অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড

অষ্টম অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড)

এই খণ্ডে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি স্থান পেয়েছে—

কবিতা ও গান : মহুয়া, বনবানী, পরিশেষ, সংযোজন ও পুনশ্চ;

নাটক ও প্রহসন : বসন্ত, রক্তকরবী ও চিরকুমার সভা;

উপন্যাস ও গল্প : গল্পগুচ্ছ

প্রবন্ধ : শান্তিনিকেতন; এবং

গ্রন্থপরিচয় : অংশ।

কবিতা গ্রন্থগুলির মধ্যে সংযোজনে রামায়ণ মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ নেই—অন্যগুলিতে অল্পস্বল্প আছে। নাটকের মধ্যে বসন্ততে কিছু নেই; তবে অন্য নাটকগুলিতে, গল্পগুচ্ছে এবং শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালাতে কিছু কিছু রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে।

মহুয়া কাব্যে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ অতি সামান্যই। ‘বিজয়ী’ কবিতাতে গঙ্গা ও শিবের কথা আছে।

”কানন—’পর ছায়া বুলায়,

ঘনায় ঘনঘটা।

গঙ্গা যেন হেসে দুলায়

ধূর্জটির জটা।”

‘পরিচয়’ কবিতাতে ঋষি দুর্বাসার কথা আছে—

তখন বর্ষণহীন অপরাহ্নমেঘে

শঙ্কা ছিল জেগে;

ক্ষণে ক্ষণে তীক্ষ্ন ভর্ৎসনায়

বায়ু হেঁকে যায়;

শূন্যে যেন মেঘচ্ছিন্ন রৌদ্ররাগে পিঙ্গল জটায়

দুর্বাসা হানিছে ক্রোধ রক্তচক্ষুকটাক্ষচ্ছটায়।”

দুর্বাসা পৌরাণিক ঋষি—মহাভারতে তাঁর কথা আছে। তিনি অত্যন্ত খামখেয়ালী এবং ক্রোধী স্বভাবের। মহর্ষি অত্রি ও অনসূয়ার সন্তান তিনি।

‘বরণ’ কবিতায় মহাভারতের ‘নল-দয়ময়ন্তীর’ কথা আছে

‘পুরাণে বলেছে

একদিন নিয়েছিল বেছে

স্বয়ম্বর সভাঙ্গনে দময়ন্তী সতী

নল-নরপতি

ছদ্মবেশী দেবতার মাঝে।

অর্ঘ্যহারা দেবতারা চলে গেল লাজে।

দেবমূর্তি চিনেছে সেদিন,

তারা যে ফেলে না ছায়া, তারা অমলিন।

সেদিন স্বর্গের ধৈর্য্য গেল টুটি

ইন্দ্রলোক করিল ভ্রূকুটি।”

নল-দময়ন্তীর কথা মহাভারতে আছে। বিদর্ভ রাজকন্যা দময়ন্তী অপূর্ব রূপলাবণ্যময়ী। নিষধরাজ নলের রূপগুণের কথা শ্রবণ করে দয়মন্তী মনে মনে তাঁকেই পতিত্বে বরণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে বিদর্ভরাজ ভীম তাঁর কন্যার স্বয়ম্বরের ঘোষণা করেছিলেন। নিষধরাজ নলও দয়মন্তীর রূপ লাবণ্যের কথা শ্রবণ করে মনে মনে তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন এবং স্বয়ম্বর সভায় যাওয়ার জন্য যাত্রা করেছিলেন।

দেবরাজ ইন্দ্র, জলাধিপতি বরুণ, মৃত্যু অধিপতি যম এবং দেব হুতাশন— এঁরাও দময়ন্তীর রূপলাবণ্যের কথা শ্রবণ করেছিলেন এবং অভিলাষী হয়ে তাঁরাও স্বয়ম্বরসভার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন—পথে নলের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ। নলকে দেখে তাঁরা ভাবলেন যে নলকে দেখার পর দময়ন্তী নিশ্চিতভাবেই নলকে পতিত্বে বরণ করবে। নলকে দেবতারা তখন নিজেদের পরিচয় দিলেন এবং বললেন যে নল যেন দেবতাদের দূত হয়ে দময়ন্তী সমীপে গমন করেন। দেবতাদের প্রভাবে নল অলক্ষিতভাবে দময়ন্তীর পুরে প্রবেশ করতে পারবেন। নলকে সেখানে গিয়ে সোজা কথায় দেবতাদের হয়ে দময়ন্তীর কাছে তদ্বির করতে হবে—দেবতাদের রুপগুণের বর্ণনা দিয়ে দময়ন্তীর মনকে দেব-মুখী করাতে হবে। নল বললেন যে তিনিও তো একই উদ্দেশ্যে স্বয়ম্বর সভাতে চলেছেন, তাই তাঁকে এই কার্যে নিযুক্ত করা দেবতাদের উচিৎ হবে না। যাই হোক দেবতাদের কথায় নল শেষপর্য্যন্ত দৌত্যকার্য স্বীকার করলেন। কিন্তু দময়ন্তী নলকে দেবতাবরণের কোন প্রতিশ্রুতি দিলেন না— বললেন যে স্বয়ম্বরে নলকেই বরণ করবার জন্য দময়ন্তী মনস্থির করে রয়েছেন। দেবতাদের সঙ্গে নলও যেন স্বয়ম্বর সভায় আসেন।

নল ফিরে এসে দময়ন্তীর সঙ্গে তাঁর সব কথাবার্তা দেবতাদের কাছে বললেন। স্বয়ম্বরসভাতে পাঁচজন পাশাপাশি বসলেন। দেবতা চারজন নলের মতোই রূপধারণ করে আসনে বসলেন। দময়ন্তী এসে দেখলেন পাঁচজন নল পাশাপাশি বসে আছেন। এই অভাবিত দৃশ্যে হতবুদ্ধি হয়ে তিনি দেবগণেরই শরণ নিলেন—প্রার্থনা করলেন তিনি যেন নলরাজাকে চিনতে পারেন। ”দেবগণ দময়ন্তীর এইরূপ কারুণ্যপূর্ণ পরিবেদন বাক্য শ্রবণ করত নলেতেই ইহার প্রগাঢ় অনুরাগ, মনোবিশুদ্ধি, বুদ্ধি ও ভক্তি দৃঢ়রূপে সংসক্ত হইয়াছে, বোধ করিয়া স্বীয় স্বীয় চিহ্ন ধারণ করিলেন। তখন দময়ন্তী, স্বেদবিন্দু বিরহিত স্তব্ধনেত্র, অম্লান পরাগশূণ্য মাল্যধারী ভূতলস্পর্শশূণ্য ও শূণ্যসনো পবিষ্ট সুরগণ ও নিমেষযুক্তনেত্র, ম্লান ও পরাগ-সহকৃত মাল্যধারী, ছায়ানুগতকায় স্বেদসমন্বিত ও ভৃপৃষ্ঠোপবিষ্ট পুণ্যশ্লোক নলকে নিরীক্ষণ করিয়া হৃষ্ট হইলেন।” (মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ কৃত অনুবাদ)। দয়মন্তীর বরমাল্য নলের গলাতেই শোভা পেল।

বনবানী কাব্যগ্রন্থের ‘চামেলিবিতান’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছেন আদিকবি বাল্মীকির মুখনির্গত প্রথম শ্লোকটির একটি ছত্র দিয়ে—

‘মা নিষাদঃ প্রতিষ্ঠাং ত্বং অগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।’ কবির না বলা দ্বিতীয় লাইনটি হলো— ‘যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃকামমোহিতম্।’ এই শ্লোকাংশটি উদ্ধৃত করার কারণ কবি বর্ণনা করেছেন এইভাবে—”শুনেছিলুম আমাদের প্রদেশে কোনো এক নদীগর্ভজাত দ্বীপ ময়ূরের আশ্রয়। ময়ূর হিন্দুর অবধ্য। মৃগয়াবিলাসী ইংরেজ এই দ্বীপের নিষেধকে উপেক্ষা করতে পারেনি অথচ গুলি করে ময়ূর মারবার প্রবল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হওয়াতে পার্শ্ববর্তী দ্বীপে খাদ্যের প্রলোভন বিস্তার করে ভুলিয়ে নিয়ে এসে ময়ূর মারত। বাল্মীকির শাপকে এ যুগের কবি পুনরায় প্রচার না করে থাকতে পারল না।”

এই কাব্যগ্রন্থের ‘হাসির পাথেয়’ কবিতায় একবার আদিকবি বাল্মীকির নাম এসেছে—

”সেইদিন দেখেছিনু নিবিড় বিস্ময়মুগ্ধ চোখে

চঞ্চল নির্ঝরধারা গুহা হতে বাহিরি আলোকে

আপনাতে আপনি চকিত, যেন কবি বাল্মীকির

উচ্ছসিত অনুষ্টুভ।”

পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের ‘আতঙ্ক’ কবিতায় রামায়ণ মহাভারতের দুটি চরিত্রের উল্লেখ আছে।—

”বাগানের জীর্ণ পাঁচিলেতে

সাদাকালো দাগগুলো

দেখা দিত ভয়ংকর মূর্তি ধরে।

ওইখানে দৈত্যপুরী,

……

……

কাশীরাম দাস

পয়ারে যা লিখেছিল হিড়িম্বার কথা

ইট বের করা সেই পাঁচিলের পরে

ছিল তার প্রত্যক্ষ কাহিনী।

তারি সঙ্গে সেইখানে নাককাটা সূর্পনখা

কালো কালো দাগে

করেছিল কুটুম্বিতা।”

সতেরো বৎসর পরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল—

”উঠেছে ভেরেন্ডাগাছ মস্তবড়ো হয়ে।

বাইরেতে সূর্পনখা-হিড়িম্বার চিহ্নগুলো আছে,

মনে তারা কোনোখানে নেই।”

হিড়িম্বা মহাভারতের চরিত্র, ভীমের অনার্য্যাপত্নী এবং ঘটোৎকচের মাতা। সূর্পনখা লংকার রাজা রাবণের ভগিনী। পঞ্চবটীবনে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা পর্ণকুটীর নির্মাণ করে বাস করছিলেন। সেইখানে একদিন সুর্পনখা গিয়ে তাঁদেরকে বিরক্ত করতে থাকে। লক্ষ্মণ তীর দিয়ে তার নাক-কান কেটে দেন। সূর্পনখা রাবণকে গিয়ে এই কথা বলে। প্রতিশোধের জন্য রাবণ-সীতাহরণের পরিকল্পনা করে এবং রামায়ণের জটিল ঘটনাপ্রবাহ সুরু হয়ে যায়।

এই কাব্যগ্রন্থের ‘শ্রীবিজয়লক্ষ্মী’ কবিতায় বাল্মীকি বেদব্যাসের কথা এসেছে—

”রামায়ণের কবি আমায় কইল আকাশ হতে,

‘আমার বাণী পার করে দাও দূর সাগরের স্রোতে।’

তোমার ডাকে উতল হল বেদব্যাসের ভাষা—

বললে, ‘আমি ওই পারেতে বাঁধব নূতন বাসা।’

পুনশ্চ—রবীন্দ্রসাহিত্যে পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের একটি বিশেষ স্থান আছে। পুনশ্চ কাব্যের রচনারীতি নিয়ে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি অনেককিছু বলেছেন। সেখানে মহাভারত রামায়ণের কথাও এসে পড়েছে। একটু উদ্ধৃত করছি—

”যে সংসারটা প্রতিদিনের অথচ সেই প্রতিদিনকেই লক্ষ্মীশ্রী চিরদিনের করে তুলছে, যাকে চিরন্তনের পরিচয় দেবার জন্যে বিশেষ বৈঠকখানায় অলংকৃত আয়োজন করতে হয় না, তাকে কাব্যশ্রেণীতেই গণ্য করি। অথচ চেহারায় সে গদ্যের মতো হতেও পারে। তার মধ্যে বেসুর আছে, প্রতিবাদ আছে, নানাপ্রকার বিমিশ্রতা আছে, সেইজন্যেই চারিত্রশক্তি আছে। যেমন কর্ণের চারিত্রশক্তি যুধিষ্ঠিরের চেয়ে অনেক বড়ো। অথচ একরকম শিশুমতি আছে যারা ধর্মরাজের কাহিনী শুনে অশ্রুবিগলিত হয়। রামচন্দ্র নামটার উল্লেখ করলুম না, সে কেবল লোকভয়ে। কিন্তু, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আদিকবি বাল্মীকি রামচন্দ্রকে ভূমিকাপত্তন—স্বরূপে খাড়া করেছিলেন তার অসবর্ণতায় লক্ষ্মণের চরিত্রকে উজ্জ্বল করে আঁকবার জন্যেই, এমন-কি, হনুমানের চরিত্রকেও বাদ দেওয়া চলবে না। কিন্তু সেই একঘেয়ে ভূমিকাটা অত্যন্ত বেশি রঙফলানো চওড়া বলেই লোকে ঐটের দিকে তাকিয়ে হায় হায় করে। ভবভূতি তা করেননি। তিনি রামচন্দ্রের চরিত্রকে অশ্রদ্ধেয় করবার জন্যেই কবিজনোচিত কৌশলে উত্তররামচরিত রচনা করেছিলেন। তিনি সীতাকে দাঁড় করিয়েছেন রামভদ্রের প্রতি প্রবল গঞ্জনারূপে।

ঐ দেখো, কী কথা বলতে কী কথা এসে পড়ল। আমার বক্তব্য ছিল এই, কাব্যকে বেড়াভাঙা গদ্যের ক্ষেত্রে স্ত্রীস্বাধীনতা দেওয়া যায় যদি তা হলে সাহিত্যসংসারের আলংকারিক অংশটা হাল্কা হয়ে তার বৈচিত্র্যের দিক, তার চরিত্রের দিক, অনেকটা খোলা জায়গা পায়— কাব্য জোরে পা ফেলে চলতে পারে। সেটা সযত্নে নেচে চলার চেয়ে সব সময়ে যে নিন্দনীয় তা নয়। নাচের আসরের বাইরে আছে এই উঁচু—নিচু বিচিত্র বৃহৎ জগৎ, রূঢ় অথচ মনোহর; সেখানে জোরে চলাটাই মানায় ভালো, কখনো ঘাসের উপর, কখনো কাঁকরের উপর দিয়ে।” (সুলভ ৮ম খণ্ড; পৃ-৭১০)

এই পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে ‘নাটক’ নামে একটি কবিতা আছে—সেখানে মহাভারতের অর্জুন-উর্বশীর কথা আছে—

”নাটক লিখেছি একটি,

বিষয়টা কি বলি।

অর্জুন গিয়েছেন স্বর্গে,

ইন্দ্রের অতিথি তিনি নন্দনবনে।

উর্বশী গেলেন মন্দারের মালা হাতে

তাঁকে বরণ করবেন বলে।

অর্জুন বললেন, দেবী, তুমি দেবলোকবাসিনী,

অতি সম্পূর্ণ তোমার মহিমা,

অনিন্দিত তোমার মাধুরী,

প্রণতি করি তোমাকে।

তোমার মালা দেবতার সেবার জন্যে।

উর্বশী বললেন, কোনো অভাব নেই দেবলোকের,

নেই তার পিপাসা।

সে জানেই না চাইতে

তবে কেন আমি হলেম সুন্দর!

তার মধ্যে মন্দ নেই,

তবে ভালো হওয়া কার জন্যে!

আমার মালার মূল্য নেই তার গলায়।

মর্তকে প্রয়োজন আমার।

আমাকে প্রয়োজন মর্তের।

তাই এসেছি তোমার কাছে,

তোমার আকাঙ্খা দিয়ে করো আমাকে বরণ,

দেবলোকের দুর্লভ সেই আকাঙ্খা

মর্তের সেই অমৃত-অশ্রুর ধারা।”

মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে অর্জুন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন উর্বশীকে।

‘বালক’ কবিতায় কবি নিজের ছেলেবেলার কথা বলতে গিয়ে রামায়ণের কথা এনে ফেলেছেন।—

”আমার খেলা ছিল মনের ক্ষুধায়, চোখের দেখায়,

পুকুরের জলে, বটের শিকড় জড়ানো ছায়ায়,

নারকেলের দোদুল ডালে, দূর বাড়ীর রোদ পোহানো ছাদে।

অশোকবনে এসেছিল হনুমান,

সেদিন সীতা পেয়েছিলেন নবদুর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের খবর।

আমার হনুমান আসত বছরে বছরে আষাঢ় মাসে

আকাশ কালো করে

সজল নবনীল মেঘে।

আনত তার মেদুর কণ্ঠে দূরের বার্তা,

যে দূরের অধিকার থেকে আমি নির্বাসিত।”

রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছে। তাঁর সন্ধানের জন্য রামচন্দ্রের বানর-মিত্র সুগ্রীব চারিদিকে বানর বীরদের প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে দক্ষিণদিকে সমুদ্রপার হয়ে হনুমান লংকায় পৌঁছেছিলেন আর সেখানে অশোকবনে বন্দিনী সীতার সাক্ষাৎ তিনি পেয়েছিলেন।

‘প্রথম পূজা’ কবিতাটি বেশ বড়—প্রথম স্তবক থেকে একটু উদ্ধৃত করছি—

”ত্রিলোকেশ্বরের মন্দির।

লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বকর্ম্মা তার ভিত পত্তন করেছিলেন

কোন মান্ধাতার আমলে,

স্বয়ং হনুমান এনেছিলেন তার পাথর বহন করে।”

কোন বড় রোল প্লে না করলেও বিশ্বকর্মার উল্লেখ রামায়ণ-মহাভারতের অনেক জায়গাতেই আছে। তাকে বলা যায় স্বর্গের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদার অবশ্য তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকর্মাকে অনেক সময়ই বিশ্বের নির্মাতারূপে দেখেছিলেন। শান্তিনিকেতন পর্যায়ের প্রবন্ধে কোন কোন জায়গায় বিশ্বকর্মা বিশ্ববিধাতার সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছেন। ‘মান্ধাতার আমল’ বলতে খুব প্রাচীনকাল বোঝায়। হনুমান রামায়ণের একজন প্রধান চরিত্র, বানর জাতিমধ্যে মহাবীর। রামচন্দ্রের একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি।

এই মন্দিরের উৎসব প্রসঙ্গে একজায়গায় বলা হয়েছে—

”বাজিকর তারস্বরে প্রলাপবাক্যে দেখাচ্ছে বাজি,

কথক পড়ছে রামায়ণকথা।”

রক্তকরবী— রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটি বহুপঠিত, বহুচর্চিত, বহুল অভিনীত। যে সমস্ত বাঙালী মহিলাদের নাম নন্দিনী, একটু ভালো করে খোঁজ নিলে জানা যাবে, তাদের পিতামাতা-রা অনেকক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে, রক্তকরবীকে ভালোবেসে কন্যার নাম নন্দিনী রেখেছিলেন।

রক্তকরবী নাটকটির প্রথমে নাম ছিল ‘যক্ষপুরী’ পরে এর নাম হয়েছিল ‘নন্দিনী’। পরিশেষে ১৩৩১ সালে ‘রক্তকরবী’ নামে নাটকটি মুদ্রিত হয়েছিল। রামায়ণের উপমা দিয়ে নাটকটিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন কবি। এই নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

”আজ আপনাদের বারোয়ারী-সভায় আমার ‘নন্দিনীর’ পালা অভিনয়। প্রায় কখনো ডাক পড়ে না, এবারে কৌতূহল হয়েছে। ভয় হচ্ছে পালা সাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কুত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও দন্তস্ফুট করতে পারবে না।

আপনারা প্রবীণ। চশমা বাগিয়ে পালাটার ভিতর থেকে একটা গূঢ় অর্থ খুঁটিয়ে বের করবার চেষ্টা করবেন। আমার নিবেদন, যেটা গূঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার সার্থকতা চলে যায়। হৃৎপিণ্ডটা পাঁজরের আড়ালে থেকেই কাজ করে। তাকে বার করে তার কার্যপ্রণালী তদারক করতে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। দশমুণ্ড বিশহাতওয়ালা রাবণের স্বর্ণলঙ্কায় সামান্য একটা বন্য বানর লেজে করে আগুন লাগায়, এই কাহিনীটি যদি কবিগুরু আজ আপনাদের এই সভায় উপস্থিত করতেন তা হলে তার গূঢ় অর্থ নিয়ে আপনাদের চণ্ডীমণ্ডপে একটা কলরব উঠত। সন্দেহ করতেন কোনো একটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধিব্যবস্থাকে বুঝি বিদ্রুপ করা হচ্ছে। অথচ শত শত বছর ধরে স্বভাবসন্দিগ্ধ লোকেরাও রামায়ণের প্রকাশ্যে যে-রস আছে তাই ভোগ করে এলেন— গোপনে যে অর্থ আছে তার ঝুঁটি ধরে টানাটানি করলেন না।

আমার পালায় একটি রাজা আছে। আধুনিক যুগে তার একটার বেশি মুণ্ড ও দুটোর বেশি হাত দিতে সাহস হল না। আদিকবির মতো ভরসা থাকলে দিতেম। বৈজ্ঞানিক শক্তিতে মানুষের হাত পা মুণ্ড অদৃশ্যভবে বেড়ে গেছে। আমার পালার রাজা যে সেই শক্তিবাহুল্যের যোগেই গ্রহণ করেন, গ্রাস করেন, নাটকে এমন আভাস আছে। ত্রেতাযুগের বহুসংগ্রহী বহুগ্রাসী রাবণ বিদ্যুৎবজ্রধারী দেবতাদের আপন প্রাসাদদ্বারে শৃঙ্খলিত করে তাদের দ্বারা কাজ আদায় করত। তার প্রতাপ চিরদিনই অক্ষুন্ন থাকতে পারত। কিন্তু তার দেবদ্রোহী সমৃদ্ধির মাঝখানে হঠাৎ একটা মানবকন্যা এসে দাঁড়ালেন, অমনি ধর্ম জেগে উঠলেন। মূঢ় নিরস্ত্র বানরকে দিয়ে তিনি রাক্ষসকে পরাস্ত করলেন। আমার নাটকে ঠিক এমনটি ঘটে নি কিন্তু এর মধ্যেও মানকন্যার আবির্ভাব আছে। তা ছাড়া কলিযুগের রাক্ষসের সঙ্গে কলিযুগের বানরের যুদ্ধ ঘটবে, এমনও একটা সূচনা আছে।

আদিকবির সাতকাণ্ডে স্থানাভাব ছিল না, এই কারণে লঙ্কাপুরীতে তিনি রাবণ ও বিভীষণকে স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু আভাস দিয়েছিলেন যে তারা একই, তারা সহোদর ভাই। একই নীড়ে পাপ ও সেই পাপের মৃত্যুবাণ লালিত হয়েছে। আমার স্বল্পায়তন নাটকে রাবণের বর্তমান প্রতিনিধিটি এক দেহেই রাবণ ও বিভীষণ; সে আপনাকেই আপনি পরাস্ত করে।

বাল্মীকির রামায়ণকে ভক্ত পাঠকেরা সত্যমূলক বলে স্বীকার করেন। আমার পালাটিকে যাঁরা শ্রদ্ধা করে শুনবেন তাঁরা জানবেন এটিও সত্যমূলক। ঐতিহাসিকের উপর প্রমাণের ভার দিলে ঠকবেন। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, কবির জ্ঞান-বিশ্বাস মতে এটি সত্য।

ঘটনাস্থানটির প্রকৃত নাম নিয়ে ভৌগোলিকদের কাছে মতের ঐক্য প্রত্যাশা করা মিছে। স্বর্ণলঙ্কা যে সিংহলে তা নিয়েও আজ কত কথাই উঠেছে। বস্তুত পৃথিবীর নানা স্থানে নানা স্তরেই স্বর্ণলঙ্কার চিহ্ন পাওয়া যায়। কবিগুরু যে সেই অনির্দিষ্ট অথচ সুপরিনির্দিষ্ট স্বর্ণলঙ্কার সংবাদ পেয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সে স্বর্ণলঙ্কা যদি খনিজ সোনাতেই বিশেষ একটা স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকত, তা হলে লেজের আগুনে ভস্ম না হয়ে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

স্বর্ণলঙ্কার মতোই আমার পালার ঘটনাস্থলের একটি ডাকনাম আছে। তাকে কবি যক্ষপুরী বলে জানে। তার কারণ এ নয় যে সেখানে পৌরাণিক কুবেরের স্বর্ণসিংহাসন। যক্ষের ধন মাটির নীচে পোঁতা আছে। এখানকার রাজা পাতালে সুড়ঙ্গ খোদাই করে সে ধন-হরণে নিযুক্ত। তাই আদর করে এই পুরীকে সমঝদার লোকেরা যক্ষপুরী বলে। লক্ষ্মীপুরী কেন বলে না? কারণ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বৈকুণ্ঠে, যক্ষের ভাণ্ডার পাতালে।

রামায়ণের গল্পের ধারার সঙ্গে এর যে একটা মিল দেখছি, তার কারণ এই নয় যে রামায়ণ থেকে গল্পটি আহরণ করা। আসল কারণ, কবিগুরুই আমার গল্পটিকে ধ্যানযোগে আগে থাকতে হরণ করেছেন। যদি বল প্রমাণ কী, প্রমাণ এই যে, স্বর্ণলঙ্কা তাঁর কালে এমন উচ্চ চূড়া নিয়ে প্রকাশমান ছিল, কেউ তা মানবে না। এটা-যে বর্তমান কালেরই, হাজার জায়গায় তার হাজার প্রমান প্রত্যক্ষ হয়ে আছে। ধ্যানের সিঁধ কেটে মহাকবি ভাবীকালের সামগ্রীতে কিরকম কৌশলে হস্তক্ষেপ করতেন তার আর একটি প্রমাণ দেব।

কর্ষণজীবী এবং আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তা ছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো। আমার মুখের এই বচনটি কবি তাঁর রূপকের ঝুলিতে লুকিয়ে আত্মসাৎ করেছেন, সেটা প্রণিধান করলেই বোঝা যায়। নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের বক্ষসংলগ্ন সীতাকে স্বর্ণপুরীর অধীশ্বর দশানন হরণ করে নিয়েছিল সেটা কি সেকালের কথা, না একালের? সেটা কি ত্রেতাযুগের ঋষির কথা, না আমার মতো কলিযুগের কবির কথা? তখনো কি সোনার খনির মালেকরা নবদুর্বাদলবিলাসী কৃষকদের ঝুঁটি ধরে টান দিয়েছিল?

আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে। কৃষি যে দানবীয় লোভের টানেই আত্মবিস্তৃত হচ্ছে, ত্রেতাযুগে তারই বৃত্তান্তটি গা-ঢাকা দিয়ে বলবার জন্যেই সোনার মায়ামৃগের বর্ণনা আছে। আজকের দিনের রাক্ষসের মায়ামৃগের লোভেই তো আজকের দিনের সীতা তার হাতে ধরা পড়ছে; নইলে গ্রামের পঞ্চবটচ্ছায়াশীতল কুটির ছেড়ে চাষীরা টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসবে কেন? বাল্মীকির পক্ষে এ সমস্তই পরবর্তী কালের, অর্থাৎ পরস্ব।

বারোয়ারির প্রবীণমণ্ডলীর কাছে একথা বলে ভালো করলেম না। সীতাচরিত প্রভৃতি পুণ্যকথাসম্বন্ধে তাঁরা আমাকে অশ্রদ্ধাবান বলেই সন্দেহ করেন। এটা আমার দোষ নয়, তাঁদেরও দোষ বলতে পারি নে, বিধাতা তাঁদের এইরকমই বুদ্ধি দিয়েছেন। বোধ করি সেটা আমার সঙ্গে বারে বারে কৌতুক করবার জন্যেই। পুণ্যশ্লোক বাল্মীকির প্রতি কলঙ্ক আরোপ করলুম বলে পুনর্বার হয়তো তাঁরা আমাকে একঘরে করবার চেষ্টা করবেন। ভরসার কথা আমার দলের লোক আছেন, কৃত্তিবাস নামে আর-এক বাঙালি কবি।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে উঠল। আধুনিক সমস্যা বলে কোনো পদার্থ-নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালের। রত্নাকরের গল্পটার মধ্যে তারই প্রমাণ পাই। রত্নাকর গোড়ায় ছিলেন দস্যু, তার পরে দস্যুবৃত্তি ছেড়ে ভক্ত হলেন রামের। অর্থাৎ ধর্ষণবিদ্যার প্রভাব এড়িয়ে কর্ষণবিদ্যায় যখন দীক্ষা নিলেন, তখনি সুন্দরের আশীর্বাদে তাঁর বীণা বাজল। এই তত্ত্বটা তখনকার দিনেও লোকের মনে জেগেছে। এককালে যিনি দস্যু ছিলেন তিনিই যখন কবি হলেন, তখনই আরণ্যকদের হাতে স্বর্ণলঙ্কার পরাভবের বাণী তাঁর কণ্ঠে এমন জোরের সঙ্গে বেজেছিল।

হঠাৎ মনে হতে পারে রামায়ণটা রূপক কথা। বিশেষত যখন দেখি রাম রাবণ দুই নামের দুই বিপরীত অর্থ। রাম হল আরাম, শান্তি; রাবণ হল চীৎকার, অশান্তি। একটিতে নবাঙ্কুরের মাধুর্য, পল্লবের মর্মর, আর—একটিতে শানবাঁধানো রাস্তার উপর দিয়ে দৈত্যরথের বীভৎস শৃঙ্গধ্বনি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও রামায়ণ রূপক নয়, আমার রক্তকরবীর পালাটিও রূপকনাট্য নয়। রামায়ণ মুখ্যত মানষের সুখদুঃখ বিরহ-মিলন ভালোমন্দ নিয়ে বিরোধের কথা; মানবের মহিমা উজ্জ্বল করে ধরবার জন্যেই চিত্রপটে দানবের পটভূমিকা। এই বিরোধ একদিকে ব্যক্তিগত মানুষের, আরেক দিকে শ্রেণীগত মানুষের; রাম ও রাবণ এক দিকে দুই মানুষের ব্যক্তিগত রূপ, আরেক দিকে মানুষের দুই শ্রেণীগত রূপ। আমার নাটকও একই কালে ব্যক্তিগত মানুষের আর মানুষগত শ্রেণীর। শ্রোতারা যদি কবির পরামর্শ নিতে অবজ্ঞা না করেন তা হলে আমি বলি শ্রেণীর কথাটা ভুলে যান। এইটি মনে রাখুন রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি ‘নন্দিনী’ বলে একটি মানবীর ছবি। চারিদিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। ফোয়ারা যেমন সংকীর্ণতার পীড়নে হাসিতে অশ্রুতে কলধ্বনিতে ঊর্ধ্বে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, তেমনি। সেই ছবির দিকেই যদি সম্পূর্ণ করে তাকিয়ে দেখেন তা হলে হয়তো কিছু রস পেতে পারেন। নয়তো রক্তকরবীর পাপড়ির আড়ালে অর্থ খুঁজতে গিয়ে যদি অনর্থ ঘটে তা হলে তার দায় কবির নয়। নাটকের মধ্যেই কবি আভাস দিয়েছে যে, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়—মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের যেখানে রূপের নৃত্য, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সেই সহজ সৌন্দর্যের।” (সুলভ-৮ম খণ্ড; পৃ ৭১৪-৭১৭)

যক্ষপুরীতে শ্রমিকদের ঠাকুর-দেবতার কথা শোনাবার জন্য আছে কেনারাম গোঁসাই। সে নাম করে ভগবানের কিন্তু অন্নগ্রহণ করে সর্দারের। শ্রমিকদের সম্বন্ধে সে বলছে—”এই এদের কথা বলছ? আহা এরা তো স্বয়ং কূর্ম-অবতার, বোঝার নীচে নিজেকে চাপা দিয়েছে বলেই সংসারটা টিঁকে আছে।” আমাদের শাস্ত্রে অবতারতত্বের কথা আছে। বলা হয় যে ‘অবতারা-হ্যসংখ্যেয়া’— অবতারের সংখ্যা করা যায় না। দশাবতারের কথাই বেশি প্রচলিত— দ্বিতীয় অবতার হচ্চেন কূর্ম-অবতার। এই অবতারে সমুদ্রমন্থনের সময়ে ভগবান পৃষ্ঠদেশে মন্থনদন্ড মন্দারপর্বতকে ধারণ করেছিলেন।

নন্দিনী যক্ষপুরীর রাজাকে কাছ থেকে দেখেছে—বিশুকে সে রাজার বর্ণনা দিচ্ছে। ” দেখলুম মানুষ কিন্তু প্রকাণ্ড। কপালখানা যেন সাতমহলা বাড়ীর সিংহদ্বার। বাহুদুটো কোন দুর্গম দুর্গের লোহার অর্গল। মনে হল যেন রামায়ণ মহাভারত থেকে নেমে এসেছে কেউ।”

চিরকুমার সভা—’প্রজাপতির নির্বন্ধ’ নামে একটি উপন্যাস সুলভ সংস্করণের দ্বিতীয় খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত আছে। সেই উপন্যাসটিই কিছু কিছু পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করে নাটকে রূপ দেওয়া হয়েছে। এই নাটকটিই ‘চিরকুমার সভা’। নাটকে উল্লেখিত রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গগুলো এখন আলোচনা করা হচ্ছে—

জগত্তারিনীর দুই অবিবাহিতা মেয়ে নৃপবালা ও নীরবালার পাত্র হিসাবে চিরকুমার সভার দুই সদস্য শ্রীশ এবং বিপিনকে টারগেট করে রেখেছে জগত্তারিনীর বড় জামাই অক্ষয় এবং আরো কয়েকজন। চিরকুমার সভার সদস্যরা আবার পণ করে বসে আছে তারা বিবাহ করবে না। তাদেরকে প্রতিজ্ঞাভ্রষ্ট করার জন্য নীরবালাদের এক বিধবা দিদি ঠিক করেছে যে সে পুরুষবেশে চিরকুমারসভার সভ্য হবে, তার পর দেখবে সভ্যদের বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা কতদিন অটুট থাকে। জগত্তারিনীর দূর সম্পর্কের খুড়ো রসিক শৈলবালাকে বলেছেন—

”ভগবান হরি নারীছদ্মবেশে পুরুষকে ভুলিয়েছিলেন, তুই শৈল যদি পুরুষ ছদ্মবেশে পুরুষকে ভোলাতে পারিস তা হলে হরিভক্তি উড়িয়ে দিয়ে তোর পূজোতেই শেষ বয়সটা কাটাব।” এখানে মনে হয় সমুদ্রমন্থনের কাহিনীই বলা হয়েছে। দেবতা এবং অসুর একসঙ্গে মিলে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। সমুদ্রমন্থনে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে অমৃতও উঠেছিল। স্বভাবতই অসুররা অমৃতের ভাগ দাবী করেছিল। অসুরদের অশুভ শক্তি হিসাবে ধরা হয়। এই অনর্থ নিবারণ করার জন্য ভগবান বিষ্ণু মোহিনী নারীরূপ ধারণ করে অসুরদের মোহিত করেছিলেন।

চিরকুমার সভার সভাপতি চন্দ্রবাবু আত্মভোলা পণ্ডিত মানুষ। তাঁর একটি ভাগ্নী নির্মলা অবিবাহিতা এবং সুন্দরী। শ্রীশ এবং বিপিন একদিন নির্মলাকে নিয়েই কথা বলছে। বিপিন একসময়ে বলছে—

”বিপিন : নারীতত্ত্বের গবেষণা স্বাস্থ্যকর না হতে পারে।

শ্রীশ : তোমার স্বাস্থ্যের যদি ব্যাঘাত না হয়ে থাকে তা হলে আমারও—

বিপিন : আরম্ভেতে রোগের প্রবেশ ধরা পড়ে না। কিন্তু কুমারের মার যখন ভিতর থেকে ফুটে উঠবে তখন অশ্বিনীকুমারেরও সাধ্য নেই রক্ষা করে। গোড়ায় সাবধান হওয়া ভালো”—অশ্বিনীকুমারদ্বয় স্বর্গের জয়েন্ট চিফ মেডিকেল অফিসারস।

শ্রীশ এবং বিপিন দুই বন্ধু। তাদের মধ্যে খুনসুটি ঝগড়া সব চলে। একদিন দুই বন্ধুর আড্ডা চলছে। শ্রীশ মতপ্রকাশ করছে যে দেশসেবার জন্য একটা সন্ন্যাসী সম্প্রদায় গড়ে তুলতে হবে। এই সন্ন্যাসীরা প্রচলিত ধারণার বিপরীত হবে— তারা সুদর্শন, চারুবাক সুবক্তা হবে এবং মানসিক প্রফুল্লতার অধিকারী হবে। এই শুনে বিপিন বলছে—

”বিপিন : অর্থাৎ একদল কার্তিককে ময়ূরের উপর চড়ে রাস্তায় বেরোতে হবে। ময়ূর না পাওয়া যায় ট্রাম আছে। পদব্রজেও নারাজ নই। কুমার সভা মানেই তো কার্তিকের সভা। কিন্তু কার্তিক কি কেবল সুপুরুষ ছিলেন। তিনিই ছিলেন স্বর্গের সেনাপতি।

বিপিন : লড়াইয়ের জন্য তাঁর দুটিমাত্র হাত, কিন্তু বক্তৃতা করবার জন্য তাঁর তিনজোড়া মুখ।

শ্রীশ : এর থেকে প্রমাণ হয় আমাদের আর্য পিতামহরা বাহুবল অপেক্ষা বাক্যবলকে তিনগুণ বেশী বলেই জানতেন। আমিও পালোয়ানিকে বীরত্বের আদর্শ বলে মানি নে।

বিপিন : ওটা বুঝি আমার উপর হল?

শ্রীশ : ঐ দেখো। মানুষকে অহংকারে কিরকম মাটি করে। তুমি ঠিক করে রেখেছ, পালোয়ান বললেই তোমাকে বলা হল। তুমি কলিযুগের ভীমসেন।” দেবসেনাপতি কার্তিকের কথা মহাভারতে আছে। মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেন মহাভারতের এক প্রধান চরিত্র।

অক্ষয় মুখে মুখে একটা কবিতা বলেছে। তাতে—

‘নীরবালা : কবিবর, সাধু সাধু। কিন্তু, তোমার রচনায় কোনো কোনো আধুনিক কবির ছায়া দেখতে পাই যেন।

অক্ষয় : তার কারণ, আমিও অত্যন্ত আধুনিক। তোরা কি ভাবিস তোদের মুখুজ্জেমশায় কৃত্তিবাস ওঝার যমজ ভাই।”

কৃত্তিবাস ওঝা পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রামায়ণ মহাকাব্য বাংলায় ভাবানুবাদ করেন।

শ্রীশ এবং বিপিন যদিও চিরকুমার সভার সভ্য হিসাবে আজীবন বিয়ে না করার ব্রত নিয়েছে, তারা যে স্ত্রীজাতিকে খুব অপছন্দ করে তা মনে হয় না।

”বিপিন : … নাড়িটা যে সবসময়ে ঠিক চিরকুমারের নাড়ির মতো চলে তা জাঁক করে বলতে পারবো না।

শ্রীশ : ঐটে তোমার আর একটা ভুল। চিরকুমারের নাড়ির উপরে উনপঞ্চাশ পবনের নৃত্য হতে দাও— কোনো ভয় নেই, বাঁধাবাঁধি চাপাচাপি কোরো না। আমাদের মতো ব্রত যাদের তারা কি হৃদয়টিকে তুলো দিয়ে মুড়ে রাখতে পারে? তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মতো ছেড়ে দাও, যে তাকে বাঁধবে তার সঙ্গে লড়াই করো।” ঊনপঞ্চাশ পবনের কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা রামায়ণ মহাভারতে আছে। যে রাজা এই যজ্ঞ করতে চান তিনি একটি সুলক্ষণযুক্ত ঘোড়ার কপালে জয়পত্র লিখে ছেড়ে দেবেন। সঙ্গে উপযুক্ত রক্ষক থাকবে। ঘোড়াটি অন্য রাজ্যের মধ্যে গেলে তিনি যদি ঘোড়া না আটকান, ধরে নেওয়া হয় তিনি যজ্ঞকারী রাজার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিচ্ছেন। যদি কোন রাজা ঘোড়া আটক করেন তবে যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে ঘোড়া ফেরৎ আনলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে।

পুরুষবেশী শৈলবালা চিরকুমার সভার সভ্য হয়েছে। একটা মিটিং-এর দিনে শৈল একটু আগেই উপস্থিত হয়েছে। সেখানে তখন ছিলেন সভাপতি চন্দ্রবাবু এবং তাঁর ভাগ্নী নির্মলা। নির্মলাও চিরকুমার সভার সভ্য হয়েছে। এর আগে চিরকুমার সভার যে নিয়ম ছিল যে স্ত্রী সভ্য নেওয়া চলবে না— সে নিয়ম বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। শৈলবালা নির্মলার সঙ্গে কথা বলছে—

”নির্মলা।..আমার মামাকে যথার্থভবে জানা খুব সহজ, ওঁর মধ্যে এমন একটি স্বচ্ছতা আছে!

শৈলবালা। দেখুন, সেই জন্যেই তো ওঁকে ঠিকমতো জানা শক্ত। দুর্যোধন স্ফটিকের দেয়ালকে দেয়াল বলে দেখতেই পাননি। সরল স্বচ্ছতার মহত্ত্ব কি সকলে বুঝতে পারে।”

দুর্যোধনের এই দুরবস্থার বর্ণনা আছে মহাভারতের সভাপর্বে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে। বেশিরভাগ অভ্যাগতরা বিদায় নিলেও কৌরবেরা যেহেতু নিকট জ্ঞাতি, দুর্যোধনেরা যজ্ঞ শেষ হলেও আরো কয়েকদিন যুধিষ্ঠিরের রাজধানীতে ছিলেন। ময়দানব নির্মিত যুধিষ্ঠিরের সভাগৃহ ও সন্নিহিত প্রাঙ্গণ পৃথিবীতে অতুলনীয়। মামা শকুনির সঙ্গে দুর্যোধন একদিন সেইসব ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের অনুবাদে দুর্যোধনের দুরবস্থা : ”দুর্যোধন কোনসময়ে সভামধ্যে এক স্পটিকময় স্থলে উপস্থিত হইয়া জলভ্রমে আপনার বসন উৎকর্ষণ করিয়া দুর্ম্মনায়মান ও প্রবেশবিমুখ হইয়া সেই সভায় পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন।…তদনন্তর স্থলভ্রমে স্ফটিকবৎ নির্ম্মল জলে ও পদ্মে সুশোভিত দীর্ঘিকাজলে সবস্ত্র পতিত হইলেন।… তিনি যে কেবল স্ফটিকময় সভাকুট্টিমেই প্রতারিত হইয়াছিলেন, এমন নহে, স্ফটিক ভিত্তিতে দ্বার বিবেচনা করিয়া যেমন প্রবেশ করিতে উদ্যত হইলেন, অমনি আহতমস্তক হইয়া ঘূর্ণিত হইতে লাগিলেন।”

শ্রীশ এবং বিপিনের চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞাকে বিদায় জানানো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। নৃপবালার প্রতি শ্রীশ এবং নীরবালার প্রতি বিপিন গভীরভাবেই আকৃষ্ট। এইরকম অবস্থায় প্রিয়তম মানুষটির কথা ভাবতে, তার কথা শুনতে ভালো লাগে। শ্রীশ রসিকবাবুকে বলছে—

”শ্রীশ—রসিকবাবু, ঐ যে সেদিন আপনি যাঁর নাম নৃপবালা বললেন তিনি—তিনি—তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত করে কিছু বলুন। সেদিন চকিতের মধ্যে তাঁর মুখে যেন একটি স্নিগ্ধভাব দেখেছি, তাঁর সম্বন্ধে কৌতূহল কিছুতেই থামাতে পারছি নে।

রসিক—বিস্তারিত করে বললে কৌতূহল আরো বেড়ে যাবে। এরকম কৌতূহল ‘হবিষা কৃষ্ণবরত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।” এই আংশিক শ্লোকটি মহাভারতের আদিপর্ব থেকে নেওয়া। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হলো—

”ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।

হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।”

গল্পগুচ্ছ—রবীন্দ্র রচনাবলীর এই অষ্টম খণ্ডে গল্পগুচ্ছের এগারোটি গল্প সংকলিত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি গল্পে রামায়ণ-মহাভারতের কথা অতি সামান্যই আছে। ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’ গল্পের তারাপ্রসন্ন একটু লেখেন-টেখেন, কিন্তু তাঁর লেখা দুর্বোধ্য। ”অনুরোধ করিয়া দাক্ষায়ণী (তারাপ্রসন্নের স্ত্রী) মাঝে মাঝে স্বামীর লেখা শুনিতেন, যতই না বুঝিতেন ততই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন। তিনি কৃত্তিবাসের রামায়ণ কাশীদাসের মহাভারত, কবিকঙ্কণ-চণ্ডী পড়িয়াছেন এবং কথকতাও শুনিয়াছেন। সে-সমস্তই জলের মতো বুঝা যায়, এমন কি, নিরক্ষর লোকেও অনায়াসে বুঝিতে পারে, কিন্তু তাহার স্বামীর মতো এমন সম্পূর্ণ দুর্বোধ হইবার আশ্চর্য্য ক্ষমতা তিনি ইতিপূর্বে কোথাও দেখেন নাই।”

‘মুক্তির উপায়’ গল্পে ফকিরচাঁদ গম্ভীর প্রকৃতির লোক কিন্তু তার স্ত্রী অল্পবয়সী এবং একটু হাসিখুশী ভালোবাসে। সে এই নবযৌবনের সময় স্বামীর নিকট হইতে আদর এবং হাস্যামোদ যথাপরিমাণে প্রত্যাশা করিয়া থাকে। কিন্তু স্বামী তাহাকে অবসর পাইলেই ভাগবত পড়ায়, সন্ধ্যাবেলায় ভগবদগীতা শুনায়।”

সংসারে থাকলে ফকিরকে কাজ করতে হবে, স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিপালন করতে হবে। এই সব দায়িত্ব পরিত্যাগ করে সে একদিন রাত্রে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবার পর সে যে সব পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল সেগুলো পড়তে ভারি মজা। ফকিরকে মাখন ভেবে পাড়ার লোকে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করছে—”আরে আরে, আমাদের সেই মাখন আজ ঋষি হয়েছেন, তপিস্বী হয়েছেন, চিরটা কাল ইয়ার্কি দিয়ে কাটালে, আজ হঠাৎ মহামুনি জামদগ্নি হয়ে বসেছেন।… একজন গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘ওরে মাখন, তুই কুচকুচে কালো ছিলি, রঙটা এমন ফরসা করলি কি করে! ফকির উত্তর দিল, ‘যোগ অভ্যাস করে।’ সকলেই বলিল, ‘যোগের কি আশ্চর্য প্রভাব।’

একজন উত্তর করিল, ‘আশ্চর্য আর কী। শাস্ত্রে আছে, ভীম যখন হনুমানের লেজ ধরে তুলতে গেলেন, কিছুতেই তুলতে পারলেন না। সে কি করে হল। সে তো যোগ বলে’।” ভীম-হনুমান সংবাদ বিষয়টি মূল মহাভারত ও কাশীরামদাসের মহাভারত, উভয় জায়গাতেই আছে। বনবাসকালে একদিন ভীম সুগন্ধি কনকপুষ্প আহরণের নিমিত্ত বনপথে একাকী চলেছিলেন। শক্তি গর্বিত ভীম চলার পথে চারিদিক আলোড়িত করে গমন করেন। সেই অরণ্যে এক বৃহৎ কদলীর বন ছিল সেটি ত্রেতাযুগের মহাবীর হনুমান রক্ষিত। সেই কদলীর বন ভঙ্গ হওয়াতে ক্রুদ্ধ হনুমান দৃষ্টিনিক্ষেপ করে দেখলেন যে এসব কাণ্ড মধ্যমপাণ্ডব ভীমের। পিতৃসূত্রে হনুমান এবং ভীম বৈমাত্রেয় ভাই, উভয়েই পবনদেবের সন্তান। তখন ভীমকে একটু সমঝে দেওয়ার জন্য জরাগ্রস্ত, রুগ্ন রূপ ধারণ করে হনুমান ভীমের পথ রুদ্ধ করে আড়াআড়িভাবে শুয়ে রইলেন। ভীম দম্ভভরে হনুমানকে রাস্তা ছেড়ে সরে যেতে বললেন। এই নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটির পর হনুমান ভীমকে বললেন যে তিনি রুগ্ন অসুস্থ—সরে শোওয়ার ক্ষমতা নেই। মহাবলশালী ভীম যেন হনুমানকে রাস্তা থেকে একটু সরিয়ে দিয়ে নিজ গন্তব্যে চলে যান। অবজ্ঞাভরে ভীম বামহস্ত দিয়ে হনুমানের লেজ ধরে তাঁকে সরিয়ে দিতে চাইলেন; কিন্তু বামহস্ত তো দূরের কথা—নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও ভীমসেন হনুমানকে কিছুমাত্র নড়াতে পারলেন না। এবারে ভীমের বুদ্ধি খুললো—তিনি বিনীতভাবে হনুমানকে সম্ভাষণ করলেন এবং উভয়ের পরিচয় হল।

শান্তিনিকেতন পর্যায়ের প্রবন্ধসমূহ-সুলভ সংস্করণের এই ৮ম সংস্করণে মোট বিয়াল্লিশটি রচনা স্থান পেয়েছে। প্রায় সবগুলি রচনাতেই উপনিষদের বাণী, উপনিষদের শিক্ষা এবং রবীন্দ্রনাথের মতামত (যেগুলো প্রায় সবসময়ই উপনিষদের অনুবর্তী) স্থান পেয়েছে। রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ প্রায় না-ই। সামান্য একটু আধটু যা আছে সেগুলো এখানে আলোচনা করা হলো।

‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ প্রবন্ধে কবি প্রসঙ্গক্রমে রামায়ণের সীতার কথা বলেছেন— ”সীতা যখন রাবণের ঘরে একা বসে কাঁদছিলেন তখন একদিন যে দূত তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিল, সে রামচন্দ্রের আংটি সঙ্গে করে এনেছিল, এই আংটি দেখেই সীতা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, এই দূতই তাঁর প্রিয়তমের কাছ থেকে এসেছে—তখনই তিনি বুঝলেন, রামচন্দ্র তাঁকে ভোলেননি, তাঁকে উদ্ধার করে নেবেন বলেই তাঁর কাছে এসেছেন।

ফুল ও আমাদের কাছে সেই প্রিয়তমের দূত হয়ে আসে। সংসারের সোনার লঙ্কায় রাজভোগের মধ্যে আমরা নির্বাসিত হয়ে আছি, রাক্ষস আমাদের কেবলই বলছে, ‘আমিই তোমার পতি, আমাকেই ভজনা করো’।

কিন্তু সংসারের পারের খবর নিয়ে আসে ঐ ফুল। সে চুপি চুপি আমাদের কানে কানে এসে বলে, ‘আমি এসেছি, আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন। আমি সেই সুন্দরের দূত, আমি সেই আনন্দময়ের খবর নিয়ে এসেছি। এই বিচ্ছিন্নতার দ্বীপের সঙ্গে তাঁর সেতু বাঁধা হয়ে গেছে, তিনি তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য ভোলেননি, তিনি তোমাকে উদ্ধার করবেন। তিনি তোমাকে টেনে নিয়ে আপন করে নেবেন। মোহ তোমার এমন করে চিরদিন বেঁধে রাখতে পারবে না।”

‘সামঞ্জস্য’ প্রবন্ধের একজায়গায় একটুখানি ভগবদগীতার কথা লিখেছেন কবি। ”আমাদের যিনি ভগবান তিনি কখনই প্রমত্ত নন; নিরবচ্ছিন্ন সৃষ্টিপরম্পরার ভিতর দিয়ে অনন্ত দেশ ও অনন্তকাল এই কথারই কেবল সাক্ষ্য দিচ্ছে—এষ সেতুর্বিধরণো লোকানামসম্ভেদায়।

এই অপ্রমত্ত পরিপূর্ণ শান্তিকে লাভ করবার অভিপ্রায় একদিন এই ভারতবর্ষের সাধনার মধ্যে ছিল। উপনিষদে ভগবদগীতায় আমরা এর পরিচয় যথেষ্ট পেয়েছি।”

‘একটি মন্ত্র’ প্রবন্ধে একজায়গায় কবি অহল্যার কথা বলেছেন—”যদি আমাদের কেউ অহল্যার মতো পাথর করে স্থির করে রাখে তবে বুঝি যে সেটা আমাদের অভিশাপ।” অহলার কথা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন