চতুর্দশ খণ্ডে সন্নিবেশিত গ্রন্থগুলি হোলো—
কবিতা ও গান : স্ফুলিঙ্গ;
উপন্যাস ও গল্প : গল্পগুচ্ছ;
প্রবন্ধ : আত্মপরিচয়, সাহিত্যের স্বরূপ, মহাত্মা গান্ধী, আশ্রমের রূপ ও বিকাশ, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম, সমবায়নীতি, খ্রীষ্ট ও পল্লীপ্রকৃতি। এই গ্রন্থসমূহের সবগুলোতেই রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ কিছু কিছু আছে।
রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে ‘অচলিত সংগ্রহ’ নাম দিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ সন্নিবেশিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে শ্রীচারুচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় লিখেছেন—”এই গ্রন্থগুলি অধিকাংশই পুনরমুদ্রিত হয় নাই। বর্তমানেও এগুলি আর চলিত ছিল না, অপরিণত রচনা মনে করিয়া কবি এগুলি বর্জন করিয়াছিলেন, এবং এই অচলিত রচনাগুলি আর যাতে প্রচলিত না হয় ইহাই তাঁর অভিপ্রায় ছিল।” তবুও এগুলি প্রকাশ করার কৈফিয়ৎ হিসাবে শ্রীভট্টাচার্য রবীন্দ্রসাহিত্যে এগুলির ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এ ছাড়া তিনি আরো বলেছেন যে কবি এই রচনাগুলিকে অপরিণত মনে করলেও সমকালীন বাংলাসাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে এই রচনাগুলি আদৌ অপকৃষ্ট ছিল না আর এই জন্যই বঙ্কিমচন্দ্রও বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে বালক রবির আবির্ভাবকে সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন।
এই খণ্ডের অন্তর্ভূক্ত অচলিত গ্রন্থসমূহ হলো—
(১) কবিকাহিনী—কবির মোটামুটি ষোলো বৎসর বয়সে এই কাব্যগ্রন্থটি রচিত।
(২) বনফুল—এই কাব্যগ্রন্থটি কবির ১৪/১৫ বৎসর বয়সকালে রচিত।
(৩) ভগ্নহৃদয়—কবি প্রথমবার বিলাতে গিয়ে সেখানে এই নাট্যকাব্যটি রচনা শুরু করেছিলেন। ফেরার সময় জাহাজে কিছু রচনা করেন এবং দেশে ফিরে এসে এটি সমাপ্ত করেন।
(৪) রুদ্রচণ্ড—কবির প্রথম নাটক।
(৫) কালমৃগয়া—এই গীতিনাট্যটির কথা কবি জীবনস্মৃতিতে একটু আলোচনা করেছেন। এর অনেকটা অংশ ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’র সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য পরে আর এটি প্রকাশিত হয়নি।
(৬) বিবিধ প্রসঙ্গ—ছোটো-বড়ো অনেক রচনা নিয়ে গ্রন্থটি।
(৭) নলিনী— ক্ষুদ্র নাট্যকাব্য।
(৮) শৈশবসঙ্গীত—কবির তেরো থেকে আঠারো বৎসর বয়সের মধ্যে রচিত কিছু কবিতা নিয়ে এই গ্রন্থটি।
(৯) বাল্মীকি প্রতিভা—এটিই প্রথমে রচিত হয়েছিল— পরে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়।
এগুলো ছাড়াও অন্যান্য খণ্ডের মতো এই খণ্ডের গ্রন্থপরিচয় অংশ আছে।
এই অপ্রচলিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বনফুল, রুদ্রচণ্ড, নলিনী ও শৈশবসঙ্গীতে রামায়ণ-মহাভারতের কোনো প্রসঙ্গ নাই, অন্য গ্রন্থগুলিতে এই প্রসঙ্গ অল্প-স্বল্প আছে।
স্ফুলিঙ্গ—এই গ্রন্থের কবিতাগুলি খুব ছোটো ছোটো। ২৫৩ সংখ্যক কবিতাটিতে ‘গীতা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে একবার—গীতার কোনো শ্লোক বা মন্ত্রের কোনো উল্লেখ নেই। এই গীতা নিশ্চয়ই শ্রীমদ্ভগবদগীতা নয়।
”সে তুষার নির্ঝরিণী
রবিকরস্পর্শে উচ্ছ্বসিতা
দিগদিগন্তে প্রচারিছে
অন্তহীন আনন্দের গীতা।”
গল্পগুচ্ছ— ‘বদনাম’ গল্পে পুলিশ অফিসারের স্ত্রী সৌদামিনী যে সব ছেলেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতো, তাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্না ছিল। স্বামী অবশ্য তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে। সৌদামিনী তার স্বামীকে বলছে—”যাই হোক-না-কেন, আমি জানি আমি যাই করি শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ক্ষমা করবেই আর সেই ক্ষমাই যথার্থ পুরুষমানুষের লক্ষণ, যেন শ্রীকৃষ্ণের বুকে ভৃগুর পায়ের চিহ্ন।”— ‘ভৃগু পায়ের চিহ্ন’ ব্যাপারটি এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
‘ভিখারিণী’ গল্পে রামায়ণের কথা আছে। কাশ্মীরের এক পাহাড়ী গ্রামে দুইটি বালক-বালিকা অমর সিংহ ও কমলের মধ্যে বিশেষ প্রণয় ছিল, ”নীরব মধ্যাহ্নে স্নিগ্ধতরুচ্ছায় শৈলের সর্বোচ্চ শিখরে বসিয়া ষোড়শবর্ষীয় অমর সিংহ ধীর মৃদুল স্বরে রামায়ণ পাঠ করিত, দুর্দান্ত রাবণ-কর্তৃক সীতাহরণ পাঠ করিয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিত। দশমবর্ষীয়া কমলদেবী তাহার মুখের পানে স্থির হরিণনেত্র তুলিয়া নীরবে শুনিত, অশোকবনে সীতার বিলাপ কাহিনী শুনিয়া পক্ষ্মরেখা অশ্রুসলিলে সিক্ত করিত।” এই বাল্যপ্রেম অবশ্য বিবাহে পরিণতি পেল না। অমর সিংহ রাজপুত। সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হলে তাকে পিতার সঙ্গে যুদ্ধে যেতে হলো। যুদ্ধে যাওয়ার আগে অমর সিংহ কমলকে বলছে—”কমল, আমি তো চলিলাম, এখন রামায়ণ শুনিবি কার কাছে।”
‘করুণা’ গল্পে পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ীর একটি ঘরে বোলতা বাসা করেছিল। ভয়ে পণ্ডিতমশাই সে ঘরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। ”বালীর পক্ষে ঋষ্যমুখ পর্বত যেরূপ, পণ্ডিতমহাশয়ের পক্ষে এই ঘরটি সেইরূপ হইয়া পড়িয়াছিল।”
বানররাজ বালী কিষ্কিন্ধ্যার প্রবল-পরাক্রান্ত রাজা। কোনো কারণে বালীর সঙ্গে তাঁর কনিষ্ঠভ্রাতা সুগ্রীবের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। তখন বালীর ভয়ে সুগ্রীব ঋষ্যমুখ পর্বতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কারণ ঋষ্যমুখ পর্বত বালীর পক্ষে অগম্য ছিল। দুন্দুভি দৈত্যের সঙ্গে বালীর যুদ্ধে দৈত্য নিহত হয়েছিল। দুন্দুভি দৈত্যের রক্ত লেগেছিল মতঙ্গমুনির গায়ে। ক্রুদ্ধ মুনি অভিশাপ দিয়েছিলেন, যে এই রক্ত ছিটিয়েছে সে যদি ঋষ্যমূখ পর্বতে যায়, তবে তার মৃত্যু হবে। এই শাপের ভয়ে বালী ঋষ্যমূখ পর্বতে যেতেন না।
‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থটি কয়েকটি প্রবন্ধের সমষ্টি। ১ সংখ্যক প্রবন্ধটি ১৩১১ সালে প্রথমে ‘বঙ্গভাষার লেখক’ গ্রন্থে মুদ্রিত হয়। বলা হয় যে এই প্রবন্ধটিকে কেন্দ্র করেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলালের মনোমালিন্যের সূত্রপাত হয়। এই গ্রন্থে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ বিশেষ নাই— সামান্য সামান্য মাত্র দুটি উল্লেখ আছে।
৩ সংখ্যক প্রবন্ধে কবি বলতে চেয়েছেন সত্য’র মধ্যে শুধুই সামঞ্জস্য নয়, অসামঞ্জস্য আছে। শুধু সামঞ্জস্যকেই সত্য বললে সেটা আর সত্য থাকে না। অসামঞ্জস্যকেও স্বীকার করতে হবে। ”শিব যেমন সমুদ্রমন্থনের সমস্ত বিষকে পান করে তবে শিব। তাই সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা করে তবে শিব।”—সমুদ্রমন্থনের কথা, শিবের বিষপানের কথা, এগুলি সব আগে আলোচনা করা হয়েছে।
এই প্রবন্ধেই কবি আলোচনা প্রসঙ্গে মহাভারতের সাবিত্রীর কথা এনেছেন। সাবিত্রীর পতিভক্তি প্রবাদপ্রতিম। ‘ধর্মবোধের এই যে যাত্রা এর প্রথমে জীবন, তার পরে মৃত্যু, তার পরে অমৃত। মানুষ সেই অমৃতের অধিকার লাভ করেছে। কেননা জীবের মধ্যে মানুষই শ্রেয়ের ক্ষুরধারনিশিত দুর্গম পথে দুঃখকে মৃত্যুকে স্বীকার করেছে। সে সাবিত্রীর মতো যমের হাত থেকে আপন সত্যকে ফিরিয়ে এনেছে।”—মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে সাবিত্রীর স্বামী সত্যবানের অকাল মৃত্যু হলে সাবিত্রী শ্রদ্ধা, ভক্তি ও যুক্তির দ্বারা মৃত্যুর অধিপতি যমরাজকে প্রসন্ন করে সত্যবানের পুনর্জীবন আদায় করে নিয়েছিলেন।
সাহিত্যের স্বরূপ— এই গ্রন্থের প্রথম রচনাটির নামও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’। সুন্দরের বোধকেই বোধগম্য করা কাব্যের উদ্দেশ্য—এই উক্তিটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে কবির মনে প্রশ্ন জাগছে সুন্দর বলে কাকে। ”ফলস্টাফের সঙ্গে কন্দর্পের তুলনা হয় না, অথচ সাহিত্যের চিত্রভাণ্ডার থেকে কন্দর্পকে বাদ দিলে লোকসান নেই, লোকসান আছে ফলস্টাফকে বাদ দিলে। দেখা গেল, সীতার চরিত্র রামায়ণে মহিমান্বিত বটে, কিন্তু স্বয়ং বীর হনুমান—তার যত বড় লাঙ্গুল তত বড়োই সে মর্যাদা পেয়েছে। এইরকম সংশয়ের সময়ে কবির বাণী মনে পড়ে, Truth is beauty। অর্থাৎ সত্যই সৌন্দর্য। কিন্তু সত্যে তখনই সৌন্দর্যের রস পাই, অন্তরের মধ্যে যখন পাই তার নিবিড় উপলব্ধি—জ্ঞানে নয়, স্বীকৃতিতে। তাকেই বলি বাস্তব। সর্বগুণাধার যুধিষ্ঠিরের চেয়ে হঠকারী ভীম বাস্তব, রামচন্দ্র যিনি শাস্ত্রের বিধি মেনে ঠাণ্ডা হয়ে থাকেন তাঁর চেয়ে লক্ষ্মণ বাস্তব—যিনি অন্যায় সহ্য করতে না পেরে অগ্নিশর্মা হয়ে তার অশাস্ত্রীয় প্রতিকার করতে উদ্যত।”
‘সাহিত্যের মাত্রা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে সাহিত্যের মূলনীতি চিরন্তন। অর্থাৎ রসসম্ভোগের যে নিয়ম আছে তা মানুষের নিত্যস্বভাবের অন্তর্গত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে, কালের আবহে কখনো কখনো বিকার দেখা যায় মূলনীতিতে। রামায়ণ মহাভারত থেকে উদাহরণ দিয়ে কবি এই প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
”মহাভারত থেকে একটা দৃষ্টান্ত দিই। মহাভারতে নানা কালে নানা লোকের হাত পড়েছে সন্দেহ নেই। সাহিত্যের দিক থেকে তার উপরে অবান্তর আঘাতের অন্ত ছিল না, অসাধারণ মজবুত গড়ন বলেই টিকে আছে। এটা স্পষ্টই দেখা যায়, ভীষ্মের চরিত্র ধর্মনীতিপ্রবণ—যথাস্থানে আভাসে ইঙ্গিতে, যথাপরিমাণ আলোচনায়, বিরুদ্ধ চরিত্র ও অবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে এই পরিচয়টি প্রকাশ করলে ভীষ্মের ব্যক্তিরূপ তাতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠবার কথা। কাব্য পড়বার সময় আমরা তাই চাই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনো-এক কালে আমাদের দেশে চরিত্রনীতি সম্বন্ধে আগ্রহ বিশেষ কারণে অতিপ্রবল ছিল এইজন্যে পাঠকের বিনা আপত্তিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ইতিহাসকে শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম দীর্ঘ এক পর্ব জুড়ে নীতিকথায় প্লাবিত করে দিলেন। তাতে ভীষ্মের চরিত্র গেল তলিয়ে প্রভূত সদুপদেশের তলায়। এখনকার উপন্যাসের সঙ্গে এর তুলনা করো। মুশকিল এই যে, এই-সকল নীতিকথা তখনকার কালের চিত্তকে যেরকম সচকিত করেছিল এখন আর তা করে না। এখনকার বুলি অন্য, সেও কালে পুরাতন হয়ে যাবে। পুরাতন না হলেও সাহিত্যে যে-কোনো তত্ত্ব প্রবেশ করবে, সাময়িক প্রয়োজনের প্রাবল্য সত্ত্বেও, সাহিত্যের পরিমাণ লঙ্ঘন করলে তাকে মাপ করা চলবে না। ভগবদগীতা আজও পুরাতন হয় নি, হয়তো কোনো কালেই পুরাতন হবে না। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে থমকিয়ে রেখে সমস্ত গীতাকে আবৃত্তি করা সাহিত্যের আদর্শ অনুসারে নিঃসন্দেহেই অপরাধ। শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রকে গীতার ভাবের দ্বারা ভাবিত করার সাহিত্যিক প্রণালী আছে, কিন্তু সৎকথার প্রলোভনে তার ব্যতিক্রম হয়েছে বললে গীতাকে খর্ব করা হয় না।
যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত রামায়ণে রামের যে দেখা পাওয়া গেছে সেটাতে চরিত্রই প্রকাশিত। তার মধ্যে ভালো দিক আছে, মন্দ দিক আছে, আত্মখণ্ডন আছে। দুর্বলতা যথেষ্ট আছে। রাম যদিও প্রধান নায়ক তবু শ্রেষ্ঠতার কোনো কাল-প্রচলিত বাঁধা নিয়মে তাঁকে অস্বাভাবিকরূপে সুসংগত করে সাজানো হয় নি, অর্থাৎ কোনো-একটা শাস্ত্রীয় মতের নিখুঁত প্রমাণ দেবার কাজে তিনি পাঠক-আদালতে সাক্ষীরূপে দাঁড়ান নি। পিতৃসত্য রক্ষা করার উৎসাহে পিতার প্রাণনাশ যদি-বা শাস্ত্রিক বুদ্ধি থেকে ঘটে থাকে, বালীকে বধ না শাস্ত্রনৈতিক না ধর্মনৈতিক। তার পরে বিশেষ উপলক্ষে রামচন্দ্র সীতা সম্বন্ধে লক্ষ্মণের উপরে যে বক্রোক্তি প্রয়োগ করেছিলেন সেটাতেও শ্রেষ্ঠতার আদর্শ বজায় থাকে নি। বাঙালি সমালোচক যেরকম আদর্শের ষোলো-আনা উৎকর্ষ যাচাই করে সাহিত্যে চরিত্রের বিচার করে থাকে সে আদর্শ এখানে খাটে না। রামায়ণের কবি কোনো-একটা মতসঙ্গতির লজিক দিয়ে রামের চরিত্র বানাননি, অর্থাৎ সে চরিত্র স্বভাবের, সে চরিত্র সাহিত্যের, সে চরিত্র ওকালতির নয়।
কিন্তু উত্তরকাণ্ড এল বিশেষ কালের বুলি নিয়ে; কাঁচপোকা যেমন তেলাপোকাকে মারে তেমনি করে চরিত্রকে দিলে মেরে। সামাজিক প্রয়োজনের গুরুতর তাগিদ এসে পড়ল, অর্থাৎ তখনকার দিনের প্রবলেম। সে যুগে ব্যবহারের যে আটঘাট বাঁধবার দিন এল তাতে রাবণের ঘরে দীর্ঘকাল বাস করা সত্ত্বেও সীতাকে বিনা প্রতিবাদে ঘরে তুলে নেওয়া আর চলে না। সেটা যে অন্যায় এবং লোকমতকে অগ্রগণ্য করে সীতাকে বনে পাঠানোর এবং অবশেষে তাঁর অগ্নিপরীক্ষার যে প্রয়োজন আছে, সামাজিক সমস্যার এই সমাধান চরিত্রের ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসল। তখনকার সাধারণ শ্রোতা সমস্ত ব্যাপারটাকে খুব একটা উঁচুদরের সামগ্রী বলেই কবিকে বাহবা দিয়েছে। সেই বাহবার জোরে ঐ জোড়াতাড়া খণ্ডটা এখনো মূল রামায়ণের সজীব দেহে সংলগ্ন হয়ে আছে।”
সাহিত্যের আদর্শ সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ এখানে রামায়ণ মহাভারতের কয়েকটি বিষয় নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তার যাথার্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ধৃষ্টতা। তবে ভগবদগীতা প্রসঙ্গে দু’চারটে কথা এখানে বলতে চাই। ভগবদগীতার অংশটুকু মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত কি প্রক্ষিপ্ত নয়—এই বিতণ্ডা বহুকাল ধরে চলে আসছে। মহাপণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, পদ্মভূষণ তাঁর সংকলিত ‘মহাভারতম’-এ এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং তাঁর যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন যে শ্রীমদভগবদগীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত নয়। এই পণ্ডিতি আলোচনায় প্রবেশ না করে মহাভারতের একজন পাঠক হিসাবে ও একজন মহাভারতপ্রেমী হিসাবে আমার মনে হয়েছে যে গীতা মহাভারতে মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গীতার উপদেশগুলো অর্জুনকে বলার প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতিটা মনে মনে চিন্তা করুন। আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হবে যে কুরুপাণ্ডবদের এই যুদ্ধটা একটা অসম যুদ্ধ। তেরো বৎসর ধরে দুই রাজ্যের সমস্ত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে দুর্যোধন যেভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলেন, পাণ্ডবরা তার কিছুই পারেন নি। কৌরবপক্ষে ছিলেন মহা মহা বীরেরা—ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভগদত্ত এবং আরো অনেকে। এঁদের সঙ্গে তুলনীয় যোদ্ধা হিসাবে পাণ্ডবপক্ষে একা অর্জুন এবং কিছুটা ভীম ও সাত্যকি। অর্জুনের ধনুর্বিদ্যা দক্ষতার উপর নির্ভর করেই (শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি, পরামর্শ তো অবশ্যই আছে।) যুধিষ্ঠির এই অসম যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধটা শুরু হবার মুখেই অর্জুন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সে মোহ এমনই যে তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, বসে পড়লেন। তাঁর হাত থেকে ধনুক-বাণ খসে পড়ার মতো অবস্থা হলো। তিনি যুদ্ধ করবেন না।
অর্জুন যদি যুদ্ধ না করেন তবে যুদ্ধটা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যায় (কৃষ্ণ এই যুদ্ধে অস্ত্রধারী হয়ে যুদ্ধ না করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ)। এতে তো অধর্মেরই জয়জয়কার হবে। এই রকম সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের যেটা করা উচিৎ ছিল তিনি সেটাই করেছেন— তিনি অর্জুনকে উদ্বোধিত করতে চেয়েছেন, তাঁকে মোহমুক্ত করে তাঁর স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। রোগ যেমন কঠিন, তিনি ঔষধও সেইরকম দিয়েছেন। অর্জুনকে ক্লীবের মতো ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। একজন ক্ষত্রিয়কে এর চাইতে বড় তিরষ্কার আর কিছু হতে পারে না। তারপর তাঁকে বুঝিয়েছেন এখনকার পরিভাষায় যাকে বলে counselling। আমাদের যখন অবসাদ আসে, যখন আমরা depression-এ আক্রান্ত হই, তখন আমরা মনোবিদের কাছে counselling-এর জন্য যাই। শ্রীকৃষ্ণ তো জগতের শ্রেষ্ঠ counsellor। তিনি তাঁর সখা, ভক্ত ও শিষ্য অর্জুনকে সঠিক counselling করে তাঁকে মোহমুক্ত করেছেন, তাঁকে তাঁর স্ব-স্বরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে সমস্ত কথার মাধ্যমে, তিনি অর্জুনের এই মোহমুক্তি ঘটিয়েছেন সেই কথাগুলিই গীতাতে সংকলিত। তাই গীতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। গীতা যদি না হতো, মহাভারতও সৃষ্টি হতে পারতো না। তবে এখানে একটা কথা আছে। গীতার সমস্ত অধ্যায়গুলো একনাগাড়ে পড়ে গেলে একঘন্টার একটু বেশীই সময় লাগে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুখে এই সময়টা পাওয়া গিয়েছিল কি না সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে এটা তো সবাই জানেন যে একটা সাধারণ কথাকে সাহিত্যিকেরা অলঙ্কার দিয়ে পল্লবিত করে অনেক বড় করে থাকেন। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে যে কথাগুলো শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন সেটাই লেখার সময়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ব্যাসদেবের বয়ানে একটু বড় হতেই পারে। আর একটা কথা। কৌরবপক্ষের প্রধান সেনাপতি তখন ছিলেন মহামতি ভীষ্ম। ভীষ্ম যতদিন প্রধান সেনাপতি ছিলেন, ততদিন যুদ্ধে কোনো নীতিহীনতা প্রকাশ পায়নি। তাই অর্জুন বা পাণ্ডবপক্ষ যুদ্ধার্থে প্রস্তুত না হলে ভীষ্ম যে কখনোই তাঁদেরকে অস্ত্রাঘাত করবেন না, এটা বলার প্রয়োজন পড়ে না। তাই নিশ্চিন্তমনেই এই সময়টুকু কৃষ্ণ নিয়েছেন। গীতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমার মনে অন্তত কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
‘কাব্য ও ছন্দ’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন— ”সবশেষে এই একটি কথা বলবার আছে, কাব্য প্রাত্যহিক সংসারের অপরিমার্জিত বাস্তবতা থেকে যত দূরে ছিল এখন তা নেই। এখন সমস্তকেই সে আপন রসলোকে উত্তীর্ণ করতে চায়— এখন সে স্বর্গারোহণ করবার সময়েও সঙ্গের কুকুরটিকে ছাড়ে না।” —স্বর্গারোহণের কথা মহাভারতে আছে। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে পাণ্ডবেরা জয়ী হয়েছিলেন, এটাই মহাকাব্যিক সত্য। কিন্তু এ জয় তাঁরা লাভ করেছিলেন সর্বস্ব খুইয়ে। যুদ্ধশেষে পাণ্ডবপক্ষে জীবিত ছিলেন মাত্র সাতজন— পাণ্ডবেরা পাঁচভাই, শ্রীকৃষ্ণ ও সাত্যকি। এই জয় তাঁদের কাছে ছিল পরাজয়েরই নামান্তর (সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ‘পুরস্কার’ কবিতা দ্রষ্টব্য)। তাঁরা ৩৬ বৎসর হস্তিনাপুরে রাজত্ব করেছিলেন সত্য কথা কিন্তু সেখানে ছিল কর্তব্য আর রাজধর্ম পালন। তাই তাঁদের পরম সহায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র যখন মর্তলীলা সংবরণ করলেন, তখন পাণ্ডবেরাও আর সংসারে রইলেন না। শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থে ও অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিৎকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে স্থাপন করে তাঁরা যাত্রা করেছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে। এই মহাযাত্রায় তাঁদের সঙ্গী হয়েছিল একটি কুকুর (ছদ্মবেশী ধর্মদেব)। পথেই পতন ঘটলো যুধিষ্ঠির ব্যতীত অন্য চার ভাইয়ের এবং দ্রৌপদীর। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে স্বর্গের দ্বারে পৌঁছেছিল সেই কুকুরটি। যুধিষ্ঠিরকে সশরীরে প্রবেশের অনুমতি দিলেও কুকুরটিকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। যুধিষ্ঠির পথের সঙ্গী কুকুরটিকে পরিত্যাগ করে স্বর্গে যেতে চাননি। তখন অবশ্য কুকুরের রহস্য প্রকাশ হয়েছিল।
‘সাহিত্যে চিত্রবিভাগ’ প্রবন্ধে কবি রামায়ণ মহাভারতের কয়েকটি চরিত্র নিয়ে একটু আলোচনা করেছেন। তাঁর লেখা থেকে একটু উদ্ধৃত করছি— ”আমরা পূর্বেই বলেছি যে, সাহিত্যে চিত্রবিভাগ যদি জীবনশিল্পীর স্বাক্ষরিত হয় তবে তার রূপের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সংশয় থাকে না। জীবনের আপন কল্পনার ছাপ নিয়ে আঁকা হয়েছে যে-সব ছবি তারই রেখায় রেখায় রঙে রঙে সকল দেশে কালে মানুষের সাহিত্য পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে। তার কোনোটা-বা ফিকে হয়ে এসেছে; ভেসে বেড়াচ্ছে ছিন্নপত্র তার আপন কালের স্রোতের সীমানায়, তার বাইরে তাদের দেখতেই পাওয়া যায় না। আর কতকগুলি আছে চিরকালের মতন। সকল মানুষের চোখের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে। আমরা একটি ছবির সঙ্গে পরিচিত আছি, সে রামচন্দ্রের। তিনি প্রজারঞ্জনের জন্যে নিরপরাধা সীতাকে বনবাস দিয়েছিলেন। এত বড়ো মিথ্যা ছবি খুব অল্পই আছে সাহিত্যের চিত্রশালায়। কিন্তু যে লক্ষ্মণ আপন হৃদয়ের বেদনার সঙ্গে অমিল হলে অধৈর্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিতেন শাস্ত্রের উপদেশ এবং দাদার পন্থার অনুসরণ, অথচ চিরাভ্যস্ত সংস্কারের বন্ধনকে কাটাতে না পেরে নিষ্ঠুর আঘাত করতে বাধ্য হয়েছেন আপন শুভবুদ্ধিকে, যার মতন কঠিন আঘাত জগতে আর নেই— সেই সর্বত্যাগী লক্ষ্মণের ছবি তাঁর দাদার ছবিকে ছাপিয়ে চিরকাল সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। ও দিকে দেখো ভীষ্মকে, তাঁর গুণগানের অন্ত নেই, অথচ কৌরবসভার চিত্রশালায় তাঁর ছবির ছাপ পড়ল না। তিনি বসে আছেন একজন নিষ্কর্মা ধর্ম-উপদেশ-প্রতীক মাত্র হয়ে। ও দিকে দেখো কর্ণকে, বীরের মতন উদার, অথচ অতিসাধারণ মানুষের মতন বার বার ক্ষুদ্রাশয়তায় আত্মবিস্মৃত। এ দিকে দেখো বিদুরকে, সে নিখুঁত ধার্মিক; এত নিখুঁত যে, সে কেবল কথাই কয় কিন্তু কেউ তার কথা মানতেই চায় না। অপর পক্ষে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র ধর্মবুদ্ধির বেদনায় প্রতি মুহূর্তে পীড়িত অথচ স্নেহে দুর্বল হয়ে এমন অন্ধভাবে সেই বুদ্ধিকে ভাসিয়ে দিয়েছেন যে যদিচ জেনেছেন অধর্মের এই পরিণাম তাঁর স্নেহাস্পদের পক্ষে দারুণ শোচনীয় তবু কিছুতে আপনার দোলায়িত চিত্তকে দৃঢ়ভাবে সংযত করতে পারেন নি। এই হল স্বয়ং জীবনের কল্পিত ছবি— মনুসংহিতার শ্লোকের উপরে উপদেশের দাগা বুলোনো নয়। এই ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য হারালেন, প্রাণাধিক সন্তানদের হারালেন, কিন্তু সাহিত্যের সিংহাসনের এই দিকভ্রান্ত অন্ধ তিনি চিরকালের জন্যে স্থির রইলেন।
রূপসাহিত্যে তাই যখন দেখি, কবি তাঁর নায়কের পরিমাণ বাড়িয়ে বলবার জন্যে বাস্তবের সীমা লঙ্ঘন করেছেন, আমরা তখন স্বতই সেটাকে শোধন করে নিই। আমাদের সত্যলোকের ভীম কখনোই তালগাছ উপড়ে লড়াই করেন নি, এক গদাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট। রূপের রাজ্যে মানুষ ছেলে ভুলিয়েছিল যে যুগে মানুষ ছেলেমানুষ ছিল। তার পর থেকে জনশ্রুতি চলে এসেছে বটে কিন্তু কালের হাতে ছাঁকাই পড়ে মনের মধ্যে তার সত্য রূপটুকু রয়ে গেছে। তাই হনুমানের সমুদ্রলঙ্ঘন এখনো কানে শুনি কিন্তু আর চোখে দেখতে পাই নে, কেননা আমাদের দৃষ্টির বদল হয়ে গেছে।”
কবি তাঁর এই লেখাতে বিদুরের যে মূল্যায়ন করেছেন সেটা নিয়ে একটু অন্যরকম কথা বলার সুযোগ সম্ভবত আছে। বিদুরের কথা কেউ শোনে না—এইরকম ধারণা বোধ হয় একটু casual হয়ে যাচ্ছে। তাঁর কথা শোনে না বা মানে না দুর্যোধন এবং তার দুষ্ট পরামর্শদাতারা। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে অনেক বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ মান্য করেন না। দুর্যোধন এবং তার দুষ্ট সঙ্গীরা দুর্বুদ্ধি-তাড়িত এবং তারা লুব্ধ। লুব্ধ ধৃতরাষ্ট্রও, সর্বোপরি তিনি দুর্যোধনের বশীভূত। এই স্বার্থান্ধ মানুষদের কাছে বিদুরের নীতি-উপদেশ বা সৎ পরামর্শ কখনোই গ্রহণীয় হয় না। বিদুরের কথা শুনে চললে তাদের অন্যায় কাজসমূহ বাধাপ্রাপ্ত হবে। বিদুরের কথা না শোনার আরো একটা কারণ বোধ হয় তাঁর জন্ম পরিচয়। বিদূর শূদ্রাণী দাসীর গর্ভজাত সন্তান। ক্ষত্রিয় দম্ভে দাম্ভিক দুর্যোধনের চোখে বিদুর হেয়। আর শুধু বিদুর কেন— তপস্বীশ্রেষ্ঠ বেদব্যাস, মৈত্রেয় এবং আরো অনেক মুনি-ঋষিদের কথা, বীরশ্রেষ্ঠ এবং জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ পিতামহ ভীষ্মের কথা, গুরু দ্রোণাচার্যোর কথা, এমন কি পিতা ধৃতরাষ্ট্র ও মাতা গান্ধারীর কথাও সে শোনে না। সেই দুর্যোধন বিদুরের কথা শোনে না বলেই বিদুর ন্যূন হয়ে যাবেন এটা হতে পারে না। যাঁরা সৎ মানুষ তাঁরা বিদুরের কথা শোনেন এবং তাঁকে মান্যও করেন। বিদূর জ্ঞানী, সৎ এবং সর্বোপরি নির্ভীক। মন্ত্রী হিসাবে তিনি সৎ পরামর্শ দেন— দুর্যোধন বা ধৃতরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হবার ভয় তিনি করেন না। তিনি যেভাবে ধৃতরাষ্ট্র বা দুর্যোধনের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেছেন, ভীষ্ম বা দ্রোণও সেটা পারেননি।
বিদুর তো ইচ্ছে করলেই দুর্যোধনের মোসাহেবদের দলে ভিড়তে পারতেন এবং তাতে তিনি অনেক আরামে থাকতে পারতেন। কিন্তু এই নীতিহীনতা বিদুরের দ্বারা সম্ভব ছিল না। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা অসামান্য।
মহাভারতের মহাকবি যে সমস্ত চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তাঁরা সকলেই প্রয়োজনীয়। বিদুর তো খুব বড় চরিত্র। ডঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর ‘লঘু-গুরু’ গ্রন্থে বলেছেন যে, মহাভারতের ছোট চরিত্রগুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। বিদুর তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী নিয়ে মহাভারতে চিরভাস্বর।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রবন্ধের উপসংহার করেছেন এই বলে— ”তাই দেখি, সাহিত্যের চিত্রশালায় যেখানে জীবনশিল্পীর নৈপুণ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেখানে মৃত্যুর প্রবেশদ্বার রুদ্ধ। সেখানে লোকখ্যাতির অনিশ্চয়তা চিরকালের জন্যে নির্বাসিত। তাই বলছিলেম, সাহিত্যে যেখানে সত্যকার রূপ জেগে উঠেছে সেখানে ভয় নেই। চেয়ে দেখলে দেখা যায়, কী প্রকাণ্ড সর্ব মূর্তি, কেউ বা নীচ শকুনির মতো, মন্থরার মতো, কেউ বা মহৎ ভীমের মতো, দ্রৌপদীর মতো— আশ্চর্য্য মানুষের অমর কীর্তি জীবনের চির-স্বাক্ষরিত। সাহিত্যের এই অমরাবতীতে যাঁরা সৃষ্টিকর্তার আসন নিয়েছেন তাঁদের কারও-বা নাম জানা আছে, কারও-বা নেই, কিন্তু মানুষের মধ্যে তাঁদের স্পর্শ রয়ে গেছে।”
মহাত্মা গান্ধী পুস্তিকাটিতে মোট পাঁচটি প্রবন্ধ আছে। প্রথম প্রবন্ধটির নাম ‘মহাত্মা গান্ধী’। এই প্রবন্ধের প্রথমে কবি মহাভারতের কথা স্মরণ করেছেন। ”ভারতবর্ষের একটি সম্পূর্ণ ভৌগোলিক মূর্তি আছে। এর পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমপ্রান্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত যে-একটি সম্পূর্ণতা বিদ্যামান, প্রাচীন কালে তার ছবি অন্তরে গ্রহণ করার ইচ্ছে দেশে ছিল, দেখতে পাই। একসময়, দেশের মনে নানা কালে নানা স্থানে যা বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল তা সংগ্রহ করে, এক করে দেখবার চেষ্টা, মহাভারতে খুব সুস্পষ্ট ভাবে জাগ্রত দেখি। তেমনি ভারতবর্ষের ভৌগোলিক স্বরূপকে অন্তরে উপলব্ধি করবার একটি অনুষ্ঠান ছিল, সে তীর্থভ্রমণ। দেশের পূর্বতম অঞ্চল থেকে পশ্চিমতম অঞ্চল এবং হিমালয় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত সর্বত্র এর পবিত্র পীঠস্থান রয়েছে, সেখানে তীর্থ স্থাপিত হয়ে একটি ভক্তির ঐক্যজালে সমস্ত ভারতবর্ষকে মনের ভিতরে আনবার সহজ উপায় সৃষ্টি করেছে।
ভারতবর্ষ একটি বৃহৎ দেশ। একে সম্পূর্ণ ভাবে মনের ভিতর গ্রহণ করা প্রাচীন কালে সম্ভবপর ছিল না। আজ সার্ভে করে, মানচিত্র এঁকে, ভূগোলবিবরণ গ্রথিত করে ভারতবর্ষের যে ধারণা মনে আনা সহজ হয়েছে, প্রাচীন কালে তা ছিল না। এক হিসাবে সেটা ভালোই ছিল। সহজ ভাবে যা পাওয়া যায় মনের ভিতরে তা গভীর ভাবে মুদ্রিত হয় না। সেইজন্য কৃচ্ছ্রসাধন করে ভারত-পরিক্রমা দ্বারা যে অভিজ্ঞতা লাভ হত তা সুগভীর, এবং মন থেকে সহজে দূর হত না।
মহাভারতের মাঝখানে গীতা প্রাচীনের সেই সমন্বয়-তত্ত্বকে উজ্জ্বল করে। কুরুক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে এই-যে খানিকটা দার্শনিকভাবে আলোচনা, এটাকে কাব্যের দিক থেকে অসংগত বলা যেতে পারে; এমনও বলা যেতে পারে যে, মূল মহাভারতে এটা ছিল না। পরে যিনি বসিয়েছেন তিনি জানতেন যে, উদার কাব্যপরিধির মধ্যে, ভারতের চিত্তভূমির মাঝখানে এই তত্ত্বকথার অবতারণা করার প্রয়োজন ছিল। সমস্ত ভারতবর্ষকে অন্তরে বাহিরে উপলব্ধি করবার প্রয়াস ছিল ধর্মানুষ্ঠানেরই অন্তর্গত। মহাভারতপাঠ যে আমাদের দেশে ধর্মকর্মের মধ্যে গণ্য হয়েছিল তা কেবল তত্ত্বের দিক থেকে নয়, দেশকে উপলব্ধি করার জন্যও এর কর্তব্যতা আছে। আর, তীর্থযাত্রীরাও ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে দেশকে স্পর্শ করতে করতে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে ক্রমশ এর ঐক্যরূপ মনের ভিতরে গ্রহণ করবার চেষ্টা করেছেন।
এ হল পুরাতন কালের কথা।
পুরাতন কালের পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল দেশের মানুষ আপনার প্রাদেশিক কোণের ভিতর সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকে। সংস্কার ও লোকাচারের জালে আমরা জড়িত, কিন্তু মহাভারতের প্রশস্ত ক্ষেত্রে একটা মুক্তির হাওয়া আছে। এই মহাকাব্যের বিরাট প্রাঙ্গণে মনস্তত্ত্বের কত পরীক্ষা। যাকে আমরা সাধারণত নিন্দনীয় বলি, সেও এখানে স্থান পেয়েছে। যদি আমাদের মন প্রস্তুত থাকে, তবে অপরাধ দোষ সমস্ত অতিক্রম করে মহাভারতের বাণী উপলব্ধি করতে পারা যেতে পারে। মহাভারতে একটা উদাত্ত শিক্ষা আছে; সেটা নঙর্থক নয়, সদর্থক, অর্থাৎ তার মধ্যে একটা হাঁ আছে। বড়ো বড়ো সব বীরপুরুষ আপন মাহাত্ম্যের গৌরবে উন্নতশির, তাঁদেরও দোষ ত্রুটি রয়েছে, কিন্তু সেই-সমস্ত দোষ ত্রুটিকে আত্মসাৎ করেই তাঁরা বড়ো হয়ে উঠেছেন। মানুষকে যথার্থ ভাবে বিচার করবার এই প্রকাণ্ড শিক্ষা আমরা মহাভারত থেকে পাই।”
এই প্রবন্ধেরই অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”পাশ্চাত্যদেশ একদিন যে মুষল প্রসব করেছে আজ তারই শক্তি ইউরোপের মস্তকের উপর উদ্যত হয়ে আছে।” ‘মুষল প্রসব’ মহাভারতের কাহিনী। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। অগণিত মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে মহাসতী গান্ধারী তাঁর মানসিক স্থৈর্য হারালেন। তিনি জানতেন তাঁর পুত্রেরা দোষী— তাদের অপরাধেই অষ্টাদশদিন ব্যাপী এই মহানরমেধযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। তবুও সবকিছু বিস্মৃত হয়ে তিনি কৃষ্ণকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করলেন এবং মহাভয়ঙ্কর অভিশাপবাণী উচ্চারণ করলেন— আত্মকলহে যেমন কৌরবেরা বিনষ্ট হয়েছে, কৃষ্ণের বংশধরেরাও এইরকম আত্মকলহে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কৌরবকুলরমণীরা যেমন কুরুক্ষেত্রে ভূলুন্ঠিতা হয়ে রোদন করছেন, যদুকুলরমনীরাও অচিরেই এইরকম রোদন করবেন।
শ্রীকৃষ্ণ শান্তভাবে গান্ধারীর এই
অভিশাপ গ্রহণ করলেন। তাঁর এবারের এই অবতার তো ধরণীর ভার লাঘব করার জন্য। এ পর্যন্ত অনেক মদগর্বী অত্যাচারী মানুষকে তিনি বধ করেছেন বা করিয়েছেন। আর এই কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধেই তো বিপুলসংখ্যক অত্যাচারী দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষাত্রশক্তির বিনাশ ঘটেছে। কিন্তু তাঁর কাজ এখনো শেষ হয়নি। তিনি জানেন তাঁরই ছত্রছায়ায় থেকে শঙ্কাবিরহিত যাদবেরা লাগামছাড়া কদাচার-ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। এখন যাদবরাই ধরণীর সবচেয়ে উৎকট ভার হয়েছে। তাঁর পুত্র-কলত্রদের বিনাশ করার ক্ষমতা বাইরের কারোর নেই। তাঁর নিজের আত্মীয়-পরিজন এই বিবেচনায় তিনি যদি যাদবদের দুর্নীতি উপেক্ষা করেন তবে ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করবেনা। তাই যাদববংশ ধ্বংস তাঁকেই করতে হবে আর এই কাজে তিনি কৃতসংকল্প। যে কাজটা তিনি নিজেই করবেন, তাই গান্ধারী অভিশাপবাণীরূপে উচ্চারণ করেছেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ৩৬ বৎসর গত হয়েছে। কৃষ্ণ তাঁর মর্তলীলা সংবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একদিন দ্বারাবতীতে এসেছেন তপস্বী বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও দেবর্ষি নারদ। কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব অত্যন্ত রূপবান। মজা করবার জন্য যাদবকুমারেরা শাম্বকে বধূবেশে সাজিয়ে ঋষিদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল এবং তার সন্তান সম্ভাবনার কথা জানতে চেয়েছিল। সর্বজ্ঞ ঋষিরা সব বুঝতে পেরে খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন—
”বৃষ্ণ্যন্ধকবিনাশায় মুসলং ঘোরমায়সম।
বাসুদেবস্য দায়াদঃ সাম্বোহয়ং জনয়িষ্যতি।।”
(কৃষ্ণের এই পুত্র শাম্ব যদুবংশ ধ্বংসের জন্য একটা ভয়ঙ্কর মুষল প্রসব করবে আর সেই মুষল দিয়ে যুদ্ধ করে তারা সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।) ঋষিশাপে শাম্ব সেই মুষল প্রসব করেছিল এবং সেই মুষল যদুবংশ ধ্বংসে কাজে লেগেছিল।
এই প্রবন্ধেই মহাত্মা গান্ধী সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন—”আমাদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই আছেন যাঁরা হিংস্রতাকে মন থেকে দূর করে দেখতে পারেন। এই হিংসাপ্রবৃত্তি স্বীকার না করেও আমরা জয়ী হব, এ কথা আমরা মানি কি। মহাত্মা যদি বীরপুরুষ হতেন কিংবা লড়াই করতেন তবে আমরা এমনি করে আজ ওঁকে স্মরণ করতুম না। কারণ, লড়াই করার মতো বীরপুরুষ এবং বড়ো বড়ো সেনাপতি পৃথিবীতে অনেক জন্মগ্রহণ করেছেন। মানুষের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ, নৈতিক যুদ্ধ। ধর্মযুদ্ধের ভিতরেও নিষ্ঠুরতা আছে, তা গীতা ও মহাভারতে পেয়েছি। তার মধ্যে বাহুবলেরও স্থান আছে কিনা এ নিয়ে শাস্ত্রের তর্ক তুলব না। কিন্তু এই যে একটা অনুশাসন, মরব তবু মারবো না, এবং এই করেই জয়ী হব— এ একটা মস্ত বড়ো কথা, একটা বাণী। এটা চাতুরী কিংবা কার্যোদ্ধারের বৈষয়িক পরামর্শ নয়। ধর্মযুদ্ধ বাইরে জেতবার জন্য নয়, হেরে গিয়েও জয় করবার জন্য। অধর্মযুদ্ধে মরাটা মরা। ধর্মযুদ্ধে মরার পরেও অবশিষ্ট থাকে; হার পেরিয়ে থাকে জিত, মৃত্যু পেরিয়ে অমৃত। যিনি এই কথাটা নিজের জীবনে উপলব্ধি করে স্বীকার করেছেন; তার কথা শুনতে আমরা বাধ্য।
মহাভারতে যুদ্ধের কথা আছে, তার মধ্যে নিষ্ঠুরতাও আছে কারণ মহাভারত শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থ নয়; এটি ইতিহাসও বটে—তখনকার দিনের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থার দর্পণ। তবে গীতাতে নিষ্ঠুরতা আছে, হিংস্রতা আছে— একথা বললে অনেকেই মানবেন না। জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মানুষকে মুক্তির পথ, উত্তরণের পথ দেখায় গীতা। গীতার উপদেশ সঠিকভাবে মেনে চললে মানুষ মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে।
ঐ একই প্রবন্ধে কবি পৃথুরাজার কথা উল্লেখ করেছেন। পৃথুরাজার কাহিনী মূলত শ্রীমদ্ভাগবতের কাহিনী। মহাভারতের শান্তিপর্বেও পৃথুরাজার কথা কিছু আছে। তবে পৃথিবী দোহনের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে যা বলেছেন তা ভাগবতের কথা।
‘গান্ধীজি’ প্রবন্ধে মহাত্মার কথা বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন— ”কিন্তু এই যে অবিচলিত নিষ্ঠা যা তাঁর সমস্ত জীবনকে অচলপ্রতিষ্ঠা করে তুলেছে, এই যে অপরাজেয় সংকল্পশক্তি, এ তাঁর সহজাত, কর্ণের সহজাত কবচের মতো।” —মহাভারতে কর্ণ অন্যতম প্রধান চরিত্র। সূর্যপুত্র কর্ণ কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। কবচ-কুণ্ডল ছিল তাঁর সহজাত।
‘ব্রত উদযাপন’ প্রবন্ধে দেখা যাচ্ছে যে অনশনরত গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করার জন্য কবি পুণাতে গিয়েছিলেন। মহাত্মাজীর অনশনভঙ্গের পরদিন বিকালে জনসভা। সেই সভায় প্রবেশ করার ব্যাপারে কবি লিখেছেন—”ভাবলেম, অভিমন্যুর মতো প্রবেশতো হল, বেরোবার কী উপায়।”— অভিমন্যুর কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে।
‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ পুস্তিকাটিতে তিনটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ৩ সংখ্যক প্রবন্ধটিতে তিনি পুরানো স্মৃতিচারণ করেছেন। বাল্যকালে যখন তিনি পিতার সঙ্গে হিমালয়ে গিয়েছিলেন তখন যাওয়ার পথে মহর্ষি বোলপুরে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। কবি লিখেছেন—”আমার ‘পরে কটি বিশেষ কাজের ভার ছিল। ভগবদগীতা-গ্রন্থে কতকগুলি শ্লোক তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, আমি প্রতিদিন কিছু কিছু তাই কপি করে দিতুম তাঁকে।”
সতীশচন্দ্র রায় সম্বন্ধে কবি লিখেছেন ‘নতুন-পাওয়া বালক-বন্ধু।’ এই অত্যন্ত প্রতিভাশালী তরুণ অল্প বয়সেই মারা যান। এই ৩ সংখ্যক প্রবন্ধেই সতীশচন্দ্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি লিখেছেন—’তার স্বাভাবিক ধ্যানদৃষ্টিতে সমস্তটাকে সে দেখতে পেত প্রত্যক্ষ। উতঙ্কের যে উপাখ্যানটি সে লিখেছিল তাতে সেই ছবিটাকে সে আঁকতে চেষ্টা করেছে।’—উতঙ্কের কাহিনী মহাভারতে আছে। তিনি ছিলেন বেদ ঋষির শিষ্য। অর্জুনের প্রপৌত্র জন্মেজয়কে সর্পযজ্ঞ করতে তিনিই প্ররোচিত করেছিলেন।
বিশ্বভারতী গ্রন্থে মোট উনিশটি রচনা সংকলিত হয়েছে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৩৪৭ সাল পর্য্যন্ত ২০ বৎসরের অধিককাল শান্তিনিকেতন আশ্রমবিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর আদর্শ সম্বন্ধে কবি যে-সকল বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এই গ্রন্থে সেগুলিই সংকলিত হয়েছে। ১ সংখ্যক প্রবন্ধে কবি লিখেছেন যে, ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈদিক পৌরাণিক বৌদ্ধ জৈন মুসলমান প্রভৃতি সমস্ত চিত্তকে সম্মিলিত ও চিত্তসম্পদকে সংগৃহীত করতে হবে। শিক্ষা নিয়ে তাঁর ধারণাকে রূপ দেওয়ার জন্য কবি মাত্র পাঁচ-ছয়টি ছেলে নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছিলেন। আর্থিক সঙ্গতির অভাব ছিল তবুও তিনি থেমে যাননি। ৪ সংখ্যক প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”আমি যা পারি তা করেছি। সেই ছেলেকয়টিকে নিয়ে রস দিয়ে ভাব দিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি।” ৬ সংখ্যক প্রবন্ধেও তিনি মোটামুটি একই কথা লিখেছেন—”আমি সন্ধ্যাবেলায় তাদের নিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি, হাস্য-করুণ রসের উদ্রেক করে তাদের হাসিয়েছি কাঁদিয়েছি। তা ছাড়া নানা গল্প বানিয়ে বলতাম, ….. তখন মুখে মুখে গল্প তৈরী করবার আমার শক্তি ছিল। …. এমনি ভাবে ছেলেদের মন যাতে অভিনয়ে গল্পে গানে, রামায়ণ-মহাভারত-পাঠে সরস হয়ে ওঠে তার চেষ্টা করেছি।” ১৭ সংখ্যক প্রবন্ধে কবি লিখেছেন— ”অল্প কয়েকটি ছেলে নিয়ে গাছের তলায় এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ আরম্ভ করেছিলাম। প্রকৃতির অবাধ সঙ্গ লাভ করবার উন্মুক্ত ক্ষেত্র এখানেই ছিল; শিক্ষায় যাতে তারা আনন্দ পায়, উৎসাহ বোধ করে, সেজন্য সর্বদা চেষ্টা করেছি, ছেলেদের রামায়ণ মহাভারত পড়ে শুনিয়েছি। অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় তখন এখানে আসতেন, তিনি তা শুনতে ছাত্র হয়ে আসতে পারবেন না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।”
উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে এটা দেখা যাচ্ছে অন্তত তিনটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন যে তিনি ছাত্রদেরকে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো অসাম্প্রদায়িক বিশ্বমানব সারা পৃথিবীতেই অত্যন্ত বিরল। এটাও তাঁর অভিপ্রেত ছিল যে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত ধর্মসমূহের মূল্যবান বিষয়গুলিকে স্থান দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই এটা বিশ্বাস করতেন যে রামায়ণ মহাভারতের আবেদন শুধুমাত্র বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এর আবেদন সার্বজনীন। এই বিশ্বাস না থাকলে তিনি কখনোই অল্পবয়স্ক ছাত্রদেরকে রামায়ণ মহাভারত পড়াতেন না। সেই রামায়ণ মহাভারত কিন্তু আমাদের বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রায় ব্রাত্য হয়ে আছে বহুদিন থেকে। বিশ্বভারতী, পাঠভবন বা শিক্ষাসত্রের পাঠ্যসূচীতে অথবা রবীন্দ্রভাবনায় ভাবিত অন্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রামায়ণ মহাভারতের বিষয় পাঠক্রমে আছে কিনা আমি জানি না।
১১ সংখ্যক রচনাতে কবি বলেছেন—”হয়তো আমাদের সাধনা সিদ্ধ হবে, হয়তো হবে না। আমি গীতার কথা অন্তরের সঙ্গে মানি—ফলে লোভ করলে আপনাকে ভোলাব, অন্যকে ভোলাবো। আমাদের কাজ বাইরে থেকে খুবই সামান্য-কটিই বা আমাদের ছাত্র, কটিই বা বিভাগ, কিন্তু অন্তরের দিক থেকে এর অধিকারের সীমা নেই।”—ফলাকাঙ্খাহীন কর্ম। এটি গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ সংখ্যক শ্লোক।
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম—এটি কবির আশ্রম প্রতিষ্ঠাদিবসের উপদেশ। এই রচনাটিতে পৌরাণিক ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ও বশিষ্ঠের কথা আছে। ”আমাদের প্রাচীনকালে যে সব ঋষিদের পায়ে জুতো ছিল না, গায়ে, পোষাক ছিল না, তাঁরা কি সাহেবের বাড়ীর জুতো এবং বিলাতি দোকানের কাপড় পরা আমাদের চেয়ে অনেক বড়ো ছিলেন না। আজ যদি আমাদের সেই যাজ্ঞবল্ক্য, সেই বশিষ্ঠ ঋষি খালি গায়ে খালি পায়ে তাঁদের সেই জ্যোতির্ময় দৃষ্টি, তাঁদের সেই পিঙ্গল জটাভার নিয়ে আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ান, তা হলে সমস্ত দেশের মধ্যে এমন কোন রাজা এমন কত বড়ো সাহেব আছেন যিনি তাঁর জুতো ফেলে দিয়ে মাথার তাজ নামিয়ে, সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলা নিয়ে নিজেকে কৃতার্থ না মনে করেন। আজ এমন কে আছে যে তার গাড়িজুড়ি অট্টালিকা এবং সোনার চেন নিয়ে তাঁদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।”
সমবায়নীতি— সমবায়নীতি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে যে-সকল প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও ভাষণ দান করেছিলেন এই গ্রন্থে সেগুলি সংকলিত। ‘ভারতবর্ষে সমবায়ের বিশিষ্টতা’ প্রবন্ধে রামায়ণের জনকরাজার কথা, সীতার কথা আছে। ”এককালে জনকরাজা ছিলেন ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার প্রতিনিধি। তিনি এই সভ্যতার অন্নময় ও জ্ঞানময় দুটি ধারাকে নিজের মধ্যে মিলিয়েছিলেন। কৃষিও ব্রহ্মজ্ঞান, অর্থাৎ আর্থিক ও পরমার্থিক। এই দুয়ের মধ্যে ঐক্যসাধনার দুই পথ। সীতা তো জনকের শরীরিণী কন্যা ছিলেন না। মহাভারতে দ্রৌপদী যেমন যজ্ঞসম্ভবা রামায়ণের সীতা তেমনি কৃষিসম্ভবা। হলবিদারণ-রেখায় জনক তাঁকে পেয়েছিলেন। এই সীতাই, এই কৃষিবিদ্যাই, আর্যাবর্ত থেকে দাক্ষিণাত্যে রাক্ষস-দমন বীরের সঙ্গিনী হয়ে সে সময়কার সভ্যতার ঐক্যবন্ধনে আর্য-অনার্য সকলকে বেঁধে উত্তরে দক্ষিণে ব্যাপ্ত হয়েছিল।”
এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলিতে রবীন্দ্রনাথ সমবায় নীতির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। ঐ একই প্রবন্ধে কবি লিখেছেন— ”লঙ্কার বহু খাদ্যখাদক দশমুণ্ডধারী বহু—অর্থ-গৃধ্নু দশ-হাতওয়ালা রাবণকে মেরেছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বানরের সংঘবদ্ধ শক্তি। একটি প্রেমের আকর্ষণে সেই সংঘটি বেঁধেছিল। আমরা যাঁকে রামচন্দ্র বলি তিনিই প্রেমের দ্বারা দুর্বলকে এক করে তাদের ভিতর প্রচণ্ড শক্তি বিকাশ করেছিলেন। আজ আমাদের উদ্ধারের জন্যে সেই প্রেমকে চাই, সেই মিলনকে চাই।”
খ্রীস্ট পুস্তিকার ‘খ্রীস্ট’ প্রবন্ধে একটুখানি গীতার কথা আছে—”খ্রীস্টর প্রেরণা মানবসমাজে আজ ছোটো বড়ো কত প্রদীপ জ্বালিয়েছে, অনাথ-পীড়িতদের দুঃখ দূর করবার জন্যে তাঁরা অপরিসীম ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। কী দানবতা আজ চারদিকে, কলুষে পৃথিবী আচ্ছন্ন, তবু বলতে হবে : ‘স্বল্প মপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’। এই বিরাট কলুষ নিবিড়তার মধ্যে দেখা যায় না তাঁদের যাঁরা মানবসমাজের পুণ্যের আকর। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয়ই আছেন। নইলে পৃথিবী অভিশপ্ত হত, সমস্ত সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যেত, সমস্ত মানবলোক অন্ধকারে অবলুপ্ত হত।”—সংস্কৃত শব্দকয়টি গীতার একটি শ্লোকের অংশ। সম্পূর্ণ শ্লোকটি আছে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে— ৪০ সংখ্যক শ্লোক (পূর্বে আলোচিত)।
পল্লীপ্রকৃতি গ্রন্থের ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে মহাভারতের একটি কাহিনীর উল্লেখ আছে। ”পুরাণে পড়েছি, একদিন দৈত্যদের সঙ্গে সংগ্রামে দেবতারা হেরে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁরা আপনাদের গুরুপুত্রকে দৈত্যগুরুর কাছে পাঠিয়েছিলেন। যাতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেই বিদ্যা দেবলোকে আনাই ছিল তাঁদের সংকল্প। তাঁরা অবজ্ঞা করে বলেন নি ‘দানবী বিদ্যাকে আমরা চাইনে।’ দানবদের কাছ থেকে বিদ্যা নিয়ে তাঁরা দানবপুরী বানাতে ইচ্ছা করেন নি, সেই বিদ্যা নিয়ে তাঁরা স্বর্গকেই রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। দানবের ব্যবহার স্বর্গের ব্যবহার না হতে পারে, কিন্তু যে বিদ্যা দানবকে শক্তি দিয়েছে সেই বিদ্যাই দেবতাকেও শক্তি দেয়— বিদ্যার মধ্যে জাতিভেদ নেই।” —মহাভারতের এই কাহিনী অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথ একটা বড় কবিতা বা কাব্যনাটিকা লিখেছিলেন, তার নাম ‘বিদায়-অভিশাপ।’ কবিতাটি নিয়ে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
শ্রীনিকেতন শিল্পভাণ্ডার—উদবোধন অনুষ্ঠানে কবি যে অভিভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যে মহাভারতের কথার একটু উল্লেখ আছে। এই ভাষণে কবির কিছু ক্ষোভও প্রকাশ পেয়েছিল। ”বীরভূমের নীরস কঠোর জমির মধ্যে সেই বীজবপন কাজের পত্তন করেছিলুম। বীজের মধ্যে যে প্রত্যাশা সে থাকে মাটির নীচে গোপনে। তাকে দেখা যায় না বলেই তাকে সন্দেহ করা সহজ। অন্তত তাকে উপেক্ষা করলে কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। বিশেষত আমার একটা দুর্নাম ছিল আমি ধনীসন্তান, তার চেয়ে দুর্নাম ছিল আমি কবি। মনের ক্ষোভে অনেকবার ভেবেছি যাঁরা ধনীও নন কবিও নন সেই-সব যোগ্য ব্যক্তিরা আজ আছেন কোথায়। যাই হোক, অজ্ঞাতবাস পর্বটাই বিরাট পর্ব। বহুকাল বাইরে পরিচয় দেবার চেষ্টাও করিনি। করলে তার অসম্পূর্ণ নির্ধন রূপ অশ্রদ্ধেয় হত।”
‘শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ’ প্রবন্ধে কবির বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার একটুখানি বলেছেন। মাঝে মধ্যেই তিনি গ্রামের মানুষদের কিছু উপকার করার চেষ্টা করতেন। ”আমার শহুরে বুদ্ধি। আমি ভাবলুম, এদের গ্রামের মাঝখানে ঘর বানিয়ে দেব; এখানে দিনের কাজের পর তারা মিলবে; খবরের কাগজ, রামায়ণ-মহাভারত পড়া হবে; তাদের একটা ক্লাবের মতো হবে। …..ঘর বাঁধা হল, কিন্তু সেই ঘর ব্যবহার হল না। মাস্টার নিযুক্ত করলুম, কিন্তু নানা অজুহাতে ছাত্র জুটল না।”
‘হলকর্ষণ’ প্রবন্ধে রামায়ণের প্রসঙ্গ এসেছে।
”তার পরে এল এক যুগ, তাকে জনক রাজর্ষির যুগ নাম দিতে পারি। তখন দেখা গেল দুই বিদ্যার আবির্ভাব। ব্যবহারিক দিকে কৃষিবিদ্যা, পারমার্থিক দিকে ব্রহ্মবিদ্যা। কৃষিবিদ্যায় জনসমাজকে দিলে ব্যক্তিগত স্বার্থের সংকীর্ণ সীমা থেকে বহুল পরিমাণে মুক্তি, সম্ভব করলে সমাজের বহু লোকের মধ্যে জীবিকার মিলন। আর ব্রহ্মবিদ্যা অধ্যাত্মক্ষেত্রে ঘোষণা করলে— আত্মবৎ সর্বভূতেষু য পশ্যতি স পশ্যতি।
কৃষিবিদ্যাকে সেদিন আর্যসমাজ কত বড়ো মূল্যবান বলে জেনেছিল তার আভাস পাই রামায়ণে। হলকর্ষণ রেখাতেই সীতা পেয়েছিলেন রূপ, অহল্যা ভূমিকে হলযোগ্য করেছিলেন রাম। এই হলকর্ষণই একদিন অরণ্যপর্বত ভেদ করে ভারতের উত্তরকে দক্ষিণকে এক করেছিল।”
আমরা কথায় কথায় বলি আগেকার দিনে বাংলার পল্লীগ্রামে কত কি ছিল— হ্যান ছিল, ত্যান ছিল ইত্যাদি। কিন্তু একশো বছর বা তার আগেই রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার হতশ্রী রূপ দেখেছিলেন। বিশ্বভারতী সম্মিলনীতে দেওয়া অভিভাষণে তার একটু আভাস আছে। ”যে পল্লীগ্রামের অভিজ্ঞতা আমার আছে, আমি দেখেছি সেখানে কি নিরানন্দ বিরাজ করছে। সেখানে যাত্রা কীর্তন রামায়ণগান সব লোপ পেয়েছে, কারণ যে লোকেরা তার ব্যবস্থা করতো তারা গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে,” ”আমি যে পল্লীর কথা জানি সেখানে সর্বদা নিরানন্দের আবহাওয়া বইছে; সেখানে মন পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খোরাকের দ্বারা সতেজ হতে পারছে না। কাজেই নানা উত্তেজনা ও দুর্নীতিতে লোকের মন নিযুক্ত থাকে। মন যদি কথকতা পূজা-পার্বণ রামায়ণগান প্রভৃতি নিয়ে সচেষ্ট থাকে তবে তাতে করে তার আনন্দরসের নিত্য যোগান হয় কিন্তু এখন সে-সকলের ব্যবস্থা নেই, তাই মন নিরন্তর উপবাসী থাকে এবং তার ক্লান্তি দূর করবার জন্য মানসিক মত্ততার দরকার হয়ে পড়ে।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে যন্ত্র ব্যবহারের পক্ষে যদিও তিনি তার বিপদ সম্বন্ধেও সচেতন। ‘বাঙালীর কাপড়ের কারখানা ও হাতের তাঁত’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন—”এ কথা মানি—যন্ত্রের বিপদ আছে। দেবাসুরে সমুদ্রমন্থনের মতো সে বিষও উদগার করে।”— সমুদ্রমন্থনের কাহিনী মহাভারতে আছে। সমুদ্রমন্থনে অমৃত ইত্যাদি প্রভূত মূল্যবান সামগ্রী উত্থিত হলেও, এতে তীব্র হলাহলও উৎপন্ন হয়েছিল। ভগবান শিব সেই তীব্র বিষ পান করে নিজের কন্ঠে ধারণ করে সৃষ্টি রক্ষা করেছিলেন।
এই প্রবন্ধের অন্যত্র কবি লিখেছেন—”যে ব্যবহারিক বিদ্যায় সংসারে মানুষ জয়ী হয়, যুরোপের সেই বিদ্যাই সব-শেষে বাংলাদেশে এসে পৌঁছলো। আমরা য়ুরোপের বৃহস্পতি গুরুর কাছ থেকে প্রথম হাতে-খড়ি নিয়েছি, কিন্তু য়ুরোপের শুক্রাচার্য্য জানেন কি করে মার বাঁচানো যায়— সেই বিদ্যার জোরেই দৈত্যেরা স্বর্গ দখল করে নিয়েছিল। শুক্রাচার্যের কাছে পাঠ নিতে আমরা অবজ্ঞা করেছি—সে হল হাতিয়ার—বিদ্যার পাঠ। এই জন্যে পদে পদে হেরেছি, আমাদের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়লো। …. বৃহস্পতি গুরুর কাছে যে বিদ্যা লাভ করেছি— তাকে পূর্ণতা দিতে হবে শুক্রাচার্যের কাছে দীক্ষা নিয়ে। যন্ত্রকে নিন্দা করে যদি নির্বাসনে পাঠাতে হয়, তা হলে যে মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্যে সেই নিন্দা রটাই তাকে সুদ্ধ বিসর্জন দিয়ে হাতে-লেখা পুঁথির চলন করতে হবে।”—বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু আর শুক্রাচার্য অসুরদের গুরু। এই দুই গুরুর কথাই মহাভারতে আছে।
শান্তিনিকেতনে সম্মিলিত রবিবাসরের সদস্যদের প্রতি সম্ভাষণে কবি আবার ছাত্রশিক্ষায় রামায়ণ মহাভারতের কথা বললেন। এই অধ্যায়েরই অন্যত্র এই প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে কবি আবার বললেন— ”মনে হল মহর্ষির সাধনস্থল শান্তিনিকেতনে যদি ছাত্রদের এনে ফেলতে পারি তবে তাদের শিক্ষা দেওয়ার ভার তেমন কঠিন হয়তো হবে না। …. প্রথমে পাঁচ-সাতটি ছাত্র নিয়ে কাজ আরম্ভ করে দিলাম। শিক্ষার ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো যোগ ছিল না, কোনো ধারণাই ছিল না। আমি তাদের রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বলেছি, নানা গল্প ও কাহিনী রচনা করে হাসিয়েছি কাঁদিয়েছি, তাদের চিত্তকে সরস করবার জন্য চেষ্টা করেছি। আমার যা-কিছু সামান্য সম্বল ছিল তাই নিয়ে এ কাজে নেমে পড়েছিলাম।”
অচলিত সংগ্রহ।
কবিকাহিনী কাব্যগ্রন্থের মাত্র এক জায়গাতে রামায়ণের রচনাকার আদিকবি বাল্মীকির কথা আছে—
”মিলি তাঁর সাথে
জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ভারতী
কাঁদিলেন আদ্র হয়ে পৃথিবীর দুখে,
ব্যাধশরে নিপতিত পাখীর মরণে
বাল্মীকির সাথে যিনি করেন রোদন!”
ভগ্নহৃদয় কাব্যগ্রন্থে পক্ষীরাজ গরুড়ের কথা আছে (গরুড়ের কথা মহাভারতে আছে।)—
”নবজাত উল্কানেত্র মহাপক্ষ গরুড় যেমন
বসিতে না পায় ঠাঁই চরাচর করিয়া ভ্রমণ,
উচ্চতম মহীরুহ পদভারে ভূমিতলে লুটে,
ভূধরের শিলাময় ভিত্তিমূল বিদারিয়া উঠে,
অবশেষে শূন্যে শূন্যে দিবারাত্রি ভ্রমিয়া বেড়ায়,
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ঢাকি ঘোর পাখার ছায়ায়,
তেমনি এ ক্লান্ত হৃদি বিশ্রামের নাহি পায় ঠাঁই—
সমস্ত ধরায় তার বসিবার স্থান যেন নাই।”
কালমৃগয়া— রামায়ণের কাহিনী অণুসরণ করে এই গীতিনাট্যটি ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়। ২৩শে ডিসেম্বর ১৮৮২ তারিখে জোড়াসাঁকো-ভবনে ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ সম্মিলন উপলক্ষে কালমৃগয়া অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ অন্ধমুনি ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দশরথের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনী অনুসারে অযোধ্যার মহা প্রতাপশালী রাজা দশরথ একদিন মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। মৃগ অন্বেষণ করে রাজা যখন কাননে ঘুরছিলেন তখন অন্ধ মুনির পুত্র সিন্ধু নিকটবর্তী সরোবরে কলসীতে জল ভরছিলেন। কলসীতে জলভরার শব্দ দশরথ শুনে ভাবলেন যে কোনো মৃগ নিশ্চয়ই জলপান করছে। রাজা দশরথের শব্দভেদী বাণ শিক্ষা ছিল। মৃগবধের জন্য দশরথ সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন। শব্দ অণুসরণ করে সেই বাণ মুনিপুত্রকে বিদ্ধ করলো। রাজা দশরথ মরণাপন্ন মুনিপুত্রকে দেখে ভুল বুঝতে পারলেন। মুনিপুত্রের প্রাণবিয়োগ হলে রাজা তাকে বহন করে তার অন্ধ পিতা-মাতার কাছে নিয়ে গেলেন। অন্ধমুনি ঘটনা জেনে দশরথকে অভিশাপ দিলেন যে পুত্রশোকে তাঁর মৃত্যু হবে। এরপর পুত্রশোকে অন্ধ ঋষিদম্পতির মৃত্যু হলো। রামায়ণের এই কাহিনী পল্লবিত করে কবি কালমৃগয়া গীতিনাট্যটি রচনা করেছিলেন।
বিবিধপ্রসঙ্গ গ্রন্থটি ছোটো-বড়ো কিছু গদ্য রচনার সংকলন এবং এটি ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি পুনমুর্দ্রিত হয় নি। ‘মনের বাগান-বাড়ী’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”প্রেম হৃদয়ের সারাভাগ (সারভাগ?) মাত্র। হৃদয় মন্থন করিয়া যে অমৃতটুকু উঠে তাহাই। ইহা দেবতাদিগের ভোগ্য। অসুর আসিয়া যায়; কিন্তু তাহাকে দেবতার ছদ্মবেশে খাইতে হয়। যাহাকে তুমি দেবতা বলিয়া জান তাহাকেই তুমি অমৃত দাও, যাহাকে দেবতা বলিয়া বোধ হইতেছে তাহাকেই অমৃত দাও। কিন্তু এমন মহাদেব সংসারে আছেন, যিনি দেবতা বটেন কিন্তু যাঁহার ভাগ্যে অমৃত জুটে নাই, সংসারের সমস্ত বিষ তাঁহাকে পান করিতে হইয়াছে—আবার এমন রাহুও আছে যে অমৃত খাইয়া থাকে।”—সমুদ্রমন্থন মহাভারতের কাহিনী। আগে আলোচনা করা হয়েছে।
‘অনধিকার’ প্রবন্ধে কবি মহাভারত থেকে জনক রাজার একটা কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন—
অনধিকার
পূর্বকালে মহারাজ জনকের রাজ্যে এক ব্রাহ্মণ কোনো গুরুতর অপরাধ করাতে জনকরাজ তাঁহাকে শাসন করিবার নিমিত্ত কহিয়াছিলেন, ”হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার অধিকার-মধ্যে বাস করিতে পারিবেন না।” মহাত্মা জনক এইরূপ আজ্ঞা করিলে ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, ”মহারাজ, কোন কোন স্থানে আপনার অধিকার আছে আপনি তাহা নির্দেশ করুন; আমি অবিলম্বেই আপনার ব্যাক্যানুসারে সেই সমূদয় স্থান পরিত্যাগ করিয়া অন্য রাজার রাজ্যে গমন করিব।” ব্রাহ্মণ এই কথা কহিলে, মহারাজ জনক তাহা শ্রবণ করিয়া দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ-পূর্বক মৌনভাবে চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ রাহুগ্রস্ত দিবাকরের ন্যায় মহামোহে সমাক্রান্ত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহার মোহ অপনীত হইলে ব্রাহ্মণকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, ”ভগবন, যদিও এই পুরুষপরম্পরাগত রাজ্য আমার বশীভূত রহিয়াছে, তথাপি আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, পৃথিবীস্থ কোনো পদার্থেই আমার সম্পূর্ণ অধিকার নাই। আমি প্রথমে সমুদয় পৃথিবীতে, তৎপরে একমাত্র মিথিলানগরীতে, ও পরিশেষে স্বীয় প্রজামণ্ডলী-মধ্যে আপনার অধিকার অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু কোনো পদার্থেই আমার সম্পূর্ণ স্বত্ব প্রতীত হইল না।”
—কালীসিংহের অনুবাদিত মহাভারত। আশ্বমেধিক পর্ব।
অনুগীতা পর্বাধ্যায়। দাত্রিংশত্তম অধ্যায়। পৃ. ৪২
‘জনক রাজার উক্তির তাৎপর্য এই যে, যাহা কিছুকে আমরা আমার বলি তাহার কিছুই আমার নয়। আমার সহিত তাহাদের ন্যূনাধিক সম্বন্ধ আছে এই পর্যন্ত, কিন্তু তাহাদের প্রতি আমার কিছু মাত্র অধিকার নাই?’
এর পরবর্তী প্রবন্ধ ‘অধিকার’— সেখানেও এই প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে—”জনক রাজা কহিলেন, এক্ষণে আমার মোহ নির্মুক্ত হওয়াতে আমি নিশ্চয় বুঝিতে পারিয়াছি যে, কোনো পদার্থেই আমার অধিকার নাই, অথবা আমি সমুদয় পদার্থেরই অধিকারী। আমার আত্মাও অমর নহে; অথবা সমুদয় পৃথিবীই আমার। ফলত ইহলোকে সকল বস্তুতেই সকলের সমান অধিকার বিদ্যমান রহিয়াছে।”
উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি কবি মহাভারত থেকে দিয়েছেন।
ছোট্ট প্রবন্ধ ‘স্ত্রৈণ’। এখানে কবি লিখেছেন—”যে ব্যক্তি পড়িয়া গেলে স্ত্রীকে ধরিয়া উঠে, মরিয়া গেলে স্ত্রীকে লইয়া মরে; যে ব্যক্তি সম্পদের সময় স্ত্রীকে পশ্চাতে রাখে ও বিপদের সময় স্ত্রীকে সম্মুখে ধরে; এক কথায় যে ব্যক্তি ‘আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি’ ইহাই সার বুঝিয়াছে, সেই স্ত্রৈণ।”—উপরের শ্লোকাংশটি মহাভারতের উদ্যোগপর্ব থেকে নেওয়া। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হলো—
”আপদর্থে ধনং রক্ষেদ্দারান্ রক্ষেদ্ধনৈরপি।
আত্মানং সততং রক্ষেদ্দারৈরপি ধনৈরপি।।”
(মহাভারতম ত্রয়োদশ খণ্ড; পৃ.—৩৪৫)
এই গ্রন্থের অন্যত্র এই শ্লোকটির অর্থ দেওয়া হয়েছে।
‘মনোগণিত’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”অনেক অশিক্ষিত লোকে যেমন বিজ্ঞানসম্মত প্রণালী ও নিয়ম না জানিয়াও কেবল বুদ্ধি অভ্যাস ও শুভঙ্করের নিয়মে অঙ্ক কষিতে পারে, তেমনি কবিগণ এতকাল ধরিয়া মনোগণিতের অঙ্ক কষিয়া আসিতেছেন। শকুন্তলা কষিতেছেন, হ্যামলেট কষিতেছেন এবং মহাভারত রামায়ণে অঙ্কের স্তূপ কষিতেছেন।”
‘নিরহংকার আত্মম্ভরিতা’ নামক ছোট্ট লেখাটিতে কবি বলেছেন, ‘ প্রতিভা যখন মুর্হূতকালের জন্য অতিথি হইয়া একজন কবিকে বীণা করিয়া তাঁহার তন্ত্রী হইতে সুর বাহির করিতে থাকে তখন তিনি নিজের সুর শুনিয়া নিজে মুগ্ধ হইয়া পড়েন। বাল্মীকি তাঁহার নিজের রচিত রামকে যেমন ভক্তি করিতেন এমন কোনো ভক্ত করেন না এবং যতক্ষণ তিনি রামের চরিত্র সৃজন করিতেছিলেন ততক্ষণ তিনি নিজেই রাম হইয়াছিলেন ও তাঁহার নিজের মহান ভাবে নিজেই মোহিত হইয়া গিয়াছিলেন।”
বাল্মীকি প্রতিভা— অচলিত সংগ্রহে যে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ রয়েছে সেটি ১৮৮০-৮১ সালে প্রকাশিত/অভিনীত হয়। এর পরে ১৮৮৬ সালে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। আগে একবার আলোচনা করা হয়েছে, তাই এখানে আর বাল্মীকি প্রতিভা নিয়ে কোনো আলোচনা করা হচ্ছে না।
গ্রন্থ পরিচয় : শ্রাবণ ১৩৩৬ সালে নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লিখিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—”আজ সুরুলে হলচালন উৎসব হবে। লাঙল ধরতে হবে আমাকে। বৈদিক মন্ত্র-যোগে কাজটা করতে হবে বলে এর অসম্মানের অনেকটা হ্রাস হবে। বহু হাজার বৎসর পূর্বে এমন একদিন ছিল যখন হাল-লাঙল কাঁধে করে মানুষ মাটিকে জয় করতে বেরিয়েছিল, তখন হলধরকে দেবতা বলে দেখেছে, তার নাম দিয়েছে বলরাম। এর থেকে বুঝবে নিজের যন্ত্রধারী স্বরূপকে মানুষ কতখানি সম্মান করেছে। বিষ্ণুকে বলেছে চক্রধারী, কেননা এই চক্র হচ্ছে বস্তুজগতে মানুষের বিজয়রথের বাহন। মাটি থেকে মানুষ ফসল আদায় করেছে এটা তার বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে হাল-লাঙলের উদ্ভাবন। …. দেহের সীমা থেকে যে বিজ্ঞান আমাদের মুক্তি দিচ্ছে আজ য়ুরোপীয় সভ্যতা তাকে বহন করে এনেছে— একে নাম দেওয়া যাক বলরামদেবের সভ্যতা। তুমি জানো বলরামদেবের একটু মদ খাবারও অভ্যাস আছে, এই সভ্যতাতেও শক্তিমত্ততা নেই তা বলতে পারি নে, কিন্তু সেই ভয়ে শক্তিহীনতাকেই শ্রেয়গণ্য করতে হবে এমন মূঢ়তা আমাদের না হোক।”—বলরাম মহাভারতের চরিত্র-শ্রীকৃষ্ণের বৈমাত্রেয় দাদা তিনি।
অধিকাংশ ইউরোপীয় পণ্ডিত খ্রীষ্টান সভ্যতা বা খ্রীষ্টধর্মের চাইতে বড়ো বা মহত্তর আর কিছু ভাবতে চান না। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাকে অর্বাচীন বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তারা আর্যবিজয় বা Aryan Invasion জাতীয় তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। তাঁদের মতে বহিরাগত আর্যেরা মোটামুটি ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ ভারতে প্রবেশ করে এবং তারপরই ভারতীয় সভ্যতা/সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার সৃষ্টি। মহাভারত রচনা বা মহাভারতীয় সভ্যতা তাঁদের মতে অনেক পরবর্তী কালের। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ধ্বজাধারী অনেক ভারতীয় পণ্ডিতও এই মতের সমর্থন করেন।
রবীন্দ্রনাথের সময় এখনকার মতো এত বেশি প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কার হয় নি বা এতবেশি গবেষণাও হয়নি। তাই সময়ের ব্যাপারে অনেকক্ষেত্রে তিনি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মত মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলরামের সময় (এটাই মহাভারতের সময়) ‘বহু হাজার বৎসর পূর্বে’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘বহু হাজার বৎসর পূর্বে’ বলতে নিশ্চয়ই আড়াই-হাজার বা তিনহাজার বৎসর আগের কথা বোঝায় না, তার অনেক বেশি আগেকার কথাই বোঝায়। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে এখানকার অনেক পণ্ডিতই মহাভারতের সময়কাল অন্তত পাঁচহাজার বৎসর পূর্বের বলে মনে করেন। উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা Dr. N.S. Rajaram এর লেখা A Search for the Historical Krishna বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন