ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড

ষোড়শ অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড)

সুলভ সংস্করণে ইতিমধ্যে প্রকাশিত পূরবী, বীথিকা, প্রহাসিনী, রোগশয্যায়, জন্মদিনে, গল্পস্বল্প ও স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থে কিছু কিছু কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ‘সংযোজন’ নাম দিয়ে উপরোক্ত কাব্যগ্রন্থসমূহের সেই অন্তর্ভুক্ত না হওয়া কবিতাগুলি এই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। কোন কবিতাতেই রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ নেই।

নূতন সংকলনে রয়েছে চিত্রবিচিত্র, রূপান্তর ও অনূদিত কবিতা। শেষেরটির মধ্যে রামায়ণ মহাভারতের কথা নেই।

নাটক ও প্রহসন অংশে রয়েছে মালঞ্চ, হাস্যকৌতুক, হেঁয়ালী নাট্য ও বিসর্জন। কবির ‘মালঞ্চ’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল আগে এবং সেটি নাটকাকারে পরে প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডের বিসর্জন নাটকটি মূল নাটকের সংক্ষিপ্তরূপ ও নারীচরিত্র বর্জিত। এই খণ্ডের হাস্যকৌতুকে এবং বিসর্জনে রামায়ণ মহাভারতের কোন কথা নেই।

উপন্যাস ও গল্প অংশে রয়েছে ‘ইঁদুরের ভোজ’ নামে একটি গল্প। এখানে রামায়ণ মহাভারতের কোন কথা নেই।

প্রবন্ধ অংশে রয়েছে ‘শিক্ষা : সংযোজন’, বাংলা শব্দতত্ত্ব এবং সঙ্গীতচিন্তা-সংযোজন। এছাড়াও আছে বিস্তৃত গ্রন্থপরিচয় অংশ।

চিত্রবিচিত্র কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতা আছে—চিত্রকূট। চিত্রকূট পাহাড়ের কথা রামায়ণে আছে। বনবাসের সময় রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা কিছুদিন এই চিত্রকূট পাহাড়ে ছিলেন। এই কবিতার বালক বক্তা বলেছে যে তাদের রান্নাঘরের পাশে একটুখানি জায়গা ছিল, সেইখানে তার খেলা চলত। সেখানে একটা ছাইয়ের গাদার ঢিবি ছিল—খেলুড়ের পাহাড়। বালকটি সেখানে একটি তেঁতুলের চারা করেছিল।

 ”একটি মাত্র গাছ সে আমার

 একটুকু সেই কোণ,

 চিত্রকূটের পাহাড়-তলায়

 সেই হল মোর বন।

 কেউ জানে না সেথায় থাকেন

 অষ্টাবক্র মুনি—

 মাটির ‘পরে দাড়ি গজায়,

 কথা কন না উনি।”

নয় বছরের জন্মদিনে সেই বালকের সেখানকার খেলা শেষ হয়ে গেল।

 ”আর সেখানে নেই তপোবন

 বয় না সুরধনী—

 অনেক দূরে চ’লে গেছেন

 অষ্টাবক্র মুনি।”

অষ্টাবক্র পৌরাণিক ঋষি-মহাভারতে তাঁর উল্লেখ আছে। তাঁর লেখা ‘অষ্টাবক্র সংহিতা’ এখনো বহু জায়গায় আদরের সঙ্গে পাঠ করা হয়।

এই গ্রন্থেই ‘হনুচরিত’ নামে একটি কবিতা আছে। হনুমান রামায়ণের চরিত্র। তিনি শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং মহাবীর। হনুমানের বিশল্যকরণী আনতে গিয়ে সমস্ত গন্ধমাদন পাহাড়টাই নিয়ে আসার কাহিনী, যাঁরা রামায়ণ পড়েছেন তাঁরা সবাই জানেন। এই কবিতার কিছু অংশ :

 ”হনু বলে, তুলব আমি গন্ধমাদন,

 অসাধ্য যা তাই জগতে করব সাধন।

 এই ব’লে তার প্রকাণ্ড কায় উঠল ফুলে।

 মাথাটা তার কোথায় গিয়ে ঠেকল মেঘে,

 শালের গুঁড়ি ভাঙল পায়ের ধাক্কা লেগে,

 দশটা পাহাড় ঢাকল তাহার দশ আঙুলে।

 পড়ল বিপুল দেহের ছায়া যে দিক বাগে

 দুপুর-বেলায় সেথায় যেন সন্ধ্যা লাগে,

 গোরু যত মাঠ ছেড়ে সব গোষ্ঠে ছোটে।”

 ”লেজ বেড়ে যায় হু হু ক’রে এঁকে বেঁকে,

 লেজের মধ্যে বন্যা নামল কোথা থেকে,

 নগর পল্লী তলায় তাহার চাপা পড়ে।”

 ”লেজের পাকে পাহাড়টাকে দিল মোড়া,

 ঝেঁকে ঝেঁকে উঠল কেঁপে আগাগোড়া,

 দুড়দাড়িয়ে পাথর পড়ে খ’সে খ’সে।”

 ”উপুড় হয়ে গন্ধমাদন পড়ল লুটে,

 বসুন্ধরার পাষাণ-বাঁধন যায় রে টুটে।”

 ”গন্ধমাদন উড়ল হনুর পৃষ্ঠে চেপে,

 লাগল হনুর লেজের ঝাপট আকাশ ব্যেপে—

 অন্ধকারে দন্ত তাহার ঝিকিমিকে।”

সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা থেকে অনূদিত বা রূপান্তরিত কিছু কবিতা রূপান্তর গ্রন্থে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে মহাভারতের দুটি শ্লোকও তিনি কবিতায় রূপ দিয়েছিলেন। মূল শ্লোক এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অনুবাদ নীচে দেওয়া হলো—

মহাভারত। মনুসংহিতা

 প্রহরিষ্যন প্রিয়ং ব্রূয়াৎ

 প্রহৃত্যাপি প্রিয়োত্তরম।

 অপি চাস্য শিরশ্ছিত্ত্বা

 রুদ্যাৎ শোচেৎ তথাপি চ।।

 —মহাভারত, আদিপর্ব ১৪০.৫৬

 মারিতে মারিতে কহিবে মিষ্ট,

 মারিয়া কহিবে আরো।

 মাথাটা কাটিয়া কাঁদিয়া উঠিবে

 যতটা উচ্চে পারো।।

 সুখং বা যদি বা দুঃখং

 প্রিয়ং বা যদি বাপ্রিয়ম।

 প্রাপ্তং প্রাপ্তমূপাসীত

 হৃদয়েনাপরাজিতঃ।।

—মহাভারত, শান্তিপর্ব ১৭৪.৩৯

 সুখ বা হোক দুখ বা হোক,

 প্রিয় বা অপ্রিয়,

 অপরাজিত হৃদয়ে সব

 বরণ করিয়া নিয়ো।।

পা ঠা ন্ত র

 সুখ হোক দুঃখ হোক,

 প্রিয় হোক অথবা অপ্রিয়,

 যা পাও অপরাজিত

 হৃদয়ে বহন করি নিয়ো।।

পা ঠা ন্ত র

 আসুক সুখ বা দুঃখ,

 প্রিয় বা অপ্রিয়,

 বিনা পরাজয়ে তারে

 বরণ করিয়ো।।

মারাঠী তুকারামের একটি ছোট কবিতায় রামনামের কথা আছে। কবি সেটিও কবিতায় অনুবাদ করেছেন। মূল এবং কবিকৃত অনুবাদ দুটিই নীচে দেওয়া হলো।

 সখে সজ্জনহো ঘ্যারে রামনাম।

 সঙ্গে এতো কোণ নিশ্চয়েসী।।

 আমুচে গাবীঞ্চে জরী রত্ন গেলেঁ।

 নাহিঁ সাংগীতলে হ্মণাল কোণী।।

 হ্মণোনীয়া জরী তূহ্মাঁ করিতোঁ ঠাওয়েঁ।

 ন কলে তরী জাওয়ে পুঢে বাটে।।

 ইতক্যাবরী রহাল জরী তুমহি মাগে।

 তুকা নিরোপ সাঙ্গে বিঠোবাশিঁ।।

 বন্ধুগণ, শুন, রামনাম করো সবে—

 তিনি ছাড়া সত্য বলো কী আছে এ ভবে,

 ‘গ্রামের রত্ন যে ছিল সে ছাড়িল দেহ

 মোদের সে বার্তা তবু জানালে না কেহ’

 পাছে এই কথা বলো ভয় করি, তাই

 পৃথ্বী ছাড়িবার আগে জানাইনু ভাই!

 লইয়া ধ্বজার বোঝা, করি ভেরীরব

 পাণ্ডরীপুরেতে যায় হরিভক্ত সব।

মালঞ্চ নাটকের একজায়গায় মহাভারতের দুঃশাসনের নাম আছে। এখনকার দিনের সভ্যতার কথা বলতে গিয়ে আদিত্য বলছে—”এখনকার সভ্যতাটা দুঃশাসনের মতো হৃদয়ের বস্ত্র হরণ করতে চায়। অনুভব করবার পূর্বেই জানিয়ে দেয় চোখে আঙুল দিয়ে।”

শিক্ষা—সংযোজন—এখানে মোট বারোটি প্রবন্ধ আছে। ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ প্রবন্ধে কবি প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রদের সঙ্গে এক ইউরোপীয় অধ্যাপকের যে বিরোধ ঘটেছিল তার কথা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি অবাঞ্ছিত এটা মেনে নিয়েও কবি বলছেন যে অল্পবয়সী ছাত্রেরা স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। তাদের প্রতি যার দরদ নেই তার অধ্যাপক হওয়া সাজে না। ”যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনো মতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া। ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীন ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা করিতে পারেন; যাঁরা জানেন, শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা; যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে কুণ্ঠিত হন না।”

সংস্কৃত শব্দ কয়টি মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের একটি শ্লোক থেকে নেওয়া। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হলো—

 ”সোহস্য দোষো ন মন্তব্যঃ ক্ষমা হি পরমং বলম্।

 ক্ষমা গুণোহ্যশক্তানাং শক্তানাং ভূষণং ক্ষমা।।”

এই শ্লোকের অর্থ ইত্যাদি ষষ্ঠ অধ্যায়ে বলা হয়েছে।

‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন যে একথা অনস্বীকার্য আজকের দিনে পৃথিবীতে পশ্চিমের লোক জয়ী হয়েছে। পশ্চিমের লোকে যে বিদ্যার জোরে বিশ্ব জয় করেছে সেই বিদ্যাকে গাল পাড়তে থাকলে দুঃখ কমবে না, কেবল অপরাধ বাড়বে। কারণ, বিদ্যাটি সত্য। ”দেবতার অধিকার আধ্যাত্মিক মহলে, আর দৈত্যের অধিকার বিশ্বের আধিভৌতিক মহলে। দৈত্য বলছি আমি বিশ্বের সেই শক্তিরূপকে যা সূর্যনক্ষত্র নিয়ে আকাশে আকাশে তালে তালে চক্রে চক্রে লাঠিম ঘুরিয়ে বেড়ায়। সেই আধিভৌতিক রাজ্যের প্রধান বিদ্যাটা আজ শুক্রাচার্যের হাতে। সেই বিদ্যাটার নাম সঞ্জীবনী বিদ্যা।”

শুক্রাচার্য, সঞ্জীবনীবিদ্যা—এই সমস্ত নিয়ে ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতা প্রসঙ্গে আগে আলোচনা করা হয়েছে।

জ্ঞান আহরণ করতে গিয়ে ক্ষেত্রবিচার করার কোনো প্রয়োজন নেই—একথা রবীন্দ্রনাথ অনেক জায়গাতেই বলেছেন। এই প্রবন্ধেও কবি বলছেন—”অবিদ্যার পথ দিয়ে মৃত্যু থেকে বাঁচতে হবে, তার পরে বিদ্যার তীর্থে অমৃত লাভ হবে। শুক্রাচার্য এই মৃত্যু থেকে বাঁচাবার বিদ্যা নিয়ে আছেন, তাই অমৃতলোকের ছাত্র কচকেও এই বিদ্যা শেখবার জন্য দৈত্য পাঠশালার খাতায় নাম লেখাতে হয়েছিল।”

এই প্রবন্ধের অন্যত্র কবি লিখেছেন—’মানুষ যখন একত্র হয় তখন যদি এক হতে না পারে তা হলেই সে সত্য হতে বঞ্চিত হয়। একত্রিত মনুষ্যদলের মধ্যে যারা যদুবংশের মাতাল বীরদের মতো কেবলই হানাহানি করেছে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনি, পরস্পরকে বঞ্চিত করতে গিয়েছে, তারা কোন কালে লোপ পেয়েছে। আর, যারা এক আত্মাকে আপনাদের সকলের মধ্যে দেখতে চেয়েছিল তারাই মহাজাতিরূপে প্রকাশ পেয়েছে।’

মহাভারতে আছে যদুবংশ (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন) আত্মকলহে বিনষ্ট হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামের ছত্রছায়ায় থেকে তারা শক্তিশালী, দুর্বিনীত ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছিল। তাদের বিনাশ না করলে শ্রীকৃষ্ণ অবতারের যে উদ্দেশ্য, ধরার ভার হরণ, সেটি সম্পূর্ণ হয় না। তাই তাদের বিনাশের ব্যবস্থা শ্রীকৃষ্ণই করেছিলেন। সেই বিশেষ দিনটিতে সম্ভবত একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর সকলেই প্রভাসতীর্থে সমবেত হয়ে আকণ্ঠ মদ্যপান করেছিল যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল সমূলে বিনাশ।

কবি বলছেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোনো কোনো জায়গায় বাহ্যিক একটা মিলের মতো হলেও মানুষ অন্তরে মিলতে পারে নি। ‘যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছিল তখন সকলেই ভাবছিল, যুদ্ধ মিটলেই অকল্যাণ মিটবে। যখন মিটল তখন দেখা গেল, ঘুরে ফিরে সেই যুদ্ধটাই এসেছে সন্ধিপত্রের মুখোশ পরে। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের গোড়ায় দেখি সেই লেজটার উপর মোড়কে মোড়কে সন্ধিপত্রের স্নেহস্নিক্ত কাগজ জড়ানো চলেছে; বোঝা যাচ্ছে এটাতে আগুন যখন ধরবে তখন কারোর ঘরের চাল আর বাকি থাকবে না। পশ্চিমের মনীষী লোকেরা ভীত হয়ে বলছেন যে, যে দুর্বুদ্ধি থেকে দুর্ঘটনার উৎপত্তি এত মারের পরেও তার নাড়ী বেশ তাজা আছে। এই দুর্বুদ্ধিরই নাম ন্যাশনালিজম, দেশের সর্বজনীন আত্মম্ভরিতা। এ হল রিপু, ঐক্যতত্ত্বের উলটো দিকে অর্থাৎ আপনার দিকটাতেই এর টান। কিন্তু জাতিতে জাতিতে আজ একত্র হয়েছে এই কথাটা যখন অস্বীকার করবার জো নেই, এত বড়ো সত্যের উপর যখন কোনো একটামাত্র প্রবল জাতি আপন সাম্রাজ্যরথ চালিয়ে দিয়ে চাকার তলায় একে ধুলো করে দিতে পারে না, তখন এর সঙ্গে সত্য ব্যবহার করতেই হবে। তখন ঐ রিপুটাকে এর মাঝখানে আনলে শকুনির মতো কপট দ্যূতের ডিপ্লমাসিতে বারে বারে সে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে।’—কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড, হনুমানের লেজ, এগুলো সব রামায়ণের কথা। শকুনি, কপট দ্যূত, কুরুক্ষেত্র এগুলো মহাভারতের কথা।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রতিরূপ একদিন ভারতবর্ষেই দেখা দিয়েছিল নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশিলা বিদ্যায়তনের মধ্যে। কবি আরো বলেছেন—”এর থেকে মনে পড়ে ভারতবর্ষে বেদব্যাসের যুগ, মহাভারতের কাল। দেশে যে বিদ্যা, যে মননধারা, যে ইতিহাসকথা দূরে দূরে বিক্ষিপ্ত ছিল, এমন-কি দিগন্তের কাছে বিলীনপ্রায় হয়ে এসেছে, এক সময়ে তাকে সংগ্রহ করা তাকে সংহত করার নিরতিশয় আগ্রহ জেগেছিল সমস্ত দেশের মনে। নিজের চিৎপ্রকর্ষের যুগব্যাপী ঐশ্বর্যকে সুস্পষ্টরূপে নিজের গোচর করতে না পারলে তা ক্রমশ অনাদরে অপরিচয়ে জীর্ণ হয়ে বিলুপ্ত হয়। কোনো এক কালে এই আশঙ্কায় দেশ সচেতন হয়ে উঠেছিল; দেশ একান্ত ইচ্ছা করেছিল, আপন সূত্রচ্ছিন্ন রত্নগুলিকে উদ্ধার করতে, সংগ্রহ করতে, তাকে সূত্রবদ্ধ করে সমগ্র করতে এবং তাকে সর্বলোকের ও সর্বকালের ব্যবহারে উৎসর্গ করতে। দেশ আপন বিরাট চিন্ময়ী প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষরূপে সমাজে স্থিরপ্রতিষ্ঠ করতে উৎসুক হয়ে উঠল। যা আবদ্ধ ছিল বিশেষ বিশেষ পণ্ডিতের অধিকারে তাকেই অনবচ্ছিন্নরূপে সর্বসাধারণের আয়ত্তগোচর করবার এই এক আশ্চর্য অধ্যবসায়। এর মধ্যে একটি প্রবল চেষ্টা, অক্লান্ত সাধনা, একটি সমগ্রদৃষ্টি ছিল। এই উদ্যোগের মহিমাকে শক্তিমতী প্রতিভা আপন লক্ষ্যভূত করেছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় মহাভারত নামটিতেই। মহাভারতের মহৎ সমুজ্জ্বল রূপ যাঁরা ধ্যানে দেখেছিলেন ‘মহাভারত’ নামকরণ তাঁদেরই কৃত। সেই রূপটি একই কালে ভৌমণ্ডলিক রূপ এবং মানস রূপ। ভারতবর্ষের মনকে দেখেছিলেন তাঁরা মনে। সেই বিশ্বদৃষ্টির প্রবল আনন্দে তাঁরা ভারতবর্ষে চিরকালের শিক্ষার প্রশস্ত ভূমি পত্তন করে দিলেন। ….ভারতে এই-যে মহাভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-যুগের উল্লেখ করলেম সেই যুগের মধ্যে তপস্যা ছিল; তার কারণ, ভাণ্ডারপূরণ তার লক্ষ্য ছিল না; তার উদ্দেশ্য ছিল সর্বজনীন চিত্তের উদ্দীপন, উদবোধন, চারিত্রসৃষ্টি।”

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ব্যাপকতায় বিশ্বাস করতেন—’শিক্ষা চায় দেশজোড়া ভূমিকা। ‘শিক্ষার বিকিরণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে এটা ”এককালে আমাদের দেশেও ছিল। … এই শিক্ষার বিশেষ চর্চা টোলে, চতুষ্পাঠিতে, কিন্তু সমস্ত দেশেই বিস্তীর্ণ ছিল বিদ্যার ভূমিকা। … দেশে এমন অনাদৃত অংশ ছিল না যেখানে রামায়ণ মহাভারত পুরাণকথা ধর্মব্যাখ্যা নানা প্রণালী বেয়ে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে না পড়ত। এমন-কি, যে-সকল তত্ত্বজ্ঞান দর্শনশাস্ত্রে কঠোর অধ্যবসায়ে আলোচিত তারও সেচন চলেছিল সর্বক্ষণ জনসাধারণের চিত্তভূমিতে। ….. এমনি কতকাল চলেছে দেশে; বার বার বিচিত্র রসের যোগে লোকে শুনেছে ধ্রুব-প্রহ্লাদের কথা, সীতার বনবাস, কর্ণের কবচদান, হরিশ্চন্দ্রের সর্বস্বত্যাগ। তখন দুঃখ ছিল অনেক, অবিচার ছিল, জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা ছিল পদে পদে, কিন্তু সেইসঙ্গে এমন একটি শিক্ষার প্রবাহ ছিল যাতে করে ভাগ্যের বিমুখতার মধ্যে মানুষকে তার আন্তরিক সম্পদের অবারিত পথ দেখিয়েছে ….।”

‘শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা’ মহাভারতের এই শ্লোকাংশটি কবি ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধেও ব্যবহার করেছেন। ”যে দারিদ্র শক্তিহীনতা থেকে উদভূত সে কুৎসিত। কথা আছে : শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। তেমনি বলা যায়, সামর্থ্যবানেরই ভূষণ অকিঞ্চনতা। অতএব সামর্থ্য শিক্ষা করাই চাই ভোগের অভ্যাস বর্জন করে। সামর্থ্যহীন দারিদ্রেই ভারতবর্ষের মাথা হেঁট হয়ে গেছে, অকিঞ্চনতায় নয়। অক্ষমকে দেবতা ক্ষমা করেন না।

‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে একদল ছাত্র স্বভাবতই ভাষাশিক্ষায় অপটু। ”গোড়ার দিকে ভালো শিক্ষকের কাছে ভালো নিয়মে ইংরেজী শেখার সুযোগ অল্প ছেলেরই হয়, গরিবের ছেলের তো হয়ই না। তাই অনেকস্থলেই বিশল্যকরণীর পরিচয় ঘটে না বলেই গোটা ইংরেজী বই মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না। সেরকম ত্রেতাযুগীয় বীরত্ব ক’জন ছেলের কাছে আশা করা যায়?”

রামায়ণে আছে যে লক্ষ্মণের চিকিৎসার জন্য বিশল্যকরণী (medicinal plant) প্রয়োজন হয়েছিল। সেটা পাওয়া যেত গন্ধমাদন পর্বতে। হনুমান বিশল্যকরণী গাছ চিনতে না পেরে গন্ধমাদন পর্বতটাই উঠিয়ে এনেছিলেন।

আবার ‘শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা’—এবারে ‘আশ্রমের শিক্ষা’ প্রবন্ধে। ”রাষ্ট্রতন্ত্রেই হোক আর শিক্ষাতন্ত্রেই হোক, কঠোর শাসননীতি শাসয়িতারই অযোগ্যতার প্রমাণ। শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। ক্ষমা যেখানে ক্ষীণ সেখানে শক্তিরই ক্ষীণতা।”

কবি প্রথমজীবনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মেঘনাদবধের বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি অবশ্য তাঁর মতের পরিবর্তন করেছিলেন। ‘ছাত্রসম্ভাষণ’ নামক রচনাটিতে দেখুন কবি কী লিখেছেন—”ইংরেজী ভাষায় ও সাহিত্যে মাইকেলের অধিকার ছিল প্রশস্ত, অনুরাগ ছিল সুগভীর। … স্বভাবতই প্রথমে তাঁর মন গিয়েছিল ইংরেজী ভাষায় কাব্য রচনা করতে। কিন্তু, একথা বুঝতে তাঁর বিলম্ব হয়নি যে ধার-করা ভাষায় সুদ দিতে হয় অত্যধিক ….। তিনি প্রথমেই মাতৃভাষায় এমন একটি কাব্যের আবাহন করলেন যে কাব্যে স্খলিতগতি প্রথমপদচারণার ভীরু সতর্কতা নেই। এই কাব্যে বাহিরের গঠনে আছে বিদেশী আদর্শ, অন্তরে আছে কৃত্তিবাসী (কৃত্তিবাস রামায়ণ মহাগ্রন্থ বাংলা পদ্যে ভাবানুবাদ করেছিলেন) বাঙালী কল্পনার সাহায্যে মিলটন-হোমার-প্রতিভার অতিথিসৎকার। এই আতিথ্যে অগৌরব নেই, এতে নিজের ঐশ্বর্যের প্রমাণ হয় এবং তার বৃদ্ধি হতে থাকে।”

ঐ একই প্রবন্ধে অন্যত্র কবি মহাভারতের কাহিনী সমুদ্রমন্থনের কথা স্মরণ করেছেন। ”আজ প্রচণ্ড আলোড়ন উঠেছে পৃথিবীব্যাপী জনসমুদ্রে। যেন সমস্ত সভ্যজগৎকে এক কল্প থেকে আর-এক কল্পের তটে উৎক্ষিপ্ত করবার জন্যে দেব—দৈত্যে মিলে মন্থন শুরু হয়েছে। এবারকারও মন্থনরজ্জু বিষধর সর্প, বহুফণাধারী লোভের সর্প। সে বিষ উদগার করছে। আপনার মধ্যে সমস্ত বিষটাকে জীর্ণ করে নেবেন এমন মৃত্যুঞ্জয় শিব পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার মর্মস্থানে আসীন আছেন কিনা এখনো তার প্রমাণ পাই নি। ভারতবর্ষে আমরা আদিকালের রুদ্রলীলাসমুদ্রের তটসীমায়।”

‘তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়’।—কথাটি ধৃতরাষ্ট্রের, বলেছিলেন সঞ্জয়কে। অতীতের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে যখন তিনি ওইসব ঘটনার কথা শুনেছেন, তখন থেকে আর যুদ্ধে জয়ের আশা করেন নাই। এই ছাত্রসম্ভাষণ প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ এই কথা ব্যবহার করেছেন। ”যখনই আমাদের দুর্গতির সকল দায়িত্ব একমাত্র বাহিরের অবস্থার অথবা অপর কোনো পক্ষের প্রতিকূলতার উপর আরোপ করে বধির শূন্যের অভিমুখে তারস্বরে অভিযোগ ঘোষণা করি তখনই হতাশ্বাস ধৃতরাষ্ট্রের মতো মন ব’লে ওঠে : তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়।

বাংলা শব্দতত্ত্ব—শব্দতত্ত্ব নামে একখানি গ্রন্থ সুলভ সংস্করণের ষষ্ঠ খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থপরিচয় অংশে বলা হয়েছে যে ষষ্ঠ খণ্ডের শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে যে সমস্ত রচনাগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়নি সেগুলি এই খণ্ডের বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। যারা বাংলাভাষা বা বাংলা ব্যাকরণে আগ্রহী, এই প্রবন্ধগুলি পাঠ করলে তাঁরা অনেক নতুন কথা জানতে পারবেন। রামায়ণ মহাভারতের বিষয় বা চরিত্র নিয়ে এই গ্রন্থে কিছু কিছু উল্লেখ আছে। সেগুলি এখন আলোচিত হবে।

‘ভাষার কথা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”বাংলা গদ্যসাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাশে এবং তার সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁদের ভাসুর-ভাদ্র বউয়ের সম্বন্ধ। …..তাঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে কিন্তু গতি নাই। সীতাকে নির্বাসন দিয়া যজ্ঞকর্তার ফরমাসে তাঁরা সোনার সীতা গড়িলেন।”

সোনার সীতার কথা রামায়ণের কাহিনী। লোকোপবাদে সীতাকে রাম বনবাসে বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু সেই শোকে আবার তিনি অস্থির। কৃত্তিবাসের রামায়ণে আছে রাম লক্ষ্মণকে বলছেন—

 ”আমার বচন শুন ভাই তিনজন।

 রাত্রিমধ্যে স্বর্ণসীতা করহ গঠন।।

 জানকী আনিলে নিন্দা করিবে যে লোক।

 দেখিয়া সোনার সীতা পাসরিব শোক।।”

বাংলায় লেখার ভাষা এবং কথার ভাষার মধ্যে এত প্রভেদ কেন একথা বলতে গিয়ে কবি ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের বৃত্তান্ত স্মরণ করেছেন। ”জলের পরিমাণ যতটা, নদী-পথের গভীরতা ও বিস্তার সেই অনুসারেই হইয়া থাকে। স্বয়ং ভগীরথও আগে লম্বা-চওড়া পথ কাটিয়া তার পরে গঙ্গাকে নামাইয়া আনেন নাই।”

‘বঙ্গভাষা’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”বাংলার ভাষাতত্ত্ব-সন্ধানের একটি ব্যাঘাত, প্রাচীন পুঁথির দুষ্প্রাপ্যতা। কবিকঙ্কণচণ্ডী, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন কাব্যগুলি জনসাধারণের সমাদৃত হওয়াতে কালে কালে অল্পে অল্পে পরিবর্তিত ও সংশোধিত হইয়া আসিয়াছে।”

ভাষা নিয়ে বলতে গিয়ে ‘বাংলা ব্যাকরণের তির্যকরূপ’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে ‘রামে মারলেও মরব রাবণে মারলেও মরব।’ বস্তুত এখানে ‘রাম’ ও ‘রাবণ’ সামান্য বিশেষ্যপদ—এখানে উক্ত দুই শব্দের দ্বারা দুই প্রতিপক্ষকে বুঝাইতেছে। কোনো বিশেষ রাম-রাবণকে বুঝাইতেছে না।”

‘প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে ইংরাজী sympathy শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে ‘সহানুভূতি’ বলিয়া একটা বিকট শব্দ জোর করিয়া বানাইতে হইয়াছে; এই গুরুভার শব্দটা ভীমের গদার মতো, ইহাকে লইয়া সর্বদা সাধারণ কাজে ব্যবহার করিতে গেলে বড়োই অসংগত হয়।”

‘কর্তৃকারক’ প্রবন্ধে ‘রামে মারলেও মরব, রাবণে মারলেও মরব’ এই প্রবাদ সম্বন্ধে লিখেছেন ”রাম ও রাবণ ব্যক্তিবিশেষের অর্থ ত্যাগ করিয়া জাতিবিশেষের অর্থ ধারণ করে।”

‘সর্বনাম’ প্রবন্ধে কবি কর্ণ অর্জুনের কথা এনেছেন। ”কর্ণ অর্জুন উভয়ে সহোদর ভাই হওয়া সত্বেও তাদের মধ্যে যখন জাতিভেদ ঘটেছিল, একজন রইল ক্ষত্রিয় আর একজন হ’ল সূত, তখনি দুই পক্ষে ঘোর বিরোধ বেধে গেল। বাংলা লেখায় আর কথায় আজ সেই দ্বন্দ্ব বেধে গেছে। এরা সহোদর অথচ এদের মধ্যে ঘটেছে শ্রেণীভেদ; একটি হলেন সাধু, আর একটি হলেন অসাধু। এই শ্রেণীভেদের কারণ ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।”

এই গ্রন্থের ‘বিবিধ’ প্রবন্ধের ৩ সংখ্যক লেখাতে কবি রামায়ণের সীতার কথা এনেছেন। ”বাংলা লেখকের পুরস্কার যে খুব বেশি তাহা নয়, ইহার উপরে তাহার লেখনী চালনার পথ যদি অত্যন্ত দুর্গম করা হয় তবে সীতা পাইবার আশা (বইতে রয়েছে ‘আসা’—সম্ভবত ছাপার ভুল) পরিত্যাগ করিয়াও লোককে ধনুক ভাঙিতে ডাকা হয়।”

‘বাংলার বানান সমস্যা’ প্রবন্ধে কবি সোনার সীতার কথা মনে করেছেন। ”আজকাল অনেকেই লেখেন ‘ভেতর’ ‘ওপর’ ‘চিবুতে’ ‘ঘুমুতে’, আমি লিখি নে, কিন্তু কার বিধানমতে চলতে হবে। কেউ কেউ বলেন প্রাকৃত বাংলা ব্যবহারে যখন এত উচ্ছৃঙ্খলতা তখন ওটাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে পণ্ডিতি বাংলার শরণ নেওয়াই নিরাপদ। তার অর্থ এই যে, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করার চেয়ে কাঠের পুতুলের সঙ্গে ব্যবহারে আপদ কম। কিন্তু এমন ভীরু তর্কে সাহিত্য থেকে আজ প্রাকৃতবাংলার ধারাকে নিবৃত্ত করার সাধ্য কারো নেই। সোনার সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্রের সংসার চলে নি। নিকষ এবং তৌলদণ্ডের যোগে সেই সীতার মূল্য পাকা করে বেঁধে দেওয়া সহজ, কিন্তু সজীব সীতার মূল্য সজীব রামচন্দ্রই বুঝতেন, তাঁর রাজসভার প্রধান স্বর্ণকার বুঝতেন না, কোষাধ্যক্ষও নয়। আমাদের প্রাকৃত বাংলার যে মূল্য, সে সজীব প্রাণের মূল্য, তার মর্মগত তত্ত্বগুলি বাঁধা নিয়ম আকারে ভালো করে আজও ধরা দেয় নি বলেই তাকে দুয়োরানীর মতো প্রাসাদ ছেড়ে গোয়ালঘরে পাঠাতে হবে, আর তার ছেলেগুলোকে পুঁতে ফেলতে হবে মাটির তলায়, এমন দণ্ড প্রবর্তন করার শক্তি কারো নেই।”

‘চিহ্নবিভ্রাট’ প্রবন্ধের ২ সংখ্যক লেখাতে কবি লিখেছেন—”আমার প্রুফ-সংশোধন প্রণালী দেখলেই বুঝতে পারবে আমি নিরঞ্জনের উপাসক— চিহ্নের অকারণ উৎপাত সইতে পারি নে। . . . আমি যে নির্বিচারে চিহ্ন-সূয়যজ্ঞের জনমেজয়গিরি করতে বসেছি তা মনে কোরো না।”

জনমেজয় ছিলেন অর্জুনের প্রপৌত্র। তিনি সর্পকূল নির্মূল করার জন্য সর্পযজ্ঞ করেছিলেন। ‘রাজসূয়’ শব্দটার অনুসরণে তিনি সম্ভবত ‘চিহ্নসূয়’ কথাটা লিখেছেন।

‘জাতীয় সাহিত্য’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”লিটারেচর’ শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদূর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে ‘মনুষ্যকৃতশ্লোকময়গ্রন্থবিশেষঃ। স তু ভট্টিরঘুকুমারসম্ভবমাঘভারবিমেঘদূত বিদগ্ধমুখমণ্ডনশান্তিশতক প্রভৃতয়ঃ।’ এমন-কি, রামায়ণ মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল।”

‘নামের পদবী’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন যে ভারতবর্ষে বাংলা দেশ ছাড়া প্রায় সকল প্রদেশেই পদবীহীন নাম বিনা উপদ্রবেই চলে আসছে। এই প্রসঙ্গে তিনি মহাভারত থেকে উদাহরণ দিয়েছেন।

”প্রাচীনকালের দিকে তাকালে নল-দময়ন্তী বা সাবিত্রী-সত্যবানের কোনো পদবী দেখা যায় না। একান্ত আশা করি, নলকে নলদেববর্মা বলে ডাকা হত না। কুলপদবীর সমাসযোগে যুধিষ্ঠির-পাণ্ডব বা দ্রৌপদী-পাণ্ডব নাম পুরাণ-ইতিহাসে চলে নি, সমাজে চলতি ছিল এমন প্রমাণ নেই। বিশেষ প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত নামের সঙ্গে আরো কিছু বিশেষণ যোগ করা চলত। যেমন সাধারণত ভগবান মনুকে শুদ্ধ মনু নামেই আখ্যাত করা হয়েছে, তাতে অসুবিধা ঘটেনি—তবু বিশেষ প্রয়োজনস্থলেই তাঁকে বৈবস্বত মনু বলা হয়ে থাকে, সর্বদা নয়।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহাভারতের দৃষ্টান্ত পুরোপুরি ব্যবহার করতে সাহস করি নে। নামের ভার যথাসম্ভব লাঘব করারই আমি সমর্থন করি, এক মানুষের বহুসংখ্যক নামকরণ দ্বাপর-ত্রেতাযুগে শোভা পেত এখন পায় না। বাপের পরিচয়ে কৃষ্ণার নাম ছিল দ্রৌপদী, জন্মস্থানের পরিচয়ে পাঞ্চালী, জন্ম-ইতিহাসের পরিচয়ে যাজ্ঞসেনী। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, শ্বশুরকূলের পরিচয়ে তাঁকে পাণ্ডবী বলা হয় নি। প্রাচীনকালে কোনো স্ত্রীর নামের সঙ্গে স্বামীর পরিচয় যুক্ত আছে এমন তো মনে পড়ে না।”

কবি লিখছেন ”আমার প্রস্তাব হচ্ছে, ব্যক্তিগত নামটাকে বজায় রেখে আর সমস্ত বাদ দেওয়া, . . . ফুলের বৃন্ত যেমন, মানুষের ব্যক্তিগত নামটি তেমনি। এই বৃন্ত থেকে প্রশাখায়, প্রশাখা থেকে শাখায়, শাখা থেকে গাছে, গাছ হয়তো আছে টবে। কিন্তু যখন ফুলটির সঙ্গেই বিশেষ ব্যবহার করতে হয়, যেমন মালা গাঁথতে . . . তখন গাছশুদ্ধ টবশুদ্ধ যদি টানি তবে বৈশল্যকরণীর প্রয়োজনে গন্ধমাদন নাড়ানোর দ্বিতীয় সংস্করণ হয়।”

সঙ্গীতচিন্তা—’সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”আমাদের রামায়ণ মহাভারত সুরে গাওয়া হয়, তাহাতে বৈচিত্র্য নাই, তাহা রাগিণী নয়, তাহার সুর মাত্র। আর কিছু নয়, ওটুকুতে কেবল সংসারের সমস্ত তুচ্ছতা দীনতা এবং বিচ্ছিন্নতার উপরের দিকে একটু ইশারা করিয়া দেয়া মাত্র। মহাকাব্যের ভাষাটা যেখানে একটা কাহিনী বলিয়া চলে, সুর সেখানে সঙ্গে সঙ্গে কেবল বলিতে থাকে—অহো, অহো, অহো। ক্ষিতি অপে মিশাল করিয়া যে মূর্তি গড়া তার সঙ্গে তেজ মরুৎ ব্যোমে যে সংযোগ আছে এই খবরটা মনে করাইয়া রাখে।”

”মহাকাব্যের বড়ো কথাটা যেখানে স্বতই বড়ো, কাব্যের খাতিরে সুর সেখানে আপনাকে ইঙ্গিত মাত্রে ছোটো করিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু যেখানে আবার সংগীতই মুখ্য সেখানে তার সঙ্গের কথাটি কেবলই বলিতে থাকে, ‘আমি কেহই না, আমি কিছুই না, আমার মহিমা সুরে।”

এই প্রবন্ধের অন্যত্র কবি লিখেছেন—”দেশের সকল শক্তিই আজ জরাসন্ধের কারাগারে বাঁধা পড়িয়াছে। তারা আছে মাত্র, তারা চলে না—দস্তুরের বেড়িতে তারা বাঁধা। সেই জরার দুর্গ ভাঙিয়া আমাদের সমস্ত বন্দী শক্তিকে বিশ্বে ছাড়া দিতে হইবে—তা, সে কী গানে, কী সাহিত্যে, কি চিন্তায়, কি কর্মে, কী রাষ্ট্র কী সমাজে।”

জরাসন্ধ মহাভারতের চরিত্র—মহাবলপরাক্রান্ত মগধের সম্রাট। বহু দুর্বল রাজাকে বন্দী করে তিনি তাঁর কারাগারে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ভীম অর্জুন তাঁদেরকে মুক্ত করেন।

সঙ্গীতসংঘ সভায় প্রদত্ত অভিভাষণে (১৭ই মার্চ, ১৯২২) কবি বলেছিলেন, ”যখন দেখতে পাব যে আমাদের দেশে সংগীত ও সাহিত্যের ধারা বন্ধ হয়েছে, তখন বুঝব দেশে প্রাণশক্তির স্রোতও অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সেই প্রাণশক্তিকে নানা শাখা-প্রশাখায় পূর্ণভাবে বহমান করে রাখবার জন্যেই, বিশ্বের গভীর কেন্দ্র থেকে যে অমৃতরসধারা উৎসারিত হচ্ছে তাকে আমাদের আবাহন করে আনতে হবে। ভগীরথ যেমন ভস্মীভূত সগরসন্তানদের বাঁচাবার জন্যে পুণ্যতোয়া গঙ্গাকে মর্ত্যে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন, তেমনি মানসলোকের ভগীরথেরা প্রাণহীনতার মধ্যে অমৃতত্ব সঞ্চয়িত করবার জন্য আনন্দরসের বিচিত্র ধারাকে বহন করে আনবেন।”—ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্ত রামায়ণের কাহিনী এবং আগে আলোচনা করা হয়েছে।

‘আলাপ-আলোচনা’ নিবন্ধের ৩ সংখ্যক লেখাতে কবি বলছেন ”হিন্দুস্থানে তুলসীদাসের রামায়ণ সুর করে পড়া হয়। তাকে সংগীতের পদবী দেওয়া যায় না। সে যেন আখ্যান—আসবাবের উপরিতলে সুরের পাতলা পালিশ।”

ঐ ৩ সংখ্যক লেখার অন্যত্র সঙ্গীতের কথা বলতে বলতে রাম-সীতার কথা বা রামায়ণ মহাভারতের অন্য চরিত্রদের কথা এসেছে।

”রচনা যে করে, রচিত পদার্থের দায়িত্ব একমাত্র তারই; তার সংশোধন বা উৎকর্ষসাধনের দায়িত্ব যদি আর-কেউ নেয় তা হলে কলাজগতে অরাজকতা ঘটে। এ কথা নিশ্চিত যে, ওস্তাদ-পরম্পরার দুর্গম কণ্ঠ-তাড়নায় তানসেনের কোনো গানেই আজ তানসেনের কিছুই বাকি নেই। প্রত্যেক গায়কই কল্পনা করে এসেছেন যে, তিনি উৎকর্ষ সাধন করছেন। রামের কুটির থেকে সীতাকে চুলে ধ’রে টেনে রাবণ যখন নিজের রথের ‘পরে চড়িয়েছিলেন তখন তিনিও সীতার উৎকর্ষসাধন করেছিলেন। তবুও রামের ভার্যারূপে বনবাসও সীতার পক্ষে শ্রেয়, রাবণের স্বর্ণপুরীও তাঁর পক্ষে নির্বাসন—এই দাম্পত্য মূলনীতিটুকু প্রমাণ করবার জন্যেই সাতকাণ্ড রামায়ণ। ললিতকলাতেও ধর্মনীতির অনুশাসন এই যে, যার যেটি কীর্তি তার সম্পূর্ণ ফলভোগ তার একলারই।

সাহিত্যে সংগীতে এমন একদিন ছিল যখন রচয়িতার সৃষ্টিতে একান্তভাবে রচয়িতার অধিকার দেওয়া দুরূহ ছিল। আল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে নিজের নিজের রুচি অনুসারে সর্বসাধারণে তার উপরে হস্তক্ষেপ করে এসেছে। বর্তমান যুগে যারা দ্রব্যসম্পত্তিতে এইরকম অবারিত কম্যুনিজম মানে আর তাই নিয়ে রক্তে যারা পৃথিবী ভাসিয়ে দিচ্ছে, তারাও কলারাজ্যে এটাকে মানে না। আদিম কালে কলাভাণ্ডারে না ছিল কুলুপ, না ছিল পাহারা। সেইজন্যেই কলারচনায় সরকারি কার্তবীর্যার্জুনের বহুহস্তক্ষেপ নিষেধ করবার উপায় ছিল না। আজকালকার দিনে ছাপাখানা ও স্বরলিপি প্রভৃতি উপায়ে নিজের রচনায় রচয়িতার দায়িত্ব পাকা করে রাখা সম্ভব, তাই রচনাবিভাগে সরকারি যথেচ্ছাচার নিবারণ করা সহজ এবং করা উচিত। নইলে দাঁড়ি টানবে কোথায়? এক কাব্যে এক রচয়িতার স্বত্ব বিচার করা সহজ, কিন্তু এক কাব্যে অসংখ্য রচয়িতার স্বত্ব বিচার করবে কে এবং কী উপায়ে। এ যে পঞ্চপাণ্ডবের পাঞ্চালীর বাড়া, এ যে পঞ্চাশ হাজার রাণী।”

এই গ্রন্থের ‘সুর ও সংগতি’ অংশে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে কবির লেখা কিছু চিঠি সন্নিবেশিত হয়েছে। একটা চিঠিতে কবি বলতে চেয়েছেন যে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা সঙ্গীতের প্রভেদ আছে। ”বাংলা গানে হিন্দুস্থানী বিধি বিশুদ্ধভাবে মিলছে না দেখে পণ্ডিতেরা যখন বলেন সংগীতের অপকর্ষ ঘটছে, তখন তাঁরা পণ্ডিতী স্পর্দ্ধা করেন—. . .। বাংলায় হিন্দুস্থানীর বিশেষ পরিণতি ঘটতে ঘটতে একটা নূতন সৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে; এ সৃষ্টি প্রাণবান, গতিবান, এ সৃষ্টি সৌখীন বিলাসীর নয়—কলাবিধাতার। বাংলায় সাহিত্যভাষা সম্বন্ধেও তদ্রূপ। এ ক্ষেত্রে পণ্ডিতির জয় হলে বাংলা ভাষা আজ সীতার বনবাসের চিতায় সহমরণ লাভ করতো।”

সঙ্গীতে হোক, সাহিত্যে হোক, একটা জায়গায় এসে থামার দরকার আছে। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে অন্য একটা চিঠিতে কবি লিখেছেন—”বেনের দল যতই দুঃখিত হোক, শতদলের উপর আর একটা পাপড়ি চাপানো চলবে না। সে আপন সম্পূর্ণতার মধ্যে থেমেছে বলেই সে অপরিসীম। . . . রামচন্দ্র সোনার সীতা বানিয়েছিলেন। সোনার প্রাচুর্য নিয়ে যদি তার গৌরব হত তা হলে দশটা খনি উজাড় করে যে পিণ্ডটা তৈরী হত তার মতো সীতার শোকাবহ নির্বাসন আর কিছু হতে পারত না। রামচন্দ্রকে ‘থামো’ বলতে হয়েছে।”

আর একটা চিঠিতে কবি অর্জুন-ভীষ্মের উপমা টেনেছেন—”অর্জুন পিতামহ ভীষ্মের প্রতি মনের মধ্যে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে দরদ রেখে শরসন্ধান করেছিলেন। তুমিও আমার মতের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রয়োগ করেছ সৌজন্য রেখে।”

এই চিঠিতেই আর্টের ব্যাপারে আয়তনের বৃহত্ব বা ক্ষুদ্রত্ব নিয়ে বলতে গিয়ে কবি রামায়ণ মহাভারতের কথা এনেছেন—”আয়তনের বৃহত্ব যে দোষের নয় এ সম্বন্ধে তুমি কিছু কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছ। না দিলেও চলত, কারণ আর্টে আয়তনটা গৌণ। . . . বেটোভেনের ‘সোনাটা’ যথেষ্ট বহরওয়ালা জিনিষ; কিন্তু বহরের কথাটাই যার সর্বোপরি মনে পড়ে, জীবে দয়ার খাতিরেই সভা থেকে তাকে যত্নসহকারে দূরে সরিয়ে রাখাই শ্রেয়। মহাভারতের উল্লেখ করতে পারতে—আমাদের দেশে ওকে ইতিহাস বলে, মহাকাব্য বলে না। ও একটি সাহিত্যিক galaxy। সাহিত্য বিশ্বে অতুলনীয়—ওর মধ্যে বিস্তর তারা আছে, তারা পরস্পর সুগ্রথিত নয়-অতি বৃহৎ নেব্যুলার জালে জালে তারা বাঁধা, আর্টের ঐক্যে নয়। এইজন্যই রামায়ণ হল মহাকাব্য, মহাভারতকে কোনো আলংকারিক মহাকাব্য বলে না।”

অন্য একটা চিঠিতে আর্টের ব্যাপারে কবি বলছেন—”উচ্চ অঙ্গের আর্টের উদ্দেশ্য নয় দুই চক্ষু জলে ভাসিয়ে দেওয়া, ভাবাতিশয্যে বিহ্বল করা, তার কাজ হচ্ছে মনকে সেই কল্পলোকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া, যেখানে রূপের পূর্ণতা। সেখানকার সৃষ্টি প্রকৃতির সৃষ্টির মতোই; অর্থাৎ সেখানে রূপ কুরূপ হতেও সংকোচ করে না; কেননা তার মধ্যেও সত্যের শক্তি আছে—যেমন মরুভূমির উট, যেমন বর্ষার জঙ্গলে ব্যাঙ, যেমন রাত্রির আকাশে বাদুড়, যেমন রামায়ণের মন্থরা, মহাভারতের শকুনি, শেকসপীয়রের ইয়াগো।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন