সুলভ সংস্করণের এই খণ্ড সমস্তটাই রবীন্দ্রনাথের অচলিত রচনার সংকলন। সন্ধ্যাসঙ্গীতের পূর্ববর্তী কোনো রচনাই কবির মতে তাঁর রচনাবলীতে স্থান পাবার যোগ্য নয়। পরবর্তীকালের অনেক লেখাও তিনি পুনঃপ্রকাশযোগ্য মনে করেন নি। যে রচনাগুলির পুনঃপ্রকাশ বা পুনর্মুদ্রণ কবির অভিপ্রেত ছিল না, সেইগুলি রচনাবলীতে সংকলনের কী প্রয়োজন ছিল, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে এই গ্রন্থের সম্পাদনা যিনি করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় শ্রী চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের যুক্তিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং সেগুলি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি। এই খণ্ডে সংকলিত গ্রন্থগুলি হলো—
(১) আলোচনা— ছয়টি গদ্য প্রবন্ধ এখানে সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ।
(২) সমালোচনা—ষোলোটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এখানে এবং এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে।
(৩) মন্ত্রি-অভিষেক—এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি ১২৯৭ সালে প্রকাশিত হয়।
(৪) ব্রহ্মমন্ত্র—এই লেখাটি কবি শান্তিনিকেতনে দশম সাম্বৎসরিক ব্রহ্মোৎসব উপলক্ষে পাঠ করেছিলেন (১৩০৭ সাল)।
(৫) ঔপনিষদ ব্রহ্ম— এটির প্রকাশকাল ১৩০৮ সাল।
এ ছাড়া আর যে সমস্ত গ্রন্থ এই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে সেগুলোকে পাঠ্যপুস্তক বলা যায়। এগুলিকে অচলিত রচনা বলা ঠিক নয়, কারণ এই গ্রন্থগুলি সবই ব্যবহারের উপযোগী। গ্রন্থগুলি হলো—সংস্কৃত শিক্ষা (দ্বিতীয় ভাগ); ইংরাজী-সোপান—উপক্রমণিকা, প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ ও তৃতীয় ভাগ; ইংরাজী-শ্রুতিশিক্ষা— প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ; ইংরাজী-সহজশিক্ষা— প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ; অনুবাদ-চর্চা; সহজ পাঠ— প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ; ইংরাজী পাঠ (প্রথম); এবং আদর্শ প্রশ্ন। তাছাড়া আছে গ্রন্থপরিচয় অংশ। এই সমস্ত গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ খুব কমই আছে। যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে এখন আলোচনা করা হচ্ছে।
আলোচনা—ভগবান শিব হচ্ছেন দেবাদিদেব। হিন্দুদের তিনি একজন প্রধান দেবতা। রামায়ণ মহাভারতে শিবের উল্লেখ বহু জায়গাতেই আছে। তিনি অবশ্য রামায়ণ মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহের নিয়ন্ত্রক নন বা তাঁকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিতও হয়নি। মনে হয় ‘ত্যাগী’ শিব রবীন্দ্রনাথের বিশেষ পছন্দের চরিত্র এবং তাঁর রচনার বহু জায়গাতেই তিনি শিবের কথা উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থের ‘একটি রূপক’ নামক লেখাতে কবি শিবের কথা বলেছেন—
”অনেক লোক আছেন, তাঁহারা জগতের সর্বত্রই অমঙ্গল দেখেন। তাঁহাদের মুখে জগতের অবস্থা যেরূপ শুনা যায়, তাহাতে তাহার আর এক মূহূর্ত টিকিয়া থাকিবার কথা নহে। সর্বত্রই যে শোক-তাপ দুঃখ-যন্ত্রণা দেখিতেছি এ কথা অস্বীকার করা য়ায় না, কিন্তু তবুও তো জগতের সংগীত থামে নাই। তাহার কারণ জগতের প্রাণের মধ্যে গভীর আনন্দ বিরাজ করিতেছে। সে আনন্দ-আলোক কিছুতেই আচ্ছন্ন করিতে পারিতেছে না বরঞ্চ যত কিছু শোক-তাপ সেই দীপ্ত আনন্দে বিলীন হইয়া যাইতেছে। শিবের সহিত জগতের তুলনা হয়। অসীম অন্ধকার দিক-বসন পরিয়া ভূতনাথ-পশুপতি জগৎ-এর কোটি কোটি ভূত লইয়া অনন্ত তাণ্ডবে উন্মত্ত। কন্ঠের মধ্যে বিষ পূর্ণ রহিয়াছে, তবু নৃত্য। বিষধর সর্প তাঁহার অঙ্গের ভূষণ হইয়া রহিয়াছে। তবু নৃত্য। মরণের রঙ্গভূমি শ্মশানের মধ্যে তাঁহার বাস, তবু নৃত্য। মৃত্যুস্বরূপিণী কালী তাঁহার বক্ষের উপর সর্বদা বিচরণ করিতেছেন, তবু তাঁহার আনন্দের বিরাম নাই। যাহার প্রাণের মধ্যে অমৃত ও আনন্দের অনন্ত প্রস্রবণ, এত হলাহল এত অমঙ্গল তিনিই যদি ধারণ করিতে না পারিবেন তবে আর কে পারিবে। সর্পের ফণা, হলাহলের নীলদ্যুতি বাহির হইতে দেখিয়া আমরা শিবকে দুঃখী মনে করিতেছি, কিন্তু তাঁহার জটাজালের মধ্যে প্রচ্ছন্ন চিরস্রোত অমৃতনিস্যন্দিনী পুণ্যভাগীরথীর আনন্দ-কল্লোল কি শুনা যাইতেছে না? নিজের ডমরুধ্বনিতে, নিজের অস্ফূট হর্ষগানে উন্মত্ত হইয়া নিজে যে অবিশ্রাম নৃত্য করিতেছেন, তাহার গভীর কারণ কী দেখিতে পাইতেছি? বাহিরের লোকে তাঁহাকে দরিদ্র বলিয়া মনে করে বটে, কিন্তু তাঁহার গৃহের মধ্যে দেখো দেখি, অন্নপূর্ণা চিরদিন অধিষ্ঠান করিতেছেন। আর ঐ যে মলিনতা দেখিতেছ, শ্মশানের ভস্ম দেখিতেছ, মৃত্যুর চিহ্ন দেখিতেছ, ও কেবল উপরে—ঐ শ্মশানভস্মের মধ্যে আচ্ছন্ন রজতগিরিনিভ চারুচন্দ্রাবতংস অতি সুন্দর অমর বপু দেখিতেছ না কি? উনি যে মৃতুঞ্জয়। আর, মৃত্যুকে কি আমরা চিনি? আমরা মৃত্যুকে করালদশনা লোলরসনা মূর্তিতে দেখিতেছি, কিন্তু ঐ মৃত্যুই ইহার প্রিয়তমা। ঐ মৃত্যুকে বক্ষে ধরিয়া ইনি আনন্দে বিহ্বল হইয়া আছেন, কালীর যথার্থ স্বরূপ আমাদের জানিবার কোনো সম্ভাবনা নাই, আমাদের চক্ষে তিনি মৃত্যু-আকারে প্রতিভাত হইতেছেন, কিন্তু ভক্তেরা জানেন কালীও যা গৌরীও তাই। আমরা তাঁহার করালমূর্তি দেখিতেছি, কিন্তু তাঁহার মোহিনীমূর্তি কেহ কেহ বা দেখিয়া থাকিবেন। শিবকে সকলে যোগী বলে। ইনি কাহার যোগে নিমগ্ন রহিয়াছেন?
যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে,
বিভূতিভূষিত শুভ্রদেহ, নাচিছ, দিক্-বসনে!
মহা আনন্দে পুলককায়,
গঙ্গা উথলি উছলি যায়,
ভালে শিশু শশী হাসিয়া চায়,
জটাজুট ছায় গগনে!”
‘তত্ত্বের বার্ধক্য’ রচনাটিতে কবি লিখেছেন—’তত্ত্ব অর্থাৎ জ্ঞান পুরাতন হইয়া যায়, মৃত হইয়া যায়, মিথ্যা হইয়া যায়।…. বাল্মীকির সময়ে যে সকল তত্ত্ব সত্য বলিয়া প্রচলিত ছিল, তাহাদের অনেকগুলি এখন মিথ্যা বলিয়া স্থির হইয়াছে, কিন্তু সেই প্রাচীন ঋষি-কবি হৃদয়ের যে চিত্র দিয়াছেন তাহার কোনোটাই এখনো অপ্রচলিত হয় নাই।”
এই গ্রন্থে ‘স্বর্গের সামগ্রী’ নামক লেখাতে কবি বলেছেন—”পৃথিবীতে সৌন্দর্যের উৎকর্ষ দেখিলে উহাকে স্বর্গচ্যুত বলিয়া গোঁজামিল দিয়া না লইলে যেন হিসাব মিলে না। এইজন্য অজ ও ইন্দুমতী সুরলোকবাসী, পৃথিবীতে নির্বাসিত।”
অজ ও ইন্দুমতী রামায়ণের চরিত্র—দশরথের পিতা এবং মাতা।
সমালোচনা— এই গ্রন্থের ‘তার্কিক’ প্রবন্ধের এক জায়গায় কবি ‘মান্ধাতার আমল’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। মান্ধাতার কথা রামায়ণে আছে। মান্ধাতার আমল বললে খুব প্রাচীনকাল বোঝায়।
‘বিজ্ঞতা’ প্রবন্ধে কবি তথাকথিত বিজ্ঞ মানুষদের সমালোচনা করেছেন। ”হে বিজ্ঞগণ, তোমরাও খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু একটা বিষয় তোমাদের জানা নাই— পৃথিবীতে সিধা জিনিসও অনেক আছে। …. হায় হায়! জন্মেজয় যখন সর্পসত্র করিয়াছিলেন তখন কি গোটাকতক ঢোঁড়া সাপই মরিয়াছিল, তোমাদের মতো বিষাক্ত বুদ্ধিমান সাপগুলা ছিল কোথায়?”
জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ মহাভারতের কাহিনী। অর্জুনের প্রপৌত্র হচ্ছেন জন্মেজয়। তাঁর পিতা পরীক্ষিৎ-এর সর্পদংশনে মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণার্থে জন্মেজয় সর্পকুল ধ্বংসের জন্য যজ্ঞ করেছিলেন।
মেঘনাদবধ কাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের এক কালজয়ী সৃষ্টি। কিন্তু অল্পবয়সে রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যের অত্যন্ত নির্মম সমালোচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন এবং জীবনস্মৃতিতে তিনি এই কাব্যকে ‘অমর কাব্য’ আখ্যায় ভূষিত করেছিলেন।
মাইকেল মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনী রামায়ণ থেকে আহরণ করলেও সেই কাহিনীকে তিনি উপস্থাপিত করেছেন সম্পূর্ণ নূতনভাবে। তাঁর কাব্যে রাবণ এবং তাঁর সহযোগীরা মহিমান্বিত হয়েছেন আর রামচন্দ্র ও তাঁর পক্ষীয়দের চরিত্রের অবমূল্যায়ণ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একুশ বৎসর বয়সে রচিত (১২৮৯ সাল) এই প্রবন্ধটিতে মেঘনাদবধ কাব্যের বিরুদ্ধে যে সব মন্তব্য করেছেন সেগুলো এই গ্রন্থের আলোচনার বিষয় নয়। এই প্রবন্ধে তিনি রামায়ণ মহাভারত বা বাল্মীকির সম্বন্ধে যে সমস্ত কথা বলেছেন, এই আলোচনাতে শুধু সেগুলিরই উল্লেখ করবো।
‘আমরা যতগুলি ট্রাজেডি দেখিয়াছি সবগুলিতেই প্রায় শেষকালে একটা না একটা মৃত্যু আছে। তাহা হইতেই সাধারণত লোকে সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছে, শেষকালে মরণ না থাকিলে আর ট্র্যাজেডি হয় না। শেষকালে মিলন হইলেই আর ট্র্যাজেডি হইল না। পাত্রগণের মিলন অথবা মরণ, সে তো কাব্যের বাহ্য আকার মাত্র, তাহাই লইয়া কাব্যের শ্রেণী নির্দেশ করিতে যাওয়া দূরদর্শী লক্ষণ নহে। যে অনিবার্য নিয়মে সেই মিলন বা মরণ সংঘটিত হইল, তাহারই প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে হইবে। মহাভারতের অপেক্ষা মহান ট্র্যাজেডি কে কোথায় দেখিয়াছে? স্বর্গরোহণকালে দ্রৌপদী ও ভীমার্জুন প্রভৃতির মৃত্যু হইয়াছিল বলিয়াই যে মহাভারত ট্র্যাজেডি তাহা নহে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ এবং শত সহস্র রাজা ও সৈন্য মরিয়াছিল বলিয়াই যে মহাভারত ট্র্যাজেডি তাহা নহে—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন পান্ডবদিগের জয় হইল তখনি মহাভারতের যথার্থ ট্র্যাজেডি আরম্ভ হইল। তাঁহারা দেখিলেন জয়ের মধ্যেই পরাজয়। এত দুঃখ, এত যুদ্ধ, এত রক্তপাতের পর দেখিলেন হাতে পাইয়া কোনো সুখ নাই, পাইবার জন্য উদ্যমেই সমস্ত সুখ; যতটা করিয়াছেন তাহার তুলনায় যাহা পাইলেন তাহা অতি সামান্য; এত দিন যুঝাযুঝি করিয়া হৃদয়ের মধ্যে একটা বেগবান অনিবার উদ্যমের সৃষ্টি হইয়াছে, যখনই ফল লাভ হইল তখনই সে উদ্যমের কার্যক্ষেত্র মরুময় হইয়া গেল, হৃদয়ের মধ্যে সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত উদ্যমের হাহাকার উঠিতে লাগিল; কয়েক হস্ত জমি মিলিল বটে, কিন্তু হৃদয়ের দাঁড়াইবার স্থান তাহার পদতল হইতে ধসিয়া গেল, বিশাল জগতে এমন স্থান সে দেখিতে পাইল না যেখানে সে তাহার উপার্জিত উদ্যম নিক্ষেপ করিয়া সুস্থ হইতে পারে! ইহাকেই বলে ট্র্যাজেডি।”
”মহাকাব্য পড়িয়া আমরা তাহার রচনাকালের যথার্থ উন্নতি অনুমান করিয়া লইতে পারি। আমরা বুঝিতে পারি সেই সময়কার উচ্চতম আদর্শ কী ছিল। কাহাকে তখনকার লোকেরা মহত্ত্ব বলিত। আমরা দেখিতেছি হোমরের সময়ে শারীরিক বলকেই বীরত্ব বলিত, শারীরিক বলের নামই ছিল মহত্ত্ব। বাহুবলদৃপ্ত একিলিসই ইলিয়ডের নায়ক ও যুদ্ধবর্ণনাই তাহার আদ্যোপান্ত। আর আমরা দেখিতেছি বাল্মীকির সময়ে ধর্মবলই যথার্থ মহত্ত্ব বলিয়া গণ্য ছিল— কেবল মাত্র দাম্ভিক বাহুবলকে তখন ঘৃণা করিত। হোমরে দেখো একিলিসের ঔদ্ধত্য, একিলিসের বাহুবল, একিলিসের হিংস্রপ্রবৃত্তি; আর রামায়ণে দেখো একদিকে রামের সত্যের অনুরোধে আত্মত্যাগ, একদিকে লক্ষ্মণের প্রেমের অনুরোধে আত্মত্যাগ, এক দিকে বিভীষণের ন্যায়ের অনুরোধে সংসারত্যাগ। রামও যুদ্ধ করিয়াছেন, কিন্তু সেই যুদ্ধঘটনাই তাঁহার সমস্ত চরিত্র ব্যাপ্ত করিয়া থাকে নাই, তাহা তাঁহার চরিত্রের সামান্য এক অংশ মাত্র। ইহা হইতেই প্রমাণ হইতেছে, হোমরের সময়ে বলকেই ধর্ম বলিয়া জানিত ও বাল্মীকির সময়ে ধর্মকেই বল বলিয়া জানিত।”
”একবার বাল্মীকির ভাষা পড়িয়া দেখো দেখি, বুঝিতে পারিবে মহাকবির ভাষা কিরূপ হওয়া উচিৎ, হৃদয়ের সহজ ভাষা কাহাকে বলে?”
‘নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”
”কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালোবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিকা পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিত্যন্ত হ্রস্ব দেখায়। অশিক্ষিতদের কুগঠিত কল্পনাদর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসংগত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকেরা কবি, তবে নিতান্ত বালকের মতো কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভালো কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই, বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষরূপে কবি। তুমি বলো দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন জাতির মধ্যে ভালো কবিতা আছে যে জাতি সভ্য হয় নাই। যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল তখন প্রাচীন কাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারও মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে?”
‘কাব্যের অবস্থা পরিবর্তন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটা ভালো কথা বলেছেন। এখন মহাকাব্যের যুগ অতীত হয়ে গেছে। এখন ব্যক্তি নহে, এখন সমষ্টির যুগ। ”কবিতাও সে নিয়মের বহির্ভূত নহে। সভ্য দেশের কবিতা এখন যদি তুমি আলোচনা করিতে চাও তবে একটা কাব্য, একটি কবির দিকে চাহিয়ো না। যদি চাও তো বলিবে ‘এ কী হইল! এ তো যথেষ্ট হইল না! এ দেশে কি তবে এই কবিতা?’ বিরক্ত হইয়া হয়তো প্রাচীন সাহিত্য অন্বেষণ করিতে যাইবে। যদি মহাভারত কি রামায়ণ কি গ্রীসীয় একটা কোনো মহাকাব্য নজরে পড়ে, তবে বলিবে—’পর্যাপ্ত হইয়াছে! প্রচুর হইয়াছে!’ এক মহাভারত বা এক রামায়ণ পড়িলেই তুমি প্রাচীন সাহিত্যের সমস্ত ভাবটি পাইলে। কিন্তু এখন সে দিন গিয়াছে। ….. মনে করো ইংলণ্ড। ইংলণ্ডে যত কবি আছে সকলকে মিলাইয়া লইয়া এক বলিয়া ধরিতে হইবে। ইংলণ্ডে যে কবিতা-পাঠক-শ্রেণী আছেন, তাঁহাদের হৃদয়ের এক-একটা মহাকাব্য রচিত হইতেছে। ….পাঠকেরাই এই মহাকাব্যের বেদব্যাস।”
মন্ত্রী অভিষেক পুস্তিকাটিতে রামায়ণ মহাভারতের কোনো প্রসঙ্গ নেই।
ব্রহ্মমন্ত্র রচনাটিতে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের মহাকবি বাল্মীকির সম্বন্ধে লিখেছেন—”কোনো রসজ্ঞ ব্যক্তি যখন বলেন কাব্যরসাবতারণায় বাল্মীকি শ্রেষ্ঠ কবি, তখন এ কথা বুঝিলে চলিবে না যে, কেবল তাঁহারই নিকট বাল্মীকির কাব্যরস সর্বাপেক্ষা উপাদেয়। তিনি বলেন সকল পাঠকের পক্ষেই এই কাব্যরস সর্বশ্রেষ্ঠ— ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতি। কিন্তু কোনো অশিক্ষিত গ্রাম্য জনপদ বাল্মীকির কাব্য অপেক্ষা যদি স্থানীয় কোনো পাঁচালিগানে অধিক সুখ অনুভব করে তবে তাহার কারণ তাহার অজ্ঞতামাত্র। সে লোক অশিক্ষাবশত বাল্মীকির কাব্য যে কী তাহা জানে না এবং সেই কাব্যের রস যেখানে, অনভিজ্ঞতাবশত সেখানে সে প্রবেশলাভ করিতে পারে না। কিন্তু তাহার অশিক্ষা-বাধা দূর করিয়া দিবামাত্র যখনই সে বাল্মীকির কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবে তখনই সে স্বভাবতই মানবপ্রকৃতির নিজগুণেই গ্রাম্য পাঁচালী অপেক্ষা বাল্মীকির কাব্যকে রমণীয় বলিয়া জ্ঞান করিবে।”
এই কথাগুলো ঔপনিষদ ব্রহ্ম পুস্তিকাটিতেও আছে।
পাঠ্যপুস্তক সংস্কৃতশিক্ষা (দ্বিতীয় ভাগ), ইংরাজী সোপান, ইংরেজী শ্রুতিশিক্ষা, ইংরেজী সহজশিক্ষা, অনুবাদ—চর্চা ও সহজপাঠ প্রথম ভাগ —এই গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ কিছু নেই। সহজ পাঠ (দ্বিতীয় ভাগ) গ্রন্থের প্রথম পাঠে খুব সাধারণভাবে মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের উল্লেখ আছে—সংসারবাবুর বাড়িতে কংসবধের অভিনয় হবে। এই কংস সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের মাতুল। শ্রীকৃষ্ণের হাতেই এই অত্যাচারী রাজার পতন ঘটে। এই গ্রন্থে আর কোথাও রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ নেই। ইংরাজী-পাঠ (প্রথম) গ্রন্থেও রামায়ণ মহাভারতের কথা কিছু নেই।
আদর্শ প্রশ্ন— গ্রন্থপরিচয় অংশে লেখা হয়েছে ‘জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যা-বিতরণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী লোকশিক্ষা সংসদের পাঠ্যতালিকা-অবলম্বনে রচিত আদর্শ প্রশ্ন — প্রথম ভাগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ১৯৪০ সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বভারতীর Bulletin No.-27 রূপে প্রকাশিত।” আদর্শ প্রশ্নের পরিশিষ্ট অংশে যে প্রশ্নপত্রাবলী মুদ্রিত আছে সেগুলি ‘১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়-শিক্ষা-পরিষৎ বা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন কর্তৃক অনুষ্ঠিত পরীক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ কৃত প্রশ্নপত্রাবলী’। প্রশ্নগুলি তৎকালীন এনট্রান্স পরীক্ষা বা ফার্স্ট আর্টস সমতুল্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।
স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচী থেকে রামায়ণ মহাভারতের কথা রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্য করেন নি। অনেক জায়গাতেই তিনি লিখেছেন যে বালক-বালিকাদের তিনি রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী শুনিয়েছেন বা পড়িয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর তৈরী করা প্রশ্নে রামায়ণ মহাভারতের কথা আছে। সেগুলিই এখানে উদ্ধৃত করছি। এগুলো অনেকের কাছেই অপরিচিত তাই কারো কারো কৌতূহলের উদ্রেক হতে পারে।
আদ্য পরীক্ষা
বাংলাভাষা ও সাহিত্য
(ক) পদ্য
বাংলা কাব্য পরিচয়
রামায়ণ : অযোধ্যাকাণ্ড
রামনির্বাসন গদ্য ভাষায় যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত করে লেখো। নমুনা—
অযোধ্যার রাজা দশরথ একদা পাত্রমিত্রগণকে ডেকে বললেন, স্থির করেছি কাল রামের রাজ্যাভিষেক হবে; আজ তার আয়োজন করা আবশ্যক।
কৈকেয়ীর এক চেড়ী ছিল তার নাম মন্থরা, সে ভরতের ধাত্রীমাতা। সে ঈর্ষান্বিতা হয়ে কৈকেয়ীকে গিয়ে বললে, ভরতকে এড়িয়ে রামকে যদি রাজা করা যায় তা হলে অপমানে দুঃখের সাগরে ডুবে মরবি, এর প্রতিবিধান করতে হবে।
প্রথমে কৈকেয়ী এ কথায় কান দেন নি কিন্তু বার বার তাঁকে উত্তেজিত করাতে তার মন বিগড়ে গেল, তিনি মন্থরাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী উপায় করা যেতে পারে।
মন্থরা তাঁকে মনে করিয়ে দিলে, এক সময় তাঁর ব্রণক্ষতের শুশ্রূষায় সন্তুষ্ট হয়ে দশরথ কৈকেয়ীকে দুটি বর দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন। আজ সেই প্রতিশ্রুতি পালন উপলক্ষে এক বরে রামের চোদ্দো বৎসর নির্বাসন, আর এক বরে ভরতকে রাজ্যদান প্রার্থনা করতে হবে।
বাকি অংশের সূচি —
কৈকেয়ী সম্ভাষণে কৈকেয়ীর ঘরে দশরথের গমন।
ভূতলশায়িনী কৈকেয়ীর ক্ষুব্ধ অবস্থায় দশরথ যখন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার উপলক্ষে তাঁর ক্ষোভের কারণ দূর করতে স্বীকৃত হলেন, তখন শুশ্রূষাকালীন পূর্ব প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে কৈকেয়ীর দুই বর প্রার্থনা। শুনে রাজার দুঃখবিহ্বল অবস্থা।
এদিকে অভিষেক সভার বিলম্ব দেখে অন্তঃপুরে এসে দশরথের কাছে সারথি সুমন্ত্রের কারণ জিজ্ঞাসা।
কৈকেয়ী-কর্তৃক সমস্ত ঘটনাবিবৃতি ও রাজার কাছ থেকে সত্যপালনের দাবি।
সুমন্ত্রের কাছ থেকে সমস্ত বিবরণ শুনে অন্তঃপুরে গিয়ে পিতার সত্যরক্ষার জন্য রামের কথা দেওয়া।
অন্যায় সত্য-লঙ্ঘনের জন্য ক্রুদ্ধ লক্ষ্মণের অনুরোধ। পিতৃসত্য-রক্ষায় রামের দৃঢ় সংকল্প। রামের বনযাত্রায় সীতা ও লক্ষ্মণের অনুগমন।
মহাভারত
মহাভারতের দ্যূতক্রীড়ার বিবরণ পূর্বোক্ত রীতিতে যথাসম্ভব সংক্ষেপে লেখো।
এই বইতে উল্লিখিত পরের প্রশ্নটি তৈরী করা হয়েছিল Seventh standard পরীক্ষার জন্য। রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ যেখানে আছে সেগুলিই শুধু উল্লেখ করছি।
Seventh Standard Examination, 1906
bengali
Second Paper
Full marks- 50
Paperset by – babu rabindra nath tagore
Examiner – pandit tarakumar kavairatna
১।
(গ) রাম লক্ষ্মণের চরিত্র তুলনা করিয়া প্রবন্ধ লিখ।
৪। নিম্নোদ্ধৃত (ক) ও (খ) দুইটি কাব্যাংশের মধ্যে যেটি ইচ্ছা গদ্যে প্রকাশ করো। গদ্য রচনারীতির প্রয়োজনানুসারে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ও নূতন যোজনা অসঙ্গত হইবে না।—
(ক) (কুরুক্ষেত্রে অভিমন্যুর মৃত দেহ)
দেখিলেন কুরুক্ষেত্র শোকের সাগর।
শবচক্র মহাবেলা; প্রশস্ত প্রাঙ্গণ
ব্যাপিয়া পাণ্ডবসৈন্য, ঊর্মির মতন
উদ্বেলিত মহাশোকে, কাঁদে অধোমুখে, —
গুণহীন ধনু, পৃষ্ঠে শরহীন তূণ।
রথী মহারথিগণ বসিয়া ভূতলে
কাঁদিতেছে অধোমুখে, যেন আভাহীন
সিক্ত রত্নরাজি পরি রত্নাকরতলে।
বাণবিদ্ধমীন-মতো পাণ্ডব সকল
করিতেছে গড়াগড়ি পড়িয়া ভূতলে।
মূর্চ্ছিত বিরাটপতি; স্তম্ভিত প্রাঙ্গণ।
কেন্দ্রস্থলে অভিমন্যু, শরের শয্যায়,—
সিদ্ধকাম মহাশিশু! ক্ষত কলেবর
রক্তজবাসমাবৃত; সস্মিত বদন
মায়ের পবিত্র অঙ্কে করিয়া স্থাপিত,
—সন্ধ্যাকাশে যেন স্থির নক্ষত্র উজ্জ্বল—
নিদ্রা যাইতেছে সুখে। বক্ষে সুলোচনা
মূর্চ্ছিতা; মূর্চ্ছিতা পদে পড়িয়া উত্তরা,
সহকার-সহ ছিন্না ব্রততীর মতো।
কেবল দুইটি নেত্র শুষ্ক, বিস্ফারিত,
এই মহাশোকক্ষেত্রে; কেবল অচল
এই মহাশোকক্ষেত্রে একটি হৃদয়;
সেই নেত্র, সেই বুক, মাতা সুভদ্রার।
চাপি মৃত পুত্রমুখ মায়ের হৃদয়ে
দুই করে, বিস্ফারিত নেত্রে প্রীতিময়,
যোগস্থা জননী চাহি আকাশের পানে—
আদর্শবীরত্ববক্ষে প্রীতির প্রতিমা।
উদ্ধৃতাংশটি মহাভারত থেকে নয় তবে যেহেতু অভিমন্যু এবং অন্যান্য মহাভারতীয় চরিত্রের উল্লেখ আছে, তাই এখানে রাখলাম।
এবারের প্রশ্ন Fifth Standard পরীক্ষার —
The National Council of Education,
Bengal
Fifth Standard Examination, 1906
Bengali
Second Paper
Full Marks : 50
Paper Set By :— Babu rabindra nath tagore
babu kshirodprasad vidyabinode, m.a.
Examiners –Babu purna chandra de. b.a.
babu kshetramohan sen gupta.
n.b. candidates are required to answer any Three out of the four question of this paper.
১। প্রবন্ধ-রচনা
(ক) ছিনু মোরা সুলোচনে গোদাবরীতীরে,
কপোত কপোতী যথা উচ্চবৃক্ষচূড়ে
বাঁধি নীড় থাকে সুখে; ছিনু ঘোর বনে,
নাম পঞ্চবটী, মর্তে সুরবনসম।
গোদাবরীতীরে স্থিত রাম ও সীতার কুটীর এমন বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করো, যেন তাহা স্বচক্ষে দেখিতেছ; অর্থাৎ কুটীরের সম্মুখবর্তী নদীর তটভাগ কিরূপ, তাহার সমীপবর্তী বনে কি কি গাছ কিরূপে অবস্থিত, কুটীরের মধ্যে কোথায় কি আছে তাহা প্রত্যক্ষবৎ লিখ।
৪। (খ) নিম্নোদ্ধৃত যে কোনো একটি কাব্যাংশ গদ্যে প্রকাশ করো। বাক্যগুলিকে পূর্ণতর করিবার জন্য আবশ্যকমত পরিবর্তন বা নূতন কিছু যোজনা করিলে অবিহিত হইবে না।
(১) (যজ্ঞশালায় গোপনে প্রবিষ্ট লক্ষ্মণের দ্বারা আক্রান্ত নিরস্ত্র ইন্দ্রজিৎ বিভীষণকে দ্বাররোধ করিতে দেখিয়া কহিলেন)—
”হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, শূলীশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ, ভ্রাতৃপুত্র রাঘববিজয়ী?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমনভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
উত্তরিলা বিভীষণ,—”বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?”
উত্তরিলা কাতরে রাবণি,—
”হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে।
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ওমুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহো তা দাসেরে
কেবা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজকাননে;
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
তবে, হে বীরকেশরি, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে?”
উদ্ধৃতাংশটি রামায়ণ থেকে নয় যদিও রামায়ণের চরিত্ররা উপস্থিত।
Fifth Standard Examination, 1907
Bengali
Second Paper
Full Marks : 50
Paper Set By :— Babu rabindra nath tagore
babu kshirod prasad vidyabinode, m.a.
Examiner – Babu Amulya Charan Vidyabhushan.
১। ”রাম রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন এবং অপ্রতিহত প্রভাবে রাজ্যশাসন ও অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।”
সমস্ত সমাসগুলি ভাঙিয়া উল্লিখিত বাক্যটিকে লিখ। —অথবা—
সমাসব্যবহার-দ্বারা ও সর্বপ্রকারে নিম্নলিখিত বাক্যটিতে সংহত করো—
যাঁহার হৃদয় সরল, যাঁহার আচার শুদ্ধ, পতিই যাঁহার প্রাণ এমন স্ত্রীলোককে, কোনো অপরাধ করেন নাই জানিয়াও যখন আমি অনায়াসে বিসর্জন দিতে উদ্যত হইয়াছি তখন এমন কে আছে যে আমা অপেক্ষা মহাপাতকী।
২। ‘সীতার বনবাস’ গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাটিকে অল্প কয়েক ছত্রের মধ্যে লিখ।
অথবা—
পুরাণে গঙ্গার উৎপত্তি সম্বন্ধে যে প্রবাদ আছে, তাহার সহিত কবি হেমচন্দ্রের বর্ণনার কি প্রভেদ দেখাইয়া দাও।
৫। নিম্নোদ্ধৃত অংশ সরল ভাষায় লিখ—
তদনন্তর মুনিশ্রেষ্ঠ বাল্মীকি সীতাসহিত জনবৃন্দমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া রামকে এইরূপ বলিতে লাগিলেন, ”হে দাশরথে, ধর্মচারিণী এই সীতা লোকপবাদহেতু আমার আশ্রমসমীপে পরিত্যক্তা হইয়াছিলেন। এই অপাপা পতিপরায়ণা তোমার নিকট প্রত্যয় প্রদান করিবেন।” রাম বাল্মীকি কর্তৃক এইরূপ কথিত হইয়া এবং সেই দেববর্ণিনী জানকীকে দেখিয়া, কৃতাঞ্জলিপূর্বক, জনগণের সমক্ষে এইরূপ বলিতে লাগিলেন, ”হে ধর্মজ্ঞ, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহাই সত্য। আপনার পবিত্র বাক্যেই আমার প্রত্যয় হইতেছে। এই জানকীকে আমি পবিত্রা মনে জানিয়াও শুদ্ধ লোকপবাদভয়ে ত্যাগ করিয়াছি। কিন্তু আপনি আমাকে ক্ষমা করিবেন, সীতা শপথ-দর্শন-জন্য কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া সকলে সমাগত হইয়াছেন।” তখন কাষায়বস্ত্রপরিধানা সীতা সকলকে সমাগত দেখিয়া অধোমুখী অধোদৃষ্টি এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া এইরূপ কহিতে লাগিলেন, ”আমি রাম ভিন্ন জানি না, আমার এই বাক্য যদি সত্য হয়, তবে পৃথিবীদেবী আমাকে বিবর প্রদান করুন।” বৈদেহী এইরূপ শপথ করিলে দিব্য সিংহাসন সহসা রসাতল হইতে আবির্ভূত হইল এবং সেই স্থলে পৃথিবীদেবী সীতাকে দুই বাহু-দ্বারা গ্রহণ করিলেন। সিংহাসনারূঢ়া সীতাকে রসাতলে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তদুপরি স্বর্গ হইতে পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল।
অথবা, নিম্নলিখিত বাক্যাংশ গদ্য করিয়া লিখ—
বিলাপ করেন রাম লক্ষ্মণের আগে,
ভূলিতে না পারি সীতা সদা মনে জাগে।
রাজ্যচ্যুত আমাকে দেখিয়া চিন্তান্বিতা
হরিলেন পৃথিবী কি আপন দুহিতা?
রাজ্যহীন যদ্যপি হয়েছি আমি বটে
রাজলক্ষ্মী তথাপি ছিলেন সন্নিকটে।
আমার সে রাজলক্ষ্মী হারাইল বনে,
কৈকেয়ীর মনোভীষ্ট সিদ্ধ এতদিনে।
সৌদামিনী যেমন লুকায় জলধরে
লুকাইল তেমন জানকী বনান্তরে।
কনকলতার প্রায়, জনকদুহিতা
বনে ছিল কে করিল তারে উৎপাটিতা।
দিবাকর নিশাকর দীপ্ত তারাগণ
দিবানিশি করিতেছে তমো নিবারণ,
তারা না হরিতে পারে তিমির আমার—
এক সীতা বিহনে সকল অন্ধকার।।
উল্লিখিত কবিতার তৃতীয় ছত্রে চিন্তান্বিতা শব্দটি কাহার বিশেষণ?
এই কাব্যাংশটি চিনতে কোন ভূল হওয়ার কথা নয়—কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে নেওয়া।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন