সুলভ সংস্করণের পঞ্চম খন্ডে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি স্থান পেয়েছে—
কবিতা ও গান – শিশু, উৎসর্গ ও খেয়া ;
নাটক – প্রায়শ্চিত্ত ও রাজা ;
উপন্যাস – যোগাযোগ ও শেষের কবিতা ;
প্রবন্ধ – আধুনিক সাহিত্য, পরিশিষ্ট, রাজা প্রজা, সমূহ, পরিশিষ্ট; এবং গ্রন্থপরিচয় অংশ।
উপরোক্ত গ্রন্থসমূহের মধ্যে একমাত্র খেয়া কাব্যগ্রন্থে রামায়ণ বা মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ আমার চোখে পড়েনি। অন্য সব গ্রন্থেই অল্প-বিস্তর রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে।
শিশু : — খোকার যত কথা সব তো মায়ের সঙ্গে। বনবাস কবিতায় (সুলভ—৫ম;পৃ-৩৫) খোকা মাকে বলছে—
”বাবা যদি রামের মতো
পাঠায় আমায় বনে,
যেতে আমি পারি নে কি
তুমি ভাবছ মনে ?
চোদ্দ বছর ক’ দিনে হয়
জানি নে মা ঠিক,
দন্ডক বন আছে কোথায়
ওই মাঠে কোন দিক।
কিন্তু আমি পারি যেতে,
ভয় করিনে তাতে —
লক্ষ্মন ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে ।”
খোকা চৌদ্দ বৎসর কতদিনে হয় সেটা এখনো ঠিক জানেনা। দন্ডকবন যে কোথায় সেটাও সে জানে না; তবুও তার বনে যেতে ভয় নেই। তার একটাই কথা লক্ষ্মণ ভাইকে সঙ্গে থাকতে হবে। বনে গিয়ে রাক্ষসদেরকে সে ভয় করবেনা কারণ সে তো সেখানে গুহক মিতাকে পাবে। রাবণও তার কিছু করবে না, কারণ খোকার সঙ্গে তো সীতাই থাকছে না। অন্য সব কিছুই খোকা সামলে নেবে শুধু লক্ষ্মণ ভাইকে তার দরকার । আর মায়ের কাছেই খোকার আবদার —
‘মা গো আমায় দে-না কেন
একটি ছোটো ভাই —
দুই জনেতে মিলে আমরা
বনে চলে যাই!’
বোঝাই যাচ্ছে মায়ের কাছে রামায়ণের গল্প খোকা ভালোই শুনেছে।
লুকোচুরি কবিতায় মহাভারতের কথা সামান্য একটু।
খোকা মাকে বলছে —
”দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,”
উৎসর্গ : ২৩ সংখ্যক কবিতাতে রয়েছে —
”রাজহংস এসেছিল কোন যুগান্তরে
শুনেছি পুরাণে।
দময়ন্তী আলবালে
স্বর্ণঘটে জল ঢালে
নিকুঞ্জবিতানে,
কার কথা হেনকালে
কহি গেল কানে –
শুনেছি পুরাণে।”
এটি মহাভারতের নল-দময়ন্তীর কথা। বিদর্ভ-রাজকন্যা দময়ন্তী পরমাসুন্দরী। কাশীরামদাসের মহাভারতে আছে যে দময়ন্তীর সখীরা তার কাছে ‘নিরবধি বাখানে নলের রূপ গুণ।” এদিকে নল রাজাও দময়ন্তীর কথা খুব শুনেছেন।
”দময়ন্তী চিন্তাতে নলের মগ্ন মন। কত দিনে দেখ তার দৈবের ঘটন।।
অন্তঃপুর উদ্যানে বিহরে দুঃখমতি। জলতটে হংস এক দেখে নরপতি।।”
নল সেই হংসকে ধরলেন। হংস তখন নলকে বললো যে নলরাজা যদি তাকে ছেড়ে দেন তবে সে নলের প্রীতিকার্য্য করবে, দময়ন্তীর সঙ্গে মিলন করিয়ে দেবে। নল হংসকে ছেড়ে দিলে হংস অন্তরীক্ষ পথে বিদর্ভ রাজের অন্তঃপুরে সরোবরে পোঁছালো। দময়ন্তীকে সে নলরাজার কথা বললো ”যদি ভাগ্যে থাকে, তব ভর্ত্তা হবে নল।”
প্রায়শ্চিত্ত : এটি ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। কবি অবশ্য বলেছেন ‘মূল উপন্যাসখানির অনেক পরিবর্তন হওয়াতে এই নাটকটি প্রায় নূতন গ্রন্থের মতোই হইয়াছে।’ যশোহরের মহারাজ প্রতাপাদিত্য ( আকবরের সময়ে বাংলার বিখ্যাত বারো ভুঁইয়ার একজন) — তাঁর পুত্র উদয়াদিত্য এবং পুত্রবধূ সুরমা। উদয়াদিত্যের মধ্যে মানবিক গুণসমূহ যথেষ্ট পরিমাণে আছে যেটা আবার মহারাজ পছন্দ করেন না। উদয়াদিত্যকে একটা পরগণা শাসনের ভার দিয়েছিলেন মহারাজ, কিন্তু তার শাসনপদ্ধতি প্রতাপাদিত্যের পছন্দ হয়নি। তিনি উদয়াদিত্যকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। সুরমা কিন্তু তাঁর স্বামীকে খুবই ভালোবাসেন। সুরমা বলছেন যে রাজপুত্রকে রাজসভা চিনল না, কিন্তু সুরমা তাকে চেনেন আর তাই তিনি রাজকুমারকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করবেন।
”রামচন্দ্র যেমন ভুলেছিলেন তিনি অবতার, তোমারও সেই দশা হয়েছে।
কিন্তু ভক্তকে ভোলাতে পারবে না।” ( সুলভ- ৫, পৃঃ ২১৫)
একটু পরেই সুরমা বলছেন — আগুনের পরীক্ষাতেও সীতার চুল
পোড়েনি। তুমি রাজভার বহনের উপযুক্ত নও, একথা কি বললেই হল?”
সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা রামায়ণে আছে। লঙ্কার রাজা রাবণ এবং তাঁর সৈন্যসামন্তদের বধ করে রামচন্দ্র বন্দিনী সীতার উদ্ধার করেছিলেন কিন্তু সীতাকে যখন রামচন্দ্রের কাছে আনা হলো, তখন রামচন্দ্র সীতার চরিত্রে সন্দিহান হয়ে তাঁকে গ্রহণে অস্বীকৃত হলেন। সীতাদেবী তখন অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চাইলেন কিন্তু তাঁর সতীত্বের প্রভাবে আগুন তাঁকে স্পর্শ করলো না— তিনি অক্ষত অবস্থায় অগ্নিকুন্ড থেকে বেরিয়ে এলেন।
মহাভারতের কথা প্রায়শ্চিত্ত নাটকের আরো এক জায়গায় আছে। প্রতাপাদিত্যের পিতৃব্য বসন্ত রায় দিল্লীর মোগল সম্রাটের অধীনতা মেনে নিয়েছিলেন। এই অপরাধে প্রতাপদিত্য তাঁর নিজের পিতৃব্যকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ মন্ত্রীর পছন্দ হয়নি। মন্ত্রী তার আপত্তির কথা রাজা প্রতাপাদিত্যকে বলেছিলেন। মন্ত্রীর কথার উত্তরে প্রতাপাদিত্য বললেন —
”পিতার অনুরোধে ভৃগু তাঁর মাকে বধ করেছিলেন, আর ধর্মের অনুরোধে আমি আমার পিতৃব্যকে কেন বধ করব না?”
এই ভৃগু হচ্ছেন ভৃগুরাম বা পরশুরাম, তাঁর মাতৃবোধের কাহিনী কাশীরাম দাসের মহাভারতে আছে। একদিন পরশুরামের পিতা জমদগ্নি তাঁর স্ত্রীর (পরশুরামের মা) কাজে সামান্য ত্রুটি হওয়াতে ক্রুদ্ধ হ’ন এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে আদেশ করেন মাতাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু মাতৃবধ মহাপাপ বিবেচনায় জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং তার পরের ভাইয়েরা পিতৃ আদেশ পালনে অস্বীকৃত হন। তখন জমদগ্নির আদেশে তাঁর কনিষ্ঠপুত্র পরশুরাম মাতাকে হত্যা করেন। পরে অবশ্য তিনি প্রসন্ন পিতার কাছে মাতার পুনর্জীবনের বর প্রার্থনা করেন এবং মাতা জীবিতা হ’ন।
‘রাজা’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথের এক অনবদ্য সৃষ্টি। অনেক রসিক এবং বিদগ্ধ মানুষই একবাক্যে স্বীকার করেন যে বাংলা সাহিত্য তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যেও ‘রাজা’ নাটকের মতো symbolic Drama খুব কমই আছে। এই রাজা নাটকে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ নেই বললেই হয়, শুধু একটি গানের মধ্যে একটু ইঙ্গিত আছে। এই নাটকের ঠাকুরদা একজন সদানন্দময় পুরুষ। লোকে বলে তিনি নাকি রাজার বন্ধু। বসন্ত উৎসবে ঠাকুরদা বেরিয়েছেন পথে তার চেলাদের নিয়ে, গানে—নাচে সবাইকে মাতিয়ে দিতে। ঠাকুরদার এক চেনা ‘পাগল’ গাইছে এই গানটি :
”তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার সোনার হরিণ চাই।
সেই মনোহরণ চপল-চরণ
সোনার হরিণ চাই।
সে যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়
যায় না তারে বাঁধা।
তার নাগাল পেলে পালায় ঠেলে
লাগায় চোখে ধাঁধা।” ইত্যাদি।
সোনার হরিণের কথা রামায়ণে আছে। সোনার হরিণ বাস্তবে সম্ভব নয়।
এটা জেনেও যে সেই অসম্ভবের পিছনে ছোটে তাকে পরিণামে দুঃখ পেতে হয়।
রামচন্দ্র তখন পত্নী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসে আছেন— দন্ডকবনে তাঁর পর্ণকুটির। ভগিনীর অপমানে ক্রুদ্ধ হয়ে লঙ্কার রাজা দশানন রাবণ এসেছেন দন্ডকবনে—সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাবেন। কিন্তু রামলক্ষ্মণ—দু’জনেই মহাবীর, তাদের সাক্ষাতে সীতাকে হরণ করা সম্ভব নয়। রাবণ তার অনুচর মারীচকে বললেন মৃগরূপ ধরে সে রামকে প্রলুব্ধ করে দূরে নিয়ে যাক। তাহলেই রাবণ সীতাকে হরণ করতে পারবেন। মারীচ রাবণকে অনেক বোঝালেন এ কাজ না করতে কিন্তু রাবণ শুনলেন না। শুনলে এত কান্ডকারখানা কিছুই হতো না, রামায়ণ রচনারই কোন প্রয়োজন হতো না। যাইহোক, রাবণের কথামত মারীচ সুবর্ণকান্তি অত্যন্ত সুন্দর হরিণের রূপ ধারণ করলো এবং শ্রীরামের কুটিরের সামনে দিয়ে যেতে লাগলো। সুন্দর হরিণটি দেখে সীতাদেবী রামকে অনুরোধ করলেন সেই হরিণকে এনে দিতে। সীতার অনুরোধে লক্ষ্মণকে রেখে রাম চললেন হরিণ ধরতে, মায়াবী-হরিণ কখনো দেখা দেয়, কখনো দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায়। এইভাবে অনেক দূর যাবার পর রাম হরিণকে আঘাত করতে পারলেন। মৃত্যুর সময় মারীচ রাবণের উপকার করে গেল। সে রামের গলার স্বর নকল করে লক্ষ্মণকে ডাকতে লাগলো। রামের বিপদ হয়েছে মনে করে সীতাদেবী লক্ষ্মণকে রামের সাহায্যে যেতে বললেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সীতার কটুক্তিতে বাধ্য হয়ে লক্ষ্মণ বেরোলেন আর সীতাকে একা পেয়ে রাবণ তাঁকে হরণ করে নিয়ে গেলেন। স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্র আর সাক্ষাৎ লক্ষ্মীস্বরূপা সীতাদেবীও মায়ামৃগের ছলনাতে ভুললেন। এটা এখনকার দিনেও সত্য। আমারা অনেকেই জেনেশুনে মায়ামৃগের পিছনে ছুটছি।
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ অনেক জায়গাতেই আছে। আগে এই উপন্যাসটির নাম ছিল ‘তিনপুরুষ’, পরে নাম পাল্টে ‘যোগাযোগ’ রাখা হয়। মধুসূদন ঘোষালের বড়লোক হওয়ার পিছনে ভাগ্যের সহায়তা ছিল। তবে সে উদ্যোগী পুরুষ, আর উদ্যোগীদের যে ভাগ্যদেবী সহায়তা করেন এটা জানা কথা। তার বৈষয়িক উন্নতির কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে—’ ব্যবসা হু হু করে এগোল গলি থেকে সদর রাস্তায়, খুচরো থেকে পাইকিরিতে, দোকান থেকে আপিসে, উদযোগ পর্ব থেকে স্বর্গারোহণে। উদযোগ, স্বর্গারোহণ— এগুলো মহাভারতের কথা। অষ্টাদশপর্ব মহাভারতে পঞ্চমপর্ব হচ্ছে উদযোগপর্ব বা উদ্যোগপর্ব আর স্বর্গারোহণ পর্ব হচ্ছে শেষপর্ব।
বিপ্রদাসের বোন কুমুদিনীর সঙ্গে মধুসূদনের বিবাহের কথা হয়েছে। বিপ্রদাসের অবস্থা একেবারেই পড়তির দিকে কিন্তু তাদের আভিজাত্য আছে। বাপ-মা মরা বোন কুমুদিনীকে সে সেইভাবেই বড় করেছে। কিন্তু মধুসূদনকে নিয়ে নানারকম কথা কানে আসে। এ বিয়েটা ভালো হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বিপ্রদাস কুমুদিনীকে এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাম-সীতা, মহাদেব-সতী ও বশিষ্ঠ-অরুন্ধতীর কথা টেনে এনেছে— ”দুই পক্ষের সততায় তবেই বিবাহবন্ধন সত্য। সুরে-বাঁধা এসরাজের কোনো মানেই থাকে না যদি বাজাবার হাতটা হয় বেসুরো। পুরাণে দেখ না, যেমন সীতা তেমনি রাম, যেমন মহাদেব তেমনি সতী, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠও তেমনি। ” ( সুলভ-৫ম, পৃ- ৩৪১)
কুমুদিনীর কেমন যেন একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে মধুসূদনের সঙ্গে তার বিয়েটা হবেই। এটা দৈবনির্বন্ধ, এর আর কোনো নড়চড় নেই। আর সে বুঝদার মেয়ে, দাদা বিপ্রদাসের আর্থিক অসঙ্গতির কথাটাও সে বোঝে। তাই মধুসূদনের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধটা ভেঙে দেওয়ার পক্ষে সে মত দিল না। আর গীতার বিখ্যাত সেই শ্লোকটির কথাও তার মনে পড়লো— ”দুঃখেষ্বনু-দ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ বীত রাগ ভয়ক্রোধঃ — ” (পৃ-৩৪১)
সম্পূর্ণ শ্লোকটি আছে শ্রী শ্রী গীতার সাংখ্য যোগ : বা দ্বিতীয় অধ্যায়ে—
”দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগত স্পৃহঃ।
বীতরাগভয় ক্রোধঃ স্থিতধি মুনিরুচ্যতে।।”
এই শ্লোকটিতে স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষের লক্ষণ বলা হয়েছে। দুঃখে যিনি উদ্বিগ্ন হ’ন না, সুখে যিনি বিগতস্পৃহ বা স্পৃহাশূন্য; যার মধ্যে ভয় বা ক্রোধ কিছুমাত্র নেই, তাঁকেই স্থিতপ্রজ্ঞ বলা যায়। শুধুমাত্র এই কয়েকটি নয়, স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষের আরো লক্ষণ আছে এবং সেগুলোও গীতাতে বলা হয়েছে।
৩৪৩ পৃষ্ঠাতে মধুসূদনের দলবলের কান্ডকারখানা নিয়ে বিপ্রদাসকে জানানো হচ্ছে। ”সঙ্গে গোটাকতক সাহেব-দালাল হবে, কিংবা মদের দোকানের বিলিতি শুঁড়ি — কাল পীরপুরের চরের থেকে কিছু না হবে তো দুশো কাদাখোঁচা পাখী মেরে নিয়ে উপস্থিত। আজ চলেছে চন্দনদহের বিলে। এই শীতের সময় সেখানে হাঁসের মরসুম—রাক্ষুসে ওজনের জীবহত্যা হবে —অহিরাবণ মহীরাবণ হিড়িম্বা ঘটোৎকচ ইস্তক কুম্ভকর্ণের পর্য্যন্ত পিন্ডি দেবার উপযুক্ত, প্রেতলোকে দশমুন্ড রাবণের চোয়াল ধরে যাবার মতো।”
মহীরাবণ, অহিরাবণ, কুম্ভকর্ণ, রাবণ এরা সব রামায়ণের চরিত্র আর হিড়িম্বা ও ঘটোৎকচ মহাভারতের চরিত্র— মহীরাবণ রাবণের পুত্র, অহিরাবণ মহীরাবণের পুত্র, কুম্ভকর্ণ রাবণের ভাই, হিড়িম্বা ভীমের অনার্য্যা পত্নী— রাক্ষসবংশজাতা আর মহাবীর ঘটোৎকচ হচ্ছে ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র।
৩৪৪ পৃষ্ঠাতে বিবাহ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। ”অবশেষে জনসাধারণকে খাওয়ানো নিয়ে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের দ্রোণপর্ব শুরু হল।” মহাভারতের অষ্টাদশপর্বের একটা পর্ব হলো দ্রোণপর্ব। এই পর্বেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তীব্রতম হয়ে উঠেছিল।
বিবাহ হয়ে গেছে, কুমুদিনী মধুসূদনের ঘরে এসেছে, কিন্তু মধুসূদনের ব্যবহারে কুমুর মনের সুর কাটতে শুরু করেছে। ”দময়ন্তী কী করে আগে থাকতে জেনেছিলেন যে, বিদর্ভরাজ নলকেই বরণ করে নিতে হবে। তাঁর মনের ভিতর নিশ্চিত বার্তা এসে পৌঁছেছিল — তেমনি নিশ্চিত বার্তা কি কুমু পায়নি?” নল-দময়ন্তী মহাভারতের চরিত্র, তাঁদের প্রসঙ্গ নিয়ে আগে আলোচনা করা হয়েছে।
নবীন হচ্ছে মধুসূদনের ছোট ভাই আর মোতির মা হলো নবীনের স্ত্রী।
এরা মধুসূদনের থেকে অনেক আলাদা। মধুসূদনের মধ্যে শুধুই অহঙ্কার—টাকার অহঙ্কার, ক্ষমতার অহঙ্কার। তুলনায় নবীন এবং মোতির মা অনেক ভালমানুষ। মোতির মা কুমুকে দেখেই তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। কুমুর দাদা বিপ্রদাসকে আগে একবার দেখেছিল মোতির মা। দেখেই তার মনে হয়েছিল ”যেন মহাভারত থেকে ভীষ্ম নেমে এলেন। (পৃ-৩৫৮) মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে ভীষ্মের চরিত্র মনে হয় রবীন্দ্রনাথের বেশ প্রিয়।
স্বামীর বাড়ীতে কুমুদিনীর কিছুই মনের মতো হচ্ছে না। তার স্বামীর রুচি এত স্থূল এবং স্বভাব এত ক্রুর যে কুমুদিনী কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। মোতির মাকে সে জিজ্ঞেস করছে— ”একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আজ থেকে আমার নিজের বলে কিছুই রইল না।” মোতির মা —
”না, রইল না। যা কিছু রইল তা স্বামীর মর্জির উপরে। জান না, চিঠিতে দাসী বলে দস্তখত করতে হবে?”
”দাসী ! মনে পড়ল রঘুবংশের ইন্দুমতীর কথা —
গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ
প্রিয় শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ—
ফর্দের মধ্যে দাসী তো কোথাও নেই। সত্যবানের সাবিত্রী কি দাসী? কিংবা উত্তররামচরিতের সীতা?” — সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী মহাভারতে আছে। সাবিত্রী তাঁর অতুলনীয়া চরিত্র স্বামীভক্তি ইত্যাদির জন্য শ্বশুরবাড়ীতে অত্যন্ত আদরণীয়া ছিলেন। রামায়ণের সীতার কথা তো সকলেরই জানা। (সুলভ—-৫ম, পৃ-৩৬১)
কুমুদিনীর দাদা কুমুদিনীকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তাকে আশীর্বাদ জানিয়ে এবং আর একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটির মধ্যে গীতার এই শ্লোকটি লেখা ছিল— ”যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যৎ তপস্যসি, কৌন্তেয়, তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।” (পৃ-৩৬৪)
এটি গীতার নবম অধ্যায় অর্থাৎ রাজবিদ্যারাজগুহ্যযোগঃ অধ্যায়ের শ্লোক।
অর্জুনকে শ্রীভগবান বলছেন — হে অর্জুন তুমি যে যে কাজ কর যেমন ভোজন, হোম, দান, তপস্যা সে সবই আমাতে সমর্পণ কর।
দিন দিন কুমুর মন ধিক্কারে ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছে। তবু এর মধ্যেই তাকে থাকতে হচ্ছে। ”কুমু চোখ বুজে মনে মনে তাঁকে ( তার ইষ্টকে ) ডেকে বলে —তুমি তো বলেছ ‘যে মানুষ আমাকে সব জায়গায় দেখে, আমার মধ্যে সমস্তকে দেখে, সেও আমাকে ত্যাগ করে না, আমিও তাকে ত্যাগ করিনে। এই সাধনায় আমার যেন একটুও শৈথিল্য না হয়।” (পৃ- ৩৭৭)। কুমুর এই প্রার্থনাটি মনে হয় গীতার নিম্নলিখিত শ্লোকটির অনুসরণে—
‘যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।”
(ষষ্ঠ অধ্যায়; শ্লোকসংখ্যা- ৩০ )
সে দিবারাত্রি যে মন্ত্রটিকে সবসময় মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে চাইতো, সেটি শ্রী শ্রী গীতার একটি মন্ত্র (একাদশ অধ্যায়; বিশ্বরূপ দর্শন যোগ : মন্ত্র-৪৪) —
”তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ং
প্রসাদয়ে ত্বাম অহমীশমীড্যং।
পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যুঃ
প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্।। ”
‘হে আমার পূজনীয়, তোমার কাছে আমার সমস্ত শরীর প্রণত করে এই প্রসাদটি চাই যে, পিতা যেমন করে পুত্রকে, সখা যেমন করে সখাকে, প্রিয় যেমন করে প্রিয়াকে সহ্য করতে পারেন, হে দেব, তুমিও যেন আমাকে তেমনি করে সইতে পার। তুমি যে তোমার ভালোবাসায় আমাকে সহ্য করতে পার তার প্রমাণ এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, তোমার ভালোবাসায় আমিও সমস্ত ক্ষমা করতে পারি।’ (সুলভ-৫ম, পৃ- ৩৭৭)।
নবীন এবং মোতির মা যে কুমুদিনীকে একটু শ্রদ্ধা ও প্রীতির চোখে দেখে এটা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মধুসূদন এটা পছন্দ করে না। সে নবীনদের আর তার বাড়ীতে থাকতে দেবে না। নবীন তার স্ত্রীকে বলছে — ”লক্ষ্মণ দেওর হবার ভাগ্য আমার ঘটল না, এইটেই মনে বাজছে।” লক্ষ্মণ রামচন্দ্র এবং সীতাদেবীর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাসম্পন্ন এবং অনুগত ছিলেন। লক্ষ্মণ এবং সীতার মধ্যে যে দেবর-বৌদির সম্পর্ক সেটা প্রবাদ-প্রতিম হয়ে গেছে।
‘যোগাযোগ’ গ্রন্থখানিতে মিষ্টি খুনসুটি জাতীয় জিনিষ প্রায় নেইই। এইখানটাতে (পৃ-৩৯৭) একটুখানি আছে। নবীন, মোতির মা ও কুমুদিনী উপস্থিত। মোতির মা নবীনের একটা বই লুকিয়ে রেখেছে। নবীন কুমুদিনীর কাছে নালিশ করছে—
”উনি (মোতির মা —নবীনের স্ত্রী ) স্বামী জাতির এডুকেশনের বিরোধী। ………… অনেক করে বোঝালেম যে, এতবড়ো যে সীতা তিনিও রামচন্দ্রের পিছনে পিছনেই চলতেন, বিদ্যে বুদ্ধিতে আমি যে তোমার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে চলছি এতে বাধা দিয়ো না।”
কুমুর দাদা বিপ্রদাসবাবুকে মধুসূদন মোটেই পছন্দ করে না। মোতির মা’র সঙ্গে নবীনের কথা হচ্ছে। নবীন বলছে — ” ও-মানুষের ভক্তির প্রকাশ ঐরকমই। এই জাতের লোকেরাই ভিতরে ভিতরে যাকে শ্রেষ্ঠ বলে জানে বাইরে তাকে মারে। কেউ কেউ বলে রামের প্রতি রাবণের অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাই বিশ হাত দিয়ে নৈবেদ্য চালাত।” রামের প্রতি রাবণের ভক্তির কথা বুঝতে হলে একটু পুরানো কথা জানতে হবে। বৈকুন্ঠে নারায়ণের দ্বারী ছিল জয় আর বিজয়। একদিন তারা ব্রহ্মশাপগ্রস্ত হলো — মর্ত্যলোকে তাদেরকে জন্মগ্রহণ করতে হবে। তারা নারায়ণের কাছে কেঁদে পড়লো। তাদের বলা হলো যে তারা যদি মর্তে নারায়ণের শত্রুরূপে জন্মগ্রহণ করে তবে যুদ্ধে নারায়ণ তাদের বধ করবেন আর তিনজন্মে তাদের মুক্তি হবে। আর তারা যদি নারায়ণের ভক্ত হয়ে জন্মায়, তবে তাদের মুক্ত হতে অনেক বেশী জন্ম জাগবে। তারা তখন শত্রুরূপে জন্মানই পছন্দ করলো। তাদের প্রথম জন্ম হলো হিরণ্যাক্ষ-হিরণ্যকশিপুরূপে। নারায়ণ বরাহ অবতার ও নৃসিংহ অবতারে তাদের বধ করলেন। তাদের দ্বিতীয় জন্ম রাবণ-কুম্ভকর্ণরূপে আর রামচন্দ্রের হাতে তাদের মৃত্যু। তাদের তৃতীয় জন্ম দন্তবক্র -শিশুপাল রূপে আর শ্রীকৃষ্ণের হাতে তাদের মৃত্যু। রাবণ যে রামের ভক্ত তার একটু বর্ণনা কৃত্তিবাসের রামায়ণে আছে।
রাম-রাবণের যুদ্ধ অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছেছে। লঙ্কাপুরীতে বড় বীর আর কেউ বেঁচে নেই। রাবণ নিজেই এসেছেন যুদ্ধে—
”বাণ খেয়ে দশানন ভাবে মনে মন। যোড়হাতে স্তব করে শ্রীরামে তখন।।
হাতের ধনুক -বাণ ফেলে ভূমিতলে। কর যুড়ি করে স্তব বস্ত্র দিয়ে গলে।।
………………………………………………………………………………………….
কুড়ি চক্ষে বারিধারা বহে অনিবার। রাম বলে, না হইল সীতার উদ্ধার।।
কার্য্য নাই রাজপাটে পুনঃ যাই বনে। রাবণ পরম ভক্ত, মারিব কেমনে ।।”
নবীন আর তার স্ত্রীর মধ্যে কথা হচ্ছে (সুলভ-৫ম; পৃ-৪৪০)।
নবীন বলছে ”পণ করেছি, স্বর্গারোহণ কালে নরক দর্শন করে যাব, বউরানীর (কুমুদিনী) চরণে এই আমার দান।” স্বর্গারোহণকালে নরকদর্শন —এটা মহাভারতের ঘটনা।
চার ভাই এবং পত্নী দ্রৌপদীর রাস্তাতে পতন হলেও ধর্ম যাঁর জীবনের অঙ্গ, সেই যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে অল্পক্ষণের জন্য নরকদর্শন করতে হয়েছিল, কারণ তাঁর জীবনেও একটুখানি পাপ ছিল।
‘যোগাযোগ’ উপন্যাস শেষ হয়ে এলো। কুমুদিনী অনেকদিন দাদা বিপ্রদাসের কাছে ছিল —এখন সে স্বামীর বাড়ী যাচ্ছে যদিও সেটা তার আনন্দের ঘর নয়। যাবার আগে বিপ্রদাস তাকে আশীর্বাদ করছেন আর সেখানে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার কথা এসেছে। অবশ্য এই দুষ্মন্ত-শকুন্তলা কালিদাসের কাহিনী যদিও মূল কাহিনী মহাভারতেরই অংশ। শকুন্তলা যখন পতিগৃহে যাত্রা করেছিল, মাঝখানে তাকে দুঃখ অপমান পেতে হলেও পরিশেষে সে অচঞ্চল শান্তিতে পৌঁছেছিল। কুমুর জন্য বিপ্রদাসের সেই পরিপূর্ণতার আশীর্বাদ।
শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস। এই গ্রন্থে রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে সেরকম কোনো serious আলোচনা নেই; তবে casual conments কিছু আছে।
এই গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতে ফ্যাশান (fashion) আর স্টাইল (style) নিয়ে কথা বলতে ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ— আর শিবের কথা বলা হয়েছে।
”ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ একেবারে স্বর্গের ফ্যাশানদুরস্ত দেবতা, যাজ্ঞিক মহলে তাঁদের নিমন্ত্রণও জুটত। শিবের ছিল স্টাইল, এত ওরিজিন্যাল যে, মন্ত্রপড়া যজমানেরা তাঁকে হব্যগব্য দেওয়াটা বেদস্তুর বলে জানত।” ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, শিব—এঁরা সবাই পৌরাণিক দেবতা। রামায়ণ মহাভারত উভয় গ্রন্থেই এঁদের উল্লেখ বহু জায়গাতেই আছে।
এই উপন্যাসের নায়ক অমিতের ‘ মেয়েদের সম্বন্ধে ওর আগ্রহ নেই, উৎসাহ আছে। ‘ এখানে দেখা যাচ্ছে যে অমিত লিলির কাছে রয়েছে ( সুলভ – ৫ম, পৃ-৪৬১) । কথা প্রসঙ্গে শকুন্তলার কথা বলা হয়েছে। শকুন্তলা মহাভারতের চরিত্র, তবে কালিদাসও শকুন্তলাকে নিয়ে একটা নাটক লিখেছেন। ”কিন্তু লিলি, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে আমাতে মঙ্গলগ্রহের লাল অরণ্যের ছায়ায় তার কোনো-একটা হাজার ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেখা হয়, আর যদি শকুন্তলার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপা সোনার মুহূর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ চাওয়া-চাউয়ি করব, তার পরে কী হবে ভেবে দেখো।”
অমিতের ( রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র লিখেছেন – ‘ অমিতর’) একটা স্বভাব হচ্ছে, সাধারণে যে কথা বলে তার উল্টো কথা বলা। মানুষের রুচি যেমন পাল্টায়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ভালোলাগা মন্দলাগা প্রভৃতির মানদন্ডের পরিবর্তন দরকার। সে বলছে —
”এখন থেকে ফেলে দাও মন ভোলাবার ছলা কলা ছন্দোবন্ধ। মন কেড়ে নিতে হবে, যেমন করে সীতাকে রাবণ কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। মন যদি কাঁদতে কাঁদতে আপত্তি করতে করতে যায় তবুও তাকে যেতেই হবে — অতিবৃদ্ধ জটায়ুটা বারণ করতে আসবে, তাই করতে গিয়েই তার হবে মরণ। তার পরে কিছুদিন যেতেই কিষ্কিন্ধ্যা জেগে উঠবে, কোন হনুমান হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে মনটাকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করবে। ”
সীতা, রাবণ, জটায়ু, হনুমান — এঁরা সবাই রামায়ণের চরিত্র। জটায়ু মহাবলশালী পক্ষী। রামচন্দ্রের পিতা দশরথের মিত্র। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে আকাশমার্গে পালাচ্ছিলেন, তখন জটায়ু দেখতে পেয়ে বাধা দিয়েছিলেন। রাবণের অস্ত্রাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে তিনি পরে মৃত্যুমুখে পতিত হ’ন। হনুমান— মহাবলশালী বানর এবং রামচন্দ্রের পরমভক্ত। আর কিষ্কিন্ধ্যা হচ্ছে রামায়ণ অনুসারে বানর জাতির বাসস্থান।
সমুদ্রমন্থনের কাহিনী মহাভারতে আছে। এই উপন্যাসের বর্ণনাতে একজায়গায় সমুদ্রমন্থনের ইঙ্গিত আছে (সুলভ-৫; পৃ৪৬৮)। পাহাড়ি রাস্তায় অমিতের গাড়ি এবং লাবণ্যর গাড়ী মুখোমুখি বড়োরকম দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেও ছোটখাটো ধাক্কা এড়ানো গেল না। লাবণ্যের গাড়িটা খানিকটা গড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে আটকে থেমে গেল। ” একটি মেয়ে গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়াল। ………….. মন্দরপর্বতের নাড়া-খাওয়া ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দোলনের উপরে — মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে।” সমুদ্র মন্থনে মন্দরপর্বতকে মন্থন-দন্ড হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সমুদ্র-মন্থনের ফলেই দেবী লক্ষ্মী সমুদ্রতল থেকে উত্থিতা হয়েছিলেন।
এই গ্রন্থের এক জায়গায় বলা হয়েছে ( সুলভ-৫ম; পৃ-৪৭১)—
” যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের উৎকৃষ্ট বাঁধাই বাংলা অনুবাদ যোগমায়ার শেলফে অনেক কাল থেকে অপেক্ষা করে আছে ।”
যে রামায়ণ সাধারন্যে প্রচলিত, সে রামায়ণ থেকে কিন্তু যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ আলাদা। আমাদের জানা রামায়ণের মতো যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ আদিকবি বাল্মীকি রচিত, তবে বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ আলাদা। রামায়ণের সপ্তকান্ডের মতো যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণেও সাতটি প্রকরণ আছে —(১) বৈরাগ্য-প্রকরণ, (২) মুমুক্ষু-প্রকরণ, (৩) উৎপত্তি-প্রকরণ, (৪) স্থিতি-প্রকরণ, (৫) উপশম-প্রকরণ, (৬) নির্ব্বাণ-প্রকরণ পূর্বভাগ ও (৭) নির্ব্বাণ-প্রকরণ-উত্তরভাগ। যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের বক্তা মহামুনি বশিষ্ঠদেব; শ্রোতা ও প্রশ্নকর্তা স্বয়ং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এবং এই গ্রন্থের রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকি।
একটু পরেই গীতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে—দীনশরণ বেদান্তরত্ন মহাশয় এক-একদিন এসে যোগমায়াকে কখনো গীতা কখনো ব্রহ্মভাষ্য থেকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে যেতেন।
খেয়ালী অমিতের মনে হয়েছে লাবণ্যকে বিয়ে করা যেতে পারে। যোগমায়ার কাছে এসে সে প্রস্তাবটা পেশ করেছে। যোগমায়া শুনে হাসছেন আর বলছেন যে কথাটা শেষ পর্যন্ত ঠাট্টা হয়ে না দাঁড়ায়। তাতে অমিত বলছে যে— ”এ সন্দেহটা পাত্রের উপর দোষারোপ। যোগমায়া বললেন যে হেসে সবকিছু হালকা করে রাখাও মানুষের একটা বড় ক্ষমতা। অমিত উত্তরে বলছে — ”দেবতাদের সেই ক্ষমতা আছে, তাই দেবতারা বিবাহের অযোগ্য, দময়ন্তী সে কথা বুঝেছিলেন।” — দময়ন্তীর কাহিনী আগে বলা হয়েছে।
লাবণ্য এবং অমিতের কথা (সুলভ-৫ম; পৃ-৪৮৫ )। লাবণ্য বলছে—
”কিছুই তোমার সহজে পছন্দ হয় না, সেইজন্যে তোমাকে এত ভয় করি মিতা।” অমিত উত্তর দিচ্ছে — ”কিন্তু আমার কথাটা বুঝে দেখো। রামচন্দ্র সীতার সত্য যাচাই করতে চেয়েছিলেন বাইরের আগুনে; তাতেই সীতাকে হারালেন।” বার বার পরীক্ষা দেওয়ার অপমান সীতা সহ্য করতে পারেননি—ধরণী মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে সংসারের জ্বালা তিনি জুড়িয়েছিলেন।
আধুনিক সাহিত্য : বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র ‘ একটি অসাধারণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি শ্রীকৃষ্ণ এবং মহাভারতের ঐতিহাসিকত্ব প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। ভারতবর্ষে এই সংক্রান্ত বিজ্ঞান সম্মত আলোচনায় তিনিই পথিকৃত। D.r N.S. Rajaram তাঁর Search for the Historical Krishna গ্রন্থে লিখেছেন যে কানাড়া ভাষায় ‘কৃষ্ণচরিত্রের’ অনুবাদ পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর মতে এই বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় পথিকৃত বঙ্কিমচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ এই কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থের একটা বিস্তারিত সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধটির নাম — ‘কৃষ্ণচরিত্র’ এবং এটি ‘আধুনিক সাহিত্য’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার প্রচুর প্রশংসা করেছেন; আবার কোথাও কোথাও তিনি ভিন্ন মতও প্রকাশ করেছেন। যে সমস্ত ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন বা শ্রীকৃষ্ণ, মহাভারত অথবা মহাভারতের কোন ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে নিজস্ব মত প্রকাশ করেছেন, বর্তমান গ্রন্থে সেইগুলোই আলোচনার জন্য নিচ্ছি।
”মহাভারতকেই বঙ্কিম প্রধানত আশ্রয় করিয়াছেন। কিন্তু তিনি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছেন যে, মহাভারতের মধ্যে বিস্তর প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে। অথচ ঠিক কোনটুকু যে মূল মহাভারত তাহা তিনি স্থাপনা করিয়া যান নাই। তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন —
‘প্রচলিত মহাভারত আদিম বৈয়াসিকী সংহিতা নহে। ইহা বৈশম্পায়ন-সংহিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু আমরা প্রকৃত বৈশম্পায়ন-সংহিতা পাইয়াছি কি না তাহা সন্দেহ। তার পরে প্রমাণ করিয়াছি যে, ইহার প্রায় তিন ভাগ প্রক্ষিপ্ত।’
বঙ্কিম মহাভারতের তিনটি স্তর আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রথম স্তরের রচনা উদার ও উচ্চকবিত্বপূর্ণ; দ্বিতীয় স্তরের রচনা অনুদার এবং কাব্যাংশে কিছু বিকৃতিপ্রাপ্ত এবং তৃতীয় স্তর বহুকালের বহুবিধ লোকের যদৃচ্ছামত রচনা।
এ কথা পাঠকদিগকে বলা বাহুল্য যে, কাব্যাংশের উৎকর্ষ ও অপকর্ষ বিচার করিয়া স্তরনির্ণয় করা নিতান্তই আনুমানিক। রুচিভেদে কবিত্ব ভিন্ন লোকের নিকট ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়। আবার, একই কবির রচনার ভিন্ন ভিন্ন অংশের কবিত্ব হিসাবে আকাশ-পাতাল তফাত হয় এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নহে।
অতএব ভাষার প্রভেদ ঐতিহাসিকের প্রধান সমালোচ্য বিষয়, কবিত্বের প্রভেদ নহে। মহাভারতের মধ্যে এই ভাষার অনুসরণ করিয়া ভিন্ন ভিন্ন কবির রচনা নির্ণয় করা এবং মূল মহাভারত নির্বাচন করা প্রভূত শ্রমসাধ্য।
দ্বিতীয় কথা এই যে, ভালো কবির রচনায় ভালো কাব্য থাকিতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিকতা কবিত্বের উপর নির্ভর করে না। কুরুপান্ডবের যুদ্ধবিবরণ সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতে নানা স্থানের নানা লোকের মুখে নানা গল্প প্রচলিত ছিল। কোনো উৎকৃষ্ট কবি সেই-সকল গল্পের মধ্য হইতে তাঁহার কবিত্বের উপযোগী উপকরণ সংগ্রহ ও সংগঠন করিয়া লইয়া একটি সুসংগত সুন্দর কাব্য রচনা করিয়া থাকিতে পারেন এবং অনেক অকবি ও কুকবি-বর্গ তাঁহার সেই কাব্যের মধ্যে তাঁহাদের নিজের জানা ইতিহাস জুড়িয়া দিতে পারেন। সে স্থলে সুকাব্যের অপেক্ষা অকাব্য ঐতিহাসিক হিসাবে অধিকতর নির্ভরযোগ্য হইতে পারে। এ কথা কাহারও অবিদিত নাই যে, কাব্যহিসাবে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ করিতে হইলে সমগ্র ইতিহাসকে অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা যায় না। শেকস্পীয়ারের কোনো ঐতিহাসিক নাটকে যদি পরবর্তী সত্যপ্রিয় ব্যক্তিগণ ঐতিহাসিক অসম্পূর্ণতা পূরণ করিয়া দিবার জন্য নিজ নিজ রচনা নির্বিচারে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিতে থাকেন তবে তাহাতে কাব্যের কত ত্রুটি, মূলের সহিত কত অসামঞ্জস্য এবং শেকসপীয়ার-বর্ণিত চরিত্রের সহিত কত বিরোধ ঘটিতে থাকে তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে; সে স্থলে কাব্যসমালোচক কবিত্ব বিচার করিয়া শেকসপীয়ারের মূলনাটক উদ্ধার করিতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস-সমালোচক ইতিহাস-উদ্ধারের জন্য একমাত্র শেকসপীয়ারের মূল গ্রন্থের উপরেই নির্ভর করিবেন এমন কথা বলিতে পারি না।
যাহা হউক, মহাভারতে যে নানা কালের নানা লোকের রচনা আছে তাহা স্বীকার্য; কিন্তু তাহাদিগকে পৃথক করিয়া তাহাদের রচনাকাল ও তাহাদের আপেক্ষিক সত্যাসত্য নির্ণয় যে কেমন করিয়া সাধিত হইতে পারে তাহা এখনো আবিষ্কৃত হয় নাই।”
”বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণের প্রত্যেক উক্তি এবং মত যতটা বিস্তারিত ব্যাখ্যার সহিত আলোচনা করিয়াছেন এবং তাহা হইতে যে ঐতিহাসিক চরিত্র গঠন করিয়াছেন তাহা আমাদের মতে যথেষ্ট তথ্যমূলক নহে। বঙ্কিমবাবুও মধ্যে মধ্যে বলিয়াছেন যে, মহাভারতে কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে সবই যে কৃষ্ণ বাস্তবিক বলিয়াছিলেন তাহা নহে, তদদ্বারা কৃষ্ণসম্বন্ধে কবির কিরূপ ধারণা ছিল তাহাই প্রমাণিত হইতেছে। কিন্তু কবির আদর্শকে সর্বতোভাবে ঐতিহাসিক আদর্শের অনুরূপ বলিয়া স্বীকার করিতে হইলে কাব্য ব্যতীত অন্যান্য অনুকুল প্রমাণের আবশ্যক। আমরা একটি উদাহরণ উদধৃত করি। বঙ্কিমবাবু বলিতেছেন —
‘কুন্তী পুত্রগণ ও পুত্রবধূর দুঃখের বিবরণ স্মরণ করিয়া কৃষ্ণের নিকট অনেক কাঁদাকাটা করিলেন। উত্তরে কৃষ্ণ যাহা তাঁহাকে বলিলেন তাহা অমূল্য। যে-ব্যক্তি মনুষ্যচরিত্রের সর্বপ্রদেশ সম্পূর্ণরূপে অবগত হইয়াছে সে ভিন্ন আর কেহই সে কথার অমূল্যত্ব বুঝিবে না। মূর্খের তো কথাই নাই। শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, ”পান্ডবগণ নিদ্রা তন্দ্রা ক্রোধ হর্ষ ক্ষুধা পিপাসা হিম রৌদ্র পরাজয় করিয়া বীরোচিত সুখে নিরত রহিয়াছেন। তাঁহারা ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিয়া বীরোচিত সুখে সন্তষ্ট আছেন; সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহোৎসাহসম্পন্ন বীরগণ কদাচ অল্পে সন্তষ্ট হয়েন না। বীর ব্যক্তিরা হয় অতিশয় ক্লেশ না-হয় অত্যুৎকৃষ্ট সুখ সম্ভোগ করিয়া থাকেন; আর ইন্দ্রিয়সুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যাবস্থাতেই সন্তষ্ট থাকে; কিন্তু উহা দুঃখের আকর; রাজ্যলাভ বা বনবাস সুখের নিদান।”
”বঙ্কিমবাবু মহাভারত হইতে কৃষ্ণের যে উক্তি উদধৃত করিয়াছেন তাহা সুগভীর ভাবগর্ভ উপদেশে পূর্ণ)। কিন্তু ইহা হইতে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের চরিত্রনির্ণয়ের বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায় এমন আমরা বিশ্বাস করি না। ইহাতে মহাভারতকার কবির মানবচরিত্রজ্ঞতা এবং হৃদয়ের উচ্চতা প্রকাশ করে। উদ্যোগপর্বের নবতিতম অধ্যায়ে কৃষ্ণের এই উক্তি বর্ণিত আছে; ইহার প্রায় চল্লিশ অধ্যায় পরেই কুন্তীর মুখে বিদুলা-সঞ্জয়সংবাদ নামক একটি পুরাতন কাহিনী সন্নিবেশিত হইয়াছে; তাহাতে তেজস্বিনী বিদুলা তাঁহার যুদ্ধচেষ্টাবিমুখ পুত্র সঞ্জয়কে ক্ষত্রধর্মে উৎসাহিত করিবার জন্য যে কথাগুলি বলিয়াছেন কৃষ্ণের পূর্বোদধৃত উক্তির সহিত তাহার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই।
বিদুলা বলিতেছেন —
‘এখনো পুরুষোচিত চিন্তাভার বহন করো। অল্পদ্বারা পরিতৃপ্ত রাখিয়া অপরিমেয় আত্মাকে অনর্থক অবমানিত করিয়ো না। ……… ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিম্নগাসকল যেমন অল্প জলেই পরিপূর্ণা হয় এবং মূষিকের অঞ্জলি যেমন অল্প দ্রব্যেই পূর্ণ হইয়া উঠে সেইরূপ কাপুরুষেরাও অত্যল্পমাত্রে পরিতৃপ্ত হওয়ায় সহজেই সন্তষ্ট হইতে থাকে। ……. চিরকাল ধূমিত হওয়া অপেক্ষা মুহূর্তকাল জ্বলিত হওয়াও শতগুণে শ্রেষ্ঠ। ….. ইহসংসারে প্রজ্ঞাবান পুরুষ অত্যল্প বস্তুকে অপ্রিয় বোধ করেন; অত্যল্প বস্তু যাহার প্রিয় হয়, তাহার সেই অল্প বস্তুই নিশ্চয় অনিষ্টকর হইয়া থাকে। …. যাহারা ফলের অনিত্যত্ব স্থির করিয়াও কর্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ না হয় তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইতেও পারে, না হইতেও পারে; কিন্তু অনিশ্চিত বোধে যারা একেবারেই অনুষ্ঠানে বিরত হয় তাহারা আর কস্মিন কালেও কৃতকার্য হইতে পারে না।’
ইহা হইতে এই দেখা যাইতেছে যে, কর্তব্যপরায়ণতা সম্বন্ধে মহাভারতের কবির আদর্শ অত্যন্ত উচ্চ ছিল, এবং সেই আদর্শ তিনি নানা উদাহরণের দ্বারা নানা স্থানে প্রচার করিয়াছেন। মহাভারত ভালো করিয়া পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে এমন কল্পনা করাও অসংগত হয় না যে, এক সময়ে ভারতে কর্মধর্মের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণার উদ্দেশে কবি লোকবিখ্যাত কুরুপান্ডবের যুদ্ধবৃত্তান্ত মহাকাব্যে গ্রথিত করিয়াছেন। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীষ্ম, ভীম, কর্ণ, দ্রোণ প্রভৃতি মহাভারতের প্রধান নায়কগুলিমাত্রেই কর্মবীরের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তস্থল; এমন-কি, গান্ধারী এবং দ্রৌপদীও কর্তব্যনিষ্ঠার মহিমায় দীপ্তিমতী। সেইজন্য গান্ধারী দুর্যোধনকে ত্যাগ করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন এবং দৌপদী বলিয়াছিলেন, ‘অবধ্য ব্যক্তিকে বধ করিলে যে পাপ হয়, বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলেও সেই পাপ হইয়া থাকে।’
অতএব বঙ্কিম যাহা বলিতেছেন তাহাতে যদি প্রমাণের কোনো ত্রুটি না থাকে তবে তদদ্বারা ইহাই স্থির হইয়াছে যে, কোনো-একটি অজ্ঞাতনামা কবির মনে মহত্ত্বের আদর্শ অতি উচ্চ ছিল; এবং তাঁহার সেই উচ্চতম আদর্শ-সৃষ্টিই মহাভারতের কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক হইতে পারেন কিন্তু মহাভারতের কৃষ্ণ যে সর্বাংশে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের প্রতিরূপ তাহার কোনো প্রমাণ নাই। ইহাও দেখা যাইতেছে যে, এই মহাভারতেই ভিন্ন লোক ভিন্ন আদর্শের কৃষ্ণ সংগঠন করিয়াছেন ।”
”বঙ্কিমবাবুর প্রমাণমতে দেখিতে পাইতেছি, ব্যাসরচিত মূল মহাভারত বর্তমান নাই। এখন যে মহাভারত পাওয়া যায় তাহা ব্যাসের মুখ হইতে বৈশম্পায়ন, বৈশম্পায়নের মুখ হইতে উগ্রশ্রবার পিতা, পিতার মুখ হইতে উগ্রশ্রবা এবং উগ্রশ্রবার মুখ হইতে অন্য কোনো-একজন কবি সংগ্রহ করিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, এ মহাভারতের মধ্যেও কালক্রমে নানা লোকের রচনা মিশ্রিত হইয়াছে; তাহা নিঃসংশয়ে বিশ্লিষ্ট করিবার কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় আপাতত স্থির হয় নাই। তৃতীয়ত, অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ হইতে তুলনা-দ্বারা মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করিবারও পথ নাই।
বঙ্কিম প্রধানত কৃষ্ণচরিত্রকেই উপলক্ষ করিয়া কেবল প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা বিচার করিয়াছেন; কিন্তু প্রথমে প্রমাণ ও বিচার প্রয়োগপূর্বক প্রধানত সমস্ত মহাভারতের ইতিহাস-অংশ বাহির করিলে পর, তবে কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা সন্তাোষজনকরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে।
উদাহরণস্বরূপে বলিতে পারি, দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ প্রামাণিক সত্য কি না, সে বিষয়ে বঙ্কিম সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন; অতএব দেখা আবশ্যক, বঙ্কিম যাহাকে মূল মহাভারত বলিতেছেন তাহার সর্বত্র হইতেই দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ বর্জন করা যায় কি না, এবং বঙ্কিম মহাভারতের যে যে অংশ হইতে কৃষ্ণচরিত্রের ইতিহাস সংকলন করিয়াছেন, সেই সেই অংশে দ্রৌপদীর পঞ্চপতিচর্যা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নাই কি না। বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত যে-সকল ঘটনাকে অনৈতিহাসিক মনে করেন সে-সমস্ত যদি তিনি তাঁহার কল্পিত মূল মহাভারত হইতে প্রমাণসহকারে দূর করিয়া দিতে পারেন তবে আমরা তাঁহার নির্বাচিত অংশকে বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসরূপে গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারি। কিন্তু মহাভারতের ঠিক কতটুকু মূল ঐতিহাসিক অংশ তাহা বঙ্কিম সুস্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট করেন নাই, তিনি কেবলমাত্র কৃষ্ণচরিত্রের ধারাটি অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। তিনি এক স্থানে বলিয়াছেন —
‘আমি বিশ্বাস করি না যে, যজ্ঞের অগ্নি হইতে দ্রুপদ কন্যা পাইয়াছিলেন, অথবা সেই কন্যার পাঁচটি স্বামী ছিল। তবে দ্রুপদের ঔরসকন্যা থাকা অসম্ভব নহে, এবং তাঁহার স্বয়ংবর বিবাহ হইয়াছিল, এবং সেই স্বয়ংবরে অর্জুন লক্ষ্যভেদ করিয়াছিলেন, ইহা অবিশ্বাস করিবারও কারণ নাই। তার পর, তাঁহার পাঁচ স্বামী হইয়াছিল, কি এক স্বামী হইয়াছিল, সে কথার মীমাংসায় আমাদের কোনো প্রয়োজন নাই।’
প্রয়োজন যথেষ্ট আছে। কারণ, বঙ্কিম মহাভারতকে ইতিহাস বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সেইজন্যই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রকে তিনি ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীবিবাহ ব্যাপারটি তুচ্ছ নহে; কিন্তু এতবড়ো ঘটনাটি যদি মিথ্যা হয়, এবং সেই মিথ্যা যদি বঙ্কিমের নির্বাচিত মহাভারতেও স্থান পাইয়া থাকে তবে তদ্দ্বারা সেই মহাভারতের প্রামাণিকতা হ্রাস ও সেই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা খর্ব হইয়া আসে। সাক্ষী যখন একমাত্র, তখন তাহার সাক্ষ্যের কোনো-এক বিশেষ অংশ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে গেলে সাক্ষ্যের অপরাংশে মিথ্যাসংস্রব না থাকা আবশ্যক।”
(এইখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন, বৈশম্পায়নের নিকট থেকে উগ্রশ্রবার পিতা মহাভারত কথা শ্রবণ করেছিলেন— একথায় একটু অসঙ্গতি আছে মনে হয়। উগ্রশ্রবার পিতাকে বলরাম অনেক আগেই হত্যা করেছিলেন। বৈশম্পায়নের বলা মহাভারতকথা জন্মজয় রাজসভায় শ্রবণ করেছিলেন উগ্রশ্রবা সূত বা সৌতি)।
‘বঙ্কিম, মেকলে কার্লাইল লামার্টিন থুকিদিদীস প্রভৃতি উদাহরণ দেখাইয়া মহাভারতকে কবিত্বময় ইতিহাস বলিতে চাহেন; আমরা মহাভারতকে ঐতিহাসিক কাব্য বলিয়া গণ্য করি। কিন্তু কৃষ্ণচরিত্রের আদর্শ আমরা ইতিহাস হইতে পাই, অথবা কাব্য হইতে পাই, অথবা কাব্য-ইতিহাসের মিশ্রণ হইতে পাই তাহা লইয়া অধিক তর্ক করিতে চাহি না। ফলত ইতিহাস যে বেদবাক্য তাহা নহে; সকলেই জানেন একটা উপস্থিত ঘটনাস্থলেও প্রকৃত বৃত্তান্ত প্রকৃতরূপে গ্রহণ করিতে এবং প্রকৃতরূপে বর্ণনা করিতে অতি অল্প লোকই পারে। খন্ড খন্ড বৃত্তান্ত হইতে একটি সমগ্র মানবচরিত্র ও ইতিহাস রচনা করা আরো অল্প লোকের সাধ্যায়ত্ত। পুরাকালে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধবৃত্তান্তসম্বন্ধে যে-সকল কিংবদন্তী বিক্ষিপ্তভাবে প্রচলিত ছিল, মহাভারতের কবি কল্পনাবলে তাহাদের অসম্পূর্ণতা পূরণ করিয়া তাহাদিগকে যে-একটি সমগ্র চিত্রে প্রতিফলিত করিয়া তুলিয়াছেন তাহা যে ঐতিহাসিকের ইতিহাস অপেক্ষা অল্প সত্য হইবেই এমন কোনো কথা নাই।”
‘মহাভারতের কবিবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের প্রত্যেক তথ্যটি প্রকৃত না হইতে পারে; কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে এবং তাঁহার প্রতি যত কার্যকলাপের আরোপ হইয়াছে তাহার প্রত্যেক ক্ষুদ্র বৃত্তান্তটি প্রামাণিক না হইতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের যে মাহাত্ম্য তিনি পাঠকদের মনে মুদ্রিত করিয়া দিয়াছেন তাহাই সর্বাপেক্ষা মহামূল্য সত্য। কৃষ্ণের যদি ইতিহাস থাকিত তবে সম্ভবত তাহাতে এমন সহস্র ঘটনার উল্লেখ থাকিত যাহা কৃষ্ণ-কর্তৃক অনুষ্ঠিত হইলেও তাহার কোনো স্থায়ী মূল্য নাই অর্থাৎ যে-সকল কাজ কৃষ্ণের কৃষ্ণত্ব প্রকাশ করে না — এমন কি, শেষ পর্যন্ত সকল কথা জানা সম্ভব নহে বলিয়া তাহার অনেকগুলি কৃষ্ণের যথার্থ স্বভাবের বিরোধী বলিয়াও মনে হইতে পারিত। প্রত্যেক মানুষে অনেক কাজে নিজের যথার্থ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করিয়াও থাকে।
মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্রে নিশ্চয়ই সেই-সকল অনাবশ্যক এবং আকস্মিক তথ্যগুলি বর্জিত হইয়া কেবল প্রকৃত স্বরূপগত সত্যগুলি নির্বাচিত হইয়াছে—এমন-কি, কৃষ্ণ যে কথা বলেন নাই কিন্তু যে কথা কেবল কৃষ্ণই বলিতে পারিতেন, সেই কথা কৃষ্ণকে বলাইয়া, কৃষ্ণ যে কাজ করেন নাই কিন্তু যে কাজ কেবল কৃষ্ণই করিতে পারিতেন সেই কাজ কৃষ্ণকে করাইয়া কবি বাস্তবিক-কৃষ্ণ অপেক্ষা তাঁহার কৃষ্ণকে অধিকতর সত্য করিয়া তুলিয়াছেন। অর্থাৎ, বাস্তব-কৃষ্ণে স্বভাবতই অকৃষ্ণ যাহা ছিল তাহা দূরে রাখিয়া এবং বাস্তব কৃষ্ণ নিজের চরিত্র গুণে কবির মনে যে আদর্শের উদয় করিয়া দিয়েছেন পরন্তু নানা বাহ্য কারণে যাহা কার্যে সর্বত্র ধারাবাহিক পরিস্ফুটভাবে ও নির্বিরোধে প্রকাশ হইতে পারে নাই, সেই আদর্শকে সর্বত্র পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুট করিয়া কবি বাস্তবিক ইতিহাস হইতে সত্যতম নিত্যতম কৃষ্ণকে উদ্ধার করিয়া লইয়াছেন।
অতএব, বঙ্কিম যখন কৃষ্ণচরিত্রের মাহাত্ম্য বাঙালি পাঠকদিগের মনে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহেন তখন কবির কাব্য হইতে তাহা উদধৃত করিয়া লওয়াই তাঁহার উপযুক্ত কার্য হইয়াছে। দুর্ভাগ্যক্রমে মহাভারত নানা কালের নানা লোকের রচনার মধ্যে চাপা পড়িয়াছে; কবির মূল আদর্শটি বাহির করা সহজ ব্যাপার নহে। সমস্ত জঞ্জাল দূর করিতে পারিলে, কেবল কৃষ্ণ নহে, ভীষ্ম কর্ণ অর্জুন দ্রৌপদী প্রভৃতি সকলেই উজ্জ্বলতর সম্পূর্ণতর আকারে আমাদের নিকট প্রকাশিত হইবেন। মহাভারতের আদিকবির মূল রচনাটি উদ্ধার করা হইলে মানবজাতির একটি পরমতম লাভ হইবে।”
”মহাভারতকার এমন-একটি মানুষের সৃষ্টি করেন নাই, যিনি মনুষ্য-আকারধারী তত্ত্বকথা বা নীতিসূত্র মাত্র। সেই তাঁহার অত্যুচ্চ কবিপ্রতিভার পরিচায়ক। তিনি তাঁহার বড়ো বড়ো বীরদিগকেও অনেক সময় এমন সকল অযোগ্য কাজে প্রবৃত্ত করাইয়াছেন যাহা ছোটো কবিদের সাহসে কুলাইত না।”
”মহাভারতকার কবি যে-একটি বীরসমাজ সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে একটি সুমহৎ সামঞ্জস্য আছে কিন্তু ক্ষুদ্র সুসংগতি নাই। খুব সম্ভব, আধুনিক খ্যাত-অখ্যাত অনেক আর্য বাঙালি লেখকই সরলা বিমলা দামিনী যামিনী-নামধেয়া এমন-সকল সতীচরিত্রের সৃষ্টি করিতে পারেন যাঁহারা আদ্যোপান্তসুসংগত অপূর্ব নৈতিকগুণে দ্রৌপদীকে পদে পদে পরাভূত করিতে পারেন, কিন্তু তথাপি, মহাভারতের দ্রৌপদী তাঁহার সমস্ত অপূর্ণতা অসংকোচে বক্ষে বহন করিয়া এই-সমস্ত নব্য বল্মীকরচিত ক্ষুদ্র নীতিস্তূপগুলির বহু ঊর্ধ্বে উদার আদিম অপর্যাপ্ত প্রবল মাহাত্ম্যে নিত্যকাল বিরাজ করিতে থাকিবেন। মহাভারতের কর্ণ সভাপর্বে পান্ডবদের প্রতি যে-সকল হীনতাচরণ করিয়াছেন আমাদের নাটক-নভেলের দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ-বর্গ কখনোই তাহা করেন না, তাঁহারা সময়ে-অসময়ে স্থানে-অস্থানে অনায়াসেই আত্মবিসর্জন করিয়া থাকেন, তথাপি মহাভারতের কবি বিনা চেষ্টায় কর্ণকে যে অমরলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন এই দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ-বর্গ সমালোচক প্রদত্ত সমস্ত ফার্স্ট ক্লাস টিকিট এবং নৈতিক পাথেয় লইয়াও তাহার নিম্নতম সোপান পর্যন্ত পৌঁছিতে পারে কি না সন্দেহ।”
কবি ‘কৃষ্ণচরিত্র’ আলোচনা প্রসঙ্গে মহাভারত রচয়িতার প্রতি যে শ্রদ্ধাপ্রকাশ করেছেন তা অনবদ্য যদিও বেদব্যাসের নাম তিনি কদাচিৎ বলেছেন। এবার আমরা অন্য প্রবন্ধগুলিতে একটু দৃষ্টিপাত করি। শুভবিবাহ প্রবন্ধে (সুলভ-৫ম, পৃ-৫৮৯) রামায়ণ মহাভারতের কয়েকজন চরিত্রের সামান্য একটু উল্লেখ আছে। ”গ্রামের দিঘির ভাঙা ঘাটটি আমার ভালো লাগে — সুন্দর বলিয়া নয়, গ্রামকে ভালোবাসি বলিয়া। …….. কিন্তু গ্রামের লোকেরা যে রামচন্দ্র-যুধিষ্ঠির, সীতা-সাবিত্রীর দল, তাহা নহে—”
‘মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস’ প্রবন্ধের একজায়গায় (পৃ-৫৯২) বলা হয়েছে ” উত্তর আমেরিকার দুর্গম তুষারমরুর মধ্যে স্বর্ণখনির সংবাদ পাইয়া লোভোন্মত্ত নরনারীগণ …….. কেমন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে ……. সে বৃত্তান্ত সংবাদপত্রে সকলেই পাঠ করিয়াছেন। এই যে অচিন্তনীয় কষ্টসাধন …….. ইহার উদ্দীপক দুর্দান্ত লোভ। দুর্যোধন প্রমুখ কৌরবগণ যেমন লোকের প্ররোচনায় উত্তরের গোগৃহে ছুটিয়াছিল ইহারাও তেমনি ধরণীর স্বর্ণরস দোহন করিয়া লইবার জন্য মৃত্যুসংকুল উত্তর মেরুর দিকে ধাবিত হইয়াছে।” — দুর্যোধন এবং কৌরবেরা মহাভারতের চরিত্র। এরা উত্তর গোগৃহে গিয়েছিলেন মৎস্যদেশের গো-ধন চুরি করতে।
‘ ঐতিহাসিক চিত্র’ প্রবন্ধের এক জায়গায় (পৃ-৫৯৮) রামায়ণ মহাভারতের কথা আছে ”যখন আর্যগণ প্রথম ভারতবর্ষে আসিয়াছিল, ……… যখন প্রাকৃতিক বাধা ও আদিম অনার্যের সহিত সংগ্রামে তাহাদিগকে সচেষ্ট দলবদ্ধ হইতে হইয়াছিল, যখন বীর পুরুষগণের স্মৃতি তাহাদিগকে বীর্যে উৎসাহিত করিত, তখন তাহাদের লিপিহীন সাহিত্যে ইতিহাসগাথার প্রাদুর্ভাব ছিল সন্দেহ নাই। সেই সকল অতিপুরাতন খন্ড-ইতিহাস বহুযুগ পরে মহাভারতে ও রামায়ণে নানা বিকারসহকারে একত্র সংযোজিত হইয়াছিল।”
ওই প্রবন্ধেরই ৫৯৯ পৃষ্ঠাতে বলা হয়েছে ”জড়ীভূতা অহল্যা রামচন্দ্রের স্পর্শে যেমন ভূমিতল হইতে মূর্তি ধারণ করিয়া দন্ডায়মান হইয়াছিল, সেইরূপ একেশ্বর ইংরাজশাসনের সংস্পর্শে আমাদের ভারতবর্ষ বিমিশ্র অস্পৃষ্ট বিচ্ছিন্ন জড়পুঞ্জমধ্য হইতে ক্রমশ এক মূর্তি গ্রহণ করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিতেছে।” অহল্যার প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
‘রাজা প্রজা’ গ্রন্থের ‘ইংরাজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধের এক জায়গায় মহাভারতের চরিত্র কর্ণ ও অশ্বত্থামার কথা বলা হয়েছে। ”কর্ণ যখন অশ্বত্থামাকে বলেন যে, তুমি ব্রাহ্মণ, তোমার সহিত কি যুদ্ধ করিব, তখন অশ্বত্থামা বলিয়াছিলেন, আমি ব্রাহ্মণ সেই জন্যেই তুমি আমার সহিত যুদ্ধ করিতে পারিবে না! আচ্ছা, তবে আমার এই পইতা ছিঁড়িয়া ফেলিলাম।” — কর্ণ এবং অশ্বত্থামা দু’জনেই দুর্যোধনের মিত্র। তাঁদের দু’জনের বাগ-বিতন্ডার কথা মহাভারতে আছে, কিন্তু এইরকম কথা-কাটাকাটির সময়ে অশ্বত্থামা যে তাঁর ব্রাহ্মণত্বের পরিচায়ক পইতা ছিঁড়ে ফেলে কর্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন, এরকম কোন বর্ণনা মহাভারতে আমার চোখে পড়েনি।
উক্ত প্রবন্ধেই একটু পরে বলা হয়েছে — কার্যে প্রবৃত্ত হইবার আরম্ভে এই পণ করিয়া বসিতে হইবে যে, যতদিন না-সুযোগ্য হইব ততদিন অজ্ঞাতবাস অবলম্বন করিয়া থাকিব।
নির্মাণ হইবার অবস্থায় গোপনের আবশ্যক। …………….. পান্ডবেরা পূর্বগৌরব গ্রহণ করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে অজ্ঞাতবাসে থাকিয়া বল সঞ্চয় করিয়াছেন। সংসারে উদ্যোগ পর্বের পূর্বে অজ্ঞাতবাসের পর্ব। আমাদেরও এখন আত্মনির্মাণ-জাতি নির্মাণের অবস্থা, এখন আমাদের অজ্ঞাতবাসের সময়।”
পান্ডবেরা পাশাখেলায় হেরে বারো বছরের জন্য বনবাস ও এক বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলেন। অজ্ঞাতবাসের অর্থ গুপ্ত অবস্থায় থাকা—যাতে তাদের পরিচয় প্রকাশ না পায়। মহাভারতের অজ্ঞাতবাস পর্বের নাম বিরাটপর্ব আর তার পরের পর্বের নাম উদযোগ পর্ব বা উদ্যোগপর্ব।
এই ‘রাজা প্রজা’ গ্রন্থে অপমানের প্রতিকার’ নামে একটা প্রবন্ধ আছে। এই প্রবন্ধে ইংরাজদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা আছে। এই প্রবন্ধ থেকে একটু অংশ উদ্ধৃত করছি।
”যাহারা মাংসাশী জাতি এবং যাহারা বিরাট হত্যাকান্ডের দ্বারা পৃথিবীর দুই নবাবিষ্কৃত মহাদেশের মধ্যে আপনাদের বাসযোগ্য স্থান পরিষ্কার করিয়া লইয়াছে, এবং সম্প্রতি তরবারির দ্বারা তৃতীয় মহাদেশের প্রচ্ছন্ন বক্ষোদেশ অল্পে অল্পে বিদীর্ণ করিয়া তাহার শস্য-অংশটুকু সুখে ভক্ষণ করিবার উপক্রম করিতেছে, তাহারা যদি নিমন্ত্রণ সভায় আরামে ও স্পর্ধাভরে নৈতিক আদর্শের উচ্চদন্ডে চড়িয়া বসিয়া জীবনের পবিত্রতা ও প্রাণহিংসার অকর্তব্যতা সম্বন্ধে অহিংসক ভারতবর্ষকে উপদেশ দিতে থাকে তবে ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’ এই শাস্ত্রবাক্য স্মরণ করিয়াই সহিষ্ণুতা অবলম্বন করিতে হয়।” —এখানে কবি সংস্কৃত শ্লোকটি আংশিক উদ্ধৃত করেছেন। সম্পূর্ণ শ্লোকটি আছে মহাভারতের বনপর্বে।
”অহিংসা পরমো ধর্ম্মঃ স চ সত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ।
‘অহিংসা সত্যবচনং সর্বভূতহিতং পরম্।
সত্যে কৃত্বা প্রতিষ্ঠাং তু প্রবর্তন্তে প্রবৃত্তয়ঃ।।”
(অহিংসা এবং সত্যবাক্য এই দুটি পরম হিতকর, তারমধ্যে আবার অহিংসা পরম ধর্ম যেটা সত্যে প্রতিষ্ঠিত আছে। সত্যের উপর নির্ভর করেই সাধুলোকের প্রবৃত্তি হয়ে থাকে।) (মহাভারতম ১০ম খন্ড, পৃ১৮০১ )
এই গ্রন্থের ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে কবি মহাভারতের একটা শ্লোকের আংশিক উল্লেখ করেছেন (সুলভ ৫ম, পৃ- ৬৬৬)। বাংলাদেশে কিছু অশান্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন — বর্তমান সংকটে রাজপুরুষদের কি করা কর্তব্য তাহা আলোচনা করিতে গেলে তাঁহারা শ্রদ্ধা করিয়া শুনিবেন বলিয়া ভরসা হয় না।
…… আমাদের বলিবার কথাও অতি পুরাতন এবং শুনিলে মনে হইবে, ভয়ে বলিতেছি। তবু সত্য পুরাতন হইলেও সত্য এবং তাহাকে ভুল বুঝিলেও তাহা সত্য। কথাটি এই— শক্তস্য ভূষনং ক্ষমা। কথা আরো একটু আছে, ক্ষমা শুধু শক্তের ভূষণ নহে, সময়বিশেষে শক্তের ব্রহ্মাস্ত্রও ক্ষমা। ”
সম্পূর্ণ শ্লোকটি মহাভারতের উদ্যোগপর্বে আছে।
”সোহোস্য দোষো ন মন্তব্যঃ ক্ষমা হি পরমং বলম্।
ক্ষমা গুণোহ্যশক্তানাং শক্তানাং ভূষণং ক্ষমা।। ”
পান্ডবেরা অজ্ঞাতবাস শেষ করলেও দুর্যোধনের রাজ্য ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছা নেই। ধৃতরাষ্ট্রও দুর্যোধনকে বাধ্য করতে পারছেন না। বিদুর বিভিন্ন সময়ে ধৃতরাষ্ট্রকে ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। এখানেও বিদুরই ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন যে মানুষের ক্ষমাগুণ অত্যন্ত সুন্দর জিনিষ। সমর্থ লোকেরা যদি অসমর্থ লোকদের ক্ষমা করেন তবে সেই গুণ তাঁদের অলংকারস্বরূপ।
(মহাভারতম ত্রয়োদশ খন্ড, পৃ- ২৫৬ )
ঐ একই প্রবন্ধে (পৃ-৬৭৪) মহাভারতের সোমকরাজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ”অধৈর্য্য বা অজ্ঞান-বশত স্বাভাবিক পন্থাকে অবিশ্বাস করিয়া অসামান্য কিছু একটাকে ঘটাইয়া তুলিবার ইচ্ছা অত্যন্ত বেশী প্রবল হইয়া উঠিলে মানুষের ধর্মবুদ্ধি নষ্ট হয়; ……….. তখন ছোটো ছোটো বালকদিগকেও এই ঊন্মত্ত ইচ্ছার নিকট নির্মমভাবে বলি দিতে মনে কোনো দ্বিধা উপস্থিত হয় না। আমরা মহাভারতের সোমক রাজার ন্যায় অসামান্য উপায়ে সিদ্ধি লাভের প্রলোভনে আমাদের অতি সুকুমার ছোটো ছেলেটিকেই যজ্ঞের অগ্নিতে সমর্পণ করিয়া বসিয়াছি— এই নির্বিচার নিষ্ঠুরতার পাপ চিত্রগুপ্তের দৃষ্টি এড়ায় নাই — তাহার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইয়াছে, বালকদের জন্য বেদনায় সমস্ত দেশের হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে । ” — নরকবাস কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে সোমকরাজার কথা আগে বলা হয়েছে।
এই গ্রন্থের ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন (সুলভ-৫ম পৃ-৬৭৯) — ”কোনটা যে প্রকৃত বাস্তব তাহা নির্ণয় করা সোজা নহে। সেইজন্যই অনেক সময় মানুষ মনে করে, যেটাকে চোখে দেখা যায় সেটাই সকলের চেয়ে বড়ো বাস্তব, যেটা মানবপ্রকৃতির নীচের তলায় পড়িয়া থাকে সেটাই আসল সত্য। কোনো ইংরাজ-সাহিত্যসমালোচক রামায়ণ অপেক্ষা ইলিয়ডের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করিবার কালে বলিয়াছেন, ইলিয়ড কাব্য অধিকতর হিউম্যান, অর্থাৎ মানবচরিত্রের বাস্তবকে বেশী করিয়া স্বীকার করিয়াছে — কারণ, উক্ত কাব্যে একিলিস নিহত শত্রুর মৃতদেহকে রথে বাঁধিয়া ট্রয়ের পথের ধূলায় লুটাইয়া বেড়াইয়াছেন, আর রাম পরাজিত শত্রুকে ক্ষমা করিয়াছেন। ক্ষমা অপেক্ষা প্রতিহিংসা মানবচরিত্রের পক্ষে অধিকতর বাস্তব এ কথার অর্থ যদি এই হয় যে, তাহা পরিমাণে বেশী তবে তাহা স্বীকার করা যাইতে পারে। কিন্তু স্থূল পরিমাণই বাস্তবতা-পরিমাপের একমাত্র বাটখারা এ কথা মানুষ কোনো দিনই স্বীকার করিতে পারে না; এই জন্যই মানুষ ঘর-ভরা অন্ধকারের চেয়ে ঘরের কোণের একটি ক্ষুদ্র শিখাকেই বেশী মান্য করিয়া থাকে। ”
এই আলোচনা প্রসঙ্গেই কবি একটু পরে লিখেছেন — ”যে পক্ষ অক্ষৌহিণী সেনাকেই গণনা গৌরবে বড়ো সত্য বলিয়া মনে করে তাহারা নারায়ণকেই অবজ্ঞাপূর্বক নিজের পক্ষে না লইয়া নিশ্চিন্ত থাকে। কিন্তু জয়লাভকেই যদি বাস্তবতার শেষ প্রমাণ বলিয়া জানি, তবে নারায়ণ যতই একলা হোন এবং যতই ক্ষুদ্রমূর্তি ধরিয়া আসুন, তিনিই জিতাইয়া দিবেন।” — নারায়নী সেনার কথা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আর্য-অনার্যের মিলন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ( পৃ-৬৮২), ইউরোপের কোন দেশেই ভারতবর্ষের মতো এত বিভিন্ন জাতি, ধর্ম বা বর্ণের মানুষের দেখা মেলে না। ”ভারতবর্ষের ইতিহাস যখনই শুরু হইল সেই মূহূর্তেই বর্ণের সঙ্গে বর্ণের, আর্যের সঙ্গে অনার্যের বিরোধ ঘটিল। তখন হইতে এই বিরোধের দুঃসাধ্য সমন্বয়ের চেষ্টায় ভারতবর্ষের চিত্ত ব্যাপৃত রহিয়াছে। আর্যসমাজে যিনি অবতার বলিয়া গণ্য সেই রামচন্দ্র দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশকে অগ্রসর করিয়া দিবার উপলক্ষে যেদিন গুহক চন্ডালরাজের সহিত মৈত্রী স্থাপন করিয়াছিলেন, যেদিন কিষ্কিন্ধ্যার অনার্যগণকে উচ্ছিন্ন না করিয়া সহায়তায় দীক্ষিত করিয়াছিলেন এবং লঙ্কার পরাস্ত রাক্ষসরাজ্যকে নির্মূল করিবার চেষ্টা না করিয়া বিভীষণের সহিত বন্ধুতার যোগে শত্রুপক্ষের শত্রুতা নিরস্ত করিয়াছিলেন, ভারতবর্ষের অভিপ্রায় এই মহাপুরুষকে অবলম্বন করিয়া নিজেকে ব্যক্ত করিয়াছিল।”
‘সমূহ’ গ্রন্থে পাবনা প্রাদেশিক সন্মিলনীতে ১৩১৪ সালে সভাপতি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ‘সভাপতির অভিভাষণ’ নামে সেটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসাবে তাঁর চাইতে যোগ্যতর লোক হয়তো ছিলেন, হয়তো ছিলেন না; তবুও রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে যথেষ্ট বিনয় প্রকাশ করেছেন। তিনি ভরত-রামচন্দ্রের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন — ”কিন্তু রামচন্দ্র সত্যপালনের জন্য নির্বাসনে গেলে পর ভরত যেভাবে রাজ্যরক্ষার ভার লইয়াছিলেন আমিও তেমনি আমার নমস্য জ্যেষ্ঠগণের খড়মজোড়াকেই মনের সম্মুখে রাখিয়া নিজেকে উপলক্ষ্যস্বরূপ এখানে স্থাপিত করিলাম।”
এই ভাষণের শেষ দিকে তিনি ‘যে সমস্ত দৃঢ়নিষ্ঠ যুবক সমস্ত সংকট উপেক্ষা করিয়াও স্বদেশহিতের জন্য স্বেচ্ছাব্রত ধারণ করিতেছেন’ তাঁদের প্রতি আশীর্বাণী উচ্চারণ করেছেন— ” তোমাদের শক্তি আজ যখন প্রীতিতে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে তখন পাষাণ গলিয়া যাইবে, মরুভূমি উর্বরা হইয়া উঠিবে, তখন ভগবান আর আমাদের প্রতি অপ্রসন্ন থাকিবেন না। তোমরা ভগীরথের ন্যায় তপস্যা করিয়া রুদ্রদেবের জটা হইতে এবার প্রেমের গঙ্গা আনিয়াছ; ইহার প্রবল পুণ্যস্রোতকে ইন্দ্রের ঐরাবতও বাধা দিতে পারিবে না, এবং ইহার স্পর্শমাত্রেই পূর্বপুরুষের ভস্মরাশি সঞ্জীবিত হইয়া উঠিবে।”— ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন, ঐরাবত ইত্যাদি প্রসঙ্গ এই গ্রন্থের অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে।
এই খন্ডের পরিশিষ্ট অংশে ‘ ইংরাজের আতঙ্ক’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। সেখানেও ‘শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা’ শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে। এই আংশিক শ্লোকটি নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে।
ভারতবর্ষে আর্য-অনার্যের মিলন দু’চারদিনে সংঘটিত হয়নি—বহুদিন ধরে বিরোধ-মিলনের মধ্য দিয়ে এই সমন্বয় পর্ব চলেছে। ‘পরিশিষ্ট’ অংশে ‘প্রসঙ্গ-কথা-২’ তে এ ব্যাপারে একটু উল্লেখ আছে (সুলভ-৫ম; পৃ- ৭৩৬)। ”এ এক বহুদিনব্যাপী প্রকান্ড যুদ্ধ। রামায়ণ-মহাভারতের সুবিশাল ছন্দঃস্রোতের মধ্যে এই প্রাণপণ যুদ্ধের প্রলয় কল্লোল এখনো ধ্বনিত হইতেছে।”
পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধিতায় সব ভারতবাসী যে একসুরে কথা বলেছে, এটা কখনোই বলা যাবে না। দলাদলি একটা চিরকালীন ঐতিহ্য। ভারতীয়দের মধ্যেও একটা শ্রেণী ছিল, যারা ইংরেজদের বশংবদ বা তাঁবেদার এবং তারাও খুব কমজোরি ছিল না। পরিশিষ্ট অংশে রবীন্দ্রনাথ ‘মুখুজ্জে বনাম বাঁড়ুজ্জে’ নামক রচনায় (সুলভ-৫ম, পৃ-৭৪৯) এই তাঁবেদার শ্রেণী ও অন্যদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার মধ্যে তিনি মহাভারত-কাহিনী থেকে উপমা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে উদ্ধৃত করি—
”রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় মহাশয় সম্প্রতি এক-সম্প্রদায় জমিদারের মুখপাত্র হইয়া কনগ্রেস-পক্ষীয়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশপূর্বক আক্ষেপ করিয়াছেন যে, দেশের যাহারা ন্যাচারাল লীডার বা স্বাভাবিক অধিনেতা বা প্রকৃত মোড়ল, নানা অস্বাভাবিক কারণে ক্ষমতা তাহাদের হস্ত হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িতেছে।
রাজত্ব কাহার হইবে ইহা লইয়া অনেক দেশে অনেক লড়াই হইয়া গিয়াছে। কুরুপান্ডবের মধ্যেও একটা খুব বড়ো রকম তর্ক হইয়াছিল যে, রাজ্যে কাহার স্বাভাবিক অধিকার। উভয় পক্ষ হইতে যে সকল সূক্ষ্ম এবং স্থূল, তীক্ষ্ম এবং গুরুতর মারাত্মক যুক্তি প্রয়োগ হইয়াছিল মহাভারতে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
দাদা ধৃতরাষ্ট্র বড়ো বটে কিন্তু তিনি অন্ধ, সেইজন্য কনিষ্ঠবংশে রাজ্যের ভার পড়িয়াছিল। আমাদের জমিদার কৌরবপক্ষীয়ের যদি স্বাভাবিক অন্ধতা না থাকিত তবে কনিষ্ঠ কনগ্রেস-পান্ডবগণের নেতৃত্ব-সিংহাসনের দাবী থাকিত না।
যাহা হউক, গৃহবিবাদে মঙ্গল নাই। কতকটা সুখের বিষয় এই যে, এ বিবাদ একটা মৌখিক অভিনয় মাত্র। মুখুজ্জেমশায় মনে মনে বেশ জানেন যে, বাঁড়ুজ্জেমহাশয় কম লোক নহেন, কিন্তু সরকারের কাছে সে কথা বলিয়া সুবিধা নাই। তাঁহাদের বলিতে হয়, হুজুরেরা যে কনগ্রেসকে দু’চক্ষে দেখিতে পারেন না, আমাদেরও ঠিক সেই দশা।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, গান্ধারী সেই আক্ষেপে নিজের চোখে কাপড় বাঁধিতেন, কারণ তিনি সাধ্বী ছিলেন। গবর্মেন্ট যদি কাহারও প্রতি অন্ধ হন তবে মুখুজ্জে মহাশয়ের কর্তব্য চোখে কাপড় বাঁধা, কারণ তাঁহারা খয়ের-খাঁ।
কনগ্রেসকে নির্বাসনে দিয়া নিজেরা পরিপুষ্ট হইবার জন্য জমিদার-সমাজ এ একটা দ্যূতক্রীড়ার সূচনা করিয়াছেন। তাঁহারা সময় বুঝিয়া যে অক্ষ ফেলিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ অকপট নহে ইহাই বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য। এইবার পৌরাণিক তুলনাটাকে খতম করিয়া দিয়া প্রকৃত বিষয়ের অবতারণা করি।”
পরিশিষ্ট অংশেই ‘দেশহিত’ প্রবন্ধে রামায়ণ-মহাভারতের উপদেশ বা শিক্ষার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ”আমাদের দেশের যে দুইটি প্রাচীন মহাকাব্য আছে সেই দুই মহাকাব্যেই এই একটি নীতি প্রচার করিয়াছে যে, অধর্ম যেখানে যে নামে যে বেশেই প্রবেশলাভ করিয়াছে সেইখানেই ভয়ংকর সর্বনাশ সাধন করিয়াছে, আমরা শনির সঙ্গে কলির সঙ্গে আপাতত সন্ধি করিয়া মহৎ কার্য উদ্ধার করিব, এমন ভ্রম আমাদের দেশের কোথাও যদি প্রবেশ করে তবে আমাদের দেশের মহাকবিদের শিক্ষা মিথ্যা ও আমাদের দেশের মহাঋষিদের সাধনা ব্যর্থ হইবে। আমাদের দেশের পূজনীয় শাস্ত্র ফলের আসক্তি ত্যাগ করিতে বলিয়াছেন।
কারণ, ফল লক্ষ্য নহে, ধর্মই লক্ষ্য। দেশের কাজেও ভারতবর্ষ যেন এই শাস্ত্রবাক্য কদাচ বিস্মৃত না হয়। …………… কোনো ফল — সে ফলকে ইতিহাস যত লোভনীয় বলিয়াই প্রচার করুক না — সেরূপ কোনো ফললাভ করিবার জন্য ধর্মকে বিসর্জন দিব এরূপ নাস্তিকতাকে প্রশ্রয় দিলে রক্ষা পাইব না। বাইবেলে কথিত আছে, ফলের লোভে ধর্মকে ত্যাগ করিয়া আদিম মানব স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া মরণধর্ম লাভ করিয়াছে। ফললাভ চরম লাভ নহে, ধর্মলাভেই লাভ, এ কথা যদি কেবল দেশহিতের বেলাতেই না খাটে তবে দেশহিত মানুষের যথার্থ হিত নহে।” — ফলের প্রত্যাশাশূন্য কর্ম শ্রীশ্রীগীতার এক মহাবাণী।
এই খন্ডের ‘গ্রন্থ পরিচয়’ অংশে ( সুলভ-৫ম; পৃ-৮০৭) দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস মহাশয়দের রচনার এবং অন্যান্য গ্রন্থের কথা স্মরণ করেছেন। ”সৌভাগ্যক্রমে আমরা বাল্যকালে বাংলাভাষায় বিদ্যাশিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম। ……… কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, একত্র বাঁধানো বিবিধার্থ সংগ্রহ, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস, বাংলা রবিনসন ক্রুসো, সুশীলার উপাখ্যান, রাজা প্রতাপাদিত্যরায়ের জীবনচরিত, বেতালপঞ্চবিংশতি প্রভৃতি তখনকার কালের গ্রন্থগুলি বিস্তর পাঠ করিয়াছিলাম।”
গ্রন্থপরিচয় অংশে ৮১৩ পৃষ্ঠাতে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান স্মরণ করতে গিয়ে মহাভারতের চরিত্রের উপমা দিয়েছেন। ”সাহিত্যরণরঙ্গভূমে কোনো মহারথী ভীমের মতো গদাযুদ্ধ করেন, আবার কেহ-বা সব্যসাচী অর্জুনের মতো কোদন্ডে ক্ষিপ্রহস্ত। ……….
সাহিত্য কুরুক্ষেত্রে বঙ্কিমবাবু সেই মহাবীর অর্জুন। তাঁহার বিদ্যুৎগামী শরজাল দশ দিক আচ্ছন্ন করিয়া ছুটিতেছে— তাহারা অত্যন্ত লঘু, কিন্তু লক্ষ্য বিদ্ধ করিতে মূহূর্ত কাল বিলম্ব করে না।” অন্যত্র (পৃ-৮০৯) রবীন্দ্রনাথ বলেছেন — ”বঙ্কিম গীতার উপদেশ অনুসারে কেবলমাত্র আপনার কর্ম করিয়া গিয়াছেন, ফললাভের প্রতি দৃকপাত করেন নাই। তিনি নিজে কৃষ্ণকে পরিপূর্ণ ভক্তি করিতেন, অথচ আধুনিক কৃষ্ণভক্তদিগকে প্রসন্ন করিবার কোনো চেষ্টা করেন নাই; তিনি কৃষ্ণের দেবত্বে সম্পূণ বিশ্বাস করিতেন, অথচ বহুযত্নে বহু সাবধানে কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত অলৌকিক অংশ দূর করিয়া দিয়াছেন।”
স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে রবীন্দ্রনাথ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অতি-উৎসাহী বা মেকী স্বদেশীদের ‘বয়কট’ অন্দোলনকে সমর্থন করেননি। গ্রন্থপরিচয় অংশে (সুলভ-৫ম; পৃ-৮২৪) রয়েছে যে এই আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কাহিনী কচের গুরুগৃহ বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। ”কচ দৈত্যগুরুর আশ্রমে আসিয়া দৈত্যদের উৎপীড়ন ও গুরুর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধৈর্য্য ও কৌশল অবলম্বনপূর্বক বিদ্যালাভ করিয়া দেবগণকে জয়ী করিয়াছেন। জাপানও য়ুরোপের আশ্রম হইতে এইরূপ কচের মতোই বিদ্যালাভ করিয়া আজ জয়যুক্ত হইয়াছেন।” — বিদায় অভিশাপ কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে কচের কাহিনী বিস্তারিত বলা হয়েছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন