রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে সন্নিবেশিত গ্রন্থগুলি হলো—
কবিতা ও গান : বীথিকা, পত্রপুট ও শ্যামলী,
নাটক ও প্রহসন : শেষরক্ষা ও পরিত্রাণ
উপন্যাস ও গল্প : গল্পগুচ্ছ
প্রবন্ধ : জাপান-যাত্রী, যাত্রী, পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারী, জাভা-যাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি ও মানুষের ধর্ম, এবং গ্রন্থপরিচয় অংশ।
পত্রপুট কাব্যগ্রন্থে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ কিছুমাত্র নেই। বীথিকা ও শ্যামলী গ্রন্থদ্বয়ে এই প্রসঙ্গ অতি সামান্য আছে। সেগুলি যথাযথভাবে আলোচনা করা হবে। শেষ রক্ষা নাটকটি ‘গোড়ায় গলদ’ প্রহসনটির পূনর্লিখিত অভিনয়—যোগ্য সংস্করণ। পরিত্রাণ নাটকটির মূল পাওয়া যাবে ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের নাট্যরূপ কবি আগে দিয়েছিলেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নামে। এই প্রায়শ্চিত্ত নাটকের পরিমার্জিত রূপ হলো ‘পরিত্রাণ’। এই নাটকদুটিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ অল্পস্বল্প আছে। রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে গল্পগুচ্ছের তেরোটি গল্প রাখা হয়েছে। এর কয়েকটিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ কিছু কিছু আছে। প্রবন্ধগুলির মধ্যে যাত্রী এবং পশ্চিমযাত্রীর ডায়রী এক সঙ্গেই রয়েছে—লেখাগুলো আলাদা করে ভাগ করা নেই। প্রবন্ধগ্রন্থের সবগুলোতেই রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে। এর মধ্যে ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ এবং মানুষের ধর্ম এই গ্রন্থ দু’খানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাভাযাত্রীর পত্রে রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।
বীথিকা কাব্যগ্রন্থের ‘নাট্যশেষ (১)’ কবিতার এক জায়গায় লেখা হয়েছে—
”যুদ্ধে উদ্ধারিয়া সীতা
পরক্ষণে প্রিয়হস্ত রচিতে বসিল তার চিতা,
সে পালার অবসানে নিঃশেষে হয়েছে নিরর্থক
সে দুঃসহ দুঃখদাহ—শুধু তারে কবির নাটক
কাব্যডোরে বাঁধিয়াছে, শুধু তারে ঘোষিতেছে গান,
শিল্পের কলায় শুধু রচে তাহা আনন্দের গান।”
রামায়ণ যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন—রাবণ-বধের পর উদ্ধার করে যখন সীতাকে রামচন্দ্রের কাছে নিয়ে আসা হল, তখন রাম তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। যেহেতু সীতা বন্দিনী হয়ে দশমাস রাবণের লঙ্কাপুরে ছিলেন, তাই তাঁর চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন রাম। কৃত্তিবাসের রামায়ণে বলা হয়েছে যে রামের আদেশে লক্ষ্মণ অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন আর সীতা সেই অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন।
শ্যামলী কাব্যগ্রন্থে ‘তেঁতুলের ফুল’ নামে একটি কবিতা আছে, সেখানে কবি ‘অর্জুন বিজয়ী মহারথী’ এক চিত্ররথ গন্ধর্বের কথা বলেছেন। তেঁতুলগাছ খুব বড় হয়, কিন্তু সে তার ফুলের সৌন্দর্য্য দিয়ে মানুষের মনোহরণ করতে পারে—এটা কখনো শুনিনি। কিন্তু কবিরা তো সাধারণত সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল। এক প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির দিনে কবি দেখেছিলেন ‘আকাশের অত্যাচারে’ প্রতিবাদী তেঁতুলগাছটিকে, ‘বৃষ্টিপাণ্ডুর দিগন্তে তার বিক্ষুব্ধ মহিমা’ কবির সহানুভূতি আকর্ষণ করেছিল।
”ফুলের পরিচয়ে আজ ওকে দেখছি।
যেন গন্ধর্ব চিত্ররথ,
যে ছিল অর্জুনবিজয়ী মহারথী
গানের সাধন করছে সে আপন মনে একা
নন্দনবনের ছায়ার আড়ালে গুণ গুণ সুরে।”
মহাভারতে কোনো ‘অর্জুনবিজয়ী’ চিত্ররথ-এর কথা আমার মনে পড়ছে না। এক ‘চিত্রসেন’ গন্ধর্বের কথা মহাভারতে আছে। পাণ্ডবদের বনবাসকালে অর্জুন যখন দিব্যাস্ত্র শিক্ষার জন্য ইন্দ্রলোকে গিয়েছিলেন তখন গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়েছিল। চিত্রসেন দেবরাজ ইন্দ্রের খুব আস্থাভাজন ছিলেন। স্বর্গলোকে অর্জুনকে তিনি নৃত্য-গীত-বাদ্যাদি শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরে এই চিত্রসেন গন্ধর্বের সঙ্গে কৌরবদের বিরোধ হয়েছিল এবং চিত্রসেন কৌরবদের পরাজিত করে দুর্যোধনাদিকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন যুধিষ্ঠিরের আদেশে অর্জুন দুর্যোধনদের মুক্ত করতে গিয়েছিলেন। সেখানে অর্জুনের সঙ্গে চিত্রসেনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। মূল মহাভারত অনুসারে অর্জুনের সঙ্গে চিত্রসেনের দ্বৈরথ সংগ্রাম হয়নি—তাই কেউ জয়ী হননি, কেউ পরাজিতও হননি।
শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের আর একটি কবিতা ‘বাঁশিওআলা’। এই কবিতার এক জায়গায় পক্ষীন্দ্র গরুড়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে—
”সেখানে আগুনের ডানা মেলে দেয়
আমার বারণ-না মানা আগ্রহ,
উড়ে চলে অজানা শূন্যপথে
প্রথম ক্ষুধায় অস্থির গরুড়ের মতো।”
গরুড়ের কথা রামায়ণে আছে, মহাভারতেও আছে। ঋষি কশ্যপ ও বিনতার সন্তান মহা বলশালী এই পক্ষী। ডিম ভেঙে যখন সে প্রথম বেরিয়ে এল, তখনই সে মহাকায়, ক্ষুধায় অস্থির। পক্ষীশাবককে পক্ষীমাতা খাবার খাইয়ে বড় করে। কিন্তু এই মহাকায় পক্ষীর খাবারের বন্দোবস্ত করা বিনতার পক্ষে সম্ভব নয়। পিতা কশ্যপ তার খাবার নির্দেশ করে দিলেন, আর গরুড়ও উড়ে চললো সেই খাবারের সন্ধানে।
এই কবিতার শেষদিকে আদিকবি বাল্মীকির নাম উল্লেখ করা হয়েছে একবার—
”তোমার ডাক শুনে একদিন
ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে
অন্ধকার কোণ থেকে
বেরিয়ে এল ঘোমটা খসা নারী।
যেন সে হঠাৎ গাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির,
চমক লাগালো তোমাকেই।”
শেষ রক্ষা নাটকটি ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকটির একটু পরিবর্তিত রূপ। এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকের উল্লেখ আছে। সেই নাটকে অবশ্য রামায়ণ মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ ছিল না। শেষরক্ষা নাটকে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ অল্প অল্প আছে। প্রথমে শব্দভেদী বাণের কথা এসেছে। নিবারণবাবুর গৃহে প্রতিপালিতা কমলের সঙ্গে কবি বিনোদবিহারীর বিয়ের কথা হচ্ছে। এই নিয়ে ক্ষান্তমণি এবং ইন্দুমতীর মধ্যে কথা—
”ক্ষান্তমণি। বলিস কী! কমল নাকি? সে ওকে দেখলে কখন?
ইন্দু। দেখেনি। সেইটেই তো বিপদ। শব্দভেদী বাণের কথা রামায়ণে শোন নি?
ক্ষান্তমণি। শুনেছি।
ইন্দু। সবচেয়ে শক্ত বাণ হল সেইটে। শব্দের রাস্তা বেয়ে কখন বুকে এসে বেঁধে, কেউ দেখতেই পায় না।”
রামায়ণে রাজা দশরথ শব্দভেদী বাণ ব্যবহারে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এই বাণ শব্দ অনুসরণ করে target কে hit করতে পারতো।
এর পরে সীতার কথা এসেছে। চন্দ্রবাবুর বন্ধু হচ্ছে বিনোদবিহারী। চন্দ্রবাবুর মনে হয়েছে কমলের সঙ্গে বিয়েতে বিনোদবিহারী হয়তো পণ নেবার কথা ভেবেছে।
”বিনোদ। ছি ছি চন্দ্র, এমন কথাটাও তোমার মুখ দিয়ে বেরোল। আমি তুচ্ছ টাকার কথাই কি ভাবছি?
চন্দ্রকান্ত। আজকালকার দিনে কোনটা তুচ্ছ, কন্যাটা না পণটা, তার হিসেব করা শক্ত নয়। যুবকরা তো সোনার মৃগ দেখেই ছোটে, সীতা পড়ে থাকেন পশ্চাতে।”
ইন্দু আর কমলের মধ্যে খুনসুটি হচ্ছে। বিনোদ আর তার দুই বন্ধুব একটা গ্রুপ ফটো ইন্দু কমলকে দিয়েছে।
”কমল। এর মধ্যে তো একজন দেখছি চন্দরবাবু।
ইন্দু। বাকি দুজনের মধ্যে কে বিনোদবাবু আন্দাজ কর দেখি। এর মধ্যে কেই বা কোকিল কেই বা কাক, কেই বা কবি কেই বা অকবি বল দেখি।
কমল। তোর মতন এমন সূক্ষ্ম দৃষ্টি আমার নেই ভাই!
ইন্দু। আচ্ছা এই নে, তোর ডেস্কের উপর রাখ, চেয়ে দেখতে দেখতে ভক্তের ধ্যানদৃষ্টিতে সত্য আপনি প্রকাশিত হবে। দময়ন্তী ছজনের মধ্যে নলকে চিনে নিয়েছিলেন, তোর তো কেবল দুজন।”
মহাভারতের নল-দময়ন্তীর কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে।
কমল আর বিনোদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন গদাই-এর সঙ্গে ইন্দুমতীর বিয়ে। দুই বন্ধু চন্দ্রকান্ত এবং বিনোদ বাসরঘরের আশে-পাশে ঘোরাফেরা করছে।
”চন্দ্রকান্ত । বাসরঘরের রুদ্ধ দুর্গ আজ আমরা স্টর্ম করব।
বিনোদ। আমরা ভীরু, সামান্য পুরুষজাত মাত্র —আমাদের দ্বারা কি এত বড়ো বিপ্লব ঘটতে পারবে।
চন্দ্রকান্ত। নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করো না বিনোদ! ভেবে দেখো, ত্রেতাযুগে যারা সেতুবন্ধন করেছিল জীব হিসাবে তারাও যে আমাদের চেয়ে খুব বেশি শ্রেষ্ঠ ছিল তার প্রমাণ নেই—এমন-কি, এক-আধটা বাহ্য বাহুল্য ছাড়া অনেক বিষয়েই মিল ছিল; মহৎ লক্ষ্য হৃদয়ে রেখে তারাও হেঁটে সমুদ্র পার হল। আর, আমাদের কেবলমাত্র এই দরজাটুকু পার হতে হবে। এতকাল এই বাসরঘরের সামনে স্ত্রীপুরুষের যে বিচ্ছেদসমুদ্র বিরাজ করছে কেবল একটিমাত্র মহাবীর বরবেশে সেটা লঙ্ঘন করবার অধিকারী; কিস্কিন্ধ্যার বাকি সকলকেই এ পারে পড়ে থাকতে হয়, এই অগৌরব যদি আমরা মোচন করতে না পারি তা হলে ধিক আমাদের পৌরুষ।”
পরিত্রাণ নাটকটির মূল রয়ে গেছে ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে ও ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে। রামায়ণ-মহাভারত প্রসঙ্গ ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক আলোচনাতে যা বলা হয়েছে, ‘পরিত্রাণ’ নাটকে সেগুলিই আছে—নতুন আর কিছু বলার নেই।
গল্পগুচ্ছ : ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের শশীভূষণ একজন শিক্ষিত সচ্চরিত্র ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। অত্যাচারী দখলদার রাজশক্তির কোপে এবং নিজদেশীয় মানুষের ষড়যন্ত্রে তাকে পাঁচ বৎসরের কারাবাস করতে হয়। তার আগে ক্ষীণদৃষ্টি শশীভূষণ যখন নিজগৃহে পড়াশোনায় ব্যাপৃত থাকতেন, তখন বালিকা গিরিবালা সেখানে মাঝে মধ্যে যেত। কিন্তু শশীভূষণের কারাবাসের পাঁচবছরে সবকিছুই ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। গিরিবালার বিবাহ হয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যে সে বিধবা হয়েছে। শশীভূষণের ভূসম্পত্তি সব বেহাত হয়ে গিয়েছে। জেল থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন গৃহহীন আত্মীয়হীন সমাজহীন অবস্থায়। জেলের বাইরে বেরিয়ে তিনি যখন ভাবছেন তাঁর ভবিষ্যৎ কর্তব্য নিয়ে তখন একটা বড় জুড়ি গাড়ী এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালো। গাড়ী থেকে নেমে একটি ভৃত্য তাঁর পরিচয় নিয়ে গাড়ীতে উঠতে বললো। শশীভূষণ বিস্মিত হলেন কিন্তু আশেপাশের লোকের কৌতূহলী দৃষ্টি এড়াতে তিনি গাড়ীতে উঠে বসলেন। গাড়ী তাঁকে একটা বড় বাড়ীতে নিয়ে এল। একটা ঘরে এসে তিনি বসলেন। টেবিলের উপরে শশীভূষণ দেখতে পেলেন একটা ভাঙা শ্লেট, কয়েকটি পুরানো খাতা, একটি ছেঁড়া ধারাপাত, কথামালা এবং একখানি কাশীরামদাসের মহাভারত। এটি গিরিবালার বাড়ী এবং শ্লেট ইত্যাদি সব গিরিবালার জিনিস। সে যখন শশীভূষণের কাছে কখনো পড়তো, এগুলো সেই সময়ের জিনিস এবং গিরিবালা সব যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
কবি উল্লেখ করেছেন কাশীরামদাসের মহাভারতখানির কথা। গত ৩০/৪০ বৎসরে বাংলার গ্রামের চিত্র পাল্টে গিয়েছে। নইলে তার আগে বাংলার ঘরে ঘরেই আর কোনো বই থাকুক আর না থাকুক, একখানি কাশীরামদাসের মহাভারত ও একখানি কৃত্তিবাসের রামায়ণগ্রন্থ থাকতো।
‘নিশীথে’ গল্পে ইন্দ্রের ঐরাবতের কথা বলা হয়েছে। জমিদার দক্ষিণাচরণ বাবু রাতে ঘুমাতে পারতেন না। এইরকম এক রাত্রে তিনি তাঁর পরিচিত ডাক্তারকে যার জবানিতে এই গল্পটি বলা হয়েছে অন্য অনেক কথার মধ্যে তাঁর প্রথমা স্ত্রীর কথা বললেন।
”আমার গৃহিনীর কাছে…সখীভাবে প্রণয় সম্ভাষণ করিতে গেলে তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন। গঙ্গার স্রোতে যেমন ইন্দ্রের ঐরাবত নাকাল হইয়াছিল তেমনি তাঁহার হাসির মুখে বড়ো বড়ো কাব্যের টুকরা এবং ভালো ভালো আদরের সম্ভাষণ মুহূর্তের মধ্যে অপদস্থ হইয়া ভাসিয়া যাইত।”—ইন্দ্রের ঐরাবতের কাহিনী পূর্বে বলা হয়েছে।
‘আপদ’ গল্পে যাত্রার দলের ছোকরা নীলকান্ত নৌকাডুবির পর সাঁতরে তীরে উঠে বায়ুপরিবর্তনে আসা একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে আশ্রয় পেয়েছে। এই পরিবারের বধূ আমোদপ্রিয় স্নেহপরায়ণা কিরণ ধীরে ধীরে রোগমুক্ত হচ্ছেন। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা নীলকান্তকে তিনি একটু বেশিরকম আদর দিতেন। মধ্যাহ্নে আহারাদির পর কিরণ ‘পানের বাটা পাশে রাখিয়া খাটের উপর বসিতেন,.. এবং নীলকান্ত নীচে দাঁড়াইয়া নলদময়ন্তীর পালা অভিনয় করিত।…. সে (নীলকান্ত) অতি অল্পবয়সেই যাত্রার দলে ঢুকিয়া রাধিকা, দময়ন্তী, সীতা এবং বিদ্যার সখী সাজিত।” কিরণের দেবর সতীশ কলকাতা থেকে একটা খুব শৌখিন দোয়াতদান কিনে এনেছিল যার মধ্যে একটা জার্মান-সিলভারের হাঁস বসানো ছিল। এই পরিবারটি যেদিন নিজেদের বাড়ীতে ফিরে যাবে তার আগের দিন সে দোয়াতদানটি খুঁজে পাওয়া গেল না। ‘কিরণ হাসিয়া কহিলেন—ঠাকুরপো, তোমার রাজহংস তোমার দময়ন্তীর অন্বেষণে উড়িয়াছে।’ নলদময়ন্তী মহাভারতের চরিত্র।
‘প্রতিহিংসা’ গল্পে জমিদার মুকুন্দবাবুদের বৈষয়িক উন্নতিতে দেওয়ান গৌরীকান্তের বিশেষ অবদান ছিল। সেইজন্য মুকুন্দর সহিত গৌরীকান্তর বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক ছিল। তাঁরা উভয়েই গত হলে জমিদার হয়েছে মুকুন্দর এক পোষ্যপুত্র বিনোদবিহারী এবং জমিদারী এস্টেটের ম্যানেজার হয়েছেন গৌরীকান্তর সুশিক্ষিত নাতজামাই অম্বিকাচরণ। অম্বিকাচরণের স্ত্রী ইন্দ্রানী জমিদার বাড়ীতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল এবং সেখানে বিনাকারণে অপমানিতা হয়েছিল। সেখানে ইন্দ্রানী সবকিছু নীরবে সহ্য করেছিল কিন্তু অপমানটা তার মনে বড় বেজেছিল, তার মনে অনেককথা উদয় হচ্ছিল। ”মহাভারতে বর্ণিত শুক্রাচার্য দুহিতা দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার কথা মনে পড়িল। দেবযানী যেমন তাহার প্রভুকন্যার দর্প চূর্ণ করিয়া তাহাকে দাসী করিয়াছিল, ইন্দ্রানী যদি তেমনি করিতে পারিত তবেই যথোপযুক্ত বিধান হইত। এক সময় ছিল, যখন দৈত্যদের নিকট দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যোর ন্যায় মুকুন্দবাবুর পরিবারবর্গের নিকট তাহার পিতামহ গৌরীকান্ত একান্ত আবশ্যক ছিলেন।”
‘বিদায়-অভিশাপ’ কবিতাটির আলোচনা প্রসঙ্গে আপনারা দেবযানীর কথা কিছুটা জেনেছেন। সেই সময়ে দৈত্যদের রাজা ছিলেন বৃষপর্ব তাঁর কন্যা শর্মিষ্ঠা। একদিন স্নানের জন্য শর্মিষ্ঠা দাসীদের সঙ্গে সরোবরে গেছেন দেবযানীও সঙ্গে গেছেন। স্নানের পর বস্ত্রপরিবর্তনের সময় শর্মিষ্ঠা দেবযানীর বস্ত্র পরিধান করেছেন ভুল করে। দেবযানী কুপিতা হয়ে শর্মিষ্ঠাকে বকাবকি করেছেন— শূদ্রা হয়ে তার এত সাহস যে সে ব্রাহ্মণ-কন্যার বস্ত্র পরিধান করে! শর্মিষ্ঠাও ক্রুদ্ধ হয়ে দেবযানীকে কথা শুনিয়েছেন—তাঁর পিতার অন্ন দ্বারাই দেবযানী ও তার পিতার ভরণপোষণ হয়। শেষে শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে একটা পরিত্যক্ত কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে নিজ গৃহে ফিরে গেলেন।
দেবযানী তাঁর পিতা শুক্রাচার্য্যকে নিজ দুঃখের কথা জানালেন। শুক্রাচার্য্যও ক্রুদ্ধ হয়ে রাজা বৃষপর্বকে অভিযোগ করলেন এবং দৈত্যরাজকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দৈত্যরাজ শুক্রাচার্যোর গুরুত্ব বোঝেন। অনেক অনুনয় বিনয় করে তিনি শুক্রাচার্য্য এবং দেবযানীকে প্রসন্ন করলেন। দেবযানী ক্ষমা করতে রাজী হলেন কিন্তু শর্ত দিলেন যে শর্মিষ্ঠাকে তাঁর দাসী হতে হবে। দৈত্যরাজ এই শর্ত স্বীকার করলেন এবং শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর দাসী হতে হল।
‘অতিথি’ গল্পে দেখা যাচ্ছে যে কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু সপরিবারে নৌকাযোগে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে পনেরো-ষোলো বছরের একটি সুদর্শন ব্রাহ্মণবালক তারাপদ তাঁদের সঙ্গে যেতে চাইল। মতিলালবাবু সাগ্রহে তাকে গ্রহণ করলেন কিন্তু দেখা গেল যে আদর-ভালোবাসা গ্রহণে বালকটি একেবারে অনিচ্ছুক যদিও অন্য সব ব্যাপারেই ছেলেটি সকলের সঙ্গে সহজভাবে মিশে গেল।
ভবঘুরে তারাপদর নানারকম মনোরঞ্জনী বিদ্যা আয়ত্তে ছিল। ”পাঁচালী কথকতা কীর্তনগান যাত্রাভিনয়ের সুদীর্ঘ খণ্ডসকল তাহার কণ্ঠাগ্রে ছিল। মতিলালবাবু চিরপ্রথামত একদিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁহার স্ত্রী-কন্যাকে রামায়ণ পড়িয়া শুনাইতেছিলেন, কুশলবের কথার সূচনা হইতেছে এমন সময় তারাপদ … কহিল, ”বই রাখুন। আমি কুশলবের গান করি, আপনারা শুনে যান।”
এই বলিয়া সে কুশলবের পাঁচালী আরম্ভ করিয়া দিল।… যখন শেষ হইয়া গেল সকলেই ব্যথিতচিত্তে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, ইহারই মধ্যে শেষ হইল কেন।”
রামায়ণের কথা রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গাতে বলেছেন। ”ইচ্ছাপূরণ’ গল্পে ইচ্ছাঠাকরুণ বালক সুশীলচন্দ্রকে পিতা সুবলচন্দ্রের মতো বৃদ্ধ করে দিয়েছেন আর সুবলচন্দ্রকে সুশীলের মতো বলেক করে দিয়েছেন। ”স্কুলের ছুটির পরে সুবল বাড়ী আসিয়া খুব একচোট ছুটাছুটি করিয়া খেলিয়া বেড়াইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়িতেন, কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে বৃদ্ধ সুশীলচন্দ্র চোখে চশমা দিয়া একখানা কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়া সুর করিয়া পড়িত, সুবলের ছুটাছুটি গোলমালে তাহার পড়ার ব্যাঘাত হইত।”
জাপান-যাত্রীর প্রবন্ধগুলিতে রামায়ণ-মহাভারত প্রসঙ্গ নেই বললেই হয় জাহাজে মাত্র একবার কবির ভীষ্মের শরশয্যার কথা মনে হয়েছিল। ‘রাত্রে বাইরে শোওয়া গেল কিন্তু এ কেমনতরো বাইরে? জাহাজের মাস্তুলে মাস্তুলে আকাশটা যেন ভীষ্মের মত শরশয্যায় শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে।”
যাত্রী-পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারী : এই খণ্ডের ৪৪৩ পৃষ্ঠাতে কবি শ্রীশ্রীগীতা থেকে একটা শ্লোক আংশিক উদ্ধৃত করেছেন এবং তাঁর নিজের মতো করে একটু ব্যাখ্যাও করেছেন। ”এই কথাটাকেই গীতা বলেছেন—স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ। (তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক সংখ্যা ৩৫) দেখা গেছে স্বধর্মে জগতে খুব মহৎ লোকেরও নিধন হয়েছে, কিন্তু সে নিধন বাইরের, স্বধর্ম ভিতরের দিক থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছে। আর এও দেখা গেছে, পরধর্মে খুব ক্ষুদ্র লোকেও হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার নিধন ভিতরের থেকে, তাকে উপনিষদ বলেন ‘মহতী বিনষ্টিঃ।’
যে-ব্যক্তি ছোটো তারও স্বধর্ম বলে একটি সম্পদ আছে। তার সেই ছোটো কৌটোটির মধ্যেই সেই স্বধর্মের সম্পদটিকে রক্ষা করে সে পরিত্রাণ পায়। ইতিহাসে তার নাম থাকে না, হয়তো তার বদনাম থাকতেও পারে, কিন্তু তার অন্তর্যামীর খাস দরবারে তার নাম থেকে যায়। লোভে পড়ে স্বধর্ম বিকিয়ে দিয়ে সে যদি পরধর্মের ডঙ্কা বাজাতে যায় তবে হাটে বাজারে তার নাম হবে। কিন্তু, তার প্রভুর দরবার থেকে তার নাম খোওয়া যাবে। …এক এক সময়ে বাহিরের কল্লোলে উদভ্রান্ত হয়ে স্বধর্মের বাণী স্পষ্ট করে শোনা যায় না। তখন ‘কর্তব্য’ নামক … একটি শব্দের হুঙ্কারে মন অভিভূত হয়ে যায়, ভুলে যাই যে, কর্তব্য বলে একটা অবচ্ছিন্ন পদার্থ নেই, আমার ‘কর্তব্যই হচ্ছে আমার পক্ষে কর্তব্য।’ … ঘোড়া যদি বলে ‘আমি সারথির কর্তব্য করবো’ বা চাকা বলে ‘ঘোড়ার কর্তব্য করবো’ তবে সেই কর্তব্যই ভয়াবহ হয়ে ওঠে।”
এই প্রবন্ধেই কবি লোকমান্য তিলকের সঙ্গে তাঁর কিছু কথার উল্লেখ করেছেন। তিলক রবীন্দ্রনাথকে একবার পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়ে বলেছিলেন যে কবিকে ইউরোপ যেতে হবে। কবি বলেছিলেন যে রাষ্ট্রিক আন্দোলনের কাজে যোগ দিয়ে তিনি ইউরোপ যেতে পারবেন না। তাতে তিলক বলেছিলেন যে কবি রাষ্ট্রিক চর্চায় থাকুন, এটি তিলকের অভিপ্রায় নয়। ভারতবর্ষের যে বাণী কবি প্রচার করতে পারেন, সেই বাণী বহন করাই কবির পক্ষে সত্য কাজ। পরে কবিকে তিলক আবার বলেছিলেন—”রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপার থেকে নিজেকে পৃথক রাখলে তবেই আপনি নিজের কাজ সুতরাং দেশের কাজ করতে পারবেন; এর চেয়ে বড়ো আর কিছু আপনার কাছে প্রত্যাশাই করি নি।” কবি অবশ্য তিলকের টাকা গ্রহণ করেন নি। তিলক সম্বন্ধে কবি লিখেছেন—”আমি বুঝতে পারলুম, টিলক যে গীতার ভাষ্য করেছিলেন, সে কাজের অধিকার তাঁর ছিল, সেই অধিকার মহৎ অধিকার।”
মহাভারতের অভিমন্যুর কথা কবি বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেকবারই বলেছেন, এখানেও (২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ তারিখের লেখা) বলেছেন—”আমাদের আগন্তুকবর্গ অভিমন্যুর মতো অতি সহজেই ঘরে প্রবেশ করতে জানেন, কিন্তু নির্গমনের পথ যে তারা জানেন সে তাদের ব্যবহারে বোঝা যায় না।”
১৯২৪ সালে ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখের লেখাতে কবি মহাভারতের সাবিত্রীর কথা বলেছেন—”আমরা কবি মেয়েদের মধ্যে মঙ্গল। অনুষ্ঠানের যে সকল আয়োজন, যে সকল চিহ্ন শুভ সূচনা করে, আমাদের দেশে তার ভার মেয়েদের উপর। … ভাইয়ের কপালে মেয়েরাই দেয় ভাইফোঁটা। আমরা জানি সাবিত্রীই মৃত্যুর হাত থেকে স্বামীকে ফিরিয়েছিল।”
সূক্ষ্ম রসসৃষ্টি অপেক্ষা অধিকাংশ মানুষ শিল্পসংস্কৃতি বা আর্টের ক্ষেত্রে চায় বাহুল্য, আড়ম্বর আর বাহ্য চমক। ২রা অক্টোবর, ১৯২৪ তারিখের লেখাটাতে কবি বলছেন যে আর্ট চীৎকার নয়, তার গভীরতম পরিচয় হচ্ছে তার আত্মসংবরণে। সস্তা জনপ্রিয়তা দিয়ে আর্টের মূল্য বিচার করা যায় না। এখানে কবি রামায়ণের কথা মনে করেছেন—”হায় রে লোকের মন, তোমাকে খুশী করবার জন্য রামচন্দ্র একদিন সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।”
১৯২৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারির লেখাতে কবি উল্লেখ করেছেন যে অনেক সময়েই পুরুষের কর্মশীলতার পিছনে নারীর প্রেরণা প্রচ্ছন্ন থাকে। এই কথাটা বলতে গিয়ে তিনি মহাভারত থেকে উদাহরণ দিয়েছেন। ”ইতিহাসের অপ্রকাশিত লিখন যদি বের করা যেত তা হলে দেখতে পেতাম নারীর প্রেমের প্রেরণা মানুষের সমাজে কী কাজ করেছে। শক্তির যে ক্রিয়া উদ্যত চেষ্টারূপে চঞ্চল আমরা তাকেই শক্তির প্রকাশরূপে দেখি, কিন্তু যে-ক্রিয়া গূঢ় উদ্দীপনারূপে পরিব্যাপ্ত তার কথা মনেই আনি নে। বিস্ময়ের কথা এই যে বিশ্বের স্ত্রীপ্রকৃতিকেই ভারতবর্ষ শক্তি বলে জেনেছে।
সকলেই জানে এই শক্তিরই বিকারের মতো এমন সর্বনেশে বিপদ আর কিছুই নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমের হৃদয়ের মধ্যে অদৃশ্য থেকে দ্রৌপদী তাঁকে বল জুগিয়েছেন। … সত্যবানকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেন সাবিত্রী, কিন্তু কত নারী পুরুষের সত্য নষ্ট করে তাকে মৃত্যুর মুখে নিয়ে গেছে তার সংখ্যা নেই।”
পরের দিন অর্থাৎ ১৪ই ফেব্রুয়ারী লেখাতে কবি রামায়ণের জহ্নুমুনির কথা বলেছেন। ”আমাদের হিন্দুস্থানি গানে বৃদ্ধি দেখতে পাইনে। তানসেন প্রভৃতির অক্ষয় কমন্ডলু থেকে যে ধারা প্রবাহিত হয়েছিল ওস্তাদ প্রভৃতি জহ্নুমুনি কারদানি দিয়ে সেটি গিলে খেয়ে বসে আছে”—রামায়ণের কাহিনীতে আছে ভগীরথ তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্ধার সাধনের নিমিত্ত গঙ্গার ধারাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন। পথে গঙ্গার জলে জহ্নুমুনির আশ্রম প্লাবিত হয়ে যায়। মুনি ক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গার জল সব পান করে নেন এবং গঙ্গার ধারা শুষ্ক হয়ে যায়। পরে অবশ্য জহ্নু ভগীরথের প্রার্থনায় গঙ্গাকে মুক্ত করে দেন।
১৫ই ফেব্রুয়ারীর লেখাতে কবি কাব্যে সাহিত্যে ক্যারেকটারের কথা আলোচনা করেছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে কবি মহাভারত ও রামায়ণ থেকে উদাহরণ দিয়েছেন। ”ইংরেজী ভাষায় ক্যারেকটার শব্দের একটা অর্থ স্বভাব, নৈতিক চরিত্র; আর একটা অর্থ, চরিত্ররূপ। অর্থাৎ এমন কতকগুলি গুণের এমন সমাবেশ যাতে এই সমাবেশটি বিশেষভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। … এইরকম বিশেষ গোচরতাই আর্টের ধর্ম। নাট্যে কাব্যে চিত্রে নৈতিক সদগুণের চেয়ে এই ক্যারেকটারের মূল্য বেশী। … চরিত্রনীতি বিলাসী ঐতিহাসিক তাঁর মহাভারতে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরাজ নাম দিয়ে সদগুণের উচ্চ পীঠের উপর দাঁড় করিয়ে সর্বদা আমাদের চোখের উপর ধরে রেখেছেন, কিন্তু তবু যুধিষ্ঠির স্পষ্ট করে চোখে পড়েন না; আর চরিত্রবিলাসী কবি তাঁর ভীমসেনকে নানা অবিবেচনা ও অসংযমের অপবাদে লাঞ্ছিত করেও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। যারা সত্য কথা বলতে ভয় করে না তারা স্বীকার করবেই যে, সর্বগুণের যুধিষ্ঠিরকে ফেলে দোষ গুণে জড়িত ভীমসেনকেই তারা ভালোবাসে। তার একমাত্র কারণ ভীমসেন সুস্পষ্ট। … রামচন্দ্রের ভক্তদের আমি ভয় করি, তাই খুব চুপিচুপি বলছি, সাহিত্যে রামের চেয়ে লক্ষ্মণ বড়ো। বাল্মীকিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিশ্চয় মানবেন যে, রামকে তিনি ভালো বলেন, কিন্তু লক্ষ্মণকে তিনি ভালোবাসেন।”
ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ গীতার কথা বলেছেন (সুলভ ১০ম, পৃ. ৪৮৬)। ”গীতায় আছে, কর্মের বিশুদ্ধ মুক্তরূপ হচ্ছে তার নিষ্কামরূপ। অর্থাৎ ত্যাগের দ্বারা নয়, বৈরাগ্যের দ্বারাই কর্মের বন্ধন চলে যায়। তেমনি ভোগেরও বিশুদ্ধরূপ আছে, সেই রূপটি পেতে গেলে বৈরাগ্য চাই। বলতে হয়, ‘মা গৃধঃ’ লোভ করো না।”
জাভাযাত্রীর পত্র : গ্রন্থ পরিচয় বিভাগে বলা হয়েছে —”সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ কর, শ্রীধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা প্রমুখ অধ্যাপক ও শিল্পীগণকে সঙ্গে লইয়া ১৯২৭ সালে ১৪ই জুলাই মাদ্রাজ হইতে রবীন্দ্রনাথ পূর্বদ্বীপপুঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করেন। জাভা, বালি প্রভৃতি দ্বীপ ভ্রমণ করিয়া সিয়াম হইয়া অক্টোবরের শেষে তিনি ফিরিয়া আসেন।
আমার এই বইটি কতজন পড়বেন বা যাঁরা পড়বেন তাঁদের ভালো লাগবে কি না আমি জানি না। তবে একটা কথা বলতে পারি যে এই লেখাটা তৈরি করতে আমার নিজের ভালো লাগছে। এই লেখা উপলক্ষে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রসাহিত্য নতুন করে পড়ছি। এর আগে রবীন্দ্রসাহিত্য যা পড়েছি সেটা খুব Selective কিছু কবিতা, নাটক-উপন্যাস, ছোট গল্প এবং কিছু প্রবন্ধ। বেশির ভাগ প্রবন্ধ এবং বিশেষ করে চিঠিপত্র আগে প্রায় পড়িই-নি। এখন যত পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ পড়ে মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন ভারতের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে এই জায়গাগুলিতে। জাভা, বালি প্রভৃতি অঞ্চলগুলো এখন ইন্দোনেশিয়া দেশের অন্তর্ভুক্ত। দেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মে মুসলমান কিন্তু কী যত্নের সঙ্গে তাঁরা রক্ষা করে চলেছেন প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া রামায়ণ-মহাভারতের সুমহান ঐতিহ্যকে। প্রাচীন ভারতবর্ষের সঙ্গে এই দ্বীপপুঞ্জের নিশ্চিতভাবেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, যখন ভারতীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য এখানে বিস্তার লাভ করেছিল। তারপরে এমন একটা সময় এসেছিল যখন ভারতের পূর্ব গরিমা অনেক ম্লান হয়ে গিয়েছিল, বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে মুসলমান ধর্মের উদ্ভব এবং প্রসার হয়েছে এবং এই দ্বীপসমূহের অধিকাংশ মানুষই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন কিন্তু রামায়ণ মহাভারতকে তাঁরা ভোলেননি। ভারতবর্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াতে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীতে বিকৃতি এসেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় নামগুলো পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু মূল জিনিসটি রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন এবং অনুভব করেছিলেন যে রামায়ণ মহাভারতের প্রতি এখানকার মানুষের টান কিছুমাত্র কমেনি। এখানে রামায়ণ-মহাভারতের প্রতি এখানকার মানুষের ভালোবাসা, এখানে প্রচলিত রামায়ণ মহাভারতের সঙ্গে ভারতবর্ষে প্রচলিত রামায়ণ-মহাভারতের পার্থক্য ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই পত্রগুলিতে বিস্তারিত লিখেছিলেন। ভাগ্যিস লিখেছিলেন আর তাই আমরা প্রায় শতবর্ষ পূর্বের জাভা, বালি ইত্যাদি জায়গার রামায়ণ-মহাভারত সংস্কৃতির অনেক কিছু জানতে পারছি। এখন আমরা রবীন্দ্ররচনার মধ্য দিয়ে দেখবো কবি কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে এই সংস্কৃতিকে দেখেছিলেন।
প্রথম পত্রটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে ১লা শ্রাবণ, ১৩৩৪ সালে। এই পত্রের প্রথমদিকেই কবি রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র এবং অহল্যার কথা মনে করেছেন। কলকাতা থেকে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) কবি গিয়েছিলেন ট্রেনে। ট্রেন থেকে পথের দৃশ্য দেখতে দেখতে কবি ভাবছেন—”ধরনীর বুকের থেকে অহল্যা জেগে উঠেছেন, নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের পায়ের স্পর্শ লাগল।”
ঐ একই পত্রে কবি শ্রীশ্রীগীতায় উক্ত নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন— ”মানুষের বিপুল চাওয়া ক্ষুদ্র নিজের জন্যে হলে তাতেই যত অশান্তির সৃষ্টি। যেখানে তার সাধনা সকলের জন্যে সেইখানেই মানুষের আকাঙ্খা কৃতার্থ হয়। এই সাধনাকেই গীতা যজ্ঞ বলেছেন, এই যজ্ঞের দ্বারাই লোকরক্ষা। এই যজ্ঞের পন্থা হচ্ছে নিষ্কাম কর্ম। সে কর্ম দুর্বল হবে না, সে-কর্ম ছোটো হবে না, কিন্তু সে-কর্মের ফলকামনা যেন নিজের জন্যে না হয়।”
২রা শ্রাবণ লিখিত দ্বিতীয় চিঠিতে কবি ভগবান বিষ্ণু এবং গরুড়ের কথা বলেছেন। ”দুই পায়ের উপর খাড়া-দাঁড়ানো ছোটো ছোটো চটুল জীব, লাফ দিয়ে চড়ে বসল মহাকায় বিপদবিভীষিকার পিঠের উপর, বিষ্ণু যেমন চড়েছেন গরুড়ের পিঠে।’ গরুড়ের বিষ্ণুর বাহন হওয়ার কাহিনী মহাভারতে আছে। গরুড়ের বিপুল পরাক্রম দর্শনে খুশি হয়ে বিষ্ণু গরুড়কে বর দিতে চাইলেন। গরুড় বর চাইল যে তার আসন যেন বিষ্ণুর চাইতে উচ্চে হয়। বিষ্ণু সেই বর তাকে দিলেন। সম্ভবত গরুড়ের একটু অহঙ্কার হয়েছিল। সেও বিষ্ণুকে বর দিতে চাইল। বিষ্ণু তাকে বাহন হিসাবে চাইলেন।
৩রা শ্রাবণের চিঠিতে জীবজগতে মানুষের জয়যাত্রার কথা বলতে গিয়ে কবি গীতার কথা স্মরণ করেছেন—গীতার মন্ত্রের আংশিক উদ্ধৃত করেছেন।
”মানুষকে নারায়ণ সখা বলে তখনই সম্মান করেছেন যখন তাকে দেখিয়েছেন তাঁর উগ্ররূপ, তাকে দিয়ে যখন বলিয়েছেন : দৃষ্টাদ্ভূতংরূপমুগ্রং তবেদং লোকত্রয়ং প্রব্যথিতঃ মহাত্মন্’—মানুষ যখন প্রাণমন দিয়ে স্তব করতে পেরেছে :
অনন্তবীর্যামিত বিক্রমস্ত্বঃ
সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ।।
তুমিই অনন্তবীর্য, তুমিই অমিতবিক্রম, তুমিই সমস্তকে গ্রহণ করো, তুমিই সমস্ত।”
সম্পূর্ণ শ্লোক দুটি আছে শ্রীশ্রীগীতার একাদশ অধ্যায়ে (বিশ্বরূপদর্শনযোগঃ)। শ্লোক দুটি এবং তার অর্থ নীচে দেওয়া হল—
”দ্যাবাপৃথিব্যোরিদমন্তরং হি ব্যাপ্তং ত্বয়ৈকেন দিশশ্চ সর্ব্বাঃ।
দৃষ্টাহদ্ভুতং রূপমুগ্রং তবেদং লোকত্রয়ং প্রব্যথিতং মহাত্বন।। (তুমি একাই স্বর্গ, মর্ত্য, আর মধ্যবর্তী স্থল সর্বত্র ব্যাপিয়া আছ। তোমার এ অদ্ভুত উগ্ররূপ দেখিয়া ত্রিলোক ভীত হইতেছে এবং আমিও ভীত হইতেছি।) (শ্লোক সংখ্যা-২০)
”নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোহস্তু তে সর্ব্বত এব সর্ব।
অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্ত্বং সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ।।”
(হে সর্বস্বরূপ! আমি তোমার সম্মুখে ও পশ্চাতে এবং সর্বদিকে প্রণাম করি। তুমি অনন্তবীর্য, তুমি অমিত বিক্রম, এবং তুমি সর্ব ব্যাপিয়া আছ, এই কারণে তুমি ‘সর্ব’ নামে অভিহিত হইয়া থাক।) (শ্লোকসংখ্যা—৪০)
২৮শে জুলাই, ১৯২৭ তারিখের চিঠিতেও তিনি একজায়গায় গীতার কথা বলেছেন —”ওখানে দেখতে পাচ্ছি, শক্তির রূপ আর মুক্তির রূপ অনবচ্ছিন্ন এক। এতেই শান্তি, এতেই সৌন্দর্য। জীবনের মধ্যে এই মিলনটিই তো খুঁজি—করার চিরবহমান নদীধারায় আর হওয়ার চিরগম্ভীর মহাসমুদ্রে মিলন। এই আত্মপরিতৃপ্ত মিলনটিকে লক্ষ করেই গীতা বলেছেন—কর্ম করো ফল চেয়ো না। এই চাওয়ার রাহুটাই কর্মের পাত্র থেকে তার অমৃত ঢেলে নেবার জন্যে লালায়িত। ভিতরকার সহজ হওয়াটি সার্থক হয় বাইরেকার সহজ কর্মে। অন্তরের সেই সার্থকতার চেয়ে বাইরের স্বার্থ প্রবল হয়ে উঠলেই কর্ম হয় বন্ধন, সেই বন্ধনেই জড়িত যত হিংসা দ্বেষ ঈর্ষা, নিজেকে ও অন্যকে প্রবঞ্চনা। … ফল চাওয়া কর্মের নাম চাকরি, সেই চাকরির মনিব আমি নিজেই হই বা অন্যেই হোক। চাকরিতে মাইনের জন্যই কাজ, কাজের জন্যে কাজ নয়। কাজ তার নিজের ভিতর থেকে নিজে যখন কিছুই রস জোগায় না, সম্পূর্ণ বাইরে থেকেই যখন আপন দাম নেয় তখনই মানুষকে সে অপমান করে।”
১লা আগস্ট ১৯২৭ তারিখে নির্মলকুমারী মহলানবিশকে কবি যে চিঠিটি লিখেছিলেন সেটাতে রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে। চিঠিটি লিখেছিলেন গিয়ানয়ার থেকে। গিয়ানয়ার রাজবাড়ীতে তিনি গিয়েছিলেন, সেখানকার রাজা অনেক সংস্কৃত শব্দ জানতেন। যাই হোক, এখন কবির চিঠি থেকে উদ্ধৃত করছি—
”রামায়ণ-মহাভারতের যে-সকল পাঠ এ দেশে প্রচলিত আমাদের দেশের সঙ্গে তার অনেক প্রভেদ। যে যে স্থানে এদের পাঠান্তর তার সমস্তই যে অশুদ্ধ, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। এখানকার রামায়ণে রাম-সীতা ভাই-বোন; সেই ভাই-বোনে বিবাহ হয়েছিল। একজন ওলন্দাজ পণ্ডিতের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল, তিনি বললেন, তাঁর মতে এই কাহিনীটাই প্রাচীন, পরবর্তীকালে এই কথাটাকে চাপা দিয়েছে।
এই মতটাকে যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় তা হলে রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে মস্ত কয়েকটি মিল দেখতে পাই। দুটি কাহিনীরই মূলে দুটি বিবাহ। দুটি বিবাহই আর্যরীতি অনুসারে অসংগত। ভাই-বোনে বিবাহ বৌদ্ধ ইতিহাসে কোনো কোনো জায়গায় শোনা যায়, কিন্তু সেটা আমাদের সম্পূর্ণ শাস্ত্রবিরুদ্ধ। অন্য দিকে এক স্ত্রীকে পাঁচ ভাইয়ে মিলে বিবাহও তেমনি অদ্ভুত ও অশাস্ত্রীয়। দ্বিতীয় মিল হচ্ছে দুই বিবাহেরই গোড়ায় অস্ত্রপরীক্ষা, অথচ সেই পরীক্ষা বিবাহযোগ্যতা প্রসঙ্গে নিরর্থক। তৃতীয় মিল হচ্ছে, দুটি কন্যাই মানবীগর্ভজাত নয়, সীতা পৃথিবীর কন্যা, হলরেখার মুখে কুড়িয়ে-পাওয়া; কৃষ্ণা যজ্ঞসম্ভবা। চতুর্থ মিল হচ্ছে, উভয়ত্রই প্রধান নায়কদের রাজ্যচ্যুতি ও স্ত্রীকে নিয়ে বনগমন। পঞ্চম মিল হচ্ছে, দুই কাহিনীতেও শত্রুর হাতে স্ত্রী অবমাননা ও সেই অবমাননার প্রতিশোধ।
সেইজন্যে আমি পূর্বেই অন্যত্র এই মত প্রকাশ করেছি যে, দুটি বিবাহই রূপকমূলক। রামায়ণের রূপকটি খুবই স্পষ্ট। কৃষির হলবিদারণরেখাকে যদি কোনো রূপ দিতেই হয় তবে তাকে পৃথিবীর কন্যা বলা যেতে পারে। শস্যকে যদি নবদূর্বাদলশ্যাম রাম বলে কল্পনা করা যায় তবে সেই শস্যও তো পৃথিবীর পুত্র। এই রূপক অনুসারে উভয় ভাইবোন, আর পরস্পর পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ।
হরধনুভঙ্গের মধ্যেই রামায়ণের মূল অর্থ। বস্তুত সমস্তটাই হরধনুভঙ্গের ব্যাপার—সীতাকে গ্রহণ রক্ষণ ও উদ্ধারের জন্যে। আর্যাবর্তের পূর্ব অংশ থেকে ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত কৃষিকে বহন করে ক্ষত্রিয়দের যে-অভিযান হয়েছিল সে সহজ হয় নি, তার পিছনে ঘরে-বাইরে মস্ত একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সেই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস রামায়ণের মধ্যে নিহিত, অরণ্যের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের দ্বন্দ্ব।
মহাভারতে খাণ্ডববন-দাহনের মধ্যেও এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের আভাস পাই। সেও বনের গাছপালা পোড়ানো নয়, সেদিন বন যে প্রতিকূল মানবশক্তির আশ্রয় ছিল তাকে ধ্বংস করা। এর বিরুদ্ধে কেবল—যে অনার্য তা নয়, ইন্দ্র যাঁদের দেবতা তাঁরাও ছিলেন। ইন্দ্র বৃষ্টিবর্ষণে খাণ্ডবের আগুন নেবাবার চেষ্টা করেছিলেন।
মহাভারতেরও অর্থ পাওয়া যায় লক্ষ্যভেদের মধ্যে। এই শূন্যস্থিত লক্ষ্যভেদের মধ্যে এমন একটি সাধনার সংকেত আছে যে, একাগ্রসাধনার দ্বারা কৃষ্ণাকে পাওয়া যায়; আর এই যজ্ঞসম্ভবা কৃষ্ণা এমন একটি তত্ত্ব যাকে নিয়ে একদিন ভারতবর্ষে বিষম দ্বন্দ্ব বেধে গিয়েছিল। একে একদল স্বীকার করেছিল, একদল স্বীকার করে নি। কৃষ্ণাকে পঞ্চপাণ্ডব গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কৌরবেরা তাঁকে অপমান করতে ত্রুটি করেনি। এই যুদ্ধে কুরুসেনাপতি ছিলেন ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য, আর পাণ্ডববীর অর্জুনের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ। রামের অস্ত্রদীক্ষা যেমন বিশ্বামিত্রের কাছ থেকে, অর্জুনের যুদ্ধদীক্ষা তেমনি কৃষ্ণের কাছ থেকে। বিশ্বামিত্র স্বয়ং লড়াই করেননি, কিন্তু লড়াইয়ের প্রেরণা তাঁর কাছ থেকে; কৃষ্ণও স্বয়ং লড়াই করেন নি কিন্তু কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের প্রবর্তন করেছিলেন তিনি; ভগবদগীতাতেই এই যুদ্ধের সত্য, এই যুদ্ধের ধর্ম, ঘোষিত হয়েছে—সেই ধর্মের সঙ্গে কৃষ্ণ একাত্মক, যে-কৃষ্ণ কৃষ্ণার সখা, অপমানকালে কৃষ্ণা যাঁকে স্মরণ করেছিলেন বলে তাঁর লজ্জা রক্ষা হয়েছিল, যে-কৃষ্ণের সম্মাননার জন্যেই পাণ্ডবদের রাজসূয়যজ্ঞ। রাম দীর্ঘকাল সীতাকে নিয়ে যে-বনে ভ্রমণ করেছিলেন সে ছিল অনার্যদের বন, আর কৃষ্ণাকে নিয়ে পাণ্ডবেরা ফিরেছিলেন যে-বনে সে হচ্ছে ব্রাহ্মণ ঋষিদের বন। পাণ্ডবদের সাহচর্যে এই বনে কৃষ্ণার প্রবেশ ঘটেছিল। সেখানে কৃষ্ণা তাঁর অক্ষয় অন্নপাত্র থেকে অতিথিদের অন্নদান করেছিলেন। ভারতবর্ষে একটা দ্বন্দ্ব ছিল অরণ্যের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের, আর-একটা দ্বন্দ্ব বেদের ধর্মের সঙ্গে কৃষ্ণের ধর্মের। লঙ্কা ছিল অনার্যশক্তির পুরী, সেইখানে আর্যের হল জয়; কুরুক্ষেত্র ছিল কৃষ্ণবিরোধী কৌরবের ক্ষেত্র, সেইখানে কৃষ্ণভক্ত পাণ্ডব জয়ী হলেন। সব ইতিহাসেই বাইরের দিকে অন্ন নিয়ে যুদ্ধ, আর ভিতরের দিকে তত্ত্ব নিয়ে যুদ্ধ। প্রজা বেড়ে যায়, তখন খাদ্য নিয়ে স্থান নিয়ে টানাটানি পড়ে, তখন নব নব ক্ষেত্রে কৃষিকে প্রসারিত করতে হয়। চিত্তের প্রসার বেড়ে যায়, তখন যারা সংকীর্ণ প্রথাকে আঁকড়ে থাকে তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে যারা সত্যকে প্রশস্ত ও গভীর ভাবে গ্রহণ করতে চায়। এক সময়ে ভারতবর্ষে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ প্রবল হয়েছিল; এক পক্ষ বেদমন্ত্রকেই ব্রহ্ম বলতেন, অন্য পক্ষ ব্রহ্মকে পরমাত্মা বলে জেনেছিলেন। বুদ্ধদেব যখন তাঁর ধর্মপ্রচার শুরু করেন তার পূর্বেই ব্রাহ্মণে ক্ষত্রিয়ে মতেব দ্বন্দ্ব তাঁর পথ অনেকটা পরিষ্কার করে দিয়েছে।
রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে ভারতবর্ষের যে মূল ইতিহাস নানা কাহিনীতে বিজড়িত, তাকে স্পষ্টতর করে দেখতে পাব যখন এখানকার পাঠগুলি মিলিয়ে দেখবার সুযোগ হবে। কথায় কথায় এখানকার একজনের কাছে শোনা গেল যে, দ্রোণাচার্য ভীমকে কৌশলে বধ করবার জন্যে কোনো-এক অসাধ্য কর্মে পাঠিয়েছিলেন। দ্রুপদ-বিদ্বেষী দ্রোণ যে পাণ্ডবদের অনুকূল ছিলেন না, তার হয়তো প্রমাণ এখানকার মহাভারতে আছে।
রামায়ণের কাহিনী সম্বন্ধে আর-একটি কথা আমার মনে আসছে, সেটা এখানে বলে রাখি। কৃষির ক্ষেত্র দুরকম করে নষ্ট হতে পারে—এক বাইরের দৌরাত্ম্যে, আর-এক নিজের অযত্নে। যখন রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গেল তখন রামের সঙ্গে সীতার আবার মিলন হতে পেরেছিল। কিন্তু, যখন অযত্নে অনাদরে রামসীতার বিচ্ছেদ ঘটল তখন পৃথিবীর কন্যা সীতা পৃথিবীতেই মিলিয়ে গেলেন। অযত্নে নির্বাসিতা সীতার গর্ভে যে-যমজ সন্তান জন্মেছিল তাদের নাম লব কুশ। লবের মূল ধাতুগত অর্থ ছেদন, কুশের অর্থ জানাই আছে। কুশ ঘাস একবার জন্মালে ফসলের খেতকে-যে কীরকম নষ্ট করে সেও জানা কথা। আমি যে-মানেটা আন্দাজ করছি সেটা যদি একেবারেই অগ্রাহ্য না হয় তা হলে লবের সঙ্গে কুশের একত্র জন্মানোর ঠিক তাৎপর্য কী হতে পারে, এ কথা আমি পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি।”
১৩ই আগস্ট, ১৯২৭ তারিখের লেখাতে দেখা যাচ্ছে যে কবি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এই দীর্ঘযাত্রার ধকলে। এর মধ্যেও গীতার কথা —”ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। দিনের মধ্যে দু-তিনরকমের প্রোগ্রাম। নতুন নতুন জায়গায় বক্তৃতা নিমন্ত্রণ ইত্যাদি। গীতার উপদেশ যদি মানতুম, ফল লাভের প্রত্যাশা যদি না থাকত, তা হলে পালতোলা নৌকার মতো জীবনতরণী তীর থেকে তীরান্তরে নেচে নেচে যেতে পারত।”
প্রতিমা দেবীকে লেখা ৩০শে আগস্ট তারিখের চিঠিতে কবি বালি দ্বীপের কথা বলেছেন। এই দ্বীপে তখন কোন রেলযোগাযোগ ছিল না যাতায়াতের জন্য, কিন্তু মোটরগাড়ী ছিল। যাদের তাড়া, মোটরগাড়ীতেই ভ্রমণ সারতে হতো তাদের। কিন্তু কবির মতে এই দ্বীপের শান্তপরিবেশে ভ্রমণটা ধীরে সুস্থে হওয়াটাই ভাল। ”পথের দুধারে যেখানে রূপের মেলা সেখানকার নিমন্ত্রণ সারতে গেলে গরজের মোটরটাকে গারাজেই রেখে আসতে হয়। মনে নেই কি, শিকার করতে দুষ্যন্ত (মহাভারতের চরিত্র) যখন রথ ছুটিয়েছিলেন তখন তার বেগ কত; এই হচ্ছে যাকে বলে প্রোগ্রেস, লক্ষ্যভেদ করবার জন্য তাড়াহুড়ো। কিন্তু তপোবনের সামনে এসে তাঁকে রথ ফেলে নামতে হল, লক্ষ্যসাধনের লোভে নয়, তৃপ্তি সাধনের আশায়।”
বালিদ্বীপে প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির মূল যে কত গভীর, কবি কন্যা মীরাকে লেখা ৩১শে আগস্ট তারিখের চিঠিতে তার কিছু কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। রামায়ণ মহাভারত এখানকার মানুষদের কাছে বাইরের কোন জিনিস নয়, এটা তাদের একেবারে অন্তরের জিনিস। ”তার পরদিনে রাজবাড়ীর কয়েকজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত তালপাতার পুঁথিপত্র নিয়ে উপস্থিত। একটি পুঁথি মহাভারতের ভীষ্মপর্ব। এইখানকার অক্ষরেûই লেখা; উপরের পঙক্তি সংস্কৃত ভাষায়, নীচের পঙক্তিতে দেশীভাষায় তারই অর্থব্যাখ্যা। কাগজের একটি পুঁথিতে সংস্কৃত শ্লোক লেখা। সেই শ্লোক রাজা পড়ে যেতে লাগলেন, উচ্চারণের বিকৃতি থেকে বহু কষ্টে তাদের উদ্ধার করবার চেষ্টা করা গেল।”
অন্য একদিন—”এমন সময়ে হঠাৎ এসে থামল এক মোটরগাড়ী। গিয়ানয়ারের রাজা ও এই প্রদেশের একজন ওলন্দাজ রাজপুরুষ নেমে এলেন। … প্রসঙ্গক্রমে আপনিই মহাভারতের কথা উঠল। মহাভারতের যে কয়টা পর্ব এখনো এখানে পাওয়া যায় তাই তিনি অনেক ভেবে ভেবে আউরিয়ে গেলেন। বাকি পর্ব কী তাই তিনি জানতে চান। এখানে কেবল আছে, আদিপর্ব, বিরাটপর্ব, উদ্যোগপর্ব, ভীষ্মপর্ব, আশ্রমবাস পর্ব, মুষলপর্ব, প্রস্থানিক পর্ব, স্বর্গারোহণ পর্ব।
মহাভারতের কাহিনীগুলির উপরে এ দেশের লোকের চিত্ত বাসা বেঁধে আছে। তাদের আমোদে আহলাদে কাব্যে গানে অভিনয়ে জীবনযাত্রায় মহাভারতের সমস্ত চরিত্রগুলি বিচিত্রভাবে বর্তমান। অর্জুন এদের আদর্শ পুরুষ। এখানে মহাভারতের গল্পগুলি কিরকম বদলে গেছে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। সংস্কৃত মহাভারতের শিখণ্ডী এখানে শ্রীকান্তি নাম ধরেছে। শ্রীকান্তি অর্জুনের স্ত্রী। তিনি যুদ্ধের রথে অর্জুনের সামনে থেকে ভীষ্মবধে সহায়তা করেছিলেন। এই শ্রীকান্তি এখানে সতী স্ত্রীর আদর্শ।
গিয়ানয়ারের রাজা আমাকে অনুরোধ করে গেলেন, আজ রাত্রে মহাভারতের হারানো পর্ব প্রভৃতি পৌরাণিক বিষয় নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান।”
পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবি চিঠি লিখেছিলেন ১৯২৭ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। এই চিঠিতেও মহাভারতের কথা আছে। ”গ্রামে গ্রামে চলছে নাচ, গান, অভিনয় অভিনয়ের বিষয় প্রায়ই মহাভারত থেকে। এর থেকে বোঝা যাবে, গ্রামের লোকের পেটের খাদ্য ও মনের খাদ্যের বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। … সেদিন এখানকার এক রাজবাড়ীতে আমরা নাচ দেখছিলুম। খানিক বাদে শোনা গেল, এই নাচ-অভিনয়ের বিষয়টা হচ্ছে শাল্ব-সত্যবতীর আখ্যান।” আমাদের দেশে প্রচলিত মহাভারতে শাল্ব এবং সত্যবতী দুটি চরিত্রই আছে, তবে তাঁরা একে অপরকে কখনো দেখেছেন এরকম বর্ণনা আমাদের মহাভারতে নেই।
পুত্রবধু প্রতিমাদেবীকে কবি ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ তারিখে যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানেও এই দ্বীপভূমিতে প্রচলিত রামায়ণ মহাভারত নিয়ে অনেক কথা আছে। এখানকার মানুষেরা নাচকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। এইরকম বহু নাচের অনুষ্ঠানে কবি উপস্থিত ছিলেন। প্রতিমাদেবীকে তিনি লিখছেন—
”বৌমা, শেষ চিঠিতে তোমাকে এখানকার নাচের কথা লিখেছিলুম, ভেবেছিলুম নাচ সম্বন্ধে শেষ কথা বলা হয়ে গেল। এমন সময়ে সেই রাত্রে আর-এক নাচের বৈঠকে ডাক পড়ল। সেই অতিপ্রকাণ্ড মণ্ডপে আসর; বহুবিস্তীর্ণ শ্বেত পাথরের ভিত্তিতলে বিদ্যুদ্দীপের আলো ঝলমল করছে। আহারে বসবার আগে নাচের একটা পালা আরম্ভ হল—পুরুষের নাচ, বিষয়টা হচ্ছে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে হনুমানের লড়াই। এখানকার রাজার ভাই ইন্দ্রজিত সেজেছেন, ইনি নৃত্যবিদ্যায় ওস্তাদ।
হনুমান বনের জন্তু, ইন্দ্রজিত সুশিক্ষিত রাক্ষস, দুইজনের নাচের ভঙ্গিতে সেই ভাবের পার্থক্যটি বুঝিয়ে দেওয়া চাই, নইলে রসভঙ্গ হয়। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে সে হচ্ছে এদের সাজ। সাধারণত আমাদের যাত্রায় নাটকে হনুমানের হনুমানত্ব খুব বেশি করে ফুটিয়ে তুলে দর্শকদের কৌতুক উদ্রেক করবার চেষ্টা হয়। এখানে হনুমানের আভাসটুকু দেওয়াতে তার মনুষ্যত্ব আরো বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। হনুমানের নাচে লম্ফ-ঝম্ফ দ্বারা তার বানরস্বভাব প্রকাশ করা কিছুই কঠিন হত না, আর সেই উপায়ে সমস্ত সভা অনায়াসেই অট্টহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠত, কিন্তু কঠিন কাজ হচ্ছে হনুমানকে মহত্ত্ব দেওয়া। বাংলাদেশের অভিনয় প্রভৃতি দেখলে বোঝা যায় যে, হনুমানের বীরত্ব, তার একনিষ্ঠ ভক্তি ও আত্মত্যাগের চেয়ে তার লেজের দৈর্ঘ্য, তার পোড়ামুখের ভঙ্গিমা, তার বানরত্বই বাঙালির মনকে বেশি করে অধিকার করেছে। আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে তার উলটো। এমন-কি, হনুমানপ্রসাদ নাম রাখতে বাপমায়ের দ্বিধা বোধ হয় না। বাংলায় হনুমানচন্দ্র বা হনুমানেন্দ্র আমরা কল্পনা করতে পারি নে। এদেশের লোকেরাও রামায়ণের হনুমানের বড়ো দিকটাই দেখে। নাচে হনুমানের রূপ দেখলুম—পিঠ বেয়ে মাথা পর্যন্ত লেজ, কিন্তু এমন একটা শোভনভঙ্গি যে দেখে হাসি পাবার জো নেই। আর-সমস্তই মানুষের মতো। মুকুট থেকে পা পর্যন্ত ইন্দ্রজিতের সাজসজ্জা একটি সুন্দর ছবি। তার পরে দুইজনে নাচতে নাচতে লড়াই; সঙ্গে সঙ্গে ঢাকে-ঢোলে কাঁসরে-ঘণ্টায় নানাবিধ যন্ত্রে ও মাঝে মাঝে বহু মানুষের কণ্ঠের গর্জনে সংগীত খুব গম্ভীর প্রবল ও প্রমত্ত হয়ে উঠছে। অথচ, সে সংগীত শ্রুতিকটু একটুও নয়, বহুযন্ত্রসম্মিলনের সুশ্রাব্য নৈপুণ্য তার উদ্দামতার সঙ্গে চমৎকার সম্মিলিত।…..
আজ সকালে দশটার সময়ে আমাদের এখানেই গৃহকর্তা আর-একটি নাচের ব্যবস্থা করেছিলেন। মেয়ে দুজনে পুরুষের ভূমিকা নিয়েছিল। অর্জুন আর সুবলের যুদ্ধ। গল্পটা হয়তো মহাভারতে আছে কিন্তু আমার তো মনে পড়ল না। ব্যাপারটা হচ্ছে—কোন এক বাগানে অর্জুনের অস্ত্র ছিল, সেই অস্ত্র চুরি করেছে সুবল, সে খুঁজে বেড়াচ্ছে অর্জুনকে মারবার জন্যে। অর্জুন ছিল বাগানের মালী-বেশে। খানিকটা কথাবার্তার পরে দুজনের লড়াই। সুবলের কাছে বলরামের লাঙল অস্ত্রটা ছিল। যুদ্ধ করতে করতে অর্জুন সেটা কেড়ে নিয়ে তবে সুবলকে মারতে পারলে।
(অর্জুন-সুবলের এই লড়াই আমাদের প্রচলিত মহাভারতে নেই)।
সব-শেষে এলেন রাজার ভাই। এবার তিনি একলা নাচলেন। তিনি ঘটোৎকচ। হাস্যরসিক বাঙালি হয়তো ঘটোৎকচকে নিয়ে বরাবর হাসাহাসি করে এসেছে। এখানকার লোকচিত্তে ঘটোৎকচের খুব আদর। সেইজন্যেই মহাভারতের গল্প এদের হাতে আরো অনেকখানি বেড়ে গেল। এরা ঘটোৎকচের সঙ্গে ভার্গিবা (ভার্গবী) বলে এক মেয়ের ঘটালে বিয়ে। সে মেয়েটি আবার অর্জুনের কন্যা। বিবাহ সম্বন্ধে এদের প্রথা য়ুরোপের কাছাকাছি যায়। খুড়তোত জাঠতোত ভাইবোনে বাধা নেই। ভার্গিবার গর্ভে ঘটোৎকচের একটি ছেলেও আছে, তার নাম শশিকিরণ। যা হোক, আজকের নাচের বিষয়টা হচ্ছে, প্রিয়তমাকে স্মরণ করে বিরহী ঘটোৎকচের ঔৎসুক্য। এমন-কি, মাঝে মাঝে মূর্ছার ভাবে সে মাটিতে বসে পড়ছে, কল্পনায় আকাশে তার ছবি দেখে সে ব্যাকুল। অবশেষে আর থাকতে না পেরে প্রেয়সীকে খুঁজতে সে উড়ে চলে গেল। এর মধ্যে একটি ভাববার জিনিস আছে। য়ুরোপীয় শিল্পীর এঞ্জেলদের মতো এরা ঘটোৎকচের পিঠে নকল পাখা বসিয়ে দেয় নি। চাদরখানা নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে ওড়ার ভাব দেখিয়েছে। এর থেকে মনে পড়ে গেল শকুন্তলা নাটকে কবির নির্দেশবাক্য—রথবেগং নাটয়তি। বোঝা যাচ্ছে, রথবেগটা নাচের দ্বারাই প্রকাশ হত, রথের দ্বারা নয়।
রামায়ণের মহাভারতের গল্প এ দেশের লোকের মনকে জীবনকে যে কীরকম গভীরভাবে অধিকার করেছে তা এই কদিনেই স্পষ্ট বোঝা গেল। ভূগোলের বইয়ে পড়া গেছে, বিদেশ থেকে অনুকূল ক্ষেত্রে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের নতুন আমদানি হবার অনতিকাল পরেই দেখতে দেখতে তারা সমস্ত দেশকে ছেয়ে ফেলেছে; এমন-কি, যেখান থেকে তাদের আনা হয়েছে সেখানেও তাদের এমন অপরিমিত প্রভাব নেই। রামায়ণ-মহাভারতের গল্প এদের চিত্তক্ষেত্রে তেমনি করে এসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। চিত্তের এমন প্রবল উদবোধন কলারচনায় নিজেকে প্রকাশ না করে থাকতে পারে না। সেই প্রকাশের অপর্যাপ্ত আনন্দ দেখা দিয়েছিল বরোবুদরের মূর্তিকল্পনায়। আজ এখানকার মেয়েপুরুষ নিজেদের দেহের মধ্যেই যেন মহাকাব্যের পাত্রদের চরিতকথাকে নৃত্যমূর্তিতে প্রকাশ করছে, ছন্দে ছন্দে এদের রক্তপ্রবাহে সেই-সকল কাহিনী ভাবের বেগে আন্দোলিত।
এ ছাড়া কত রকম-বেরকমের অভিনয়, তার অধিকাংশই এই-সকল বিষয় নিয়ে। বাইরের দিকে ভারতবর্ষের থেকে এরা বহু শতাব্দী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন; তবু এতকাল এই রামায়ণ মহাভারত নিবিড়ভাবে ভারতবর্ষের মধ্যেই এদের রক্ষা করে এসেছে। ওলন্দাজরা এই দ্বীপগুলিকে বলে ‘ডাচ ইন্ডীস’, বস্তুত এদের বলা যেতে পারে ‘ব্যাস ইন্ডীস’।
পূর্বেই বলেছি, এরা ঘটোৎকচের ছেলের নাম রেখেছে শশিকিরণ। সংস্কৃত ভাষা থেকে নাম রচনা এদের আজও চলেছে। মাঝে মাঝে নামকরণ অদ্ভুতরকম হয়। …. এদের নামে যেমন বিশুদ্ধ ও সুগম্ভীর সংস্খৃত শব্দের ব্যবহার এমনতরো আমাদের দেশে দেখা যায় না। যেমন আত্মসুবিজ্ঞ, শাস্ত্রাত্ম, বীরপুস্তক, বীর্যসুশাস্ত্র, সহস্রপ্রবীর, বীর্যসুব্রত, পদ্মসুশাস্ত্র, কৃতাধিরাজ, সহস্রসুগন্ধ, পূর্ণপ্রণত, যশোবিদগ্ধ, চক্রাধিরাজ, মৃতসঞ্জয়, আর্যসুতীর্থ, কৃতস্মর, চক্রাধিব্রত, সূর্যপ্রণত, কৃতবিভব।
সেদিন যে-রাজার বাড়িতে গিয়েছিলেম তাঁর নাম সুসুহুনন পাকু-ভুবন। তাঁরই এক ছেলের বাড়িতে কাল আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল, তাঁর নাম অভিমন্যু। এঁদের সকলেরই সৌজন্য স্বাভাবিক নম্রতা সুন্দর। সেখানে মহাভারতের বিরাটপর্ব থেকে ছায়াভিনয়ের পালা চলছিল। ছায়াভিনয় এ দেশ ছাড়া আর কোথাও দেখি নি, অতএব বুঝিয়ে বলা দরকার। একটা সাদা কাপড়ের পট টাঙানো, তার সামনে একটা মস্ত প্রদীপ উজ্জ্বল শিখা নিয়ে জ্বলছে; তার দুই ধারে পাতলা চামড়ায় আঁকা মহাভারতের নানা চরিত্রের ছবি সাজানো, তাদের হাতপাগুলো দড়ির টানে নড়ানো যায় এমনভাবে গাঁথা। এই ছবিগুলি এক-একটা লম্বা কাঠিতে বাঁধা। একজন সুর করে গল্পটা আউড়ে যায়, আর সেই গল্প-অনুসারে ছবিগুলিকে পটের উপরে নানা ভঙ্গিতে নাড়াতে দোলাতে চালাতে থাকে। ভাবের সঙ্গে সংগতি রেখে গামেলান বাজে। এ যেন মহাভারতশিক্ষার একটা ক্লাসে পাঠের সঙ্গে ছবির অভিনয়-যোগে বিষয়টা মনে মুদ্রিত করে দেওয়া। মনে করো, এমনি করে যদি স্কুলে ইতিহাস শেখানো যায়, মাস্টারমশায় গল্পটা বলে যান আর একজন পুতুল-খেলাওয়ালা প্রধান প্রধান ব্যাপারগুলো পুতুলের অভিনয় দিয়ে দেখিয়ে যেতে থাকে, আর সঙ্গে সঙ্গে ভাব-অনুসারে নানা সুরে তালে বাজনা বাজে, ইতিহাস শেখাবার এমন সুন্দর উপায় কী আর হতে পারে।….
এই দেশের লোক ক্রমাগতই সুর ও নাচের সাহায্যে রামায়ণ মহাভারতের গল্পগুলিকে নিজের চৈতন্যের মধ্যে সর্বদাই দোলায়িত করে রেখেছে। এই কাহিনীগুলি রসের ঝরনাধারায় কেবলই এদের জীবনের উপর দিয়ে প্রবাহিত। রামায়ণ-মহাভারতকে এমনি নানাবিধ প্রাণবান উপায়ে সর্বতোভাবে আত্মসাৎ করবার চেষ্টা। শিক্ষার বিষয়কে একান্ত করে গ্রহণ ও ধারণ করবার প্রকৃষ্ট প্রণালী কী তা যেন সমস্ত দেশের লোকে মিলে উদ্ভাবন করেছে, রামায়ণ-মহাভরতকে গভীর করে পাবার আগ্রহে ও আনন্দেই এই উদ্ভাবনা স্বাভাবিক হল।”
প্রতিমা দেবীকে লিখিত চিঠিতে এই দ্বীপপুঞ্জের মানুষের রামায়ণ মহাভারতকে নিয়ে উন্মাদনার বিষয়টা অনেক পরিমাণে জানা গেল।
পরের চিঠিটি কবি লিখেছেন ওই ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখেই অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে। এই চিঠিতেও রামায়ণ মহাভারত নিয়ে আলোচনা আছে।
অমিয়, এখানকার দেখাশুনা প্রায় শেষ হয়ে এল। ভারতবর্ষের সঙ্গে জোড়াতাড়া দেওয়া এদের লোকযাত্রা দেখে পদে পদে বিস্ময় বোধ হয়েছে। রামায়ণ-মহাভারত এখানকার লোকের প্রাণের মধ্যে যে কীরকম প্রাণবান হয়ে রয়েছে সে-কথা পূর্বেই লিখেছি। প্রাণবান বলেই এ জিনিসটা কোনো লিখিত সাহিত্যের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি নয়। এখানকার মানুষের বহুকালের ভাবনা ও কল্পনার ভিতর দিয়ে তার অনেক বদল হয়ে গেছে। তার প্রধান কারণ, মহাভারতকে এরা নিজেদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনে প্রতিদিন ব্যবহার করেছে। সংসারের কর্তব্যনীতিকে এরা কোনো শাস্ত্রগত উপদেশের মধ্যে সঞ্চিত পায় নি, এই দুই মহাকাব্যের নানা চরিত্রের মধ্যে তারা যেন মূর্তিমান। ভালোমন্দ নানা শ্রেণীর মানুষকে বিচার করবার মাপকাঠি এই-সব চরিত্রে। এইজন্যেই জীবনের গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের এই জীবনের সামগ্রীর অনেকরকম বদল হয়েছে। কালে কালে বাঙালি গায়কের মুখে মুখে বিদ্যাপতি-চণ্ডিদাসের পদগুলি যেমন রূপান্তরিত হয়েছে এও তেমনি। কাল আমরা যে-ছায়াভিনয় দেখতে গিয়েছিলেম তার গল্পাংশটাকে টাইপ করে আমাদের হাতে দিয়েছিল। সেটা পাঠিয়ে দিচ্ছি, পড়ে দেখো। মূল মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে এটা বাংলায় তর্জমা করে নিয়ো। এ গল্পের বিশেষত্ব এই যে, এর মধ্যে দ্রৌপদী নেই। মূল মহাভারতের ক্লীব বৃহন্নলা এই গল্পে নারীরূপে ‘কেন-বর্দি’ নাম গ্রহণ করেছে। কীচক একে দেখেই মুগ্ধ হয় ও ভীমের হাতে মারা পড়ে। এই কীচক জাভানি মহাভারতে মৎস্যপতির শত্রু, পাণ্ডবেরা একে বধ করে বিরাটের রাজার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিল।
আমি মঙ্কুনগরো-উপাধিধারী যে-রাজার বাড়ির অলিন্দে বসে লিখছি চারি দিকে তার ভিত্তিগাত্রে রামায়ণের চিত্র রেশমের কাপড়ের উপর অতি সুন্দর করে অঙ্কিত। অথচ ধর্মে এরা মুসলমান। কিন্তু, হিন্দুশাস্ত্রের দেবদেবীদের বিবরণ এঁরা তন্ন তন্ন করে জানেন। ভারতবর্ষের প্রাচীন ভূ-বিবরণের গিরিনদীকে এঁরা নিজেদের দেশের মধ্যেই গ্রহণ করেছেন। বস্তুত, সেটাতে কোনো অপরাধ নেই, কেননা রামায়ণ-মহাভারতের নরনারীরা ভাবমূর্তিতে এদের দেশেই বিচরণ করছেন, আমাদের দেশে তাঁদের এমন সর্বজনব্যাপী পরিচয় নেই, সেখানে ক্রিয়াকর্মে উৎসবে আমোদে ঘরে ঘরে তাঁরা এমন করে বিরাজ করেন না।”
এর পরের চিঠিটি কবি লিখেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ১৯শে সেপ্টেম্বর তারিখে। এখানে শিবের কথা আছে, রামায়ণ মহাভারত নিয়েও কথা আছে। একটু উদ্ধৃত করি—
”আমাদের দেশে এক সময়ে শিবকে দুই ভাগ করে দেখেছিল। এক দিকে তিনি অনন্ত, তিনি সম্পূর্ণ, সুতরাং তিনি নিষ্ক্রিয়, তিনি প্রশান্ত; আর-এক দিকে তাঁরই মধ্যে কালের ধারা তার পরিবর্তন-পরম্পরা নিয়ে চলেছে, কিছুই চিরদিন থাকছে না, এইখানে মহাদেবের তাণ্ডবলীলা কালীর মধ্যে রূপ নিয়েছে। কিন্তু, জাভায় কালীর কোনো পরিচয় নেই। কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলারও কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। পুতনাবধ প্রভৃতি অংশ আছে কিন্তু গোপীদের দেখতে পাই নে। এর থেকে সেই সময়কার ভারতের ইতিহাসের কিছু ছবি পাওয়া যায়। এখানে রামায়ণ-মহাভারতের নানাবিধ গল্প আছে যা অন্তত সংস্কৃত মহাকাব্যে ও বাংলাদেশে অপ্রচলিত। এখানকার পণ্ডিতদের মত এই যে, জাভানিরা ভারতবর্ষে গিয়ে অথবা জাভায় সমাগত ভারতীয়দের কাছ থেকে লোকমুখে-প্রচলিত নানাগল্প শুনেছিল, সেইগুলোই এখানে রয়ে গেছে। অর্থাৎ, সে সময়ে ভারতবর্ষেই নানা স্থানে নানা গল্পের বৈচিত্র্য ছিল। আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের কোনো পণ্ডিতই রামায়ণ-মহাভারতের তুলনামূলক আলোচনা করেন নি। করতে গেলে ভারতের প্রদেশে প্রদেশে স্থানীয় ভাষায় যে-সব কাব্য আছে মূলের সঙ্গে সেইগুলি মিলিয়ে দেখা দরকার হয়। কোনো-এক সময়ে কোনো এক জার্মান পণ্ডিত এই কাজ করবেন বলে অপেক্ষা করে আছি। তার পরে তাঁর লেখার কিছু প্রতিবাদ কিছু সমর্থন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ডাক্তার উপাধি পাব।”
নির্মলকুমারী মহলানবীশকে কবি একটা চিঠি লিখেছিলেন ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ সালে। প্রধানত নাচের মাধ্যমে রাময়ণ কথার অভিনয় নিয়ে আলোচনা আছে এই চিঠিতে।
”কাল রাত্রে এক জায়গায় গিয়েছিলুম জটায়ুবধের অভিনয় দেখতে। দেখে এ দেশের লোকের মনের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা যাকে অভিনয় বলি তার প্রধান অংশ কথা, বাকি অংশ হচ্ছে নানাপ্রকার হৃদয়ভাবের সঙ্গে জড়িত ঘটনাবলীর প্রতিরূপ দেখানো। এখানে তা নয়। এখানে প্রধান জিনিস হচ্ছে ছবি এবং গতিচ্ছন্দ। কিন্তু, সেই ছবি বলতে প্রতিরূপ নয়, মনোহর রূপ। আমরা সংসারে যে দৃশ্য সর্বদা দেখি তার সঙ্গে খুব বেশি অনৈক্য হলেও এদের বাধে না। পৃথিবীতে মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে চলাফেরা করে থাকে। এই অভিনয়ে সবাইকে বসে বসে চলতে ফিরতে হয়। সেও সহজ চলাফেরা নয়, প্রত্যেক নড়াচড়া নাচের ভঙ্গিতে। মনে মনে এরা এমন একটা কল্পলোক সৃষ্টি করেছে যেখানে সবাই বসার অবস্থায় নেচে বেড়ায়। এই পঙ্গু মানুষের দেশ যদি প্রহসনের দেশ হত তা হলেও বুঝতুম। একেবারেই তা নয়, এ মহাকাব্যের দেশ। এরা স্বভাবকে খাতির করতে চায় না। স্বভাব তার প্রতিশোধস্বরূপে যে এদের বিদ্রূপ করবে, এদের হাস্যকর করে তুলবে, তাও ঘটল না। স্বভাবের বিকারকেও এরা সুদৃশ্য করবে, এই এদের পণ। ছবিটাই এদের লক্ষ্য, স্বভাবের অনুকরণ এদের লক্ষ্য নয়, এই কথাটা এরা যেন স্পর্ধার সঙ্গে বলতে চায়। মনে করো না কেন, প্রথম দৃশ্যটা রাজসভায় দশরথ ও তাঁর অমাত্যবর্গ। রঙ্গভূমিতে এরা সবাই গুঁড়ি মেরে প্রবেশ করল। মনে হয়, এর চেয়ে অদ্ভুত কিছুই হতে পারে না। ব্যাপারটাকে হাস্যকরতা থেকে বাঁচানো কত কঠিন ভেবে দেখো। কিন্তু, এতে আমরা বিরূপ কিছুই দেখলুম না, এরা দশরথ কিংবা রাজামাত্য সে কথাটা সম্পূর্ণ গৌণ হয়ে গেল। পরের দৃশ্যে কৈকেয়ী প্রভৃতি রানী আর সখীরা তেমনি করেই বসা-অবস্থায় হেলে দুলে নেচে নেচে প্রবেশ করলে। আট-নয় বছরের ছেলেরা সব কৌশল্যা প্রভৃতি রানী সেজেছে। এদিকে কৌশল্যার ছেলে রাম যে সেজেছে তার বয়স অন্তত পঁচিশ হবে, এটা যে কত বড়ো অসংগত সে প্রশ্ন কারও মনেই আসে না, কেননা, এরা দেখছে ছবির নাচ। যতক্ষণ সেটাতে কোনো দোষ ঘটছে না ততক্ষণ নালিশ করবার কোনো হেতু নেই।”
”কাল রাত্রে এই রঙ্গক্ষেত্রের বহিরঙ্গনে কত যে লোক জমেছে তার সংখ্যা নেই। নিঃশব্দে তারা দেখেছে, শুধু কেবল দেখারই সুখ। তাদের মনের মধ্যে রামায়ণের গল্প আছে, সেই গল্পের ধারার সঙ্গে ছবির ধারা মিলে কল্পনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এর মধ্যে আশ্চর্যের বিষয়টা হচ্ছে এই যে, যে-ছবিটা দেখছে সেটাতে গল্পকে ফুটিয়ে তোলবার কোনো চেষ্টা নেই। রামের যৌবরাজ্যে কৈকেয়ী রাগ করেছে, কিন্তু যেরকম ভাবভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে আমাদের চোখে কানে রাগের ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ছবির মধ্যে তার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আট-দশ বছরের ছেলে স্ত্রীবেশে কৈকেয়ী সাজলে তার মধ্যে কৈকেয়ীর লেশমাত্র থাকা অসম্ভব। তবু এরা তাতে কোনো অভাব বোধ করে না।”
রাশিয়ার চিঠি : কবি রাশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। রাশিয়ায় বিশেষ করে দুটি জিনিস কবিকে মুগ্ধ করেছিল এক, ‘ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব, দুই, শিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার। শিক্ষাকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সরকারী প্রয়াস তাঁর ভালো লেগেছিল। রাশিয়া ভ্রমণের সময় এবং তার পরেও রাশিয়া নিয়ে তিনি যে সমস্ত চিঠিপত্র লিখেছিলেন তাতে এইসব বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে। রামায়ণ মহাভারত প্রসঙ্গ খুব সামান্য সামান্যভাবে কখনো-সখনো এসেছে।
ইউরোপ ভ্রমণ, রাশিয়া ভ্রমণ ইত্যাদি সব একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াতে তাঁকে অনেকদিন দেশের বাইরে থাকতে হয়েছিল। ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩০ তারিখের চিঠিতে মজা করে তিনি লিখেছিলেন—”দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো আমাদের দেশে যাবার সময়কে যতই টান মারছে ততই অফুরান হয়ে বেড়ে চলেছে।” —দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কাহিনী মহাভারতে আছে। আমন্ত্রিত হয়ে যুধিষ্ঠির কৌরবরাজসভায় এসেছিলেন পাশাখেলায় অংশগ্রহণের জন্য। দুর্যোধনের হয়ে ধূর্ত শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাশাখেলায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং সেই খেলার পণে যুধিষ্ঠির সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। দ্রৌপদীও বিজিতা হয়েছিলেন। কর্ণ দুর্যোধনের উসকানিতে দুরাত্মা দুঃশাসন ক্ষণপূর্বের ভারত সম্রাজ্ঞীকে কেশ আকর্ষণ করে সভামধ্যে নিয়ে এসে তাঁকে বিবস্ত্রা করতে চেয়েছিল। এই চরম বিপদে দ্রৌপদী কৃষ্ণের শরণ নিয়েছিলেন এবং অলৌকিক উপায়ে তাঁর লজ্জা রক্ষা হয়েছিল। দ্রৌপদীর পরিধেয় বস্ত্র অফুরান হয়েছিল এবং দুঃশাসন প্রাণপণে দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণ করেও তাঁকে বিবস্ত্রা করতে পারেনি। সমসাময়িককালে কৃষ্ণ-বলরাম রক্ষিত যাদবদের চাইতে সামরিকশক্তিতে বেশী বলবান আর কোনো রাজা ভারতবর্ষে ছিলেন না। হতে পারে শ্রীকৃষ্ণের ভয়েই ধৃতরাষ্ট্র দুঃশাসনকে নিবৃত্ত করেছিলেন।
১৯৩০ সালের ২রা অক্টোবর বার্লিন থেকে কবি যে চিঠিটা লিখেছিলেন সেখানে রাশিয়ার কৃষিব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা আছে। এই প্রসঙ্গে কবি মহাভারতের কৃষ্ণ-বলরামের কথা বলেছেন। ”আমাদের দেশে কোনো-এক সময়ে গোবর্ধনধারী কৃষ্ণ বোধ হয় ছিলেন কৃষির দেবতা, গোয়ালার ঘরে তাঁর বিহার, তাঁর দাদা বলরাম, হলধর। ঐ লাঙল-অস্ত্রটা হল মানুষের যন্ত্রবলের প্রতীক। কৃষিকে বলদান করেছে যন্ত্র। আজকের দিনে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের কোনো কিনারায় বলরামের দেখা নেই, তিনি লজ্জিত। যে দেশে তাঁর অস্ত্রে তেজ আছে সেই সাগরপারে তিনি চলে গেছেন। রাশিয়ার কৃষি বলরামকে ডাক দিয়েছে, দেখতে দেখতে সেখানকার কেদারখণ্ডগুলো অখণ্ড হয়ে উঠল, তাঁর নতুন হলের স্পর্শে অহল্যাভূমিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে।
একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত, রামেরই হলযন্ত্রধারী রূপ হচ্ছে বলরাম।”
রাশিয়া থেকে ফিরে কবি আমেরিকা চলেছেন জাহাজে। রাশিয়ায় যা দেখেছেন তা তখনো তাঁর মনকে আলোড়িত করে চলেছে। জাহাজ থেকে ৩রা অক্টোবরের চিঠিতে তিনি লিখেছেন এইসব আর উদাহরণ দিয়েছেন পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের (সমুদ্রমন্থন বৃত্তান্ত আগে বলা হয়েছে)। ”য়ুরোপে অন্য সকল দেশেরই সাধনা ব্যক্তির লাভকে, ব্যক্তির ভোগকে নিয়ে। তারই মন্থন-আলোড়ন খুবই প্রচণ্ড, আর পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের মতোই তার থেকে বিষ ও সুধা দুইই উঠছে। কিন্তু সুধার ভাগ কেবল এক দলই পাচ্ছে, অধিকাংশই পাচ্ছে না এই নিয়ে অসুখ-অশান্তির সীমা নেই। সবাই মেনে নিয়েছিল এইটেই অনিবার্য, বলেছিল মানবপ্রকৃতির মধ্যেই লোভ আছে এবং লোভের কাজই হচ্ছে ভোগের মধ্যে অসমান ভাগ করে দেওয়া। অতএব প্রতিযোগিতা চলবে এবং লড়াইয়ের জন্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকা চাই। কিন্তু সোভিয়েটরা যা বলতে চায় তার থেকে বুঝতে হবে মানুষের মধ্যে ঐক্যটাই সত্য, ভাগটাই মায়া …।”
রাশিয়ার যে সবকিছুই ভালো—এটা অবশ্য কবি ভাবেননি। উপসংহার অংশে তাঁর লেখার মধ্যে সমালোচনার সুর লক্ষ্য করা যায়। ”রাশিয়া যে কাজে লেগেছে এ হচ্ছে যুগান্তরের পথ বানানো, পুরাতন বিধিবিশ্বাসের শিকড়গুলো তার সাবেক জমি থেকে উপড়ে দেওয়া, চিরভ্যাসের আরামকে তিরস্কৃত করা।… মানবপ্রকৃতিতে সাধনা করে বশ করবার অপেক্ষা আছে, এ কথা ভুলে যায়, মনে করে, তাকে তার আশ্রয় থেকে ছিঁড়ে নিয়ে একটা সীতাহরণ ব্যাপার করে তাকে পাওয়া যেতে পারে। তার পরে লঙ্কায় আগুন লাগে তো লাগুক।” (রামায়ণ যারা পড়েছেন তারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে সীতাকে হরণ করে নিয়ে এলেও রাবণ তাকে পান নি।)
মানুষের ধর্ম : এই প্রবন্ধগুলিতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ বেশ ভালোরকমই আছে। এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধেই (সুলভ ১০ম, পৃ. ৬২১) কবি গীতার প্রসঙ্গ এনেছেন। ”ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁছেছে বিশ্বমানসলোকে। … সফলতার জন্যে সে মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম নিয়ে বাহ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েছিল, অবশেষে সার্থকতালাভের জন্যে একদিন সে বললে, তপস্যা বাহ্যানুষ্ঠানের নয়, সত্যই তপস্যা, গীতার ভাষায় ঘোষণা করলে, দ্রব্যময় যজ্ঞের চেয়ে জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেয় (১) খ্রীষ্টের বাণীতে শুনলে, বাহ্য বিধিনিষেধে পবিত্রতা নয়, পবিত্রতা চিত্তের নির্মলতায়। তখন মানবের রুদ্ধ মনে বিশ্বমানবচিত্তের উদবোধন হল। এই তার অন্তরসত্তার বোধ দৈহিক সত্তার ভেদসীমা ছাড়িয়ে দেশে কালে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের দিকে প্রসারিত। এই বোধেরই শেষ কথা এই যে, যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মধ্যে আপনার আত্মাকে জানে সেই জানে সত্যকে (২)।
(১) দ্রব্যময় যজ্ঞের চেয়ে জ্ঞান যজ্ঞই শ্রেয়—এই কথাটির সঙ্গে গীতার যে শ্লোকটির যোগ সেটি মনে হয় এইটি—
”শ্রেয়ান দ্রব্যময়াদ যজ্ঞাজ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ।
সর্বং কর্ম্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।”
(হে মহাবীর অর্জুন! দ্রব্যময় যজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞ ভালো, কারণ সমস্ত কর্ম জ্ঞানের বিকাশে পরিসমাপ্ত হয়) (চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৩ সংখ্যক শ্লোক)
(২) সম্পর্কিত গীতার শ্লোকটি মনে হয় ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ২৯ সংখ্যক শ্লোক।
”সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।”
(নিজেকে সর্বজীবে সমদর্শী হইয়া আত্মাকে সর্বভূতস্থিত দেখেন, আর সর্বভূতকে আত্মাতে সমদর্শন করেন)। এই বিষয়টি পূর্ব অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এই প্রবন্ধেরই অন্য একটি জায়গায় (সুলভ-১০ম, পৃ. ৬২২) কবি আবারও গীতার কথা বলেছেন। ”মানুষও আপন অন্তরের গভীরতর চেষ্টার প্রতি লক্ষ করে অনুভব করেছে যে, সে শুধু ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্মা। সেই বিরাট মানব ‘অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম’। সেই বিশ্বমানবের প্রেরণায় ব্যক্তিগত মানুষ এমন সকল কাজে প্রবৃত্ত হয় যা তার ভৌতিক সীমা অতিক্রমণের মুখে। যাকে সে বলে ভালো, বলে সুন্দর, বলে শ্রেষ্ঠ—কেবল সমাজরক্ষার দিক থেকে নয়—আপন আত্মার পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তির দিক থেকে।”
উপরে উল্লিখিত সংস্কৃত শব্দগুলো গীতার একটি শ্লোকের অংশ। মূল শ্লোকটি রয়েছে গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে (ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগঃ) —১৭ সংখ্যক শ্লোক।
”অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।”
(যিনি সর্বভূতে অবিভক্ত অথচ বিভক্তের ন্যায় স্থির আছেন; তিনি সর্বভূতকে ভরণ করেন, প্রলয়কালে গ্রাস করেন, সৃষ্টিকালে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হল এবং সকলেরই তিনিই মূল কারণ।)
১ নং প্রবন্ধে (পৃ. ৬২৮) রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের একটা শ্লোকের আংশিক উল্লেখ করেছেন—’ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম—মানব ধর্মের গভীর সত্য নিহিত আছে গোপনে।’ মূল শ্লোকটি আছে মহাভারতের বনপর্বে।
”বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্না।
নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।
ধর্মস্য তত্বং নিহিতং গুহায়াং
মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ।।”
পাণ্ডবদের বারো বছরের বনবাসপর্ব প্রায় শেষ হয়ে এসেছে—তাঁরা অজ্ঞাতবাস নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। এই সময় ধর্মদেব একদিন পাণ্ডবদের ধর্মে নিষ্ঠা, শাস্ত্রজ্ঞান ইত্যাদি পরীক্ষা করেছিলেন। বকপক্ষীরূপে তিনি একটা সরোবরের তীরে অপেক্ষা করছিলেন। পাণ্ডবেরা একে একে জলের সন্ধানে সেই সরোবরের তীরে এসেছিলেন (কাশীরামদাসের গ্রন্থে দ্রৌপদীর নামও আছে কিন্তু মূল গ্রন্থে দ্রৌপদীর উল্লেখ নেই) বকপক্ষী বা যক্ষের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জলস্পর্শ করাতে যুধিষ্ঠির বাদে সবাই প্রাণ হারালেন, পরে যুধিষ্ঠির যখন সকলের সন্ধানে সেখানে এলেন তখন পক্ষী তাঁকেও জলস্পর্শ করার আগে তাঁর প্রশ্নের উত্তর চাইলেন। মূল মহাভারতে যক্ষের বহু প্রশ্ন ছিল, কাশীরাম দাসের গ্রন্থে মাত্র চারটি প্রশ্নের উল্লেখ আছে।
”কা চ বার্তা কিমাশ্চর্যং কঃ পন্থাঃ কশ্চ মোদতে।” এর মধ্যে তৃতীয় প্রশ্ন ছিল কঃ পন্থা অর্থাৎ কোনটাকে পথ বলা যায়। উপরে লিখিত শ্লোকটি এই তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর। কাশীরামের গ্রন্থে এই শ্লোকটির সুন্দর অনুবাদ করা রয়েছে—
”বেদ আর স্মৃতিশাস্ত্র একমত নয়।
স্বেচ্ছামত নানা মুনি নানা মত কয়।।
কে জানে নিগূঢ় ধর্মতত্ব নিরূপণ।
সেই পথ গ্রাহ্য, যাহে যায় মহাজন।।”
ঐ একই প্রবন্ধের অন্যত্র (সুলভ ১০ম, পৃ. ৬৩১) কবি আবার গীতার কথা বলেছেন। ”মানুষের যে সংসার তার অহং-এর ক্ষেত্র সে দিকে তার অহংকার ভূরিতায়, যে দিকে তার আত্মা সে দিকে তার সার্থকতা ভূমায়। একদিকে তার গর্ব স্বার্থসিদ্ধিতে, আর-এক দিকে তার গৌরব পরিপূর্ণতায়। সৌন্দর্য্য কল্যাণ বীর্য ত্যাগ প্রকাশ করে মানুষের আত্মাকে, অতিক্রম করে প্রাকৃত মানুষকে, উপলব্ধি করে জীবমানবের অন্তরতম বিশ্বমানবকে। যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।”
উপরের সংস্কৃত শব্দকয়টি গীতার একটি শ্লোকের অংশ (ষষ্ঠ অধ্যায় ২২ সংখ্যক শ্লোক।) সম্পূর্ণ শ্লোকটি অর্থসহ নীচে দেওয়া হল।
”যং লব্ধবা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।।”
(যে অবস্থা লাভ করিলে তিনি অন্য সব লাভকেই তুচ্ছ বলিয়া মনে করেন এবং কোনো প্রকার কর্মতেই বিচলিত হন না, তাহাই যোগ)।
দ্বিতীয় প্রবন্ধে আবার গীতার কথা বলেছেন কবি (সুলভ ১০ম, পৃ. -৬৩৫)। ”উপনিষদ বলেন, মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন পূর্বমর্ষৎ। তিনি মনকে ইন্দ্রিয়কে ছাড়িয়ে চলে গেছেন। ছাড়িয়ে যদি না যেতেন তবে পদে পদে মানুষও আপনাকে ছাড়িয়ে যেত না। অথর্ববেদ বলেছেন এই ‘আরো’র দিকে, এই ছাড়িয়ে যাবার দিকে মানুষের শ্রী, তার ঐশ্বর্য, তার মহত্ব।
তাই মানবদেবতার সম্বন্ধে এই কথা শুনি—
যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশ সম্ভবম্।
যা কিছুতে ঐশ্বর্য আছে, শ্রী আছে, শ্রেষ্ঠতা আছে, সে আমারই তেজের অংশ থেকে সম্ভূত।”
এটি গীতার দশম অধ্যায়ের (বিভূতি যোগঃ) ৪১ সংখ্যক শ্লোক।
এই দ্বিতীয় প্রবন্ধের অন্য জায়গায় (সুলভ ১০ম, পৃ. ৬৩৮) কবি রামায়ণের কথা আলোচনায় এনেছেন। ”মনে করা যাক, সবই হল, ভৌতিক শক্তির পূর্ণতাই ঘটল। তবু কি মানুষ বলতে ছাড়বে ‘ততঃ কিম্।’ রামায়ণে বর্ণিত দশাননের শরীরে মানবের স্বভাবসিদ্ধ দেহশক্তি বহুগুণিত হয়েছিল, দশ দিক থেকে আহরিত ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়েছিল স্বর্ণলঙ্কাপুরী। কিন্তু মহাকাব্যে শেষ জায়গাটা সে পেল না। তার পরাভব হল রামচন্দ্রের কাছে। অর্থাৎ বাহিরে যে দরিদ্র, আত্মায় যে ঐশ্বর্যবান, তার কাছে। সংসারে এই পরাভব আমরা যে সর্বদা প্রত্যক্ষ করে থাকি তা নয়, অনেক সময়ে তার বিপরীত দেখি, তবু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মানুষ একে পরাভব বলে।”
একটু পরে কবি মহাভারত থেকে আংশিক শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন তার আলোচনার মধ্যে। ”যেহেতু ভগবান সর্বগত, সকলকে নিয়ে আছেন, সেইজন্যেই তিনি শিব। সমগ্রের মধ্যেই শিব, শিব ঐক্যবন্ধনে। আচারীরা সামাজিক কৃত্রিম বিধির দ্বারা যখন খণ্ডতার সৃষ্টি করে তখন কল্যাণকে হারায়, তার পরিবর্তে যে কাল্পনিক পদার্থ দিয়ে আপনাকে ভোলায় তার নাম দিয়েছে পুণ্য। সেই পুণ্য আর যাই হোক সে শিব নয়। সেই সমাজবিধি আত্মার ধর্মকে পীড়িত করে। ‘স্বলক্ষণন্তু যো বেদ স মুনিঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে।’ আত্মার লক্ষণকে যে জানে সেই মুনি, সেই শ্রেষ্ঠ। আত্মার লক্ষণ হচ্ছে শুভবুদ্ধি, যে শুভবুদ্ধিতে সকলকে এক করে।”
এই আংশিক শ্লোকটি মহাভারত থেকে নেওয়া। উদ্যোগপর্বের সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল—”মৌনান্নস মুনির্ভবতি নারণ্যবসনান্মুনিঃ।
স্বলক্ষণন্তু যো বেদ স মুনিঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে।।”
মৌন অবলম্বন করে বা সন্ন্যাসীর মতো বনে বাস করলেই মুনি হওয়া যায় না। যিনি ব্রহ্মের লক্ষণ জানেন, তাকেই মুনি বলা যায়।
(মহাভারতম্ চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ৪৬১)
এর পরেও রামায়ণ মহাভারতের কথা এই প্রবন্ধে অনেক আছে। পাশ্চাত্যের লোকেরা বলে—nothing is unfair in love and war, কিন্তু প্রাচীন ভারতবর্ষের নীতি এটা নয়। সেখানে যুদ্ধের সময়েও কিছু নিয়ম মেনে চলা হতো। এই প্রবন্ধে (পৃ. ৬৩৯) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
”আমাদের ধর্মশাস্ত্রে বলে, যুদ্ধকালে যে মানুষ রথে নেই, যে আছে ভূতলে, রথী তাকে মারবে না! যে ক্লীব, যে কৃতাঞ্জলি, যে মুক্তকেশ, যে আসীন, যে সানুনয়ে বলে ‘আমি তোমারই’, তাকেও মারবে না। যে ঘুমচ্ছে, যে বর্মহীন, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে অযুধ্যমান, যে যুদ্ধ দেখছে মাত্র, যে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত, তাকেও মারবে না। যার অস্ত্র গেছে ভেঙে, যে শোকার্ত, যে পরিক্ষত, যে ভীত, যে পরাবৃত্ত, সত্যের ধর্ম অনুসরণ করে তাকেও মারবে না।”
মহাভারতের ভীষ্ম একাধিকবার এইরকম কথা বলেছেন। কুরুপিতামহ ভীষ্ম যে দশদিন কৌরবপক্ষের প্রধান সেনাপতি ছিলেন, ততদিন যুদ্ধে কোনো নীতিহীনতা প্রকাশ পায়নি। যুদ্ধ আরম্ভের পূর্বেই তিনি যুধ্যমান দুইপক্ষেরই পালনীয় কিছু নিয়ম করেছিলেন। যুদ্ধে ভীষ্মের পরাক্রম পাণ্ডবদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। নবমদিনের যুদ্ধশেষে পাণ্ডবেরা তাই ভীষ্মের কাছেই গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্মের বধোপায় ভীষ্মকেই জিজ্ঞাসা করতে। স্নেহপরায়ণ ভীষ্ম তখন এই সমস্ত নিয়মের কথা বলেছিলেন যুদ্ধকালে যেগুলো তিনি নিজে অনুসরণ করেন।
এই কথাগুলোই আরো বিস্তৃত কর রবীন্দ্রনাথ বলছেন—
”সত্যের ধর্ম বলতে বোঝায় মানুষের মধ্যে যে সত্য তাঁরই ধর্ম, মানুষের মধ্যে যে মহৎ তাঁরই ধর্ম। যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে ছোটো দিকে তার জিত হলেও বড়ো দিকে তার হার। উপকরণের দিকে তার সিদ্ধি, অমৃতের দিকে সে বঞ্চিত, এই অমৃতের আদর্শ মাপজোখের বাইরে।
স্বর্ণলঙ্কার মাপজোখ চলে। দশাননের মুণ্ড ও হাত গণনা করে বিস্মিত হবার কথা। তার অক্ষৌহিণী সেনারও সংখ্যা আছে, জয়বিস্তারের পরিধি-দ্বারা সেই সেনার শক্তিও পরিমেয়। আত্মার মহিমার পরিমাণ নেই। শত্রুকে নিধনের পরিমাপ আছে, শত্রুকে ক্ষমার পরিমাপ নেই। আত্মা যে মহার্ঘতায় আপন পরিচয় দেয় ও পরিচয় পায় সেই পরিচয়ের সত্য কি বিরাজ করে না অপরিমেয়ের মধ্যে, যাকে অথর্ববেদ বলেছেন সকল সীমার উদবৃত্ত, সকল শেষের উৎশেষ। সে কি এমন একটি স্বয়ম্ভূব বুদবুদ কোনো সমুদ্রের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই। মানুষের কাছে শুনেছি, ‘ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ’—তোমার প্রতি পাপ যে করে তার প্রতি ফিরে পাপ কোরো না। কথাটাকে ব্যবহারে ব্যক্তিবিশেষ মানে বা নাই মানে, তবু মন তাকে পাগলের প্রলাপ বলে হেসে ওঠে না। মানুষের জীবনে এর স্বীকৃতি দৈবাৎ দেখি, প্রায় দেখি বিরুদ্ধতা, অর্থাৎ মাথা গুনতি করে এর সত্য চোখে পড়ে না বললেই হয়। তবে এর সত্যতা কোনখানে। মানুষের যে স্বভাবে এটা আছে তার আশ্রয় কোথায়। মানুষ এ প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছে শুনি—
যস্যাত্মা বিরতঃ পাপাৎ কল্যাণে চ নিবেশিতঃ
তেন সর্বমিদং বুদ্ধং প্রকৃতির্বিকৃতিশ্চ যা।
আত্মা যার পাপ থেকে বিরত ও কল্যাণে নিবিষ্ট তিনি সমস্তকে বুঝেছেন। তাই তিনি জানেন কোনটা স্বভাবসিদ্ধ, কোনটা স্বভাববিরুদ্ধ।
মানুষ আপনার স্বভাবকে তখনই জানে যখন পাপ থেকে নিবৃত্ত হয়ে কল্যাণের অর্থাৎ সর্বজনের হিতসাধনা করে। অর্থাৎ মানুষের স্বভাবকে জানে মানুষের মধ্যে যারা মহাপুরুষ। জানে কী করে। ‘তেন সর্বমিদং বুদ্ধম্।’ স্বচ্ছ মন দিয়ে সমস্তটাকে সে বোঝে। সত্য আছে, শিব আছে সমগ্রের মধ্যে। যে পাপ অহংসীমাবদ্ধ স্বভাবের তার থেকে বিরত হলে তবে মানুষ আপনার আত্মিক সমগ্রকে জানে, তখনই জানে আপনার প্রকৃতি। তার এই প্রকৃতি কেবল আপনাকে নিয়ে নয়, তাঁকেই নিয়ে যাঁকে গীতা বলছেন, তিনিই পৌরুষংনৃষু। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব। মানুষ এই পৌরুষের প্রতিই লক্ষ করে বলতে পারে, ধর্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ম জিতম। মৃত্যুতে সেই পৌরুষকে সে প্রমাণ করে যা তার দেবত্বের লক্ষণ, যা মৃত্যুর অতীত।”
উপরে উল্লিখিত শ্লোকটি মহাভারতের উদ্যোগপর্বে আছে।
‘পৌরুষং নৃষু’—কবি যেটা উপরে বলেছেন, সেটা গীতার একটি শ্লোকের অংশ। শ্লোকটি আছে গীতার সপ্তম অধ্যায়ে (জ্ঞানবিজ্ঞানযোগঃ)। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল—
‘রসোহহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্য্যয়োঃ।
প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।।
(হে অর্জুন! আমিই জল মধ্যে রস, আমিই চন্দ্রসূর্যোর প্রভা, আমিই সকল বেদে প্রণব, আমিই আকাশে শব্দ এবং আমিই মানবমধ্যে পুরুষকার।)
‘ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ’ মহাভারতের বনপর্বের শ্লোকের একটি অংশ। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল—
ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ সাধুরেব সদা ভবেৎ।
আত্মনৈব হতঃ পাপো যঃ পাপং কর্তুমিচ্ছতি।।
এই গ্রন্থের ৩ নং প্রবন্ধে কবি বলেছেন গীতার সেই মহাবানী ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’। তিনি লিখেছেন—”একটিমাত্র প্রদীপ অন্ধকারে একটুমাত্র ছিদ্র করলে তাতে রাত্রির ক্ষয় হয় না, সমস্ত অন্ধকারের অপসারনে রাত্রির অবসান। সেইজন্যে মানুষের মুক্তি যে মহাপুরুষেরা কামনা করেছেন তাঁদেরই বাণী ”সম্ভবামি যুগে যুগে।”
গীতার এই শ্লোকটি বহু শ্রুত, বহু পঠিত, বহু চর্চিত। বস্তুতপক্ষে চতুর্থ অধ্যায়ের (জ্ঞানযোগঃ) দুটি শ্লোকের এখানে উল্লেখ করতে হবে—৭ সংখ্যক ও ৮ সংখ্যক শ্লোক।
”যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।। (৭)
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।” (৮)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন