সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড

সপ্তদশ অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড)

সুলভ রচনাবলীর এই খণ্ডটির আয়তন বিশাল—মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা-৮৩০। প্রকাশক জানিয়েছেন যে কোনো কোনো গ্রন্থের উদবৃত্ত রচনা এবং অগ্রন্থিত রচনাসমূহ প্রকাশ করার যে পরিকল্পনা ছিল, সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে অগ্রন্থিত রচনাসমূহ এই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। এই অগ্রন্থিত রচনাগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত এবং সাময়িক পত্রে প্রকাশিত। এর মধ্যে অনেক লেখা আছে যেগুলো ১২৮১, ১২৮২ বা তার কাছাকাছি সময়ে রচিত—অর্থাৎ কবির বয়স যখন তেরো-চৌদ্দ বা পনেরো বছর, সেই সময়কার রচনা। কবি নিজে এই সমস্ত রচনাগুলোকে পুনঃপ্রকাশ বা সংরক্ষণের জন্য বিবেচনা করেননি। এই খণ্ডেরই গ্রন্থপরিচয় অংশে বলা হয়েছে যে সন্ধ্যাসঙ্গীত, প্রভাতসঙ্গীত, ছবি ও গান, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থগুলির প্রথম সংস্করণে মুদ্রিত কতকগুলি কবিতা রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বর্জন করেছিলেন। সেই বর্জিত কবিতাগুলিও এই খণ্ডে রাখা হয়েছে। ‘রাজনারায়ণ বসু’ নামক প্রবন্ধে (সুলভ ১৮; পৃ ১৩২) কবি লিখেছেন—”১৮ বছরের সময় ইংলণ্ড হইতে ফিরিয়া আমি ভারতীতে যাহা লিখিতাম, তাহা পাঠ করিয়া আমার লজ্জা হয়, তাহা এখনো ছাপার অক্ষরে আমার প্রতি চাহিয়া আমাকে লজ্জিত করে।” কবির অভিপ্রেত না হলেও যেহেতু রচনাগুলি রবীন্দ্ররচনাবলীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, আমিও সেগুলি থেকে আমার গ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয় অংশগুলো গ্রহণ করেছি।

এই খণ্ডের বিষয়সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না কারণ বিপুল সংখ্যক লেখা এই খণ্ডে স্থান পেয়েছে। সেই সমস্ত বিষয়সমূহের সূচীপত্রই সম্পূর্ণ নয়টি পৃষ্ঠা জুড়ে আছে। এই গ্রন্থের জন্য যেগুলো প্রয়োজন অর্থাৎ রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ—সেগুলোই এখানে উল্লেখ করবো।

‘অভিলাষ’ নামক কবিতাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে ১২৮১ বঙ্গাব্দে (কবির বয়স তখন ১২/১৩) প্রকাশিত হয়েছিল। এই কবিতা থেকে কিছু কিছু অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করছি—

৩২

 হৃদয়ের উচ্চাসনে বসি অভিলাষ

 মানবদিগকে লয়ে ক্রীড়া কর তুমি

 কাহারে বা তুলে দাও সিদ্ধির সোপানে

 কারে ফেল নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর কবলে।

৩৩

 কৈকেয়ী হৃদয়ে চাপি দুষ্ট অভিলাষ।

 চতুর্দশ বর্ষ রামে দিলে বনবাস,

 কাড়িয়া লইলে দশরথের জীবন,

 কাঁদালে সীতায় হায় অশোক-কাননে।

৩৪

 রাবণের সুখময় সংসারের মাঝে

 শান্তির কলস এক ছিল সুরক্ষিত

 ভাঙিল হঠাৎ তাহা ভাঙিল হঠাৎ

 তুমিই তাহার হও প্রধান কারণ।

৩৫

 দুর্যোধন-চিত্ত হায় অধিকার করি

 অবশেষে তাহারেই করিলে বিনাশ

 পাণ্ডুপুত্রগণে তুমি দিলে বনবাস

 পাণ্ডবদিগের হৃদে ক্রোধ জ্বালি দিলে।

৩৬

 নিহত করিলে তুমি ভীষ্ম আদি বীরে

 কুরুক্ষেত্র রক্তময় করে দিলে তুমি

 কাঁপাইলে ভারতের সমস্ত প্রদেশ

 পাণ্ডবে ফিরায়ে দিলে শূন্য সিংহাসন।

‘হোক ভারতের জয়’ কবিতাটিও মোটামুটি একই সময়ে প্রকাশিত। এই কবিতাতে কবি রামায়ণ মহাভারতের চরিত্রদের স্মরণ করেছেন—

 ”নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ—

 হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির

 ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর,

 অনন্ত জলধিতলে হয়েছে মগন।

 নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন,

 বিক্রম-আদিত্যরাজ,

 কালিদাস কবিরাজ,

 পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ।

 সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায়

 মিশাইয়া নিজদেহ

 অনন্ত ব্রহ্মের গেহ

 পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায়।”

‘হিন্দুমেলায় উপহার’ কবিতা থেকে কয়েকটি স্তবক উদ্ধৃত করি—

হিন্দুমেলায় উপহার

 হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন-‘পরি,

 গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি—

 কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,

 কাঁপায়ে নীহারশীতল বায়।

 ঝংকারিয়া বীণা কবিবর গায়,

 ‘কেন রে ভারত কেন তুই, হায়,

 আবার হাসিস! হাসিবার দিন।

 আছে কি এখনো এ ঘোর দুঃখে।

 দেখিতাম যবে যমুনার তীরে,

 পূর্ণিমা নিশীথে নিদাঘ সমীরে,

 বিশ্রামের তরে রাজা যুধিষ্ঠির,

 কাটাতেন সুখে নিদাঘ-নিশি।

১৬

 রাজা যুধিষ্ঠির (দেখেছি নয়নে)

 স্বাধীন নৃপতি আর্য-সিংহাসনে,

 কবিতার শ্লোকে বীণার তারেতে,

 সে-সব কেবল রয়েছে গাঁথা।

১৭

 শুনেছি আবার, শুনেছি আবার,

 রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার,

 শাসিতেন হায় এ-ভারতভূমি,

 আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!

এই কবিতাতে কবি বীণাহাতে ব্যাসদেবকে দিয়ে গান করিয়েছেন। মহাভারতে এর কোনো সমর্থন নেই।

কবিকৃত বিদেশী কবিদের কিছু কবিতার অনুবাদ রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে স্থান পেয়েছে। জার্মান কবি Heinrich Heine এর একটি কবিতার অনুবাদে দেখা যাচ্ছে সেখানে ঋষি বশিষ্ঠ ঋষি বিশ্বামিত্রের কথা আছে, তাঁদের বিবাদের কথা আছে—

বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!

 বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!

 দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে,

 তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে

 বশিষ্ঠের গাইটি নিলে কেড়ে।

 বিশ্বামিত্র তোমার মতো গোরু

 দুটি এমন দেখি নি বিশ্বে!

 নইলে একটি গাভী পাবার তরে

 এত যুদ্ধু এত তপিস্যে!

এই অনুবাদটি পড়ে খুব আশ্চর্য মনে হচ্ছিল। সন্দেহভঞ্জন হলো যখন গ্রন্থপরিচয় অংশটি পড়লাম। জার্মান ভাষায় কবিতাটির প্রথম লাইন সেখানে দেওয়া রয়েছে—

‘Den Konig Wiswamitra’

‘প্রবন্ধ’ অংশে প্রথম প্রবন্ধ ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী’ ১২৮৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত। নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ কাব্য, রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘অবসর সরোজিনী’ কাব্য এবং হরিশ্চন্দ্র নিয়োগীর ‘দুঃখসঙ্গিনী’ কাব্য—এই তিনখানি কাব্যের সমালোচনামূলক প্রবন্ধ এটি। এই প্রবন্ধে কবি এখনকার দিনে মহাকাব্য রচনার অসম্ভবতার কথা লিখেছেন—”গীতিকাব্য অকৃত্রিম, কেননা তাহা আমাদের নিজের হৃদয়কাননের পুষ্প; আর মহাকাব্য শিল্প, কেননা তাহা পর—হৃদয়ের অনুকরণমাত্র। এই নিমিত্ত আমরা বাল্মীকি, ব্যাস, হোমর, ভার্জিল প্রভৃতি প্রাচীনকালের কবিদিগের ন্যায় মহাকাব্য লিখিতে পারিব না; কেননা সেই প্রাচীনকালে লোকে সভ্যতার আচ্ছাদনে হৃদয় গোপন করিতে জানিত না, সুতরাং কবি হৃদয় প্রত্যক্ষ করিয়া সেই অনাবৃত হৃদয়-সকল সহজেই চিত্র করিতে পারিতেন।” ”এখনকার মহাকাব্যের কবিরা রুদ্ধহৃদয়ে লোকদের হৃদয়ে উঁকি মারিতে গিয়া নিরাশ হইয়াছেন ও অবশেষে মিল্টন খুলিয়া ও কখনো কখনো রামায়ণ ও মহাভারত লইয়া অনুকরণের অনুকরণ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত মেঘনাদবধে, বৃত্রসংহারে ওই সকল কবিদিগের পদছায়া স্পষ্টরূপে লক্ষিত হইয়াছে।” ”ভারতমাতা, যবন, উঠ, জাগো, ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি শুনিয়া শুনিয়া আমাদের হৃদয় এত অসাড় হইয়া পড়িয়াছে যে ও-সকল কথা আর আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে না।”

রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে মেঘনাদবধ কাব্যের একটি সমালোচনা সংকলিত হয়েছে। এই সমালোচনা ১২৮৪ সালের (কবির বয়স তখন ষোলো বৎসর) ভারতী পত্রিকাতে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ ও ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থের ষোড়শ অধ্যায়ের মেঘনাদবধ কাব্যের একটি সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২৮৯ সালে অর্থাৎ কবির একুশ বৎসর বয়সের সময়। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ১২৮৪ সালের লেখা সমালোচনার ব্যাপারে লিখেছেন—

এই সময়টাতেই বড়দাদাকে সম্পাদক করিয়া জ্যোতিদাদা ‘ভারতী’ পত্রিকা বাহির করিবার সংকল্প করিলেন। এই আর-একটা আমাদের পরম উত্তেজনার বিষয় হইল। আমার বয়স তখন ঠিক ষোলো। কিন্তু আমি ভারতীর সম্পাদকচক্রের বাহিরে ছিলাম না। ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস-কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ন হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ‘ভারতীতে’ প্রথম লেখা আরম্ভ করিলাম।….

ভারতীর পত্রে পত্রে আমার বাল্যলীলার অনেক লজ্জা ছাপার কালির কালিমায় অঙ্কিত হইয়া আছে। কেবলমাত্র কাঁচা লেখার জন্য লজ্জা নহে—উদ্ধত অবিনয়, অদ্ভুত আতিশয্য ও সাড়ম্বর কৃত্রিমতার জন্য লজ্জা।’

আগেই উল্লেখ করেছি যে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ মেঘনাদবধ কাব্য সম্বন্ধে তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। তবে বালক বয়সের লেখা হলেও এই সমালোচনাটি একেবারে হেলাফেলার নয়—কিছু কিছু সত্য কথাও আছে এর মধ্যে। উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন প্রবন্ধটি। যাই হোক, এখন এই প্রবন্ধ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশসমূহ উদ্ধৃত করছি।

”ভাবিলাম মহাকবি সাগরের কী একটি মহান গম্ভীর চিত্রই করিবেন, অন্য কোনো কবি এ সুবিধা ছাড়িতেন না। সমুদ্রের গম্ভীর চিত্র দূরে থাক, কবি কহিলেন—

 বহিছে জলস্রোত কলরবে

 স্রোতঃপথে জল যথা বরিষার কালে

যাঁহাদের কবি আখ্যা দিতে পারি তাঁহাদের মধ্যে কেহই এরূপ নীচ বর্ণনা করিতে পারেন না, তাঁহাদের মধ্যে কেহই বিশাল সমুদ্রের ভাব এত ক্ষুদ্র করিয়া ভাবিতে পারেন না। এই স্থলে পাঠকগণের কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য রামায়ণ হইতে একটি উৎকৃষ্ট সমুদ্র বর্ণনা উদধৃত করিয়া দিলাম।

”বিস্তীর্ণ মহাসমুদ্র প্রচণ্ড বায়ুবেগে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলিত হইতেছে। উহার কোথাও উদ্দেশ নাই, চতুর্দিক অবাধে প্রসারিত হইয়া আছে। উহা ঘোর জলজন্তুগণে পূর্ণ; প্রদোষকালে অনবরত ফেন বিকাশপূর্বক যেন হাস্য করিতেছে এবং তরঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনপূর্বক যেন নৃত্য করিতেছে। তৎকালে চন্দ্র উদিত হওয়াতে মহাসমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস বর্ধিত হইয়াছে এবং প্রতিবিম্বিত চন্দ্র উহার বক্ষে ক্রীড়া করিতেছে। সমুদ্র পাতালের ন্যায় ঘোর গভীরদর্শন; উহার ইতস্ততঃ তিমি তিমিঙ্গিল প্রভৃতি জলজন্তুসকল প্রচণ্ডবেগে সঞ্চরণ করিতেছে। স্থানে স্থানে প্রকাণ্ড শৈল; উহা অতলস্পর্শ; ভীম অজগরগণ গর্ভে লীন রহিয়াছে। উহাদের দেহ জ্যোতির্ময়, সাগরবক্ষে যেন অগ্নিচূর্ণ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। সমুদ্রের জলরাশি নিরবচ্ছিন্ন উঠিতেছে ও পড়িতেছে। সমুদ্র আকাশতুল্য এবং আকাশ সমুদ্রতুল্য; উভয়ের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য নাই; আকাশে তারকাবলী এবং সমুদ্রে মুক্তাস্তবক; আকাশে ঘনরাজি এবং সমুদ্রে তরঙ্গজাল; আকাশে সমুদ্র ও সমুদ্রে আকাশ মিশিয়াছে। প্রবল তরঙ্গের পরস্পর সংঘর্ষ নিবন্ধন মহাকাশে মহাভেরীর ন্যায় অনবরত ভীম রব শ্রুত হইতেছে। সমুদ্র যেন অতিমাত্র ক্রুদ্ধ; উহা রোষভরে যেন উঠিবার চেষ্টা করিতেছে এবং উহার ভীম গম্ভীর রব বায়ুতে মিশ্রিত হইতেছে।”

”বাল্মীকির রামায়ণে শোকের সময় রাবণের কীরূপ অবস্থা বর্ণিত আছে, এ স্থলে তাহা অনুবাদ করিয়া পাঠকদের গোচরার্থে লিখিলাম, ইহাতে পাঠকেরা দেখিবেন বাল্মীকির রাবণ হইতে মেঘনাদবধের রাবণের কত বিভিন্নতা।

অনন্তর হনুমান-কর্তৃক অক্ষ নিহত হইলে রাক্ষসাধিপতি মনঃসমাধানপূর্বক শোক সংবরণ করিয়া ইন্দ্রজিৎকে রণে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন। মনঃসমাধানপূর্বক শোক সংবরণ করার মধ্যে রাবণের যে মহান ভাব প্রকাশিত হইতেছে, তাহা যদি ইংরাজি-পুথি-সর্বস্ব-পাঠকেরা দেশীয় কবি বাল্মীকি লিখিয়াছেন বলিয়া বুঝিতে না পারেন, এইজন্য ইংরাজি কবি মিলটন হইতে তাহার আংশিক সাদৃশ্য উদধৃত করিয়া দিতেছি,

 Thrice he essay’d and thrice, in spite of scorn,

 Tears, such as angels weep, burst forth :–

ধূম্রাক্ষ নিহত হইয়াছেন শুনিয়া রাবণ ক্রোধে হতজ্ঞান হইয়া কৃতাঞ্জলিবদ্ধ সৈনাধ্যক্ষকে কহিলেন, অকম্পনকে সেনাপতি করিয়া শীঘ্র যুদ্ধবিশারদ ঘোরদর্শন দুর্ধর্ষ রাক্ষসগণ যুদ্ধার্থে নির্গত হউক।

অতঃপর ক্রুদ্ধ রাবণ অকম্পন হত হইয়াছেন শুনিয়া কিঞ্চিৎ দীনভাবে চিন্তা করিতে লাগিলেন। রাক্ষসপতি মুহূর্তকাল মন্ত্রীদিগের সহিত চিন্তা করিয়া ক্রোধে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে গৃহ হইতে নির্গত হইলেন।

অতিকায় নিহত হইলে তাহাদের বচন শুনিয়া শোকবিহ্বল, বন্ধুনাশবিচেতন, আকুল রাবণ কিছুই উত্তর দিলেন না। সেই রাক্ষসশ্রেষ্ঠকে শোকাভিপ্লুত দেখিয়া কেহই কিছু কহিলেন না; সকলেই চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন।

নিকুম্ভ ও কুম্ভ হত হইয়াছেন শুনিয়া রাবণ ক্রোধে প্রজ্বলিত অনলের ন্যায় হইলেন।

স্ববল ক্ষয় এবং বিরূপাক্ষবধ শ্রবণে রাক্ষসেশ্বর রাবণ দ্বিগুণ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন।”

তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে রামের চরিত্র যেভাবে মাইকেল চিত্রিত করেছেন তা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি। এই প্রসঙ্গে তিনি রামায়ণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন—

”বাল্মীকি রামের চরিত্র-বর্ণনাকালে বলিয়াছেন, ‘যম ও ইন্দ্রের ন্যায় তাঁহার বল, বৃহস্পতির ন্যায় তাঁহার বুদ্ধি, পর্বতের ন্যায় তাঁহার ধৈর্য। …. ক্ষোভের কারণ উপস্থিত হলেও তিনি ক্ষুব্ধ হন না। যখন কৈকেয়ী রামকে বনে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন, তখন ‘মহানুভব রাম কৈকেয়ীর এইরূপ কঠোর বাক্য শুনিয়া কিছুমাত্র ব্যথিত ও শোকাবিষ্ট হইলেন না। …. চন্দ্রের যেমন হ্রাস, সেইরূপ রাজ্যনাশ তাঁহার স্বাভাবিক শোভাকে কিছুমাত্র মলিন করিতে পারিল না! জীবন্মুক্ত যেমন সুখে দুঃখে একই ভাবে থাকেন, তিনি তদ্রূপই রহিলেন; ফলতঃ ঐ সময়ে তাঁহার চিত্তবিকার কাহারই অণুমাত্র লক্ষিত হইল না। ….. ঐ সময় দেবী কৌশল্যার অন্তঃপুরে অভিষেকমহোৎসব-প্রসঙ্গে নানাপ্রকার আমোদ প্রমোদ হইতেছিল। রাম তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়াও এই বিপদে ধৈর্যাবলম্বন করিয়া রহিলেন। জ্যোৎস্নাপূর্ণ শারদীয় শশধর যেমন আপনার নৈসর্গিক শোভা ত্যাগ করেন না; সেইরূপ তিনিও চিরপরিচিত হর্ষ পরিত্যাগ করিলেন না।’ সাধারণ্যে রামের প্রজারঞ্জন, এবং বীরত্বের ন্যায় তাঁহার অটল ধৈর্যও প্রসিদ্ধ আছে। বাল্মীকি রামকে মনুষ্যচরিত্রের পূর্ণতা অর্পণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন; তিনি তাঁহাকে কোমলতা ও বীরত্ব, দয়া ও ন্যায়, সহৃদয়তা ও ধৈর্য প্রভৃতি সকল প্রকার গুণের সামঞ্জস্য-স্থল করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আমরা উপরি-উক্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া মেঘনাদবধ কাব্যের রাম চরিত্র সমালোচনা করিব, অথবা যদি মাইকেল রাম-চরিত-চিত্রের আদিকবির অনুসরণ না করিয়া থাকেন, তবে তাহা কতদূর সংগত হইয়াছে আলোচনা করিয়া দেখিব।”

”বাল্যকাল হইতে রামের প্রতি আমাদের এরূপ মমতা আছে যে, প্রিয়ব্যক্তির মিথ্যা অপবাদ শুনিলে যেরূপ কষ্ট হয়, মেঘনাদবধ কাব্যে রামের কাহিনী পড়িলে সেইরূপ কষ্ট হয়।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, রামের চরিত্রে বীরত্ব ও কোমলত্ব সমানরূপে মিশ্রিত আছে। পৌরুষ এবং স্ত্রীত্ব উভয় একাধারে মিশ্রিত হইলে তবে পূর্ণ মনুষ্য সৃজিত হয়, বাল্মীকি রামকে সেইরূপ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। মেঘনাদবধে রামের কোমলতা অংশটুকু অপর্যাপ্তরূপে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু পাঠক, এমন একটি কথাও কি পাইয়াছেন, যাহাতে তাঁহাকে বীর বলিয়া মনে হয়? প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত কেবল বিভীষণের সহিত পরামর্শ করিয়াছেন, কেবল লক্ষ্মণের জন্য রোদন করিয়াছেন। ইন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে প্রেরণ করিবার সময় সংস্কৃত রামায়ণে রাম লক্ষ্মণকে কহিতেছেন—

বৎস, সেই ভয়াবহ দূরাত্মার (ইন্দ্রজিতের) সমস্ত মায়া অবগত আছি। সেই রাক্ষসাধম দিব্য অস্ত্রধারী, এবং সংগ্রামে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণকেও বিসংজ্ঞ করিতে পারে। সে রথে আরোহণপূর্বক অন্তরীক্ষে বিচরণ করে, এবং মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের ন্যায় তাহার গতি কেহ জ্ঞাত হইতে পারে না। হে সত্যপরাক্রম অরিন্দম, বাণ দ্বারা সেই মহাবীর রাক্ষসকে বধ করো।

হে বৎস, সংগ্রামে দুর্মদ যে বীর বজ্রহস্তকেও পরাজিত করিয়াছে, হনুমান, জাম্বুবান ও ঋক্ষসৈন্য দ্বারা পরিবৃত হইয়া যাও—তাহাকে বিনাশ করো। বিভীষণ তাহার অধিষ্ঠিত স্থানের সমস্ত অবগত আছেন, তিনিও তোমার অনুগমন করিবেন।

মূল রামায়ণে লক্ষ্মণের শক্তিশেল যেরূপে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা অনুবাদিত করিয়া নিম্নে উদধৃত করা গেল—

ভুজগরাজের জিহ্বার ন্যায় প্রদীপ্ত শক্তি রাবণ দ্বারা নিক্ষিপ্ত হইয়া মহাবেগে লক্ষ্মণের বক্ষে নিপতিত হইল। লক্ষ্মণ এই দূরপ্রবিষ্ট শক্তি দ্বারা ভিন্নহৃদয় হইয়া ভূতলে মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন। সন্নিহিত রাম তাঁহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া ভ্রাতৃস্নেহে বিষণ্ণ হইলেন ও মুহূর্তকাল সাশ্রুনেত্রে চিন্তা করিয়া ক্রোধে যুগান্তবহ্নির ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। ‘এখন বিষাদের সময় নয়’ বলিয়া রাম রাবণ-বধার্থ পুনর্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। ওই মহাবীর অনবরত শরবর্ষণপূর্বক রাবণকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন। শর-জালে আকাশ পূর্ণ হইল এবং রাবণ মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।

অনন্তর রাম দেখিলেন, লক্ষ্মণ শক্তিবিদ্ধ হইয়া শোণিত-লিপ্ত-দেহে সসর্প-পর্বতের ন্যায় রণস্থলে পতিত আছেন। সুগ্রীব, অঙ্গদ ও হনুমান প্রভৃতি মহাবীরগণ লক্ষ্মণের বক্ষঃস্থল হইতে বহু যত্নেও রাবণ-নিক্ষিপ্ত-শক্তি আকর্ষণ করিতে পারিলেন না। পরে রাম ক্রুদ্ধ হইয়া দুই হস্তে ওই ভয়াবহ শক্তি গ্রহণ ও উৎপাটন করিলেন, শক্তি উৎপাটন-কালে রাবণ তাঁহার প্রতি অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। কিন্তু মহাবীর রাম তাহা লক্ষ না করিয়া লক্ষ্মণকে উত্থাপনপূর্বক হনুমান ও সুগ্রীবকে কহিলেন, দেখো, তোমরা লক্ষ্মণকে পরিবেষ্টনপূর্বক এই স্থানে থাকো এবং ইহাকে অপ্রমাদে রক্ষা করো। ইহা চিরপ্রার্থিত পরাক্রম প্রকাশের অবসর। ওই সেই পাপাত্মা রাবণ, বর্ষার মেঘের ন্যায় গর্জনকরত আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে। হে সৈন্যগণ, আমার প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করো, আজ জগৎ অরাবণ বা অরাম হইবে। তোমরা কিছুতে ভীত হইয়ো না। আমি সত্যই কহিতেছি এই দুরাত্মাকে নিহত করিয়া রাজ্যনাশ, বনবাস, দণ্ডকারণ্যে পর্যটন ও জানকীবিয়োগ এই সমস্ত ঘোরতর দুঃখ ও নরক-তুল্য-ক্লেশ নিশ্চয় বিস্মৃত হইব। আমি যাহার জন্য এই কপিসৈন্য আহরণ করিয়াছি, যাহার জন্য সুগ্রীবকে রাজা করিয়াছি, যাহার জন্য সমুদ্রে সেতুবন্ধন করিলাম, সেই পাপ আজ আমার দৃষ্টিপথে উপস্থিত, তাহাকে আজ আমি সংহার করিব। এই পামর আজ দৃষ্টিবিষ ভীষণ সর্পের দৃষ্টিতে পড়িয়াছে, কিছুতেই ইহার নিস্তার নাই। সৈন্যগণ, এক্ষণে তোমরা শৈলশিখরে উপবিষ্ট হইয়া আমাদের এই তুমুল সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করো। আমি আজ এমন ভীষণ কার্য করিব যে, অদ্যকার যুদ্ধে গন্ধর্বেরা, কিন্নরেরা, দেবরাজ ইন্দ্র, চরাচর সমস্ত লোক, স্বর্গের সমস্ত দেবতারা রামের রামত্ব প্রত্যক্ষ করিয়া যতকাল পৃথিবী রহিবে ততকাল তাহা ঘোষণা করিতে থাকিবে।

এই বলিয়া মহাবীর রাম মেঘ হইতে জলধারার ন্যায় শরাসন হইতে অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। উভয়পক্ষের নিক্ষিপ্ত শর গতিপথে সংঘর্ষপ্রাপ্ত হওয়াতে একটি তুমুলশব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল।

এই তো রামায়ণ হইতে লক্ষ্মণের পতনদৃষ্টে রামের অবস্থা বর্ণনা উদধৃত করা গেল। এক্ষণে রামায়ণের অনুকরণ করিলে ভালো হইত কিনা, আমরা তৎসম্বন্ধে কিছু বলিতে চাহি না, পাঠকেরা তাহা বিচার করিবেন।”

রামায়ণ অনুসরণ করে কবি লক্ষ্মণের চরিত্র আলোচনা করেছেন—

”রামায়ণের লক্ষ্মণ একটি উদ্ধত উগ্র-যুবক, অন্যায় তাঁহার কোনোমতে সহ্য হয় না, তরবারির উপরে সর্বদাই তাঁহার হস্ত পড়িয়া আছে, মনে যাহা অন্যায় বুঝিবেন মুহূর্তে তাহার প্রতিবিধান করিতে প্রস্তুত আছেন, তাহার আর বিবেচনা করিবেন না, অগ্রপশ্চাৎ করিবেন না, তাহার ফল ভালো হইবে কি মন্দ হইবে তাহা জ্ঞান নাই, অন্যায় হইলে আর রক্ষা নাই। অল্পবয়স্ক বীরের উদ্ধত চঞ্চল হৃদয় রামায়ণে সুন্দররূপে চিত্রিত হইয়াছে। যখন দশরথ রামকে বনে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন ও রামও তাহাতে সম্মত হইলেন, তখন লক্ষ্মণ যাহা কহিতেছেন তাহার কিয়দংশ উদধৃত করিয়া দিলাম, ইহাতে পাঠকেরা কিয়ৎপরিমাণে রামায়ণে বর্ণিত লক্ষ্মণচরিত্র বুঝিতে পারিবেন—

‘রাম এইরূপ কহিলে মহাবীর লক্ষ্মণ সহসা দুঃখ ও হর্ষের মধ্যগত হইয়া অবনতমুখে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিলেন এবং ললাটপট্টে ভ্রূকুটি বন্ধনপূর্বক বিলমধ্যস্থ ভুজঙ্গের ন্যায় ক্রোধভরে ঘন ঘন নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহার বদনমণ্ডল নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিল এবং কুপিত সিংহের মুখের ন্যায় অতি ভীষণ বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর হস্তী যেমন আপনার শুণ্ড বিক্ষেপ করিয়া থাকে, তদ্রূপ তিনি হস্তাগ্র বিক্ষিপ্ত এবং নানাপ্রকার গ্রীবাভঙ্গি করিয়া বক্রভাবে কটাক্ষ নিক্ষেপপূর্বক কহিতে লাগিলেন, আর্য! ধর্মদোষ পরিহার এবং স্বদৃষ্টান্তে লোকদিগকে মর্যাদায় স্থাপন এই দুই কারণে বনগমনে আপনার যে আবেগ উপস্থিত হইয়াছে, তাহা নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক। ….আপনি অনায়াসেই দৈবকে প্রত্যাখ্যান করিতে পারেন, তবে কি নিমিত্ত একান্ত শোচনীয় অকিঞ্চিৎকর দৈবের প্রশংসা করিতেছেন? …. বীর! এই জঘন্য ব্যাপার আমার কিছুতেই সহ্য হইতেছে না! এক্ষণে আমি মনের দুঃখে যাহা কিছু কহিতেছি, আপনি ক্ষমা করিবেন। আরও আপনি যে ধর্মের মর্ম অনুধাবন করিয়া মুগ্ধ হইতেছেন, যাহার প্রভাবে আপনার মতদ্বৈধ উপস্থিত হইয়াছে আমি সেই ধর্মকেই দ্বেষ করি। আপনি কর্মক্ষম, তবে কি কারণে সেই স্ত্রৈণ রাজার ঘৃণিত অধর্মপূর্ণ বাক্যের বশীভূত হইবেন? এই যে রাজ্যাভিষেকের বিঘ্ন উপস্থিত হইল, বরদান ছলই ইহার কারণ; কিন্তু আপনি যে তাহা স্বীকার করিতেছেন না, ইহাই আমার দুঃখ; ফলতঃ আপনার এই ধর্মবুদ্ধি নিতান্তই নিন্দনীয় সন্দেহ নাই। ….. তাঁহারা আপনার রাজ্যাভিষেকে বিঘ্নাচরণ করিলেন, আপনিও তাহা দৈবকৃত বিবেচনা করিতেছেন, অনুরোধ করি, এখনই এইরূপ দুর্বুদ্ধি পরিত্যাগ করুন, এই প্রকার দৈব কিছুতেই আমার প্রীতিকর হইতেছে না। যে ব্যক্তি নিস্তেজ, নির্বীর্য, সেইই দৈবের অনুসরণ করে, কিন্তু যাঁহারা বীর, লোকে যাঁহাদিগের বল-বিক্রমের শ্লাঘা করিয়া থাকে, তাঁহারা কদাচই দৈবের মুখাপেক্ষা করেন না। যিনি স্বীয় পৌরুষপ্রভাবে দৈবকে নিরস্ত করিতে সমর্থ হন, দৈববলে তাঁহার স্বার্থহানি হইলেও অবসন্ন হন না। আর্য! আজ লোকে দৈববল এবং পুরুষের পৌরুষ উভয়ই প্রত্যক্ষ করিবে। অদ্য দৈব ও পুরুষকার উভয়েরই বলাবল পরীক্ষা হইবে। যাহারা আপনার রাজ্যাভিষেক দৈবপ্রভাবে প্রতিহত দেখিয়াছে, আজ তাহারাই আমার পৌরুষের হস্তে তাহাকে পরাস্ত দেখিবে। আজ আমি উচ্ছৃঙ্খল দুর্দান্ত মদস্রাবী মত্ত কুঞ্জরের ন্যায় দৈবকে স্বীয় পরাক্রমে প্রতিনিবৃত্ত করিব। পিতা দশরথের কথা দূরে থাকুক, সমস্ত লোকপাল, অধিক কি ত্রিজগতের সমস্ত লোকও আপনার রাজ্যাভিষেকে ব্যাঘাত দিতে পারিবে না। যাহারা পরস্পর একবাক্য হইয়া আপনার অরণ্যবাস সিদ্ধান্ত করিয়াছে, আজ তাহাদিগকেই চতুর্দশ বৎসরের নিমিত্ত নির্বাসিত হইতে হইবে। আপনার অনিষ্ট সাধন করিয়া ভরতকে রাজ্য দিবার নিমিত্ত রাজা ও কৈকেয়ীর যে আশা উপস্থিত হইয়াছে, আজ আমি তাহাই দগ্ধ করিব। যে আমার বিরোধী, আমার দুর্বিষহ পৌরুষ যেমন তাহার দুঃখের কারণ হইবে, তদ্রূপ দৈববল কদাচই সুখের নিমিত্ত হইবেক না।

…প্রতিজ্ঞা করিতেছি, আমিই আপনকার রাজ্য রক্ষা করিব, নতুবা চরমে যেন আমার বীরলোক লাভ না হয়। তীরভূমি যেমন মহাসাগরকে রক্ষা করিতেছে, তদ্রূপ আমি আপনার রাজ্য রক্ষা করিব। এক্ষণে আপনি স্বয়ংই যত্নবান হইয়া মাঙ্গলিক দ্রব্যে অভিষিক্ত হউন। ভূপালগণ যদি কোনো প্রকার বিরোধাচরণ করেন, আমি একাকীই তাঁহাদিগকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইব। আর্য! আমার যে এই ভুজদণ্ড দেখিতেছেন, ইহা কি শরীরের সৌন্দর্য সম্পাদনার্থ? যে কোদণ্ড দেখিতেছেন, ইহা কি কেবল শোভার্থ? এই খড়্গে কি কাষ্ঠবন্ধন, এই শরে কি কাষ্ঠভার অবতরণ করা হয়?—মনেও করিবেন না! এই চারিটি পদার্থ শত্রুবিনাশার্থই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এক্ষণে বজ্রধারী ইন্দ্রই কেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হউন না, বিদ্যুতের ন্যায় ভাস্বর তীক্ষ্মধার অসি দ্বারা তাঁহাকেও খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিব। হস্তীর শুণ্ড অশ্বের ঊরুদেশ এবং পদাতিক মস্তক আমার খড়্গে চূর্ণ হইয়া সমরাঙ্গন একান্ত গহন ও দুরবগাহ করিয়া তুলিবে। অদ্য বিপক্ষেরা আমার অসিধারায় ছিন্নমস্তক হইয়া শোণিতলিপ্ত দেহে প্রদীপ্ত পাবকের ন্যায় বিদ্যুদ্দামশোভিত মেঘের ন্যায় রণক্ষেত্রে নিপতিত হইবে। ….. যে হস্ত চন্দন লেপন, অঙ্গদ ধারণ, ধন দান ও সুহৃদবর্গের প্রতিপালনের সম্যক উপযুক্ত, অদ্য সেই হস্ত আপনার অভিষেক-বিঘাতকদিগের নিবারণ বিষয়ে স্বীয় অনুরূপ কার্য সাধন করিবে। এক্ষণে আজ্ঞা করুন আপনার কোন শত্রুকে ধন প্রাণ ও সুহৃদগণ হইতে বিযুক্ত করিতে হইবে? আমি আপনার চিরকিঙ্কর, আদেশ করুন, যেরূপে এই বসুমতী আপনার হস্তগত হয়, আমি তাহারই অনুষ্ঠান করিব।’

মূল রামায়ণে ইন্দ্রজিতের সহিত লক্ষ্মণের যেরূপ যুদ্ধবর্ণনা আছে তাহার কিয়দংশ আমরা পাঠকদিগের গোচরার্থে এইখানে অনুবাদ করিয়া দিতেছি।

‘তুমি এই স্থানে বয়স কাটাইয়াছ, তুমি আমার পিতার সাক্ষাৎ ভ্রাতা, সুতরাং পিতৃব্য হইয়া কীরূপে আমার অনিষ্ট করিতেছ? জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি ও সৌহার্দ্যও তোমার নিকট কিছুই নয়। তুমি ধর্মকেও উপেক্ষা করিতেছ। নির্বোধ! তুমি যখন স্বজনকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যের দাসত্ব স্বীকার করিয়াছ তখন তুমি শোচনীয় এবং সাধুগণের নিন্দনীয়। আত্মীয়স্বজনের সহবাস ও অপর নীচ ব্যক্তির আশ্রয় এই দুইটির যে কত অন্তর তুমি বুদ্ধিশৈথিল্যে তাহা বুঝিতেছ না। পর যদি গুণবান হয় এবং স্বজন যদি নির্গুণও হয় তবুও নির্গুণ স্বজন শ্রেষ্ঠ, পর যে সে পরই। স্বজনের প্রতি তোমার যেরূপ নির্দয়তা, ইহাতে তুমি জনসমাজে প্রতিষ্ঠা ও সুখ কদাচই পাইবে না। আমার পিতা গৌরব বা প্রণয়বশতই হউক তোমাকে যেমন কঠোর ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন তেমনই তো আবার সান্ত্বনাও করিয়াছেন। গুরু লোক প্রীতিভরে অপ্রিয় কথা বলেন বটে কিন্তু অবিচারিত মনে আবার তো সমাদরও করিয়া থাকেন। দেখো, যে ব্যক্তি সুশীল মিত্রের বিনাশার্থ শত্রুর বৃদ্ধি কামনা করে ধান্যগুচ্ছের সন্নিহিত শ্যামাকের ন্যায় তাহাকে পরিত্যাগ করা উচিত।’

ইন্দ্রজিৎ বিভীষণকে এইরূপ ভর্ৎসনা করিয়া ক্রোধভরে লক্ষ্মণকে কটূক্তি করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর লক্ষ্মণ রোষাবিষ্ট হইয়া নির্ভয়ে কহিলেন, রে দুষ্ট! কথা মাত্রে কখনো কার্যের পারগামী হওয়া যায় না, যিনি কার্যত তাহা প্রদর্শন করিতে পারেন তিনিই বুদ্ধিমান। তুই নির্বোধ, কোন দুষ্কর কার্যে কতকগুলি নিরর্থক বাক্য ব্যয় করিয়া আপনাকে কৃতকার্য জ্ঞান করিতেছিস। তুই অন্তরালে থাকিয়া রণস্থলে আমাদিগকে ছলনা করিয়াছিস। কিন্তু দেখ, এই পথটি তস্করের, বীরের নয়। এক্ষণে আত্মশ্লাঘা করিয়া কী হইবে, যদি তুই সম্মুখযুদ্ধে তিষ্ঠিতে পারিস, তবেই আমরা তোর বলবীর্যের পরিচয় পাইব। আমি তোরে কঠোর কথা কহিব না, তিরস্কার কি আত্মশ্লাঘাও করিব না অথচ বধ করিব। দেখ, আমার কেমন বল বিক্রম। অগ্নি নীরবে সমস্ত দগ্ধ করিয়া থাকেন এবং সূর্য নীরবে উত্তাপ প্রদান করিয়া থাকেন। এই বলিয়া মহাবীর লক্ষ্মণ ইন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।”

‘স্যাকসন জাতি ও অ্যাংলো স্যাকসন সাহিত্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কবি কিডমনের কথা বলতে গিয়ে বাংলায় রামায়ণ গ্রন্থের ভাবানুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার কথা স্মরণ করেছেন—”কৃত্তিবাস যেমন কথকতা শুনিয়া রামায়ণ লিখিতেন, তেমনি একজন কিডমনকে বাইবেল অনুবাদ করিয়া শুনাইত আর তিনি তাহা ছন্দে পরিণত করিতেন।”

কল্পনার জন্যও শিক্ষা আবশ্যক। সাহিত্যে ‘অশিক্ষিত পটুত্ব’ ব’লে কিছু হয় না। এই কথাটা বোঝাতে গিয়ে কবি তাঁর ‘বাঙালী কবি নয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন—”প্রাচীনকালে অনেক ভালো কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষ রূপে কবি। তুমি বলো দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন জাতির মধ্যে ভালো কবিতা আছে, যে জাতি সভ্য হয় নাই? যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল, তখন প্রাচীনকাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারও মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে?”

ঐ একই প্রবন্ধে কবি মন্তব্য করেছেন যে ‘কবিকঙ্কণচণ্ডী’ অত্যন্ত সরস কাব্য কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। কবি লিখেছেন যে ”কোথায় ভাঙা কুঁড়িয়া, তালপাতার ছাউনি আছে, কোথায় গাঁয়ের মোড়ল ভাঁড়ুদত্ত হাটে এসেছে, ঐসব মুকুন্দরাম খুব ভালো করে দেখেছেন।” ”কিন্তু এই হাট মাঠই কি কল্পনায় বিচরণের পক্ষে যথেষ্ট?…. যে কল্পনা রাম, সীতা, অর্জুন সৃষ্টি করে, তাহার পক্ষে কি কালকেতু, ভাঁড়ুদত্ত ও লহনা খুল্লনাই যথেষ্ট?”

দূরের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার চাইতেও উপস্থিত সমস্যা আমাদের কাছে বেশি মনে হয়। ‘সাহিত্য ও সভ্যতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”উপস্থিত বিষয় উপস্থিত ঘটনার মধ্যে যেমন নেশা, স্থায়ী বিষয়ের মধ্যে তেমন নেশা নাই। গোলদিঘির ধারে মারামারি বা চক্রবর্তী-পরিবারের গৃহবিচ্ছেদ যত তুমুল বলিয়া বোধ হয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও এমন মনে হয় না।”

এই খণ্ডে ধর্ম/দর্শন অংশে একটি প্রবন্ধ আছে ‘বেদান্তের বিদেশীয় ব্যাখ্যা’। রবীন্দ্রনাথ জার্মান অধ্যাপক ডঃ পল ডয়সেনের বেদান্ত দর্শন বিষয়ক একটি প্রবন্ধ অনুবাদ করেন এবং প্রবন্ধটির সমালোচনাও করেন। এই প্রবন্ধের ‘পরকালতত্ত্ব’ অংশে ভগবদগীতার কথা আছে।

”অধ্যাপক মহাশয় বলেন, লোকে বেদান্তকে ধর্মনীতি অংশে অঙ্গহীন বলিয়া দোষ দিয়া থাকে। বাস্তবিকও ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি কর্ম অপেক্ষা ধ্যানের প্রতি অধিকতর পক্ষপাতী। কিন্তু তথাপি তাঁহার মতে উচ্চতম এবং বিশুদ্ধতম ধর্মনীতিজ্ঞান বেদান্ত হইতে প্রসূত হইয়া থাকে। প্রতিবেশীকে আপনার মতো ভালোবাসা বাইবেলের মতে সর্বোচ্চ ধর্মনীতি—এবং কথাটিও সত্য বটে। কিন্তু যখন আমি সমস্ত সুখ-দুঃখ নিজের মধ্যেই অনুভব করি প্রতিবেশীর মধ্যে করি না তখন প্রতিবেশীকে কেনই বা নিজের মতো ভালোবাসিব? বাইবেলে ইহার কোনো উত্তর নাই, কিন্তু বেদের একটি কথায় ইহার উত্তর আছে—তত্ত্বমসি—তুমিও সে। বেদ বলেন তুমি ভ্রমক্রমে আপনাকে প্রতিবেশী হইতে স্বতন্ত্র বলিয়া জান, কিন্তু তোমরা এক। ভগবদগীতা বলিতেছেন—যিনি আপনার মধ্যে সকলকে দেখেন তিনি ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং, আপনার দ্বারা আপনাকে হিংসা করেন না। ইহাই সমস্ত ধর্মনীতির সার কথা এবং ইহাই ব্রহ্মজ্ঞানীর প্রতিষ্ঠাস্থল। তিনি আপনাকেই সর্ব বলিয়া জানেন এইজন্য কিছু প্রার্থনা করেন না; তিনি আপনাতেই সমস্ত উপলব্ধি করেন এইজন্য কাহারও ক্ষতি করেন না, তিনি মায়া দ্বারা পরিবৃত হইয়া জগতে বাস করেন অথচ মুগ্ধ হন না। অবশেষে যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন তাঁহার পক্ষে আর সংসার থাকে না; ন তস্য প্রাণা উৎক্রামন্তি। তিনি ব্রহ্ম এব সন ব্রহ্ম অপ্যোতি। তিনি নদীর ন্যায় ব্রহ্মসমুদ্রে প্রবেশ করেন।”

”ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং’—এটি শ্রীশ্রীগীতার কথা। সম্পূর্ণ শ্লোকটি ত্রয়োদশ অধ্যায়ে (ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগঃ) আছে—এখানে উদ্ধৃত করা হলো—

 ”সমং পশ্যন হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।

 ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্।।”

 (২৯ সংখ্যক শ্লোক)

অর্থাৎ—সর্বভূতে সমানভাবে ঈশ্বরকে সর্বত্র দর্শন করিয়া যিনি আত্মহিংসামুক্ত, তিনিই মুক্তিলাভ করেন।

এই প্রবন্ধে বেদব্যাসের নামও উল্লেখ করা হয়েছে তবে সেখানে বেদব্যাসের ব্রহ্মসূত্র গ্রন্থের কথা বলা হয়েছে।

এই খণ্ডের শিক্ষা অংশে ‘ছাত্রদের নীতিশিক্ষা’ প্রবন্ধে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তবে সে উল্লেখ মহাভারতের কোন কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত নয়। ”আজকাল আমাদের ছাত্রবৃন্দ নীতিশিক্ষা লইয়া অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। কমিটি, বক্তৃতা আর চটি বইয়ের এত ছড়াছড়ি আরম্ভ হইয়াছে যে, এই কয়টি উপাদানের মাহাত্ম্যে নীতির উৎকর্ষসাধন হইবার সম্ভাবনা থাকিলে অনতিবিলম্বে আজকালকার বালকগণ এক-একটি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির রূপে অভিব্যক্ত হইবে এরূপ আশা করা যাইতে পারে।”

এই প্রবন্ধে রামায়ণের মান্ধাতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মান্ধাতার কাল বললে অতি প্রাচীনকাল বোঝায়।

সমাজ অংশে নিন্দা-তত্ত্ব প্রবন্ধে যুধিষ্ঠিরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তবে তার সঙ্গে মহাভারতের কোন কাহিনীর যোগ নেই।

‘পারিবারিক দাসত্ব’ প্রবন্ধে মহাভারতের ভীষ্মের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ”যেখানে বাঙালী সেইখানেই পদাঘাত, সেইখানেই গালাগালি, সেইখানেই অপমান, এবং সেই অপমান পদাঘাতবৃষ্টির মধ্যে এই ক্ষীণশরীর সুন্দর বনবাসীদের শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের ন্যায় অবিকৃত মুখশ্রী।”

‘জুতা-ব্যবস্থা’ প্রবন্ধটি ১২৮৮ সালে অর্থাৎ কবির কুড়ি বৎসর বয়সকালে লিখিত হয়। কিন্তু বন্ধনীর মধ্যে লেখা হয়েছে—১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত। অর্থাৎ আরও প্রায় দশ বৎসর পর বাঙালী জাতির কিরকম অবস্থা হবে তারই কাল্পনিক চিত্র এটি। এই কৌতুক প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ গীতার শ্লোকাংশ ব্যবহার করেছেন—”স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মোভয়াবহঃ। জুতা খাইতে খাইতে মরাও ভালো, সে আমাদের স্বজাতি-প্রচলিত ধর্ম।”—গীতার এই শ্লোকটি নিয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

‘চেঁচিয়ে বলা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে প্রাণের সঙ্গে বা নিজের বিশ্বাস নিয়ে আমরা যখন কোন কথা বলি সে কথাটা এমনিতেই যথেষ্ট জোরালো হয়; কিন্তু যে কথার পিছনে বিশ্বাসের জোর থাকে না সেটা চেঁচিয়ে বলতে হয়, বিস্তর বলতে হয়। ”যেখানে সামান্য জমা-খরচের কথা হইতেছে, সেখানে ভাস্করাচার্য ও লীলাবতীর উল্লেখ না করিলে তাহার মনঃপূত হয় না; একজন ফিরিঙ্গি বালকের সহিত দেশীয় বালককে ঝগড়া করিতে দেখিলে তাহার ভীষ্ম দ্রোণ ভীমার্জুনকে পর্যন্ত মনে পড়ে।”

‘জিহ্বা আস্ফালন’ প্রবন্ধে কবি আবার ভীষ্মদ্রোণের কথা এনেছেন। ”একদল লোক আছেন, তাঁহারা কেবল উত্তেজিত ও উদ্দীপ্তই করিতেছেন, তাঁহাদের বক্তৃতায় বা লেখায় কোনো উদ্দেশ্য দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহারা কেবল বলিতেছেন, ‘এখনও চৈতন্য হইতেছে না, এখনও ঘুমাইতেছ? এই বেলা আলস্য পরিহার করো গাত্রোত্থান করো। আমাদের পূর্বপুরুষদের একবার স্মরণ করো—ভীষ্ম দ্রোণ গৌতম বশিষ্ঠ ইত্যাদি।’ কী করিতে হইবে বলেন না, কোন পথে যাইতে হইবে বলেন না, পথের পরিণাম কোথায় বলেন না, কেবল উত্তেজিতই করিতেছেন।”

‘ন্যাশনাল ফাণ্ড’ প্রবন্ধে কবি ‘আবেদন-নিবেদনপন্থীদের’ বিরুদ্ধে বলেছেন। ”যাঁহারা কেবলমাত্র অথবা প্রধানত গবর্মেন্টের কাছে ভালোরূপ ভিক্ষা করিয়া দেশের উন্নতি করিতে চান তাঁহারা কীরূপ দেশহিতৈষী! ….. দেশের লোককে তাঁহারা কেবলই জ্বলন্ত উদ্দীপনায় শাক্যসিংহ ব্যাস বাল্মীকি ও ভীষ্মার্জুনের দোহাই দিয়া গবর্মেন্টের কাছে ভিক্ষা চাহিতে বলিতেছেন।”

‘অকাল কুষ্মাণ্ড’ প্রবন্ধে আবার ভীষ্ম-দ্রোণের কথা। আজকাল খাতায় টুকিয়া রাখিতে হয়-অমুক দিন ঠিক অমুক সময়ে পকেট হইতে রুমালটি বাহির করিয়া দেশের জন্য কাঁদিব—তাহার পরদিন সাড়ে তিনটের সময় সহসা দেশের লোকের কুসংস্কার কিছুতেই বরদাস্ত করিতে পারিব না ও তাহাই লইয়া ঠিক তিনপোয়া-আন্দাজ রাগ ও একপোয়া-আন্দাজ দুঃখ করিব; বন্ধু যখন নিমন্ত্রণ করিতে আসেন—ঊনত্রিশে চৈত্র ১১টার সময় আমার ওখানে আহার করিতে আসিয়ো, তখন আমাকে বলিতে হয়—’না ভাই তাহা পারিব না। কারণ ত্রিশে চৈত্র আমার কাগজ বাহির হইবে, অতএব কাল ঠিক এগারোটার সময় দেশের অনৈক্য দেখিয়া আমার হৃদয় ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠিবে এবং ভীষ্ম দ্রোণ ও অশ্বত্থামাকে স্মরণ করিয়া আমাকে অতিশয় শোকাতুর হইতে হইবে।’

ঐ একই প্রবন্ধে রামায়ণের চরিত্র রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের কথা আছে—ভারত-জাগানো ভাবটা কিছু মন্দ নয়। বিশেষত যথার্থ সহৃদয়ের কাতর মর্মস্থান হইতে এই জাগরণ-সংগীত বাজিয় উঠিলে, আমাদের মতো কুম্ভকর্ণেরও এক মুহূর্তের জন্য নিদ্রাভঙ্গ হয়; নিদেন হাই তুলিয়া গা-মোড়া দিয়া পাশ ফিরিয়া শুইতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখন এমনি হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, ভারত-জাগানো কথাটা যেন মারিতে আসে! তাহার কারণ আর কিছুই নয়, আজ দশ-পনেরো বৎসর ধরিয়া অনবরত বালকে এবং স্ত্রীলোকে পর্যন্ত ভারত-জাগানোর ভান করিয়া আসিয়াছে— ভাবটা ফ্যাশন হইয়া পড়িল, সাহিত্য-দোকানদারেরা লোকের ভাব বুঝিয়া বাজারের দর দেখিয়া দিনে দিনে সপ্তাহে সপ্তাহে মাসে মাসে প্রচুর পরিমাণে আমদানি করিতে লাগিল; কাপড়ের একটা নতুন পাড় উঠিলে তাহার যেমন সহসা হাটে-ঘাটে-মাঠে অত্যন্ত প্রচলিত হইয়া ওঠে—ভারত-জাগানোটাও ঠিক তেমনি হইয়া উঠিল—কাজেই ঝট করিয়া তাহাকে মারা পড়িতে হইল। কুম্ভকর্ণকে যেমন ঢাকঢোল জগঝম্প বাজাইয়া উৎপীড়ন করিয়া কাঁচাঘুম হইতে জাগাইয়া তুলিল ও সে যেমন জাগিল, তেমনি মরিল। ইহার বিপুল মৃতদেহ আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রের কতটা স্থান জুড়িয়া পড়িয়া আছে একবার দেখো দেখি!

এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে বিশ্বামিত্র এবং তাঁর সৃষ্ট জগতের কথা বলা হয়েছে। বিশ্বকর্মা হচ্ছেন স্বর্গের প্রধান যন্ত্রবিদ—Chief Engineer। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অনেক জায়গাতেই বিশ্বকর্মাকে বিশ্ববিধাতা হিসাবে ধরে নিয়েছেন।

আমরা বিশ্বামিত্রের মতো গায়ের জোরে একটা মিথ্যাজগৎ নির্মাণ করিতে চাহিতেছি—কিন্তু ছাঁচে ঢালিয়া, কুমারের চাকে ফেলিয়া, মস্ত একতাল কাদা লইয়া জগৎ গড়া যায় না। বিশ্বামিত্রের জগৎ ও বিশ্বকর্মার জগৎ দুই স্বতন্ত্র পদার্থ—বিশ্বকর্মার জগৎ এক অচল অটল নিয়মের মধ্য হইতে উদ্ভিন্ন হইয়া বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহার আর বিনাশ নাই; তাহা রেষারেষি করিয়া, তর্জমা করিয়া, গায়ের জোরে বা খামখেয়াল হইতে উৎপন্ন হয় নাই; এই নিমিত্তই তাহার ভিত্তি অচলপ্রতিষ্ঠ। এই নিমিত্তই এই জগৎকে আমরা এত বিশ্বাস করি—এই নিমিত্তই এক পা বাড়াইয়া আর-এক পা তুলিবার সময় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে হয় না পাছে জগৎটা পায়ের কাছ হইতে হুস করিয়া মিলাইয়া যায়। আর বিশ্বামিত্রের ঘরগড়া জগতে যে হতভাগ্য জীবদিগকে বাস করিতে হইত তাহাদের অবস্থা কী ছিল একবার ভাবিয়া দেখো দেখি। তাহারা তপ্ত ঘিয়ে ময়দার চক্র ছাড়িয়া দিয়া ভাবিতে বসিত ইহা হইতে লুচি হইবে কি চিনির শরবত হইবে! এক গাছ ফল দেখিলেও তাহাদের গাছে উঠিয়া পাড়িতে প্রবৃত্তি হইত না, সন্দেহ হইত পাছে হাত বাড়াইলেই ওগুলো পাখি হইয়া উড়িয়া যায়। তাহাদের বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা মিলিয়া তর্ক করিত পায়ে চলিতে হয় কি মাথায় চলিতে হয়; কিছুই মীমাংসা হইত না। প্রতিবার নিশ্বাস লইবার সময় দুটো-তিনটে ডাক্তার ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিতে হইত, নাকে নিশ্বাস লইব কি কানে নিশ্বাস লইব, কেহ বলিত নাকে, কেহ বলিত কানে। অবশেষে একদিন ঠিক দুপুরবেলা যখন সেখানকার অধিবাসীরা ক্ষুধা পাইলে খাইতে হয় কি উপবাস করিতে হয়, এই বিষয়ে তর্ক করিতে করিতে গলদঘর্ম হইয়া উঠিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ বিশ্বামিত্রের জগৎটা উল্টোপাল্টা, হিজিবিজি, হ—য—ব—র—ল হইয়া, ভাঙিয়া চুরিয়া ফাটিয়া, বোমার মতো আওয়াজ করিয়া, হাউয়ের মতো আকাশে উঠিয়া সবসুদ্ধ কোনখানে যে মিলাইয়া গেল, আজ পর্যন্ত তাহার ঠিকানাই পাওয়া গেল না। তাহার কারণ আর কিছু নয়—সৃষ্ট হওয়ায় এবং নির্মিত হওয়ায় অনেক তফাত। বিশ্বামিত্রের জগৎটা যে অন্যায় হইয়াছিল তা বলিবার জো নাই—তিনি এই জগৎকেই চোখের সুমুখে রাখিয়া এই জগৎ হইতেই মাটি কাটিয়া লইয়া তাঁহার জগৎকে তাল পাকাইয়া তুলিয়াছিলেন, এই জগতের বেলের খোলার মধ্যে এই জগতের কুলের আঁটি পুরিয়া তাঁহার ফল তৈরি করিয়াছিলেন; অর্থাৎ এই জগতের টুকরো লইয়া খুব শক্ত শিরীষের আঠা দিয়া জুড়িয়াছিলেন সুতরাং দেখিতে কিছু মন্দ হয় নাই। আমাদের এই জগৎকে যেমন নিঃশঙ্কে আকাশে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, এ আপনার কাজ আপনি করিতেছে, …… আপনি বাড়িয়া উঠিতেছে, কোনো বালাই নাই, বিশ্বামিত্রের জগৎ সেরূপ ছিল না; তাহাকে ভারি সন্তর্পণে রাখিতে হইত, রাজর্ষির দিন-রাত্রি তাহাকে তাঁহার কোঁচার কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া বেড়াইতেন, এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারিতেন না। কিন্তু তবু তো সে রহিল না। তাহার কারণ, সে মিথ্যা।

‘হাতে কলমে’ প্রবন্ধে কবি আড়ম্বরপ্রিয়তাকে, যারা মুখসর্বস্ব তাদেরকে সমালোচনা করেছেন। ”আর আড়ম্বর ধরাকেও সরা জ্ঞান করে। ছোটো কাজের কথা হইলেই তিনি বলিয়া বসেন, ‘ও পরে হইবে’। তিনি বলেন, এক-পা এক-পা করিয়া চলাও তো আপামরসাধারণ সকলেই করিয়া থাকে, তবে উৎকট লম্ফ-প্রয়োগ যদি বল তবে তিনিই তাহা সাধন করিবেন এবং ইতিহাসে যদি সত্য হয় তবে ত্রেতাযুগে তাঁহারই এক পূর্বপুরুষ তাহা সাধন করিয়াছিলেন। তিনি এমন সকল কাজে হস্তক্ষেপ করেন যাহা ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর’ শাস্ত্রসম্মত, ইতিহাসসম্মত, যাহা কনস্টিট্যুশনল। সমস্ত ভারতবর্ষের যত দুঃখ-দুর্দশা, দুর্ঘটনা, দুর্নাম আছে সমস্তই তিনি বালীর লাঙ্গুলপাশবদ্ধ দশাননের ন্যায় এক পাকে জড়াইয়া একই কালে ভারতসমুদ্রের জলে চুবাইয়া মারিবেন, কিন্তু ভারতবর্ষের কোনো-একটা ক্ষুদ্র অংশের কোনো-একটা কাজ সে তাঁহার দ্বারা হইয়া উঠিবে না। বিপুলা পৃথিবীতে জন্মিয়া ইঁহার আর কোনো কষ্ট নাই, কেবল স্থানাভাবের জন্য কিঞ্চিৎ কাতর আছেন। বামনদেব তিনপায়ে তিন লোক অধিকার করিয়াছিলেন, কিন্তু তদাপেক্ষা বামন এই বামনশ্রেষ্ঠের জিহ্বার মধ্যে তিনটে লোক তিনটে বাতাসার মতো গলিয়া যায়।

বালী কিষ্কিন্ধ্যার মহাবলপরাক্রান্ত রাজা, সুগ্রীবের দাদা। লঙ্কার রাজা রাবণও যুদ্ধে বালীর নিকট পরাস্ত হয়েছিলেন। বামন দেবমাতা অদিতির পুত্র। স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি অদিতির গর্ভে বামনরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

কবি শ্লেষ করে বলেছেন যে এইসব আড়ম্বরপ্রিয় ‘ভীমার্জুনের প্রপৌত্র’ গণেরা স্বদেশের হিত করবার প্রেরণায় স্বদেশীদের হিতসাধনের সময় পান না। কবি বলছেন—”স্বজাতির প্রতি যাঁহাদের আন্তরিক প্রাণের টান নাই, তাহাদের স্বদেশ জিনিষটা কী জানিতে কৌতূহল হয়। সেটা কি রাম লক্ষ্মণ সীতা হনুমান ও রাবণ বিবর্জিত রামায়ণ? না কলার আত্যন্তিক অভাববিশিষ্ট কলার কাঁদি। না লাঙ্গুলের সম্পর্কশূন্য কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড!”

রবীন্দ্রনাথের একটি বড় প্রবন্ধ ‘একটি পুরাতন কথা’। প্রবন্ধটি ১২৯১ সালে প্রকাশিত অর্থাৎ কবির বয়স যখন কিঞ্চিদধিক তেইশ বৎসর। এই লেখাটির কারণে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে মনোমালিন্য বা তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এই প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্র কিছু লেখেন এবং তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ আবার ‘কৈফিয়ৎ’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেটি ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালের পৌষ সংখ্যাতে। ‘একটি পুরাতন কথাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—”আমাদের দেশের প্রধান লেখক (বঙ্কিমচন্দ্র) প্রকাশ্যভাবে অসংকোচে নির্ভয়ে অসত্যকে সত্যের সহিত একাসনে বসাইয়াছেন, সত্যের পূর্ণ সত্যতা অস্বীকার করিয়াছেন, এবং দেশের সমস্ত পাঠক নীরবে নিস্তব্ধভাবে শ্রবণ করিয়া গিয়াছেন। ….. লেখক মহাশয় একটি হিন্দুর আদর্শ কল্পনা করিয়া বলিয়াছেন, তিনি ‘যদি মিথ্যা কহেন তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণপূর্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয়-অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন’। কোনোখানেই মিথ্যা সত্য হয় না, শ্রদ্ধাস্পদ বঙ্কিমবাবু বলিলেও হয় না স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলিলেও হয় না।”

এখানে কবি মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের কথাও বলেছেন যদিও তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বঙ্কিমচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ নন। এখানে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি, সেটি অত্যন্ত জটিল এবং দুর্জ্ঞেয় একটি বিষয়। মহাভারতের অনেক জায়গাতেই এই বিষয়ে আলোচনা আছে। বনপর্বে ঋষি মার্কণ্ডেয় বলছেন—

 ”বহু লোকে বিপর্য্যস্তং দৃশ্যতে দ্বিজসত্তম।

 ধর্মযুক্তমধর্মঞ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে।”

অর্থাৎ—জগতে বহুতর বিপরীত দেখা যায় এবং ধর্ম্মকার্যকে অধর্ম বলিয়া ও অধর্মকার্যকে ধর্ম বলিয়া মনে হয়। এক্ষেত্রে কি করণীয়? ধর্মব্যাধ নিজেই তার উত্তর দিচ্ছেন—

 ”যদ্ভূতহিতমত্যন্তং তৎ সত্যমিতি ধারণা।

 বিপর্য্যয়কৃতো ধর্মঃ পশ্য ধর্মস্য সূক্ষ্মতাম্।।”

এইসব ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার এরকম অর্থ করতে হবে যে, যা প্রাণীগণের পক্ষে হিতকর তাই সত্য এবং যা প্রাণীগণের পক্ষে অহিতকর তাই মিথ্যা। এরকম ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করলেই ধর্ম হয়।

মহাভারতের কর্ণপর্বে কথাপ্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন—

 ”সত্যস্ব বচনং সাধু ন সত্যদ্বিদ্যতে পরম্।

 তত্ত্বেনৈব সুদুর্জ্ঞেয়ং পশ্য সত্যমনুষ্ঠিতম্।।

 ভবেৎ সত্যমবক্তব্যং বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।

 যত্রানৃতং ভবেৎ সত্যং সত্যঞ্চাপ্যনৃতং ভবেৎ।।”

সত্য কথা বলা তো অবশ্যই ভালো কারণ সত্যের চাইতে ভালো আর কিছু নেই। কিন্তু সত্যকে যথার্থরূপে জানা অতি শক্ত—অতি দুর্জ্ঞেয়। যেখানে মিথ্যা বললে সত্য কথা বলার মত উপকারী হয় এবং সত্য বললে মিথ্যা বলার মতো অপকারী হয়ে পড়ে, সেখানে সত্য না বলে মিথ্যা বলাই উচিৎ। এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ একটি কাহিনী শুনিয়েছেন—”কৌশিক নামে এক বহুশ্রুত তপস্বিশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ গ্রামের অনতিদূরে নদীগণের সঙ্গমস্থানে বাস করিতেন। ঐ ব্রাহ্মণ সর্বদা সত্যবাক্য প্রয়োগরূপ ব্রত অবলম্বনপূর্ব্বক তৎকালে সত্যবাদী বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। একদা কতকগুলি লোক দস্যুভয়ে ভীত হইয়া বনমধ্যে প্রবেশ করিলে দস্যুরাও ক্রোধভরে যত্নসহকারে সেই বনে তাহাদিগকে অন্বেষণ করত সেই সত্যবাদী কৌশিকের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিল, হে ভগবন! কতকগুলি ব্যক্তি এইদিকে আগমন করিয়াছিল, তাহারা কোন পথে গমন করিয়াছে, যদি আপনি অবগত থাকেন, তাহা হইলে সত্য করিয়া বলুন। কৌশিক দস্যুগণকর্তৃক এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া সত্যপালনার্থে তাহাদিগকে কহিলেন, কতকগুলি লোক এই বৃক্ষ লতা ও গুল্ম পরিবেষ্টিত অটবীমধ্যে গমন করিয়াছে। তখন সেই ক্রুরকর্ম্মা দস্যুগণ তাহাদের অনুসন্ধান পাইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ ও বিনাশ করিল। সুক্ষ্মধর্মানভিজ্ঞ সত্যবাদী, কৌশিকও সেই সত্যবাক্যজনিত পাপে লিপ্ত হইয়া ঘোর নরকে নিপতিত হইলেন” (কালীপ্রসন্ন সিংহকৃত অনুবাদ-২য় খণ্ড পৃ-৩৮১)। এখানে মিথ্যা সত্যের চাইতে বেশি উপকারী হতে পারতো।

ঐ একই প্রবন্ধে কবি বাল্মীকির নাম উল্লেখ করেছেন—”এখন আমাদের সাহিত্য সম্বন্ধে অনেকেই বলিয়া থাকেন, বই বিক্রী করিয়া টাকা হয় না, এ সাহিত্যের মঙ্গল হইবে কি করিয়া। ….. বই লিখিয়া টাকা নাই হইল! যে না লিখিয়া থাকিতে পারিবে না সেই লিখিবে, যাহার টাকা না হইলে চলে না সে লিখিবে না। …… বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করিয়া কি কুবেরের ভাণ্ডার লুঠ করিয়াছিলেন? যদি তাঁহার কুবের ভাণ্ডার থাকিত রামায়ণ রচনার প্রতিবন্ধক দূর করিতে তিনি সমস্ত ব্যয় করিতে পারিতেন।”

‘সত্য’ প্রবন্ধে (১২৯২) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”মিথ্যাচারীরা বলিয়া থাকে, আত্মানাং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি। অর্থাৎ আপনার কাছে আর কিছুই সত্য নহে, দারা সত্য নহে, দারার প্রতি কর্তব্য সত্য নহে।”

সংস্কৃত শব্দ কয়টি মহাভারতের উদ্যোগপর্বের একটি শ্লোকের অংশ, সম্পূর্ণ শ্লোকটি হলো—

 ”আপদর্থে ধনং রক্ষেদ্দারান রক্ষেদ্ধনৈরপি।

 আত্মানং সততং রক্ষেদ্দারৈরপি ধনৈরপি।।”

কালীপ্রসন্ন সিংহ এই শ্লোকটির অনুবাদ করেছেন এইরকম—

”আপৎকালের নিমিত্ত ধন রক্ষা করিবে, ধনদ্বারা স্ত্রীকে রক্ষা করিবে এবং স্ত্রী ও ধন উভয়দ্বারা সতত আত্মাকে রক্ষা করিবে।” ”মনুসংহিতা, হিতোপদেশ, চাণক্যশ্লোক প্রভৃতি জায়গাতেও এই শ্লোকটি আছে। চাণক্যশ্লোকের আলোচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদার এরকম মন্তব্য করেছেন যে কাপুরুষতার চূড়ান্ত নিদর্শন এই শ্লোকটির প্রতিই কবির সর্বাপেক্ষা বিরাগ ছিল। মহাভারতে বহু কথার সঙ্গে এই কথাটি বিদূর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন। দুর্যোধনের বশীভূত ধৃতরাষ্ট্র যখন কিছুতেই পাণ্ডবদেরকে তাঁদের প্রাপ্য রাজ্যাংশ ফেরৎ দিচ্ছিলেন না তখন বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে অনেক নীতি উপদেশ দিয়েছিলেন। সমস্ত প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে শুধুমাত্র একটা/দুটো লাইন বললে অনেক সময়ই ভুল সংকেত যায়। আর সাধারণভাবে এটাই সত্য যে সমস্ত জীবের কাছে নিজের প্রাণ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় (কিছু কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। বলা হয় যে মাতৃস্নেহের তুল্য আর কিছু হয় না, তবুও তো কাগজ খুললেই মাঝে মধ্যেই দেখা যায় মা তার সদ্যোজাত শিশুকে ডাস্টবিনে ফেলে চলে গিয়েছে বা নিজের সন্তানকে বিক্রী করে দিয়েছে। শ্লোকটি হয়তো আদর্শ হিসাবে গণ্য হওয়া উচিৎ নয়, কিন্তু এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আর মহাভারত সমাজের বাস্তব চিত্র।

‘হিন্দুদিগের জাতীয় চরিত্র ও স্বাধীনতা’ প্রবন্ধের প্রথমেই একটা ধারণার কথা বলা হয়েছে যে সমতলভূমির লোকেরা সাধারণত অলস হয়ে থাকে। তারা ”সকল দুরূহ [প্রশ্নেরই] চটপট একটা মীমাংসা বাহির করিয়া ফেলে। কিছুতেই যখন পাওয়া যায় না তখন একটা গল্প তৈরী করে। পঞ্চপাণ্ডব যে এক স্ত্রী বিবাহ করিল সেটা যেমনি বুঝিতে একটু গোল বাধে অমনি তাহার গল্প বাহির হয়।”

আমাদের জীবন বাঁধা নিয়মে চলে। এটাই বিস্তৃত করতে গিয়ে কবি লিখেছেন—”আমরা হাড়গোড় ভাঙিয়া সকলেই সমান নির্বীষ নির্জীব….শান্তিসুখ উপভোগ করিতেছি। আর যাহা হৌক বা না হৌক কোনো উপদ্রব নাই। ভাবনা-চিন্তা তর্ক [বিতর্কের বদলে] শাস্ত্র আছে এবং পঞ্জিকা আছে। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে পরস্পর পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিয়া মিলিয়া দুই হাতে শাস্ত্রখণ্ড অবলম্বন করিয়া ভবস্রোতে নির্বিঘ্নে ভাসিয়া যাইতেছি, সন্তরণ শিক্ষা করিবার আবশ্যক নাই, ব্যক্তিগত বল সঞ্চয় করিবার প্রয়োজন নাই। কেবল যে প্রয়োজন নাই তাহা নহে, তাহা অন্যায়; একজন নিজের বলে আর-একজনের চেয়ে বেশি মাথা তুলিতে চেষ্টা করিলে আমাদের শান্তিপূর্ণ নিয়মবদ্ধ সমাজের মধ্যে আগাগোড়া একটা গোল উপস্থিত হয়। এইজন্য যখন রাম-রাজত্ব শূদ্রক তপশ্চরণাদি দ্বারা আপনাকে ….. পদবীতে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন তখন দয়াময় রামচন্দ্র সমাজের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তাঁহার শিরশ্ছেদন করিলেন। সীতার বনবাস আমাদের এই অতি-নিয়মবদ্ধ সমাজতন্ত্রের একটি দৃষ্টান্তস্থল বলিয়া বোধ হয়। ব্যক্তিগত ন্যায়পরতাও এই সমাজশাসনে পিষ্ট হইয়া যায়-অর্থাৎ ব্যক্তি একেবারেই কেহ নহে…..পূর্বেই বলিয়াছি ইহা হইতে এই প্রমাণ হয় যে আমাদের জাতীয় অভিজ্ঞতা হইতে এই স্থির হইয়াছে যে, সামান্য এমন কোনো বিষয় নাই যাহাতে আমরা আপনাকে বিশ্বাস করিতে পারি। খাওয়া শোওয়া সে বিষয়েও হে শাস্ত্র তুমি বলিয়া দাও আমাদিগকে কী করিতে হইবে। কোথাও কিছু যদি ছিদ্র থাকে আমাদের আলস্যবশত ক্রমেই সেটা বাড়িয়া উঠিবে। সীতার প্রতি প্রমাণহীন সন্দেহ সেটা একটা ছিদ্র কিন্তু সেটা যদি রাখিতে দাও তবে আমাদের (জাতীয়) স্বভাবগুণে ক্রমে সেটা মস্ত হইয়া উঠিবে।”

ইতিহাস অংশে ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ প্রবন্ধে কবি গীতার কথা স্মরণ করেছেন—”ঐতিহাসিক চিত্রের সূচনা লিখিবার জন্য সম্পাদক-দত্ত অধিকার পাইয়াছি, আর কোনো প্রকারের অধিকারের দাবি রাখি না। কিন্তু আমাদের দেশের সম্পাদক ও পাঠকবর্গ লেখকগণকে যেরূপ প্রচুর পরিমাণে প্রশ্রয় দিয়া থাকেন তাহাতে অনধিকার প্রবেশকে আর অপরাধ বলিয়া জ্ঞান হয় না।”

”যাঁহারা কর্মকর্তা, গীতা তাঁহাদিগকে উপদেশ দিয়াছেন যে : কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। অর্থাৎ, কর্মেই তোমার অধিকার আছে, ফলে কদাচ নাই। আমরা কর্মকর্তা নহি। আমাদের একটা সুবিধা এই যে, কর্মে আমাদের অধিকার নাই, কিন্তু ফলে আছে। সম্পাদক-মহাশয় যে অনুষ্ঠান ও যেরূপ আয়োজন করিয়াছেন তাহার ফল বাংলার, এবং আশা করি অন্য দেশের, পাঠকমণ্ডলী চিরকাল ভোগ করিতে পারিবেন।”

‘বিজ্ঞান’ অংশে সামুদ্রিক জীব প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”বাল্মীকি সমুদ্র-বর্ণনায় লিখিয়াছেন যে, ‘স্থানে স্থানে প্রকাণ্ড শৈল। উহা অতলস্পর্শ। ভীম অজগরগণ গর্ভে লীন রহিয়াছে; উহাদের দেহ জ্যোতির্ময়। সাগর-বক্ষে যেন অগ্নি-চূর্ণ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে।’ এখনকার নাবিকেরাও সমুদ্র ভ্রমণ করিবার সময়, সময়ে সময়ে দেখিতে পান, সাগরবক্ষে যেন অগ্নিচূর্ণ প্রক্ষিপ্ত রহিয়াছে। দাঁড়ের আঘাতে এবং তরঙ্গের গতিতে তাহাদের উজ্জ্বলতা আরও বৃদ্ধি হইয়া উঠে। সমস্ত সমুদ্র যেন একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড বলিয়া বোধ হয়। কখনো ভাঁটা পড়িয়া গেলে দেখা যায় পর্বত-দেহে, সামুদ্রিক তৃণসমূহে ও তীর-ভূমিতে যেন আগুন লাগিয়াছে। বাল্মীকির সময়ে যাহা লোকে অজগরের দেহজ্যোতি বলিয়া মনে করিত, বৈজ্ঞানিকেরা অসংখ্য ক্ষুদ্র কীটের দেহ নিঃসৃত ফসফরিয় আলোক বলিয়া জানিয়াছেন। সেই কীটদিগের নাম নক্তালোকা।”

বিবিধ অংশে ‘গোঁফ এবং ডিম’ রচনাতে কবি লিখেছেন—ব্যাসদেবের যে অত্যন্ত বৃহৎ এক জোড়া গোঁফ ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই; কারণ যে গোঁফে তিনি বৃহৎ মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের আঠারোটা ডিম নয়টা নয়টা করিয়া দুইদিকে অদৃশ্যভাবে ঝুলাইয়া বহন করিয়া বেড়াইতেন সে বড়ো সাধারণ গোঁফ হইবে না। ক্রমওয়েল সাহেবের গোঁফে ইংলন্ডের বর্তমান পার্লামেন্টের ডিম যখন ঝুলিত, তখন কেহ দেখিতে পায় নাই, আজ দেখো, সেই পার্লামেন্ট ডিম ভাঙিয়া মস্ত ডাগর হইয়া ক্যাঁক ক্যাঁক করিয়া বেড়াইতেছে। পিতামহ ব্রহ্মার আর কিছু থাক না থাক, চার মুখে চার জোড়া খুব বড়ো বড়ো গোঁফ অনন্ত আকাশ আচ্ছন্ন করিয়াছিল, ইহা কি কেহ অস্বীকার করিতে পারিবে? নহিলে চরাচর কোথায় থাকিত।’

এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯০ সালে অর্থাৎ কবির বাইশ বছর বয়সে। এটি অল্পবয়সের চটুল রচনা বলে মনে হয়।

আর একটি হাল্কা রচনাতে—ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবনী-কবি রামচন্দ্রের কথা বলেছেন। ”রামকে রাঘব বলা হইয়া থাকে। রঘুর তিন পুরুষ পরে রাম।”

১২৯২ সালে রচিত ‘বর্ষার চিঠি’তে কবি ব্যাস বশিষ্ঠের কথা মনে করেছেন। ”কিন্তু আজকাল ব্যাঙ ডাকে না কেন? …..ছেলেবেলায় মেঘের ঘটা হলেই ব্যাঙের ডাক শুনতুম—কিন্তু আজকাল পাশ্চাত্য সভ্যতা এল, সার্বভৌমিকতা এবং ‘ঊনবিংশ শতাব্দী’ এল, পোলিটিকল অ্যাজিটেশন, খোলা ভাঁটি এবং স্বায়ত্তশাসন এল, কিন্তু ব্যাঙ গেল কোথায়? হায় হায়, কোথায় ব্যাস বশিষ্ঠ, কোথায় গৌতম শাক্যসিংহ, কোথায় ব্যাঙের ডাক!”

ভারতী এবং সাধনা পত্রিকাদুটিতে কবি অনেক গ্রন্থ সমালোচনা করেছিলেন এখনকার ভাষায় যাকে বুক রিভিউ বলা হয়। এই রিভিউ করা গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষের রচিত রাবণ-বধ দৃশ্যকাব্য, অভিমন্যুবধ দৃশ্যকাব্য, সীতার বনবাস দৃশ্যকাব্য, লক্ষ্মণবর্জন দৃশ্যকাব্য; শ্রীপ্রসাদদাস গোস্বামীর অভিমন্যুসম্ভব কাব্য; শ্রীদেবেন্দ্রনাথ সেনের ঊর্মিলাকাব্য এবং শ্রীগৌরগোবিন্দ রায় মহাশয়ের রচিত শ্রীমদ্ভগবদগীতা—সমন্বয় ভাষ্য। যেহেতু গ্রন্থগুলি রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীভিত্তিক, তাই রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের উল্লেখ বারেবারেই করা হয়েছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচিত সব গ্রন্থগুলিই তাঁর প্রশংসা পেয়েছে। কবির লেখা থেকে একটু উদ্ধৃত করছি—

”এমন-কি, মাইকেল তাঁহার মেঘনাদবধ কাব্যে শূর-শ্রেষ্ঠ লক্ষ্মণ দেবকে কী বেরঙে আঁকিয়াছেন।—ইহা কি সামান্য পরিতাপের বিষয় যে, যে লক্ষ্মণকে আমরা রামায়ণে শৌর্যের আদর্শ স্বরূপ মনে করিয়াছিলাম—যে লক্ষ্মণকে আমরা কেবলমাত্র মূর্তিমান ভ্রাতৃস্নেহ ও নিঃস্বার্থ উদারতা ও বিক্রম বলিয়া ভাবিয়া আসিতেছি, সেই লক্ষ্মণকে মেঘনাদবধ কাব্যে একজন ভীরু স্বার্থপূর্ণ—”’গোঁয়ার” মাত্র দেখিলে আমাদের বুকে কী আঘাতই লাগে! কেনই বা তা হইবে না? কল্পনার আদর্শভূত একটি পশুপক্ষীরও একগাছি লোমের হানি করিলেও আমাদের সহ্য হয় না। সুখের বিষয় এই যে শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র আমাদের প্রাণে সে আঘাত দেন নাই। কি তাঁহার অভিমন্যু-বধ, আর কি তাঁহার রাবণ-বধ—এই উভয় নাটকেই তিনি রামায়ণ ও মহাভারতের নায়ক ও উপনায়কদের চরিত্র অতি সুন্দর রূপে রক্ষা করিতে পারিয়াছেন। ইহা সামান্য সুখ্যাতির কথা নহে। এক খণ্ড কয়লার মধ্যে সূর্যের আলোক তো প্রবেশই করিতে পারে না, কিন্তু এক খণ্ড স্ফটিকে শুদ্ধ যে সূর্যকিরণ প্রবেশ করিতে পারে এমন নয়, আবার স্ফাটিক্য গুণে সেই কিরণ সহস্র বর্ণে প্রতিফলিত হইয়া সূর্যের মহিমা ও স্ফটিকের স্বচ্ছতা প্রচার করে। শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্রবাবুর কল্পনা সেই স্ফটিক-খণ্ড—এবং তাঁহার অভিমন্যু-বধ ও রাবণ-বধ প্রকৃত রামায়ণ ও মহাভারতের প্রতিফলিত রশ্মিপুঞ্জ। অভিমন্যুর নাম উচ্চারণ হইলেই আমাদের মনে যে ভাব উদয় হয় অভিমন্যু-বধ কাব্য পড়িয়া সে ভাবের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় না, বরং সে ভাব আরও উজ্জ্বলতর রূপে ফুটিয়া উঠে। যে অভিমন্যু বিশ্ববিজয়ী অর্জুন ও বীরাঙ্গনা সুভদ্রার সন্তান, তাহার তেজস্বিতা তো থাকিবেই, অথচ অভিমন্যুর কথা মনে আসিলেই সূর্যের কথা মনে আসে না, কারণ সূর্য বলিতেই কেবল প্রখর তীব্র তেজোরাশির সমষ্টি বুঝায়—কিন্তু অভিমন্যুর সঙ্গে কেমন একটি সুকুমার সুন্দর যুবার ভাব ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযোজিত আছে যে, তাহার জন্য অভিমন্যুকে মনে পড়িলেই চন্দ্রের কথা মনে হওয়া উচিত, কিন্তু তাহাও হইতে পারে না, কারণ চন্দ্রের তেজস্বিতা তো কিছুই নাই। সেইজন্য অভিমন্যুকে আমরা চন্দ্র-সূর্য-মিশ্রিত একটি অপরূপ সামগ্রী বলিয়াই মনে করি। অভিমন্যু-বধের অভিমন্যু, আমাদের সেই মহাভারতের অভিমন্যু সেই আমাদের অভিমন্যু—সেই কল্পনার আদর্শভূত অভিমন্যু। এই বঙ্গীয় নাটকখানিতে যেখানেই আমার অভিমন্যুকে পাইয়াছি—কি উত্তরার সঙ্গে প্রেমালাপে, কি সুভদ্রার সঙ্গে স্নেহ-বিনিময়ে, কি সপ্তরথীর দুর্ভেদ্য ব্যূহমধ্যে বীরকার্য সাধনে—সকল স্থানেই এই নাটকের অভিমন্যু প্রকৃত অভিমন্যুই হইয়াছে। বলিতে কি, মহাভারতের সকল ব্যক্তিই শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্রের হস্তে কষ্টকর মৃত্যুতে, জীবন না ফুরাইলেও অপঘাত মৃত্যুতে প্রাণ ত্যাগ করে নাই। ব্যাসদেবের কথা অনুসারে, যাহার যখন মৃত্যু আবশ্যক, গিরিশবাবু তাহাই করিয়াছেন। মাইকেল মহাশয় যেমন অকারণে লক্ষ্মণকে অসময়ে মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মারিয়াছেন অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে লক্ষ্মণের ধ্বংস সাধন করিয়াছেন গিরিশবাবু অভিমন্যুকে কি অর্জুনকে কি কৃষ্ণকে কোথাও সেরূপ হত্যা করেন নাই—ইহা তাঁহার বিশেষ গৌরব।”

এইরকম আরো সব কথা আছে। বাহুল্যবোধে সবগুলো উদ্ধৃত করলাম না। শ্রীমদ্ভগবদগীতা-সমন্বয় ভাষ্য আলোচনায় কবি লিখেছেন—”বর্তমান গ্রন্থের উপযুক্ত সমালোচনা আমাদের সাধ্যায়ত্ত নহে। ইহাতে ভগবদগীতার বিচিত্র ভাষ্যের যথোচিত সমন্বয় হইয়াছে কিনা তাহা বিচার করিবার মতো পাণ্ডিত্য আমাদের নাই। ….. ইহার অনুবাদ অংশ যে নির্ভরযোগ্য, এবং ইহার বিস্তারিত বাংলা ভাষা যে, মনোযোগ এবং শ্রদ্ধা সহকারে পাঠ্য সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই।”

শুধু গ্রন্থসমালোচনাই নয়, বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত লেখারও কবি সমালোচনা করেছেন এবং সেগুলি এই খণ্ডে ‘সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা’ অংশে সংকলিত হয়েছে। ‘সাধনার’ ফাল্গুন ১২৯৮ সংখ্যাতে নারীজাতি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন—”অধৈর্য হইবার আবশ্যক নাই; নারীর আদর কালক্রমে আপনি বাড়িবে, ….। রাবণের ঘরে সীতা অপমানিতা, সেখানে কেবল পশুবল, সেখানে সীতা বন্দিনী। রামের ঘরে সীতা সম্মানিতা, সেখানে বলের সহিত ধর্মের মিলন, সেখানে সীতা স্বাধীনা।”

সাময়িক সারসংগ্রহ অংশে ‘প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। সেখানে সাবিত্রী সত্যবানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে—”প্রাচীন পুস্তকালয় অনুসন্ধান করিয়া যতদূর বাহির হইতে পারে তাহা বোধ করি একপ্রকার সমাধা হইয়াছে। কাজটা নিতান্ত সহজ নহে। কেবল বসিয়া বসিয়া পুঁথি বাছা বিস্তর ধৈর্যসাধ্য, তাহা ছাড়া আর একটা বড়ো কঠিন কাজ আছে। পুরাকালে লিপিকারগণ অনেক সময়ে একটা পুঁথির অক্ষর মুছিয়া ফেলিয়া তাহার উপর আর একটা গ্রন্থ লিখিতেন। বহুকষ্টে সেই মোছা অক্ষর পড়িয়া পড়িয়া অনেক দুর্লভ গ্রন্থ উদ্ধার করা হইয়াছে। এইরূপ এক-একখানি পুঁথি লইয়া এক-এক পণ্ডিত বিস্তর চেষ্টায় গুটিকতক লুপ্তপ্রায় দাঁড়ি কষি বিন্দু খুঁজিয়া বাহির করিলেন, আবার আর এক পণ্ডিত দ্বিগুণতর ধৈর্যসহকারে তাহাতে আরও গুটিকতক যোগ করিয়া দিলেন। এইরূপে পতিনিষ্ঠ সাবিত্রীর ন্যায় তাঁহারা অনেক সত্যবান গ্রন্থকে যমের দ্বার হইতে ফিরাইয়া লইয়া আসিয়াছেন।”

‘জাতীয় সাহিত্য’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন ”লিটারেচর শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদূর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে : ‘মনুষ্যকৃত শ্লোকময় গ্রন্থবিশেষঃ। স তু ভট্টি রঘু কুমারসম্ভব মাঘ ভারবি মেঘদূত বিদগ্ধমুখমণ্ডল শান্তিশতক প্রভৃতয়ঃ।’ এমন-কি, রামায়ণ-মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল।”

‘চিত্রল অধিকার’ লেখাটিতে কবি ‘ভারতরথের সারথি জনার্দন’-এর উল্লেখ করেছেন। জনার্দন অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ যে পক্ষে থাকবেন, সেই পক্ষই জয়ী হবে।

পরিশিষ্ট অংশে দেখা যাচ্ছে যে বঙ্কিমচন্দ্রের একটি কবিতাপুস্তক রিভিউ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকাতে ১২৮৫ সালে। কবি পরিস্কার লিখেছেন যে বঙ্কিমচন্দ্রের এই কবিতাপুস্তক তাঁর ভালো লাগেনি। ‘সাবিত্রী’ কবিতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে কবি মহাভারতের সাবিত্রী-সত্যবানের কথা এবং অন্য প্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। ”গ্রন্থকার যে সত্যবানকে জীবনদান না করিয়া সাবিত্রীকে পর্যন্ত মারিয়া ফেলিলেন কেন—তাহা তো আমরা বুঝিতে পারি না। কোথায় সতীত্বের অমোঘ প্রভাবে যমহস্ত হইতেও পতিব্রতা সতী মৃত স্বামীকে ফিরিয়া লইবেন-না সাবিত্রীও এ দেশীয় শত সহস্র স্ত্রীর মতো যমের নিকটে সহমরণের বর প্রার্থনা করিয়া পতির সঙ্গেই সহমরণে অন্তর্ধান হইলেন। যদি কোনো পুরাণে এরূপ কথা থাকিত তা হইলেও বুঝিতাম যে গ্রন্থকার কী করিবেন—কিন্তু তাহা নয়, বঙ্কিমবাবু স্বেচ্ছামতো পুরাণের উৎকর্ষ সাধন করিতে গিয়া দেশীয় একটি অতি সুন্দর কাহিনীর সুন্দরতম অংশটুকু একেবারে মৃত্তিকাসাৎ করিয়াছেন।”

”সহমরণে যাওয়াই কি সাবিত্রীর অলৌকিক পাতিব্রত্যের পরাকাষ্ঠা মনে করিতে হইবে?—পুরাণে তাহা বলে না। পুরাণে এই কথাই বলে যে সাবিত্রী আপনার সতীত্ব-প্রভাবে উত্তেজিত হইয়া এই সংকল্প করিলেন যে সতীত্বের অলৌকিক মাহাত্ম্যে যমের হস্ত হইতে পর্যন্ত আমার মৃত স্বামীকে ফিরাইয়া আনিব। সেই সংকল্প অনুসারে তিনি একাকিনী চতুর্দশীর ভীষণ নিশীথ-যোগে বিকট অরণ্যে মৃত পতিকে ক্রোড়ে লইয়া যমরাজের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন—যমরাজ সাবিত্রীকে দেখিয়া প্রীত হইলেন—প্রীত হইয়া অবশেষে সত্যবানকে সতী স্ত্রীর আলিঙ্গনে প্রত্যর্পণ করিলেন।—পুরাণের এ কথা কেহ বিশ্বাস করিবেন না বটে, কিন্তু ইহার ভিতর একটি ভাব আছে—এবং সেই ভাবের প্রভাবে সাবিত্রীর গল্পটি ভারতবাসিনীদের হৃদয়ের শিরা এবং উপশিরায় ঘোর ঘনিষ্ঠ ভাবে বিজড়িত আছে। দুই-তিন সহস্র সতী স্ত্রী মৃত পতির সহিত সহমরণে গিয়াছে—কিন্তু কেহই তাহাদের সহমরণকে সতীত্বের যারপরনাই মাহাত্ম্য লক্ষণ মনে করে না। পুরাণের সহিত বাল্যক্রীড়া করা আমাদের মতে যুক্তি-সংগত নহে।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন