একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড

একাদশ অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড)

রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি সন্নিবেশিত হয়েছে—

কবিতা ও গান : খাপছাড়া ও সংযোজন, ছড়ার ছবি, প্রান্তিক ও সেঁজুতি;

নাটক ও প্রহসন : তপতী ও পরিশিষ্ট, নবীন ও পরিশিষ্ট, শাপমোচন ও সংযোজন, কালের যাত্রা ও পরিশিষ্ট;

উপন্যাস ও গল্প : গল্পগুচ্ছ;

প্রবন্ধ : ছন্দ ও পরিশিষ্ট, পারস্যে; এবং গ্রন্থপরিচয়।

এই গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রান্তিক, নবীন ও শাপমোচনে রামায়ণ মহাভারত প্রসঙ্গ নাই। খাপছাড়া, ছড়ার ছবি, সেঁজুতি, তপতী, কালের যাত্রা এবং গল্পগুচ্ছতে রামায়ণ-মহাভারত প্রসঙ্গ খুব অল্প অল্প আছে এবং সেগুলো Casual ধরনের। ছন্দ এবং পারস্যে গ্রন্থদ্বয়ে অবশ্য আলোচনার মতো বেশ কিছু প্রসঙ্গ আছে।

খাপছাড়া —১৩ নং কবিতাটি অত্যন্ত ছোট। সম্পূর্ণ কবিতাটি:

‘ইতিহাস—বিশারদ গণেশ ধুরন্ধর।

ইজারা নিয়েছে একা বম্বাই বন্দর।

নিয়ে সাতজন জেলে

দেখে মাপকাঠি ফেলে

সাগরমথনে কোথা উঠেছিল চন্দর,

কোথা ডুব দিয়ে আছে ডানা কাটা মন্দর।’

সমুদ্রমন্থনে মন্দর পর্বত মন্থন দণ্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। চন্দ্র সমুদ্রমন্থনে উত্থিত হয়েছিলেন।

৬২ নং কবিতার অংশ বিশেষ

”ননীলাল বাবু যাবে লঙ্কা,

শ্যালা শুনে এল, তার

ডাক—নাম টঙ্কা।

বলে, ‘হেন উপদেশ তোমারে দিয়েছে সে কে,

আজও আছে রাক্ষস, হঠাৎ চেহারা দেখে

রামের সেবক বলে করে যদি শঙ্কা।”

রাক্ষসরাজ রাবণের রাজ্য ছিল লঙ্কা। রামের সেবক বলতে হনুমানদের বোঝানো হচ্ছে। রামের সঙ্গে লঙ্কায় গিয়ে তারা রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল।

৮৫ নং কবিতার একটু অংশ—

‘যোগ যদি করা যায় হিড়িম্বা কুন্তীতে,

সে কি ২ হতে পারে গণিতের গুণতিতে।

কাব্যগ্রন্থের নাম ‘খাপছাড়া’ আর তাই হিড়িম্বার সঙ্গে কুন্তী যোগ করা হচ্ছে। হিড়িম্বা হচ্ছেন মধ্যমপাণ্ডব ভীমের রাক্ষসবংশজাতা স্ত্রী। কুন্তী যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুনের মাতা এবং নকুল ও সহদেবের বিমাতা।

ছড়ার ছবি কাব্যে ‘বালক’ কবিতায় আছে—

”কঙ্কালী চাটুজ্জে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে,

বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে।

দ্রুত লয়ে আউরে যেত লবকুশের ছড়া,

থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া—”

লব এবং কুশ রামায়ণের রামচন্দ্রের দুই পুত্র। জীবনস্মৃতির কিশোরী চাটুজ্জের কথা মনে করেই সম্ভবত কবি এখানে কঙ্কালী চাটুজ্জেকে সৃষ্টি করেছেন।

‘ছবি-আঁকিয়ে’, কবিতা থেকে দুটি লাইন—

‘ওগো চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে,

এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চেশ্রবা ত্যেজে।’

সমুদ্রমন্থনে উত্থিত হয়েছিল অশ্বশ্রেষ্ঠ উচ্চৈঃশ্রবা।

সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থের ‘ভাগীরথী’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন—

‘পূর্বযুগে, ভাগীরথী, তোমার চরণে দিল আনি

মর্তর ক্রন্দন বাণী,

সঞ্জীবনী তপস্যায় ভগীরথ

উত্তরিল দুর্গম পর্বত,

নিয়ে গেল তোমা কাছে মৃত্যুবন্দী প্রেতের আহ্বান—

…..

মৃত্যু বিজয়ীর জটা হতে

অক্ষয় অমৃতস্রোতে

প্রতিক্ষণে নামিছ ধরায়।

ভগীরথের কাহিনী আছে রামায়ণে। কপিলমুনির অভিশাপে ভস্মীভূত পূর্বপুরুষদের উদ্ধারের জন্য ভগীরথ তপস্যা করে গঙ্গাকে মর্তে নিয়ে এসেছিলেন। শিবের এক নাম মৃত্যুঞ্জয়। গঙ্গা পতিত হয়েছিলেন মহাদেবের মস্তকে আর তারপর শিবের জটার মধ্য থেকে নির্গত হয়ে মর্তে অবতরণ করেছিলেন।

তপতী ‘রাজারানীর’ মেদবর্জিত নাট্যরূপ—রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘সর্বাঙ্গ সুন্দর’ নাটক। (আমার অবশ্য ‘রাজারানী’ পড়তেই বেশি ভালো লাগে)।

জালন্ধরের রাজা বিক্রমদেব রাণী সুমিত্রার প্রেমে সবকিছু বিস্মৃত হয়েছেন। রানীর এটা পছন্দ নয়—তিনি চান বিক্রম আগে রাজ্যের রাজা হয়ে উঠুন, তারপর তিনি সুমিত্রার স্বামী হোন। প্রজাদের মধ্যে অসন্তাোষ ধূমায়িত হয়ে উঠছে। এই নিয়ে রাজা এবং দেবদত্তের মদ্যে কথোপকথন। দেবদত্ত প্রাক্তন রাজপুরোহিত এবং রাজা ও রাজ্যের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী।

”বিক্রম। তবে মুখ খোলো। স্পষ্ট করেই বলো, প্রজারা আমার নামে কী বলছে।

দেবদত্ত। তারা বলছে, অন্তঃপুরের অবগুণ্ঠনতলে সমস্ত রাজ্যে আজ প্রদোষান্ধকার, রাজলক্ষ্মী রাজ্ঞীর ছায়ায় ম্লান।

বিক্রম। দুর্মুখ, প্রজারঞ্জনে আর-একবার সীতার নির্বাসন চাই নাকি?

দেবদত্ত। নির্বাসন তো তুমিই দিতে চাও তাঁকে অন্তঃপুরে, প্রজারা তাঁকে চায় সর্বজনের রাজসিংহাসনে। তাঁর হৃদয়ের সম্পূর্ণ অংশ তো তোমার নয়, এক অংশ প্রজাদের। শুধু কি তিনি রাজবধূ। তিনি যে লোকমাতা।

বিক্রম। দেবদত্ত, অংশ নিয়েই যত বিরোধ। ঐ নিয়েই কুরুক্ষেত্র।”

এই খণ্ডের অন্যত্র (সুলভ একাদশ খণ্ড, পৃ. ১৭৫) আছে যে রাজা রাজ্যে কন্দর্পদেবের পূজা চালু করতে চান। এতে মানুষের মনে বিভ্রান্তি।

”গৌরী। ত্রিবেদীঠাকুর, এও বুঝি তোমাদের জালন্ধরের সৃষ্টিছাড়া কীর্তি?

মীনকেতুর উৎসবে রক্তপাতের পালা?”…

ত্রিবেদী (বর্তমান রাজপুরোহিত)। সুন্দরী, জগতে এ পালা বার বার অভিনয় হয়ে গেছে। ত্রেতাযুগে এই পালায় একবার রাক্ষসে-বানরে মিলে অগ্নিকাণ্ড করেছিল। কলিযুগে তাদের বংশ বেড়েছে বৈ কমেনি।”

প্রজা-অসন্তোষ জায়গায় জায়গায় বিদ্রোহের রূপ নিয়েছে। রাজা ক্রুদ্ধ (সুলভ একাদশ খণ্ড, পৃ. ১৮৩)। রানীর উপরেও তিনি ক্রুদ্ধ কারণ রানী প্রজাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।

”বিক্রম। প্রতিহারী, মহারানী কোথায়। আমার আহ্বান এখনই তাঁকে জানাও গে তিনি শুনুন তাঁর দয়াদৃপ্ত প্রজারা আজ বিদ্রোহ করেছে—…,। কিন্তু তিনি ওদের বাঁচাতে পারবেন? বিচার সর্বাগ্রে তাকেই গ্রহণ করতে হবে।… নির্বাসন দিতে পারি নে ভাবছ? আমাদের বংশ রামচন্দ্রের, সূর্যবংশ।”

এরপরে অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অত্যাচারী সামন্তদের রাজা দমন না করায় রানী সুমিত্রা রাজ্য ছেড়ে চলে এসেছেন। ক্রুদ্ধ রাজা রাজ্যের সমস্যার সমাধান না করে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ছুটে আসছেন সুমিত্রাকে বন্দী এবং তাঁর সমর্থকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। দেবদত্তও বেরিয়েছেন পথে। তিনি রাজারানীর মিলন ঘটিয়ে রাজ্যে শান্তি আনতে চান—খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি রানীকে। রানীর শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন—অনেক খুঁজে দেবদত্ত তাঁর সন্ধান পেয়েছেন। রানীকে দেবদত্ত বলছেন—”কয়েকদিন থেকে দর্শনের চেষ্টা করেছিলুম, আমার চেহারা দেখে তোমার অনুচরদের মনে সংশয় ঘোচে না। অশোকবনে হনুমানকে দেখে রাক্ষসরা যেরকম সন্ধিগ্ধ হয়েছিল এদের সেই দশা।”

কালের যাত্রা গ্রন্থে তিনটি অংশ রয়েছে—রথের রশি, কবির দীক্ষা এবং পরিশিষ্ট অংশে রথযাত্রা।

এই সমস্ত লেখাগুলোতে রামায়ণ-মহাভারতের কিছু কথা আছে।

রথযাত্রায় এবারে রথ নড়ানো যায়নি। পুরোহিত-ব্রাহ্মণদের টানে রথ নড়েনি—মোটা দড়িটা পড়ে আছে মাটির উপরে। মেয়েরা পূজো দিচ্ছে—ঘি, দুধ, গঙ্গাজল ঢালছে আর মুখে বলছে ‘জয় দড়ি-নারায়ণের জয়। একজন নাগরিক বলছে তারা মহাকালনাথের নামে জয়ধ্বনি দিক। তাতে প্রথমা রমণী বলছে—

”কোথায় তোমাদের মহাকালনাথ? দেখি নে তো চক্ষে।

দড়ি-প্রভুকে দেখছি প্রত্যক্ষ—

হনুমানপ্রভুর লঙ্কা-পোড়ানো লেজখানার মতো—

কী মোটা, কী কালো, আহা দেখে চক্ষু সার্থক হল।”

এবারে সৈন্যরা এসেছে। তারাও খুব বিমর্ষ। রাজার সঙ্গে মিলে তারাও টেনেছিল রথের দড়ি কিন্তু নড়াতে পারেনি রথ। তার অর্থ ব্রাহ্মণদের পরে ক্ষত্রিয় বাহিনীরও মাথা হেঁট হল। এক নাগরিক সৈন্যদের বলছে—

”শোনো ভাই, আমার কথা।

কালের অপমান করেছি আমরা, তাই ঘটেছে এ-সব অনাসৃষ্টি।”

সে ব্যাখ্যা করে বলছে—

”ত্রেতাযুগে শূদ্র নিতে গেল ব্রাহ্মণের মান—

চাইলে তপস্যা করতে, এত বড়ো আস্পর্ধা—

সেদিনও অকাল লাগল দেশে, অচল হল রথ।

দয়াময় রামচন্দ্রের হাতে কাটা গেল তার মাথা,

তবে তো হল আপদশান্তি।”

এটি রামায়ণের কাহিনী। রামচন্দ্র তখন অযোধ্যাতে রাজা। প্রজার মনোরঞ্জনের জন্য রাম সীতাকে বর্জন করেছেন—সীতা বাল্মীকির আশ্রয়ে তাঁর তপোবনে আছেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণে আছে যে একদিন এক ব্রাহ্মণ পঞ্চমবর্ষীয় মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে রামের কাছে এসে এই অভিযোগ করলেন যে রাজার অনাচার বা পাপেই এই শিশুমৃত্যু ঘটেছে। ব্রাহ্মণের এই অভিযোগ শুনে রামচন্দ্র তাঁর সভাসদদের নিয়ে মিটিঙে বসলেন—রাজগুরু বশিষ্ঠ এলেন, এলেন দেবর্ষি নারদ এবং আরো অনেকে। সব শুনে দেবর্ষি নারদ বললেন যে ব্রাহ্মণপুত্রের অকালমৃত্যু রামচন্দ্রের দোষে হয়নি—কালের ধর্ম লংঘিত হয়েছে আর তাতেই এই মৃত্যু। ত্রেতাযুগে শূদ্রের তপস্যা করার অধিকার নেই, তবুও সেই জিনিস ঘটেছে। আর তাতেই এই দ্বিজপুত্রের অকালমৃত্যু। এই শুনে রাম খুঁজতে বেরোলেন এবং পেলেন তপস্যারত এক শূদ্রকে—তার নাম শম্বুক। তপস্যা করার অপরাধে রাম শম্বুককে হত্যা করলেন।

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের পর বৈশ্য অর্থাৎ বণিকপ্রধানেরাও এসেছিল রথের দড়ি টানতে কিন্তু রথ নড়াতে পারেনি। সবশেষে এসেছে শূদ্রেরা যারা এতকাল ছিল সকলের নীচে। মন্ত্রী এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারছেন। তিনি বুঝেছেন যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়েরা নয়, এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্রেরাই হবে এখন চালিকা-শক্তি। মন্ত্রী তাই শূদ্র দলপতিকে বলছেন—

”সর্দার, মহাকালের বাহন তোমরাই,

তোমরা নারায়ণের গরুড়।”

গরুড় নারায়ণের বাহন হতে স্বীকার করেছিলেন—সেই কাহিনী মহাভারতে আছে। এর আগের অধ্যায়ে সে কথা বলা হয়েছে।

শূদ্রদলের টানে রথ চলতে শুরু করেছিল। যারা ক্ষুব্ধ হল তাদেরই একজন, এক পুরোহিত কবিকে জিজ্ঞাসা করলো—

”তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান—

ওরাই কি দড়ির নিয়ম মেনে চলতে পারবে।”

কবি বলছেন—”পারবে না হয়তো।

একদিন ওরা ভাববে, রথী কেউ নেই, রথের সর্বময় কর্তা ওরাই।

দেখো কাল থেকেই শুরু করবে চেঁচাতে—

জয় আমাদের হাল লাঙল চরকা তাঁতের।

তখন এরাই হবেন বলরামের চেলা

হলধরের মাতলামিতে জগৎটা উঠবে টলমলিয়ে।”

বলরাম মহাভারতের চরিত্র। তিনি শ্রীকৃষ্ণের বৈমাত্রেয় বড়ভাই, হল বা লাঙল তাঁর অস্ত্র এবং যন্ত্র দুই-ই। তাঁর মদ্যপানও অপরিমিত।

কবি আরো বুঝিয়ে বলছেন যে অনিয়ন্ত্রিত শক্তি বিপর্যয় সৃষ্টি করে। কারণ তার মধ্যে ছন্দ নেই। শুভ শক্তির মধ্যে শুধু গায়ের জোর নয়, ছন্দের জোরও থাকতে হবে—

”আমরা মানি ছন্দ, জানি একঝোঁকা হলেই তাল কাটে।

মরে মানুষ সেই অসুন্দরের হাতে

চাল-চলন যার একপাশে বাঁকা,

কুম্ভকর্ণের মতো গড়ন যার বেমানান,

যার ভোজন কুৎসিত,

যার ওজন অপরিমিত।”

কুম্ভকর্ণ রামায়ণের চরিত্র-রাবণের ভাই।

পরিশিষ্ট অংশে ‘রথযাত্রা’ নামে একটি নাটিকা রয়েছে। সেখানেও রথ চলেনি, আর তাই নিয়ে সৈনিকদলের কয়েকজনের সঙ্গে নাগরিকদের কথা হচ্ছে। এর মধ্যে রামায়ণের কথা এসে পড়েছে।

”১ নাগরিক। দাদা, তোমাদের অস্ত্রের জোরে রথ চলবেও না, রথ ভাঙবেও না। গণৎকার কি গুনে বলেছে তা শোন নি বুঝি?

১ সৈনিক। কী বল তো।

১ নাগরিক। ত্রেতাযুগে একবার যে কাণ্ড ঘটেছিল, এখন তাই ঘটবে।

১ সৈনিক। আরে, ত্রেতাযুগে তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছিল।

১ নাগরিক। সে নয়, সে নয়।

২ সৈনিক। কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড?

১ নাগরিক। তারই কাছাকাছি। সেই যে শূদ্র তপস্যা করতে গিয়েছিল, মহাকাল তাতেই তো সেদিন ক্ষেপে উঠেছিলেন। তারপর রামচন্দ্র শূদ্রের মাথা কেটে তবে বাবাকে শান্ত করেছিলেন।

৩ সৈনিক। আজ তো সে ভয় নেই, আজ ব্রাহ্মণই তপস্যা ছেড়ে দিয়েছে, শূদ্রের তো কথাই নেই।”

পুরোহিতের সঙ্গে কবির কথা হচ্ছে—শূদ্র রথের দড়িতে টান দিয়েছে আর রথ চলতে শুরু করেছে, কথা তাই নিয়ে। রথের রশিতে কবি যে কথা বলেছিলেন, এখানেও সেই একই কথা বলছেন—

”পুরোহিত। আর তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান যে দড়ির নিয়ম সামলে চলতে পারবে।

কবি। হয়তো পারবে না। একদিন ভাববে ওরাই রথের কর্তা, তখনই মরবার সময় আসবে। দেখো-না, কালই বলতে শুরু করবে, আমাদেরই হাল লাঙল চরকা তাঁতের জয়। যে বিধাতা মানুষের বুদ্ধিবিদ্যা নিজের হাতে গড়েছেন, অন্তরে বাহিরে অমৃতরস ঢেলে দিয়েছেন, তাঁকে গাল পাড়তে বসবে। তখন এঁরাই হয়ে উঠবেন বলরামের চেলা, হলধরের মাতলামিতে জগৎটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।”

গল্পগুচ্ছ : এই একাদশ খণ্ডের গল্পগুচ্ছ অংশে অন্তত তেইশটি গল্প আছে। এই গল্পগুলির কোনো কোনোটিতে মাঝে-মধ্যে রামায়ণ মহাভারতের কথা বলা হয়েছে—সামান্য সামান্য কথা এবং সেই সব কথার সবগুলোই আগে কোথাও না কোথাও আলোচনা করা হয়েছে। যাই হোক, কথাগুলোর উল্লেখ নীচে করছি।

‘দুরাশা’ গল্পে গল্পকার মেঘ-কুয়াশা ঘেরা দার্জিলিঙে প্রায়ান্ধকার পরিবেশে বদাউনের এক নবাবপুত্রীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সিপাহীবিদ্রোহের সময়ে নবাবজাদী তাঁদের কেল্লাদার হিন্দুব্রাহ্মণ কেশরলালকে দেখেছিলেন। সেই ব্রাহ্মণসৈনিকের গৌরবর্ণ সুন্দর দেহ এবং তাঁর নিজধর্মের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা বিধর্মী নবাবপুত্রীকে মুগ্ধ করেছিল। যুদ্ধে আহত কেশরলাল নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন এবং নবাবনন্দিনী তাঁকে খুঁজে বেরিয়েছিলেন দীর্ঘকাল। তারপর দর্শন হয় কিন্তু সেই দর্শন তাঁর কাছে নিদারুণ মানসিক আঘাত নিয়ে এসেছিল। এই রকম অবস্থায় গল্পকথকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তখন নবাবপুত্রী তাঁর কেশরলালকে দেখার সময়ের কথা বলেছিলেন—

”আমার হিন্দু দাসীর নিকট হিন্দুধর্মের সমস্ত আচার ব্যবহার, দেবদেবীর সমস্ত আশ্চর্য কাহিনী, রামায়ণ-মহাভারতের সমস্ত অপূর্ব ইতিহাস তন্ন তন্ন করিয়া শুনিতাম,…”

‘অধ্যাপক’ গল্পের অকালকুষ্মাণ্ড গল্পকার একপাক্ষিকভাবে এক ষোড়শী তরুণীর প্রেমে পড়েছিল। এই কথা বলতে গিয়ে সে মহাভারতের দুষ্মন্ত (রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘দুষ্যন্ত’) শকুন্তলার কথা নিয়ে এসেছে।

”ভাবিয়াছিলাম যে, দুষ্যন্ত বড়ো বড়ো বাণ শরাসন বাগাইয়া রথে চড়িয়া বনে মৃগয়া করিতে আসিয়াছিলেন, মৃগ তো মরিল না, মাঝে হইতে দৈবাৎ দশমিনিট কাল গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া যাহা দেখিলেন, যাহা শুনিলেন, তাহাই তাঁহার জীবনের সকল দেখাশোনার সেরা হইয়া দাঁড়াইল। আমিও পেন্সিল কলম এবং খাতাপত্র উদ্যত করিয়া কাব্যমৃগয়ায় বাহির হইয়াছিলাম, বিশ্বপ্রেম বেচারা তো পলাইয়া রক্ষা পাইল, আর আমি দুইটি জামগাছের আড়াল হইতে যাহা দেখিবার তাহা দেখিয়া লইলাম।”

”কিন্তু, সে যে কুমারী এ-কথা আমাকে কে বলিল। আমার বহুপূর্ববর্তী প্রেমিক দুষ্যন্তকে পরিচয়লাভের পূর্বেই যিনি শকুন্তলা সম্বন্ধে আশ্বাস দিয়াছিলেন, তিনিই।”

”আমার শকুন্তলার তপোবনকুটিরটি গঙ্গার ধারেই ছিল। কুটিরটি ঠিক কন্বের কুটিরের মতো ছিল না,”

”কিরণকে (মেয়েটি) যখন দূর হইতে দেখিতাম তখন তাহাকে শকুন্তলা, দময়ন্তী প্রভৃতি বিচিত্র নামে এবং বিচিত্রভাবে জানিতাম, এখন ঘরের মধ্যে তাহাকে ‘কিরণ’ বলিয়া জানিলাম।”

”আমি ইন্দ্র, আমার উচ্চৈঃশ্রবার পথে কোনো বাধা দেখিতে পাই নাই।”

”দৃষ্টিদান’ গল্পে কুমুদিনী তার চোখের দৃষ্টি হারিয়েছিল স্বামীর গোঁয়ার্তুমিতে। কিন্তু স্বামীকে কোন দোষ না দিয়ে সে বলছে—”যখন পূজার ফুল কম পড়িয়াছিল তখন রামচন্দ্র তাঁহার চক্ষু উৎপাটন করিয়া দেবতাকে দিতে গিয়াছিলেন। আমার দেবতাকে আমার দৃষ্টি দিলাম—” রামচন্দ্রের এই কাহিনীটি সংক্ষেপে নীচে লিখছি—

রামচন্দ্র বানরসৈন্য নিয়ে লঙ্কাপুরীতে পৌঁছেছেন। রাবণবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু রাবণবধ হচ্ছে না। রাবণবধ না হলে সীতার উদ্ধারও সম্ভব নয়। রাবণবধ হবে কী করে—তিনি যে দেবী অম্বিকার আশ্রিত। রামচন্দ্রের প্রতি দেবীর কৃপাদৃষ্টি না পড়লে রাবণবধ হবে না। লোকাপিতামহ ব্রহ্মা রামচন্দ্রকে পরামর্শ দিলেন অকালবোধন করে দেবীর পূজা করতে। রামচন্দ্র সেই ব্যবস্থা করলেন। নীলপদ্ম দেবীর বড় প্রিয়। হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম যোগাড় করে দিলেন। কিন্তু পূজার সময় দেবী ছলনা করে একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। ১০৮টি নীলপদ্ম ছাড়া পূজা সম্পূর্ণ হবে না। একটি পদ্ম কম পড়াতে রঘুনাথ খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন। বিলাপ করতে করতে তিনি ভাবলেন—

”ভাবিতে ভাবিতে রাম করিলেন মনে।

নীলকমলাক্ষ মোরে বলে সর্বজনে।।

নয়নযুগল মোর ফুল্ল নীলোৎপল।

সঙ্কল্প করিব পূর্ণ বুঝিবে সকল।।

এক চক্ষু দিব আমি দেবীর চরণে।”

রাম যখন ধনুক-বাণ ধারণ করে নিজের চক্ষু উৎপাটনে উদ্যত, তখন দেবী কাত্যায়নী দর্শন দিয়ে তাঁকে নিবারণ করলেন।

‘সদর ও অন্দর’ গল্প থেকে একটুখানি অংশ নীচে উদ্ধৃত হল—

”সুভদ্রাহরণ গীতিনাট্য রিহার্শালশেষে প্রস্তুত। রাজবাটির অঙ্গনে তাহার অভিনয় হইল। রাজা স্বয়ং সাজিলেন কৃষ্ণ, বিপিন, সাজিলেন অর্জুন। আহা, অর্জুনের যেমন কণ্ঠ তেমনি রূপ।”

‘নষ্টনীড়’ গল্পে মহাভারতের অভিমন্যুর কথা আছে একজায়গায়। অমল মন্দাকিনীকে তার লেখা শোনাচ্ছে—

”সে পড়িতেছিল—অভিমন্যু যেমন গর্ভবাসকালে কেবল ব্যূহ-প্রবেশ করিতে শিখিয়াছিল ব্যূহ হইতে নির্গমন শেখে নাই—নদীর স্রোত সেইরূপ গিরিদরীর পাষাণ-জঠরের মধ্যে থাকিয়া কেবল সম্মুখেই চলিতে শিখিয়াছিল, পশ্চাতে ফিরিতে শেখে নাই।”

‘কর্মফল’ গল্পে মন্মথ নীতিনিষ্ঠ মানুষ। তার স্ত্রী বিধুমুখী তাকে বলছে—”ওগো, এতবড়ো সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির হলে সংসার চলে না।”

‘গুপ্তধন’ গল্পে অগস্ত্য মুনির নাম বলা হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রামের মুদি তাকে বলছে—”এককালে ওই বন শহর ছিল কিন্তু অগস্ত্য মুনির শাপে ওখানকার রাজা প্রজা সমস্তই মড়কে মরিয়াছে। লোকে বলে ওখানে অনেক ধনরত্ন আজও খুঁজিলে পাওয়া যায়”।

‘রাসমণির ছেলে’ গল্পে একজায়গায় অভিমন্যুর নাম বলা হয়েছে। ভবানীচরণ সংসারানভিজ্ঞ গোবেচারী একজন মানুষ। ‘ভবানীচরণের টাকা অভিমন্যুর ঠিক উল্টো, সে বাহির হইতেই জানে, প্রবেশ করিবার বিদ্যা তাহার জানা নাই।” এই গল্পেরই অন্যত্র রামায়ণের রামসীতার নাম বলা হয়েছে। ভবানীচরণের জাতিরা পৈতৃক উইল চুরি করে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিল। রাসমণির শিক্ষায় পুত্র কালীপদর মন বাস্তবধর্মী। দারিদ্র সত্বেও জীবনে একটু উন্নতি করবার আশায় পড়াশোনা করার জন্য সে কলকাতায় গিয়েছিল। ”তাহাদের পরিবারের এই প্রাচীন অন্যায়টা সম্বন্ধে তাহার মনে যথেষ্ট উত্তেজনা ছিল না। তবু সে পিতার কথায় সায় দিয়া গেল। সীতাকে উদ্ধার করিবার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ রাম যেমন লঙ্কায় যাত্রা করিয়াছিলেন, কালীপদর কলিকাতায় যাত্রাকেও ভবানীচরণ তেমনি খুব বড়ো করিয়া দেখিলেন—সে কেবল সামান্য পাশ করার ব্যাপার নয়—ঘরের লক্ষ্মীকে ঘরে ফিরাইয়া আনিবার আয়োজন।”

‘পণরক্ষা’ গল্পে বংশী দরিদ্র হলেও অমানুষিক পরিশ্রম করে ছোট ভাই রসিকের জন্য একটু টাকা জমানোর চেষ্টা করে কিন্তু রসিক কোন কাজকর্ম করতে চায় না। তার একটা সাইকেলের খুব শখ। অন্য একটা ছেলের সাইকেল নিয়ে সে চালানো শিখেছে। ”কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষ্ম সুদর্শনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের মতো মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া ছোটে। রামায়ণ-মহাভারতের সময় মানুষে কখনো কখনো দেবতার অস্ত্র লইয়া যেমন ব্যবহার করিতে পাইত এ যেন সেইরকম।”

ছন্দ গ্রন্থে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ মোটামুটি আছে।

ছন্দের অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের যুগের মহাকবি আদিকবি বাল্মীকিকে স্মরণ করেছেন—”আমাদের পুরাণে ছন্দের উৎপত্তির কথা যা বলেছে তা সবাই জানেন। দুটি পাখীর মধ্যে একটিকে যখন ব্যাধ মারলে তখন বাল্মীকি মনে যে ব্যথা পেলেন সেই ব্যথাকে শ্লোক দিয়ে না জানিয়ে তাঁর উপায় ছিল না। যে পাখীটা মারা গেল এবং আর যে একটি পাখী তার জন্যে কাঁদল তারা কোনকালে লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই নিদারুণতার ব্যথাটিকে তো কেবল কালের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না। সে-যে অনন্তের বুকে বেজে রইল। সেইজন্যে কবির শাপ ছন্দের বাহনকে নিয়ে কাল থেকে কালান্তরে ছুটতে চাইলে। হায় রে, আজও সেই ব্যাধ নানা অস্ত্র হাতে নানা বীভৎসতার মধ্যে নানা দেশে নানা আকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই আদিকবির শাপ শাশ্বতকালের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে রইল। এই শাশ্বতকালের কথাকে প্রকাশ করবার জন্যেই তো ছন্দ।” ”তমসাতীরে ক্রৌঞ্চবিরহিনীর দুঃখ কোনোখানেই নেই, কিন্তু আমাদের চিত্তের আত্মানুভূতির মধ্যে সেই বেদনার তার বাঁধা হয়েই আছে।’

কাশীরামদাসের মহাভারত যাঁরা পড়েছেন তাঁরা দুটি লাইনের সঙ্গে খুবই পরিচিত। লাইনদুটি কবির ভণিতা হিসাবে গ্রন্থের বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। লাইনদুটি হল—

‘মহাভারতের কথা অমৃতসমান।

কাশীরাম দাস কহে শুনে পূণ্যবান।।’

এই লাইন দুটি রবীন্দ্রনাথের ‘ছন্দ’ গ্রন্থের অন্তত ছয় জায়গায় উদ্ধৃত করা হয়েছে। ছন্দের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার সময় উদাহরণ হিসাবে লাইনদুটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ছন্দের অর্থ’ অংশে প্রথমে এর উল্লেখ আছে। কবি লিখেছেন—”পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির মতো কাব্যে ছন্দের আবর্তনের দুটি অঙ্গ আছে, একটি বড়ো গতি আর একটি ছোটো গতি। অর্থাৎ চাল এবং চলন। প্রদক্ষিণ এবং পদক্ষেপ।… প্রদক্ষিণের মাত্রার চেয়ে পদক্ষেপের মাত্রার পরেই ছন্দের বিশেষত্ব বেশী নির্ভর করছে। কেননা এই আট পদক্ষেপের আবর্তন সকল ছন্দেই চলে। বস্তুত এইটেই হচ্ছে অধিকাংশ ছন্দের চলিত কায়দা। যথা—

এও আট পদক্ষেপ।”

দ্বিতীয়বার কবি এই উদাহরণটি দেখিয়েছেন ‘ছন্দের মাত্রা’ অংশে। কবি লিখেছেন—’পৃথিবী চলছে, তার একটা ছন্দ আছে। অর্থাৎ তার গতিকে মাত্রাসংখ্যায় ভাগ করা যায়। ….

মহাভারতের কথা অমৃতসমান,

কাশীরামদাস কহে শুনে পুণ্যবান।

… এর মাত্রাসংখ্যা চোদ্দ। বলা বাহুল্য, এই চোদ্দ মাত্রা একটা অখণ্ড নিরেট পদার্থ নয়। এর মধ্যে জোড় দেখা যায়, সেই জোড় আটমাত্রার অবসানে, অর্থাৎ ‘মহাভারতের কথা’ একটুখানি দাঁড়িয়েছে যেখানে এসে। পয়ারে এই দাঁড়াবার আড্ডা দু জায়গায়, প্রথম আট ধনিমাত্রার পরে ও শেষার্ধের ছয় ধনিমাত্রার ও দুই যতিমাত্রার শেষে।… যতি-সমেত ষোলো মাত্রার পয়ারেও তেমনি আছে উত্তরভাগ ও দক্ষিণভাগ, কিন্তু সেই দুটি ভাগ সমগ্রেরই অন্তর্গত।

মহাভারতের বাণী

অমৃত সমান মানি,

কাশীরামদাস ভনে

শোনে তাহা সর্বজনে।

যদিও পয়ারের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ তবু একে অন্য ছন্দ বলব, কারণ এর পুনরাবর্তন আট মাত্রায়, ষোলো মাত্রায় নয়।” এইরকমভাবে এই গ্রন্থের অনেক স্থানে এই ভণিতাটির সাহায্যে ছন্দের অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এই গ্রন্থের নাম ছন্দ। এখানে রবীন্দ্রনাথ কাব্যে-সাহিত্যে ছন্দের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। কাজেই রামায়ণ-মহাভারতের যে প্রসঙ্গই এখানে আসুক না কেন, সেটি এসেছে ছন্দ আলোচনার উদাহরণ হিসাবে। আঠারো অক্ষরের দীর্ঘ পয়ার নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন—”ছোটো পয়ার আর বড়ো পয়ার, বাংলাকাব্যে এরা যেন ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবা আর ঐরাবত।” গদ্যছন্দ আলোচনায় কবি লিখেছেন—’গদ্যে প্রধানত অর্থবান শব্দকে ব্যূহবদ্ধ করে কাজে লাগাই, পদ্যে প্রধানত ধ্বনিমান শব্দকে ব্যূহবদ্ধ করে সাজিয়ে তোলা হয়। এ যেন বহু-ইন্ধনের হোমহুতাশন থেকে যাজ্ঞসেনীর আবির্ভাব।” দ্রৌপদীর অন্য এক নাম যাজ্ঞসেনী। ‘যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা’, তাই তিনি যাজ্ঞসেনী।

ছাপাখানার বহুল প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে ”সাহিত্যে শব্দসংকোচের প্রয়োজন চলে গেছে। আজ সরস্বতীর আসনই বলো, আর তাঁর ভাণ্ডারই বলো প্রকাণ্ড আয়তনের। সাবেক সাহিত্যের দুই বাহন, তার উচ্চৈঃশ্রবা আর তার ঐরাবত, তার শ্রুতি ও স্মৃতি, তারা নিয়েছে ছুটি।”

জে. ডি. এন্ডার্সনকে লিখিত একটি চিঠিতে কবি রামায়ণ-মহাভারতের কথা বলেছেন—”একটা কথা মনে রাখিতে হইবে, বাংলা রামায়ণ, মহাভারত … প্রভৃতি সমস্ত পুরাতন কাব্য গানের সুরে কীর্তিত হইত। এইজন্য শব্দের মধ্যে যাহা কিছু ক্ষীণতা ও ছন্দের মধ্যে যাহা কিছু ফাঁক ছিল সমস্তই গানের সুরে ভরিয়া উঠিত।”

ছন্দ নিয়ে অতিসচেতনতা অনাবশ্যক। দিলীপ কুমার রায়কে একটা চিঠিতে (১৩ মাঘ ১৩৩৯) কবি লিখেছেন—”তুমি যদি ছন্দরসিক হও তবে ছুরিকাঁচি ফেলে দিয়ে কানের পথ খোলসা রাখো যেখান দিয়ে বাঁশি মরমে প্রবেশ করে। গীতার একটি শ্লোকের আরম্ভ এই—

অপরং ভবতো জন্ম,

ঠিক তার পরবর্তী শ্লোক—

বহুনি মে ব্যতীতানি।

দ্বিতীয়টির সমান ওজনে প্রথমটি যদি লিখতে হয় তা হলে লেখা উচিৎ ‘অপারং ভাবতো জন্ম।’ কিন্তু যাঁরা এই ছন্দ বানিয়েছিলেন তাঁরা ছান্দসিকের হাটে গিয়ে নিক্তি নিয়ে বসেন নি।”

শ্রীশ্রীগীতার যে শ্লোকদুটির কথা এখানে বলা হয়েছে, সে শ্লোক দুটি গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে (জ্ঞানযোগঃ অধ্যায়) আছে। প্রথম শ্লোকটি অর্জুন বলছেন—

”অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।

কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি।।”

(আপনার জন্ম সূর্যের জন্মের পরে, তাহলে আপনি সূর্যকে প্রথমে বলেছিলেন এটা আমি কী করে জানবো? কৃষ্ণ বললেন—

‘বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।

তান্যহং বেদ সর্বানি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।”

(হে মহাবীর অর্জুন! আমার এবং তোমার বহুবার জন্ম হয়েছে, আমি সে সব জানি কিন্তু তুমি জান না।)

পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো গদ্যকবিতা হিসাবে চিহ্নিত। এই কবিতাসমূহের ছন্দ ইত্যাদি নিয়ে কবি ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন চিঠি। সেই চিঠির মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের কথা এসেছে (দেওয়ালি ১৩৩৯)। ”যে সংসারটা প্রতিদিনের, অথচ সেই প্রতিদিনকেই লক্ষ্মীশ্রী’ চিরদিনের করে তুলছে, যাকে চিরন্তনের পরিচয় দেবার জন্য বিশেষ বৈঠকখানায় অলংকৃত আয়োজন করতে হয় না তাকে কাব্যশ্রেণীতেই গণ্য করি। অথচ চেহারায় সে গদ্যের মতো হতেও পারে। তার মধ্যে বেসুর আছে, প্রতিবাদ আছে, নানাপ্রকার বিমিশ্রতা আছে, সেইজন্যেই চারিত্রশক্তি আছে। যেমন কর্ণের চারিত্রশক্তি যুধিষ্ঠিরের চেয়ে আনেক বড়ো। অথচ, একরকম শিশুমতি আছে যারা ধর্মরাজের কাহিনী শুনে অশ্রুবিগলিত হয়। রামচন্দ্র নামটার উল্লেখ করলুম না সে কেবল লোকভয়ে, কিন্তু আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আদিকবি বাল্মকি রামচন্দ্রকে ভূমিকাপত্তন স্বরূপে খাড়া করেছিলেন তার অসবর্ণতায় লক্ষ্মণের চরিত্রকে উজ্জ্বল করে আঁকবার জন্যেই, এমন কি হনুমানের চরিত্রকেও বাদ দেওয়া চলবে না। কিন্তু সেই একঘেয়ে ভূমিকাটা অত্যন্ত বেশী রঙফলানো চওড়া বলেই লোকে ঐটের দিকে তাকিয়ে হায় হায় করে। ভবভূতি তা করেন নি। তিনি রামচন্দ্রের চরিত্রকে অশ্রদ্ধেয় করবার জন্যেই কবিজনোচিত কৌশলে ‘উত্তররামচরিত’ রচনা করেছিলেন। তিনি সীতাকে দাঁড় করিয়েছেন রামভদ্রের প্রতি প্রবল গঞ্জনারূপে।” (কর্ণের চারিত্রশক্তি যুধিষ্ঠিরের চেয়ে অনেক বড়ো—এই মতের বিরুদ্ধ মত অনেক পাওয়া যাবে বলেই মনে হয়)।

দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র কথা মহাভারতে অল্প আছে। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে কবির লিখিত অন্য একটি চিঠিতে বক্তব্য এই যে, এই জাতের কবিতায় গদ্যকে কাব্য হতে হবে। গদ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কাব্য পর্য্যন্ত পৌঁছল না, এটা শোচনীয়। দেবসেনাপতি কার্তিকেয় যদি কেবল স্বর্গীয় পালোয়ানের আদর্শ হবেন তা হলে শুম্ভনিশুম্ভের চেয়ে উপরে উঠতে পারতেন না। কিন্তু, তাঁর পৌরুষ যখন কমনীয়তার সঙ্গে মিশ্রিত হয় তখনই তিনি দেবসাহিত্যে গদ্যকাব্যের সিংহাসনের উপযুক্ত হন।”

পারস্যে : এই রচনাটিতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ কিছু কিছু আছে।

পারস্যভ্রমণে কবি এরোপ্লেনে গিয়েছিলেন। উড়োজাহাজে যাত্রীপরিবহন সেইসময়ে এখনকার মতো জলভাত হয়ে যায়নি। এরোপ্লেন যুদ্ধের জন্যও ব্যবহৃত হয় এবং এর এই অকল্যাণকর রূপটিও রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল। তিনি লিখেছেন—”আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেননা, হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের ‘পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্বোপদেশও এই রকমের উড়োজাহাজ—অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্বনির্মিত উড়োজাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’।”

ভগবদগীতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বাল্যকাল থেকেই। ভগবদ্গীতার প্রতি তিনি সাধারণভাবে সশ্রদ্ধ। অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদার তাঁর ‘রবীন্দ্রসংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস’ গ্রন্থে একটা খুব সত্যি কথা লিখেছেন। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ গীতার সবকিছুই অভ্রান্তভাবে মেনে নেন নি। ‘ন হন্যতে হন্যমানে’—এই শব্দগুলো গীতার সাংখ্যযোগঃ, দ্বিতীয় অধ্যায়ের অন্তর্গত। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল—

”ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বাহভবিতা বা ন ভূয়ঃ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।”

এখানে আত্মার কথা বলা হয়েছে। এই আত্মার জন্ম বা মৃত্যু নাই। ইহা অজ, নিত্য, শাশ্বত ও চিরপুরাতন। দেহ হত হলেও আত্মা হত হয় না। এই মত রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত পছন্দ করেন নি বা গ্রহণ করেন নি, আর সেইজন্যই সম্ভবত তাঁর মন্তব্য এখানে তির্য্যক।

এই লেখার মধ্যে কবি পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা একটু বলেছেন—বলেছেন তুরস্ক-গ্রীসের বিরোধের কথা। কবি লিখলেন—”কালনেমি মামার লঙ্কাভাগের উৎসাহ তখনো খুব ঝাঁঝালো ছিল।”—কালনেমির কথা রামায়ণে আছে।

রাবণের শক্তিশেলে লক্ষ্মণ অচৈতন্য। গন্ধমাদন পর্বত থেকে রাত্রের মধ্যেই ঔষধের গাছ আনতে পারলে তাঁকে বাঁচানো যাবে, নইলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। হনুমান যাচ্ছেন ঔষধ আনতে। রাবণ ভাবছেন যে হনুমানকে যদি আটকে দেওয়া যায়, সে যদি ঔষধ আনতে না পারে, তা হলেই রাবণের অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। রাবণ একজন প্রবীণ নিশাচর রাক্ষস কালনেমিকে এই দায়িত্ব দিলেন। কালনেমি হনুমানের সামনে যেতে ভয় পাচ্ছে। রাবণ তাকে লোভ দেখালেন। কালনেমি যদি কাজটা করতে পারে তবে সমৃদ্ধিশালী লংকারাজ্য দুইভাগ করে একভাগ কালনেমিকে দেওয়া হবে। কালনেমি তখন এক বৃদ্ধ তপস্বীর ছদ্মবেশে হনুমানের পথে রইল। হনুমান এলে তাকে এক সরোবরে স্নান করতে পাঠালো। সেই সরোবরে খুব বড় একটা কুমীর থাকতো—সরোবরে জীবজন্তু গেলেই সে ধরে খেয়ে ফেলতো। হনুমানের ফিরতে একটু দেরী হচ্ছে। কালনেমি ভাবলো হনুমানকে কুমীরে খেয়েছে। কালনেমি তখন খুব আনন্দের সঙ্গে ভাবতে শুরু করলো লংকারাজ্যকে কীভাবে ভাগ করবে কোন অর্ধেক সে নেবে এইসব। এই হল কালনেমির লংকাভাগ।

পারস্যে কবি অতীতদিনের সম্রাট দরিয়ুসের ভগ্ন প্রাসাদ দেখতে গেছেন। দেখে তিনি বিস্মিত। ”যে বিদ্যার জোরে এই সকল গুরুভার অতি প্রকাণ্ড পাথরগুলি যথাস্থানে বসানো হয়েছিল সে বিদ্যা আজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত। দেখে মনে পড়ে মহাভারতের ময়দানবের কথা। বোঝা যায় বিশাল প্রাসাদ-নির্মাণের বিদ্যা যাদের জানা ছিল তারা যুধিষ্ঠিরের স্বজাতি ছিল না। হয়তো বা এই দিক থেকেই রাজমিস্ত্রি গেছে। যে পুরোচন পাণ্ডবদের জন্যে সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল সেও তো যবন।”—মহাভারত অনুসারে পুরোচন পাণ্ডবদের জন্য সুড়ঙ্গ বানায়নি। সে দুষ্ট দুর্যোধনের কথাতে জতুগৃহ বানিয়েছিল পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবার জন্য। পাণ্ডবদের বাঁচবার জন্য সুড়ঙ্গ বানিয়ে দিয়েছিলেন বিদুর প্রেরিত বিশ্বস্ত লোক।

ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মত অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ ‘আর্যবিজয়’ জাতীয় theory এখানে একটু বর্ণনা করেছেন। এই মত অনুসারে খ্রিষ্টজন্মের দেড়হাজার বৎসর পূর্বে এই তথাকথিত ‘আর্যবিজয়’ ঘটেছিল।

”একদা আর্যজাতির এক শাখা পর্বতবিকীর্ণ মরুবেষ্টিত পারস্যের উচ্চভূমিতে আশ্রয় নিলে। তখন কোনো এক অজ্ঞাতনামা সভ্যজাতি ছিল এখানে। তাদের রচিত যে-সকল কারুদ্রব্যের চিহ্নশেষ পাওয়া যায় তার নৈপুণ্য বিস্ময়জনক। বোধ করি বলা যেতে পারে মহেনজোদারো যুগের মানুষ। তাদের সঙ্গে এদের হাতের কাজের মিল আছে। এই মিল এশিয়ায় বহুদূর বিস্তৃত। মহেনজোদারোর স্মৃতিচিহ্নের সাহায্যে তৎকালীন ধর্মের যে চেহারা দেখতে পাই অনুমান করা যায়, সে বৃষভবাহন শিবের ধর্ম। রাবণ ছিলেন শিবপূজক, রাম ভেঙেছিলেন শিবের ধনু। রাবণ যে জাতের মানুষ সে জাতি না ছিল অরণ্যচর, না ছিল পশুপালক। রামায়ণগত জনশ্রুতি থেকে বোঝা যায়, সে জাতি পরাভূত দেশ থেকে ঐশ্বর্যসংগ্রহ করে নিজের রাজধানীকে সমৃদ্ধ করেছে এবং অনেকদিন বাহুবলে উপেক্ষা করতে পেরেছে আর্যদেবতা ইন্দ্রকে। সে জাতি নগরবাসী। মহেনজোদারোর সভ্যতাও নাগরিক। ভারতের আদিম আরণ্যক বর্বরতর জাতির সঙ্গে যোগ দিয়ে আর্যেরা এই সভ্যতা নষ্ট করে। সেদিনকার দ্বন্দ্বের একটা ইতিহাস আছে পুরাণকথায়, দক্ষযজ্ঞে।” (খ্রি. পূর্ব ১৫০০ বৎসর সময়ে আর্যবিজয়ের এই তত্ত্ব এখন অনেক পণ্ডিতই বিশ্বাস করেন না এবং তাঁদের কথাতে যুক্তি আছে। আর্যবিজয়ের তত্ত্ব ইউরোপীয়ানদের স্বার্থবুদ্ধিপ্রণোদিত।)

পর্সিপোলিস হচ্ছে ভগ্ন বিশাল প্রাসাদ যেটা রবীন্দ্রনাথ দেখতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় ভগ্ন-ঊরু ধূলিশায়ী মৃত দুর্যোধনের মতো ভগ্নাবশিষ্ট এই পর্সিপোলিস।

প্রাচীন পারস্যের সঙ্গে প্রাচীন ভারতবর্ষের একটু তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ এই লেখাতে। সেখানেও রামায়ণ-মহাভারতের কথা এসেছে। ”প্রাচীনকাল থেকে পারস্যে সাম্রাজ্য সৃষ্টি হয়ে এসেছে। মানুষের ইতিহাসে সব চেয়ে পুরাতন মহাসাম্রাজ্য সাইরাস স্থাপন করেন, তার পরেও দীর্ঘকাল পারস্যের ইতিহাসক্ষেত্রে সাম্রাজ্যিক দ্বন্দ্ব। তার প্রধান কারণ, পারস্যের চারিদিকেই বড়ো বড়ো প্রাচীন রাজশক্তির স্থান। হয় তাদের সকলকে দমন করে রাখতে হবে, নয় তাদের কেউ-না কেউ এসে পারস্যকে গ্রাস করবে। নানা জাতির সঙ্গে এই নিরন্তর দ্বন্দ্ব থেকেই পারস্যের ঐতিহাসিক বোধ, ঐতিহাসিক সত্তা এত প্রবল হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষ সমাজ সৃষ্টি করেছে, মহাজাতির ইতিহাস সৃষ্টি করেনি। আর্যের সঙ্গে অনার্যের দ্বন্দ্ব প্রধানত সামাজিক। অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক আর্য বহুসংখ্যক অনার্যের মাঝখানে পড়ে নিজের সমাজকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ রাষ্ট্রজয়ের নয়, সমাজ রক্ষার—সীতা সেই সমাজনীতির প্রতীক। রাবণ সীতাহরণ করেছিল, রাজ্যহরণ করেনি। মহাভারতেও বস্তুত সমাজনীতির দ্বন্দ্ব, এক পক্ষ কৃষ্ণকে স্বীকার করেছে, কৃষ্ণাকে পণ রেখে তাদের পাশাখেলা; অন্যপক্ষ কৃষ্ণকে অস্বীকার ও কৃষ্ণাকে করেছে অপমান। শাহনামায় আছে প্রকৃত ইতিহাসের কথা, রাষ্ট্রীয় বীরদের কাহিনী, ইরানীদের সঙ্গে তাতারীদের বিরোধ। তাতে ভগবদগীতার মতো তত্ত্বকথা বা শান্তিপর্বের মতো নীতি-উপদেশ প্রাধান্য পায়নি।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন