তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড

তৃতীয় অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ৩য় খণ্ড)

রবীন্দ্ররচনাবালীর এই খণ্ডে সন্নিবেশিত গ্রন্থগুলি হলো—চৈতালী, কণিকা, কাহিনী, হাস্যকৌতুক, নৌকাডুবি, গোরা, বিচিত্র প্রবন্ধ, প্রাচীন সাহিত্য এবং লোকসাহিত্য। এছাড়া গ্রন্থপরিচয় অংশও আছে। এই গ্রন্থগুলির কোনো কোনোটিতে অতি সামান্য ভাবে এবং কোনোটিতে বিশেষভাবেই রামায়ণ-মহাভারত কাহিনীর উল্লেখ আছে।

চৈতালী কাব্যগ্রন্থের ‘বনে ও রাজ্যে’ কবিতাটিতে রামায়ণের রামচন্দ্রের কথা আছে। রামচন্দ্র রাজা হয়েছেন কিন্তু প্রজারা সীতার চরিত্র নিয়ে কানাকানি করে। প্রজানুরঞ্জক রাম সীতাকে নির্দোষ জেনেও তাঁকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন প্রজাদের সন্তুষ্ট করতে। সীতা বিহনে রামের দিন কীভাবে কাটছে তা-ই এই ছোট্ট কবিতাটিতে (চতুর্দশপদী) বলা হয়েছে।

”সারাদিন কাটাইয়া সিংহাসন’-পরে

সন্ধ্যায় পশিল রাম শয়নের ঘরে।

শয্যার আধেক অংশ শূন্য বহুকাল,

তারি পরে রাখিলেন পরিশ্রান্ত ভাল।

……….

কহিলেন নতজানু কাতর নিঃশ্বাসে—

‘যতদিন দীনহীন ছিনু বনবাসে

নাহি ছিল স্বর্ণমণি মাণিক্যমুকুতা,

তুমি সদা ছিলে লক্ষ্মী প্রত্যক্ষ দেবতা।

আজি আমি রাজ্যেশ্বর, তুমি নাই আর

আছে স্বর্ণমাণিক্যের প্রতিমা তোমার।”

মিলনদৃশ্য কবিতাটিতে (পৃ-২৪) শকুন্তলা যখন তপোবন থেকে বিদায় নিয়ে পতিগৃহে যাবেন সেই সময়কার কথা আছে। শকুন্তলার কাহিনী মূলতঃ মহাভারতেরই কাহিনী যদিও কালিদাস ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটক লিখে এই কাহিনীকে আরো বিখ্যাত করেছেন।

কণিকা কাব্যগ্রন্থে ‘শক্তের ক্ষমা’, কবিতায় দেবর্ষি নারদ ও ধরণী মায়ের কথোপকথন আছে। এটি রামায়ণ বা মহাভারতের কোনো কাহিনী নয়।

কাহিনী কাব্যগ্রন্থে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক কাহিনি আছে। এই কাব্যগ্রন্থটির আলোচনা অনেক বিস্তারিত হবে। গান্ধারীর আবেদন, নরকবাস ও কর্ণকুন্তী সংবাদ কাহিনীগুলি মহাভারতের কাহিনী অবলম্বন করে রচিত। ‘পতিতা’ এবং ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতা দুটির সঙ্গে রামায়ণের যোগ আছে।

ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাহিনী আছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। বিভাণ্ডক ঋষির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ। সে পিতার কাছে তপোবনে থাকে। জন্ম থেকে সে কোন নারী দেখেনি। স্ত্রী-পুরুষের ভেদ সে জানেনা। অঙ্গদেশের রাজা লোমপাদ। সে দেশে দ্বাদশ বৎসর অনাবৃষ্টি। পণ্ডিতেরা বিচার করে বললেন যে, ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে যদি রাজ্যে নিয়ে আসা যায় তবে রাজ্যে সুবৃষ্টি হবে। চৌদ্দ বছরের বালক ঋষ্যশৃঙ্গ। তাকে নিজরাজ্যে আনয়নের জন্য রাজা লোমপাদ বারাঙ্গনা পাঠিয়েছিলেন। অতীত দিনের বারাঙ্গনা এক বৃদ্ধার নেতৃত্বে অনেক তরুণী সুন্দরী বারাঙ্গনা উৎকৃষ্ট খাদ্য-পানীয় নিয়ে বিভাণ্ডক মুনির তপোবনে গিয়েছিল এবং বালক ঋষ্যশৃঙ্গকে ভুলিয়ে তারা লোমপাদ রাজার রাজ্যে নিয়ে এসেছিল। যে সমস্ত বারাঙ্গনারা গিয়েছিল তাদেরই একজন ফিরে এসে রাজমন্ত্রীর সঙ্গে যে সমস্ত বাক্যালাপ করেছিল, ‘পতিতা’ কবিতার বিষয়বস্তু সেটাই। কথোপকথন সবটাই রবীন্দ্রনাথের কল্পনা।

”ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিরে ভুলাতে

পাঠাইলে বনে যে কয়জন

সাজায়ে যতনে ভূষণে রতনে,

আমি তারি এক বারাঙ্গনা।”

ঋষি বালকের পূজায় সেই বারাঙ্গনার মধ্যে দেবতার জন্ম হয়েছিল—

”ঋষির বালক পুলকে তাহারে

পূজিলা প্রথম পূজার ফুলে।

আনন্দে মোর দেবতা জাগিল,

জাগে আনন্দ ভকত-প্রাণে

এ বারতা মোর দেবতা তাপস

দোঁহে ছাড়া আর কেহ না জানে।”

‘ভাষা ও ছন্দ’ একটি অপূর্ব কবিতা। দস্যু রত্নাকর যে ঋষি বাল্মীকিতে রূপান্তরিত হয়েছিল, সেই রূপান্তরের কারিগর লোকপিতামহ ব্রহ্মা এবং দেবর্ষি নারদ। দেবী সরস্বতীর কৃপায় আদিকবি বাল্মীকির মুখ দিয়ে বেরিয়েছে অপূর্ব শ্লোক। কবির মধ্যে একটা অস্থিরতা। তিনি

”সেইমত বনানীর ছায়ে

স্বচ্ছ শীর্ণ ক্ষিপ্রগতি স্রোতস্বতী তমসার তীরে

অপূর্ব উদবেগ্ভরে সঙ্গীহীন ভ্রমিছেন ফিরে

মহর্ষি বাল্মীকি কবি, রক্তবেগতরঙ্গিত বেগে

গম্ভীর জলদমন্দ্রে বারম্বার আবর্তিয়া মুখে

নব ছন্দ; বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত

মুহূর্ত্তে নিল যে জন্ম পরিপূর্ণ বাণীর সঙ্গীত,

তারে লয়ে কি করিবে, ভাবে মুনি কি তার উদ্দেশ—”

বাল্মীকির যখন এইরকম অবস্থা তখন এক সন্ধ্যাকালে ব্রহ্মার নির্দেশে দেবর্ষি নারদ এসেছেন বাল্মীকির কাছে। ব্রহ্মা জানতে চেয়েছেন বাল্মীকির কাছে—

”ওগো ভাগ্যবান,

এ মহা সংগীতধন কাহারে করিবে তুমি দান।

এই ছন্দে গাঁথি লয়ে, কোন দেবতার যশঃ কথা

স্বর্গের অমরে কবি মর্তলোকে দিবে অমরতা?”

মহর্ষি বাল্মীকি তখন জানতে চাইলেন—

”ভগবন, ত্রিভুবন তোমাদের প্রত্যক্ষে বিরাজে—

কহ মোরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে।

কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,

কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম

ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,

মহৈশ্বর্যো আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত,

সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,

কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,

কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম

সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম—

কহ মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পূণ্য নাম।

নারদ কহিলা ধীরে, ‘অযোধ্যার রঘুপতি রাম’।”

বাল্মীকি তখন বললেন যে রামের কথা তিনি একটু একটু জানেন—সবটা জানেন না। তা হলে কী করে লিখবেন তিনি সেই রামকথা? দেবর্ষি বললেন—

 ”সেই সত্য যা রচিবে তুমি,

ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি তব মনোভূমি

রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”

গান্ধারীর আবেদন কবিতাটি মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত। বাচিক শিল্পীদের কাছে এটি এখনও জনপ্রিয়। অনেক জায়গাতেই এটি আবৃত্তি হিসাবে বা শ্রুতিনাটিকা হিসাবে পরিবেশিত হয়।

একই কুরুবংশের দুটি শাখা। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা দুর্যোধন সহ শতভাই ‘কৌরব’ নামে অভিহিত আর পাণ্ডুর পুত্রেরা যুধিষ্ঠিরসহ পাঁচভাই ‘পাণ্ডব’ নামে পরিচিত। কৌরব দুর্যোধন দুরাচারী—তার দুষ্ট মন্ত্রীরা হলো মাতুল শকুনি, সখা কর্ণ ও ভ্রাতা দুঃশাসন। রাজসূয় যজ্ঞকালে পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি আর প্রতিপত্তি দেখে, দুর্যোধন ঈর্ষান্বিত। জ্ঞাতিদের এই রকম অভাবিত সৌভাগ্য কারোরই ভালো লাগেনা—দুর্যোধনের তো লাগেইনি। মাতুল শকুনিকে তিনি বলছেন—”আমার এরূপ অন্তর্দাহ উপস্থিত হইয়াছে যে, আমি আর জীবনধারণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। হয় প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে প্রবেশ করিব, না হয় হলাহল ভক্ষণ করিয়া জীবন শেষ করিব অথবা জল প্রবেশ করিয়া এই বিষম জ্বালার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইব।” দুর্যোধনের এই বিলাপ শুনে দুষ্ট শকুনি তাকে বললো যে যুদ্ধ করে পাণ্ডবদের পরাজিত করা যাবে না। পাণ্ডবদের ধনসম্পত্তি দখল করতে হলে যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলায় আমন্ত্রণ জানাতে হবে। শকুনি পাশাখেলায় অত্যন্ত দক্ষ। দুর্যোধনের হয়ে শকুনি পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করে সমস্ত ধনসম্পত্তি জিতে নেবে। পরিকল্পনাটা দুর্যোধনের খুব পছন্দ হলো। তখন দুর্যোধন মাতুল শকুনিকে সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গেলেন ও পাশাখেলার ব্যবস্থার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দুর্যোধন একটু চাপ দিতেই তিনি অনুমতি প্রদান করলেন। মহামতি বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে নিষেধ করেছিলেন কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কথার অনাদর করেছিলেন। বস্তুত ধৃতরাষ্ট্র নিজেও ছিলেন লুব্ধ এবং তাঁর মধ্যে কপটতা ছিল প্রচুর পরিমাণে।

তারপর সেই পাশাখেলা। রাজা ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রভৃতি বয়োবৃদ্ধদের উপস্থিতি সত্বেও সেদিন রাজসভা যে কদর্যতা প্রত্যক্ষ করেছিল তা এতকাল পরেও পাঠককে ক্ষুব্ধ করে, বিচলিত করে। মূল মহাভারতে দেখা যাচ্ছে সেদিনের ওই সভাতে গান্ধারীও উপস্থিত ছিলেন। ”তত্ত্ববেত্তা বিদুর ও গান্ধারী ঐ ঘোরতর উৎপাত দর্শনে সাতিশয় ভীত ও কাতর হইয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন।” (মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহকৃত অনুবাদ)।

প্রথমবারের পাশাখেলায় যুধিষ্ঠির সমস্ত ধনসম্পত্তি, নিজেদেরকে এবং দ্রৌপদীকেও পণ রেখে পরাজিত হয়েছিলেন। সেদিনের সেই সভাতে যখন দ্রৌপদীর অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা চলছিল তখন একমাত্র বিদুর ও দুর্যোধনেরই একভাই বিকর্ণ ছাড়া আর কেউ কোন প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক, ভয় পেয়ে বা সামান্য নীতিবোধ জাগ্রত হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে সর্ববিধ পণ থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্যোধনের চাপে পড়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্বিতীয়বার পাশা খেলার অনুমতি দিলেন—এবারের পণ, পরাজিত পক্ষ তেরো বৎসরের জন্য বনবাস ও অজ্ঞাতবাসে যাবে। ধৃতরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন দ্রোণ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, বিদুর, অশ্বত্থামা, বৈশ্যাপুত্র যুযুৎসু, ভীষ্ম, বিকর্ণ, প্রভৃতি। মূল মহাভারতে দেখা যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রপত্নী গান্ধারী এবারে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন—তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করার জন্য। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর কথাতেও অনাদর করে দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ার আদেশ দিয়েছিলেন।

দ্যূতক্রীড়ার ফল কী হবে সে তো জানাই। অল্প সময়ের মধ্যে যুধিষ্ঠির পরাজিত হলেন। যুধিষ্ঠির, তাঁর চারভাই এবং দ্রৌপদী প্রস্তুত হলেন সবকিছু ফেলে রেখে বনবাসে যাবার জন্য। এইখান থেকে আমরা রবীন্দ্র কবিতাটি পাচ্ছি। কবিতার সঙ্গে মূল মহাভারতের কাহিনীর অল্পস্বল্প অমিল দেখা যাচ্ছে, তবে সেটা খুব স্বাভাবিক। প্রথম এবং প্রধান ব্যতিক্রমটি হচ্ছে—গান্ধারী তাঁর কথা ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়েছিলেন দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়া আরম্ভের পূর্বে, আর রবীন্দ্র কবিতায় দেখা যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর কথোপকথন দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ার পর।

মহাভারতের এই সরল কাহিনী রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় এক অসামান্যতা লাভ করেছে। এমনকী কবির লেখনীতে দুর্যোধনের যুক্তিগুলিকেও আমাদের অন্তঃসারশূন্য মনে হয় না—মনে হয় যে মানুষের পক্ষে এই প্রবৃত্তিগুলো স্বাভাবিক। লোকে অনাত্মীয়দের ঐশ্বর্যে তত বেশি অখুশি হয় না যত হয় আত্মীয়দের উত্থানে। পাণ্ডবেরা যেহেতু নিকটাত্মীয়, তাই তাদের এই সমৃদ্ধি দুর্যোধনের গাত্রদাহের কারণ। দুর্যোধন পিতাকে বলছেন—

‘যদি হত দূরবর্তী পর

নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্বরীর শশধর

মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে,

কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব—উদয়শিখরে

দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক কিছুতে না ধরে।”

ধৃতরাষ্ট্র যখন বলছেন যে এটা ধর্মের পরাজয় হলো, তখন দুর্যোধন বলছেন—

”লোকধর্ম রাজধর্ম এক নহে পিতঃ

লোকসমাজের মাঝে সমকক্ষ জন

সহায় সুহৃদরূপে নির্ভর বন্ধন।

কিন্তু রাজা একেশ্বর; সমকক্ষ তার

মহাশত্রু, চিরবিঘ্ন, স্থান দুশ্চিন্তার,”

ধৃতরাষ্ট্র বলছেন—দুর্যোধন তো কপট পাশাখেলায় জিতেছে; তাই নিয়ে এত অহঙ্কার করার কী আছে! দুর্যোধন তখন বলছেন—

 ”যার যাহা বল

তাই তার অস্ত্র, পিতঃ যুদ্ধের সম্বল।

ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,

তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ

কোন নর লজ্জা পায়?”

ধৃতরাষ্ট্র দৃষ্টিশক্তিতে অন্ধ, পুত্রস্নেহেও অন্ধ। দুর্যোধনের কাজগুলোকে অন্যায় জেনেও তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন, সমর্থন করেছেন। পুত্রস্নেহ তাঁর কত অন্ধ সেটা বোঝা যাচ্ছে তাঁর কথায়—

”ওরে তোরা জয়বাদ্য বাজা।

জয়ধ্বজা তোল শূন্যে। আজি জয়োৎসবে

ন্যায় ধর্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি রবে—

না রবে বিদুর ভীষ্ম, না রবে সঞ্জয়,

নাহি রবে লোকনিন্দা লোকলজ্জা ভয়,

কুরুবংশ রাজলক্ষ্মী নাহি রবে আর—

শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার,

আর কালান্তক যম—শুধু পিতৃস্নেহ

আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ।”

ধৃতরাষ্ট্র সব জানেন, সব বোঝেন; জ্ঞানপাপী তিনি। এই সময়ে গান্ধারী এসেছেন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে সাক্ষাতে। গান্ধারী নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী নারী, ধর্মবোধ, নীতিবোধ তাঁর মধ্যে যথেষ্ট প্রখর (মহাভারতে অবশ্য দেখা যায় তাঁর মধ্যেও ক্ষোভ, হতাশা, ক্রোধ—এগুলো কিছু পরিমাণে হলেও ছিল। তবে এসব নিয়েও তিনি মহিয়সী নারী)। আর রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটিতে গান্ধারী চরিত্রকে এক অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। গান্ধারী এসে ধৃতরাষ্ট্রেকে প্রার্থনা জানাচ্ছেন— দুর্যোধনকে ত্যাগ করো। ধৃতরাষ্ট্র বলছেন— দুর্যোধন ধর্ম লঙ্ঘন করেছে, ধর্ম তাকে শাসন করবে। তিনি তো পিতা—। গান্ধারীর শানিত উত্তর

”মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা

জাগ্রত হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?

স্নেহ বিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে

উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি

তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?

……..

লয়ে টানি

মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,

প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি মহারাজ,

সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করে আজ।”

.. ..

ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করছেন—কী রাখিব তারে ত্যাগ করি?

গান্ধারীর উত্তর—ধর্ম তব।

ধৃতরাষ্ট্র জানতে চাইলেন—কী দিবে তোমারে ধর্ম?

গান্ধারীর দ্বিধাহীন উত্তর—দুঃখ নব নব।

পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্মের পণে

জিনি লয়ে চিরদিন বহিব কেমনে

দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া?

ধর্মপথে চললেই যে সুখ—সম্পদ-শান্তি সব উছলে পড়বে এমন নয়। বরং ধর্মপথে চললে দুঃখ পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি; তবুও ধর্মপথেই থাকতে হবে। ঈশ্বর অধর্মাচরণের জন্য দুর্যোধনকে কি শাস্তি দেবেন, তার ওপরে ছেড়ে দিলে চলবে না—কারণ ধৃতরাষ্ট্র হচ্ছেন রাজা। আর রাজার মাধ্যমেই তো ঈশ্বর ধর্মরক্ষার কাজ করেন। গান্ধারী জিজ্ঞাসা করছেন—

”শুধাই তোমারে,

যদি কোনো প্রজা তব সতী অবলারে

পরগৃহ হতে টানি করে অপমান

বিনা দোষে—কী তাহার করিবে বিধান?

ধৃতরাষ্ট্র উত্তর দিচ্ছেন যে নির্বাসনই তার শাস্তি। তখন গান্ধারী বললেন—

”তবে আজ রাজপদতলে

সমস্ত নারীর হয়ে নয়নের জলে

বিচার প্রার্থনা করি। পুত্র দুর্যোধন

অপরাধী প্রভু! তুমি আছ, হে রাজন,

প্রমাণ আপনি। পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব

স্বার্থ লয়ে বাধে অহরহ—

……..

পুরুষেরে ছাড়ি

অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া নিরুপায় নারী

গৃহধর্মচারিণীর পুণ্যদেহপরে

কলুষ পরুষ স্পর্শে অসম্মানে করে,

হস্তক্ষেপ—….

…প্রভু মাতৃগর্বভরে

ভেবেছিনু গর্ভে মোর বীরপুত্রগণ

জন্মিয়াছে—হায় নাথ, সেদিন যখন

অনাথিনী পাঞ্চালীর আর্তকণ্ঠরব

প্রাসাদ পাষাণভিত্তি করি দিল দ্রব

লজ্জাঘৃণা করুণার তাপে, ছুটি গিয়া

হেরিনু গবাক্ষে, তার বস্ত্র আকর্ষিয়া

খল খল হাসিতেছে সভা-মাঝখানে

গান্ধারীর পুত্র পিশাচেরা—ধর্ম জানে

সেদিন চূর্ণিয়া গেল জন্মের মতন

জননীর শেষ গর্ব।”

তবু কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে টলাতে পারলেন না গান্ধারী। ধৃতরাষ্ট্র সব স্বীকার করে নিয়েও বলছেন—

”এখন তো আর

বিচারের কাল নাই, নাই প্রতিকার

নাই পথ —ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার,

ফলিবে যা ফলিবার আছে।

এর পরে দুর্যোধন পত্নী ভানুমতীর সঙ্গে গান্ধারীর কথোপকথন আছে। মূল মহাভারতে ভানুমতীকে এই পর্যায়ে কখনো প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। মহাভারতে এইটুকু বলা আছে যে দ্রৌপদীকে দেখে কৌরবরমণীরা অসূয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ”ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূগণ অপ্রশস্ত মনে দ্রৌপদীর পরমোৎ কৃষ্ট সম্পত্তি দর্শন করিতে লাগিলেন।” (মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ)। রবীন্দ্ররচনায় দেখা যাচ্ছে যে ভানুমতী দুর্যোধনের যোগ্যা মহিষী। গান্ধারী যখন ভানুমতীকে জিজ্ঞাসা করলেন যে কোন উৎসবের জন্য সে এত সাজগোজ করেছে, তখন ভানুমতী উত্তর দিচ্ছে—

”শত্রুপরাভব-শুভক্ষণ

সমাগত।

”জিনি বসুমতী

ভুজবলে, পাঞ্চালীরে তার পঞ্চপতি

দিয়েছিল যত রত্ন মণি অলংকার

…. সে রত্নভূষণে

আমারে সাজায়ে তারে যেতে হল বনে।”

গান্ধারী যখন ভানুমতীকে তার অহঙ্কারের জন্য তিরস্কার করলেন, সে বললো—

”মাতঃ, মোরা ক্ষত্রনারী, দুর্ভাগ্যের ভয়

নাহি করি। কভু জয়, কভু পরাজয়—

মধাহ্নগগনে কভু, কভু অস্তধামে,

ক্ষত্রিয় মহিমা সূর্য উঠে আর নামে।

.. .. ….

দুর্দিন দুর্যোগ যদি আসে,

বিমুখ ভাগ্যেরে তবে হানি উপহাসে

কেমনে মরিতে হয় জানি তাহা দেবী—

কেমনে বাঁচিতে হয় শ্রীচরণ সেবি

সে শিক্ষাও লভিয়াছি।”

এরপরে গান্ধারীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির, দ্রৌপদী, প্রভৃতির সাক্ষাৎ দেখানো হয়েছে। যুধিষ্ঠির বিদায়ের আগে গান্ধারীকে প্রণাম করতে গেছেন। মূল মহাভারতে যুধিষ্ঠির গান্ধারীর কাছে বিদায় নিতে গেছেন, এরকম কোন বর্ণনা নেই। ”যুধিষ্ঠির কহিলেন, এক্ষণে আমি সকল ভারত, বৃদ্ধ পিতামহ, রাজা সোমদত্ত, বাহ্লীক, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, সকল ধার্ত্তরাষ্ট্র, সঞ্জয় এবং অন্যান্য সভাসদগণের নিকট বিদায় লইয়া চলিলাম….”। উল্লেখ না থাকলেও এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যুধিষ্ঠিরের যা প্রকৃতি তাতে তিনি অবশ্যই যাওয়ার আগে গান্ধারীকেও প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। অন্যত্র আমি লিখেছি ব্যাসদেব আমাদের যে লক্ষ শ্লোকের মহাভারত দিয়েছেন তা সংক্ষিপ্ত এবং অনেক জায়গাতেই আমাদের কৌতূহলের নিবৃত্তি হয় না। আর এই সমস্ত জায়গাতেই কবি সাহিত্যেকেরা তাঁদের কল্পনাকে পল্লবিত করতে পারেন।

নরকবাস কবিতাটির কাহিনী মহাভারত থেকে নেওয়া। মূল মহাভারতে এই কাহিনী আছে তবে কাশীরামদাসের মহাভারতে নেই। তাঁর রচনায় রবীন্দ্রনাথ মোটামুটি মহাভারতের কাহিনীই অনুসরণ করেছেন।

পাশাখেলায় হেরে গিয়ে পাণ্ডবেরা যখন বনবাসে ছিলেন তখন লোমশমুনি এসেছিলেন পাণ্ডবদের কাছে। পাণ্ডবদের সঙ্গে যতদিন ছিলেন অনেক কাহিনী শুনিয়েছিলেন তিনি যার মধ্যে সোমকরাজার কথাও ছিল। এই সোমকরাজার কাহিনী নিয়েই রবীন্দ্রনাথের ‘নরকবাস’ কবিতা।

সোমক রাজার একশত মহিষী ছিলেন, তা সত্বেও রাজার বহুদিন পর্যন্ত কোন অপত্য লাভ হয়নি। পরিশেষে রাজার বৃদ্ধবয়সে এক রাণী একটি মাত্র পুত্রসন্তান প্রসব করেন তার নামে জন্তু। একমাত্র সন্তান হওয়ার জন্য জন্তু মাতা এবং সমস্ত বিমাতাদেরই খুব প্রিয়পাত্র ছিল। রাজাও এই জন্তুর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। একদিন একটি পিঁপড়ে জন্তুকে দংশন করলে সে ব্যথায় চীৎকার করে কেঁদে ওঠে। তাই শুনে রাজা ব্যস্ত হয়ে পাত্রমিত্রসহ অন্তঃপুরে গিয়ে জন্তুকে সান্ত্বনা করেন। রাজসভায় ফিরে এসে তিনি সকলের সামনেই মতপ্রকাশ করলেন যে একপুত্র হওয়া খুব যন্ত্রণাদায়ক—তার চাইতে পুত্র না হওয়া ভাল। রবীন্দ্ররচনায় বলা হয়েছে যে সেই সময়ে রাজপুরোহিত ঋত্বিক রাজাকে আশীর্বাদ করার জন্য ধান-দুর্বা নিয়ে রাজসভায় এসেছিলেন। রাজা কোন কিছু তোয়াক্কা না করে ব্রাহ্মণকে ঠেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন অন্তঃপুরে। কিছুক্ষণ পরে রাজা ফিরে এলেন রাজসভায়—তখন তিনি শান্ত হয়েছেন, লজ্জিতও হয়েছেন একটু। ব্রাহ্মণ ঋত্বিক তাকে তিরস্কার করলেন—কি এমন অনর্থ ঘটেছিল যার জন্য রাজা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রেখে ছুটে গিয়েছিলেন অন্তঃপুরে! তিরস্কারের পরও রাজা নস্র হয়ে ব্রাহ্মণকে বলেছিলেন—

”ভগবন, শান্তি নাই এক পুত্র লয়ে।

ভয়ে ভয়ে কাটে কাল। মোহবশে তাই

অপরাধী হইয়াছি—ক্ষমা ভিক্ষা চাই।

ঋত্বিকের রাগ তখনো কমেনি। তিনি বললেন—

”এক-পুত্র-শাপ

দূর করিবারে চাও—পন্থা আছে তারো

কিন্তু সে কঠিন কাজ, পারো কি না পারো

ভয় করি।”

রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন, যত কঠিন কাজই হোক তিনি করবেন। ঋত্বিক বললেন—

”হে রাজন

শুন তবে। আমি করি যজ্ঞ আয়োজন

তুমি হোম করো দিয়ে আপন সন্তান।

তারি মেদগন্ধধূম করিয়া আঘ্রাণ

মহিষীরা হইবেন শতপুত্রবতী।”

এই কথা শুনে সভার সকলেই ধিক্কার দিল, কিন্তু রাজা বললেন যে তাঁর প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হবে না—তিনি ব্রাহ্মণের কথামতো কাজ করবেন।

ঋত্বিক যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। শিশুটিকে অন্তঃপুর থেকে নিয়ে আসতে কেউ রাজী নয়। তখন ঋত্বিক নিজে গেলেন অন্তঃপুরে।

”বল করি

মাতৃগণ-অঙ্ক হতে লইলাম হরি

সহাস্য শিশুরে।”

শিশুকে নিয়ে এসে ঋত্বিক রাজাকে বললেন—”হে রাজন,

আমি করি মন্ত্রপাঠ, তুমি এরে লও,

দাও অগ্নিদেবে।”

যজ্ঞ সম্পন্ন হলে নিদিষ্ট সময় অন্তে রাজার মহিষীরা সবাই পুত্রবতী হয়েছিলেন। তারপর বহুদিন রাজত্ব করার পর রাজার যখন দেহত্যাগ হলো, তখন দেবদূতেরা তাকে স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি শুনতে পেলেন কেউ তাকে ডাকছে—রাজা তাকে দেখতে পাচেছন না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন। রাজার জিজ্ঞাসায় সেই কন্ঠস্বর বললো যে সে ঋত্বিক-মর্ত্য লোকে সে রাজার পুরোহিত ছিল, এখন সে নরকভোগ করছে। আরো বললো যে রাজার একমাত্র পুত্রকে যজ্ঞের জন্য বধ করে সে যে পাপ করেছিল তার শাস্তি হিসাবেই তার নরকবাস হয়েছে। রাজা তখন বললেন যে তিনিও তো একই অপরাধে অপরাধী। তবে তিনি কেন স্বর্গে যাচ্ছেন আর তার পুরোহিত নরক ভোগ করছেন। ধর্মরাজ তখন বললেন যে রাজারও পাপ ছিল সত্যকথা কিন্তু তিনি অনুশোচনার মাধ্যমে প্রায়শিত্ত করেছেন।

”করিয়াছ প্রায়শ্চিত্ত তার

অন্তর নরকানলে। সে পাপের ভার

ভস্ম হয়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। যে ব্রাহ্মণ

বিনা চিত্তপরিতাপে পরপুত্রধন

স্নেহ বন্ধ হতে ছিঁড়ি করেছে বিনাশ

শাস্ত্রজ্ঞান অভিমানে, তারি হেথা বাস

সমুচিত।”

ধর্মরাজ বললেও রাজা কিন্তু তার পুরোহিতকে পরিত্যাগ করলেন না। তিনিও পুরোহিতের সঙ্গে নরকেই থাকতে চাইলেন। ধর্ম তখন বললেন—

”মহান গৌরবে হেথা রহো মহীপতি!

ভালের তিলক হোক দুঃসহ দহন,

নরকাগ্নি হোক তব স্বর্ণসিংহাসন।”

কর্ণকুন্তী-সংবাদ—মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটিও খুব জনপ্রিয়। মহাভারতে কর্ণ দোষে-গুনে মেশানো এক অত্যন্ত বর্ণময় চরিত্র। তিনি মহাবীর, অদ্বিতীয় দাতা এবং অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। আবার সেই কর্ণই নারীঅবমাননাকারী এবং বালকহন্তা। তিনি ভাগ্যবিড়ম্বিতও! জন্মলগ্ন থেকেই ভাগ্য তাঁকে বঞ্চনা করে চলেছে। মাতা কুন্তীর কানীন পুত্র তিনি। লোকলজ্জাভয়ে জন্মের পরই কুন্তী তাঁকে পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এই অবস্থায় শিশুটির বেঁচে থাকার কথা নয়, কিন্তু দৈব অত্যন্ত বলবান। সূত অধিরথ এবং তাঁর সন্তানহীনা স্ত্রী রাধা এসেছিলেন নদীতে স্নানের জন্য। অধিরথ দেখতে পেলেন নদীতে ভেসে যাওয়া পেটিকাটিকে। সেটি সংগ্রহ করে তিনি দেখতে পেলেন সদ্যজাত শিশু তখনো জীবিত। দৈবপ্রেরিত মনে করে শিশুটিকে তিনি তুলে দিলেন তাঁর স্ত্রী রাধার কোলে; সন্তানহীনা রাধা সেই শিশুটিকে পেয়ে বাৎসল্যে অভিভূত হলেন। তাঁর স্তনে দুগ্ধসঞ্চার হলো এবং তিনি শিশুটিকে প্রতিপালন করলেন। যথাসময়ে সূতপুত্র হিসাবে (অধিরথ সূতবংশীয়, তাই কর্ণও সূতপুত্র) তাঁর জাতকর্মাদি সম্পন্ন হলো। ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয় পুরুষের সংযোগে যে সন্তান উৎপন্ন হয় তাকে সূত বলা হয়। এই সূতদের মধ্যে কেউ কেউ সারথির কাজ করতো আবার কেউ কেউ পুরাণকথা, কাব্য ইত্যাদি কীর্তন করে বেড়াতো। যেহেতু তারা বর্ণসংকর তাই সমাজে তারা হীনজাতি বলে পরিগণিত হতো। ক্ষত্রিয় সন্তান হয়েও কর্ণ তাই সূতপুত্র পরিচয়ে বড় হতে লাগলেন। তবে সূতের বৃত্তি তিনি নিলেন না—অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করলেন।

শস্ত্রগুরু পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করে কর্ণ একজন দুর্ধর্ষ বীরে পরিণত হলেন। যেদিন কৌরব রাজকুমারদের (পাণ্ডবেরাও কৌরব কারণ তারাও মহারাজ কুরুর অধস্তন প্রজন্ম) অস্ত্রবিদ্যার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে সেদিন কর্ণও সেখানে হাজির হয়ে গেলেন—তিনি রাজকুমারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর অর্জুনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবেন। কিন্তু বংশকৌলিন্য ছাড়া তো রাজকুমারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যাবে না। কৃপাচার্য্য তাঁর বংশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। কর্ণর বলবার মতো কিছু ছিল না—তিনি তো নিজেকে অধিরথের পুত্র বলেই জানেন।

ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন পাণ্ডবদের প্রতি অত্যন্ত বিদ্বিষ্ট। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসাবে স্বীকৃত হওয়াতে দুর্যোধনের খুব হিংসা হয়েছিল। কর্ণকে দেখে তার মনে হলো এ অর্জুনের যোগ্য প্রতিপক্ষ হতে পারবে। রাজা বা রাজপুত্র নয় বলে কর্ণকে অর্জুনের সঙ্গে অস্ত্রপ্রতিযোগিতা করতে দেওয়া হচ্ছিল না। দুর্যোধন সঙ্গে সঙ্গে কর্ণকে কৌরবসাম্রাজ্যের অন্তর্গত এক জনপদের রাজা হিসাবে ঘোষণা করলেন এবং তাঁর অভিষেক করে দিলেন যাতে অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কোন বাধা না থাকে।

অস্ত্রপরীক্ষা যাঁরা দেখছিলেন তাঁদের মধ্যে পাণ্ডবজননী কুন্তীও ছিলেন। যদিও কর্ণকে পেটিকায় করে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার পর কুন্তী আর তাকে দেখেননি, তবুও কর্ণকে দেখামাত্র তিনি চিনতে পারলেন কারণ কর্ণ জন্মেছিলেন শরীরের সঙ্গে কবচকুণ্ডল যুক্ত হয়ে। এরকম আর কারো ছিল না। বহুদিন পর পুত্রমুখ দর্শনের আনন্দ, পরিচয় প্রকাশ হওয়ার আশংকা এবং নিজেরই দুই পুত্র অর্জুন এবং কর্ণর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা—এত উদ্বেগ কুন্তী সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মূর্ছিতা হয়ে পড়লেন আর কৃপাচার্য্য সেদিনের মতো অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু অর্জুন এবং কর্ণের মধ্যে একটা চিরকালীন বৈরিতা সৃষ্টি হয়ে গেল। তখন থেকে কর্ণর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো অর্জুনকে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বীর হিসাবে প্রতিপন্ন করা আর অর্জুনও চাইতেন এই হীনজাতি সূতপুত্রকে যুদ্ধে উচিৎ শিক্ষা দিতে।

অর্জুন ও কর্ণর মধ্যে যে যুদ্ধটা সম্ভাবনার আকারে ছিল সেটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ালো যখন পাণ্ডবরা বনবাস ও অজ্ঞাতবাসপর্ব শেষ করে এলেন, কিন্তু দুর্যোধন তাঁদের প্রাপ্য রাজ্যাংশ ফেরৎ দিতে অস্বীকৃত হলেন। কর্ণকে দেখার পর থেকেই কুন্তী খুব অশান্তির মধ্যে থাকতেন—কখন তাঁর দুই পুত্রের যুদ্ধ লেগে যায়! এখনযখন যুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে গেল তখন কুন্তী অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি জানেন এই দুজনের যুদ্ধ শুরু হলে হয় অর্জুন না হয় কর্ণ যে কোন একজন নিহত হবেন। যিনিই নিহত হোন না কেন তিনি তো কুন্তীরই পুত্র, তাঁরই নাড়ী ছেঁড়া ধন। তিনি ভাবলেন একবার শেষ চেষ্টা করবেন যাতে অর্জুন এবং কর্ণর যুদ্ধ বন্ধ করা যায়! কুন্তী শুনেছেন কর্ণর দানশীলতার কথা। কর্ণ প্রাতঃকালে জাহ্নবীর পবিত্র সলিলে অবগাহন করে ভগবান দিবাকরের পূজা করেন। কুন্তী ঠিক করলেন এই সময়েই তিনি কর্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর জন্মপরিচয় প্রদান করবেন আর অনুরোধ করবেন তাঁর নিজের ভাইদের সঙ্গে মিলিত হতে। ”মহানুভবা কুন্তী এইরূপ কার্য্য বিনিশ্চয় করিয়া ভাগীরথীতীরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ক্রমে গঙ্গাতীরে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, স্বীয় আত্মজ সত্যপরায়ণ মহাতেজাঃ কর্ণ পূর্বমুখে উর্দ্ধবাহু হইয়া বেদ পাঠ করিতেছেন। পাণ্ডুপত্নী পৃথা আতপতাপে নিতান্ত তাপিত হইয়াছিলেন। কর্ণের পাশ্চাদ্ভাগে উত্তরীয়চ্ছায়ায় দন্ডায়মান হইয়া তাঁহার জপাবসান প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। মহানুভব কর্ণ অপরাহ্ন পর্য্যন্ত পূর্বাভিমুখে জপ করিয়া পরিশেষে পশ্চিমাভিমুখ হইবামাত্র কুন্তীকে অবলোকন করিলেন।” (কালীপ্রসন্ন সিংহ কৃত অনুবাদ) এইখান থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি আমরা পাচিছ। কুন্তী এবং কর্ণর কথোপকথনের মধ্যে পুরোনো কথা এসেছে এবং কবিতাটি পাঠ করে আমরা সেগুলো জানতে পারছি। কুন্তীকে দেখে কর্ণ বলছেন—

”পূণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার

বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার

অধিরথ সুতপুত্র, রাধাগর্ভজাত

সেই আমি—কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ”

(কাশীদাসী মহাভারতে এই নদীকে যমুনা বলা হয়েছে)। কুন্তী অবশ্য তখনই কর্ণর সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ স্পষ্ট করে বললেন না—তবে বললেন যে তিনি অর্জুনজননী। অর্জুনের মা হয়েও তিনি যে কর্ণর শুভাকাঙ্ক্ষী, বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে তিনি সেটা বোঝাতে চাইলেন। বললেন যে অস্ত্রপরীক্ষার দিনে কর্ণ যখন রঙ্গস্থলে প্রবেশ করেছিলেন, তখন

”যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত

তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী

অতৃপ্ত স্নেহ ক্ষুধার সহস্র নাগিনী

জাগায়ে জর্জর বক্ষে—কাহার নয়ন

তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশীষ চুম্বন।

অর্জুন জননী সে যে।”

যখন কৃপাচার্য্য এসে কর্ণর পিতার নাম জিজ্ঞাসা করলেন আর বললেন—’রাজকূলে জন্ম নহে যার অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার’—তখন কর্ণ কোন উত্তর দিতে না পেরে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্ণর সেই লজ্জা আর যাকে পীড়িত করেছিল, তিনি অর্জুনজননী কুন্তী। সেদিন এই কুন্তীই কর্ণকে বীর বলে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। সব শুনে কর্ণ বললেন—

”প্রণমি তোমারে আর্যে। রাজমাতা তুমি।

কেন হেথা একাকিনী। এ যে রণভূমি,

আমি কুরুসেনাপতি।”

কুন্তী তখন বললেন যে তিনি কর্ণর কাছে একটা ভিক্ষা চাইতে এসেছেন তবে তখনো কর্ণর সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধটা পরিষ্কার করে দিলেন না। অপেক্ষা করলেন সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসা পর্যন্ত। তারপর অন্য কিছু কথাবার্তার পর জানালেন—

”পুত্র মোর, ওরে,

বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে

এসেছিলি একদিন—সেই অধিকারে

আয় ফিরে সগৌরবে, আয় নির্বিচারে—

সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম-

লহ আপনার স্থান।”

ঐ অভাবনীয় সংবাদ যে তিনি কুন্তীর পুত্র, অর্জুনের আপন ভাই,—জানতে পেরে কর্ণ প্রথমে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন—

”রাজমাতঃ অয়ি,

সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, এসো স্নেহময়ী

তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে

রাখো ক্ষণকাল।”

তবে এই ঘোর কেটে গেলে তিনি নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এই বলে—

”কেন তবে

আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে

কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন

অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে। কেন চিরদিন

ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে—

কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে।”

কুন্তী কর্ণকে সিংহাসনের কথা বলেছিলেন—

 ”রাজ্য আপনার

বাহুবলে করি লহো, হে বৎস, উদ্ধার।

দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির,

ভীম ধরিবেন ছত্র, ধনঞ্জয় বীর

সারথি হবেন রথে…

….. তুমি শত্রুজিৎ

অখণ্ড প্রতাপে রবে বান্ধবের সনে

নিঃসপত্ন রাজ্য মাঝে রত্নসিংহাসনে।”

কর্ণর উত্তর— ”সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহপাশ—

তাহারে দিতেছ, মাতঃ, রাজ্যের আশ্বাস।

একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত

সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।

মাতা মোর ভ্রাতা মোর, মোর রাজকুল

এক মুহূর্তেই, মাতঃ করেছ নির্মূল

মোর জন্মখনে।”

মহাভারতের কর্ণ গর্ভধারিণী জননীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তিনি অর্জুন ছাড়া অপর চার ভাইকে বধ করবেন না। সেক্ষেত্রে অর্জুন বা কর্ণ যিনিই নিহত হন, কুন্তী পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন। এই কবিতাতে কর্ণ কুন্তীকে এরকম কোন আশ্বাস দেননি। বরং তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, যুদ্ধে পাণ্ডবেরা বিজয়ী হবেন, তবে তিনি দুর্যোধনকে ত্যাগ করবেন না—

”মাতঃ, করিয়ো না ভয়।

কহিলাম, পাণ্ডবের হইবে বিজয়।

……..

.. যে পক্ষের পরাজয়

সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।

জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান—

আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে।”

হাস্যকৌতুকের লেখাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ক্ষুদ্র কৌতুকনাট্য। এর মধ্যে কখনো কখনো অল্প-স্বল্প রামায়ণ-মহাভারতের কথা এসেছে casual ভাবে কখনো মজা করার জন্য কখনো বা ব্যঙ্গার্থে। বর্ণনাগুলোর উল্লেখ করছি।

‘চিন্তাশীল’ নাটিকার নরহরি সবসময়ই চিন্তা করে, সব কথা নিয়েই ভাবে। তার মাসীমা তাকে বলছেন—”ছি নরু, তুই কি পাগল হলি? ছেঁড়া চাদর, একমুখ দাড়ি সমুখে ভাত নিয়ে ভাবনা। সুবলের মা তোকে দেখে হেসেই কুরুক্ষেত্র।” নরহরি বলছে ”কুরুক্ষেত্র! আমাদের আর্যগৌরবের শ্মশানক্ষেত্র! মনে পড়লে কি শরীর রোমাঞ্চিত হয় না! অন্তঃকরণ অধীর হয়ে ওঠে না! … বলো কি মাসী! হেসেই কুরুক্ষেত্র! তার চেয়ে বলো-না কেন কেঁদেই কুরুক্ষেত্র!”

(কুরুক্ষেত্রে কৌরব এবং পাণ্ডবদের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল)

‘আর্য ও অনার্য’ নাটিকার চিন্তামণি দাবী করে সে আর্য্য। তার বিদ্যাবুদ্ধি পড়াশোনা বিশেষ কিছু নেই। এই রকম আচার—সর্বস্ব ধর্মের ধ্বজাধারীদের রবীন্দ্রনাথ কখনো পছন্দ করেননি। এই নাটিকাটিতে চিন্তামণিকে নিয়ে কৌতুক এবং ব্যঙ্গ আছে।

”চিন্তামণি : যে আজ্ঞে, আপনি না হয় আর্য্য না হলেন, আমি এবং আমার শ্রীবাবা আর্য! হায় কোথায় আমাদের সেই পূর্বপুরুষগণ, কোথায় কশ্যপ ভরদ্বাজ ভৃগু—

অদ্বৈত : এ ব্যক্তি বলে কী! কশ্যপ তো আমাদের পূর্বপুরুষ, আমাদের কশ্যপ গোত্রে জন্ম-তোমার পূর্বপুরুষ কশ্যপ ভরদ্বাজ ভৃগু এ কিরকম কথা!

চিন্তামণি : আপনি এ সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ,…..হায়! এ সকল ইংরাজী শিক্ষার শোচনীয় ফল।

অদ্বৈত : ইংরাজী শিক্ষা আপনাতে কি ফলেনি?

চিন্তামনি : আজ্ঞে, সে দোষ আমাকে দিতে পারবেন না, স্বাভাবিক আর্যরক্তের তেজে আমি অতি বাল্যকালেই ইস্কুল পালিয়েছিলুম।”

”চিন্তামণি : যুরোপীয়েরা অতি নিকৃষ্ট জাতি এবং বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যদের তুলনায় তারা নিতান্ত মূর্খ—….। এখনো আর্যবংশীয়েরা তেল মাখার পূর্বে অশ্বত্থামাকে স্মরণ করে ভূমিতে তিনবার তৈল নিক্ষেপ করেন। কেন করেন আপনি জানেন?”

উত্তরে উপস্থিত সকলেই বললো যে তারা জানে না। তখন চিন্তামণি নিজেই উত্তর দিচ্ছে—”ম্যাগনেটিজম! আর কিছু নয়। ইংরেজীতে যাকে বলে ম্যাগনেটিজম।”

অশ্বত্থামার কাহিনী মহাভারতে আছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অষ্টাদশ দিবসের যুদ্ধে দুর্যোধনের পতনের পর পাণ্ডবেরা জয়ী হন। রাত্রিবেলা পাণ্ডবশিবিরে সবাই যখন শান্তির নিদ্রায় মগ্ন, তখন ব্রাহ্মণকুলাঙ্গার অশ্বত্থামা যুদ্ধের সমস্ত নিয়মনীতি লংঘন করে চোরের মতো পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ করে এবং তাদেরকে হত্যা করে। শ্রীকৃষ্ণ, সাত্যকি এবং পাণ্ডবেরা পাঁচভাই অন্যত্র থাকাতে বেঁচে যান। পরদিবস পাণ্ডবেরা অশ্বত্থামার খোঁজ করে তাকে শাস্তি দেন। কাশীরাম দাসের মহাভারতে আছে যে শাস্তি হিসাবে পাণ্ডবেরা অশ্বত্থামার মাথার মহামূল্যবান মণি কেটে নেন। ব্যাসদেব অশ্বত্থামাকে বলেছিলেন—

”মণি দিলে শির ক্ষত হইবে তোমার। বৎসর সহস্র তৈলে নাহি প্রতিকার।।

শিরের পীড়ায় তুমি করিবে ভ্রমণ। যেমন তোমার কর্ম্ম হইল তেমন।।”

”পৃথিবীতে লোকে তৈল মাখিবার কালে। তব নামে তিনবার অগ্রে দিবে ফেলে।।

সেই তৈল পড়িবেক পৃথিবী উপরে। তোমার মস্তকে পড়িবেক মম বরে।।

তাহাতে নিবৃত্তি হবে তোমার জ্বলনী। নিজস্থানে যাহ, ভয় না করিহ দ্রৌণী।।”

মূল মহাভারতে এই তৈল প্রদানের কোন কাহিনী নেই।

আশ্রমপীড়া নাটিকাটিতে কয়েকটি ছিটগ্রস্ত চরিত্র আছে। তাদের একজন, লেখক গণেশ বলছে—”নল যে বিনা আয়োজনে আগুন জ্বালাতেন সে অক্সিজেন হাইড্রোজেন যোগে।” মূল মহাভারত এবং কাশীদাসী মহাভারত দুই জায়গাতেই নল রাজার কাহিনী আছে। দেববরে নলরাজার কিছু দুর্লভ ক্ষমতা ছিল। যে কোন আয়োজন ব্যতীতই তিনি আগুন জ্বালাতে পারতেন।

গুরুবাক্য নাটিকাটিতে বদন একজন শিষ্য। তার মনে একটা তর্ক এসেছে। —”কাল মশারি ঝাড়তে ঝাড়তে হঠাৎ মনে একটা তর্ক এল যে, এত দেশ থাকতে জটায়ু কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে মারা পড়ল? জটায়ু যে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে ম’ল তার অর্থ কী, তার কারণ কী এবং তার তাৎপর্য্যই বা কী? এর মধ্যে যদি কোন রূপক থাকে তবে তাই বা কী? যদি কোন অর্থ না থাকে তাই বা কেন?”

অন্য শিষ্যেরা এই প্রশ্নের যখন উত্তর খুঁজছে তখন গুরুদেব শিরোমণিমশাই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। গুরুদেবকে প্রশ্নগুলো বলা হলো। একজন শিষ্য যে উত্তরটা দিয়েছিল রাবণের অস্ত্রাঘাতই জটায়ুর মৃত্যুর কারণ সেটাও তাকে বলা হল। এই উত্তরটা যে দিয়েছিল শিরোমণিমশাই তাকে খুব তাচ্ছিল্য করলেন।

রাবণ এবং জটায়ু দুজনেই রামায়ণের চরিত্র। রাবণ বা দশানন লঙ্কার রাজা। জটায়ু মহাবলশালী পক্ষী, রামচন্দ্রের পিতা দশরথের মিত্র। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল, জটায়ু দেখতে পেয়ে বাধা দেয়। রাবণের অস্ত্রাঘাতে জটায়ু গুরুতররূপে আহত হয়, পরে তার মৃত্যু হয়।

রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি একটা অত্যন্ত সুখপাঠ্য উপন্যাস। এই বৃহৎ উপন্যাসে রামায়ণ-মহাভারতের উল্লেখ বিশেষ চোখে পড়েনি। শুধুমাত্র একজায়গায় রামায়ণের চরিত্র রামচন্দ্র এবং সীতার একটু উল্লেখ আছে। সেটি রামায়ণের কোনো কাহিনীর নয় এবং প্রসঙ্গটিও অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর। নৌকাডুবিতে বেঁচে যাওয়া কমলা স্টীমারে চলেছে। তার সঙ্গী রমেশের সঙ্গে তার সম্পর্কে একটু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। স্টীমারে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে পশ্চিম-মুলুকের চক্রবর্তী খুড়ার সঙ্গে। চক্রবর্তী মহাশয় আলাপী এবং উপকারী মানুষ। কমলার পায়ে সম্ভবত চটিটি ছিল। ”চক্রবর্তী তাহাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন—না না মা, এটা ভালো হইল না।…

কমলা, কী ভালো হইল না কিছু বুঝিতে না পারিয়া আশ্চর্য্য ও কুন্ঠিত হইয়া উঠিল। বৃদ্ধ কহিলেন—ঐ যে, ঐ জুতোটা। রমেশবাবু, এটা আপনা কর্তৃকই হইয়াছে।… দেশের মাটিকে এই সকল চরণস্পর্শ হইতে বঞ্চিত করিবেন না…। রামচন্দ্র যদি সীতাকে ডসনের বুট পরাইতেন তার লক্ষ্মণ কি চোদ্দ বৎসর বনে ফিরিয়া বেড়াইতে পারিতেন মনে করেন? (সুলভ ৩য় পৃঃ ২৬৯)

‘গোরা’ একটি অসাধারণ উপন্যাস। রবীন্দ্রসাহিত্য যাঁরা পড়েন গোরা তাঁদের কাছে অচেনা নয়। প্রথমদিকে গোরা হিন্দুত্ববাদী, পরে সে মানবতাবাদী। বিনয় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিনয় একটা ব্রাহ্ম পরিবারে যাতায়াত শুরু করেছে যেখানে শিক্ষিতা অবিবাহিতা মেয়েরা আছে। বিনয়ের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে গোরা বলছে—’তদা নাশংসে মরণায় সঞ্জয়!’ (সুলভ, ৩য়, পৃ-৩৮৫) এটা মহাভারতের আদিপর্বের একটা শ্লোকের অনুকরণে বলা। মূলে আছে—’নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়’ ধৃতরাষ্ট্র বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সঞ্জয়কে বলছেন যে যখন তিনি এটা জেনেছেন বা শুনেছেন তখন থেকেই তিনি আর পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের আশা করেননি—নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়। গোরা এখানে বিজয়ায় না বলে ‘মরণায়’ বলেছে।

উক্ত গ্রন্থের (সুলভ-৩য় খণ্ড) ৪১৭ পৃষ্ঠাতে গোরা বিনয়ের ব্রাহ্মবাড়ীতে যাতায়াতের ব্যাপারে বলছে—”আমার সন্দেহ হচ্ছে অভিমন্যুর মতো তুমি প্রবেশ করবার রাস্তাই জানো—বেরোবার রাস্তা জানো না।” অভিমন্যুর কাহিনী মহাভারতে আছে। দ্রোণচার্য্য তখন কৌরব পক্ষের প্রধান সেনাপতি। যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে সংশপ্তকেরা অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করে বহুদূরে নিয়ে গেছে। দ্রোণাচার্য্য যুদ্ধক্ষেত্রে চক্রব্যূহ রচনা করে পাণ্ডবদের অবস্থা খুব কঠিন করে দিয়েছেন। যুধিষ্ঠির তখন অভিমন্যুকে বলছেন যে পাণ্ডবদের শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে এই চক্রব্যূহ ভেদ করার কৌশল জানেন মাত্র চারজন—শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন (অন্যত্র যুদ্ধে ব্যাপৃত), কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন (যুদ্ধে যোগ দেননি) এবং অভিমন্যু। তাই অভিমন্যুকেই এই চক্রব্যূহ ভেদ করে কৌরব আক্রমণ ভোঁতা করে দিতে হবে। নইলে পাণ্ডবপক্ষ ধ্বংস হয়ে যাবে। অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করে ভিতরে প্রবেশের কৌশল জানতেন কিন্তু বেরিয়ে আসবার নিয়ম জানতেন না। তবুও অভিমন্যু সাহস করে চক্রব্যূহে প্রবেশ করেছিলেন এবং সেখানে কৌরবদের সমবেত আক্রমনে নিহত হয়েছিলেন।

উক্ত গ্রন্থের ৪২৬ পৃষ্ঠাতে গোরার ‘নাগপাশের’ কথা মনে পড়েছে। সে বিনয়কে দেখেছে ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে একই গাড়ীতে যেতে। গোরা তখন বিনয়ের সম্বন্ধে ভাবছে ”মূঢ়! নাগপাশে এমনি করিয়াই ধরা দিতে হয়।”

নাগপাশের কথা রামায়ণে আছে। নাগপাশ অস্ত্রে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণকে বেঁধে ফেলেছিল। নিজেদের চেষ্টায় নাগপাশ থেকে রামলক্ষণ মুক্ত হতে পারেননি।

গোরাদের পরিবারে একটু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মহিম তার কন্যা শশীমুখীর বিবাহ গোরার বন্ধু বিনয়ের সঙ্গে দেবে—এরকম একটা পরিকল্পনা করেছিল। কথাবার্তাও একটু আধটু হয়েছিল। এখন সমস্যা দেখা দেওয়াতে মহিম আনন্দময়ীর সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। বলছে—”ইতিমধ্যে গোরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে বিনয় যথেষ্ট পরিমাণে হিঁদু নয়। মনু পরাশরের সঙ্গে তার মতের একটু আধটু অনৈক্য হয়ে থাকে। তাই গোরা বেঁকে দাঁড়িয়েছে—…. কলিযুগের জনক যদি পণ করতেন যে বাঁকা গোরাকে সোজা করলে তবে সীতা দেব, তবে শ্রীরামচন্দ্র হার মেনে যেতেন।”

মনু, পরাশর, জনক—এঁদের কথা মহাভারতে রামায়ণে আছে।

গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ মানবধর্মের জয়গান করেছেন। গোঁড়া হিন্দুয়ানী বা ব্রাহ্মধর্মের গোঁড়ামি কোনোটাই তিনি সমর্থন করেননি। পরেশবাবু ব্রাহ্ম হলেও তাঁর মধ্যে গোঁড়ামি নেই। রবীন্দ্রনাথের সমর্থন তাঁর দিকেই। অন্যদিকে রয়েছেন হারাণবাবু, ব্রাহ্মসমাজের এক কট্টরপন্থী নেতা। মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে গোরা উপন্যাসের এই অংশে (সুলভ ৩য়; পৃ-৪৩৪) একটু আলোচনা আছে—”সে সময়ে বাংলাদেশে ইংরেজীশিক্ষিত দলের মধ্যে ভগবদগীতা লইয়া আলোচনা ছিল না। কিন্তু পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া মাঝে মাঝে গীতা পড়িতেন—কালীসিংহের মহাভারতও তিনি প্রায় সমস্তটা সুচরিতাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। হারাণবাবুর কাছে তাহা ভালো লাগে নাই। এ সমস্ত গ্রন্থ তিনি ব্রাহ্মপরিবার হইতে নির্বাসিত করিবার পক্ষপাতী।…রামায়ণ-মহাভারত ভগবদগীতাকে তিনি হিন্দুদের সামগ্রী বলিয়া স্বতন্ত্র রাখিতে চাহিতেন। ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বাইবলই তাঁহার একমাত্র অবলম্বন ছিল।”

শশীমুখীর বিবাহ নিয়ে মহিম আবার গোরার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। বলেছিল—”তোমার কাছে আমার মিনতি এই যে, তুমি বাধাও দিয়ো না, অনুরোধও করো না। কুরুপক্ষে নারায়ণী সেনাতেও আমার কাজ নেই, আর পাণ্ডবপক্ষে নারায়ণেও আমার দরকার নেই।” (সুলভ-৩য়, পৃ-৪৫৩) মহাভারতে নারায়ণী সেনার কথা আছে। কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের প্রস্তুতির সময়ে দুর্যোধন এবং পাণ্ডবেরা যত বেশি সম্ভব সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তখনকার দিনে যদুকুলপতি শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন সর্বাপেক্ষা সম্মানিত এবং সর্বাপেক্ষা বলবীর্যশালী ব্যক্তি। তাই তাঁকে বরণ করবার জন্য অর্জুন এবং দুর্যোধন দু’জনেই দ্বারকায় গেছেন। দু-পক্ষই যাদবদের আত্মীয় তাই তিনি কাউকেই বিমুখ করতে চাইলেন না। বললেন যে একপক্ষে তিনি একা থাকবেন—নিরস্ত্র, যুদ্ধ করবেন না; অপরপক্ষে তাঁর বিখ্যাত বিশালসংখ্যক নারায়ণী সেনা যারা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। এখন অর্জুন আর দুর্যোধন বেছে নিন কে কী নেবেন। অর্জুন নিরস্ত্র কৃষ্ণকেই চাইলেন আর দুর্যোধন নারায়ণী সেনা নিয়ে খুশি হয়ে চলে গেলেন।

অত্যাচারী রাজশক্তি গোরাকে জেলে পাঠিয়েছিল। সেখান থেকে সে মা আনন্দময়ীকে চিঠি লিখেছিল—” মা, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো,তুমি চোখের জল ফেলিয়ো না। ভৃগুপদাঘাতের চিহ্ন শ্রীকৃষ্ণ চিরদিন বক্ষে ধারণ করিয়াছেন; জগতে ঔদ্ধত্য যেখানে যত অন্যায় আঘাত করিতেছে ভগবানের বুকের সেই চিহ্নকেই গাঢ়তর করিতেছে।” (সুলভ-তয়, পৃঃ ৫০৩)।

ভৃগুপদচিহ্নের কাহিনী শ্রীমদ্ভাগবতের কাহিনী। কাশীরাম দাস তাঁর মহাভারতে এই কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—এই ত্রয়ী হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসাবে স্বীকৃত। মহর্ষি ভৃগুর একবার মনে হলো এই তিনজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ সেটা জানতে হবে। এই মনে করে তিনি প্রথমে ব্রহ্মা ও তারপর মহেশ্বরের কাছে গেলেন কিন্তু ইচ্ছা করে তিনি তাঁদের উপযুক্ত শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করলেন না। এতে তাঁরা দুজনেই খুব ক্রুদ্ধ হলেন। এরপর তিনি বিষ্ণুর কাছে গেলেন এবং কোন কথা না বলে তাঁর বুকে একখানা লাথি মারলেন। ভৃগুর এই ব্যবহারে এমনকি মা-লক্ষ্মী পর্য্যন্ত ক্রুদ্ধা হলেন। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু দ্রুত উঠে এসে মহর্ষি ভৃগুর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। বিষ্ণুর বক্ষঃস্থল অত্যন্ত কঠিন, সেখানে পদাঘাত করে মহর্ষি নিশ্চয়ই তাঁর পায়ে অত্যন্ত ব্যথা পেয়েছেন। মহর্ষির চরণবেদনা প্রশমনের জন্য ভগবান বিষ্ণু অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে মহর্ষির পদসেবা করতে লাগলেন। এইবারে ভৃগু লজ্জিত হলেন, কিন্তু ভগবান শ্রীহরি হাত জোড় করে বললেন যে ভৃগু যেন এটা নিয়ে কোন চিন্তা না করেন। এই পদাঘাতকে শ্রীহরি ভূষণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

গোরা এবং বিনয় খুব বন্ধু হলেও তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে জোর তর্ক হয়। গোরার স্বভাব হলো সব কথা খুব জোরের সঙ্গে বলা আর সেইজন্য বিনয় অনেকসময় একটু নত হয়ে গোরার কথা মেনে নেয়। কিন্তু আর সে নত হবে না। ”আজ আমি একলা দাঁড়ালুম। সমাজ বলে রাক্ষসের কাছে প্রতিদিন মানুষ বলি দিয়ে কোনোমতে তাকে ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে এবং যেমন করে হোক তারই শাসনপাশ গলায় বেঁধে বেড়াতে হবে, তাতে প্রাণ থাক আর না থাক, এ আমি কোনমতেই স্বীকার করতে পারবো না।

গোরা কহিল ”মহাভারতের সেই ব্রাহ্মণ শিশুটির মতো খড়কে নিয়ে বকাসুর বধ করতে বেরোবে নাকি?” (সুলভ-৩য়; পৃ-৬০৯)

বকাসুরের কাহিনী মহাভারতে আছে। দুর্যোধনের চক্রান্ত ব্যর্থ করে পাণ্ডবেরা বারণাবত থেকে পালাতে পেরেছিলেন কিন্তু সহায়সম্বলহীন হয়ে তাঁদেরকে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তখন তাঁরা একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে আছেন। একদিন সেই ব্রাহ্মণের গৃহ থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। ব্রাহ্মণ, তার পত্নী, একটি অবিবাহিতা কন্যা ও একটি শিশুপুত্রকে নিয়ে ব্রাহ্মণের সংসার। সেই গ্রামের প্রান্তদেশে বক নামে এক দুর্দান্ত রাক্ষস থাকতো। সে নিয়ম করে দিয়েছিল যে প্রতিদিন গ্রামের এক একটা গৃহ থেকে একজন মানুষ সঙ্গে প্রচুর খাদ্য দ্রব্য রাক্ষসের খাদ্য হিসাবে পাঠাতে হবে নইলে সে গ্রাম ধ্বংস করে দেবে। সেদিন সেই ব্রাহ্মণের বাড়ীর পালা। কে রাক্ষসের খাদ্য হিসাবে যাবে এই চিন্তাতেই বাড়ীতে কান্নাকাটি চলছে। পুত্রটি একেবারেই শিশু। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার মতো বয়স তার হয়নি। অন্য তিনজনের বিলাপ শুনে সে হাতে একগাছি তৃণ নিয়ে বলেছিল—

”হাতে এক তৃণ লইয়া বলে সেই শিশু। রাক্ষসের ভয় তোরা না করিস কিছু।। রাক্ষসে মারিব এই তৃণের প্রহারে। কোথা আছে দেখাইয়া দেহ, দেখি তারে।।” কুন্তী অবশ্য তাদেরকে এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ করেছিলেন ভীমকে পাঠিয়ে। গোরার চেলা অবিনাশ গোরার সম্বন্ধে বলছে (সুলভ ৩য়; পৃ-৬৫২) ”তিনি বৈকুণ্ঠবাসী নারদের মতো বীণা বাজাইয়া বিষ্ণুকে বিগলিত করিয়া গঙ্গার সৃষ্টি করিতেছেন।” গঙ্গার উৎপত্তির কাহিনী কৃত্তিবাসী রামায়ণে এরকম বলা হয়েছে—

”একদিন গোলোকেতে বসিয়া নারায়ণ। পঞ্চমুখে গান করে দেব ত্রিলোচন।।

শিঙ্গাবলে শ্রীরাম, ডম্বুরে বলে হরি। পঞ্চমুখে রাম-নাম গান ত্রিপুরারি।।

লক্ষ্মীসহ বসিয়া আছেন মহাশয়। শুনিয়া যে গান হইলেন দ্রবময়।।

দ্রবরূপ হইলেন নিজে চক্রপাণি। সেই গঙ্গা জন্মিলেন পতিত-পাবণী।।”

এখানে নারদের কথা কিছু বলা হয়নি। সুবলচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের অভিধানে আরো বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। দেবর্ষি নারদের ধারণা হয়েছিল তিনি খুব উৎকৃষ্ট সঙ্গীত শিল্পী। কিন্তু নারদের গানে তালমাত্রা ইত্যাদি ঠিক না থাকাতে রাগ-রাগিনীরা বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। নারদ এটা জানতে পেরে খুব দুঃখিত হন। তাঁকে বলা হয় যে দেবাদিদেব মহাদেব যদি সঙ্গীত করেন, তবে রাগরাগিনীরা পূর্বাবস্থা ফিরে পাবে। নারদের প্রার্থনায় ভগবান শিব গান গাইতে রাজী হলেন কিন্তু বললেন যে শ্রোতা হিসাবে ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুকে আনতে হবে। তাঁরা এলে গান শুরু হলো। রাগ-রাগিণীরা বিকলাঙ্গ দশা থেকে মুক্তি পেলেন। ব্রহ্মা সে গানের বিশেষ কিছু বুঝলেন না। বিষ্ণু যেটুকু বুঝলেন তাতেই তিনি দ্রবীভূত হতে শুরু করলেন। ব্রহ্মা সেটি তাঁর কমণ্ডলুতে ধরে রাখলেন। এই দ্রবীভূত বিষ্ণুই হলেন গঙ্গা।

প্রাচীন সাহিত্য গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ হলো রামায়ণ। শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের গ্রন্থ ‘রামায়ণী কথা’র ভূমিকা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ এটি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে রামায়ণ এবং মহাভারতের জন্য ‘মহাকাব্য’ নাম অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত। আবার এ দুটি গ্রন্থ ইতিহাসও বটে। তবে শুধুমাত্র ঘটনাবলীর ইতিহাস নয়, রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। ”ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্ম্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।

এই কারণে রামায়ণ-মহাভারতের যে সমালোচনা তাহা অন্য কাব্য সমালোচনার আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র। রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষ্মণের চরিত্র আমার ভালো লাগে কী মন্দ লাগে, এই আলোচনাই যথেষ্ট নহে। স্তব্ধ হহয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কীরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে।” রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের কথা কীর্তন করা হয়েছে। দেবর্ষি নারদ বলেছেন নরচন্দ্রমা রামচন্দ্রের মধ্যে যে সমস্ত গুণরাজি বিরাজিত সে সমস্ত গুণ দেবতার মধ্যেও পাওয়া যায় না। ‘রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ নয়, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।’ কবি আরো বলছেন—”রামায়ণ কথা ভারতবর্ষের কাছে কোনো অংশে অতিমাত্র হয় নাই। এই রামায়ণ-কথা হইতে ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতা, আপামর সাধারণ কেবল যে শিক্ষা পাইয়াছে তাহা নহে, আনন্দ পাইয়াছে; কেবল যে ইহাকে শিরোধার্য করিয়াছে তাহা নহে, ইহাকে হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়াছে; ইহা যে কেবল তাহাদের ধর্মশাস্ত্র তাহা নহে, ইহা তাহাদের কাব্য।” ‘রামায়ণে ভারতবর্ষ যাহা চায় তাহা পাইয়াছে।’ ‘ভারতবর্ষের ঘরের লোক এত সত্য নহে, রাম লক্ষ্মণ সীতা তাহার পক্ষে যত সত্য।’

কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা’ প্রবন্ধটি মহাকবি কালিদাসের দুটি কাব্য প্রসঙ্গে রচিত। তবে এর মধ্যে রামায়ণ মহাভারতের কথাও আছে। কবি লিখেছেন— মহাভারতে যে-একটা বিপুল কর্মের আন্দোলন দেখা যায় তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ বৈরাগ্য স্থির অনিমেষভাবে রহিয়াছে। মহাভারতে কর্মেই কর্মের চরম প্রাপ্তি নহে। তাহার সমস্ত শৌর্যবীর্য রাগদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রয়াস ও সিদ্ধির মাঝখানে শ্মশান হইতে মহাপ্রস্থানের ভৈরবসংগীত বাজিয়া উঠিতেছে। রামায়ণেও তাহাই; পরিপূর্ণ আয়োজন ব্যর্থ হইয়া যায়, করায়ত্ত সিদ্ধি স্খলিত হইয়া পড়ে—সকলেরই পরিণামে পরিত্যাগ। অথচ এই ত্যাগে দুঃখে নিষ্ফলতাতেই কর্মের মহত্ব ও পৌরুষের প্রভাব রজতগিরির ন্যায় উজ্জ্বল অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে।” রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন মহাভারতকে একই কালে কর্ম ও বৈরাগ্যের কাব্য বলা যায়। মহাভারতের সমস্ত কর্ম যেন মহাপ্রস্থানে শেষ হয়েছে।

এই গ্রন্থের কাদম্বরী চিত্র প্রবন্ধে রামায়ণ মহাভারত নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিই গল্প শুনিতে ভালোবাসে; কিন্তু কেবল প্রাচীন ভারতবর্ষেই গল্প শুনিতে কোনো ঔৎসুক্য ছিল না।… ভগবদগীতার মাহাত্ম্য কেহ অস্বীকার করিতে পারিবে না; কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের তুমুল যুদ্ধ আসন্ন তখন সমস্ত ভগবদগীতা অবহিত হইয়া শ্রবণ করিতে পারে, ভারতবর্ষ ছাড়া এমন দেশ জগতে আর নাই। কিষ্কিন্ধ্যা এবং সুন্দরকাণ্ডে সৌন্দর্যোর অভাব নাই এ কথা মানি, তবু রাক্ষস যখন সীতাকে হরণ করিয়া লইয়া গেল তখন গল্পের উপর অত বড়ো একটা জগদ্দল পাথর চাপাইয়া দিলে সহিষ্ণু ভারতবর্ষই কেবল তাহা মার্জনা করিতে পারে। কেনই বা সে মার্জনা করে? কারণ, গল্পের শেষ শুনিবার জন্য তাহার কিছুমাত্র সত্বরতা নাই। চিন্তা করিতে করিতে, প্রশ্ন করিতে করিতে, আশপাশ পরিদর্শন করিতে করিতে, ভারতবর্ষ সাতটি প্রকাণ্ড কাণ্ড এবং আঠারোটি বিপুলায়তন পর্ব অকাতরচিত্তে মৃদুমন্দগতিতে পরিভ্রমণ করিতে কিছুমাত্র ক্লান্তি বোধ করে না।

আবার, গল্প শুনিবার আগ্রহ-অনুসারে গল্পের প্রকৃতিও ভিন্নরূপ হইয়া থাকে। ছয়টি কাণ্ডে যে গল্পটা বেদনা ও আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, একটিমাত্র উত্তরকাণ্ডে তাহাকে অসংকোচে চূর্ণ করিয়া ফেলা কি সহজ ব্যাপার? আমরা লঙ্কাকাণ্ড পর্য্যন্ত এই দেখিয়া আসিলাম যে, অধর্মাচারী নিষ্ঠুর রাক্ষস রাবণই সীতার পরম শত্রু, অসাধারণ শৌর্যে ও বিপুল আয়োজনে সেই ভয়ংকর রাবণের হাত হইতে সীতা যখন পরিত্রাণ পাইলেন তখন আমাদের সমস্ত চিন্তা দূর হইল, আমরা আনন্দের জন্য প্রস্তুত হইলাম, এমন সময় মুহূর্তের মধ্যে কবি দেখাইয়া দিলেন—সীতার চরম শত্রু অধার্মিক রাবণ নহে, সে শত্রু ধর্মনিষ্ঠ রাম; নির্বাসনে তাঁহার তেমন সংকট ঘটে নাই, যেমন তাঁহার রাজাধিরাজ স্বামীর গৃহে।”

”মহাভারতেও তাই। এক স্বর্গারোহণপর্বেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটার স্বর্গপ্রাপ্তি হইল। গল্পপ্রিয় ব্যক্তির কাছে গল্পের অবসান যেখানে মহাভারত সেখানে থামিলেন না—অতবড়ো গল্পটাকে বালুনির্মিত খেলাঘরের মতো এক মুহূর্তে ভাঙিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন, সংসারের প্রতি এবং গল্পের প্রতি যাহাদের/বৈরাগ্য তাহারা ইহার মধ্য হইতে সত্য লাভ করিল এবং ক্ষুব্ধ হইল না। মহাভারতকে যে লোক গল্পের মতো করিয়া পড়িতে চেষ্টা করে সে মনে করে অর্জুনের শৌর্য অমোঘ, সে মনে করে শ্লোকের উপর শ্লোক গাঁথিয়া মহাভারতকার অর্জুনের জয়স্তম্ভ অভ্রভেদী করিয়া তুলিতেছেন—কিন্তু সমস্ত কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের পর হঠাৎ একদিন একস্থানে অতি অল্প কথার মধ্যে দেখা গেল, একদল সামান্য দস্যু কৃষ্ণের রমনীদিগকে অর্জুনের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া গেল, নারীগণ কৃষ্ণসখা পার্থকে আহ্বান করিয়া আর্তস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন, অর্জুন গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। অর্জুনের এমন অভাবনীয় অবমাননা যে মহাভারতকারের কল্পনায় স্থান পাইতে পারে তাহা পূর্ববর্তী অতগুলা পর্বের মধ্যে কেহ সন্দেহ করিতে পারে নাই। কিন্তু কাহারও উপর কবির মমতা নাই। যেখানে শ্রোতা বৈরাগী, লৌকিক শৌর্য বীর্য মহত্ত্বের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম স্মরণ করিয়া অনাসক্ত, সেখানে কবিও নির্মম এবং কাহিনীও কেবলমাত্র কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য সর্বপ্রকার ভার মোচন করিয়া দ্রুতবেগ অবলম্বন করে না।”

আর একটি অসাধারণ প্রবন্ধ এবার আমরা আমাদের আলোচনার মধ্যে আনছি। ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্গত—কাব্যের উপেক্ষিতা। এই প্রবন্ধে কবি আমাদের চারজন উপেক্ষিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন—রামায়ণের ঊর্মিলা, কালিদাসের নাটকের অনসূয়া এবং প্রিয়ংবদা—আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার দুই প্রিয়সখী এবং কবি বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ কাহিনীর পত্রলেখা। কালিদাস ও বাণভট্টের রচনা আমরা বর্তমান পুস্তকের আলোচনার মধ্যে রাখিনি। সেই জন্য শুধুমাত্র ঊর্মিলার ব্যাপারে কবির বক্তব্যটুকুই এখানে নেবো। কবির রচনা থেকে উদ্ধৃত করি—

”কবি তাঁহার কল্পনা-উৎসের যত করুণাবারি সমস্তই কেবল জনকতনয়ার পুণ্য অভিষেকে নিঃশেষ করিয়াছেন। কিন্তু আর-একটি যে ম্লানমুখী ঐহিকের-সর্বসুখ-বঞ্চিতা রাজবধূ সীতাদেবীর ছায়াতলে অবগুন্ঠিতা হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন, কবি-কমগুলু হইতে একবিন্দু অভিষেকবারিও কেন তাঁহার চিরদুঃখাভিতপ্ত নম্রললাটে সিঞ্চিত হইল না! হায় অব্যক্তবেদনা দেবী ঊর্মিলা, তুমি প্রত্যুষের তারার মতো মহাকাব্যের সুমেরুশিখরে একবার মাত্র উদিত হইয়াছিলে, তার পরে অরুণালোকে আর তোমাকে দেখা গেল না। কোথায় তোমার উদয়াচল, কোথায় বা তোমার অস্তশিখরী তাহা প্রশ্ন করিতেও সকলে বিস্মৃত হইল।

কাব্যসংসারে এমন দুটি-একটি রমণী আছে যাহারা কবিকর্তৃক সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইয়াও অমরলোক হইতে ভ্রষ্ট হয় নাই। পক্ষপাতকৃপণ কাব্য তাহাদের জন্য স্থানসংকোচ করিয়াছে বলিয়াই পাঠকের হৃদয় অগ্রসর হইয়া তাহাদিগকে আসন দান করে।

কিন্তু এই কবিপরিত্যক্তাদের মধ্যে কাহাকে কে হৃদয়ে আশ্রয় দিবেন, তাহা পাঠকবিশেষের প্রকৃতি এবং অভিরুচির উপর নির্ভর করে। আমি বলিতে পারি, সংস্কৃত-সাহিত্যে কাব্যযজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে যে-কয়টি অনাদৃতার সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে তাহার মধ্যে ঊর্মিলাকে আমি প্রধান স্থান দিই। বোধ করি তাহার একটা কারণ, এমন মধুর নাম সংস্কৃত কাব্যে আর দ্বিতীয় নাই। নামকে যাঁহারা নামমাত্র মনে করেন আমি তাঁহাদের দলে নই। শেকসপীয়র বলিয়া গেছেন—গোলাপকে যে-কোনো নাম দেওয়া যাক তাহার মাধুর্যের তারতম্য হয় না। গোলাপ সম্বন্ধে হয়তো তাহা খাটিতেও পারে, কারণ গোলাপের মাধুর্য সংকীর্ণ-সীমাবদ্ধ। তাহা কেবল গুটিকতক সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষগম্য গুণের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের মাধুর্য এমন সর্বাংশে সুগোচর নহে, তাহার মধ্যে অনেকগুলি সূক্ষ্ম সুকুমার সমাবেশে অনির্বচনীয়তার উদ্রেক করে; তাহাকে আমরা কেবল ইন্দ্রিয়দ্বারা পাই না, কল্পনাদ্বারা সৃষ্টি করি। নাম সেই সৃষ্টিকার্যের সহায়তা করে। একবার মনে করিয়া দেখিলেই হয়, দ্রৌপদীর নাম যদি ঊর্মিলা হইত তবে সেই পঞ্চবীরপতিগর্বিতা ক্ষত্রনারীর দীপ্ত তেজ এই তরুণ কোমল নামটির দ্বারা পদে পদে খণ্ডিত হইত।

অতএব এই নামটির জন্য বাল্মীকির নিকট কৃতজ্ঞ আছি। কবিগুরু ইহার প্রতি অনেক অবিচার করিয়াছেন, কিন্তু দৈবক্রমে ইহার নাম যে মাণ্ডবী অথবা শ্রুতকীর্তি রাখেন নাই সে একটা বিশেষ সৌভাগ্য। মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, জানিবার কৌতূহলও রাখি না। উর্মিলাকে কেবল আমরা দেখিলাম বধূবেশে, বিদেহনগরীর বিবাহসভায়। তার পরে যখন হইতে সে রঘুরাজকুলের সুবিপুল অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হইতে আর তাহাকে একদিনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। সেই তাহার বিবাহসভার বধূবেশের ছবিটিই মনে রহিয়া গেল। উর্মিলা চিরবধূ—নির্বাককুণ্ঠিতা নিঃশব্দচারিণী। ভবভূতির কাব্যেও তাহার সেই ছবিটুকুই মুহূর্তের জন্য প্রকাশিত হইয়াছিল—সীতা কেবল সস্নেহকৌতুকে একটিবার মাত্র তাহার উপরে তর্জনী রাখিয়া দেবরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বৎস, ইনি কে?’ লক্ষ্মণ লজ্জিতহাস্যে মনে মনে কহিলেন, ‘ওহো ঊর্মিলার কথা আর্যা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।’ এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ লজ্জায় সে ছবি ঢাকিয়া ফেলিলেন; তাহার পর রামচরিত্রের এত বিচিত্র সুখ-দুঃখ চিত্রশ্রেণীর মধ্যে আর একটিবারও কাহারও, কৌতূহল-অঙ্গুলি এই ছবিটির উপরে পড়িল না। সে তো কেবল বধূ ঊর্মিলা-মাত্র।

তরুণ শুভ্রভালে যেদিন প্রথম সিন্দূরবিন্দুটি পরিয়াছিলেন, ঊর্মিলা চিরদিনই সেইদিনকার নববধূ। কিন্তু রামের অভিষেক-মঙ্গলাচরণের আয়োজনে যেদিন অন্তঃপুরিকাগণ ব্যাপৃত ছিল সেদিন এই বধূটিও কি সীমন্তের উপর অর্ধাবগুণ্ঠণ টানিয়া রঘুকুললক্ষ্মীদের সহিত প্রসন্নকল্যাণমুখে মাঙ্গল্যরচনায় নিরতিশয় ব্যস্ত ছিল না? আর, যেদিন অযোধ্যা অন্ধকার করিয়া দুই কিশোর রাজভ্রাতা সীতাদেবীকে সঙ্গে লইয়া তপস্বীবেশে পথে বাহির হইলেন সেদিন বধূ ঊর্মিলা রাজহর্ম্যের কোন নিভৃত শয়নকক্ষে ধূলিশয্যায় বৃন্তচ্যুত মুকুলটির মতো লুন্ঠিত হইয়া পড়িয়া ছিল তাহা কি কেহ জানে? সেদিনকার সেই বিশ্বব্যাপী বিলাপের মধ্যে এই বিদীর্যমান ক্ষুদ্র কোমল হৃদয়ের অসহ্য শোক কে দেখিয়াছিল? যে ঋষিকবি ক্রৌঞ্চবিরহিণীর বৈধব্যদুঃখ মুহূর্তের জন্য সহ্য করিতে পারেন নাই, তিনিও একবার চাহিয়া দেখিলেন না।

লক্ষ্মণ রামের জন্য সর্বপ্রকারে আত্মবিলোপ সাধন করিয়াছিলেন, সে গৌরব ভারতবর্ষের গৃহে, গৃহে আজও ঘোষিত হইতেছে, কিন্তু সীতার জন্য ঊর্মিলার আত্মবিলোপ কেবল সংসারে নহে, কাব্যেও! লক্ষ্মণ তাঁহার দেবতাযুগলের জন্য কেবল নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছিলেন, ঊর্মিলা নিজের চেয়ে অধিক নিজের স্বামীকে দান করিয়াছিলেন। সে কথা কাব্যে লেখা হইল না। সীতার অশ্রুজলে ঊর্মিলা একেবারে মুছিয়া গেল।

লক্ষ্মণ তো বারো বৎসর ধরিয়া তাঁহার উপাস্য প্রিয়জনের প্রিয়কার্যে নিযুক্ত ছিলেন—নারী-জীবনের সেই বারোটি শ্রেষ্ঠ বৎসর ঊর্মিলার কেমন করিয়া কাটিয়াছিল? সলজ্জ নবপ্রেমে আমোদিত বিকচোন্মুখ হৃদয়মুকুলটি লইয়া স্বামীর সহিত যখন প্রথমতম মধুরতম পরিচয়ের আরম্ভসময় সেই মুহূর্তে লক্ষ্মণ সীতাদেবীর রক্তচরণক্ষেপের প্রতি নতদৃষ্টি রাখিয়া বনে গমন করিলেন—যখন ফিরিলেন তখন নববধূর সুচিরপ্রণয়ালোকবঞ্চিত হৃদয়ে আর কি সেই নবীনতা ছিল? পাছে সীতার সহিত ঊর্মিলার পরম দুঃখ কেহ তুলনা করে, তাই কি কবি সীতার স্বর্ণমন্দির হইতে এই শোকোজ্জ্বলা মহাদুঃখিনীকে একেবারে বাহির করিয়া দিয়াছেন—জানকীর পাদপীঠপার্শ্বেও বসাইতে সাহস করেন নাই।”

আধুনিক কালের মহাকবির এই লেখাটি পড়ে ঊর্মিলার জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবেন না—এমন কেউ কি আছেন?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর লোকসাহিত্য প্রবন্ধের শেষে (সুলভ-৩য়, পৃ-৮০৮-৮০৯) হরগৌরী কথা ও রামসীতা কথার একটু তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।—

”বাংলার গ্রাম্যছড়ায় হরগৌরী এবং রাধাকৃষ্ণের কথা ছাড়াও সীতারাম ও রাম-রাবণের কথাও পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা তুলনায় স্বল্প। একথা স্বীকার করিতেই হইবে, পশ্চিমে, যেখানে রামায়ণকথাই সাধারণের মধ্যে বহুলপরিমাণে প্রচলিত সেখানে বাংলা অপেক্ষা পৌরুষের চর্চা অধিক।….রামসীতার দাম্পত্য আমাদের দেশপ্রচলিত হরগৌরীর দাম্পত্য অপেক্ষা বহুতরগুণে শ্রেষ্ঠ, উন্নত এবং বিশুদ্ধ; তাহা যেমন কঠোর গম্ভীর তেমনি স্নিগ্ধ কোমল। রামায়ণকথায় একদিকে কর্তব্যের দূরূহ কাঠিন্য অপর দিকে ভাবের অপরিসীম মাধুর্য একত্র সম্মিলিত। তাহাতে দাম্পত্য, সৌভ্রাত্র, পিতৃভক্তি, প্রভুভক্তি, প্রজাবাৎসল্য প্রভৃতি মানুষ্যের যত প্রকার উচ্চ অঙ্গের হৃদয়বন্ধন আছে তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ পরিস্ফূট হইয়াছে। তাহাতে সর্বপ্রকার হৃদবৃত্তিকে মহৎধর্মনিয়মের দ্বারা পদে পদে সংযত করিবার কঠোর শাসন প্রচারিত। সর্বতোভাবে মানুষকে মানুষ করিবার উপযোগী এমন শিক্ষা আর কোনো দেশে কোনো সাহিত্যে নাই। বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণকথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের কথার উপরে যে মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে নাই তাহা আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের পৌরুষ কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা উচ্চতর।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন