্যের পথে যথার্থ অগ্রসর হওয়া গেছে কি না সেটা বুঝতে হলে দুটো ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে—মন কলুষমুক্ত হয়েছে কি না আর সকলের প্রতি হৃদয়ে প্রেম বা ভালোবাসার সঞ্চার হচ্ছে কি না। ‘মানুষের মধ্যে হাজার রকম বাধা আছে বলেই সেই বাধা এবং তার কঠোর আঘাতকে অতিক্রম করতে পারলেই প্রেমের সার্থকতা। এই প্রেমের আনুষঙ্গিক যে সেবা সংসারেই তার বিশুদ্ধতা প্রমাণ হয় শুধু তাই নয় সেই সেবায় সংসারেরই প্রয়োজন দেবতার নয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেচেন দরিদ্রান ভর কৌন্তেয় মা প্রয়চ্ছেশ্বরে ধনং-দেবতা তো দরিদ্র নন, দরিদ্র যে মানুষ, মানুষকে সত্য বস্তু দিতে পারলেই দেবতা স্বয়ং তা আদরে গ্রহণ করেন।—গীতাতে এরকম কোন শ্লোক নেই। অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদারের গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে যে উদ্দিষ্ট শ্লোকটি হিতোপদেশে আছে। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হোলো—
দরিদ্রান্ ভর কৌন্তেয় মা প্রয়চ্ছেশ্বরে ধনম্।
ব্যাধিতস্যৌষধং পথ্যং নীরুজস্য কিমৌষধৈঃ।।
ঘরে-বাইরে উপন্যাস পড়ে অনেকেই কবিকে সমালোচনা করেছিলেন যে তাঁর লেখাতে সীতার অবমাননা হয়েছে। সেই সমস্ত সমালোচনার তিনি জবাব দিয়েছিলেন। হেমন্তবালা দেবীও সেই প্রসঙ্গ তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন। কবি তাঁর ১৪৩ সংখ্যক চিঠিতে (৫ জুলাই ১৯৩৪) এই অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন। —’তোমার কোনো একটা পত্রে জনশ্রুতির কথা লিখেচ যে, আমি সীতার নিন্দা করেচি। এমন অদ্ভুত অপবাদ বাংলা দেশেই সম্ভব। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে সঞ্জীব (সন্দীপ) বলে একটা মানুষ খাড়া করেছিলাম, তার চরিত্রে ভদ্রতার আদর্শ নেই। সীতার সম্বন্ধে এমন কিছু বলে থাকে যা সীতার পক্ষে সম্মানকর নয় তাহলে সেটাকে রবীন্দ্রনাথের বাণী বলা মূঢ়তা। দ্রৌপদীকে কীচক নিঃসন্দেহে অপমান করেছিল, দুঃশাসন সভাস্থলে তাঁর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেছিল এ কথাও মহাভারতে পড়েছি, বেদব্যাসকে সে জন্যে বাঙালী সমালোচকও নিন্দা করে নি।’—মনে হয় এই সমালোচনা কবিকে খুবই ক্ষুব্ধ করেছিল এবং সেই ক্ষোভের রেশ থেকে গিয়েছিল অনেকদিন।
হেমন্তবালা দেবী একজায়গায় লিখেছিলেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে চিঠি আদায় করতেন। কবির ১৫৬ সংখ্যক চিঠিটিও (২১ নভেম্বর, ১৯৩৪) মনে হয় এইরকম খোঁচার ফল। এই চিঠিটিতে শ্রীকৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্র, গীতা—এইসব শব্দ আছে। কিন্তু শুধুমাত্র সেই একটি বা দুটি লাইন উদ্ধৃত করলে কবির বক্তব্য বিষয় হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। তাই বিশেষ প্রাসঙ্গিক না হলেও একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি—
তোমার সঙ্গে অনেকদিন তর্ক করি নি আজ করব। আমাকে বিজয়নগ্রামের মহারাণী ভক্তি নিবেদন করেছিলেন, সেই ভক্তির সঙ্গে পাণ্ডার পা পূজোর সমমূল্যতা অবধারণ করেছ। উভয়ের মধ্যে প্রভেদ কী সেটা বলা আবশ্যক। আমাকে ভক্তি করার মধ্যে ঐহিক বা পারত্রিক কোনো ফললাভের প্রলোভন নেই। বোধ করি মহারাণী আমার মধ্যে ভক্তিযোগ্য কোনো মহত্ত্ব কল্পনা করেছিলেন, সেটা তাঁর ভুল হতে পারে কিন্তু মহত্ত্বকে ভক্তি করা অহৈতুক, সেটা বিশুদ্ধ ভক্তি। কিন্তু তোমাদের যে সব মেয়েরা স্বর্গফলের লোভে ঘটা করে দেবতার পুজো দেন এবং সেই ফলকে সমাপ্তি দেবার জন্যে পাণ্ডার পা দেন মোহরে ঢেকে তাঁদের এই মনোবৃত্তিকে যদি ভক্তি নাম দাও, তাহলে বৈষয়িক ফৌজদারী মকদ্দমার অনুকূলে দারোগাকে যে ঘুষ দেওয়া হয় সেও তো ভক্তি বলে গণ্য হতে পারে। এমনতরো বিকৃতিকেও তোমরা ভক্তি নাম দিতে পারো সে আমাদের দেশের আবহাওয়ারই দোষে। এই মনোভাবের থেকেই তোমাদের পণ্ডিত তর্ক করেন যে শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন অক্ষৌহিণী সৈন্য নাশ করতে পেরেছেন তখন পূজা উপলক্ষ্যে শত সহস্র পাঁঠা মহিষ বলি দিতে কুন্ঠিত হবার কারণ নেই। ”বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং” ভগবানকে বারে বারে জন্ম নিতে হয় এই কথা গীতায় আছে। ধর্মযুদ্ধে অনিবার্য্য নিধনকার্য্য নিরাসক্ত মনেই করা যেতে পারে কিন্তু দেবী যে প্রত্যহ পাঁঠার রক্ত পান করে থাকেন তারা কি দুষ্কৃতের দলে—যারা তাদের বধ করে তাদের চেয়েও কি তারা দুষ্কৃত। মহাভারতের বকাসুর রোজ একটা করে মানুষ খেত—ভারতের পূজামন্দিরে দেবীও মহামাংসনৈবেদ্যকে সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য বলে গ্রহণ করেছেন তার প্রমাণ আছে, উক্ত অসুরের লোভের সঙ্গে এই লোভের প্রভেদ কি? পাঁঠার রক্তলোভও সেই জাতেরই। পুরাণ কাহিনীতে আছে চণ্ডী কোনো এক যুগে মহিষ নামধারী দানবকে বধ করেছিলেন—দানব যদি দুষ্টস্বভাব হয় তবে দেবী ভালোই করেছিলেন, কিন্তু হতভাগা মহিষ পশুটা কী দোষ করেছে? কিন্তু মহিষের রক্তে দেবী প্রসন্ন হন এই কল্পনা করে যারা পূজা করে তাদের পূজা কি পূজা, না দেবতার অবমাননা? বোলপুরের কাছে কঙ্কালীতলা বলে এক তীর্থে বৎসরে একবার বিশেষ পরবে নানা ভক্তের মানৎরূপে বহু শত পাঁঠার বলিদান হয়, নিকটের জলাশয় রক্তে লাল হয়ে ওঠে। এই লুব্ধ হিংস্রতাকে যদি পূজা নাম দিতে কুন্ঠা না হয় তাহলে পাণ্ডার পা পূজাকেও ভক্তি নাম দিতে পার। ভক্তিকে রিপুর দলে ফেলো না। এমন কি ভক্তি দেখিয়ে দেবতার প্রসন্নতা লাভ করা যায় এ মনে করাতেও ভক্তির খর্বতা করা হয়। ভক্তি যে করে ভক্তিতে তারই চরিতার্থতা।
পত্র সংখ্যা ১৮৩ (১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫)—রামচন্দ্র শর্মা নামে এক ব্যক্তি কালীঘাট মন্দিরে জীববলি বন্ধ করার জন্য অনশন করেছিলেন। কবি তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ চিঠির কারণও মনে হয় হেমন্তবালার খোঁচা। হেমন্তবালা তো নিজেকে বৈষ্ণব বলতেন। সেই হেমন্তবালা যখন রামচন্দ্র শর্মার নিন্দা করেছিলেন, মনে হয় সেটা কবিকে উত্তেজিত করার জন্য। সেটাই যদি হেমন্তবালার উদ্দেশ্য হয়, তবে সে উদ্দেশ্য সফল। কবি বেশ বড় চিঠিই লিখেছিলেন। কবি লিখেছেন—’কুৎসিৎ আদর্শবিকৃতি থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্য যিনি প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রবৃত্ত, তিনি তো ধর্মের জন্যেই প্রাণ দিতে প্রস্তুত; শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই ধর্মের উদ্দেশ্যেই প্রাণ দিতে ও নিতে স্বয়ং উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই উপদেশই তো রামচন্দ্র শর্মা পালন করচেন, ধর্মের নামকে কলঙ্কিত করে অনিচ্ছুক অশক্ত প্রাণীকে বলি দেওয়ার সঙ্গে রামশর্মার ধর্মোদ্দেশে ইচ্ছাকৃত আত্মবলিকে তুমি এক কোঠায় ফেলে নিন্দা করলে কি মনে করে, আমি বুঝতে পারলুম না।”
১৮৬ সংখ্যক চিঠিতে (৯ অক্টোবর ১৯৩৫) কবি কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। সেখানে শ্রীকৃষ্ণের কথা এসেছে। ‘শুচিতা জলে মাটিতে অশনে বসনে মন্ত্রে তন্ত্রে নেই—শুচিতা অন্তর প্রকৃতিতে—যেহেতু মানুষ মুখ্যতঃ আধ্যাত্মিক। যিশুখৃষ্ট এই কথাই বলেছেন, ভগবান বুদ্ধেরও এই উপদেশ। ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেন যখন যজ্ঞকে তিনি বাহ্য উপকরণগত না বলে বলেছেন আন্তরিক। সত্যই যজ্ঞ, দান যজ্ঞ, জীবে দয়া যজ্ঞ, সর্ব মানুষে মৈত্রী যজ্ঞ।’
১৮৮ সংখ্যক পত্র (৩ নভেম্বর, ১৯৩৫)—এই চিঠির মধ্যে রামায়ণের রামচন্দ্রের উল্লেখ আছে। এইরকম কথা কবি অন্যত্রও বলেছেন। কবি লিখেছেন—’তোমার চিঠিতে মুসোলিনিকে আমার পুরাতন বন্ধু বলে উল্লেখ করেছ। একদিন প্রকাশ্যভাবে আমার বন্ধুর অত্যাচারের নিন্দা করেছি—। …. এই বন্ধুর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য করে আমি প্রিয়বাক্য বলিনি। রামচন্দ্র প্রজারঞ্জনের জন্যে ধর্মপত্নীকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, সেই পথ অনুসরণ করে লোকরঞ্জনের খাতিরে যদি সত্যকে বর্জন করতে পারতুম, তাহলে দেশের জনসাধারণের প্রিয়পাত্র হতে বাধা থাকত না …..।
পত্রসংখ্যা ২২৩ (৯ অক্টোবর ১৯৩৭)। কবি একদিন সন্ধ্যার সময় হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত দীর্ঘসময় তিনি অজ্ঞানাবস্থায় ছিলেন। কবি এই চিঠিতে লিখেছেন—’মৃত্যুদূত এসে আমার ছুটির পাওনা পাকা করে গিয়েছে। মনে করচি আমার ভীষ্মপর্ব শেষ হোলো—অনবরত তুচ্ছ দাবির শরবর্ষণ আজ থেকে ব্যর্থ হবে—স্বর্গারোহণ পর্ব পর্য্যন্ত এই রকমই যেন চলে এই আমি কামনা করছি।’
বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীকে (হেমন্তবালার পুত্র) কবি চিঠি লিখেছিলেন মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) থেকে ২৫ অক্টোবর ১৯৩৪ তারিখে। সবসময়ে মানুষের ভিড়। কবি মজা করে লিখেছেন—’লোকের ভিড়ে পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। অভিমন্যুর মনের ভাব কতকটা আন্দাজ করতে পারি।’
কবি বিজ্ঞানে বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার অর্থ নাস্তিকতা কারণ বিজ্ঞানও ঈশ্বরের সৃষ্টি। বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীকে একটা চিঠিতে (২৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৭) তিনি লিখেছেন—’ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণের মহাবাণী মহীয়সী, ইতিহাস যদি বলে ব্যাধের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল তাতে কিছু আসে যায় না। আধ্যাত্মিক গৌরব আত্মায়, আধিদৈহিকে নয়।’
শ্রীমতী বাসন্তীকে (হেমন্তবালাদেবীর কন্যা) ৩ সংখ্যক চিঠিতে (১ আগষ্ট ১৯৩১) ঈশ্বর আরাধনার কথা বলতে গিয়ে কবি বলছেন যে জ্ঞান এবং কর্মকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভক্তিকে বাড়িয়ে তুললে আমাদের পরিত্রাণ নেই। ‘রামচন্দ্রের পূজায় একশো পদ্ম থেকে একটি পদ্ম কম পড়েছিল বলে বিপত্তি ঘটেছিল। মানব প্রকৃতিতেও একশো পদ্মই আছে, সবগুলিই পূজায় লাগে। কে বলবে তার নিরেনব্বইটাকে বাদ দিলেই ভগবানকে খুশী করা হবে?’—কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে যে লঙ্কায় রাবণবধ করার জন্য অকালবোধন করে রামচন্দ্র দেবী অম্বিকার পূজা করেছিলেন। এই পূজায় ১০৮টি পদ্মের প্রয়োজন ছিল।
শ্রীমতী বাসন্তীকেও কবি অনেকগুলি চিঠি লিখেছিলেন। ১৬ই এপ্রিল ১৯৩৪ সিংহল যাত্রার প্রাক্কালে কবি বাসন্তীদেবীকে লিখেছিলেন—’এই মাসের শেষভাগে আমার গ্রহ সিংহলযাত্রার তাগিদ করেছে—এখন থেকে তার ব্যবস্থা করতে হচ্চে। খুব সম্ভব আমার জন্মদিন পড়বে সমুদ্রে কিম্বা বিভীষণের রাজত্বে।’—রাবণবধের পর রামচন্দ্র রাবণের ছোটোভাই বিভীষণকে লঙ্কার সিংহাসনে বসান।
চিঠিপত্র—১০ খণ্ড : এই খণ্ডে দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় এবং তৎপুত্র অরুণচন্দ্র সেনকে কবি যে চিঠিগুলি লিখেছিলেন এবং তাঁরা কবিকে যে সমস্ত চিঠি লিখেছিলেন, সেইগুলি স্থান পেয়েছে।
২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯০২ তারিখে দীনেশচন্দ্র সেনকে কবির লিখিত ৩ সংখ্যক পত্রটিতে একটু তর্ক—বিতর্কের আভাস আছে। বাংলাভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ক লেখা নিয়ে শরৎ শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতান্তর ঘটেছিল। এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—’পাছে কলহের দুষ্ট সরস্বতী ঘাড়ে চাপিয়া বসে সেইজন্য শরৎ শাস্ত্রীর লেখা আমি পড়িই নাই। তাহা ছাড়া আমি জানি হীরেন্দ্রবাবু যখন গাণ্ডীব ধরিয়াছেন তখন পরাজয়ের আশঙ্কামাত্র নাই।’—গাণ্ডীব তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের ধনুক। এই গাণ্ডীব নিয়ে যুদ্ধ করে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় অপরাজেয় ছিলেন। হীরেন্দ্রবাবু বা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত কবিকে সমর্থন করেছিলেন।
অসুস্থা কন্যা রেণুকার বায়ুপরিবর্তনের জন্য কবি সপরিবারে হাজারিবাগ গিয়েছিলেন মার্চ ১৯০৩। সেখানে সবাই ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কবি মজা করে লিখেছেন—’ঐ রোগটার দোষ এই যে উহার লঙ্কাকাণ্ডের অপেক্ষা উত্তরকাণ্ডই বেশী নিদারুণ। কাশি দুর্বলতা অরুচি মন্দাগ্নি প্রভৃতি উপসর্গ কিছুতেই দখল ছাড়িতে চায় না।’ সপ্তকাণ্ড রামায়ণে লঙ্কাকাণ্ডই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সীতা উদ্ধারের জন্য লঙ্কায় যুদ্ধ ইত্যাদি সব এই কাণ্ডেই বর্ণিত হয়েছে। লঙ্কাকাণ্ডের পর উত্তরকাণ্ড। সাহিত্যের বিচারে উত্তরকাণ্ড অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জাতে উত্তরকাণ্ড অর্থাৎ পরবর্তী অসুবিধাগুলো বেশি কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। (১২ সংখ্যক চিঠি—২ এপ্রিল ১৯০৩)
পত্রসংখ্যা ১৪ (১৫ অক্টোবর ১৯০৩)। দীনেশচন্দ্র সেন রামায়ণের চরিতাবলী নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং সেগুলির ব্যাপারে কবির মতামত চেয়েছিলেন। কবি এই চিঠিতে তাঁর অভিমত জানিয়েছিলেন। ‘লক্ষ্মণ, ভরত কৌশল্যা প্রবন্ধগুলির মধ্যে সর্বোত্তম হইয়াছে। পরে যথাক্রমে সীতা ও [রাম] এবং দশরথ ক্লাসের মধ্যে নিম্নে। ….. সীতা ও রামচরিত্রের যে বিশেষত্ব গভীরভাবে কাব্যে নিহিত আছে তাহাকে আপনার লেখনীঅগ্রে নূতন আলোকে ধরিয়া দেখান দরকার ……। দশরথ কৈকেয়ীর মধ্যে দাম্পত্য বিকৃতি প্রকাশ পাইয়াছে তাহারই কালিমাকে পশ্চাতে রাখিয়া রাম-সীতা দাম্পত্যের ঊষালোকের ন্যায় রামায়ণে উদ্ভাসিত। এই দাম্পত্য নির্বাসনকে সুমধুর করিয়াছে। …… দাম্পত্যর এই মাধুর্য্য ও বীর্য্য দশরথ কৈকেয়ীর কাম-আসক্তির মসীলেপের উপর কেমন করিয়া চিরন্তন দীপ্তিলাভ করিয়া উঠিয়াছে তাহাই সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত হওয়া চাই।’
অরুণচন্দ্র সেনকে লিখিত ৮ সংখ্যক চিঠি তাং ২ মার্চ ১৯১১। এই চিঠিতে কবি অরুণচন্দ্রের স্ত্রীর জন্য মহাভারতের শান্তিপর্বের একটা শ্লোক লিখে দিয়েছেন—
সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ংবা যদি বা প্রিয়ম্
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা।
কবি বলেছেন যে বৌমা (অরুণচন্দ্রের স্ত্রী) যেন এই শ্লোকটি ভাল করে মুখস্থ করে রাখেন এবং যখনি আঘাত পাবেন তখনি শ্লোকটি যেন স্মরণ করেন।
চিঠিপত্র—একাদশ খণ্ড : এই খণ্ডে শ্রীঅমিয় চক্রবর্তীর মাতা অনিন্দিতা দেবীকে এবং অমিয় চক্রবর্তীকে লিখিত কবির পত্রাবলীসমূহ সংকলিত হয়েছে। শ্রীঅমিয় চক্রবর্তী তরুণ বয়সেই রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীর কাজে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক ও কবির সাহিত্য সহায়করূপে। রবীন্দ্রনাথের বিদেশ সফরেও তিনি একাধিকবার সঙ্গী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় ও আস্থাভাজন ছিলেন।
পত্রসংখ্যা ১৮ তাং ৩০ মার্চ, ১৯২২। মনে হচ্ছে কবির বিরুদ্ধে কোন লেখার জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। কবি তাঁকে এই চিঠিতে লিখেছিলেন—’ এ পর্য্যন্ত আমি অনেক মার খেয়েছি কিন্তু মরি নি ….. বাংলা সাহিত্যে আমি অভিমন্যু, অথচ অভিমন্যুর শেষ দশা আমার ঘটেনি। অতএব সপ্তরথীগুলিকে আমি সাদর অভিবাদন করে সজ্ঞানে বিদায় নিতে পারব। …… তুমি জোর কলমের পরিচয় দিয়েছ বটে। জোর মানে গদাঘাত নয়। তোমার মারের মধ্যে সূক্ষ্মতা, ক্ষিপ্রতা এবং কলানৈপুণ্য আছে—। সাহিত্যে তোমার অজ্ঞাতবাসের পালা শেষ হয়েছে এবারে প্রকাশবান হও। অর্জুনও গোড়ায় যখন তীর অভ্যাস করেছিলেন নিশ্চয়ই মাটির পুতুলের উপর শরবর্ষণ করে হাত পাকিয়েছিলেন—এবার তুমিও মাটির পুতুলটিকে যে রকম নাস্তানাবুদ করেচ তাই দেখে আমি তোমাকে খেলার ক্ষেত্র থেকে রণক্ষেত্রে নামতে অনুরোধ করচি।’
১৯২৭ সালে কবি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বালি, জাভা ইত্যাদি স্থানসমূহ ভ্রমণ করেছিলেন এবং লক্ষ করেছিলেন যে রামায়ণ-মহাভারত এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯২৭ (পত্রসংখ্যা ৪৫) কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন—’রামায়ণ মহাভারত এখানকার লোকের প্রাণের মধ্যে ….. প্রাণবান হয়ে রয়েচে। প্রাণবান বলেই এ জিনিষটা কোনো লিখিত সাহিত্যের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি নয়। এখানকার মানুষের বহুকালের ভাবনা ও কল্পনার ভিতর দিয়ে তার অনেক বদল হয়ে গেছে। তার প্রধান কারণ, মহাভারতকে এরা নিজেদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনে প্রতিদিন ব্যবহার করেছে। সংসারের কর্তব্য নীতিকে এরা কোনো শাস্ত্রগত উপদেশের মধ্যে সঞ্চিত পায় নি, এই দুই মহাকাব্যের নানা চরিত্রের মধ্যে তারা যেন মূর্তিমান। ….. কাল আমরা যে ছায়াভিনয় দেখতে গিয়েছিলেম তার গল্পাংশটা …. দিয়েছিল। ….. এ গল্পের বিশেষত্ব এই যে, এর মধ্যে দ্রৌপদী নেই। মূল মহাভারতের ক্লীব বৃহন্নলা এই গল্পে নারীরূপে ‘কেনবর্দি’ নাম গ্রহণ করেচে। কীচক একে দেখেই মুগ্ধ হয় ও ভীমের হাতে মারা পড়ে। এই কীচক জাভানি মহাভারতে মৎস্যপতির শত্রু, পাণ্ডবেরা একে বধ করে বিরাটের রাজার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিল।
আমি …… যে রাজার বাড়ীর অলিন্দে বসে লিখচি চারিদিকে তার ভিত্তিগাত্রে রামায়ণের চিত্র রেশমের কাপড়ের উপর অতি সুন্দর করে অঙ্কিত। অথচ ধর্মে এঁরা মুসলমান। …… রামায়ণ মহাভারতের নরনারীরা ভাবমূর্তিতে এঁদের দেশেই বিচরণ করচেন, আমাদের দেশে তাঁদের এমন সর্বজনব্যাপী পরিচয় নেই—।’
অমিয় চক্রবর্তী বিশ্বভারতী ছেড়ে ইংলণ্ডে চলে গেছেন—অক্সফোর্ডে সুযোগ পেয়েছেন। কবি ৬৪ সংখ্যক চিঠিটি তাঁকে লিখেছিলেন ২ এপ্রিল ১৯৩৪। অমিয় চক্রবর্তীর সাহচর্য্য কবির কাছে কত মূল্যবান ছিল এই চিঠিতে কবি সেটা প্রকাশ করেছেন। কবির চিঠিতে একটা বিষাদের সুর বেজেছে এটা সহজেই বোঝা যায়। ”লোকচক্ষুর গোচরে অনেকদিন কেটে গেছে, এখন আস্তে আস্তে আলো নিবিয়ে নেপথ্যে যাবার সময় হোলো এই কথাটাকে সহজ মনে স্বীকার করা উচিত। মহাভারতে আছে অভিমন্যু ব্যূহে প্রবেশ করতেই জানতেন বেরোবার বিদ্যা তাঁর জানা ছিল না—আধুনিককালের মানুষ আমরা, জীবন সংগ্রামে ব্যূহ থেকে বেরোবার রাস্তাটা শিখি নি।’
৭২ সংখ্যক পত্রে (১১ ডিসেম্বর ১৯৩৪) কবি অনেক কথার সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীকে শান্তিনিকেতনে শীতের খবর দিয়েছেন। ‘শান্তিনিকেতনে শীতকালটা অত্যন্ত রমণীয় ….. পাতাঝরানো গাছ অতি অল্পই আছে। দুঃশাসন শীত বনলক্ষ্মীর বস্ত্র হরণে কৃতকার্য হতে পারেনি।’
ভারতবর্ষের অনেক জায়গা ঘুরে (প্রায় একমাস ধরে এবারে ঘুরেছেন তিনি) দেশের যে ছবি তাঁর চোখে ধরা পড়েছে তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ৭৪ সংখ্যক দীর্ঘ চিঠিতে (৭ মার্চ ১৯৩৫) কবি অমিয় চক্রবর্তীকে তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো জানিয়েছেন। চিঠিটিতে রাশিয়ার একটু প্রশংসা আছে এবং কথাপ্রসঙ্গে মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ ও জরাসন্ধের কথা এসেছে। ‘নব্যরাশিয়া মানবসভ্যতার পাঁজর থেকে একটা বড়ো মৃত্যুশেল তোলবার সাধনা করচে যেটাকে বলে লোভ। এ প্রার্থনা মনে আপনিই জাগে যে, তাদের এই সাধনা সফল হোক। দুর্দ্ধর্ষ প্রতাপ জরাসন্ধের কারাগার থেকে শ্রীকৃষ্ণ যেমন বহুকালের বহু বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিলেন তেমনি ধনমদমত্ত সভ্যতার বিরাট কারাগারে শৃঙ্খলবদ্ধ অসংখ্য বন্দী যেন একদা মুক্তি পায়।’
৭৬ সংখ্যক চিঠিতে (১২ এপ্রিল ১৯৩৫) কবি মুখ্যত তাঁর ‘চার-অধ্যায়’ উপন্যাস নিয়ে লিখেছেন। নিজের শারীরিক মানসিক ও আর্থিক প্রতিকূলতার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন—’বিশল্যকরণীর উদ্দেশ্যে গন্ধমাদন সুদ্ধ উৎপাটন করা এ যুগে আমাদের দ্বারা সম্ভব হয় না।’ —বিশল্যকরণী, গন্ধমাদন উৎপাটন এগুলো সব রামায়ণের কথা এবং পূর্বে আলোচিত হয়েছে।
অমিয় চক্রবর্তীকে কবি যে সমস্ত চিঠিগুলি লিখেছেন তার অনেকগুলিতেই মাঝে মাঝে উচ্চ সাহিত্যতত্ব আলোচিত হয়েছে। ১১১ সংখ্যক পত্রটিতেও (১১ এপ্রিল ১৯৩৯) কবি নিজের সাহিত্যজীবনের কথা বলেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের লেখা নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে সুধীন্দ্রের লেখা পাঠকদের কাছ থেকে ভাবনার দাবী করে, কেননা মননশীল তাঁর মন। কবি আরো লিখেছেন—’সুধীন্দ্র অনায়াসে বলতে পেরেছেন ….. তাঁর অনেক পুরানো মতের সঙ্গে তাঁর এখনকার মত মেলে না অথচ তাই বলে তাঁর কাছে সেগুলো পরিত্যাজ্য বলে মনে হয় নি, কেননা তিনি মননবিলাসী। গীতার সঙ্গে এই ভাবটার সুর মেলে, যে গীতা বলেন ফলের দিকে দৃষ্টি রেখো না।’
পৃথিবীর চারিদিকে যে অশান্তির আবহাওয়া ঘনিয়ে উঠেছে তাতে কবির মন ভারাক্রান্ত, বিক্ষুব্ধ। অমিয় চক্রবর্তীকে লিখিত ১১৩ সংখ্যক পত্রে (৮ মে ১৯৩৯) কবি লিখেছেন— ‘ইতিহাসের ঝোড়ো মাতুনি চলেছে জগৎ জুড়ে, ….. একটা সংকটের পর্ব চুকিয়ে দিয়ে যারা টিঁকে থাকবে তারা নতুন জীবনের পালা আরম্ভ করবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন অতীতের মাঝখানে, যার অনিবার্যতা সব নিষেধকে ঠেলেঠুলে ঢুঁ মারবে ভিতর থেকে। আমরা সেই অনিবার্যতার সঙ্গে জড়িত তাও জানি, আমাদের জোর লাগাতে হবে তার দক্ষিণে নয় বাঁয়ে দাঁড়িয়ে, তাকে চরমে নিয়ে যাব সবাই মিলে সত্যমিথ্যার ঠেলাঠেলিতে। তবু গীতার শাসন মানতে হবে—ইতিহাস- বিধাতার সৃষ্টিকার্যে খাটুনি খাটতেই হবে কিন্তু মনকে রাখতে হবে নিরাসক্ত।’
১১৫ সংখ্যক চিঠিটি (২০ মে ১৯৩৯) বেশ দীর্ঘ। কবি সাধারণত রাজনীতির বাইরে থাকতেই পছন্দ করতেন তবুও কখনো কখনো তার আঁচ লেখাতে চলে আসতো। ১৯৩৯ সালে বিশ্বজুড়ে যে অশান্তির পরিমণ্ডল তৈরী হচ্ছিল তাতে কবির মন ভারাক্রান্ত হচ্ছিল। এই চিঠির শুরুতেই অমিয় চক্রবর্তীকে কবি লিখেছেন—’অত্যন্ত উদ্বেগ নিয়ে তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি।’ এই চিঠিতে মূলত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। কংগ্রেস বাঙালী জাতির প্রতি অবজ্ঞা করছে—এইরকম একটা কথা তখন চাউর হয়েছিল। কবি লিখছেন—’এই নালিশটাকে বিশ্বাস করে নেওয়ার মধ্যে দুর্বলতা আছে। চারদিকে সকলেই বিরুদ্ধ চক্রান্ত করছে, সর্বদা মনের মধ্যে এইরকম সংশয়কে আলোড়িত হতে দেওয়া মনোবিকারের লক্ষণ।’ দেশের জননায়কতার দায়িত্ব নেওয়া কবির পক্ষে স্বাভাবিক হবে না। ‘এ সকল পোলিটিকাল প্রয়াস আমার পক্ষে স্বাভাবিক বলে আমি অনুভব করি নে। পরধর্মো ভয়াবহঃ। আমার নিজের এতদিনের অভ্যস্ত পথেই আমি সান্ত্বনা পাই।’—সংস্কৃত শব্দ দুটি শ্রীশ্রীগীতার কথা এবং পূর্বে বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বপরিস্থিতিতে কবি বিচলিত—তার পরিচয় অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এই চিঠির (পত্রসংখ্যা ১১৮, ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) ছত্রে ছত্রে। ‘আমাকে তোমরা বলচ কিছু লিখতে, কোন পক্ষের মনের কথা বলি ভেবে পাইনে। ….. আজ ধর্মের নামেই হোক অধর্মের নামেই হোক, বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে যাব এ কোন পঙ্গুতা নিয়ে? অঘাসুরকে ঠেকাবার ভঙ্গী করতে পারি যেমন ভঙ্গী করেছিল বকাসুরকে মারবার জন্যে ব্রাহ্মণ গৃহস্থের শিশুপুত্রটি ভাঙা কাঠি হাতে নিয়ে, তার চেয়ে তোমরা যাকে বলো এসকেপিজম, আমার সেই কবিত্বই ভালো। …. এই যুদ্ধে ইংলণ্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি।’—বক রাক্ষসের কথা মহাভারতে আছে। দুর্যোধনের পরিকল্পনা ছিল বারণাবত জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা হবে। সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে জতুগৃহে থেকে তাঁরা পালাতে পেরেছিলেন। পালিয়ে গিয়ে তাঁরা ছদ্মপরিচয়ে এখানে-সেখানে থাকতে লাগলেন। একসময়ে ব্রাহ্মণ পরিচয়ে তাঁরা এক ব্রাহ্মণের গৃহে ছিলেন। সেই নগরের প্রান্তে যে জঙ্গল সেখানে মহাশক্তিশালী বক রাক্ষস তার অনুচরদের নিয়ে বাস করতো। সে নিয়ম করেছিল যে প্রতিদিন নগরের এক—-একটা বাড়ী থেকে একজন মানুষ এবং অন্যান্য প্রচুর খাদ্যদ্রব্য তাকে পাঠাতে হবে। পাণ্ডবেরা যে বাড়ীতে থাকতেন একদিন সেই ব্রাহ্মণের পালা এলো। ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণী, এক কন্যা ও একটি শিশুপুত্র নিয়ে ব্রাহ্মণের সংসার। এদের মধ্যে রাক্ষসের খাদ্যহিসাবে কে যাবে এই নিয়ে বাড়ীতে একটা অত্যন্ত শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হোলো। এই সমস্ত কান্নাকাটি দেখে ব্রাহ্মণের শিশুপুত্রটি যার কিছু বোঝবার বয়স হয়নি, সে একটি তৃণগাছি হাতে নিয়ে সবাইকে রাক্ষসের ভয়ে ভীত না হতে বললো—সে সেই তৃণগাছটি দিয়ে রাক্ষসকে বধ করবে। জননী কুন্তীর কথাতে ভীম এই দুরন্ত রাক্ষসকে বধ করেন।
১২৯ সংখ্যক চিঠিতে (২০ জুন ১৯৪০) রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি প্রিয় গীতার শ্লোকাংশ উল্লেখ করেছেন—স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ। এটি পূর্বে অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে। (শ্রীশ্রীগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪০ সংখ্যক শ্লোক)
চিঠিপত্র—দ্বাদশ খণ্ড : রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী চট্টোপাধ্যায়, রমা দেবী, ইষিতা দেবী, অশোক চট্টোপাধ্যায়, শান্তা দেবী, কালিদাস নাগ ও সীতাদেবীকে রবীন্দ্রনাথের লিখিত পত্রাদি; রবীন্দ্রনাথকে লিখিত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পত্র এবং অন্য আর কয়েকটি প্রসঙ্গ এই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লোকে প্রধানত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেই জানে। বাংলা সাহিত্যে প্রবাসীপত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম।
এই খণ্ডে সংকলিত পত্রগুলিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ বিশেষ নাই। অল্প যে কয়েকটি আছে সেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হোলো—
সক্রিয় রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ সেরকমভাবে কখনো যুক্ত হন নি। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে তিনি রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটতে দেননি। তবুও বিদেশী রাজশক্তির সন্দেহ থেকে তিনি সম্পূর্ণ রেহাই পাননি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত ১৩ সংখ্যক চিঠিটিতে (৯ নভেম্বর, ১৯১১) কবি এ সমস্ত উল্লেখ করেছেন। সরকারী লোকেরা তাঁর চিঠি খুলে পড়তো; সরকারী চাপে অভিভাবকেরা কবির শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় থেকে ছাত্রদেরকে সরিয়ে নিতেন। কবি চিঠিতে লিখেছেন—’ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে ধর্মপ্রচার হউক অথবা অন্য যে কোনো হিতকর্মই হউক—কোনো কিছু গড়িয়া তুলিতে গেলেই দেশের রাজার নিকট হইতে বাধা পাইতে হইবে। এ সম্বন্ধে মুখামুখি একটা বোঝাপড়ায় নামা যাইবে সে রাস্তাও বন্ধ—মেঘনাদের মত মেঘের মধ্যে অদৃশ্য থাকিয়া যখন রাজশক্তি অস্ত্রপাত করে তখন তাহার জবাব দিবারও যো নাই নিজেকে বাঁচাইবারও পথ বন্ধ।’—মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ রামায়ণের রাবণের পুত্র। তিনি শূন্যমার্গে অদৃশ্য হয়ে যুদ্ধ করতে পারতেন। এইজন্য তাঁকে কেউ পরাজিত করতে পারতো না।
কবি কাশ্মীরে গেছেন। সেখান থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছেন (৪৬ সংখ্যক চিঠি—অক্টোবর ১৯১৫)। ‘শরশয্যায় এতদিন কাটিল, একটুখানি অবসরশয্যার সন্ধানে আছি—জুটিবে কিনা জানিনা কিন্তু শরসংখ্যা আর বাড়াইতে ইচ্ছা হয় না।’—’শরশয্যা’ কথাটি মহাভারতের ভীষ্মের নামের সঙ্গে জড়িত। কবি যে দেশের লোকের কাছ থেকে প্রচুর নিন্দা সমালোচনা পেয়েছেন এ ক্ষোভ তাঁর প্রশমিত হয়নি।
পত্রসংখ্যা ৫৮ (১১ মে ১৯১৯)। কবি লিখেছেন—’ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন সংবাদ ১৩০৪ সালে, সুতরাং বছর বাইশ পূর্ব্বে লিখিত।’ —ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধন মহাভারতের চরিত্র। কবি এখানে ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতাটির কথাই বলতে চেয়েছেন মনে হয়।
১১৩ সংখ্যক পত্র (১৮ ডিসেম্বর ১৯৩১)। এখানে কবি নিজের আঁকা ছবির কথা বলেছেন। ‘ছবিতে নাম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। ….. আমি কোনো বিষয় ভেবে আঁকি নে—দৈবক্রমে একটা কোনো অজ্ঞাতকুলশীল চেহারা ….. খাড়া হয়ে ওঠে। জনকরাজার লাঙলের ফলার মুখে যেমন জানকীর উদ্ভব। কিন্তু সেই একটিমাত্র আকস্মিককে নাম দেওয়া সহজ ছিল ….. আমার যে অনেকগুলি—তারা অনাহূত এসে হাজির। রেজিস্টার দেখে নাম মিলিয়ে নেব কোন উপায়ে।’—জনকরাজা এবং জানকী বা সীতা রামায়ণের চরিত্র।
১১৬ সংখ্যক চিঠিতে (২১ এপ্রিল ১৯৩৩) কবি মহাভারতের কথা বলেছেন। ‘অতীত ইতিহাস যদি সন্ধান করি তবে দেখতে পাব, কী আর্থিক কী সামাজিক পদ্ধতি মানবসংসারে একটানা চলে আসে নি। এক মহাভারত আলোচনা করলে তার যত পরিচয় পাই তেমন কোনো একখানা বইয়ে পাওয়া যায় না।’
দ্বাদশ খণ্ডের যে চিঠিগুলো এতক্ষণ আলোচনা করা হোলো সেগুলো সবই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা। এবারে কালিদাস নাগকে লেখা একটা চিঠি। চিঠির সংখ্যা ১২ তাং ২৮ অক্টোবর ১৯২১। কবির মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে দেশের মানুষের কাছে তিনি শুধু নিন্দা এবং সমালোচনাই পেয়েছেন। তুলনায় ইউরোপ তাঁকে প্রচুর সমাদর করেছে। কবি লিখেছেন—’যাই হোক এইসব নানা দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আমি জানকীর মতই আমার বর্তমান অবস্থাকে বলচি তুমি দ্বিধা হও আমি অন্তর্ধান করি। সে আমার অনুরোধ মত দ্বিধা হল। একদিকে কাব্য, আরেক দিকে গান। আমি এরই মধ্যে তলিয়ে গেছি।’ —জানকী বা সীতা রামায়ণের চরিত্র। তাঁর মতো দুঃখিনী চরিত্র আমাদের প্রাচীন কাব্যসাহিত্যে বেশী আছে বলে মনে হয় না। রাবণবধের পর রাবণের বন্দীশালা থেকে যখন তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হোলো, রামচন্দ্র তখন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। সেখানে সকলের সামনে তাঁকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল এবং সেই পরীক্ষায় তিনি নিজের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছিলেন। তবুও দেশে ফিরে আসার কিছুদিন পরে লোকোপবাদে রামচন্দ্র তাঁকে বনে নির্বাসিত করলেন। বনবাসী অবস্থায় বাল্মীকির তপোবনে তিনি দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন—তারা রামচন্দ্রের সন্তান। রামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের পরে বাল্মীকির ব্যবস্থাপনায় তিনি যখন রাজধানীতে ফিরে এলেন তখন রামচন্দ্র আবার তাঁকে পরীক্ষা দিতে বললেন। এত অপমান আর তাঁর সহ্য হোলো না। ধরিত্রী মায়ের সন্তান তিনি। সেই মাকেই তিনি বললেন দ্বিধাবিভক্ত হতে। বিভক্ত হয়ে মা তাঁর দুঃখিনী কন্যাকে নিজের কোলে গ্রহণ করলেন।
চিঠিপত্র—ত্রয়োদশ খণ্ড : এই খণ্ডে কবির লিখিত চিঠিগুলির প্রাপকরা হচ্ছেন মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণাকিরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীমতী জ্যোৎস্নিকা দেবী, সুবোধচন্দ্র মজুমদার, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুঞ্জলাল ঘোষ। এ ছাড়াও এই খণ্ডে আছে কবিকে মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুধাকান্ত রায়চৌধুরী লিখিত পত্রসমূহ এবং আরো কিছু বিষয়। এই চিঠিগুলির মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের বিষয় খুবই কম আছে।
মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের একেবারে প্রথমদিকের শিক্ষক। পরে অবশ্য তিনি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে যান। মনোরঞ্জনবাবু কবিকে একসময় অন্যায়ভাবে দোষারোপ করেছিলেন। তা সত্বেও ২৭ সংখ্যক (২৫ অক্টোবর, ১৯০৪) চিঠিতে দেখা যাচ্ছে যে কবি মনোরঞ্জনবাবুর মানসিক অশান্তিতে কিছু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কবি লিখেছেন—’ক্ষ্যাপার ক্ষ্যাপামি আপনার কাছে সম্প্রতি কিছু অতিরিক্ত বলিয়া বোধ হইতেছে—কিন্তু এ কথা মনে রাখিবেন তাঁহার তাণ্ডবলীলার উপদ্রব আপনার চেয়ে অনেক বেশি সহিয়াছে এমন লোক চারিদিকেই আছে। …… আমার সুখ দুঃখে কি আসে—জগন্নাথের রথ চলিতেছে এবং ইচ্ছা করি বা না করি আমাকে তাহা টানিতেই হইবে। মুখ ভার করিয়া মনে বিদ্রোহ রাখিয়া টানাই পরাজয়— প্রফুল্লমুখে চলিতে পারিলেই আমার জিৎ।
সুখং বা যদি বা দুঃখং
প্রিয়ং বা যদি বাপ্রিয়ং
প্রাপ্তম প্রাপ্তমুপাসীত
হৃদয়েনাপরাজিতা।
সুখ বা হোক্ দুখ বা হোক্
প্রিয় বা অপ্রিয়
অপরাজিত হৃদয়ে সব
বরণ করি নিয়ো।
(এটি মহাভারতের শান্তিপর্বের শ্লোক। অনেক জায়গাতেই কবি এই শ্লোকটি বা এর অংশ ব্যবহার করেছেন।)
বরণ তো করিতেই হইবে, পেয়াদায় করাইবে, তাহার উপরে হৃদয়কে কেন পরাস্ত হইতে দেওয়া? …. যাহা কিছু হইতেছে তাহাকে সহজে স্বীকার করিয়া লইলে বিশ্বশক্তির একটা আনুকূল্য হৃদয়ের মধ্যে লাভ করা যায়।’
গীতাতে যে ফলাকাঙ্খাহীন কর্মের কথা বলা হয়েছে সেই ভাবটি রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ। অনেক জায়গাতেই তিনি এই ভাবটির উল্লেখ করেছেন। মনোরঞ্জনবাবুকে লেখা ৪৯ সংখ্যক চিঠিতেও (২০ ফেব্রুয়ারী ১৯০৮) এরকম উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। ‘গীতা বলেন কাজ করে যান লড়াই করে যান তারপরে ফল যা হয় তা হবে। বস্তুত উপস্থিত ফলটা কিছুই নয়—কাজের দ্বারা কাজ থেকে মুক্তিলাভটাই হচ্ছে চরম সিদ্ধি।’
চিঠিপত্র—চতুর্দশ খণ্ড : এই খণ্ডে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে লেখা কবির চিঠিগুলি; চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কবিকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেগুলি এবং অন্য কিছু বিষয় সংকলিত হয়েছে।
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত ১৮ সংখ্যক পত্রে (২৮ জুলাই ১৯১০) চারুবাবু লিখিত একটি গল্প সম্বন্ধে কবি মন্তব্য করেছেন। ‘শেষ অংশটি বাদ দেওয়াই কর্তব্য ….. লঙ্কাকাণ্ডে সীতা উদ্ধারের পর আবার উত্তরকাণ্ডে দুর্মুখের দুর্যোগে তাকে বনবাস দেওয়া যেমন বাড়াবাড়ি তোমার উপসংহার অংশটিও তদ্রূপ।’
চারুবাবুকে ৩২ সংখ্যক চিঠিতে (৪ এপ্রিল ১৯১১) কবি লিখেছেন—”এই জেলার প্রতি যতদিন থেকে রাম সদয় হয়েছেন ততদিন হনুমানের উপদ্রবটা বড় বেড়ে গিয়েছে—মাঝে মাঝে একটা দুটো প্রায়ই যাতায়াত করছে।’ এই রাম হনুমান রামায়ণের কেউ নন। আশ্রমবিদ্যালয়ের কাজকর্ম নিয়ে বিদেশী সরকারের সন্দেহ তৈরী হয়েছিল আর সেইজন্যই হনুমান বা গুপ্তচরের আনাগোনা বেড়েছিল।
কবি তখন আমেরিকায় (পত্রসংখ্যা ৫৪, জানুয়ারী ১৯১৩)—বিদেশে তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছেন। দেশে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (এবং আরো কেউ কেউ) কবিকে নিয়ে অপ্রিয় কথা বলেছেন বা লিখেছেন। এই চিঠিতে সেইসব কথা কবি একটু লিখেছেন এবং সেখানে দস্যু রত্নাকরের (পরবর্তীতে যিনি ঋষি বাল্মীকি-রামায়ণের রচনাকার) নাম উল্লিখিত হয়েছে। ‘দ্বিজেন্দ্রবাবুর প্রতিভা কি তাঁর একলার সামগ্রী? তিনি যেখানে মহৎ সেখানে সে মহত্ত্ব আমাদের সকলেরই, কিন্তু যেখানে তিনি ক্ষুদ্র, সেখানেই তিনি স্বতন্ত্র। দস্যু রত্নাকরের পুত্রপরিবারেরা তার ঐশ্বর্যোর ভাগ নিয়েছিল কিন্তু তাঁর পাপের ভাগ নিতে ত পারেনি।’।
প্রবাসী পত্রিকার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তাঁর বহু লেখা প্রবাসীতে ছাপা হয়েছে। কিন্তু তাঁর বিদেশবাসকালে তিনি প্রবাসীতে লেখা পাঠাতে পারছিলেন না। এতে প্রবাসী’র নিশ্চয়ই একটু অসুবিধা হচ্ছিল। সম্ভবত এই অনুযোগের উত্তরই কবি ৫৫ সংখ্যক চিঠিতে (১৭ মে ১৯১৩—লণ্ডন থেকে) চারুবাবুকে দিয়েছেন। ‘তোমাদের সামনে একটা লড়াইয়ের দিন এসেছে দেখতে পাচ্ছি—কিন্তু তোমাদের প্রতি একান্ত স্নেহ সত্ত্বেও আমাকে বোধ হয় হার মানতে হবে। তোমরা যখন দস্যুর আক্রমণে পড়েছ তখন আমার গাণ্ডীব তোলবার শক্তি ভগবান অপহরণ করচেন।’—অর্জুনের গাণ্ডীব তোলবার অক্ষমতার কথা কবি বেশ কয়েক জায়গায় বলেছেন।
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ঢাকাতে। ৮৭ নম্বর পত্রে (২১ ডিসেম্বর ১৯২৫) কবি ঢাকাতে যাবার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। তিনি মজা করে চিঠিতে লিখেছিলেন—’আমার জন্য অভ্যর্থনার বিরাট পর্ব করলে সইবে না, তাহলে শান্তিপর্ব ডিঙিয়ে একেবারে স্বর্গারোহণপর্ব এগিয়ে আসবে।’
কবি তাঁর প্রথমজীবনের কিছু রচনা নিয়ে পরবর্তীকালে অনেকসময় কুন্ঠা প্রকাশ করেছেন। ১১৭ সংখ্যক পত্রে (১৩ মে ১৯৩৮) চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি লিখেছিলেন—’স্বয়ং বিধাতা তাঁর সেকালের সৃষ্টিতে লজ্জিত, নইলে আজ মানুষ জন্মাত না, সঙ্কোচে তিনি আদি জীবসৃষ্টির চিহ্ন চাপা দিয়েছেন মাটির নীচে। বৈজ্ঞানিক গুপ্তচর তাঁর সৃষ্টির আব্রু নষ্ট করতে উদ্যত। আমার কাব্যেরও সেই দশা। দ্রৌপদীর লজ্জা শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করেছিলেন, আমার কবিতার লজ্জা তোমরা রাখলে না।’
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থ রবিরশ্মি রবীন্দ্রকাব্যের আলোচনা। বইটি মনে হয় কবির ভালো পছন্দ হয়নি। ১১৮ সংখ্যক চিঠিতে (১৬ মে ১৯৩৮) কবি চারুবাবুকে লিখেছিলেন—’আমার ধারণা ছিল রবিরশ্মি সাহিত্যালোচনার উচ্চ পর্যায়ের। ….. কিন্তু বইটা হয়েছে প্রধানত ছাত্রদের পড়বার জন্যে, তন্ন তন্ন ব্যাখ্যা ….. দেয়ালকে রাস্তা মনে করে দুর্যোধনের মতো মাথা ঠুকেছিলুম। দুর্যোধনের আক্ষেপে বিচলিত হোয়ো না, একটু হেসো।’ —দুর্যোধনের এই দুরবস্থা হয়েছিল ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের নবনির্মিত আশ্চর্য সভাগৃহে। এর ফলশ্রুতিতেই কৌরব রাজসভায় দুর্যোধন কর্তৃক পাশাখেলার আয়োজন করা।
চিঠিপত্র—পঞ্চদশ খণ্ড : এই খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যদুনাথ সরকার ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর যে সমস্ত পত্রবিনিময় হয়েছিল, সেইগুলি সংকলিত হয়েছে। কিছু কিছু অন্য বিষয়ও আছে। এই খণ্ডে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ নাই বলিলেই চলে। শুধুমাত্র রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখিত ৩৯ সংখ্যক পত্রে (১৮ এপ্রিল ১৯১৭) অর্জুন এবং গাণ্ডীবের উল্লেখ আছে। ‘কলমটা অর্জুনের শেষদশার গাণ্ডীবটার মতই ভারী হইয়া উঠিল।’
চিঠিপত্র—ষোড়শ খণ্ড : এই খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সমর সেনের যে পত্রবিনিময় হয়েছিল সেগুলিই সংকলিত হয়েছে। অন্য বিষয়ও কিছু আছে। এই খণ্ডে রামায়ণ-মহাভারত প্রসঙ্গ খুবই সামান্য আছে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লিখিত ২১ সংখ্যক চিঠিতে (৩ মে ১৯৩৫) প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উপর কবির একটু ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। কবি লিখেছেন—’এইটুকু জানি, স্ট্যাটিস্টিক্সের গাণিতিক ছক কাটা ছাড়া অন্য সকল কাজেই উপকরণ সংগ্রহ পর্য্যন্তই তার চিন্তা বিচার পরামর্শ উদ্যোগ। যেই সেটাকে আকার দিয়ে প্রকাশ করবার সময় আসে অমনি তার মনটা স্তুষ্ণীম্ভূত (তূষ্ণীম্ভূত) ঔদাসীন্যে অবিচলিত হয়ে পড়ে। একেবারে মা ফলেষু কদাচন—ওর কোনো কাজেই ফলের টিকি দেখবার জো নেই।’ সংস্কৃত শব্দ কয়টি গীতার একটা শ্লোকের অংশ—বহুবার আলোচনা করা হয়েছে।
১৯২৬ সালে কবির ইউরোপ ভ্রমণের সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও রানী মহলানবিশ। এই সফরে কবি অভূতপূর্ব সমাদর লাভ করেন। কবির ক্ষোভ ছিল প্রশান্ত মহলানবিশ সেই ভ্রমনবৃত্তান্ত দেশের কাগজে প্রকাশ করেননি। এতে অবশ্য প্রশান্তচন্দ্রের কোনো দোষ ছিল না। তাঁর পাঠানো টাইপ করা ভ্রমণবৃত্তান্ত বিশ্বভারতীর গুদামে পড়ে ছিল।
চিঠিপত্র—সপ্তদশ খণ্ড : এই খণ্ডের চিঠিগুলি কবি লিখেছিলেন কলকাতার তৎকালীন মেয়ো হাসপাতালের রেসিডেন্ট সার্জন ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে। ডাক্তারবাবুকে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯১৪ তারিখের চিঠিতে কবি মহাভারত থেকে ‘অজ্ঞাতবাস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ‘আপনারা সব দল বেঁধে চলেছেন শুনে মনের মধ্যে পথের ডাক ডেকে উঠেছে— … তাছাড়া দেশবিখ্যাত হবার মুস্কিল এই যে দেশের মধ্যে বেরবার জো নেই—অতএব আমার অজ্ঞাতকবাসের মেয়াদ পাণ্ডবদের মত কেবল এক বছরের নয়—এ চির জীবনের। আমাকে সঙ্গে নিলে আপনারাও আরাম পাবেন না—সমস্ত পথ কেবলি ভিড় ঠেলে চলতে হবে।’
চিঠিপত্র—অষ্টাদশ খণ্ড : এই খণ্ডটি অনেক বড়ো—পৃষ্ঠা সংখ্যা ছয়শতের অধিক। রাণু অধিকারী (মুখোপাধ্যায়), অধ্যাপক ফণীভূষণ অধিকারী, সরযূবালা অধিকারী, লেডি যাদুমতি মুখোপাধ্যায়, আশা অধিকারী ও ভক্তি অধিকারীকে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত চিঠিগুলি লিখেছিলেন সেইগুলি; রবীন্দ্রনাথকে লেখা রাণু অধিকারী ও আশা অধিকারীর (আর্যনায়কম) পত্রসমূহ এবং আরো কিছু বিষয় এই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে।
রাণুর জন্ম ১৯০৬ সালে। যখন তার বয়স মাত্র এগারো বৎসর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে (৬ সেপ্টেম্বর) কবি তাকে চিঠিতে মজা করে লিখেছিলেন যে কবিকে দেখতে নারদ মুনির মতো—মস্ত বড় পাকা দাড়ি কিন্তু রাণু তাঁকে যেন ভয় না করে।
৩১ সংখ্যক পত্রে (২১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮) কবি তাঁর এক বুধবারের ভাষণের কথা রাণুকে লিখেছিলেন যেখানে অভিমন্যুর নাম এসেছে। ‘এবারে বলেছিলুম, জগতে একটা খুব বড় শক্তি হচ্ছে প্রাণ—অথচ সেই শক্তি বাইরের দিক থেকে কত ছোট কত সুকুমার, একটু আঘাতেই ম্লান হয়ে যায়। এমন জিনিষটা প্রতি মুহূর্তে বিপুল জড় বিশ্বের ভারাকর্ষণের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে দাঁড়িয়ে আছে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বালক অভিমন্যু যেমন সপ্তরথীর ব্যূহে ঢুকে লড়াই করেছিল আমাদের সুকুমার প্রাণ তেমনি অসংখ্য মৃত্যুর সৈন্যদলের মধ্যে দিয়ে অহর্নিশি লড়াই করে চলেছে।’
রাণু জানতে চেয়েছে কবিকে ‘রবিদাদা’ ছাড়া অন্য কোন নামে ডাকা যায় কি না। কবি চিঠির উত্তরে লিখছেন (৩২ সংখ্যক পত্র; ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৮) ‘মহাভারতের সময়ে মানুষের এক এক জনের দশটা বিশটা করে নাম থাকত, যার যেটা পছন্দ বেছে নিতে পারত …. অর্জুনের কত নাম যে ছিল তা অর্জুনকে রোজ বোধ হয় নামতা মুখস্থ করার মত মুখস্থ করতে হত।’
কবি শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা আসার পথে রাত এগারোটায় হাওড়ায় পৌঁছেছেন। এসে শুনলেন হাওড়ার ব্রিজ খুলে দিয়েছে। (তখন গঙ্গা পার হওয়ার জন্য একটি পন্টুনব্রিজ ছিল। জোয়ারের সময় বড় জাহাজ যাওয়ার পথ করে দেওয়ার জন্য পন্টুন ব্রিজ খুলে দেওয়া হতো)। কবি তাঁর যাত্রায় দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়েছেন রাণুকে (পত্র ৬১; ৯ অক্টোবর ১৯১৯)। ‘নৌকোয় গঙ্গা পার হতে হবে ……একটা মাল্লা এসে আমাকে আড়কোলা করে তুলে নিয়ে চলল। নৌকোর কাছাকাছি এসে আমাকে সুদ্ধ ঝপাস করে পড়ে গেল—আমার সেই ঝোলাকাপড় নিয়ে সেইখানে জলকাদায় লুটোপুটি ব্যাপার। গঙ্গামৃত্তিকায় লিপ্ত এবং গঙ্গাজলে অভিষিক্ত হয়ে নিশীথরাত্রে বাড়ী এসে পৌঁছন গেল। গঙ্গাতীরে বাস তবুও ইচ্ছা করে বহুকাল গঙ্গাস্নান করিনি—ভীষ্মজননী ভাগীরথী সেই রাত্রে তার শোধ তুললেন।’
৭৬ সংখ্যক পত্রে নিউইয়র্ক থেকে রাণুকে কবি লিখেছেন (৩০ অক্টোবর ১৯২০)—’ধরণীর ভানুদেব অতলান্তিকের পূর্ব পার থেকে আজ পশ্চিমপারে অবতীর্ণ হয়েছে। …. পুরাণে সমুদ্রমন্থনের কথা শুনেছিলুম—সেই মথিত সমুদ্রের মূর্তি কি, এবার তা মাঝে মাঝে দেখে নিয়েচি।’
১০৬ সংখ্যক চিঠিতে (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২) কবি বলেছেন যে তিনি ফলাকাঙ্খা বিবর্জিত হয়ে চিঠি লিখছেন। ফলাকাঙ্খাহীন কর্ম—এটা গীতার কথা।
মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গবানী’ কবির অনুমতি না নিয়েই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল যে আশ্বিনের বঙ্গবানীতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থাকবে। কবি তাই কবিতা লেখা নিয়ে ব্যস্ত। রাণুকে লিখেছেন (পত্রসংখ্যা ১২০, ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯২৩) ‘পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্র বনে গিয়েছিলেন সে ত্রেতাযুগে, সম্পাদকের সত্য পালনের জন্য কবিকে কবিতা লিখতে হয় এ কলিযুগে।’
কবির কাশী যাওয়ার কথা হচ্ছে (রাণুদের বাড়ী সেখানেই)। ১৩০ সংখ্যক পত্রে (৯/১০ জানুয়ারী ১৯২৪) রাণুকে তিনি লিখলেন—’এবারে ছোট্ট চিঠি লিখব। কেননা শীঘ্রই চিঠির খনিসুদ্ধ তোমার ওখানে গিয়ে পৌঁছবে। শুধু বিশল্যকরণী নয় স্বয়ং গন্ধমাদন গিয়ে উপস্থিত হবে।’
রাণুর দিদি আশা অত্যন্ত বিদূষী। রাশিয়া ঘুরে আমেরিকা যাওয়ার পথে আশাকে কবি একটা চিঠি লিখেছিলেন ১৫ আশ্বিন ১৩৩৭ তারিখে। নতুন রাশিয়ায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য কবি প্রাথমিকভাবে অভিভূত হয়েছিলেন। আশাকে তিনি লিখলেন—’আমাদের দেশে কোনো এক সময়ে গোবর্দ্ধনধারী কৃষ্ণ বোধ হয় ছিলেন কৃষির দেবতা …. তাঁর দাদা বলরাম, হলধর। ঐ লাঙল অস্ত্রটা হোলো মানুষের যন্ত্রবলের প্রতীক। কৃষিকে বল দান করেছে যন্ত্র। আজকের দিনে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের কোনো কিনারায় বলরামের দেখা নেই—তিনি লজ্জিত-যে দেশে তাঁর অস্ত্রে তেজ আছে সেই সাগরপারে তিনি চলে গেছেন। রাশিয়ার কৃষি বলরামকে ডাক দিয়েছে…..তাঁর নূতন হলের স্পর্শে অহল্যাভূমিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত, রামেরই হলযন্ত্রধারী রূপ হচ্চে বলরাম। —১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে এখানে যে বিপ্লব হয়ে গেল তার আগে এদেশে শতকরা ৯৯ জন চাষী আধুনিক হলযন্ত্র চক্ষেও দেখে নি। তারা সেদিন আমাদেরই চাষীদের মতো সম্পূর্ণ দুর্ব্বলরাম ছিল, নিরন্ন, নিঃসহায়, নির্ব্বাক। আজ …. এদের ক্ষেতে হাজার হাজার হল যন্ত্র নেমেছে। আগে এরা ছিল যাকে আমাদের ভাষায় বলে কৃষ্ণের জীব—আজ এরা হয়েচে বলরামের দল।’
চিঠিপত্র—ঊনবিংশ খণ্ড : এই খণ্ডে সজনীকান্ত দাসকে লিখিত কবির পত্রাবলী, রবীন্দ্রনাথকে লিখিত সজনীকান্ত দাসের পত্রাবলী এবং আরো কিছু বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে। এই খণ্ডে রামায়ণ মহাভারতের কোন উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ নেই।
ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী : ১৮৮৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৯৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কবি তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাদেবীকে যে চিঠিগুলি লেখেন তার কতকগুলি ছিন্নপত্র গ্রন্থে সংকলিত হয় ১৩১৯ বঙ্গাব্দে। ইন্দিরা দেবী এই কিঞ্চিদধিক আট বৎসর সময়ের মধ্যে পাওয়া অধিকাংশ চিঠির সারাংশ তৈরী করে দুটি বাঁধানো খাতাতে রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ বহু চিঠি সম্পূর্ণভাবে আর বহু চিঠির বহু অংশ বর্জন করেন; প্রয়োজনমত ভাষা ও ভাবগত সংস্কার করে সেগুলোকে সাহিত্যিক আকার দেন। ছিন্নপত্র গ্রন্থ সংকলনের এটাই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
ইন্দিরাদেবীর খাতা দুটিতে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি যেভাবে পাওয়া যায়, ছিন্নপত্রাবলী গ্রন্থে সেভাবেই সংকলিত হয়েছে। সেইজন্য এইগ্রন্থে ছিন্নপত্রে বর্জিত চিঠি স্থান পেয়েছে আর যে সমস্ত চিঠির অংশবিশেষ বর্জিত হয়েছিল সেগুলি পূর্ণরূপে এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থপরিচয় অংশে বলা হয়েছে যে ছিন্নপত্রাবলীতে পত্রগুলির ছিন্নাবস্থা না ঘুচিলেও পত্রগুলি অনেক বেশি পূর্ণতা পেয়েছে। আর সেইজন্যই ছিন্নপত্রাবলী পড়তে অনেক বেশি ভালো লাগে।
ছিন্নপত্রের ষষ্ঠ সংখ্যক পত্রের প্রাপক শ্রীশচন্দ্র মজুমদার। এই পত্রে রামায়ণের হরিশচন্দ্র ও বিশ্বামিত্রের কথা বলা হয়েছে। ‘হরিশচন্দ্র যেমন বিশ্বামিত্রকে সমস্ত পৃথিবী দান করে বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন, অবশেষে স্বর্গটা পর্যন্ত অদৃষ্টে জুটল না, আমিও তেমনি আমার সমস্ত সময় পরের হাতে দিয়ে অবশেষে স্বর্গ পর্যন্ত খোয়াতুম—কারণ, খবরের কাগজ লিখে এ পর্যন্ত কেউ অমরলোক প্রাপ্ত হয় নি।’
ছিন্নপত্রাবলীর ৮৪ সংখ্যক পত্র ইন্দিরাদেবীকে লেখা তাং ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৩। এই চিঠিটিতে কবি তার একটা প্রিয় ভাব ব্যক্ত করেছেন। ‘আমার মত হচ্ছে এই যে, এখন বহুকাল আমাদের অজ্ঞাতবাস বিজনবাস আবশ্যক। এখন আমাদের প্রস্তুত হবার সময়, এই অসম্পূর্ণ অবস্থায় নিজেকে সকলের চোখের সামনে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াবার কাল নয়। যে সময় গঠন হতে থাকে সেই সময়টা অত্যন্ত গোপনীয় সময়। ….. কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার সময় পাণ্ডবরা একবৎসর অজ্ঞাতবাস যাপন করেছিলেন—গুরুগোবিন্দ তাঁর গুরুপদ গ্রহণ করবার পূর্বে বহুকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্জনে প্রস্তুত হয়েছিলেন।’
ছিন্নপত্রাবলীর ১০৭ সংখ্যক রচনা ইন্দিরা দেবীকে লিখিত তাং ১০-৭-১৮৯৩। কবির প্রতিভা বহু বিচিত্র পথে গমন করেছে। কখনো কবির মনে হয় কবিতাই তাঁর শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র আবার কখনো মনে হয় ছোটগল্প লেখাতে বেশি সময় দিলে বোধ হয় ভালো হয়। কবির কখনো মনে হয় সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জোরালো ভাবে মত প্রচার করার দরকার, কখনো বা মনে হয় গান লিখে তাঁর বেশি আনন্দ হয়। আবার চিত্রবিদ্যাও তাঁর পছন্দের জিনিষ। ‘মদগর্বিতা যুবতী যেমন তার অনেকগুলি প্রণয়ীকে নিয়ে কোনোটিকেই হাতছাড়া করতে চায় না, আমার কতকটা যেন সেই দশা হয়েছে। ….. আমার অবস্থাটা দ্রৌপদীর মতো হয়েছে—তিনি মনে করেছিলেন যে, আহা, সেই যদি আমার পাঁচটি স্বামীই হল তবে ঐ কর্ণকে সুদ্ধ নিয়ে ছটি হলেই দিব্যি হত। আমার বিশ্বাস যদি কর্ণকেও পেতেন তা হলে দুর্যোধন-দুঃশাসনকেও হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হত না। কারণ, হয় এক, নয় অসংখ্য—এর মাঝখানে আর কোথাও বেশ স্বাভাবিক বিরামের স্থান নেই। পাঁচ বললে ছয় আপনি এগিয়ে আসে এবং ছয়ের পর সাত আট নয় দশ প্রভৃতি সমস্ত সংখ্যাগুলি সার বেঁধে অনিমেষ লোচনে মুখের দিকে [চেয়ে] অপেক্ষা করে থাকে।
দ্রৌপদী সম্বন্ধে কবির এখানকার মন্তব্যটি নিতান্তই অবাঞ্ছিত। দ্রৌপদী স্বামী হিসাবে মনে মনে কর্ণকে কখনো কামনা করেছিলেন—এরকম কোনো বর্ণনা মূল মহাভারতে নেই। মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদীর যখন পতন হয়েছিল তখন ভীমের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পতনের কারণ হিসাবে বলেছিলেন—অর্জুনের প্রতি সমধিক প্রীতিই দ্রৌপদীর পতনের কারণ। ভাইদের বা দ্রৌপদীর—কারও দুর্বলতাই যুধিষ্ঠিরের অজানা ছিল না। দ্রৌপদীর মনে যদি এই পাপচিন্তা থাকতো যুধিষ্ঠির এই মহাপ্রস্থানের পথে সেটা গোপন করতেন না। দ্রৌপদীর কর্ণ কামনা—যেটা রবীন্দ্রনাথ এখানে উল্লেখ করেছেন, সেইরকম কাহিনী কাশীরাম দাসের মহাভারতে আছে। আর এটা তো সকলেরই জানা যে কাশীরাম দাস মূল মহাভারত বহির্ভূত বহু বিষয় তাঁর গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন (এই লেখকের ‘কাশীদাসী মহাভারত ও মূল মহাভারত—সাদৃশ্য/বৈসাদৃশ্য’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। রবীন্দ্রনাথ এখানেই থামেননি—তিনি তাঁর নিজের মনের অত্যন্ত অন্যায্য এবং অশোভন বিশ্বাস এখানে ব্যক্ত করেছেন যে কর্ণকে পেলেও দ্রৌপদী নিবৃত্ত হতেন না, তিনি দুর্যোধন দুঃশাসনকেও হাতছাড়া করতেন না। কবির মনে এইরকম বিশ্বাস যে কিভাবে তৈরি হয়েছিল সেটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। পাশাখেলায় যখন যুধিষ্ঠির পরাজিত হয়েছিলেন তখন দুর্যোধনের মোসাহেবরা তো দ্রৌপদীকে বলেছিল পাণ্ডবদেরকে ছেড়ে দুর্যোধনকে ভজনা করতে। দ্রৌপদী কি সেটা স্বীকার করেছিলেন?
পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার পরও দুর্যোধন যখন রাজ্য ফিরিয়ে দিতে রাজী হলেন না তখন পাণ্ডবপক্ষে এটাই ঠিক হোলো যে শেষ চেষ্টা হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ কৌরবরাজসভায় গিয়ে সন্ধির চেষ্টা করবেন। সেই আলোচনাসভাতে ভীম-অর্জুন পর্যন্ত সন্ধির পক্ষে মত দিয়েছিলেন—বিরোধিতা করেছিলেন সহদেব ও সাত্যকি। সেইসময় দ্রৌপদী বাসুদেব কৃষ্ণকে সন্ধি নয়, যুদ্ধ যেন হয় সেই চেষ্টাই করতে বলেছিলেন। ”অসিতাপাঙ্গী দ্রুপদনন্দিনী এই কথা বলিয়া কুটিলাগ্র, পরম রমনীয়, সর্বগন্ধাদিবাসিত, সর্বলক্ষণসম্পন্ন, মহাভুজগসদৃশ কেশকলাপ ধারণ করিয়া অশ্রুপূর্ণলোচনে দীনবচনে পুনরায় কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন, হে জনার্দন! দুরাত্মা দুঃশাসন আমার এই কেশ আকর্ষণ করিয়াছিল। শত্রুগণ সন্ধিস্থাপনের মত প্রকাশ করিলে তুমি এই কেশকলাপ স্মরণ করিবে।” ভীম ও অর্জুন যে সন্ধির পক্ষে মতপ্রকাশ করেছিলেন এটা দ্রৌপদীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তিনি কৃষ্ণকে বলেছিলেন যে ভীমার্জুন যদি যুদ্ধে অনাগ্রহী হন তিনি অভিমন্যুকে সেনাপতি করে তাঁর পঞ্চপুত্রকে যুদ্ধে পাঠাবেন। দ্রৌপদীর পিতা এবং ভ্রাতারাও তাদের অনুগমন করবেন। ‘দুরাত্মা দুঃশাসনের শ্যামল বাহু ছিন্ন, ধরাতলে নিপতিত ও পাংশুলুণ্ঠিত না দেখিলে আমার শান্তিলাভের সম্ভাবনা কোথায়?’ এই ঘটনা অবশ্য দ্রৌপদীর বিবাহের বেশ কয়েকবছর পরের। বনবাস অজ্ঞাতবাসের পূর্বেও যে দ্রৌপদীর মন দুর্যোধন দুঃশাসনের প্রতি অনুকূল ছিল এরকম কোন বর্ণনা মহাভারতে নেই।
সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্ন। সাহিত্যের চরিত্রহিসাবে দ্রৌপদীকে তিনি ভালো নম্বর দিয়েছেন, কিন্তু মানবী দ্রৌপদী রবীন্দ্রনাথের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পাননি। সহানুভূতি তো নয়ই, দ্রৌপদী সম্বন্ধে তাঁর বিরাগ আছে বলেই মনে হয়। সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে মহাভারতের অন্য কোনো চরিত্র সম্বন্ধে এত অকরুণ মন্তব্য সম্ভবত আর নেই। অন্যত্র কবি দ্রৌপদীকে শত্রুরক্তলোলুপা বলেছেন। কৌরবরাজসভায় দ্রৌপদীর অপমানের কথাটা কবি কি ভুলে গিয়েছিলেন? সহস্র ইতর পুরুষের দৃষ্টির সামনে ক্ষণপূর্বের ভারতসম্রাজ্ঞী দ্রৌপদীর সেদিন যে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা হয়েছিল, মানুষের ইতিহাসে তাঁর সমপর্যায়ের কোনো নারীকে সেরকম লাঞ্ছনা না অতীতে কোনোদিন সহ্য করতে হয়েছে না ভবিষ্যতে কোনদিন হবে।
পত্রসংখ্যা ১৬৯ তাং ২৫ অক্টোবর ১৮৯৪। এখানে কবি ভগবদগীতার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘ভগবদগীতায় আছে কর্মেই আমাদের অধিকার আছে, ফলে অধিকার নেই—অর্থাৎ ফল পাব কি না পাব সে কথা না ভেবে কাজ করতে হবে। ফল পাব না মনে করেই আমাদের দেশে কাজ করতে হয়।’—গীতার এই বাণীটি রবীন্দ্রনাথের পছন্দের ভাব; অনেক জায়গায় এই কথার অবতারণা করেছেন।
২১৫ সংখ্যক পত্রে (২৪-৬-১৮৯৫) কবি মহাভারতের শান্তিপর্বের সেই শ্লোকটি স্মরণ করেছেন—সুখং বা যদি বা দুঃখং। ”অবিশ্রাম কাজকর্মে মানুষকে শক্ত এবং প্রবীণ করে দেয়। সেটুকু শক্ত হওয়া দরকার জানি—সংসারক্ষেত্রের উপযোগী হতে গেলে সে পরিমাণে প্রবীণতা অত্যাবশ্যক, কিন্তু তবু সেটা আমার কাছে ভারী অপ্রিয় বোধ হয়। কিন্তু ‘সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং যদি বা প্রিয়ং’ ইত্যাদি শ্লোক স্মরণ করে অবশ্য সম্ভাবনার বিরুদ্ধে বৃথা পরিতাপ পরিত্যাগ করে আপনাকে চারিদিকের সমস্ত অবস্থা এবং উপস্থিত সমস্ত কার্যের জন্যে প্রস্তুত করে নিতে হবে।”
এইখানে আমি আমার লেখা থেকে বিরাম নিচ্ছি। গ্রন্থটি একটু মেদবহুল হয়ে গেল। অপ্রধান কিছু বিষয় বাদ দেওয়া যেতে পারতো কিন্তু আমি সেটা চাইনি। রবীন্দ্রসাহিত্যে রামায়ণ মহাভারতের সমস্ত প্রসঙ্গই আমি এই গ্রন্থে রেখেছি যাতে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে আর অন্য কোথাও খুঁজতে না হয়। কিছু কিছু জায়গায় পুনরাবৃত্তি হয়েছে—যে কথা কবি প্রবন্ধে বলেছেন সেই একই কথা হয়তো চিঠিতেও বলেছেন। আমি যেহেতু গ্রন্থ অনুসারে আলোচনা করেছি, তাই এই পুনরাবৃত্তিগুলো এসেছে। আর মুদ্রণটিও হয়েছে একটু বড়ো হরফে যাতে বয়স্ক মানুষেরাও কোনোরকম ক্লেশস্বীকার না করে পড়তে পারেন।
১. বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী (সুলভ সংস্করণ)—সমস্ত খণ্ড।
২. বিশ্বভারতী প্রকাশিত চিঠিপত্র—বিভিন্ন খণ্ড সমূহ।
৩. মহাভারতম—সংকলন মহামহোপাধ্যায় ভারতাচার্য্য শ্রী হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, পদ্মভূষণ।
৪. মহাভারত—মহাত্মা কালীপ্রসাদ সিংহ মহাশয় অনূদিত।
৫. মহাভারত—কাশীরাম দাস।
৬. রামায়ণ—কৃত্তিবাস ওঝা।
৭. রবীন্দ্র সংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস—অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদার।
৮. রবীন্দ্রনাথ ও মানুষের ধর্ম—অধ্যাপক শ্রী গৌতম নিয়োগী।
৯. সরল বাংলা অভিমান—সুবলচন্দ্র মিত্র।
১০. পান্থজনের সখা—আবু সয়ীদ আইয়ুব।
১১. অন্যান্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন