এই খণ্ডে সন্নিবেশিত গ্রন্থগুলি হলো
কবিতা ও গান : পলাতকা, শিশু ভোলানাথ, পূরবী ও লেখন;
নাটক ও প্রহসন : গুরু, অরূপরতন, ঋণশোধ ও মুক্তধারা;
উপন্যাস ও গল্প : ধর্ম ও শান্তিনিকেতন; চার অধ্যায় ও গল্পগুচ্ছ; এবং
গ্রন্থ পরিচয় অংশ।
এই গ্রন্থগুলির মধ্যে শিশু ভোলানাথ, লেখন, গুরু, ঋণশোধ এগুলোতে রামায়ণ বা মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ নেই। অন্য গ্রন্থগুলিতে এই প্রসঙ্গ অল্পবিস্তর আছে।
পলাতকা কাব্যগ্রন্থের নিষ্কৃতি কবিতাটি এক পাষণ্ড স্বামী ও পিতার কাহিনী। সে কচি মেয়ে মঞ্জুলিকার বিয়ে ঠিক করেছে মঞ্জুলিকার চাইতে পাঁচগুণ বয়সে বড় এক কুলীন পাত্রের সঙ্গে। মা এটা মেনে নিতে পারেন না, তিনি পাড়ার একটা ভালো ছেলের কথা তোলেন কিন্তু ছেলেটি কুলীন নয় বলে বাবা এটা নাকচ করে দেয়।
”দেখতে শুনতে ভলো হলেই পাত্র হল! রাধে!
স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে।”
বাবার ধারণা সে খুব দৃঢ়চেতা মানুষ—
”তিনি বলেন, তাঁর সাধনা বড়োই সুকঠোর;
আর কিছু নয়, শুধু মনের জোর,
অষ্টাবক্র জমদগ্নি প্রভৃতি সব ঋষির সঙ্গে তুল্য,
মেয়েমানুষ বুঝবে না তার মূল্য।”
অষ্টাবক্র জমদগ্নি—এঁরা পৌরানিক ঋষি, মহাভারতে এঁদের উল্লেখ আছে। উদ্দালক ঋষির শিষ্য ছিলেন কহোড়। এই কহোড়ের পুত্র ছিলেন অষ্টাবক্র। বেদ ছাড়াও আমাদের ছয়টি বেদাঙ্গ আছে—শিক্ষা, কল্প, নিরক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ ও জ্যোতিষ। বেদাঙ্গ শিক্ষাতেও বলা হয়েছে যে বেদ পাঠ করতে হবে সঠিকভাবে এবং সুন্দর উচ্চারণে। একদিন কহোড় যখন বেদপাঠ করছিলেন সেটা ঠিকভাবে পাঠ হচ্ছিল না। অষ্টাবক্র বার বার পিতার ভুল ধরে দিচ্ছিলেন আর ঠিকভাবে পাঠ করতে বলছিলেন। অন্য শিষ্যদের সম্মুখে কহোড় এতে খুব অপমানিত বোধ করেন এবং অভিশাপ দেন যে অষ্টাবক্রের (তখন অবশ্য সে অষ্টাবক্র হয়নি, কারণ সে তখন মাতৃগর্ভে) সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বাঁকাচোরা হবে। শিশুটি সেইভাবেই ভূমিষ্ঠ হলো আর তার নাম হলো অষ্টাবক্র। কহোড় একবার জনক রাজসভায় গিয়ে শাস্ত্রবিচারে বরুণপুত্র বন্দি কর্তৃক পরাস্ত হন এবং জলে নিমজ্জিত হন। অষ্টাবক্র যখন দ্বাদশবর্ষীয় বালক, তখন তিনি এই কথা জানতে পারেন। তিনি তাঁর মাতুল শ্বেতকেতুর সঙ্গে জনকরাজ সভায় যান এবং বিচারে বন্দিকে পরাজিত করে পিতার উদ্ধারসাধন করেন। এতে তাঁর পিতা প্রীত হয়ে অষ্টাবক্রের শরীরের বক্রতা অপনোদন করেন। অষ্টাবক্রের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অষ্টাবক্র সংহিতা। জমদগ্নি পরশুরামের পিতা। ইনি অতি ক্রোধীস্বভাবের ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর কোন কাজে সামান্য বিলম্বের জন্য তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর পুত্রদের মাতৃবধের আদেশ দেন। প্রথম চারপুত্র অস্বীকৃত হলে, কনিষ্ঠপুত্র পরশুরাম মাতাকে কুঠার দিয়ে হত্যা করেন।
মঞ্জুলিকার বিয়ে হয়ে গেল পিতার ঠিক করা বুড়ো পাত্রের সঙ্গে।
”বিদায়বেলায় মেয়েকে বাপ বলে দিলেন মাথায় হস্ত ধরি,
হও তুমি সাবিত্রীর মতো এই কামনা করি।
কিমাশ্চর্যমতঃপরং বাপের সাধন জোরে
আশীর্বাদের প্রথম অংশ দুমাস যেতেই ফলল কেমন করে—
পঞ্চাননকে ধরল এসে যমে;
কিন্তু মেয়ের কপালক্রমে
ফলল না তার শেষের দিকটা, দিলে না যম ফিরে;
মঞ্জুলিকা বাপের ঘরে ফিরে এল সিঁদুর মুছে শিরে।”
মহাভারতের সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। একনিষ্ঠ স্বামীপ্রেমের পরাকাষ্ঠা সাবিত্রী তাঁর ভক্তি এবং বুদ্ধির জোরে যমরাজার কাছ থেকে মৃতস্বামী সত্যবানের পুনর্জীবনের বর আদায় করে নিয়েছিলেন।
কন্যার এই ভাগ্য বিপর্য্যয়ে সন্তপ্তা মা মৃত্যুর কোলে আশ্রয় পেয়ে ভবজ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পেলেন। মঞ্জুলিকা তার পিতার সর্বপ্রকারে সেবাযত্ন করে। তবুও তার পিতা স্ত্রীর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরই পুনর্বিবাহ মনস্থ করলো। তার পরলোকগতা মায়ের স্মৃতির এইরকম অবমাননা মঞ্জুলিকাকে কষ্ট দেয়। সে তার পিতার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলে। তার পিতার বক্তব্য—ধর্মাচরণের জন্যই তাকে এই বিবাহ করতে হবে, কারণ স্ত্রী ব্যতীত গৃহধর্ম অপূর্ণ থাকে।
”কিন্তু গৃহধর্ম
স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়
মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়।”
—মনু বৈদিক যুগের ঋষি। হিন্দু ধর্মের দুটো প্রধান স্তম্ভ শ্রুতি (বেদ) এবং স্মৃতি (মনুসংহিতা)। তিনি যে নীতিশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন তা মনুসংহিতা নামে পরিচিত। এই গ্রন্থের জন্য নিন্দা প্রশংসা এখনো তাঁর প্রতি বর্ষিত হয়। নিন্দার ভাগই বেশী। হাজার হাজার বছর আগে তিনি যে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন তার বিচার তখনকার সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটেই হওয়া উচিত। আর শুধু হিন্দুধর্মে কেন, অন্যধর্মেও বহু সামাজিক অনুশাসন ছিল বা আছে সেগুলো এখনকার দিনে অবাঞ্ছিত মনে হয়। আইনি বিধিসমূহ প্রণয়নের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতেই তাঁকে একজন পথিকৃৎ বলে সম্মান করা হয়।
পলাতকা কাব্যগ্রন্থের ‘ভোলা’ কবিতার প্রথমেই শিবের জটা আর গঙ্গার কথা বলা হয়েছে। স্নেহশীল পিতার শিশুপুত্রের মৃত্যুতে মনে হলো—
”হঠাৎ আমার হল মনে,
শিবের জটার গঙ্গা যেন শুকিয়ে গেল অকারণে;”
রামায়ণের কাহিনী অনুসারে ভগীরথ গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন ঋষি অভিশাপে মৃত তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্ধারের জন্য। জননী গঙ্গা যখন প্রস্তুত হলেন অবতরণের জন্য তখন একটা সমস্যার উদয় হলো, গঙ্গার অবতরণের বেগ সহ্য করা পৃথিবীতে কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তখন ভগীরথ ভগবান শিবের তপস্যা করে তাঁকে প্রসন্ন করলেন—শিব তাঁর মস্তকে গঙ্গার পতনের বেগ ধারণ করলেন।
পূরবী কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’—প্রয়াত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই কবিতায় মহাভারতের অর্জুনের একটু উল্লেখ অছে—
”অন্যায় অসহ্য যত, যত কিছু অত্যাচার পাপ
কুটিল কুৎসিত ক্রুর, তার’পরে তব অভিশাপ
বর্ষিয়াছ ক্ষিপ্রবেগে অর্জুনের অগ্নিবাণ-সম”।।
এই কাব্যগ্রন্থের ‘শিলঙের চিঠি’ কবিতায় (শ্রীমতী শোভনা দেবী ও শ্রীমতী নলিনী দেবীর প্রতি) বাল্মীকি এবং বেদব্যাসের নাম এসেছে—
”ছন্দে লেখা একটি চিঠি চেয়েছিলে মোর কাছে,
ভাবছি বসে এই কলমের আর কি তেমন জোর আছে।
তরুণ বেলায় ছিল আমার পদ্য লেখার বদ-অভ্যাস,
মনে ছিল হই বুঝি বা বাল্মীকি কি বেদব্যাস”।
ঐ একই কবিতায় ঋষি দুর্বাসা এবং মৃত্যু-অধিপতি যমরাজার কথা এসেছে—
”তবু আমার পক্ক কৈশোর লম্বা দাড়ির সম্ভ্রমে
আমাকে যে ভয় করনি দুর্বাসা কি যম ভ্রমে,
মোর ঠিকানায় পত্র দিতে হয়নি কলম কম্পিত,
কবিতাতে লিখতে চিঠি হুকুম এল লম্ফিত—”
মৃত্যু-অধিপতি যমরাজার উল্লেখ রামায়ণ এবং মহাভারত—এই উভয় গ্রন্থেই আছে। দুর্বাসা পৌরাণিক ঋষি। তাঁর কাহিনী মহাভারতের বহু জায়গাতেই আছে। অভিধানে দেখা যাচ্ছে যে তিনি মহর্ষি অত্রি ও অনসূয়ার সন্তান। তিনি অতিশয় স্বেচ্ছাপরতন্ত্র এবং কোপন স্বভাব ছিলেন।
উদাসীন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ভোলানাথ ভগবান শঙ্কর রবীন্দ্রনাথের প্রিয়। ‘তপোভঙ্গ’ কবিতায় কবি বিভিন্নভাবে তাঁকে স্মরণ করেছেন। রামায়ণ ও মহাভারত এই উভয়গ্রন্থেই ভগবান শিবের কথা আছে।
‘ঝড়’ কবিতাতেও তিনি ভগবান শিব এবং গঙ্গার কথা বলেছেন—
”মহাদেবের তপের জটা হতে
মুক্তিমন্দাকিনী এল ‘কুল ডোবানো স্রোতে;”
পূরবী কাব্যগ্রন্থে ‘বৈতরণী’ নামে একটি কবিতা আছে। বৈতরণী নদীর কথা মহাভারতে আছে। মহাভারতের অভিধানে দেখা যাচ্ছে বৈতরণী নদী হলো মৃতগণের যমপুরে গমনকালীন পথিমধ্যে প্রবাহমানা নদীবিশেষ। কাশীরামদাসের মহাভারতে বৈতরণী নদীর এই রকম বর্ণনা আছে—
”এই বৈতরণী নদী পরম নির্ম্মল। উত্তর হইতে বহে দক্ষিণ মণ্ডল।।
দক্ষিণ শমনপুরে বড়ই তরঙ্গ। পাপী পার হতে নারে, দেখি দেয় ভঙ্গ।”
‘প্রবাহিনী’ কবিতাতেও শিব এবং গঙ্গার কথা আছে—
”যোগীশ্বরের জটার মধ্যে
তরঙ্গিনীর নুপূর বাজাই।’
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবি লিখেছিলেন ‘চিঠি’ কবিতার আকারে।
পূরবী কাব্যগ্রন্থে রয়েছে সেটি। এখানে যোগীশ্বর শিব এবং মদনভস্মের কথা আছে।
”হিমালয়ে যোগীশ্বরের রোষের কথা জানি,
অনঙ্গেরে জ্বালিয়েছিলেন চোখের আগুন হানি।”
ভারতীয় সভ্যতার প্রাণধারা গঙ্গা। সেই পুণ্যসলিলা জাহ্নবীর প্রতি কবি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন ‘প্রাণগঙ্গা’ কবিতায়। এই কবিতাতেও জটাধারী শিব এবং গঙ্গার কথা বলা হয়েছে।
”মৃত্যুঞ্জয় শিবের অসীম জটাজালে
ঘুরে ঘুরে কালে কালে
তপস্যার তাপ লেগে প্রবাহ পবিত্র হল তার।”
পূরবী কাব্যগ্রন্থে বেশ কয়েকটি কবিতাতে শিব এবং গঙ্গার কথা আছে। ঐ পর্বে রবীন্দ্রনাথ কি শিবের ভাবে একটু বেশী মগ্ন ছিলেন?
অরূপরতন নাটকটি বলা যেতে পারে মঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী ‘রাজা’ নাটকের সংক্ষিপ্ত রূপ। প্রাসাদের বাগানে যখন আগুন লেগেছে তখন সেই বিপদের মধ্যে ক্ষণকালের জন্য সুদর্শনা দেখতে পেয়েছে রাজার ভয়ঙ্কর রূপ। এই দর্শন তার বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া সে দেখেছে মেকি রাজা সুবর্ণের নয়নভোলানো রূপ। তাই সুদর্শনা আর থাকবে না ঘরে— সে বেরিয়ে পড়বে রাস্তায়। আবার সে এরকমও ভাবছে যে রাজা যদি তাকে জোর করে আটকে রাখেন তবে ভালো হয়। রাজকন্যা সুদর্শনার এইরকম মনের অবস্থা, ওদিকে আগুন থেকে বাঁচতে লোকে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। এরই মধ্যে কিছু সাধারণ নাগরিক নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। কথাতেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত। কথার মধ্যে তারা নিজেদের মতো করে রামায়ণ মহাভারতের কথাও বলেছে—
”প্রথম (নাগরিক)। এটি ঘটালেন আমাদের রাজকন্যা সুদর্শনা।
দ্বিতীয় । সকল সর্বনাশের মূলেই স্ত্রীলোক আছে। বেদেই তো আছে— কী আছে বলো না হে বটুকেশ্বর—তুমি বামুনের ছেলে।
তৃতীয়। আছে বৈকি। বেদে যা খুঁজবে তাই পাওয়া যাবে—অষ্টাবক্র বলেছেন, নারীনাঞ্চ নখিনাঞ্চ শৃঙ্গিনাং শস্ত্রপাণিনাং অর্থাৎ কিনা—
দ্বিতীয়। আরে, বুঝেছি, বুঝেছি—আমি থাকি তর্করত্নপাড়ায়-অনুস্বার—বিসর্গের একটা ফোঁটা আমার কাছে এড়াবার জো নেই।
প্রথম। আমাদের এ হল যেন কলির রামায়ণ। কোথা থেকে ঘরে ঢুকে পড়ল দশমুণ্ড রাবণ, আচমকা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিল।
তৃতীয়। যুদ্ধের হাওয়া তো চলছে, এ দিকে রাজকন্যা যে কোথায় অদর্শন হয়েছেন কেউ খোঁজ পায় না। মহারাজ তো বন্দী (সুদর্শনার পিতা), এ দিকে কে যে লড়াই চালাচ্ছে তারও কোনো ঠিকানা নেই।
দ্বিতীয়। কিন্তু আমি ভাবছি, এখন আমাদের উপায় কী? আমাদের ছিল এক রাজা, এখন সাতটা হতে চলল, বেদে পুরাণে কোথাও তো এর তুলনা মেলে না।
প্রথম। মেলে বৈকি—পঞ্চপাণ্ডবের কথা ভেবে দেখো।
তৃতীয়। আরে সে হল পঞ্চপতি—
প্রথম। একই কথা। তারা হল পতি, এরা হল নৃপতি। কোনোটারই বাড়াবাড়ি সুবিধে নয়।
তৃতীয়। আমাদের পাঁচকড়ি একেবারে বেদব্যাস হয়ে উঠল হে—রামায়ণ মহাভারত ছাড়া কথাই কয় না।
দ্বিতীয়। তোরা তো রামায়ণ মহাভারত নিয়ে পথের মধ্যে আসর জমিয়েছিস, এদিকে আমাদের নিজের কুরুক্ষেত্রে কী ঘটছে খবর কেউ রাখিস নে।”
এই সমস্ত কথাবার্তার কোন গভীর অর্থ আবিষ্কার করার চেষ্টায় বিরত থাকাই ভাল। নাটকের মাঝখানে একটু কমিক রিলিফ বলে ভেবে নিলেই সব গোল মিটে যায়।
মুক্তধারা নাটকে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ নাই বললেই হয়—কাহিনী ছাড়াই দুটো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেইগুলোর সামান্য একটু উল্লেখ করবো।
বিভূতি দেশের শ্রেষ্ঠযন্ত্রবিদ। সে একটা বিশাল বাঁধ দিয়ে নদীর জলধারাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এটা উত্তরকূটের মানুষদের পক্ষে ভাল কিন্তু শিবতরাইয়ের মানুষদের পক্ষে খুব খারাপ কারণ সেখানে প্রচণ্ড জলাভাব দেখা দেবে। উত্তরকূটের মানুষেরা উৎসবের মেজাজে রাস্তায় বেরিয়েছে,
৪। (চতুর্থ নাগরিক)। মনে করেছিলুম বিশাই সামন্তের রথটা চেয়ে এনে আজ বিভূতিদাদার রথযাত্রা করাব। কিন্তু রাজাই নাকি আজ পায়ে হেঁটে মন্দিরে যাবেন।
৫। ভালোই হয়েছে। সামন্তের রথের যে দশা, একেবারে দশরথ। পথের মধ্যে কথায় কথায় দশখানা হয়ে পড়ে।
৫। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। দশরথ। আমাদের লম্বু এক একটা কথা বলে ভালো। দশরথ।”
দশরথ অযোধ্যার মহাপ্রতাপশালী রাজা। ভগবান যখন রাম অবতারে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তিনি দশরথের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এই নাটকেই অন্য জায়গায় শিবতরাইয়ের মানুষেরা উত্তরকূটের মানুষদের সম্বন্ধে ঘৃণাসূচক কথা বলছে—বলতে বলতে সমুদ্রমন্থনের কথা টেনে এনেছে।
”১। (প্রথম নাগরিক) আমাদের গুরু বলে ওদের ছায়া মাড়ানো নৈব নৈব চ। কেন জানিস?
৩। কেন বল্তো?
২। তা জানিস নে? সমুদ্রমন্থনের পর দেবতার ভাঁড় থেকে অমৃত গড়িয়ে যে মাটিতে পড়েছিল আমাদের শিবতরাইয়ের পূর্বপুরুষ সেই মাটি দিয়ে গড়া। আর দৈত্যরা যখন দেবতার উচ্ছিষ্ট ভাঁড় চেটে চেটে নর্দমায় ফেলে দিলে তখন সেই ভাঁড়াভাঙা পোড়ামাটি দিয়ে উত্তরকূটের মানুষকে গড়া হয়। তাই এরা শক্ত, কিন্তু থুঃ—অপবিত্র।”
সমুদ্রমন্থনের কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে।
চার অধ্যায় উপন্যাসে যে সমস্ত জায়গায় রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ এসেছে সেগুলি এখন আলোচনা করা হয়েছে।
চার অধ্যায় উপন্যাসটি ১৩৪১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। চরমপন্থী দেশসেবকদের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের যোগাযোগ আছে। যারা ঐসব ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত বা সহানুভূতিশীল, তাদের মধ্যে দোলাচলচিত্ততা আছে—সব সময় বুঝে উঠতে পারে না কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। এখন এলার সঙ্গে ইন্দ্রনাথের কথা হচ্ছে। এলা নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছে। এলা তার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছে অনেক ভলো ছেলেরা যাদের মধ্যে ইতরতা নেই, তারাই ছুটেছিল মৃত্যুদূতের পিছনে। এলা ভেবে পায়না এমন সব ছেলেদের কোন অন্ধশক্তির কাছে বলি দেওয়া হচ্ছে। ইন্দ্রনাথ বললেন— ”বৎসে, এই যে ধিক্কার এটাই কুরুক্ষেত্রের উপক্রমনিকা। অর্জুনের মনেও ক্ষোভ লেগেছিল।”
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তেই অর্জুন মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন। সে এমনই মোহ যে তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না—তাঁর হাত থেকে ধনুক খসে পড়ার মতো অবস্থা হলো। তিনি যুদ্ধ করবেন না। প্রিয়তম পিতামহ, গুরু দ্রোণাচার্য্য এবং অসংখ্য আত্মীয় স্বজনদের বধ করে রাজ্য লাভ করার চাইতে তিনি বরং ভিক্ষাজীবি হয়ে জীবনধারণ করবেন। অর্জুনের এই মোহ কিন্তু যুদ্ধের প্রতি বিরাগ থেকে নয়। তিনি তো জানতেনই যে এই যুদ্ধটা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যুদ্ধ। বিপক্ষে যে ভীষ্ম দ্রোণ থাকবেন, এটা তো নতুন কথা নয়। আসলে অর্জুন ভয় পেয়েছিলেন। না। নিজের প্রাণের ভয়ে ভীত হননি মহাবীর অর্জুন। তাঁর ভয় সম্মানহানির, মর্যাদাহানির। এতদিন তিনি বলে এসেছেন কুরুবাহিনী অতি নগণ্য—তিনি একাই সমস্ত কুরুসৈন্যকে ধ্বংস করতে পারেন। কিন্তু দূর থেকে মুখে বলা এক কথা, আর যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে সেটা করে দেখানো অন্য কথা। ভীষ্ম-দ্রোণ বা কর্ণের ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনো সংশয় নেই—তাঁরা প্রায় অজেয়। যদি তিনি এই মহাবীরদের পরাজিত করে যুদ্ধে জয়লাভ না করতে পারেন, তবে তাঁর সুনাম তো ধূলায় মিশে যাবে। অর্জুনের ভয় এই অবমাননার।
এই উপন্যাসের অন্যত্র রয়েছে (সুলভ ৭ম, পৃ-৩৮৫) ইন্দ্রনাথ এলাকে বোঝাচ্ছেন—” তোমাকে যদি বাঘে খেতে আসত আর তুমি যদি ভীতু না হতে তা হলে তখনই তাকে মারতে দ্বিধা করতে না। আমরা সেই বাঘটাকে মনের সামনে স্পষ্ট দেখছি, দয়ামায়া দিয়েছি বিসর্জন, …। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই কথাটাই বুঝিয়েছেন। নির্দয় হবে না কিন্তু কর্তব্যের বেলা নির্মম হতে হবে।”
৩৮৯ পৃষ্ঠাতে ইন্দ্রনাথ গীতার সেই বিখ্যাত শ্লোকটা আংশিক শুনিয়েছেন কানাইকে— কর্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।—এই শ্লোকটি নিয়ে আগে আলোচনা করা হয়েছে।
৩৯১ পৃষ্ঠাতে অতীন মান্ধাতার কথা উল্লেখ করেছে— ”জীবনটা অতি ছোটো, কায়দাকানুন অতি দীর্ঘ, নিয়ম বাঁচিয়ে চলবার উপযুক্ত পরমায়ু ছিল সনাতন যুগে মান্ধাতার। কলিকালে তার টানাটানি পড়েছে।” রামায়ণে মান্ধাতা রাজার কথা আছে। অতি প্রাচীনকাল বোঝাতে মান্ধাতার কথা বলা হয়।
কথা হচ্ছে অতীন এবং এলার মধ্যে (সুলভ-৭ম; পৃষ্ঠা ৩৯৩)। অতীন এলার ভালোবাসার মানুষ। এলা বলেছে—”আমার উপায় ছিল না অন্তু। দ্রৌপদীকে দেখবার আগেই কুন্তী বলেছিলেন, তোমরা সবাই মিলে ভাগ করে নিয়ো। তুমি আসবার আগেই শপথ করে দেশের আদেশ স্বীকার করেছি। বলেছি আমার একলার জন্য কিছুই রাখবো না। দেশের কাছে আমি বাগদত্তা।”—মহাভারতের এই কাহিনীটি আপনাদের সকলেরই জানা। দুর্যোধনের ষড়যন্ত্রে এবং ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতিতে কুন্তী সহ পাণ্ডবদের যেতে হয়েছিল বারণাবতে সেখানে জতুগৃহে তাঁদের দগ্ধ হবার কথা। বিদুরের মন্ত্রণায় তাঁরা মৃত্যুকে এড়াতে পারলেও সহায়সম্বলহীন তাঁদেরকে দুর্যোধনের ভয়ে ভিক্ষাজীবি হয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছিল। এইভাবেই ঘুরতে ঘুরতে ভাগ্য একদিন পাঁচভাইকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল পাঞ্চাল রাজ্যে রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায়। সেখানে সুকঠিন লক্ষ্যভদ করে ছদ্মবেশী অর্জুন লাভ করেছিলেন ত্রিভুবনে অতুলনীয়া অযোনিসম্ভবা কন্যা দ্রৌপদীকে। তারপর তাঁরা নবলব্ধ কন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কুম্ভকারগৃহে যেখানে মাতা কুন্তীর সঙ্গে তাঁরা ছদ্মবেশে বাস করেছিলেন। মাকে বললেন—
গত্বা তু তাং ভার্গবকর্ম্মশালাং পার্থৌপৃথাং প্রাপ্য মহানুভাবৌ।
তাং যাজ্ঞসেনীং পরমপ্রতীতৌ ভিক্ষেত্যথাবেদয়তাং নবা গ্রৌ।
(মহাভারতম চতুর্থ খণ্ড, পৃ-১৮৩৮)
‘মা ভিক্ষা এনেছি’। কুন্তী কিছু না দেখেই বললেন—
কুটীগতা সা ত্বনবেক্ষ পুত্রৌ প্রোবাচ ভুঙক্তেতি সমেত্য সর্ব্বে।
(মহাভারতম ৪র্থ খণ্ড, ১৮৩৮)
‘যা এনেছো সবাই মিলে ভোগ করো।’
আবার অতীন এবং এলার কথা (সুলভ-৭ম; পৃ-৪০৯)। অতীন এলাকে বলছে—”শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বীরের কর্তব্যই করতে বলেছিলেন অত্যন্ত অরুচি সত্ত্বেও; কুরুক্ষেত্র চাষ করার উদ্দেশে এগ্রিকালচারাল ইকনমিকস চর্চা করতে বলেননি।” অর্জুনের মোহ প্রসঙ্গে আগে আলোচনা হয়েছে। অতীন এসেছে এলার কাছে অনেক বিপদ মাথায় নিয়ে (সুলভ-৭ম; পৃ-৪১৩) স্বভাবতই এলা খুব উদ্বিগ্ন। অতীন বলছে—”এলা, মন সহজ করো। যেন কিছু হয়নি, যেন আমরা দুজনে আছি লঙ্কাকাণ্ড আরম্ভ হবার আগে সুন্দরকাণ্ডে।”—রামায়ণ মহাকাব্য সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত। লঙ্কাকাণ্ডে রাম বানরসেনা নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছেন। তারপর সেখানে যুদ্ধ, রাক্ষসবীরসমূহ ও রাবণবধ এবং সীতার উদ্ধার। লঙ্কাকাণ্ডকে বলা যায় ফাইনাল অ্যাসাল্ট; সুন্দরকাণ্ড হচ্ছে লঙ্কাকাণ্ডের আগে। এটাকে প্রিপারেশন স্টেজ বলা যায়।
গল্পগুচ্ছতে কয়েকটি ছোটগল্প আছে। গল্পগুচ্ছের আরো গল্প পরবর্তী খণ্ডতে পাওয়া যাবে। এইখণ্ডের গল্পগুলির মধ্যে ‘ঘাটের কথা’ ও ‘রাজপথের কথা’ গল্পদুটিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ অল্পস্বল্প আছে। সেগুলি এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।
নদীর ঘাটের বাঁধানো সিঁড়ি অনেক পুরানো হয়ে গেছে। সে বলছে—”যদিও বয়স অনেক হইয়াছিল তবু তখনো আমি সিধা ছিলাম। আজ যেমন মেরুদণ্ড ভাঙিয়া অষ্টাবক্রের মতো বাঁকিয়া চুরিয়া গিয়াছি,…. তখন আমার সে দশা ছিল না।”—অষ্টাবক্রের কথা আগে আলোচিত হয়েছে।
ঘাটের কাছে শিবমন্দিরে একবার এক সন্ন্যাসী এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ”কোনোদিন ভাগবত পাঠ করিতেন, কোনদিন ভগবদগীতার ব্যাখ্যা করিতেন।”
‘রাজপথের কথা’ গল্পে রামায়ণের অহল্যার কথা আছে। ”আমি রাজপথ। অহল্যা যেমন মুনির শাপে পাষাণ হইয়া পড়িয়াছিল, আমিও যেন তেমনি কাহার শাপে চিরনিদ্রিত সুদীর্ঘ অজগর সর্পের ন্যায়….বহুদিন ধরিয়া জড় শয়নে শয়ান রহিয়াছি।”—অহল্যা প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচিত।
‘ধর্ম’ অংশের প্রবন্ধগুলিতে অল্প-স্বল্প রামায়ণ, মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে। ‘ধর্মের সরল আদর্শ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে ভারতবর্ষের সফলতার পথ একান্ত সরল একনিষ্ঠতার পথ। ইহাই যদি সম্ভবপর হয়, তবে ভারতবর্ষে ঋষিদের জন্ম, উপনিষদের শিক্ষা, গীতার উপদেশ…সমস্তই সার্থক হইবে—(সুলভ ৭ম পৃ-৪৬৭)।
‘দুঃখ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন—”রামায়ণে কবি রামকে সীতাকে লহ্মণকে ভরতকে দুঃখের দ্বারাই মহিমান্বিত করিয়া তুলিয়াছেন। রামায়ণের কাব্যরসে মানুষ যে আনন্দের মঙ্গলময় মূর্তি দেখিয়াছে দুঃখই তাহাকে ধারণ করিয়া আছে, মহাভারতেও সেইরূপ। মানুষের ইতিহাসে যত বীরত্ব যত মহত্ব সমস্তই দুঃখের আসনে প্রতিষ্ঠিত। মাতৃস্নেহের মূল্য দুঃখে, পাতিব্রতের মূল্য দুঃখে,বীর্যের মূল্য দুঃখে, পুণ্যের মূল্য দুঃখে।” (সুলভ-৭ম, পৃঃ ৪৯৪)
ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শ্রীশ্রীগীতার একদশ অধ্যায় বিশ্বরূপদর্শনযোগঃ থেকে অর্জুনের বলা ৩০ সংখ্যক শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন। রবীন্দ্র রচনার প্রাসঙ্গিক অংশসমূহ এবং শ্লোকটি নীচে দেওয়া হলো—
”কিন্তু হে ভীষণ, তোমার দয়াকে তোমার আনন্দকে কোথায় সীমাবদ্ধ করিব? কেবল সুখে, কেবল সম্পদে, কেবল জীবনে, কেবল নিরাপদ নিরাতঙ্কতায়? দুঃখ বিপদ মৃত্যু ও ভয়কে তোমা হইতে পৃথক করিযা তোমার বিরুদ্ধে দাঁড় করাইয়া জানিতে হইবে? তাহা নহে। হে পিতা। তুমিই দুঃখ, তুমিই বিপদ, হে মাতা, তুমিই মৃত্যু, তুমিই ভয়। তুমিই ভয়ানং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং।
তুমিই—
লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তাৎ লোকান সমগ্রান বদনৈর্জ্বলদ্ভিঃ
তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্রং ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণোঃ।
সমগ্র লোককে তোমার জ্বলৎবদনের দ্বারা গ্রাস করিতে করিতে লেহন করিতেছ, সমস্ত জগৎকে তেজের দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া, হে বিষ্ণু, তোমার উগ্রজ্যোতি প্রতপ্ত হইতেছে।” (সুলভ-৭ম, পৃঃ ৪৯৫)
‘ততঃ কিম্’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”আমাদের দেশে একদিন মানুষকে সমস্ত প্রয়োজনের চেয়ে কিরূপ বড়ো করিয়া দেখা হইয়াছিল, তাহা সাধারণে প্রচলিত একটি চাণক্যশ্লোকেই দেখা যায়—
ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ।।
মানুষের আত্মা কুলের চেয়ে, গ্রামের চেয়ে, দেশের চেয়ে, সমস্ত পৃথিবীর চেয়ে বড়ো। অন্তত কাহারও চেয়ে ছোটো নয়। প্রথমে মানুষের আত্মাকে এইরূপে সমস্ত দেশিক ও ক্ষণিক প্রয়োজন হইতে পৃথক করিয়া তাহাকে বিশুদ্ধ ও বৃহৎ করিয়া দেখিতে হইবে, তবেই সংসারের সমস্ত প্রয়োজনের সঙ্গে তাহার সত্যসম্বন্ধ, জীবনের ক্ষেত্রের মধ্যে তাহার যথার্থ স্থান নির্ণয় করা সম্ভবপর হয়।’
উপরে উদ্ধৃত শ্লোকটি চাণক্যশ্লোক ছাড়া অন্যত্রও আছে। প্রায় একই রকমের একটি শ্লোক মহাভারতের উদ্যোগপর্বেও আছে। সেটি হলো—
”ত্যজেৎ কুলার্থে পুরুষং গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ।।
তবে প্রেক্ষিত আলাদা। রবীন্দ্রনাথ এই শ্লোকের ব্যখ্যায় আত্মার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন। আর মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করার জন্য। ”হে মহাত্মগণ! ধর্ম্ম যেমন দুর্দান্ত দানবগণকে বদ্ধ করয়া বরুণের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন; তদ্রূপ আপনারা দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন ও সুবলনন্দন শকুনিকে বদ্ধ করিয়া পাণ্ডবগণের নিকট প্রদান করুন। কুলরক্ষার নিমিত্ত একজনকে পরিত্যাগ করিবে; গ্রামরক্ষার নিমিত্ত কুল পরিত্যাগ করিবে; জনপদরক্ষার নিমিত্ত গ্রাম পরিত্যাগ করিবে এবং আত্মরক্ষার নিমিত্ত পৃথিবী পর্যন্ত পরিত্যাগ করিবে; অতএব হে রাজন! আপনি দুর্যোধনকে বন্ধন করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন করুন; আপনার দোষে যেন সমুদয় ক্ষত্রিয় বিনষ্ট না হয়।’
(মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ কৃত অনুবাদ; প্রথম খণ্ড; পৃ-৯৪০)
‘ততঃকিম্’ প্রবন্ধের অন্যত্র (সুলভ ৭ম; পৃঃ ৫১২) রবীন্দ্রনাথ আলোচনা প্রসঙ্গে মহাভারত আদিপর্বের একটা শ্লোকের আংশিক উদ্ধৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন—”আমাদের যাহা প্রয়োজন, তাহার সংগ্রহই যথেষ্ট দুরূহ, তাহার উপরে ভূরি পরিমাণ অনাবশ্যকের বোঝা চাপিয়া সেই আবশ্যকের আয়োজনও কষ্টকর হইয়া উঠিয়াছে। শুধু তাহাই নয় — ইচ্ছা যখন একবার স্বভাবের সীমা লঙ্ঘন করে, তখন কোথাও তাহার আর থামিবার কারণ থাকে না, তখন সে ”হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে”— কেবল সে চাই চাই করিয়া বাড়িয়াই চলে। পৃথিবীতে নিজের এবং পরের পনেরো আনা দুঃখের কারণ ইহাই।” মহাভারতের সম্পূর্ণ শ্লোকটি এইরকম—
”ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।”
যযাতি পুরুকে তার যৌবন ফিরিয়ে দেবার সময় বলেছেন যে তিনি পুরুর যৌবন নিয়ে একহাজার বৎসর জীবন উপভোগ করেছেন কিন্তু পছন্দের বস্তু পেলেও কামের তৃপ্তি হয় না। ঘি দিলে আগুন যেমন বেড়ে যায়, কাম্য বস্তুর উপভোগে কাম তেমনি বেড়ে যায়। (মহাভারতম ২য় খণ্ড; পৃঃ-৮৯৭)
ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”আমরা কোনোদিন এমনতরো হাটের মানুষ ছিলাম না। আজ আমরা হাটের মধ্যে বাহির হইয়া ঠেলাঠেলি ও চীৎকার করিতেছি—ইতর হইয়া উঠিয়াছি, কলহে মাতিয়াছি, ….অথচ ইহা একটা নকল।…. এই নকলের যুগ আসিবার পূর্বে আমাদের মধ্যে এমন একটা স্বাভাবিক মর্যাদা ছিল যে, দারিদ্রেও আমাদিগকে মানাইত, মোটা ভাত মোটা কাপড়ে আমাদের গৌরব নষ্ট করিতে পারিত না। কর্ণ যেমন তাঁহার কবচকুণ্ডল লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তখনকার দিনে আমরা সেইরূপ একটা স্বাভাবিক আভিজাত্যের কবচ লইয়াই জন্মিতাম। সেই কবচেই আমাদিগকে বহুদিনের অধীনতা ও দুঃখদারিদ্র্যের মধ্যেও বাঁচাইয়া রাখিয়াছে আমাদের সম্মান নষ্ট করিতে পারে নাই।” (সুলভ-৭ম, পৃঃ ৫১৫)।
১৩১৫ অগ্রহায়ণ থেকে ১৩২১ পৌষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতন মন্দিরে এবং অন্যত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত উপদেশ দিয়েছিলেন সেগুলিই শান্তিনিকেতন প্রবন্ধগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এইরকম কিছু প্রবন্ধ সুলভ সংস্করণের ৭ম খণ্ডে আছে, আর কিছু প্রবন্ধ অন্য খণ্ডে আছে। এই প্রবন্ধগুলিতে উপনিষদের কথাই খুব বেশিভাবে আছে। রামায়ণ মহাভারতের কথাও কিছু কিছু আছে।
এই গ্রন্থের ‘ত্যাগ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ গীতার কথা বলেছেন। ”ঘোড়া গাড়ীর সঙ্গে লাগামে বদ্ধ হয়ে গাড়ী চালায়—কিন্তু ঘোড়া কি বলতে পারে গাড়ীটা আমার? বস্তুত গাড়ীর চাকার সঙ্গে তার বেশী তফাৎ কি? যে সারথী মুক্ত থেকে গাড়ী চালায় গাড়ীর উপর কর্তৃত্ব তারই।
যদি কর্তা হতে চাই তবে মুক্ত হতে হবে। এই জন্য গীতা সেই যোগকেই কর্মযোগ বলেছেন যে যোগে আমরা অনাসক্ত হয়ে কর্ম করি। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করলেই কর্মের উপর আমার পূর্ণ অধিকার জন্মে—নইলে কর্মের সঙ্গে জড়ীভূত হয়ে আমরা কর্মেরই অঙ্গীভূত হয়ে পড়ি, আমরা কর্মী হইনে।”
‘সামঞ্জস্য’ প্রবন্ধে কবি লিখছেন—”একমাত্র প্রেমের মধ্যেই সমস্ত দ্বন্দ্ব একসঙ্গে মিলে থাকতে পারে।….তর্কক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে যারা দিতিপুত্র ও অদিতিপুত্রের মতো পরস্পরকে একেবারে বিনাশ করবার জন্যেই সর্বদা উদ্যত, প্রেমের মধ্যে তারা আপন ভাই।”—দিতি এবং অদিতি ঋষি কশ্যপের দুই স্ত্রী। দিতির পুত্ররা দৈত্য বা অসুর এবং অদিতি দেবমাতা। সুতরাং দেবতারা ও দৈত্যেরা বৈমাত্রেয় ভাই। কিন্তু তাদের মধ্যে বিরোধ অনাদিকাল ধরে চলে আসছে।
‘প্রেমের অধিকার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”দুবেলা যার অন্ন জোটে না সেও কুবেরের ভান্ডারের স্বপ্ন দেখে।”—রামায়ণের অনেক জায়গাতেই কুবেরের কথা আছে, মহাভারতেও তাঁর উল্লেখ আছে। বিশ্বশ্রবা ঋষির পুত্র তিনি। রামায়ণে আছে—
”কুবের ব্রহ্মার বরে হইল অমর।
অমর হইল আর হৈল ধনেশ্বর।।”
‘প্রকৃতি’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন—”ঈশ্বরকে বাহিরে অর্থাৎ তাঁর শক্তির ক্ষেত্রে কোনো জায়গায় আমরা লাভ করতে পারিনে। সেখানে যে বালুকণাটির অন্তরালে তিনি রয়েছেন সেই বালুকণাটিকে নিঃশেষে অতিক্রম করে এমন সাধ্য কোনো বৈজ্ঞানিকের, কোনো যান্ত্রিকের নেই। অতএব শক্তির ক্ষেত্রে যে লোক ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে যায় সে অর্জুনের মতো ছদ্মবেশী মহাদেবকে বাণ মারে— সে বাণ তাকে স্পর্শ করে না—সেখানে না হেরে উপায় নেই।
মহাদেব-অর্জুনের যুদ্ধের কথা অন্যত্র বলা হয়েছে।
‘সমগ্র’ প্রবন্ধে (সুলভ-৭ম; পৃ-৫৮০) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”মূলে যাদের ঐক্য আছে, সেই ঐক্যমূল থেকে বিছিন্ন করে দিলে তারা যে কেবল পৃথক হয় তা নয়, তারা পরস্পরের বিরোধী হয়। ঐক্যের সহজ টানে যারা আত্মীয়রূপে থাকে, বিচ্ছিন্নতার ভিতর দিয়ে তারা প্রলয়সংঘাতে আকৃষ্ট হয়।
অর্জুন এবং কর্ণ সহোদর ভাই। মাঝখানে কুন্তীর বন্ধন তারা যদি না হারিয়ে ফেলত তা হলে পরস্পরের যোগে তারা প্রবল বলী হত; সেই মূল বন্ধনটি বিস্মৃত হওয়াতেই তারা কেবলই বলেছে, ‘হয় আমি মরব নয় তুমি মরবে।”—অর্জুন এবং কর্ণের বিষয়ে বিশদে পূর্বেই বলা হয়েছে ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ কবিতা আলোচনার সময়ে।
‘কর্ম’ প্রবন্ধে কবি গীতার কর্মযোগ নিয়ে একটুখানি বলেছেন—’আনন্দের ধর্ম যদি কর্ম হয় তবে কর্মের দ্বারাই সেই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের সঙ্গে আমাদের যোগ হতে পারে। গীতায় একেই বলে কর্মযোগ।”
‘নবযুগের উৎসব’ প্রবন্ধে (৫৯৬-৬০১) রবীন্দ্রনাথ বিশ্বব্যাপী একের মন্ত্র ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ নিয়ে বারে বারে আলোচনা করেছেন। ”পৃথিবীতে কালে কালে যে সকল মহাপুরুষ ভিন্ন ভিন্ন দেশে আগমন করেছেন সেই যাজ্ঞবল্ক্য বিশ্বামিত্র বুদ্ধ খ্রীষ্ট মহম্মদ সকলকেই তাঁরা ব্রহ্মের বলে চিনেছেন; তাঁরা মৃত বাক্য মৃত আচারের গোরস্থানে প্রাচীর তুলে বাস করেন না, তাঁদের বাক্য প্রতিধ্বনি নয়, কার্য্য অনুকরণ নয়, গতি অনুবৃত্তি নয়; তাঁরা মানবাত্মার মাহাত্ম্য-সংগীতকে এখনই বিশ্বলোকের রাজপথে ধ্বনিত করে তুলছেন। সেই মহাসংগীতের মূল ধুয়াটি আমাদের গুরু ধরিয়ে দিয়ে গেছেন— একমেবাদ্বিতীয়ম। সকল বিচিত্র তানকেই এই ধুয়াতেই বারংবার ফিরিয়ে আনতে হবে একমেবাদ্বিতীয়ম।”
যাজ্ঞবল্ক্য, বিশ্বামিত্র—এঁরা পৌরাণিক ঋষি, রামায়ণ মহাভারতে এঁদের কথা আছে। ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ শব্দটি একটি শ্লোকের অংশ। শ্লোকটি আছে ছান্দোগ্য উপনিষদে। মহাভারতের উদ্যোগপর্বের একটি শ্লোক আছে যার মধ্যে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ শব্দটি আছে। দুটি শ্লোক অবশ্য আলাদা। মহাভারতের সম্পূর্ণ শ্লোকটি হলো—
”একমেবাদ্বিতীয়ম যত্তদ্রাজন! নাববুধ্যসে।
সত্যং স্বর্গস্য সোপানং পারাবারস্য নৌরিব।”
মহাভারতের এই শ্লোকটি বিদুর বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। দুর্যোধনের কোনো ইচ্ছা নেই পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেবার। নীতিনিষ্ঠ বিদুর বিভিন্নভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছেন। এখানে বিদুর বলছেন—রাজা যার কোনো দ্বিতীয় নেই এবং যা একমাত্র, আপনি সেই সত্যকে বুঝতে পারছেন না। সমুদ্রে নৌকার মতো সত্য হচ্ছে স্বর্গের সিঁড়ি। (মহাভারতম ত্রয়োদশ খণ্ড; পৃঃ-২৫৫)।
‘বিশ্বাস’ প্রবন্ধে একাগ্রতার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ—কথাপ্রসঙ্গে মহাভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। ”আত্মাকে পরমাত্মার মধ্যে লাভ করাই যে জীবনের চরম লক্ষ্য, এই লক্ষ্যটিকে একান্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে একাগ্রচিত্তে স্থির করে নিতে হবে। দেখো, দেখো, নিরীক্ষণ করে দেখো। সমস্ত চেষ্টাকে স্তব্ধ করে সমস্ত মনকে নিবিষ্ট করে নিরীক্ষণ করে দেখো। একটি চাকা কেবলই ঘুরছে, তারই মাঝখানে একটি বিন্দু স্থির হয়ে আছে। সেই বিন্দুটিকে অর্জুন বিদ্ধ করে দ্রৌপদীকে পেয়েছিলেন। তিনি চাকার দিকে মন দেননি, বিন্দুর দিকে সমস্ত মন সংহত করেছিলেন। সংসারের চাকা কেবলই ঘুরছে, লক্ষ্যটি তার মাঝখানে ধ্রুব হয়ে আছে। সেই ধ্রুবের দিকেই মন দিয়ে লক্ষ্য স্থির করতে হবে, চলার দিকে নয়।” এখানে দ্রৌপদীর স্বয়ম্ভরসভায় অর্জুনের লক্ষ্যভেদের কথা বলা হয়েছে।
একটা ছোট্ট লেখা রয়েছে—’তরীবোঝাই’ (সুলভ—-৭ম; পৃ-৬৩৬)। সেখানে গীতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই বিষয়টি ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ পর্যালোচনা করার সময়ে বিশদে বলা হয়েছে।
‘স্বভাবকে লাভ’ এই প্রবন্ধে (সুলভ-৭ম, পৃ.-৬৩৭) রবীন্দ্রনাথ আত্মা, পরমাত্মা প্রভৃতি কথা আলোচনা করেছেন। ”ঐ যে একটা ক্ষুধিত অহং আছে, যে কাঙাল সব জিনিষই মুঠো করে ধরতে চায়, সে কৃপণ নেবার মতলব ছাড়া কিছু দেয় না, ফলের মতলব ছাড়া কিছু করে না, সেই অহংটাকে বাইরে রাখতে হবে—তাকে পরমাত্মীয়ের মতো সমাদর করে অন্তঃপুরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সে বস্তুত আত্মার আত্মীয় নয়, কেননা সে যে ঘরে আর আত্মা যে অমর।
আত্মা যে, ন জায়তে ম্রিয়তে, না জন্মায় না মরে। কিন্তু এই অহংটা জন্মেছে।…কিছু না পারে তো, অন্তত তার এই নামটাকে স্থায়ী করবার জন্য তার প্রাণপণ যত্ন। এই যে আমার অহং, একে একটা বাইরের লোকের মতো আমি দেখব…তার …কিছুতেই আমি অংশ নেব না।”
এখানে রবীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছেন যে আত্মা অমর বা অবিনশ্বর। এটা শ্রীশ্রীগীতার কথা। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মার ব্যাপারে শ্রীভগবান অনেক কথা বলেছেন। ‘ন জায়তে ম্রিয়তে’ গীতার একটা শ্লোকের অংশ। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হলো—
”ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বাহভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।”
অর্থাৎ, এই আত্মা কখনও জন্মায় না বা মরে না। বার বার জন্মিয়া সে বৃদ্ধি পায় না। ইহার ক্ষয়ক্ষতি কিছুই নাই। ইহা অজ, নিত্য, শাশ্বত ও চির পুরাতন। দেহ হত হইলে আত্মা হত হয় না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন অহং থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। দান করব, কর্ম করব, কিন্তু অহং যখন সেই কর্মের ফল হাতে করে তাকে লেহন করে দংশন করে নাচতে নাচতে উপস্থিত হবে তখন তার সেই উচ্ছিষ্ট ফলকে কোনোমতেই গ্রহণ করবো না। কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”—এটাও গীতারই কথা। মা ফলেষু কদাচন—এটা নিয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
‘শক্ত ও সহজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটা শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন—
‘জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ
জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ।
ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদিস্থিতেন
যথা নিযুক্তোহস্যি তথা করোমি।”
চিত্রা কাব্যগ্রন্থের আলোচনাকালে উল্লেখ করেছি যে গ্রন্থের সূচনাতে কবি একটা শ্লোক আংশিক উদ্ধৃত করেছিলেন—’ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।’ এখানে কবি সম্পূর্ণ শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন। এই কথাগুলি মহাভারতের চরিত্র দুর্যোধনের নামেই প্রচলিত তবে মহাভারতে এই শ্লোকটি আমার চোখে পড়েনি। কবিও শ্লোকটির উৎস উল্লেখ করেননি। আমি শ্লোকটি পেয়েছি সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধানে।” সেখানে শ্লোকটির অর্থ দেওয়া হয়েছে এইরকম—”ধর্ম কি আমি জানি, কিন্তু তাহাতে আমার প্রবৃত্তি হয়না; অধর্ম কাহাকে বলে তাহাও জানি, কিন্তু তাহা হইতে আমি নিবৃত্ত হইতে পারি না। হে হৃষিকেশ; তুমি আমার হৃদয়ে অবস্থিত হইয়া আমাকে যেরূপ কার্যে নিযুক্ত করিতেছ, আমি অবশভাবে, তাহাই সম্পাদন করিতেছি।” অভিধানেও শ্লোকটির উৎস নির্দেশ করা নেই। রবীন্দ্রনাথ এই শ্লোকটির একটু অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন— ”এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে, আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ আমি তেমনি চলেছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি আমি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না; তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সেই দিকে চলব। স্বার্থ আমাকে যেদিকে চালাতে চায় সে দিকে চলব না, অহংকার আমাকে যে পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চায় আমি সেপথ থেকে নিবৃত্ত হব না।”
”বিশ্বপিতার সঙ্গে পুত্ররূপে আমার মিলন হবে, রাজচক্রবর্তী হওয়ার চেয়েও এটা বড় ইচ্ছা। কিন্তু এত বড় ইচ্ছাকেও অহরহ সত্য করে জাগিয়ে রাখা কঠিন…। আমার চারিদিকের লোক এই ইচ্ছাটা আমার মধ্যে করছে না। এর চেয়ে ঢের যৎসামান্য, এমন-কি ঢের অর্থহীন ইচ্ছাকেও তারা আমার মনে সত্য করে তুলেছে এবং তাকে কোনোমতে নিবে যেতে দিচ্ছে না।” বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘দেশের ইচ্ছা’ প্রবন্ধে (সুলভ-৭ম, পৃ. ৬৭৩)। এই রকম বিরুদ্ধ পরিবেশে নিজের মনের ইচ্ছাটিকে জাগিয়ে রাখা খুব কঠিন। ”কিন্তু আশার কথা এই যে, নারায়ণকে যদি সারথি করি তবে অক্ষৌহিনী সেনাকে ভয় করতে হবে না। লড়াই একদিনে শেষ হবে না, কিন্তু শেষ হবেই, জিত হবে তার সন্দেহ নেই।”
মহাভারতের যুগে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। কৌরব এবং পাণ্ডব—উভয়পক্ষই তাঁর আত্মীয়; কিন্তু সচ্চরিত্রতার জন্য পাণ্ডবেরা তাঁর সমধিক প্রিয়। যুদ্ধের প্রারম্ভে দুর্যোধন এবং অর্জুন দুজনেই তাঁর কাছে গেছেন মহাযুদ্ধে তাঁকে নিজের পক্ষে বরণ করার জন্য। তিনি কাউকেই বিমুখ করবেন না। তিনি দুর্যোধন ও অর্জুনকে অপশন দিলেন বেছে নেওয়ার জন্য। প্রথম অপশন শ্রীকৃষ্ণ একা এবং তিনি অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধ করবেন না। তিনি নিরস্ত্র সারথীর কাজ করতে পারেন বা পরামর্শদাতা হিসাবে থাকবেন। দ্বিতীয় অপশন—তাঁর মহাবলশালী অজস্র নারায়ণী সেনা। দুর্যোধন ভাবলেন—কৃষ্ণ তো একা এবং তিনি যুদ্ধও করবেন না, তাহলে তাঁকে নিয়ে কী লাভ। তিনি নারায়ণী সেনা নিলেন এবং হারলেন। নারায়ণকে তিনি চিনতে পারেননি। অর্জুন কিন্তু কৃষ্ণকেই নিলেন আর জিতলেন। তিনি নারায়ণকে সারথী হিসাবে নিয়েছিলেন, তাই অক্ষৌহিনী সেনার ভয় আর রইল না।
ভারতীয় সভ্যতা তপোবনে জাত, তপোবনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত—এটি রবীন্দ্রনাথের একটি প্রিয় ভাবনা। তপোবন প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন—”ভারতবর্ষে বিক্রমাদিত্য যখন রাজা…কালিদাস যখন কবি, তখন এদেশে তপোবনের যুগ চলে গেছে।… তখন জনকের মতো রাজা একদিকে স্বহস্তে লাঙল নিয়ে চাষ করছেন, অন্যদিকে দেশ-দেশান্তর হতে আগত জ্ঞানপিপাসুদের ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছেন, এ দৃশ্য দেখবার আর কাল ছিল না।”—রাজর্ষি জনক রামায়ণের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চরিত্র। তাঁর আড়ম্বরহীন জীবনযাত্রা ভারতীয় জনজীবনের কাছে একটা আদর্শ হিসাবে পরিগণিত হতো। এইরকম জমি চাষ করার সময়েই তিনি পেয়েছিলেন অযোনিসম্ভবা কন্যা সীতাকে।
রবীন্দ্রনাথ কালিদাসে মুগ্ধ। এই তপোবন প্রবন্ধে কালিদাস এবং তাঁর কাব্য নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝে মাঝে অন্য প্রসঙ্গও অবশ্য এসেছে। দুষ্মন্ত শকুন্তলা এবং তাদের পুত্র ভরতের কাহিনী মূলে মহাভারতেরই কাহিনী এবং এই কাহিনী নিয়ে কালিদাস লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’। ভরতের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”যে ভরত বীর্যবলে চক্রবর্তী সম্রাট হয়ে ভারতবর্ষকে নিজনামে ধন্য করেছেন তাঁর জন্মঘটনায় অবারিত প্রবৃত্তির যে কলঙ্ক পড়েছিল কবি তাকে তপস্যার অগ্নিতে দগ্ধ এবং দুঃখের অশ্রুজলে সম্পূর্ণ ধৌত না করে ছাড়েননি।” তপোবনে দুষ্মন্ত শকুন্তলার যে গান্ধর্ব বিবাহ সেটি একান্তভাবেই কামজ বিবাহ।
এই প্রবন্ধেরই অন্য একটি জায়গায় (সুলভ-৭ম, পৃ৬৯৭) যুধিষ্ঠিরের কথা আছে। ”স্বর্গে যাবার সময় যুধিষ্ঠির তাঁর কুকুরকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের কাব্যে মানুষ যখন স্বর্গে পৌঁছয় প্রকৃতিকে সঙ্গে নেয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজে বড় হয়ে ওঠে না।” পাণ্ডবেরা রাজ্য ভোগ সুখ সব পরিত্যাগ করে মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেছিলেন। পথে পতন হয়েছিল যুধিষ্ঠির বাদে বাকী চার ভাই এবং দ্রৌপদীর। পথের সাথী একটি কুকুর যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে স্বর্গের দ্বার পর্যন্ত গিয়েছিল। মহাভারত অবশ্য পরে জানিয়েছেন যে এই কুকুর ছিলেন ছদ্মবেশী ধর্ম-যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করার জন্য সঙ্গে ছিলেন।
দুঃখকে ভয় পাওয়া নয়, দুঃখের মধ্যেই আনন্দকে খুঁজে নেওয়াই প্রাচীন ভারতবর্ষের সাধনা। রামায়ণের থেকে উদাহরণ নিয়ে কবি এই কথাটা আরো পরিষ্কার করলেন ওই তপোবন প্রবন্ধে (পৃ. ৬৯৭)
”রামায়ণে রামের বনবাস হল। কেবল রাক্ষসের উপদ্রব ছাড়া সে বনবাসে তাঁদের আর কোনো দুঃখই ছিল না। তাঁরা বনের পর বন, নদীর পর নদী, পর্বতের পর পর্বত পার হয়ে গেছেন, তাঁরা পর্ণকুটিরে বাস করেছেন, মাটিতে শুয়ে রাত্রি কাটিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা ক্লেশবোধ করেন নি। এই সমস্ত নদীগিরি অরণ্যের সঙ্গে তাঁদের হৃদয়ের মিলন ছিল। এখানে তাঁরা প্রবাসী নন।
অন্য দেশের কবি রাম লক্ষ্মণ সীতার মাহাত্ম্যকে উজ্জ্বল করে দেখাবার জন্যেই বনবাসের দুঃখকে খুব কঠোর করেই চিত্রিত করতেন। কিন্তু বাল্মীকি একেবারেই তা করেননি—তিনি বনের আনন্দকেই বারংবার পুনরুক্তি দ্বারা কীর্তন করে চলেছেন।
রাজৈশ্বর্য যাঁদের অন্তঃকরণকে অভিভূত করে আছে, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মিলন কখনোই তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক হতে পারে না। সমাজগত সংস্কার ও চিরজন্মের কৃত্রিম অভ্যাস পদে পদেই তাঁদের বাধা না দিয়ে থাকতে পারে না। সেই-সকল বাধার ভিতর থেকে প্রকৃতিকে তাঁরা কেবল প্রতিকূলই দেখতে থাকেন।
আমাদের রাজপুত্র ঐশ্বর্যে পালিত, কিন্তু ঐশ্বর্যের আসক্তি তাঁর অন্তকরণকে অভিভূত করে নি। ধর্মের অনুরোধে বনবাস স্বীকার করাই তার প্রথম প্রমাণ। তাঁর চিত্ত স্বাধীন ছিল, শান্ত ছিল, এইজন্যেই তিনি অরণ্যে প্রবাসদুঃখ ভোগ করেন নি; এই জন্যেই তরুলতা পশুপক্ষী তাঁর হৃদয়কে কেবলই আনন্দ দিয়েছে। এই আনন্দ প্রভুত্বের আনন্দ নয়, ভোগের আনন্দ নয়, সম্মিলনের আনন্দ। এই আনন্দের ভিত্তিতে তপস্যা, আত্মসংযম। এর মধ্যেই উপনিষদের সেই বাণী : তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথাঃ।
কৌশল্যার রাজগৃহবধূ সীতা বনে চলেছেন—
একৈকং পাদপং গুল্মং
লতাং বা পুষ্পশালিনীম্
অদৃষ্টরূপাং পশ্যন্তী
রামং পপ্রচ্ছ সাবলা।
রমণীয়ান বহুবিধান্
পাদপান কুসুমোৎকরান
সীতাবচনসংরব্ধ
আনয়ামাস লক্ষ্মণঃ।
বিচিত্রবালুকাজলাং
হংসসারসনাদিতাম্
রেমে জনকরাজস্য
সুতা প্রেক্ষ্য তদা নদীম্।
যে-সকল তরুগুল্ম কিংবা পুষ্পশালিনী লতা সীতা পূর্বে কখনো দেখেননি তাদের কথা তিনি রামকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। লক্ষ্মণ তাঁর অনুরোধে তাঁকে পুষ্পমঞ্জরীতে ভরা বহুবিধ গাছ তুলে এনে দিতে লাগলেন। সেখানে বিচিত্রবালুকাজলা হংসসারসমুখরিতা নদী দেখে জানকী মনে আনন্দ বোধ করলেন।
প্রথমে বনে গিয়ে রাম চিত্রকূট পর্বতে যখন আশ্রয় গ্রহণ করলেন, তিনি
সুরম্যমাসাদ্য তু চিত্রকূটং
নদীঞ্চ তাং মাল্যবতীং সুতীর্থাং
ননন্দ হৃষ্টো মৃগপক্ষিজুষ্টাং
জহৌ চ দুঃখং পুরবিপ্রবাসাৎ।
সেই সুরম্য চিত্রকট, সেই সুতীর্থা মাল্যবতী নদী, সেই মৃগপক্ষিসেবিতা বনভূমিকে প্রাপ্ত হয়ে পুরবিপ্রবাসের দুঃখকে ত্যাগ করে হৃষ্টমনে রাম আনন্দ করতে লাগলেন।
দীর্ঘকালোষিতস্তস্মিন গিরৌ গিরিবনপ্রিয়ঃ—গিরিবনপ্রিয় রাম দীর্ঘকাল সেই গিরিতে বাস করে একদিন সীতাকে চিত্রকূটশিখর দেখিয়ে বলছেন—
ন রাজ্যভ্রংশনং ভদ্রে ন সুহৃদ্ভির্বিনাভবঃ
মনো মে বাধতে দৃষ্টা রমণীয়মিমং গিরিম্।
রমণীয় এই গিরিকে দেখে রাজ্য ভ্রংশনও আমাকে দুঃখ দিচ্ছে না, সুহৃদগণের কাছ থেকে দূরে বাসও আমার পীড়ার কারণ হচ্ছে না।
সেখান থেকে রাম যখন দণ্ডকারণ্যে গেলেন যেখানে গগনে সূর্যমণ্ডলের মতো দুর্দর্শ প্রদীপ্ত তাপসাশ্রমমণ্ডল দেখতে পেলেন। এই আশ্রম শরণ্যং সর্বভূতানাম। ইহা ব্রাহ্মীলক্ষ্মী—দ্বারা সমাবৃত। কুটিরগুলি সুমার্জিত, চারি দিকে কত মৃগ কত পক্ষী।
রামের বনবাস এমনি করেই কেটেছিল— কোথাও বা রমণীয় বনে, কোথাও বা পবিত্র তপোবনে।
রামের প্রতি সীতার ও সীতার প্রতি রামের প্রেম তাঁদের পরস্পর থেকে প্রতিফলিত হয়ে চারিদিকে মৃগপক্ষীকে আচ্ছন্ন করেছিল। তাঁদের প্রেমের যোগে তাঁরা কেবল নিজেদের সঙ্গে নয়, বিশ্বলোকের সঙ্গে যোগযুক্ত হয়েছিলেন। এইজন্য সীতাহরণের পর রাম সমস্ত অরণ্যকেই আপনার বিচ্ছেদবেদনার সহচর পেয়েছিলেন। সীতার অভাব কেবল রামের পক্ষে নয়—সমস্ত অরণ্যই যে সীতাকে হারিয়েছে। কারণ রামসীতার বনবাসকালে অরণ্য একটি নূতন সম্পদ পেয়েছিল—সেটি হচ্ছে মানুষের প্রেম। সেই প্রেমে তার পল্লবঘনশ্যামলতাকে, তার ছায়াগম্ভীর গহনতার রহস্যকে একটি চেতনার সঞ্চারে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল।
শেকসপীয়রের ‘As You Like It’ নাটক একটি বনবাসকাহিনী— টেম্পেস্টও তাই, Midsummer Night’s Dream ও অরণ্যের কাব্য। কিন্তু সে সকল কাব্যে মানুষের প্রভুত্ব ও প্রবৃত্তির লীলাই একেবারে একান্ত— অরণ্যের সঙ্গে সৌহার্দ্য দেখতে পাই নে। অরণ্যবাসের সঙ্গে মানুষের চিত্তে সামঞ্জস্যসাধন ঘটেনি। হয় তাকে জয় করবার, নয় তাকে ত্যাগ করবার চেষ্টা সর্বদাই রয়েছে; হয় বিরোধ, নয় বিরাগ, নয় ঔদাসীন্য। মানুষের প্রকৃতি বিশ্বপ্রকৃতিকে ঠেলেঠুলে স্বতন্ত্র হয়ে উঠে আপনার গৌরব প্রকাশ করেছে।
মিলটনের প্যারাডাইস লস্ট কাব্যে আদি মানবদম্পতির স্বর্গারণ্যে বাস বিষয়টিই এমন যে অতি সহজেই সেই কাব্যে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলনটি সরল প্রেমের সম্বন্ধে বিরাট ও মধুর হয়ে প্রকাশ পাবার কথা। কবি প্রকৃতিসৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন, জীবজন্তুরা সেখানে হিংসা পরিত্যাগ করে একত্রে বাস করছে তাও বলেছেন, কিন্তু মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সাত্ত্বিক সম্বন্ধ নেই। তারা মানুষের ভোগের জন্যেই বিশেষ করে সৃষ্ট, মানুষ তাদের প্রভু। এমন আভাসটি কোথাও পাই নে যে এই আদি দম্পতি প্রেমের আনন্দ প্রাচুর্যে তরুলতা পশুপক্ষীর সেবা করছেন, ভাবনাকে কল্পনাকে নদী গিরি অরণ্যের সঙ্গে নানা লীলায় সম্মিলিত করে তুলেছেন। এই স্বর্গারণ্যের যে নিভৃত নিকুঞ্জটিতে মানবের প্রথম পিতামাতা বিশ্রাম করতেন সেখানে—
Beast, bird, insect or worm durst enter none;
Such was their awe of man… … …
অর্থাৎ পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ কেউ প্রবেশ করতে সাহস করত না, মানুষের প্রতি এমনই তাদের একটি সভয় সম্ভ্রম ছিল।”
এই প্রবন্ধটি (তপোবন) বেশ বড়। এর পরে কবি গীতার কথা বলেছেন, বিজ্ঞানের সাধনার কথা বলেছেন। ”মানুষের জ্ঞান বর্বরতা থেকে অনেক দূরে অগ্রসর হয়েছে তার একটি প্রধান লক্ষণ কী? না, মানুষ বিজ্ঞানের সাহায্যে জগতের সর্বত্রই নিয়মকে দেখতে পাচ্ছে। …. তার জ্ঞান অণু হতে অণুতম ও বৃহৎ হতে বৃহত্তম সকলের সঙ্গেই নিজের যোগস্থাপনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছে। এই হচ্ছে বিজ্ঞানের সাধনা।
ভারতবর্ষ যে সাধনাকে গ্রহণ করেছে সে হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে চিত্তের যোগ, আত্মার যোগ, অর্থাৎ সম্পূর্ণ যোগ। কেবল জ্ঞানের যোগ নয়, বোধের যোগ।
গীতা বলেছেন—
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসন্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতন্তু সঃ।
ইন্দ্রিয়গণকে শ্রেষ্ঠ পদার্থ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, আবার মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, আর বুদ্ধির চেয়ে যা শ্রেষ্ঠ তা হচ্ছেন তিনি। (এই শ্লোকটি শ্রীশ্রীগীতার তৃতীয় অধ্যায় কর্মযোগের ৪২ নং শ্লোক)
ইন্দ্রিয়সকল কেন শ্রেষ্ঠ, না, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগসাধন হয়। কিন্তু সে যোগ আংশিক। ইন্দ্রিয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, কারণ মনের দ্বারা যে জ্ঞানময় যোগ ঘটে তা ব্যাপকতর। কিন্তু জ্ঞানের যোগেও সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ দূর হয় না। মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, কারণ বোধের দ্বারা যে চৈতন্যময় যোগ তা একেবারে পরিপূর্ণ। সেই যোগের দ্বারাই আমরা সমস্ত জগতের মধ্যে তাঁকেই উপলব্ধি করি যিনি সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
এই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠকে সকলের মধ্যেই বোধের দ্বারা অনুভব করা ভারতবর্ষের সাধনা।”
কবি ভারতবর্ষে আর্যসভ্যতা বিস্তারে অগস্ত্যের অবদানের কথা বলেছেন। অগস্ত্য একজন প্রভাবশালী পৌরাণিক ঋষি। রামায়ণ এবং মহাভারত উভয় গ্রন্থেই তাঁর নাম আছে। ”বহু প্রাচীনকালে একদিন অরণ্যসংকুল ভারতবর্ষে আমাদের আর্য পিতামহেরা প্রবেশ করেছিলেন। আধুনিক ইতিহাসে য়ুরোপীয়দল ঠিক তেমনি করেই নূতন আবিষ্কৃত মহাদ্বীপের মহারণ্যে পথ উদঘাটন করেছেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগামী সাহসিকগণ অপরিচিত ভূখণ্ডসকলকে অনুবর্তীদের জন্যে অনুকূল করে নিয়েছেন। আমাদের দেশেও অগস্ত্য প্রভৃতি ঋষিরা অগ্রগামী ছিলেন।”
এই প্রবন্ধের শেষের দিকে আবার একটু গীতার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ— ”আজ আমাদের অবহিত হয়ে বিচার করতে হবে যে, যে সত্যে ভারতবর্ষ আপনাকে আপনি নিশ্চিতভাবে লাভ করতে পারে, সে সত্যটি কী। সে সত্য প্রধানত বনিগবৃত্তি নয়, স্বারাজ্য নয়, স্বাদেশিকতা নয়; সে সত্য বিশ্বজাগতিকতা। সেই সত্য ভারতবর্ষের তপোবনে সাধিত হয়েছে, উপনিষদে উচ্চারিত হয়েছে, গীতায় ব্যাখ্যাত হয়েছে।”
‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে গীতার ফলাকাঙ্খাহীন কর্মের কথা বলা হয়েছে। ”বুদ্ধদেবের যে শিক্ষা সেও বাসনাবর্জনের শিক্ষা; গীতাতেও বলছে— ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে নিরাসক্ত হয়ে কাজ করবে।” (পৃ. ৭২৩)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন