রবীন্দ্ররচনাবলীর এইখণ্ডে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি সন্নিবিষ্ট হয়েছে—
কবিতা ও গান : বিচিত্রিতা, শেষসপ্তক ও সংযোজন;
নাটক ও প্রহসন : শোধবোধ, গৃহপ্রবেশ, শেষবর্ষণ, নটীর পূজা ও নটরাজ;
উপন্যাস ও গল্প : গল্পগুচ্ছ;
প্রবন্ধ : জীবনস্মৃতি, সঞ্চয়, পরিচয় ও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, এবং গ্রন্থপরিচয় অংশ। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে বিচিত্রিতা কাব্যগ্রন্থ ও নটরাজ নাটক ব্যতীত অন্য গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ কম-বেশি আছে।
শেষসপ্তক গ্রন্থের ৩নং কবিতাতে আদিকবি এবং রামায়ণের রচনাকার বাল্মীকির কথা বলা হয়েছে। শীতের অবসানে এবং বসন্তের সমাগমে গাছে গাছে নতুন পাতা বেরোতে শুরু করে। এইরকম একদিনে কবি দেখলেন
”হঠাৎ দেখি শিশিরে ভেজা বাতাবি গাছে
ধরেছে কচি পাতা;
সে যেন আপনি বিস্মিত।
একদিন তমসার কূলে বাল্মীকি
আপনার প্রথম নিশ্বসিত ছন্দে
চকিত হয়েছিলেন নিজে,
তেমনি দেখলেম ওকে।”
‘তমসা’ নদী সম্বন্ধে অভিধানে বলা হয়েছে —”এই নদীতীরেই বাল্মীকির মুখ হইতে প্রথম সংস্কৃত শ্লোক নির্গত হয়।”
শেষসপ্তক গ্রন্থের ১৭ সংখ্যক কবিতাটি শ্রী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে উদ্দেশ্য করে লেখা। একটু উদ্ধৃত করি—
‘আমি যে রস পাই, ব্যথা পাই,
রূপ দেখি,
এ-কথা যার প্রাণ বলে
গান তারি জন্যে,
শাস্ত্রে সে আনাড়ি হলেও
তার নাড়িতে বাজে সুর।
ধূর্জটিবাবুকে কবি উপদেশ দিয়েছেন—
”যদি সুযোগ পাও
কথাটা নারদমুনিকে শুধিয়ো
ঝগড়া বাধাবার জন্যে নয়,
তত্ত্বের পার পাবার জন্য সংজ্ঞার অতীতে।”
দেবর্ষি নারদের কথা রামায়ণ মহাভারতের বহু জায়গায় আছে। তিনি বিশেষ জ্ঞানী এবং নারায়ণের পরমভক্ত। তবে ঋষিবরের একটা অখ্যাতি আছে যে তিনি ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে মজা দেখতে বড়ো ভালোবাসেন। সংগীতশাস্ত্রে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি আছে যদিও পৌরাণিক একটা কাহিনীতে বলা হয়েছে যে তাঁর তালজ্ঞানহীন সংগীতের জন্যই রাগ-রাগিনীদের অঙ্গবিকৃতি ঘটেছিল।
৪৪ নং কবিতাতে অহল্যার কথা বলেছেন একটুখানি—
”এসেছি তোমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে,
যেখানে একদিন রেখেছিল অহল্যাকে
নবদূর্বাশ্যামলের
করুণ পদস্পর্শে
চরম যুক্তিজাগরণের প্রতীক্ষায়,
নবজীবনের বিস্মিত প্রভাতে।”
অহল্যার কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে।
সংযোজন — শেষসপ্তকের ৩ নং কবিতায় যেমন বাতাবি লেবুগাছ এবং আদিকবি বাল্মীকির কথা বলা হয়েছিল, সংযোজনের ‘বাতাবির চারা’ কবিতায় মোটামুটি সেই কথাই বলা হয়েছে—
”প্রখর পৌষের অবসানে
কুহেলী ঘুচাল যবে কৌতূহলী ভোরের আলোক,
সহসা পড়িল চোখ—
হেরিনু শিশিরে ভেজা সেই গাছে
কচিপাতা ধরিয়াছে,
যেন কি আগ্রহে,
কথা কহে,
যে কথা আপনি শুনে পুলকেতে দুলে;
যেমন একদা কবে তমসার কূলে
সহসা বাল্মীকি মুনি
আপনার কণ্ঠ হতে আপন প্রথম ছন্দ শুনি
আনন্দসঘন
গভীর বিস্ময়ে নিমগন।”
শোধবোধ নাটকে মিঃ নন্দী একজন বিত্তশালী নবীন যুবক ও নলিনীর প্রণয়প্রার্থী। নলিনীর পিতা-মাতা মিঃ নন্দীকে পছন্দ করলেও নলিনী করেনা। নলিনীর জন্মদিনে মিঃ নন্দী একটা হীরে দেওয়া ব্রেসলেট উপহার দিয়েছে। এই নিয়ে নলিনী এবং তার বান্ধবী চারুর কথোপকথন— ”চারু। ইস। এ যে হীরে দেওয়া ব্রেসলেট! যা বলিস, তোর কপাল ভালো, এ বুঝি তোর জন্মদিনের—
নলিনী। হাঁ হাঁ, জন্মদিনের উপহার—আমার জন্ম মৃত্যু বিবাহ এই তিনকেই ঘিরে ফেলবার সুদর্শন চক্র।
চারু। সুদর্শন চক্র বটে। যা বলিস, মিঃ নন্দীর টেস্ট আছে”। সুদর্শন চক্র ভগবান বিষ্ণু বা ভগবানের অবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রধান অস্ত্র। এই অস্ত্র সম্বন্ধে অভিধানে লেখা হয়েছে—”মহাদেবের আদেশে বিশ্বকর্মা দেবগণের তেজো-গুণাংশ দ্বারা একটি চক্র প্রস্তুত করিয়া তাঁহাকে অর্পণ করেন, মহাদেব আবার তাহা দৈত্য দানবগণের বিনাশার্থে বিষ্ণুকে প্রদান করেন।” মহাভারতে দেখা যাচ্ছে যে দ্বাপরযুগে ভগবান যখন নরদেহ ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তখন খাণ্ডববন দহনের প্রাক্কালে অগ্নিদেব শ্রীকৃষ্ণকে এই সুদর্শনচক্র প্রদান করেন।
সতীশ নলিনীর আর একজন প্রণয়প্রার্থী। তার আর্থিক সামর্থ্য নেই তবু সে মিঃ নন্দীর সঙ্গে টক্কর দিতে যায়। তার বাবা আদর্শবাদী মানুষ—বাজে খরচের জন্য ছেলেকে তিনি টাকা দেবেন না। তাই সতীশ বাবার একটা সোনার জিনিস চুরি করে। সতীশের মা আবার সতীশের সব কাজেই সমর্থন করেন। তিনি সতীশের উপর থেকে চুরির সন্দেহটা সতীশের পিতার চাকর বনমালীর দিকে ঘুরিয়ে দিতে চান। ”ওঁর তো সেই বড়ো ভালোবাসার উড়ে বেয়ারা আছে—বনমালী। তার হাতেই তো ওঁর সব। সে হল ভারি সাধু, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির।” যুধিষ্ঠির মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র। ধর্ম তাঁর চরিত্রের ভূষণ। এখানে অবশ্য ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’ কথাটি ব্যঙ্গার্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
‘গৃহপ্রবেশ’ নাটকের একজায়গায় কৌস্তভরত্নের কথা আছে (সুলভ ৯ম, পৃ-১৭৫)। মহাভারতে আছে সমুদ্রমন্থনে কৌস্তমমণি উত্থিত হয়েছিল এবং নারায়ণ সেটি বক্ষে ধারণ করেছিলেন।
শেষবর্ষণে মহাভারতের প্রসঙ্গ একটুখানি আছে (সুলভ ৯ম খণ্ড, পৃ. ২০৬)। রাজা, রাজকবি এবং অন্যন্যরা গানের পালা শুনতে বসেছেন— গান পরিবেশন করবেন অন্য রাজ্য মধুকপত্তনের গানের দল। দলের নেতা হিসাবে আছেন নটরাজ—তাঁর কথাবার্তা রাজা এবং তাঁর পারিষদবর্গের কাছে একটু হেঁয়ালিমাখা মনে হচ্ছে। একজন পারিষদ রাজাকে বলছেন—
”পারিষদ। মহারাজ, আমি ওঁদের দেশের পরিচয় জানি। ওঁদের হেঁয়ালি বরঞ্চ বোঝা যায় কিন্তু যখন ব্যাখ্যা করতে বসেন তখন একেবারেই হাল ছেড়ে দিতে হয়।
রাজকবি। যেন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, টানলে আরো বাড়তে থাকে।”
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ মহাভারতের সভাপর্বের ঘটনা। সমগ্র মহাভারতে সর্বাপেক্ষা ন্যক্কারজনক ঘটনা এটি। খলবুদ্ধি শকুনির কাছে কৌরবরাজসভায় যুধিষ্ঠির যখন পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারালেন তখন দুর্যোধন-কর্ণের কথাতে দুঃশাসন ক্ষণপূর্বের ভারতসম্রাজ্ঞীকে বলপূর্বক প্রকাশ্য রাজসভায় নিয়ে এসেছিল। সেদিন সেই রাজসভায় সহস্র ইতর পুরুষের দৃষ্টির সামনে দ্রৌপদীর যে লাঞ্ছনা হয়েছিল তা অবর্ণনীয়। সেদিনের সেই প্রকাশ্য সভায় দুঃশাসন রাজকূলবধূ, রাজরানী দ্রৌপদীকে বিবস্ত্রা করতে চেষ্টা করেছিল। ঈশ্বরের অনুগ্রহে দুঃশাসনের এই অপকর্ম সফল হয়নি। সে দ্রৌপদীর পরিধেয় বস্ত্র যতই আকর্ষণ করেছে, ঈশ্বরের মাহাত্ম্যে সে বস্ত্র ততই অফুরান হয়ে উঠেছে। শেষে দুঃশাসন নিজেই পরিশ্রান্ত হয়ে এই অপচেষ্টা পরিত্যাগ করে বসে পড়েছে।
নটীর পূজা— মগধের মহারাজা বিম্বিসার ভগবান বুদ্ধের অনুগামী। তাঁর পুত্র অজাতশত্রু যখন রাজা হলেন তখন তিনি পুরানো বৈদিক ধর্মকেই গ্রহণ করলেন। বিম্বিসারের সময়ে বৌদ্ধধর্মের যে রমরমা ছিল সেটা কমে গেলেও বৌদ্ধধর্ম একেবারে বিলুপ্ত হলো না—ভগবান বুদ্ধের কিছু অনুগামী বিভিন্ন স্থানে থেকেই গেল। বিম্বিসার পত্নী মহারানী লোকেশ্বরী বিম্বিসারের সিংহাসন ত্যাগে এবং আরো কিছু কারণে বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন (সুলভ ৯ম পৃ. ৬৮১)। লোকেশ্বরী একজনকে বলছেন— ”তোমরা নাকি বলে বেড়াচ্ছ, অহিংসা পরমো ধর্মঃ।”
বৌদ্ধধর্মে অহিংসা একটি প্রধান অনুশাসন হলেও, এই শ্লোকাংশটি কিন্তু মহাভারত থেকে নেওয়া। মহাভারতের বনপর্বে সম্পূর্ণ শ্লোকটি আছে।
”অহিংসা সত্যবচনং সর্বভূতহিতং পরম।—
অহিংসা পরমো ধর্মঃ স চ সত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ।
সত্যে কৃত্বা প্রতিষ্ঠাং তু প্রবর্তন্তে প্রবৃত্তয়ঃ।”
লোকেশ্বরীর কথার মধ্যে একবার পরশুরামের কথা এসেছে (সুলভ ৯ম পৃ. ২৩৪)। রামায়ণ এবং মহাভারতে পরশুরামের কথা আছে। তিনি ঈশ্বরের এক অবতাররূপে স্বীকৃত। পরশুরাম ব্রাহ্মণ্য শক্তির প্রতিভূ। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি ক্ষত্রিয় নির্মূলকরণ ব্রত নিয়েছিলেন।
গল্পগুচ্ছ : ‘জয়পরাজয়’ গল্পে রাজা উদয়নারায়ণের সভাকবি শেখর। তাঁর কবিতার মধ্যে উগ্রতা বা অহংকর নেই—শান্ত সৌন্দর্য্যই তাঁর কাব্যের সম্পদ। একবার এক জয়দর্পী, পণ্ডিতাভিমানী কবি পুণ্ডরীক সেই রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন—উদ্দেশ্য রাজকবির সঙ্গে কাব্যযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া এবং তাঁকে পরাজিত করে নিজের জয়পতাকা উড্ডীন করা। রাজা তাঁর সভাকবি শেখরকে ভালোবাসেন কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি এটাও আশা করেন যে শেখর এই বহিরাগত পণ্ডিতকে পরাজিত করে রাজ্যের সম্মান বৃদ্ধি করবেন।
পুণ্ডরীক বাক্যবাগীশ এবং উদ্ধত। সে যেন দেবী সরস্বতীর কমলবনে মত্ত হাতীর মতো এসেছে। রাজা এই পুণ্ডরীকের সামনে শেখরকে ফেলে দেওয়ায় তাঁর একটু অভিমান হয়েছে। ”শেখরও ভক্তি প্রণয় অভিমান এবং একপ্রকার সকরুণ সংকোচপূর্ণ দৃষ্টি রাজার দিকে প্রেরণ করিল এবং ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাম যখন লোকরঞ্জনার্থে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা করিতে চাহিয়াছিলেন, তখন সীতা যেন এইরূপভাবে চাহিয়া এমনি করিয়া তাঁহার স্বামীর সিংহাসনের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিলেন।”
‘মহামায়া’ গল্পের মহামায়া সুন্দরী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্না। রাজীবের সঙ্গে তার বাল্যপ্রণয় থাকলেও সামাজিক কারণে এই বিয়ে হয়নি। মহামায়ার দাদা এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে মহামায়ার বিয়ে দিয়েছিল। এরপর যা ঘটবার তাই হল—অনতিবিলম্বেই মহামায়া বিধবা হলো। এর আগে মহামায়া রাজীবকে কথা দিয়েছিল সে রাজীবের ঘরে যাবে—রাজীব যেন অপেক্ষা করে।
মহামায়াকে সহমৃতা করার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে চিতার আগুন নিভে যায় এবং শ্মশানযাত্রীরাও পালিয়ে যায়। মহামায়ার শরীরের চেয়ে মুখটা একটু বেশি পুড়েছিল তাই সে চিতা থেকে নেমে মুখ ঢেকে রাজীবের গৃহে উপস্থিত হলো—বললো যে সে তার কথা রাখার জন্য রাজীবের ঘরে এসেছে। রাজীব যদি প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে কখনো মহামায়ার মুখের ঘোমটা খুলবে না বা তার মুখ দেখবে না, তাহলে সে রাজীবের ঘরে থাকবে। রাজীব সম্মত হয়েছিল। ”রাজীব ভাবিত, মানুষে মানুষে স্বভাবতই যথেষ্ট ব্যবধান আছে—বিশেষত মহামায়া পুরাণবর্ণিত কর্ণের মতো সহজকবচধারী—সে আপনার স্বভাবের চারিদিকে একটা আবরণ লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে।”
‘অসম্ভব কথা’ গল্পে একজায়গায় সাবিত্রীর কথা আছে (সুলভ ৯ম, পৃ. ৩৭৬)। মহাভারতে সাবিত্রী সত্যবানের কাহিনী আছে। সাবিত্রীর পতিভক্তি প্রবাদপ্রতিম। সত্যবানের মৃত্যুর পর সে মৃত্যু-অধিপতি যমরাজার অনুগমন করে সত্যবানের পুনর্জীবনের বর নিয়ে এসেছিল।
জীবনস্মৃতি : এই গ্রন্থ রচনার জন্য ‘জীবনস্মৃতিতে’ প্রাপ্ত তথ্যাদি অত্যন্ত মূলবান। গ্রন্থের প্রারম্ভে জীবনস্মৃতির কথা কিছু কিছু উল্লেখ করেছি—এখন বিশদ আলোচনা করা হচ্ছে।
জীবনস্মৃতির ‘শিক্ষারম্ভ’ অংশে কবি লিখেছেন—”কান্নার জোরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে অকালে ভরতি হইলাম। … এমনি করিয়া নিতান্ত শিশু বয়সেই আমার পড়া আরম্ভ হইল। চাকরদের মহলে যে-সকল বই প্রচলিত ছিল তাহা লইয়াই আমার সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। তাহার মধ্যে চাণক্য শ্লোকের অনুবাদ ও কৃত্তিবাস রামায়ণই প্রধান। সেই রামায়ণ পড়ার একটা দিনের ছবি মনে স্পষ্ট জাগিতেছে।
সেদিন মেঘলা করিয়াছে, বাহিরবাড়ীতে রাস্তার ধারের লম্বা বারান্দাটিতে খেলিতেছি। মনে নাই সত্য কী কারণে আমাকে ভয় দেখাইবার জন্য হঠাৎ ‘পুলিশম্যান’ ‘পুলিশম্যান’ করিয়া ডাকিতে লাগিল। … এরূপ নির্মম শাসনবিধি হইতে নিরপরাধ বালকের পরিত্রাণ কোথায় তাহা ভাবিয়া না পাইয়া একেবারে অন্তঃপুরে দৌড় দিলাম, … মাকে গিয়া আমার আসন্ন বিপদের সংবাদ জানাইলাম, তাহাতে তাঁহার বিশেষ উৎকণ্ঠার লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। কিন্তু আমি বাহিরে যাওয়া নিরাপদ বোধ করিলাম না। দিদিমা, আমার মাতার কোনো এক সম্পর্কে খুড়ী, যে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়িতেন সেই মার্বেল কাগজ মণ্ডিত কোনছেঁড়া মলাটওয়ালা মলিন বইখানি কোলে লইয়া মায়ের ঘরের দ্বারের কাছে পড়িতে বসিয়া গেলাম। … রামায়ণের কোনো একটা করুণ বর্ণনায় আমার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে দেখিয়া দিদিমা জোর করিয়া আমার হাত হইতে বইটা কাড়িয়া লইয়া গেলেন।”
জীবনস্মৃতির ‘ঘর ও বাহির’ অংশে রামায়ণের কথা আছে। রবীন্দ্রনাথের শিশুকাল কেটেছে চাকরদের তত্বাবধানে। ”আমাদের এক চাকর ছিল, তাহার নাম শ্যাম।… সে আমাকে ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসাইয়া আমার চারিদিকে খড়ি দিয়া গণ্ডি টানিয়া দিত। গম্ভীর মুখ করিয়া তর্জনী তুলিয়া বলিয়া যাইত, গণ্ডির বাহিরে গেলেই বিষম বিপদ। … গণ্ডি পার হইয়া সীতার কী সর্বনাশ হইয়াছিল তাহা রামায়ণে পড়িয়াছিলাম, সেইজন্য গণ্ডিটাকে নিতান্ত অবিশ্বাসীর মতো উড়াইয়া দিতে পারিতাম না।”
‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’ অংশে রামায়ণ মহাভারতের কথা এইরকম বলা হয়েছে। ”এই ভূতপূর্ব গুরুমহাশয় (ভৃত্য ঈশ্বর) সন্ধ্যাবেলায় আমাদিগকে সংযত রাখিবার জন্য একটি উপায় বাহির করিয়াছিল। সন্ধ্যাবেলায় রেড়ির তেলের ভাঙা সেজের চারদিকে আমাদের বসাইয়া সে রামায়ণ-মহাভারত শোনাইত। চাকরদের মধ্যে আরো দুই-চারটি শ্রোতা আসিয়া জুটিত। ক্ষীণ আলোকে ঘরের কড়িকাঠ পর্য্যন্ত মস্ত মস্ত ছায়া পড়িত, … আমরা স্থির হইয়া বসিয়া হাঁ করিয়া শুনিতাম। যেদিন কুশলবের কথা আসিল, বীর বালকেরা তাহাদের বাপখুড়াকে একেবারে মাটি করিয়া দিতে প্রবৃত্ত হইল, সেদিনকার সন্ধ্যাবেলাকার সেই অস্পষ্ট আলোকের সভা নিস্তব্ধ ঔৎসুক্যের নিবিড়তায় যে কীরূপ পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা এখনো মনে পড়ে। এদিকে রাত হইতেছে, আমাদের জাগরণকালের মেয়াদ ফুরাইয়া আসিতেছে, কিন্তু পরিণামের অনেক বাকি। এহেন সংকটের সময় হঠাৎ আমাদের পিতার অনুচর কিশোরী চাটুজ্জ্যে আসিয়া দাশুরায়ের পাঁচালি গাহিয়া অতি দ্রুত গতিতে বাকি অংশটুকু পূরণ করিয়া গেল— কৃত্তিবাসের সরল পয়ারের মৃদুমন্দ কলধ্বনি কোথায় বিলুপ্ত হইল—অনুপ্রাসের ঝকমকি ও ঝংকারে আমরা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম।
কোনো কোনোদিন পুরাণ পাঠের প্রসঙ্গে শ্রোতৃসভায় শাস্ত্রঘটিত তর্ক উঠিত, ঈশ্বর সুগভীর বিজ্ঞতার সহিত তাহার মীমাংসা করিয়া দিত। যদিও ছোটো ছেলেদের চাকর বলিয়া ভৃত্যসমাজে পদমর্য্যদায় সে অনেকের চেয়ে হীন ছিল, তবু কুরুসভায় ভীষ্মপিতামহের মতো সে আপনার কনিষ্ঠদের চেয়ে নিম্ন আসনে বসিয়াও আপন গুরু গৌরব অবিচলিত রাখিয়াছিল।”
কুরুবংশে শ্রেষ্ঠ মানুষটি ছিলেন নিঃসন্দেহে ভীষ্ম, এবং বয়োবৃদ্ধও। তবুও তিনি নিম্নাসনে বসতেন কারণ তিনি রাজা নন। কামুক পিতা শান্তনুর কাম-ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কখনো তিনি হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন গ্রহণ করবেন না। তাই শান্তনুর পরে যাঁরা হস্তিনাপুরের রাজা হয়েছিলেন তাঁরা সবাই বয়সে এবং গৌরবে ভীষ্মের চাইতে হীন থাকলেও রাজসভার উচ্চাসন ছিল তাঁদের জন্যই কারণ তাঁরা ছিলেন রাজা আর ভীষ্মের জন্য ছিল নিম্নাসন।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে বাল্যকালেই বাড়ীতে তাঁদের বহু বিষয়ে পড়াশোনা করতে হতো— স্কুলে তাঁদের যে সব পাঠ্য বই ছিল তার চাইতে অনেক বেশি বাড়ীতে পড়তে হতো। সেই বাল্যকালেই বাড়ীতে নর্মাল স্কুলের শিক্ষক শ্রীনীলকমল ঘোষাল মহাশয়ের কাছে অন্য বহু বিষয়ের সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘মেঘনাদবধকাব্য’ও তিনি পড়েছিলেন। এখনকার দিনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও মেঘনাদবধকাব্য আত্মস্থ করতে হিমসিম খেয়ে যায়, আর সেই দুরূহ কাব্য রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন তাঁর বাল্যকালেই। মধুসূদন রামায়ণের কাহিনী অবলম্বন করেই এই কাব্যগ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন যদিও রাম, রাবণ প্রভৃতিদের চরিত্র তিনি অন্যভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ অনেকসময়ই দেশভ্রমণে ব্যাপৃত থাকতেন। একবার তিনি বাড়ী আসার সময় ‘লেনু’ নামক একজন অল্পবয়সী পাঞ্জাবী চাকর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”সে আমাদের কাছে যে সমাদরটা পাইয়া ছিল তাহা স্বয়ং রণজিতসিংহের পক্ষেও কম হইত না। সে একে বিদেশী তাহাতে পাঞ্জাবী ইহাতেই আমাদের মন হরণ করিয়া লইয়াছিল। পুরাণে ভীমার্জুনের প্রতি যেরকম শ্রদ্ধা ছিল, এই পাঞ্জাবী জাতের প্রতিও মনে সেই প্রকারের একটা সম্ভ্রম ছিল।”
রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে চলেছেন হিমালয়ে। এই প্রথম তিনি বাড়ী ছেড়ে দূরের যাত্রায় বেরোলেন। কবির ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ একবার বোলপুর গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি কবিকে তাঁর ভ্রমণের গল্প বলেছিলেন। তার মধ্যে নিশ্চয়ই অতিরঞ্জন ছিল, কারণ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”তাহার কাছে ভ্রমণবৃত্তান্ত যাহা শুনিয়াছিলাম ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো ভদ্রঘরের শিশু তাহা কখনোই বিশ্বাস করিতে পারিত না।কিন্তু আমাদের সেকালে সম্ভব অসম্ভবের মাঝখানে সীমারেখাটা যে কোথায় তাহা ভালো করিয়া চিনিয়া রাখিতে শিখি নাই। কৃত্তিবাস কাশীরামদাস এ সম্বন্ধে আমাদের কোনো সাহায্য করেন নাই।”
এই ভ্রমণের সময়ে দেবেন্দ্রনাথ ছোট রবিকে কিছু কাজ দিয়েছিলেন, যেমন একটা কাজ ছিল শ্রীমদ্ভগবদগীতার কিছু শ্লোক কপি করা। ”ভগবদগীতায় পিতার মনের মতো শ্লোকগুলি চিহ্নিত করা ছিল। সেইগুলি বাংলা অনুবাদ সমেত আমাকে কাপি করিতে দিয়াছিলেন। বাড়ীতে আমি নগন্য বালক ছিলাম, এখানে আমার পরে এইসকল গুরুতর কাজের ভার পড়াতে তাহার গৌরবটা খুব করিয়া অনুভব করিতে লাগিলাম।”
এর আগে ভগবদগীতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় যদি নাও ঘটে থাকে, এবারে মহর্ষির সঙ্গে এই ভ্রমণের সময় সেটা ভালোভাবে ঘটে গেল। পরবর্তী জীবনে গীতা যে তিনি খুব ভালোভাবে পড়েছিলেন এবং তার উপদেশসমূহ আত্মস্থ করেছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। এই ভ্রমণকালেই ছোট রবি তাঁর পিতার কাছে পড়লেন আদিকবি মহর্ষি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের অংশবিশেষ। কবি লিখেছেন—
”পৃথিবীশুদ্ধ লোক কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির রচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশী হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি।’
হায়, এক ঋজুপাঠের সামান্য উদধৃত অংশ (ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ হইতে কৈকেয়ী দশরথসংবাদ) তাহার মধ্যে আবার আমার পড়া অতি অল্পই তাহাও পড়িতে গিয়া দেখি মাঝে মাঝে অনেকখানি অংশ বিস্মৃতিবশত অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে মা পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির অসামান্যতা অনুভব করিয়া আনন্দসম্ভোগ করিবার জন্য উৎসুক হইয়া বসিয়াছেন, তাঁহাকে ‘ভুলিয়া গেছি’ বলিবার মতো শক্তি আমার ছিল না। সুতরাং ঋজুপাঠ হইতে যেটুকু পড়িয়া গেলাম তাহার মধ্যে বাল্মীকির রচনা ও আমার ব্যাখ্যার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে অসামঞ্জস্য রহিয়া গেল। স্বর্গ হতে করুণহৃদয় মহর্ষি বাল্মীকি নিশ্চয়ই জননীর নিকট খ্যাতিপ্রত্যাশী অর্বাচীন বালকের সেই অপরাধ সকৌতুক স্নেহহাস্যে মার্জনা করিয়াছেন, কিন্তু দর্পহারী মধুসূদন আমাকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেন না।
মা মনে করিলেন, আমার দ্বারা অসাধ্যসাধন হইয়াছে তাই আর সকলকে বিস্মিত করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কহিলেন, ‘একবার দ্বিজেন্দ্রকে শোনা দেখি।’ তখন মনে মনে সমূহ বিপদ গনিয়া প্রচুর আপত্তি করিলাম। মা কোনোমতেই শুনিলেন না। বড়দাদাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বড়দাদা আসিতেই কহিলেন, ‘রবি কেমন বাল্মীকির রামায়ণ পড়িতে শিখিয়াছে একবার শোন না।’ পড়িতেই হইল। দয়ালু মধুসূদন তাঁহার দর্পহারিত্বের একটু আভাসমাত্র দিয়া আমাকে এ যাত্রা ছাড়িয়া দিলেন। বড়দাদা বোধ হয় কোনো একটা রচনায় নিযুক্ত ছিলেন বাংলা ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য তিনি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, গুটিকয়েক শ্লোক শুনিয়াই ‘বেশ হইয়াছে’ বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।”
জীবনস্মৃতি গ্রন্থের ‘সাহিত্যের সঙ্গী’ অংশে বিহারীলাল চক্রবর্তীকে নিয়ে একটু আলোচনা আছে। সেখানে কবি লিখেছেন যে বিহারীলাল কালিদাস ও বাল্মীকির কবিত্বে মুগ্ধ ছিলেন।
সঞ্চয় গ্রন্থের ‘রূপ ও অরূপ’ প্রবন্ধে কবি বলতে চেয়েছেন যে আপাত দৃষ্টিতে আমরা জগতের বস্তুসমূহকে যেভাবে অবলোকন করি সেই দেখাটা যে সবসময়ে সঠিক দেখা এটা বলা যায় না। ”কোনো জিনিস বস্তুত স্থির নাই, তাহার সমস্ত অনু পরমাণু নিয়ত কম্পমান অথচ জানিবার বেলায় এবং ব্যবহারকালে আমরা তাহাকে স্থির বলিয়াই জানিতেছি।” এই প্রসঙ্গে তিনি মহাভারত থেকে একটা উদাহরণ দিয়েছেন। ”স্ফটিক জিনিসটা যে কঠিন জিনিস তাহা দুর্যোধন একদিন ঠেকিয়া শিখিয়াছিলেন অথচ আলোকের কাছে যেন সে জিনিসটা একেবারে নাই বলিলেই হয়।” স্ফটিক নিয়ে দুর্যোধনের যে বিভ্রান্তি এবং দূরবস্থা সেটি আমরা আগে দেখেছি।
‘ধর্মশিক্ষা’ প্রবন্ধে বালক বালিকাদিগকে প্রথম থেকেই কীভাবে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন কবি। ‘ধর্মশিক্ষা’ সম্বন্ধে আমরা সত্যই কিরূপ পরামর্শ চাহিতেছি সেটা একটু ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখা দরকার। কারণ গীতায় বলিয়াছেন, আমাদের ভাবনাটা যেরূপ তাহার সিদ্ধিও সেইরূপ হইয়া থাকে।” এই কথাটি নিয়ে অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদার তাঁর ‘রবীন্দ্র সংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস গ্রন্থে (পৃ. ৪৯০) আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে কবির বক্তব্যের সঙ্গে মিল আছে যে শ্লোকাংশের সেটি হলো ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।’ কিন্তু এই শ্লোকটি গীতাতে নেই— সেটি আছে পঞ্চতন্ত্র এবং হলায়ুধের ‘ধর্ম বিবেক-এ। অধ্যাপিকা মজুমদার অনুমান করেছেন যে কবির অভিপ্রেত শ্লোকটি হতে পারে গীতার ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম’।
ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে কোনো বিষয়ের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার একটা অসামঞ্জস্য কখনো কখনো দেখা যায়। ”এই জন্যই পাশ্চাত্য দেশে প্রায় সর্বত্রই বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে ধর্মশিক্ষার যোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইবার আয়োজন চলিতেছে। … বিজ্ঞানকে যদি একবার বিচারক বলিয়া মানেন তবে কেবলমাত্র ওকালতির জোরে চিরদিন মকদ্দমায় জিত হইবার আশা নাই। বরাহ অবতার যে সত্যসত্যই বরাহবিশেষ নহে তাহা ভূকম্পশক্তি রূপকমাত্র এ কথা বলাও যা আর ধর্মবিশ্বাসের শাস্ত্রীয় ভিত্তিকে কোনো প্রকারে ভদ্রতা রক্ষা করিয়া বিদায় করাও তা।” আমাদের শাস্ত্রের অবতারতত্ত্বে দশাবতাদের তৃতীয় অবতার হচ্ছেন ‘বরাহ-অবতার’। এই অবতারে ভগবান বিষ্ণু দৈত্য হিরণ্যাক্ষকে বধ করেন এবং সমুদ্রতল থেকে ধরণীকে উত্তোলিত করেন।
‘ধর্মের অধিকার’ প্রবন্ধে কবি গীতা থেকে আংশিক শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন—”স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’—’অতি অল্পমাত্র ধর্মও মহাভয় হইতে ত্রাণ করিতে পারে।’ সম্পূর্ণ শ্লোকটি আছে শ্রীশ্রীগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে (৪০ নং শ্লোক বা মন্ত্র)
”নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।”
অর্থাৎ—এই নিষ্কাম কর্ম করিলে তাহা কখনো বিফল হয় না, তাহাতে কোনো পাপও হয় না, আর এই ধর্মের অল্পতা দ্বারাও মহাভয় হইতে পরিত্রাণ হয়।
‘আমার জগৎ’ প্রবন্ধে কবি একজন সাহিত্যিক বা কবির দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টি তত্ত্বের কথা বলেছেন —স্বভাবতই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে সেটা মিলছে না। ”বিজ্ঞান ঘড়ির কাঁটার কাল এবং গজকাঠির মাপ দিয়ে সমস্তকে দেখতে চায়। দেশকালের এক আদর্শ দিয়ে সমস্ত সৃষ্টিকে সে বিচার করে। কিন্তু এই এক আদর্শ সৃষ্টির আদর্শই নয়। সুতরাং বিজ্ঞান সৃষ্টিকে বিশ্লিষ্ট করে ফেলে। অবশেষে অণু-পরমাণুর ভিতর দিয়ে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছয় যেখানে সৃষ্টিই নেই। কারণ সৃষ্টি তো অণু-পরমাণু নয়—দেশকালের বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে আমাদের মন যা দেখছে তাই সৃষ্টি।… আমার বোধকে বাদ দিয়ে যুক্তি দ্বারা যা দেখছি তাই প্রলয়, আর বোধের দ্বারা যা দেখছি তাই সৃষ্টি।… মনকে বাদ দিয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব আলোচনা, আর রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণ গান একই কথা।”
পরিচয় : রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে যে কোনো আলোচনাতেই পরিচয় গ্রন্থে সন্নিবেশিত ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ নামক দীর্ঘ প্রবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আর্য অনুপ্রবেশ (Aryan Invasion), আর্য-অনার্য সংঘাত এবং মিলন, এই মিলন প্রক্রিয়ায় কারা অংশ নিয়েছিলেন এবং তাঁদের ভূমিকা, রামায়ণ মহাভারতে এই সংঘাত ও মিলনের ইতিহাস, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
ভারতবর্ষে আর্য অনুপ্রবেশের ধারণাটা একটা বিতর্কমূলক বিষয়। এই তত্ত্বের পক্ষে যাঁরা বলেন তাঁরা অনেকেই ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত। ভারতবর্ষের ঐতিহাসিকরা দ্বিধাবিভক্ত। অনেকেই ইউরোপীয় মতাবলম্বী আবার, কেউ কেউ অন্যরকম মত পোষণ করেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যাঁরা অনুপ্রবেশ তত্ত্বের উদগাতা বা সমর্থক তাঁরা ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব বিশেষ স্বীকার করতে চান না। ঋগ্বেদের প্রাচীনত্বকে কিছুটা স্বীকার করেও তাঁরা বলেন যে এটি খ্রি. পূঃ ১৫০০ বৎসরের বেশি প্রাচীন নয়, রামায়ণ মহাভারত এগুলির তুলনায় অনেক অর্বাচীন। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের এই মত এখন অনেকেই মানতে চান না। তাঁরা বলেন যে ইউরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করাই এই মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্য। বলা হয় যে, আর্যজাতি (Aryan Race) এই ধারণাটাই ইউরোপীয়ানদের সৃষ্ট এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের সঙ্গে এর কোন যোগ নেই। এই Aryan Race এবং Aryan Invasion তত্ত্বের বিরোধিতা শুধু কিছু ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা করছেন তাই নয়, এর বিরোধিতা ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্য থেকেও এসেছে। Sir Julian Huxley লিখেছেন –‘‘He (Max Muller) introduced a proposition which is demonstratively false. He spoke not only of a definite Aryan language … but also of a corresponding Aryan Race. The idea was rapidly taken up both in Germany and in England.’’ (Search for the Historical Krishna by Dr. N. S. Rajaram)
রামায়ণ-মহাভারত যে ভারতবর্ষের ইতিহাস শ্রেণীভুক্ত একথাটা অন্য অনেকের মতো রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেন যদিও এই গ্রন্থদ্বয়ের আক্ষরিক সত্যতা তিনি মানেন না। অনেকেই বলেন যে এই গ্রন্থদ্বয়ের বিশেষ করে রামায়ণের কাহিনী অনেকটাই রূপক এবং সেই রূপকের আড়ালে লুকিয়ে আছে আসল ইতিহাস। তাঁর নিজের মতো করে এই রূপকের খোলস ভেঙে আসল ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে।
এখন এই প্রবন্ধ থেকে রামায়ণ মহাভারতের ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক অংশগুলো উদ্ধৃত করা হবে।
”পর্দা উঠিবামাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথমাঙ্কেই আমরা আর্য-অনার্যের প্রচণ্ড জাতিসংঘাত দেখিতে পাই। এই সংঘাতের প্রথম প্রবলবেগে অনার্যের প্রতি আর্যের যে বিদ্বেষ জাগিয়াছিল তাহারই ধাক্কায় আর্যেরা নিজের মধ্যে নিজেরা সংহত হইতে পারিল।”
”অনার্যদের সহিত বিরোধের দিনে আর্যসমাজে যাঁহারা বীর ছিলেন, জানি না তাঁহারা কে! তাঁহাদের চরিতকাহিনী ভারতবর্ষের মহাকাব্যে কই তেমন করিয়া তো বর্ণিত হয় নাই। হয়তো জনমেজয়ের সর্পসত্রের কথার মধ্যে একটা প্রচণ্ড প্রাচীন যুদ্ধ-ইতিহাস প্রচ্ছন্ন আছে। পুরুষানুক্রমিক শত্রুতার প্রতিহিংসা-সাধনের জন্য সর্প-উপাসক অনার্য নাগজাতিকে একেবারে ধ্বংস করিবার জন্য জনমেজয় নিদারুণ উদযোগ করিয়াছিলেন এই পুরাণ-কথায় তাহা ব্যক্ত হইয়াছে বটে তবু এই রাজা ইতিহাসে তো কোনো বিশেষ গৌরব লাভ করেন নাই।
কিন্তু অনার্যদের সহিত আর্যদের মিলন ঘটাইবার অধ্যবসায়ে যিনি সফলতা লাভ করিয়াছিলেন তিনি আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে অবতার বলিয়া পূজা পাইয়া আসিতেছেন।
আর্য-অনার্যদের যোগবন্ধন তখনকার কালের যে একটি মহা উদযোগের অঙ্গ, রামায়ণ-কাহিনীতে সেই উদযোগের নেতারূপে আমরা তিনজন ক্ষত্রিয়ের নাম দেখিতে পাই। জনক, বিশ্বামিত্র ও রামচন্দ্র। এই তিনজনের মধ্যে কেবলমাত্র একটা ব্যক্তিগত যোগ নহে একটা এক-অভিপ্রায়ের যোগ দেখা যায়। বুঝিতে পারি, রামচন্দ্রের জীবনের কাজে বিশ্বামিত্র দীক্ষাদাতা এবং বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের সম্মুখে যে লক্ষ্যস্থাপন করিয়াছিলেন তাহা তিনি জনক রাজার নিকট হইতে লাভ করিয়াছিলেন।
এই জনক, বিশ্বামিত্র ও রামচন্দ্র যে পরস্পরের সমসাময়িক ছিলেন সে কথা হয়তো-বা কালগত ইতিহাসের দিক দিয়া সত্য নহে, কিন্তু ভাবগত ইতিহাসের দিক দিয়া এই তিন ব্যক্তি পরস্পরের নিকটবর্তী।”
”এইরূপ ভাবগত ইতিহাসে ব্যক্তি ক্রমে ভাবের স্থান অধিকার করে। ব্রিটিশ পুরাণ-কথায় যেমন রাজা আর্থার। তিনি জাতির মনে ব্যক্তিরূপ ত্যাগ করিয়া ভাবরূপ ধারণ করিয়াছেন। জনক ও বিশ্বামিত্র সেইরূপ আর্য-ইতিহাসগত একটি বিশেষ ভাবের রূপক হইয়া উঠিয়াছেন। রাজা আর্থার মধ্যযুগের যুরোপীয় ক্ষত্রিয়দের একটি বিশেষ খৃষ্টীয় আদর্শদ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া তাহাকেই জয়যুক্ত করিবার জন্য বিরুদ্ধ পক্ষের সহিত লড়াই করিতেছেন এই যেমন দেখি, তেমনি ভারতে একদিন ক্ষত্রিয়দল ধর্মে এবং আচরণে একটি বিশেষ উচ্চ আদর্শকে উদ্ভাবিত করিয়া তুলিয়া বিরোধিদলের সহিত দীর্ঘকাল ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসে তাহার আভাস পাওয়া যায়। এই সংগ্রামে ব্রাহ্মণেরাই যে তাঁহাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তাহারও প্রমাণ আছে।”
”এইরূপে সমাজে যে আদর্শের ভেদ হইয়া গেল, সেই আদর্শভেদের মূর্তি পরিগ্রহস্বরূপে আমরা দুই দেবতাকে দেখিতে পাই। প্রাচীন বৈদিক মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকাণ্ডের দেবতা ব্রহ্মা এবং নব্যদলের দেবতা বিষ্ণু। ব্রহ্মার চারি মুখ চারি বেদ—তাহা চিরকালের মতো ধ্যানরত স্থির, আর বিষ্ণুর চারি ক্রিয়াশীল হস্ত কেবলই নব নব ক্ষেত্রে মঙ্গলকে ঘোষিত করিতেছে, ঐক্যচক্রকে প্রতিষ্ঠিত করিতেছে, শাসনকে প্রচারিত করিতেছে এবং সৌন্দর্যকে বিকাশিত করিয়া তুলিতেছে।”
”ভারতবর্ষের ব্রহ্মবিদ্যার মধ্যে আমরা দুইটি ধারা দেখিতে পাই, নির্গুণ ব্রহ্ম ও সগুণ ব্রহ্ম, অভেদ ও ভেদাভেদ। এই ব্রহ্মবিদ্যা কখনো একের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিয়াছে, কখনো দুইকে মানিয়া সেই দুইয়ের মধ্যেই এককে দেখিয়াছে। দুইকে না মানিলে পূজা হয় না, আবার দুইয়ের মধ্যে এককে না মানিলে ভক্তি হয় না। দ্বৈতবাদী য়িহুদিদের দূরবর্তী দেবতা ভয়ের দেবতা, শাসনের দেবতা, নিয়মের দেবতা। সেই দেবতা নূতন টেস্টামেন্টে যখন মানবের সঙ্গে এক হইয়া মিশিয়া আত্মীয়তা স্বীকার করলেন তখনই তিনি প্রেমের দেবতা ভক্তির দেবতা হইলেন। বৈদিক দেবতা যখন মানুষ হইতে পৃথক তখন তাঁহার পূজা চলিতে পারে কিন্তু পরমাত্মা ও জীবাত্মা যখন আনন্দের অচিন্ত্যরহস্যলীলায় এক হইয়াও দুই, দুই হইয়াও এক, তখনই সেই অন্তরতম দেবতাকে ভক্তি করা চলে। এইজন্য ব্রহ্মবিদ্যার আনুষঙ্গিকরূপেই ভারতবর্ষে প্রেমভক্তির ধর্ম আরম্ভ হয়। এই ভক্তিধর্মের দেবতাই বিষ্ণু।
বিপ্লবের অবসানে বৈষ্ণবধর্মকে ব্রাহ্মণেরা আপন করিয়া লইয়াছেন কিন্তু গোড়ায় যে তাহা করেন নাই তাহার কিছু কিছু প্রমাণ এখনো অবশিষ্ট আছে। বিষ্ণুর বক্ষে ব্রাহ্মণ ভৃগু পদাঘাত করিয়াছিলেন এই কাহিনীর মধ্যে একটি বিরোধের ইতিহাস সংহত হইয়া আছে। এই ভৃণ্ড যজ্ঞকর্তা ও যজ্ঞফলভাগীদের আদর্শরূপে বেদে কথিত আছেন। ভারতবর্ষে পূজার আসনে ব্রহ্মার স্থানকে সংকীর্ণ করিয়া বিষ্ণুই যখন তাহা অধিকার করিলেন—বহুপল্লবিত যাগযজ্ঞ-ক্রিয়াকাণ্ডের যুগকে পশ্চাতে ফেলিয়া ভক্তিধর্মের যুগ যখন ভারতবর্ষে আবির্ভূত হইল তখন সেই সন্ধিক্ষণে একটা বড়ো ঝড় আসিয়াছিল। আসিবারই কথা। এই বিচিত্র ক্রিয়াকাণ্ডের অধিকার যাঁহাদের হাতে, এবং সেই অধিকার লইয়া যাঁহাদের সমাজে একটি বিশেষ আদর পাইয়াছিলেন, তাঁহারা সহজে তাহার বেড়া ভাঙিতে দেন নাই।
এই ভক্তির বৈষ্ণবধর্ম যে বিশেষভাবে ক্ষত্রিয়ের প্রবর্তিত ধর্ম, তাহার একটি প্রমাণ একদা ক্ষত্রিয় শ্রীকৃষ্ণকে এই ধর্মের গুরুরূপে দেখিতে পাই—এবং তাঁহার উপদেশের মধ্যে বৈদিক মন্ত্র ও আচারের বিরুদ্ধে আঘাতেরও পরিচয় পাওয়া যায়। তাহার দ্বিতীয় প্রমাণ এই-প্রাচীন ভারতের পুরাণে যে দুইজন মানবকে বিষ্ণুর অবতার বলিয়া স্বীকার করিয়াছে তাঁহারা দুইজনেই ক্ষত্রিয়—একজন শ্রীকৃষ্ণ, আর একজন শ্রীরামচন্দ্র। ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় ক্ষত্রিয়দলের এই ভক্তিধর্ম, যেমন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ তেমনি রামচন্দ্রের জীবনের দ্বারাও বিশেষভাবে প্রচারলাভ করিয়াছিল।
বৃত্তিগত ভেদ হইতে আরম্ভ করিয়া ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের মধ্যে এই চিত্তগত ভেদ এমন একটা সীমায় আসিয়া দাঁড়াইল যখন বিচ্ছেদের বিদারণ-রেখা দিয়া সামাজিক বিপ্লবের অগ্নি-উচ্ছ্বাস উদগিরিত হইতে আরম্ভ করিল। বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের কাহিনীর মধ্যে এই বিপ্লবের ইতিহাস নিবদ্ধ হইয়া আছে।
এই বিপ্লবের ইতিহাসে ব্রাহ্মণপক্ষ বশিষ্ঠ নামটিকে ও ক্ষত্রিয়পক্ষ বিশ্বামিত্র নামটিকে আশ্রয় করিয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় মাত্রই যে পরস্পরের বিরুদ্ধ দলে যোগ দিয়াছে তাহা নহে। এমন অনেক রাজা ছিলেন যাঁহারা ব্রাহ্মণদের সপক্ষে ছিলেন। কথিত আছে ব্রাহ্মণের বিদ্যা বিশ্বামিত্রের দ্বারা পীড়িত হইয়া রোদন করিতেছিল, হরিশ্চন্দ্র তাহাদিগকে রক্ষা করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, অবশেষে রাজ্য সম্পদ সমস্ত হারাইয়া বিশ্বামিত্রের কাছে তাঁহাকে সম্পূর্ণ হার মানিতে হইয়াছিল।
এরূপ দৃষ্টান্ত আরো আছে। প্রাচীনকালের এই মহাবিপ্লবের আর যে-একজন প্রধান নেতা শ্রীকৃষ্ণ কর্মকাণ্ডের নিরর্থকতা হইতে সমাজকে মুক্তি দিতে দাঁড়াইয়াছিলেন তিনি একদিন পাণ্ডবদের সাহায্যে জরাসন্ধকে বধ করেন। সেই জরাসন্ধ রাজা তখনকার ক্ষত্রিয়দলের শত্রুপক্ষ ছিলেন। তিনি বিস্তর ক্ষত্রিয় রাজাকে বন্দী ও পীড়িত করিয়াছিলেন। ভীমার্জুনকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁহার পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন তখন তাঁহাদিগকে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরিতে হইয়াছিল। এই ব্রাহ্মণ-পক্ষপাতী ক্ষত্রবিদ্বেষী রাজাকে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের দ্বারা যে বধ করিয়াছিলেন এটা একটা খাপছাড়া ঘটনামাত্র নহে। শ্রীকৃষ্ণকে লইয়া তখন দুই দল হইয়াছিল। সেই দুই দলকে সমাজের মধ্যে এক করিবার চেষ্টায় যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করিয়াছিলেন তখন শিশুপাল বিরুদ্ধদলের মুখপাত্র হইয়া শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করেন। এই যজ্ঞে সমস্ত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, সমস্ত আচার্য ও রাজার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকেই সর্বপ্রধান বলিয়া অর্ঘ্য দেওয়া হইয়াছিল। এই যজ্ঞে তিনি ব্রাহ্মণের পদক্ষালনের জন্য নিযুক্ত ছিলেন পরবর্তীকালের সেই অত্যুক্তির প্রয়াসেই পুরাকালীন ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বিরোধের ইতিহাস স্পষ্ট দেখা যায়। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের গোড়ায় এই সামাজিক বিবাদ। তাহার এক দিকে শ্রীকৃষ্ণের পক্ষ, অন্য দিকে শ্রীকৃষ্ণের বিপক্ষ। বিরুদ্ধপক্ষে সেনাপতিদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ব্রাহ্মণ-দ্রোণ—কৃপ ও অশ্বত্থামাও বড়ো সামান্য ছিলেন না।
অতএব দেখা যাইতেছে, গোড়ায় ভারতবর্ষের দুই মহাকাব্যেরই মূল বিষয় ছিল সেই প্রাচীন সমাজবিপ্লব। অর্থাৎ সমাজের ভিতরকার পুরাতন ও নূতনের বিরোধ। রামায়ণের কালে রামচন্দ্র নূতন দলের পক্ষ লইয়াছিলেন তাহা স্পষ্ট দেখা যায়। বশিষ্ঠের সনাতন ধর্মই ছিল রামের কুলধর্ম, বশিষ্ঠবংশই ছিল তাঁহাদের চিরপুরাতন পুরোহিতবংশ, তথাপি অল্পবয়সেই রামচন্দ্র সেই বশিষ্ঠের বিরুদ্ধপক্ষ বিশ্বামিত্রের অনুসরণ করিয়াছিলেন। বস্তুত বিশ্বামিত্র রামকে তাঁহার পৈতৃক অধিকার হইতে ছিনাইয়া লইয়াছিলেন। রাম যে পন্থা লইয়াছিলেন তাহাতে দশরথের সম্মতি ছিল না, কিন্তু বিশ্বামিত্রের প্রবল প্রভাবের কাছে তাঁহার আপত্তি টিকিতে পারে নাই। পরবর্তীকালে এই কাব্য যখন জাতীয়সমাজে বৃহৎ ইতিহাসের স্মৃতিকে কোনো-এক রাজবংশের পারিবারিক ঘরের কথা করিয়া আনিয়াছিল তখনই দুর্বলচিত্ত বৃদ্ধ রাজার অদ্ভুত স্ত্রৈণতাকেই রামের বনবাসের কারণ বলিয়া রটাইয়াছে।
রামচন্দ্র যে নব্যপন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন ইতিহাসে তাহার আর-এক প্রমাণ আছে। একদা যে ব্রাহ্মণ ভৃগু বিষ্ণুর বক্ষে পদাঘাত করিয়াছিলেন তাঁহারই বংশোদ্ভব পরশুরামের ব্রত ছিল ক্ষত্রিয়বিনাশ। রামচন্দ্র ক্ষত্রিয়ের এই দুর্ধর্ষ শত্রুকে নিরস্ত্র করিয়াছিলেন। এই নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণবীরকে বধ না করিয়া তিনি তাঁহাকে যে বশ করিয়াছিলেন তাহাতে অনুমান করা যায়, ঐক্যসাধনব্রত গ্রহণ করিয়া রামচন্দ্র তাহার প্রথম পর্বেই কতক বীর্যবলে কতক ক্ষমাগুণে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিরোধভঞ্জন করিয়াছিলেন। রামের জীবনের সকল কার্যেই এই উদার বীর্যবান সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়।
বিশ্বা-মিত্রই রামচন্দ্রকে জনকের গৃহে লইয়া গিয়াছিলেন এবং এই বিশ্বামিত্রের নেতৃত্বেই রামচন্দ্র জনকের ভূকর্ষণজাত কন্যাকে ধর্মপত্নীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই সমস্ত ইতিহাসকে ঘটনামূলক বলিয়া গণ্য করিবার কোনো প্রয়োজন নাই, আমি ইহাকে ভাবমূলক বলিয়া মনে করি। ইহার মধ্যে হয়তো তথ্য খুঁজিলে ঠকিব কিন্তু সত্য খুঁজিলে পাওয়া যাইবে।
মূল কথা এই, জনক ক্ষত্রিয় রাজার আদর্শ ছিলেন। ব্রহ্মবিদ্যা তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া বিকাশলাভ করিয়াছিল। এ বিদ্যা কেবলমাত্র তাঁহার জ্ঞানের বিষয় ছিল না, এ বিদ্যা তাঁহার সমস্ত জীবনে রূপ গ্রহণ করিয়াছিল, তিনি তাঁহার রাজ্যসংসারের বিচিত্র কর্মের কেন্দ্রস্থলে এই ব্রহ্মজ্ঞানকে অবিচলিত করিয়া রক্ষা করিয়াছিলেন ইতিহাসে তাহা কীর্তিত হইয়াছে। চরমতম জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের ছোটো বড়ো সমস্ত কর্মের আশ্চর্য যোগসাধন ইহাই ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয়দের সর্বোচ্চ কীর্তি। আমাদের দেশে যাঁহারা ক্ষত্রিয়ের অগ্রণী ছিলেন তাঁহারা ত্যাগকেই ভোগের পরিণাম করিয়া কর্মকে মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠ উপায় বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন।
এই জনক এক দিকে ব্রহ্মজ্ঞানের অনুশীলন, আর-এক দিকে স্বহস্তে হলচালন করিয়াছিলেন। ইহা হইতেই জানিতে পারি কৃষিবিস্তারের দ্বারা আর্যসভ্যতা বিস্তার করা ক্ষত্রিয়দের একটি ব্রতের মধ্যে ছিল। জনক মিথিলার রাজা ছিলেন—ইহা হইতেই জানা যায় আর্যাবর্তের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত আর্য উপনিবেশ আপনার সীমায় আসিয়া ঠেকিয়াছিল। তখন দুর্গম বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণভাগে অরণ্য অক্ষত ছিল এবং দ্রাবিড়সভ্যতা সেই দিকেই প্রবল হইয়া করিয়া আর্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিয়াছিল। রাবণ বীরপরাক্রমে ইন্দ্র প্রভৃতি বেদের দেবতাকে পরাস্ত করিয়া আর্যদের যজ্ঞের বিঘ্ন ঘটাইয়া নিজের দেবতা শিবকে জয়ী করিয়াছিলেন। যুদ্ধজয়ে স্বকীয় দলের দেবতার প্রভাব প্রকাশ পায়। পৃথিবীতে সকল সমাজেরই বিশেষ অবস্থায় এই বিশ্বাস দৃঢ় থাকে—কোনো পক্ষের পরাভবে সে পক্ষের দেবতারই পরাভব গণ্য হয়। রাবণ আর্যদেবতাদিগকে পরাস্ত করিয়াছিলেন এই যে লোকশ্রুতি আমাদের দেশে প্রচলিত আছে ইহার অর্থই এই যে, তাঁহার রাজত্বকালে তিনি বৈদিক দেবতার উপাসকদিগকে বারংবার পরাভূত করিয়াছিলেন।
এমন অবস্থায় সেই শিবের হরধনু ভাঙিবে কে একদিন এই এক প্রশ্ন আর্যসমাজে উঠিয়াছিল। শিবোপাসকদের প্রভাবকে নিরস্ত করিয়া যিনি দক্ষিণখণ্ডে আর্যদের কৃষিবিদ্যা ও ব্রহ্মবিদ্যাকে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারিবেন তিনিই যথার্থভাবে ক্ষত্রিয়ের আদর্শ জনকরাজার অমানুষিক মানসকন্যার সহিত পরিণীত হইবেন। বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রকে সেই হরধনু ভঙ্গ করিবার দুঃসাধ্য পরীক্ষায় লইয়া গিয়াছিলেন। রাম যখন বনের মধ্যে গিয়া কোনো কোনো প্রবল দুর্ধর্ষ শৈববীরকে নিহত করিলেন তখনই তিনি হরধনু ভঙ্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন এবং তখনই তিনি সীতাকে অর্থাৎ হলচালনরেখাকে বহন করিয়া লইবার অধিকারী হইতে পারিলেন। তখনকার অনেক বীর রাজাই এই সীতাকে গ্রহণ করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিলেন কিন্তু তাঁহারা হরধনু ভাঙিতে পারেন নাই, এইজন্য রাজর্ষি জনকের কন্যাকে লাভ করিবার গৌরব হইতে তাঁহারা বঞ্চিত হইয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। কিন্তু এই দুঃসাধ্য ব্রতের অধিকারী কে হইবেন, ক্ষত্রিয় তপস্বিগণ সেই সন্ধান হইতে বিরত হন নাই। একদা বিশ্বামিত্রের সেই সন্ধান রামচন্দ্রের মধ্যে আসিয়া সার্থক হইল।
বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামচন্দ্র যখন বাহির হইলেন তখন তরুণ বয়সেই তিনি তাঁহার জীবনের তিনটি বড়ো বড়ো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। প্রথম, তিনি শৈব রাক্ষসদিগকে পরাস্ত করিয়া হরধনু ভঙ্গ করিয়াছিলেন; দ্বিতীয়, যে ভূমি হলচালনের অযোগ্যরূপে অহল্যা হইয়া পাষাণ হইয়া পড়িয়া ছিল, ও সেই কারণে দক্ষিণাপথের প্রথম অগ্রগামীদের মধ্যে অন্যতম ঋষি গৌতম যে ভূমিকে একদা গ্রহণ করিয়াও অবশেষে অভিশপ্ত বলিয়া পরিত্যাগ করিয়া যাওয়াতে যাহা দীর্ঘকাল ব্যর্থ হইয়া পড়িয়াছিল, রামচন্দ্র সেই কঠিন পাথরকেও সজীব করিয়া তুলিয়া আপন কৃষিনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছিলেন; তৃতীয়, ক্ষত্রিয়দলের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণদের যে বিদ্বেষ প্রবল হইয়া উঠিতেছিল তাহাকেও এই ক্ষত্রঋষি বিশ্বামিত্রের শিষ্য আপন ভুজবলে পরাস্ত করিয়াছিলেন।
অকস্মাৎ যৌবরাজ্য-অভিষেকে বাধা পড়িয়া রামচন্দ্রের যে নির্বাসন ঘটিল তাহার মধ্যে সম্ভবত তখনকার দুই প্রবল পক্ষের বিরোধ সূচিত হইয়াছে। রামের বিরুদ্ধে যে একটি দল ছিল তাহা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রবল—এবং স্বভাবতই অন্তঃপুরের মহিষীদের প্রতি তাহার বিশেষ প্রভাব ছিল। বৃদ্ধ দশরথ ইহাকে উপেক্ষা করিতে পারেন নাই এইজন্য একান্ত অনিচ্ছাসত্বেও তাঁহার প্রিয়তম বীর পুত্রকেও তিনি নির্বাসনে পাঠাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। সেই নির্বাসনে রামের বীরত্বের সহায় হইলেন লক্ষ্মণ ও তাঁহার জীবনের সঙ্গিনী হইলেন সীতা অর্থাৎ তাঁহার সেই ব্রত। এই সীতাকেই তিনি নানা বাধা ও নানা শত্রুর আক্রমণ হইতে বাঁচাইয়া বন হইতে বনান্তরে ঋষিদের আশ্রম ও রাক্ষসদের আবাসের মধ্য দিয়া অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইতে লাগিলেন।
আর্য-অনার্যের বিরোধকে বিদ্বেষের দ্বারা জাগ্রত রাখিয়া যুদ্ধের দ্বারা নিধনের দ্বারা তাহার সমাধানের প্রয়াস অন্তহীন দুশ্চেষ্টা। প্রেমের দ্বারা মিলনের দ্বারা ভিতরের দিক হইতে ইহার মীমাংসা হইলেই এত বড়ো বৃহৎ ব্যাপারও সহজ হইয়া যায়।”
”ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র একদিন গুহক চণ্ডালকে আপন মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন এই জনশ্রুতি আজ পর্যন্ত তাঁহার আশ্চর্য উদারতার পরিচয় বলিয়া চলিয়া আসিয়াছে। পরবর্তী যুগের সমাজ উত্তরকাণ্ডে তাঁহার এই চরিতের মাহাত্ম্য বিলুপ্ত করিতে চাহিয়াছে, শূদ্র তপস্বীকে তিনি বধদণ্ড দিয়াছিলেন এই অপবাদ রামচন্দ্রের উপরে আরোপ করিয়া পরবর্তী সমাজরক্ষকের দল রামচরিতের দৃষ্টান্তকে স্বপক্ষে আনিবার চেষ্টা করিয়াছে। যে সীতাকে রামচন্দ্র সুখে দুঃখে রক্ষা করিয়াছেন ও প্রাণপণে শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, সমাজের প্রতি কর্তব্যের অনুরোধে তাহাকেও তিনি বিনা অপরাধে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। উত্তরকাণ্ডের এই কাহিনী সৃষ্টির দ্বারা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায় আর্যজাতির বীরশ্রেষ্ঠ আদর্শচরিত্ররূপে পূজা রামচন্দ্রের জীবনীকে একদা সামাজিক আচার-রক্ষার অনুকুল করিয়া বর্ণনা করিবার বিশেষ চেষ্টা জন্মিয়াছিল। রামচরিতের মধ্যে যে একটি সমাজ-বিপ্লবের ইতিহাস ছিল পরবর্তীকালে যথাসম্ভব তাহার চিহ্ন মুছিয়া ফেলিয়া তাহাকে নব্যকালের সামাজিক আদর্শের অনুগত করা হইয়াছিল। সেই সময়েই রামের চরিতকে গৃহধর্মের ও সমাজধর্মের আশ্রয়রূপে প্রচার করিবার চেষ্টা জাগিয়াছিল এবং রামচন্দ্র যে একদা তাহার স্বজাতিকে বিদ্বেষের সংকোচ হইতে প্রেমের প্রসারণের দিকে লইয়া গিয়াছিলেন ও সেই নীতির দ্বারা একটি বিষম সমস্যার সমাধান করিয়া সমস্ত জাতির নিকট চিরকালের মতো বরণীয় হইয়াছিলেন সে কথাটা সরিয়া গিয়াছে এবং ক্রমে ইহাই দাঁড়াইয়াছে যে তিনি শাস্ত্রানুমোদিত গার্হস্থ্যের আশ্রয় ও লোকানুমোদিত আচারের রক্ষক। ইহার মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার এই, এককালে যে রামচন্দ্র ধর্মনীতি ও কৃষিবিদ্যাকে নূতন পথে চালনা করিয়াছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁহারই চরিতকে সমাজ পুরাতন বিধিবন্ধনের অনুকূল করিয়া ব্যবহার করিয়াছে। একদিন সমাজে যিনি গতির পক্ষে বীর্য প্রকাশ করিয়াছিলেন আর-একদিন সমাজ তাঁহাকেই স্থিতির পক্ষে বীর বলিয়া প্রচার করিয়াছে। বস্তুত রামচন্দ্রের জীবনের কার্যে এই গতিস্থিতির সামঞ্জস্য ঘটিয়াছিল বলিয়াই এইরূপ হওয়া সম্ভবপর হইয়াছে।
তৎসত্ত্বেও এ কথা ভারতবর্ষ ভুলিতে পারে নাই যে তিনি চণ্ডালের মিতা, বানরের দেবতা, বিভীষণের বন্ধু ছিলেন। তিনি শত্রুকে ক্ষয় করিয়াছিলেন এ তাঁহার গৌরব নহে তিনি শত্রুকে আপন করিয়াছিলেন। তিনি আচারের নিষেধকে, সামাজিক বিদ্বেষের বাধাকে অতিক্রম করিয়াছিলেন, তিনি আর্য অনার্যের মধ্যে প্রীতির সেতু বন্ধন করিয়া দিয়াছিলেন।
নৃতত্ত্ব আলোচনা করিলে দেখা যায় বর্বর জাতির অনেকেরই মধ্যে এক-একটি বিশেষ জন্তু পবিত্র বলিয়া পূজিত হয়। অনেক সময়ে তাহারা আপনাদিগকে সেই জন্তুর বংশধর বলিয়া গণ্য করে। সেই জন্তুর নামেই তাহারা আখ্যাত হইয়া থাকে। ভারতবর্ষে এইরূপে নাগবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। কিষ্কিন্ধ্যায় রামচন্দ্র যে অনার্যদলকে বশ করিয়াছিলেন তাহারাও যে এইরূপ কারণেই বানর বলিয়া পরিচিত তাহাতে সন্দেহ নাই। কেবল তো বানর নহে রামচন্দ্রের দলে ভল্লুকও ছিল। বানর যদি অবজ্ঞাসূচক আখ্যা হইত তবে ভল্লুকের কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।
রামচন্দ্র এই যে বানরদিগকে বশ করিয়াছিলেন তাহা রাজনীতির দ্বারা নহে, ভক্তিধর্মের দ্বারা। এইরূপে তিনি হনুমানের ভক্তি পাইয়া দেবতা হইয়া উঠিয়াছিলেন। পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যায়, যে-কোনো মহাত্মাই বাহ্যধর্মের স্থলে ভক্তিধর্মকে জাগাইয়াছেন, তিনি স্বয়ং পূজা লাভ করিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণ, খৃষ্ট, মহম্মদ, চৈতন্য প্রভৃতি তাহার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। শিখ, সুফি, কবীরপন্থী প্রভৃতি সর্বত্রই দেখিতে পাই, ভক্তি যাঁহাদিগকে আশ্রয় করিয়া প্রকাশ পায় অনুবর্তীদের কাছে তাঁহারা দেবত্ব প্রাপ্ত হন। ভগবানের সহিত ভক্তের অন্তরতম যোগ উদঘাটন করিতে গিয়া তাঁহারাও যেন দেবত্বের সহিত মনুষ্যত্বের ভেদসীমা অতিক্রম করিয়া থাকেন। এইরূপে হনুমান ও বিভীষণ রামচন্দ্রের উপাসক ও ভক্ত বৈষ্ণবরূপে খ্যাত হইয়াছেন।
রামচন্দ্র ধর্মের দ্বারাই অনার্যদিগকে জয় করিয়া তাহাদের ভক্তি অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি বাহুবলে তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়া রাজ্যবিস্তর করেন নাই। দক্ষিণে তিনি কৃষিস্থিতিমূলক সভ্যতা ও ভক্তিমূলক একেশ্বরবাদ প্রচার করিয়াছিলেন। তিনি সেই যে বীজ রোপন করিয়া আসিয়াছিলেন বহু শতাব্দী পরেও ভারতবর্ষ তাহার ফল লাভ করিয়াছিল। এই দাক্ষিণাত্যে ক্রমে দারুণ শৈবধর্মও ভক্তিধর্মের রূপ গ্রহণ করিল এবং একদা এই দাক্ষিণাত্য হইতেই ব্রহ্মবিদ্যার এক ধারায় ভক্তিস্রোত ও আর-এক ধারায় অদ্বৈতজ্ঞান উচ্ছ্বসিত হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষকে প্লাবিত করিয়া দিল।”
আর্যে অনার্যে যখন অল্প অল্প করিয়া যোগস্থাপন হইতেছে তখন অনার্যদের ধর্মের সঙ্গেও বোঝাপড়া করার প্রয়োজন ঘটিয়াছিল। এই সময়ে অনার্যদের দেবতা শিবের সঙ্গে আর্য-উপাসকদের একটা বিরোধ চলিতেছিল এবং সেই বিরোধে কখনো আর্যেরা কখনো অনার্যেরা জয়ী হইতেছিল। কৃষ্ণের অনুবর্তী অর্জুন কিরাতদের দেবতা শিবের কাছে একদিন হার মানিয়াছিলেন। শিবভক্ত বাণ-অসুরের কন্যা উষাকে কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ হরণ করিয়াছিলেন—এই সংগ্রামে কৃষ্ণ জয়ী হইয়াছিলেন। বৈদিক যজ্ঞে অনার্য শিবকে দেবতা বলিয়া স্বীকার করা হয় নাই, সেই উপলক্ষে শিবের অনার্য অনুচরগণ যজ্ঞ নষ্ট করিয়াছিল। অবশেষে শিবকে বৈদিক রুদ্রের সহিত মিলাইয়া একদিন তাঁহাকে আপন করিয়া লইয়া আর্য-অনার্যের এই ধর্মবিরোধ মিটাইতে হইয়াছিল। তথাপি দেবতা যখন অনেক হইয়া পড়েন তখন তাঁহাদের মধ্যে কে বড়ো কে ছোটো সে বিবাদ সহজে মিটিতে চায় না। তাই মহাভারতে রুদ্রের সহিত বিষ্ণুর সংগ্রামের উল্লেখ আছে—সেই সংগ্রামে রুদ্র বিষ্ণুকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।
মহাভারত আলোচনা করিলে স্পষ্টই দেখা যায় বিরোধের মধ্য দিয়াও আর্যদের সহিত অনার্যদের রক্তের মিলন ও ধর্মের মিলন ঘটিতেছিল। এইরূপে যতই বর্ণসংকর ও ধর্মসংকর উৎপন্ন হইতে লাগিল ততই সমাজের আত্মরক্ষণীশক্তি বারংবার সীমানির্ণয় করিয়া আপনাকে বাঁচাইতে চেষ্টা করিয়াছে। যাহাকে ত্যাগ করিতে পারে নাই তাহাকে গ্রহণ করিয়া বাঁধ বাঁধিয়া দিয়াছে। মনুতে বর্ণসংকরের বিরুদ্ধে যে চেষ্টা আছে এবং তাহাতে মূর্তি-পূজা ব্যবসায়ী দেবল ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা প্রকাশিত হইয়াছে তাহা হইতে বুঝা যায় রক্তে ও ধর্মে অনার্যদের মিশ্রণকে গ্রহণ করিয়াও তাহাকে বাধা দিবার প্রয়াস কোনোদিন নিরস্ত হয় নাই। এইরূপে প্রসারণের পরমুহূর্তেই সংকোচন আপনাকে বারংবার অত্যন্ত কঠিন করিয়া তুলিয়াছে।
একদিন ইহারই একটা প্রবল প্রতিক্রিয়া ভারতবর্ষের দুই ক্ষত্রিয় রাজসন্ন্যাসীকে আশ্রয় করিয়া প্রচণ্ডশক্তিতে প্রকাশ পাইয়াছে। ধর্মনীতি যে একটা সত্য পদার্থ, তাহা যে সামাজিক নিয়মমাত্র নহে—সেই ধর্মনীতিকে আশ্রয় করিয়াই যে মানুষ মুক্তি পায়, সামাজিক বাহ্য প্রথাপালনের দ্বারা নহে, এই ধর্মনীতি যে মানুষের সহিত মানুষের কোনো ভেদকে চিরন্তন সত্য বলিয়া গণ্য করিতে পারে না ক্ষত্রিয় তাপস বুদ্ধ ও মহাবীর সেই মুক্তির বার্তাই ভারতবর্ষে প্রচার করিয়াছিলেন। আশ্চর্য এই যে তাহা দেখিতে জাতির চিরন্তন সংস্কার ও বাধা অতিক্রম করিয়া সমস্ত দেশকে অধিকার করিয়া লইল। এইবার অতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে ক্ষত্রিয়গুরুর প্রভাব ব্রাহ্মণের শক্তিকে একেবারে অভিভূত করিয়া রাখিয়াছিল।
সেটা সম্পূর্ণ ভালো হইয়াছিল এমন কথা কোনোমতেই বলিতে পারি না। এইরূপ একপক্ষের ঐকান্তিকতায় জাতি প্রকৃতিস্থ থাকিতে পারে না, তাহার স্বাস্থ্য নষ্ট হইতে বাধ্য। এই কারণেই বৌদ্ধযুগ ভারতবর্ষকে তাহার সমস্ত সংস্কারজাল হইতে মুক্ত করিতে গিয়া যেরূপ সংস্কারজালে বদ্ধ করিয়া দিয়াছে এমন আর কোনোকালেই করে নাই।”
”আমরা কী এবং কোন জিনিসটা আমাদের—চারি দিকের বিপুল বিশ্লিষ্টতার ভিতর হইতে এইটেকে উদ্ধার করিবার একটা মহাযুগ আসিল। সেই যুগেই ভারতবর্ষ আপনাকে ভারতবর্ষ বলিয়া সীমাচিহ্নিত করিল। তৎপূর্বে বৌদ্ধসমাজের যোগে ভারতবর্ষ পৃথিবীতে এত দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল যে সে আপনার কলেবরটাকে সুস্পষ্ট করিয়া দেখিতেই পাইতেছিল না। এইজন্য আর্য জনশ্রুতিতে প্রচলিত কোনো পুরাতন চক্রবর্তী সম্রাটের রাজ্যসীমার মধ্যে ভারতবর্ষ আপনার ভৌগোলিক সত্তাকে নির্দিষ্ট করিয়া লইল। তাহার পরে, সামাজিক প্রলয়ঝড়ে আপনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সূত্রগুলিকে খুঁজিয়া লইয়া জোড়া দিবার চেষ্টা চলিতে লাগিল। এই সময়েই সংগ্রহকর্তাদের কাজ দেশের প্রধান কাজ হইল। তখনকার যিনি ব্যাস, নূতন রচনা তাঁহার কাজ নহে পুরাতন সংগ্রহেই তিনি নিযুক্ত। এই ব্যাস একব্যক্তি না হইতে পারেন কিন্তু ইনি সমাজের একই শক্তি। কোথায় আর্যসমাজের স্থিরপ্রতিষ্ঠা ইনি তাহাই খুঁজিয়া একত্র করিতে লাগিলেন।
সেই চেষ্টার বশে ব্যাস বেদ সংগ্রহ করিলেন। যথার্থ বৈদিককালে মন্ত্র ও যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রণালীগুলিকে সমাজ যত্ন করিয়া শিখিয়াছে ও রাখিয়াছে, তবু তখন তাহা শিক্ষণীয় বিদ্যামাত্র ছিল এবং সে বিদ্যাকেও সকলে পরাবিদ্যা বলিয়া মানিত না।
কিন্তু একদিন বিশ্লিষ্ট সমাজকে বাঁধিয়া তুলিবার জন্য এমন একটি পুরাতন শাস্ত্রকে মাঝখানে দাঁড় করাইবার দরকার হইয়াছিল যাহার সম্বন্ধে নানা লোক নানাপ্রকার তর্ক করিতে পারিবে না—যাহা আর্যসমাজের সর্বপুরাতন বাণী, যাহাকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করিয়া বিচিত্র বিরুদ্ধসম্প্রদায়ও এক হইয়া দাঁড়াইতে পারিবে। এইজন্য বেদ যদিচ প্রাত্যহিক ব্যবহার হইতে তখন অনেক দূরবর্তী হইয়া পড়িয়াছিল তথাপি দূরের জিনিস বলিয়াই তাহাকে দূর হইতে মান্য করা সকলের পক্ষে সহজ হইয়াছিল। আসল কথা, যে জাতি বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল কোনো একটি দৃঢ়নিশ্চল কেন্দ্রকে স্বীকার না করিলে তাহার পরিধি নির্ণয় কঠিন হয়। তাহার পরে আর্যসমাজে যত কিছু জনশ্রুতি খণ্ড খণ্ড আকারে চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকেও একত্র করিয়া মহাভারত নামে সংকলিত করা হইল।
যেমন একটি কেন্দ্রের প্রয়োজন, তেমনি একটি ধারাবাহিক পরিধিসূত্রও তো চাই—সেই পরিধিসূত্রই ইতিহাস। তাই ব্যাসের আর-এক কাজ হইল ইতিহাস সংগ্রহ করা। আর্যসমাজের যত কিছু জনশ্রুতি ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকে তিনি এক করিলেন। শুধু জনশ্রুতি নহে, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস, তর্কবিতর্ক ও চারিত্রনীতিকেও তিনি এইসঙ্গে এক করিয়া একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন। ইহার নাম দিলেন মহাভারত। এই নামের মধ্যেই তখনকার আর্যজাতির একটি ঐক্য উপলব্ধির চেষ্টা বিশেষভাবে প্রকাশ পাইতেছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সংজ্ঞা অনুসারে মহাভারত ইতিহাস না হইতে পারে কিন্তু ইহা যথার্থই আর্যদের ইতিহাস। ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিবৃত্তান্ত। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি এই-সমস্ত জনশ্রুতিকে গলাইয়া পোড়াইয়া বিশ্লিষ্ট করিয়া ইহা হইতে তথ্যমূলক ইতিহাস রচনা করিবার চেষ্টা করিত তবে আর্যসমাজের ইতিহাসের সত্য স্বরূপটি আমরা দেখিতে পাইতাম না। মহাভারত সংগ্রহের দিনে আর্যজাতির ইতিহাস আর্যজাতির স্মৃতিপটে যেরূপ রেখায় আঁকা ছিল, তাহার মধ্যে কিছু-বা স্পষ্ট কিছু-বা লুপ্ত, কিছু-বা সুসংগত কিছু-বা পরস্পরবিরুদ্ধ, মহাভারতে সেই সমস্তেরই প্রতিলিপি একত্র করিয়া রক্ষিত হইয়াছে।
এই মহাভারত কেবল যে নির্বিচারে জনশ্রুতি সংকলন করা হইয়াছে তাহাও নহে। আতস-কাচের এক পিঠে যেমন ব্যাপ্ত সূর্যালোক এবং আর-এক পিঠে যেমন তাহারই সংহত দীপ্তিরশ্মি, মহাভারতেরও তেমনি এক দিকে ব্যাপক জনশ্রুতিরাশি আর-এক দিকে তাহারই সমস্তটির একটি সংহত জ্যোতি—সেই জ্যোতিটিই ভগবদ্গীতা। জ্ঞান কর্ম ও ভক্তির যে সমন্বয়যোগ তাহাই সমস্ত ভারত-ইতিহাসের চরমতত্ত্ব। নিঃসন্দেহই পৃথিবীর সকল জাতিই আপন ইতিহাসের ভিতর দিয়া কোনো সমস্যার মীমাংসা কোনো তত্ত্বনির্ণয় করিতেছে, ইতিহাসের ভিতর দিয়া মানুষের চিত্ত কোনো একটি চরম সত্যকে সন্ধান ও লাভ করিতেছে—নিজের এই সন্ধানকে ও সত্যকে সকল জাতি স্পষ্ট করিয়া জানে না, অনেকে মনে করে পথের ইতিহাসই ইতিহাস, মূল অভিপ্রায় ও চরম গম্যস্থান বলিয়া কিছুই নাই। কিন্তু ভারতবর্ষ একদিন আপনার সমস্ত ইতিহাসের একটি চরমতত্ত্বকে দেখিয়াছিল। মানুষের ইতিহাসের জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম অনেক সময়ে স্বতন্ত্রভাবে, এমন-কি, পরস্পর-বিরুদ্ধ-ভাবে আপনার পথে চলে, সেই বিরোধের বিপ্লব ভারতবর্ষে খুব করিয়াই ঘটিয়াছে বলিয়াই এক জায়গায় তাহার সমন্বয়টিকে স্পষ্ট করিয়া সে দেখিতে পাইয়াছে। মানুষের সকল চেষ্টাই কোনখানে আসিয়া অবিরোধে মিলিতে পারে মহাভারত সকল পথের চৌমাথার সেই চরম লক্ষ্যের আলোকটি জ্বালাইয়া ধরিয়াছে। তাহাই গীতা। এই গীতার মধ্যে যুরোপীয় পণ্ডিতেরা লজিকগত অসংগতি দেখিতে পান। ইহাতে সাংখ্য, বেদান্ত এবং যোগকে যে একত্রে স্থান দেওয়া হইয়াছে তাঁহারা মনে করেন সেটা একটা জোড়াতাড়া ব্যাপার—অর্থাৎ তাঁহাদের মতে ইহার মূলটি সাংখ্য ও যোগ, বেদান্তটি তাহার পরবর্তী কোনো সম্প্রদায়ের দ্বারা যোজনা করা। হইতেও পারে মূল ভগবদ্গীতা ভারতবর্ষের সাংখ্য ও যোগতত্ত্বকে আশ্রয় করিয়া উপদিষ্ট, কিন্তু মহাভারত সংকলনের যুগে সেই মূলের বিশুদ্ধতা-রক্ষাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না। সমস্ত জাতির চিত্তকে সমগ্র করিয়া এক করিয়া দেখাই তখনকার সাধনা ছিল। অতএব যে গ্রন্থে তত্ত্বের সহিত জীবনকে মিলাইয়া মানুষের কর্তব্যপথ নির্দেশ করা হইয়াছে সে গ্রন্থে বেদান্ততত্ত্বকে তাঁহারা বাদ দিতে পারেন নাই। সাংখ্যই হউক যোগই হউক বেদান্তই হউক সকল তত্ত্বেরই কেন্দ্রস্থলে একই বস্তু আছেন, তিনি কেবলমাত্র জ্ঞান বা ভক্তি বা কর্মের আশ্রয় নহেন, তিনি পরিপূর্ণ মানবজীবনের পরমাগতি, তাঁহাতে আসিয়া না মিলিলে কোনো কথাই সত্যে আসিয়া পৌঁছিতে পারে না, অতএব ভারতচিত্তের সমস্ত প্রয়াসকেই সেই এক মূল সত্যের মধ্যে এক করিয়া দেখাই মহাভারতের দেখা। তাই মহাভারতের এই গীতার মধ্যে লজিকের ঐক্যতত্ত্ব সম্পূর্ণ না থাকিতেও পারে কিন্তু তাহার মধ্যে বৃহৎ একটি জাতীয় জীবনের অনির্বচনীয় ঐক্যতত্ত্ব আছে। তাহার স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতা, সংগতি ও অসংগতির মধ্যে গভীরতম এই একটি উপলব্ধি দেখা যায় যে, সমস্তকে লইয়াই সত্য, অতএব এক জায়গায় মিল আছেই। এমন-কী, গীতায় যজ্ঞকেও সাধনাক্ষেত্রে স্থান দিয়াছে। কিন্তু গীতায় যজ্ঞব্যাপার এমন একটি বড়ো ভাব পাইয়াছে যাহাতে তাহার সংকীর্ণতা ঘুচিয়া সে একটি বিশ্বের সামগ্রী হইয়া উঠিয়াছে। যে-সকল ক্রিয়াকলাপে মানুষ আত্মশক্তির দ্বারা বিশ্বশক্তিকে উদবোধিত করিয়া তোলে তাহাই মানুষের যজ্ঞ। গীতাকার যদি এখনকার কালের লোক হইতেন তবে সমস্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিক অধ্যবসায়ের মধ্যে তিনি মানুষের সেই যজ্ঞকে দেখিতে পাইতেন। যেমন জ্ঞানের দ্বারা অনন্ত জ্ঞানের সঙ্গে যোগ, কর্মের দ্বারা অনন্ত মঙ্গলের সঙ্গে যোগ, ভক্তির দ্বারা অনন্ত ইচ্ছার সঙ্গে যোগ, তেমনি যজ্ঞের দ্বারা অনন্ত শক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ—এইরূপে গীতায় ভূমার সঙ্গে মানুষের সকল প্রকারের যোগকেই সম্পূর্ণ করিয়া দেখাইয়াছেন—একদা যজ্ঞকাণ্ডের দ্বারা মানুষের যে চেষ্টা বিশ্বশক্তির সিংহদ্বারে আঘাত করিতেছিল গীতা তাহাকেও সত্য বলিয়া দেখিয়াছে।
এইরূপে ইতিহাসের নানা বিক্ষিপ্ততার মধ্য হইতে তখনকার কালের প্রতিভা যেমন একটি মূলসূত্র খুঁজিয়া বাহির করিয়াছিল তেমনি বেদের মধ্য হইতেও তাহা একটি সূত্র উদ্ধার করিয়াছিল তাহাই ব্রহ্মসূত্র। তখনকার ব্যাসের এও একটি কীর্তি। তিনি যেমন এক দিকে ব্যষ্টিকে রাখিয়াছেন আর-এক দিকে তেমনি সমষ্টিকেও প্রত্যক্ষগোচর করিয়াছেন, তাঁহার সংকলন কেবল আয়োজনমাত্র নহে তাহা সংযোজন, শুধু সঞ্চয় নহে তাহা পরিচয়। সমস্ত বেদের নানা পথের ভিতর দিয়া মানুষের চিত্তের একটি সন্ধান ও একটি লক্ষ্য দেখিতে পাওয়া যায়—তাহাই বেদান্ত। তাহার মধ্যে একটি দ্বৈতেরও দিক আছে একটি অদ্বৈতেরও দিক আছে কারণ এই দুইটি দিক ব্যতীত কোনো একটি দিকও সত্য হইতে পারে না। লজিক ইহার কোনো সমন্বয় পায় না, এইজন্য যেখানে ইহার সমন্বয় সেখানে ইহাকে অনির্বচনীয় বলা হয়। ব্যাসের ব্রহ্মসূত্রে এই দ্বৈত অদ্বৈত দুই দিককেই রক্ষা করা হইয়াছে। এইজন্য পরবর্তীকালে এই একই ব্রহ্মসূত্রকে লজিক নানা বাদ-বিবাদে বিভক্ত করিতে পারিয়াছে। ফলত ব্রহ্মসূত্রে আর্যধর্মের মূলতত্ত্বটি-দ্বারা সমস্ত আর্যধর্মশাস্ত্রকে এক আলোকে আলোকিত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। কেবল আর্যধর্ম-কেন সমস্ত মানবের ধর্মের ইহাই এক আলোক।”
”আমরা এই যে মহাভারতের কথা এখানে আলোচনা করিলাম ইহাকে কেহ যেন কালগত যুগ না মনে করেন— ইহা ভাবগত যুগ, অর্থাৎ আমরা কোনো একটি সংকীর্ণ কালে ইহাকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিতে পারি না। বৌদ্ধযুগের যথার্থ আরম্ভ কবে তাহা সুস্পষ্টরূপে বলা অসম্ভব। শাক্যসিংহের বহু পূর্বেই যে তাহার আয়োজন চলিতেছিল এবং তাঁহার পূর্বেও যে অন্য বুদ্ধ ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহা একটি ভাবের ধারাপরম্পরা যাহা গৌতমবুদ্ধে পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। মহাভারতের যুগও তেমনি কবে আরম্ভ তাহা স্থির করিয়া বলিলে ভুল বলা হইবে।”
প্রাচীন ভারতবর্ষের মানুষ দেশের ইতিহাস রচনার ব্যাপারে মোটেই যত্নবান ছিলেন না আর তাই আমাদের দেশের প্রাচীনযুগের কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। অত্যন্ত দীর্ঘ এই প্রবন্ধে কবি রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীগুলোকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন আর প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের হারানো সূত্রগুলোকে ধরবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য তাঁর বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই একমত হবেন এটা আশা করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তসমূহ যে প্রধান স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেটি হোলো আর্য অনুপ্রবেশ (Aryan Invasion) তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে সব ঐতিহাসিক সমর্থন করেন না। তাঁরা বলেন যে এই আর্য অনুপ্রবেশের তত্ত্ব ইউরোপীয়ানদের সৃষ্ট ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাচীনত্বকে খর্ব করার জন্য। এছাড়া আরো অনেক মতানৈক্যের জায়গা আছে। এই লেখাটি প্রকাশের পর বেশ একটু হৈ চৈ হয়েছিল। কবির জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেও মহাদেবের আদিম পীঠস্থান যে দক্ষিণ ভারতে, এটা মেনে নিতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন (সুলভ নবম খণ্ড, পৃ. ৭২৩)। এ ছাড়াও এই লেখার অনেক বিরুদ্ধ সমালোচনা বের হয়েছিল। জনৈক শশীভূষণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্য পত্রিকাতে চার কিস্তিতে (জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, ভাদ্র, আশ্বিন, ১৩১৯) সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ’। সমালোচকের মতে ভাষার জটিলতায় ও মোহিনী কল্পনার বাহুল্যে এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বিফল এবং সিদ্ধান্ত ভ্রান্তপথে পরিচালিত হয়েছে। রবিবাবুর কল্পনা নিতান্ত শাস্ত্র বিরুদ্ধ ও প্রমাণবিরুদ্ধ যার বশে তাঁর সিদ্ধান্ত হয়েছে যে শিব অনার্যের দেবতা আর বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের বিবাদ হলো ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের বিবাদ। বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র দুজনেই ব্রাহ্মণ ছিলেন (বিশ্বামিত্র প্রথমে ক্ষত্রিয়, পরে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিলেন)। রামায়ণ-মহাভারতের সবকিছুই রূপক—এটা মেনে নিতেও অনেকেই আপত্তি করবেন।
উদ্ধৃতিগুলি অনেক বেশি হয়ে গেল। আসলে আমি বড়রকম কোন কাটছাঁট করতে চাইনি। যে অননুকরণীয় ভাষা এবং অনবদ্য বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধের সম্পদ সেগুলো রক্ষা পেত না যদি আমি কবির বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত করে আমার কথা এর মধ্যে চালিয়ে দিতাম।
‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে মহাভারতের কথা, রামচন্দ্রের কথা, শ্রীকৃষ্ণের কথা এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা এবং বর্তমান হিন্দুসভ্যতা এক জিনিস নয়। সময়, সামাজিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীক ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে হিন্দুসমাজের মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন ঘটে গেছে। ”একদিন এই হিন্দুসমাজ সজীব ছিল, … তখন তাহার আচার-ব্যবহার যে চিরকালের মতো লোহার ছাঁচে ঢালাই করা ছিল না মহাভারত পড়িলে পাতায় পাতায় তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই বৃহৎ বিচিত্র, জীবনের বেগে চঞ্চল, জাগ্রত চিত্তবৃত্তির তাড়নায় নব নব অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত হিন্দুসমাজ—যে সমাজ ভুলের ভিতর দিয়া সত্যে চলিয়াছিল, … যে সমাজের এক মহাপুরুষ একদিন অনার্যদিগকে মিত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন, আর এক মহাপুরুষ কর্মের আদর্শকে বৈদিক যাগযজ্ঞের সংকীর্ণতা হইতে উদ্ধার করিয়া উদার মনুষত্বের ক্ষেত্রে মুক্তিদান করিয়াছিলেন এবং ধর্মকে বাহ্য অনুষ্ঠানের বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ না করিয়া তাহাকে ভক্তি ও জ্ঞানের প্রশস্ত পথে সর্বলোকের সুগম করিয়া দিয়াছিলেন, সেই সমাজকে আজ আমরা হিন্দুসমাজ বলিয়া স্বীকার করিতেই চাই না—যাহা চলিতেছে না তাহাকে আমরা হিন্দুসমাজ বলি।”
এই পরিচয় গ্রন্থে ‘ছবির অঙ্গ’ নামে একটা প্রবন্ধ আছে। এই প্রবন্ধে কবি ছবির ছয় অঙ্গের কথা বলেছেন—রূপভেদ, প্রমাণ, ভাব, লাবণ্য, সাদৃশ্য ও বর্ণিকাভঙ্গ। এই কথা বলতে গিয়ে কবি বলেছেন—স্বয়ং দ্রৌপদীকে যে ছাড়াইয়া গেল (দ্রৌপদীর পাঁচস্বামী আর ছবির ছয় অঙ্গ—এটাই সম্ভবত কবি এখানে বুঝিয়েছেন)।
এই গ্রন্থের ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন যে বর্ষা ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু। ”কেননা কবি গীতার উপদেশকে ছাড়াইয়া গেছে। তাহার কর্মেও অধিকার নাই, ফলেও অধিকার নাই। তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে, কর্ম হইতে ছুটি, ফল হইতে ছুটি।”
‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ একটি ছোট লেখা। এখানে মহাভারতের প্রসঙ্গ কিছু কিছু আছে। এক জায়গায় কবি লিখেছেন —”অভিমন্যু মায়ের গর্ভেই ব্যৃৃহে প্রবেশ করিবার বিদ্যা শিখিল, বাহির হইবার বিদ্যা শিখিল না, তাই সে সর্বাঙ্গে সপ্তরথীর মারটা খাইয়াছে। আমরাও জন্মিবার পূর্ব হইতেই বাঁধা পড়িবার বিদ্যাটাই শিখিলাম, গাঁঠ-খুলিবার বিদ্যাটা নয়, তারপর জন্মমাত্রই বুদ্ধিটা হইতে শুরু করিয়া চলাফেরাটা পর্যন্ত পাকে পাকে জড়াইলাম, আর সেই হইতেই জগতে যেখানে যত রথী আছে, এমন কী পদাতিক পর্য্যন্ত সকলের মার খাইয়া মরিতেছি।”
এই গ্রন্থের একটি জায়গায় বলা হয়েছে (সুলভ ৯ম খণ্ড, পৃ. ৬৫৩) —”গাছতলায় বসিয়া জ্ঞানী বলিতেছে, ‘যে মানুষ আপনাকে সর্বভূতের মধ্যে ও সর্বভূতকে আপনার মধ্যে এক করিয়া দেখিয়াছে সেই সত্যকে দেখিয়াছে।” এই প্রসঙ্গে ঈশোপনিষদের এই মন্ত্রটা মনে আসে—
”যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।। ” (৬ সংখ্যক মন্ত্র)
তিনি সমুদয় বস্তুই আত্মাতে এবং সমুদয় বস্তুতেই আত্মাকে দেখেন, তিনি কাহাকেও ঘৃণা করেন না।
এর সমার্থক শ্লোক গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে রয়েছে :
”সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।”
(নিজেকে সর্বজীবে সমদর্শী হইয়া আত্মাকে সর্বভূতস্থিত দেখেন, আর সর্বভূতকে আত্মাতে সমদর্শন করেন— ২৯ সংখ্যক শ্লোক)। ৩০ সংখ্যক শ্লোকটিও দেখা যেতে পারে)
এই লেখাতেই মহাভারতের দ্রোণাচার্য্য ও একলব্যের কথা বলা হয়েছে। নিষাদপুত্র একলব্যের গুরুভক্তি অসাধারণ, কিন্তু গুরু দ্রোণাচার্য্য স্বার্থান্ধ ও নিষ্ঠুর। একলব্য কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে এসেছিল কিন্তু নীচজাতি বলে দ্রোণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন একলব্য গুরু দ্রোণের মৃন্ময় মূর্তি তৈরি করে তাঁর সামনে ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করতে শুরু করলো এবং সময়ে বিপুল পারদর্শিতা অর্জন করলো। দ্রোণ অর্জুনকে কথা দিয়েছিলেন যে অর্জুনই হবেন দ্রোণাচার্যোর শ্রেষ্ঠ শিষ্য। কিন্তু যখন একলব্যের অস্ত্রশিক্ষার ব্যাপারটা নজরে এল, তখন দেখা গেল যে, সে ধনুর্বিদ্যায় অর্জুন অপেক্ষা অধিকতর পারদর্শী। সে যেন অর্জুনকে অতিক্রম করতে না পারে এই জন্য গুরু দ্রোণ একলব্যের কাছে নির্লজ্জভাবে গুরুদক্ষিণা চাইলেন—তার দক্ষিণ হস্তের একটি আঙ্গুল। একলব্য কোনো দ্বিধা না করে সেই দক্ষিণা প্রদান করলো যদিও সে জানতো যে এর ফলে তীরন্দাজ হিসাবে তার দক্ষতা ভীষণভাবে হ্রাস পাবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”একলব্য পরম নিষ্ঠুর দ্রোণাচার্য্যকে তার বুড়া আঙ্গুল কাটিয়া দিল, কিন্তু এই অন্ধ নিষ্ঠার দ্বারা সে নিজের চিরজীবনের তপস্যাফল হইতে তার সমস্ত আপনজনকে বঞ্চিত করিয়াছে।”
জীবনস্মৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলায় পিতার সঙ্গে হিমালয় যাত্রার কথা বলেছেন। সেই ভ্রমণকালে দেবেন্দ্রনাথ ছোট রবিকে ভগবদগীতার কিছু শ্লোক কপি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ লেখবার বহু পরে কবি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন—’আশ্রমবিদ্যালয়ের সূচনা’। এই প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ গীতার শ্লোক কপি করার কথা উল্লেখ করেছেন। (সুলভ ৯ম খণ্ড, পৃ. ৬৯৫)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন