ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড

ত্রয়োদশ অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড)

এই খণ্ডে সংকলিত গ্রন্থগুলি হোলো—

কবিতা ও গান : রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনে, ছড়া, শেষ লেখা;

নাটক ও প্রহসন : শ্রাবণ গাথা, নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা, শ্যামা ও পরিশিষ্ট এবং মুক্তির উপায়;

উপন্যাস ও গল্প : তিনসঙ্গী ও পরিশিষ্ট, লিপিকা, সে এবং গল্পসল্প;

প্রবন্ধ : বিশ্বপরিচয়, বাংলা ভাষা পরিচয়, পথের সঞ্চয়, ছেলেবেলা, সভ্যতার সংকট, এবং গ্রন্থ পরিচয় অংশ।

কবিতাগ্রন্থ ‘আরোগ্য’ ও ‘জন্মদিনে’ রামায়ণ-মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ নেই। নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার কাব্যরূপ নাট্যকাব্য চিত্রাঙ্গদা এবং সেটি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। মহাভারতের একটা কাহিনীকে ভিত্তি করেই নাট্যকাব্য চিত্রাঙ্গদা রচিত হয়েছিল। শ্যামা এবং নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকাতে রামায়ণ-মহাভারতের কোনো প্রসঙ্গ নেই। ‘গল্পসল্প’তেও এই প্রসঙ্গ নেই বললেই চলে। কবির ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি কয়েকটি বিজ্ঞানবিষয়ক রচনার সংকলন। এখানে রামায়ণ মহাভারতের কোনো প্রসঙ্গ নেই। এ ছাড়া অন্য গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ বিভিন্ন জায়গায় আছে যদিও অধিকাংশক্ষেত্রেই সে উল্লেখগুলো বড়োই মামুলি। ‘রোগশয্যায়’ কাব্য গ্রন্থের একটি কবিতাতে অবশ্য ভালো আলোচনার উপাদান আছে।

রোগশয্যায়—এই গ্রন্থের ১ সংখ্যক কবিতাতে স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠা উর্বশীর কথা বলা হয়েছে —

 ”সুরলোকে নৃত্যের উৎসবে

 যদি ক্ষণকালতরে

 ক্লান্ত উর্বশীর

 তালভঙ্গ হয়

 দেবরাজ করে না মার্জনা।

 পূর্বার্জিত কীর্তি তার

 অভিসম্পাতের তলে হয় নির্বাসিত।

 আকস্মিক ত্রুটি মাত্র স্বর্গ কভু করে না স্বীকার।”

উর্বশীর কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী প্যারাতে বলেছি যে এই গ্রন্থের একটি কবিতা নিয়ে ভালো আলোচনার উপাদান আছে। ১৪ সংখ্যক কবিতায় প্রথম স্তবকের এই লাইনগুলো লক্ষ্য করুন —

 ”নদীর একটা কোণে শুষ্ক মরা ডাল

 স্রোতের ব্যাঘাত যদি করে,

 সৃষ্টিশক্তি ভাসমান আবর্জনা নিয়ে

 সেখানে প্রকাশ করে আপনার রচনাচাতুরী—

 ছোটো দ্বীপ গড়ে তোলে, টেনে আনে শৈবালের দল,

 তীরের যা পরিত্যক্ত নেয় সে কুড়ায়ে,

 দ্বীপসৃষ্টি-উপাদানে যাহা-তাহা জোটায় সম্বল।”

যাঁরা এই কবিতাটি পড়েছেন তাঁরা কেউ কি ভেবেছেন যে এর সঙ্গে রামায়ণ বা মহাভারতের কোনো যোগসূত্র থাকা সম্ভব! আমি মহাভারতের শান্তিপর্ব থেকে দুটো শ্লোক উদ্ধৃত করবো, তারপর আপনারাই বিবেচনা করে দেখবেন মহাভারতের সেই বর্ণনার সঙ্গে কবি রচিত এই লাইনগুলির কোনো মিল আছে কিনা।

মহাভারতের বিশালবুদ্ধি মহাকবি শ্রী বেদব্যাস ধর্মকে শুধুমাত্র শ্রুতি বা স্মৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ধর্ম বলতে তিনি মানুষের আচার ব্যবহার-সদাচার ইত্যাদির কথাও বলেছেন। এই আচার ব্যবহার ইত্যাদি কেউ তৈরি করে দেয় না—গতিশীল সমাজে মানুষের ন্যায়সংগত প্রয়োজনবোধে এগুলো তৈরি হয়ে যায়। মহাভারত একটা সুন্দর কথা বলেছেন। নদীর ধারে দৃষ্টিকে বহুদূরে প্রসারিত করে দিয়ে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো কখনো কখনো দেখা যাবে একটা কাষ্ঠখণ্ড নিজের মতো নদীর স্রোতে ভেসে আসছে। তার এই ভেসে আসার পথে আরো দুটো-চারটে ভাসতে থাকা কাঠের টুকরো ওই কাষ্ঠখণ্ডটার সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। লেগে যাচ্ছে ভেসে থাকা কচুরীপানা, তৃণগুল্ম গাছের ছোটোখাটো ভাঙা ডালপালা, শুকনো গোবর, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইগুলোর পিছন পিছন অনেকক্ষণ অণুসরণ করে গেলে একসময় দেখা যাবে যে এগুলো সব মিলে-মিশে একটা বেশ বড় সংগ্রহ তৈরি হয়ে গেছে। কবি যাকে বলেছেন ছোটো দ্বীপ। এটা কিন্তু কেউ সাজিয়ে-গুছিয়ে তৈরী করে দেয়নি—ভাসতে ভাসতে নিজের থেকেই কখন তৈরী হয়ে গেছে।

 ”নদ্যাঞ্চেহ যথা কাষ্ঠমুহ্যমানং যদৃচ্ছয়া।

 যদৃচ্ছয়ৈব কাষ্ঠেন সন্ধিং গচ্ছেত কেনচিৎ।।

 তত্রাপরাণি দারুণি সংসৃজ্যন্তে পরস্পরম্।

 তৃণকাষ্ঠকরীষাণি কদাচিন্ন সমীক্ষয়া।।”

(মহাভারতম ৩৬তম খণ্ড, পৃ. ২৫৯৭, ২৫৯৮)

(হঠাৎ হঠাৎই নদীতে যেমন কোন কাষ্ঠ ভাসিয়া চলিতে থাকিলে আবার হঠাৎই অপর কোন কাষ্ঠের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং সেগুলোর সঙ্গে আরো অনেক কাষ্ঠ বা তৃণ, শুষ্ক গোময় ইত্যাদি আসিয়া মিলিত হয়—সেগুলো কেউ পর্যালোচনা করিয়া সংযুক্ত করে না।)

এই শ্লোকদুটি মহাভারতের শান্তিপর্বে জাজলি-তুলাধার সংবাদের মধ্যে আছে। কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতে এই কথাগুলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে আছে এবং তা’ থেকে বিশেষ কিছুই বোঝা যায় না। মূলসংস্কৃত মহাভারতের এই শ্লোকদুটি থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কবিতাটির idea পেয়েছিলেন কিনা আমি জানি না, তবে আমার কাছে মহাভারতের এই শ্লোকদুটির সঙ্গে রবীন্দ্রকবিতার উদ্ধৃত লাইনগুলোর মিল খুব ঘনিষ্ঠ মনে হচ্ছে। কবি যদি মহাভারত থেকেই idea টা নিয়ে থাকেন তবে মূল সংস্কৃত মহাভারতের সঙ্গে তিনি যে পরিচিত ছিলেন এটা বোঝা যায়।

(যাঁরা এই শ্লোক দুটির মর্মার্থ বিশেষরূপে জ্ঞাত হতে চান, তাঁরা ডঃ নৃসিংহ কুমার ভাদুড়ীর লেখা—’মহাভারতে নীতির দ্বন্দ্ব’ পড়ে দেখবেন। লেখাটি ‘বর্তমান-শারদসংখ্যা ১৪১৮’তে প্রকাশিত। অত্যন্ত সুন্দর লেখা।)

ছড়া— এই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা সম্বন্ধে ‘শনিবারের চিঠি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—” অবচেতন মনের কাব্যরচনা অভ্যাস করছি। সচেতন বুদ্ধির পক্ষে বচনের অসংলগ্নতা দুঃসাধ্য। ভাবী যুগের সাহিত্যের প্রতি লক্ষ্য করে হাত পাকাতে প্রবৃত্ত হলেম। তারই এই নমুনা। কেউ কিছুই বুঝতে যদি না পারেন, তা হ’লেই আশাজনক হবে।” কাজে কাজেই, রামায়ণ-মহাভারতের দু’চারটে কথা এই গ্রন্থে যা আছে সেগুলোর অর্থ খোঁজার প্রয়োজন নেই। ৭ সংখ্যক কবিতাকে আছে—

 ”রাবণের দশ মুণ্ডে নেমেছে

 বকুনি ছাড়ায়ে মাত্রা;

 নেড়ানেড়ি দলে হরি-হরি বলে,

 শেষ হল রামযাত্রা।”

৮ সংখ্যক কবিতাটিতে কাশীরাম দাসের নাম আছে—

 ”নয় দশ বারো তেরো চোদ্দ,

 মনে পড়ে পয়ারের পদ্য।

 কাশীরাম দাসে আনে পুণ্য,

 দশে আর বিশে লাগে শূন্য।

 ‘কাশীরাম কাশীরাম’ বোল দেয়,

 সারাদিন মনে তার দোল দেয়।”

শেষলেখা— ২ সংখ্যক কবিতায় আছে—

 ”রাহুর মতন মৃত্যু

 শুধু ফেলে ছায়া,

 পারে না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত

 জড়ের কবলে

 এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।”

মহাভারতের ‘সমুদ্রমন্থন’ কাহিনীতে রাহুর কথা আছে। দেবতা এবং অসুর সম্মিলিতভাবে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন এবং এই মন্থনে অমৃত উত্থিত হয়েছিল। রাহু দৈত্য দলভুক্ত। দৈত্যদেরকে অশুভশক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তারা অমৃত পান করে অমর হ’লে বিশ্বসংসারের প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। এই বিবেচনায় তাদেরকে অমৃত থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পনা করা হয়। দেবতাদের যখন অমৃত দেওয়া হচ্ছিল তখন রাহু সেই দলের মধ্যে মিশে একটু অমৃত মুখে ফেলতে পেরেছিল। ধরা পড়ে যাওয়াতে তার শিরশ্ছেদ করা হয়। তবে যেহেতু সে অমৃত মুখে ফেলতে পেরেছিল তাই তার শরীর দ্বিখণ্ডিত হলেও তার কাটামুণ্ড জীবিত থাকে।

৩ সংখ্যক কবিতাটিতে শুধুমাত্র ‘গীতা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে— গীতার কোনো শ্লোক বা উপদেশের কথা কিছু বলা হয়নি।

 ”দুঃখরাতের স্বপনতলে

 প্রভাতী তোর কী যে বলে

 নবীন প্রাণের গীতা,

 জানিস নে তুই কি তা।”

৯ সংখ্যক কবিতাটিতে উর্বশীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে—

 ”বিস্মৃত স্বর্গের কোন্

 উর্বশীর ছবি

 ধরনীর চিত্তপটে

 বাঁধিতে চাহিয়াছিল

 কবি —”

শ্রাবণ গাথা— বর্ষার অভ্যর্থনা দিয়ে উৎসব শুরু হয়েছে। শ্রোতাদের মধ্যে আছেন কাব্যরসিক রাজা, তাঁর সভাকবি এবং অন্যান্যরা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করছেন নটরাজ, তিনি অবশ্য পালাকার বা লেখক নন। পালার রচনাকার পালিয়েছেন। সভাকবি এই শুনে বলছেন—

 ”এ তো বড়ো কৌতুক। পাঁজিতে লিখেছে পূর্ণিমা এ দিকে

 চাঁদ মেরেছেন দৌড়, পাছে কেউ বলে বসে তাঁর

 আলোটা ঝাপসা।”

নটরাজ উত্তর দিচ্ছেন— ”বিশল্যকরণীটারই দরকার, গন্ধমাদনটা বাদ দিলেও চলে। না’-ই রইলেন কবি, গানগুলো রইলো।”

বিশল্যকরণী এবং গন্ধমাদনের কথা আছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। রাবণের অস্ত্র শক্তিশেলের আঘাতে লক্ষ্মণ আহত এবং অচেতন। রামচন্দ্রের বাহিনীতে বৈদ্য আছেন সুষেণ। তিনি বলেছেন যে গন্ধমাদন পর্বতে ঔষধের গাছ আছে বিশল্যকরণী। সেটা আনতে পারলে তবেই লক্ষ্মণকে বাঁচানো যাবে, নইলে নয়। হনুমান বিশল্যকরণী চিনতে না পেরে সমস্ত গন্ধমাদন পর্বতটাই তুলে এনেছিলেন। পর্বত দরকার ছিল না— শুধু বিশল্যকরণী গাছটাই দরকার ছিল।

সভাকবি রাজার মতো অতো বেশি কাব্যরসিক নন, একটু বস্তুতান্ত্রিক। তবুও তিনি বলছেন—

”আমরা সহ্য করব ওঁদের স্বরবর্ষণ, মহাবীর ভীষ্মের মতো।” অনুষ্ঠান যখন অনেকটাই এগিয়েছে তখন রাজা বললেন—”আমার একটা অনুরোধ আছে। আমি ভালোবাসি কড়া পাকের রস। বর্ষার সবটাই তো কান্না নয়, ওতে আছে ঐরাবতের গর্জন, আছে উচ্চৈঃশ্রবার দৌড়।”— ঐরাবত এবং অশ্বশ্রেষ্ঠ উচ্চৈঃশ্রবা উত্থিত হয়েছিল সমুদ্রমন্থনে। এ দুটোই পেয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র।

মুক্তির উপায়— এটি নাটক। একই নামে একটি গল্প আছে গল্পগুচ্ছতে— সেটি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

হৈমবতীর স্বামী হচ্ছে ফকির। সে গুরু অচ্যুতানন্দের চেলা। বাড়ীর কোন কাজকর্ম করেনা। গুরু যে তাকে দোহন করছে, সে সেটা বুঝবে না। হৈমবতী তার দূরসম্পর্কের উচ্চশিক্ষিতা দিদি পুষ্পমালাকে বলছে—

”দক্ষিণা পেলেই গুরু তালপাতার উপর গীতার শ্লোক লিখে সেগুলো জল দিয়ে ধুয়ে দেন। গীতা-ধোওয়া জলে ঐ বোতলগুলো ভরা। তিন সন্ধ্যে স্নান করে তিন চুমুক করে খান। ওঁর (ফকির) বিশ্বাস, ওঁর রক্তে গীতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আমার সংসার-খরচের দশ টাকার পাঁচখানা নোট ঐ বন্যায় গেছে ভেসে।”

পুষ্পমালার সঙ্গে ফকিরের কথা হচ্ছে। ফকিরের শোওয়ার ঘরে আছে একখানা মাণ্ডূক্যোপনিষৎ। ফকির সেটাকে বালিশের নীচে রেখে ঘুমায়। ফকির বলছে যে গুরুকৃপায় তাকে পড়তে হয়না। সে আরো বলছে—

”আমি স্বয়ং দেখেছি গুরুজিকে, দুপুরবেলা আহারের পর ভগবদগীতা পেটের উপর নিয়ে চিত হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়— গভীর নিদ্রা, বারণ করে দিয়েছেন সাধনায় ব্যাঘাত করতে।”

গুরুর সঙ্গে তার কয়েকজন শিষ্য রয়েছে। তার মধ্যে একজন নিতাই— সে স্ত্রীর বাক্স ভেঙে একটা দামী গয়না এনে গুরুকে দিয়েছে। তাতে সে একটু ভয়ে ভয়ে আছে। কারণ তার স্ত্রী বলেছে যে ঘরে ফিরলে নিতাইকে সে ঝাঁটাপেটা করবে। গুরু তাকে অভয় দিচ্ছে চিন্তা না করতে কারণ দাম্পত্যকলহ দু’দিনেই মিটে যাবে। তখন নিতাই বলছে—”ঐ নারীটিকে চেনেন না। সীতা সাবিত্রীর সঙ্গে মেলেনা। নাম দিয়েছি হিড়িম্বা। তা বরঞ্চ যদি অনুমতি পাই তা হলে দ্বিতীয় সংসার করে শান্তিপুরে বাসা বাঁধব। তাতে গুরু বলছে—”দোষ কী! বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিরা বলেছেন, অধিকন্তু ন দোষায়।”— সীতা রামায়ণের চরিত্র, রামচন্দ্রের পতিব্রতা স্ত্রী। সাবিত্রীর কাহিনী মহাভারতে আছে— সত্যবানের পতিব্রতা স্ত্রী। মধ্যমপাণ্ডব ভীমের স্ত্রী হিড়িম্বা। তাঁর প্রতি অন্যায় কটাক্ষ করা হয়েছে। সে সাধ্বী এবং মর্যাদাসম্পন্না। বশিষ্ঠ বিখ্যাত পৌরাণিক ঋষি। তিন সূর্যবংশের কুলপুরোহিত। রামচন্দ্র তাঁর কাছেই বিদ্যা এবং অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন।

হৈমবতী এবং পুষ্পমালার কথা হচ্ছে। হৈম পুষ্পমালার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তাতে পুষ্পমালা বলছে— ”ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, তাই গান্ধারী চোখে কাপড় বেঁধে অন্ধ সাজলেন। তোমারও সেই দশা। স্বামী এল বেরিয়ে রাস্তায়, স্ত্রী এল বেরিয়ে মামার বাড়ীতে।”—মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ধৃতরাষ্ট্র। যদিও তিনি হস্তিনাপুরের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র, জন্মান্ধ হওয়ার জন্য তিনি রাজা হতে পারলেন না— রাজা হলেন তাঁর কনিষ্ঠ পাণ্ডু। কিন্তু পাণ্ডু যখন বনচারীর জীবন বেছে নিলেন, তখন অন্ধ হলেও ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে বসলেন। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল গান্ধার রাজকন্যা গান্ধারীর। গান্ধারী যখন শুনলেন যে তাঁর ভাবী স্বামী জন্মান্ধ, তিনি নিজের দুই চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে নিলেন— দৃষ্টিশক্তি থেকে বঞ্চিত করলেন নিজেকে।

বিদূষী, বাকপটীয়সী এবং পরিহাসপ্রিয় পুষ্পমালা নিজের মতো করে চেষ্টা করছে ফকিরকে গুরুর খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে তাকে স্বাভাবিক মানুষ করতে এবং হৈমবতীর কাছে ফিরিয়ে আনতে। এর মধ্যে তার আর একটা কাজ জুটে গেল। ষষ্ঠীচরণের পুত্র মাখনলাল দুই মুখরা স্ত্রীকে সামলাতে না পেরে ঘর ছেড়েছে সাতবছর। ষষ্ঠীচরণকেও পুষ্প আশ্বাস দিয়েছে মাখনকে সে ফিরিয়ে আনবে। সে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছে নাটকে হনুমানের পার্ট করার জন্য একটা লোক চাই। তারপরে মাখনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে এবং ভাবগতিকে মনে হচ্ছে সে পুষ্পমালার কথা শুনবে। ঘরছাড়া ফকিরকে মাখন একদিন দেখেছিল এবং দেখে তার মজা লেখেছিল। মাখন ফকিরকে চেনে না কিন্তু তার অদ্ভুৎ ব্যবহারের কথা সে পুষ্পকে বলেছিল। পুষ্প তাই শুনে বলছে— ”ভালো হল। হনুমানের সঙ্গে অঙ্গদ চাই। ওকে তোমারই হাতে তৈরী করে নিতে হবে।”—মহাবীর হনুমান রামচন্দ্রের পরমভক্ত। অঙ্গদ কিস্কিন্ধ্যার মহাপরাক্রান্ত বানররাজ বালির পুত্র। বালিকে রামচন্দ্র হত্যা করেছিলেন। বালির মৃত্যুর পর কিস্কিন্ধ্যার রাজা হলেন বালির কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুগ্রীব এবং অঙ্গদ সুগ্রীবের কর্তৃত্ব মেনে নিলেন। লংকার রাবণবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে রামচন্দ্রের একজন প্রধান বীর সেনানী ছিলেন অঙ্গদ।

পুষ্প মাখনকে জিজ্ঞাসা করেছে যে এই সাতবছর মাখন কি করে জীবন কাটিয়েছে! মাখন বলছে—”ময়রার দোকানে মাছি তাড়িয়েছি, পেয়েছি বাসি লুচি তেলে-ভাজা, ….. যাত্রার দলে ভিস্তি সেজেছি, জল খেতে দিয়েছেন অধিকারী মুড়কি আর পচা কলা। সুবিধে পেলেই মা মাসি পাতিয়ে মেয়েদের পাঁচালি শুনিয়ে দিয়েছি যখন পুরুষরা কাজে চলে গেছে—

ওরে ভাই, জানকীরে দিয়ে এসো বন—

ওরে রে লক্ষ্মণ, এ কী কুলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ।”

মাখন পুষ্পকে মা-অঞ্জনা বলতে চেয়েছে। অঞ্জনা মহাবীর হনুমানের মা।

শেষমেশ পুষ্প তার দুই কাজেই সফল। গুরুর প্রতি মোহশূন্য হয়ে ফকির ঘরে ফিরেছে। মাখনও তার ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে ঘরে এসেছে। পুষ্পকে সে বলছে—

 ”মা অঞ্জনা, কিস্কিন্ধ্যায় তো ঢোকালে। মাঝে মাঝে খবর নিয়ো। নইলে বিপদে পড়লে আবার লাফ মারব।”

তিনসঙ্গী— এই গ্রন্থে ‘শেষকথা’— এই একই নামে দুটো রচনা রয়েছে। গ্রন্থপরিচয় অংশে লেখা হয়েছে— ”শেষকথা গল্পটির একটি ভিন্নতর পাঠ ‘দেশ’ পত্রিকার বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংখ্যায় (৩০শে অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) ‘ছোটো গল্প’ নামে বাহির হইয়াছিল।”

সুলভ ত্রয়োদশ খণ্ডের প্রথম ‘শেষকথা’ গল্পটিতে কচ-দেবযানীর কথা আছে (পৃ.—২৬৫, ২৬৬)। বিদূষী অচিরা বিজ্ঞানী নবীনমাধবকে বলছে— ‘বাংলা সাহিত্য আপনি বোধ হয় পড়েন না। কচ ও দেবযানী ব’লে একটা কবিতা আছে। তাতে ঐ কথাই আছে মেয়েদের ব্রত হচ্ছে পুরুষকে বাঁধা, আর পুরুষদের ব্রত সে-বাঁধন কাটিয়ে অমরলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আপনি কাটিয়ে এসেছেন মায়ের অনুনয়। একই কথা।” দ্বিতীয় লেখাটিতেও (ছোটোগল্প-শেষকথা) মোটামুটি একই কথাগুলি আছে। তার সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত কথাও আছে। অচিরা বলছে—”দেবযানী কচকে কি অভিসম্পাত দিয়েছিল জানেন? বলেছিল, তোমার সাধনায় পাওয়া বিদ্যা তোমার নিজের ব্যবহারে লাগাতে পারবে না।” ”দাদু একদিন আমাদের কলেজ-ক্লাসে কচ ও দেবযানীর ব্যাখ্যা করছিলেন। কচ হয়েছে পুরুষের প্রতীক, আর দেবযানী মেয়ের।”

কচ ও দেবযানীর কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে আছে। এই কাহিনীকে ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ যে বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন, তার নাম ‘বিদায় অভিশাপ’। এই কবিতাটি নিয়ে বিশদ আলোচনা আগেই করা হয়েছে।

দ্বিতীয় শেষকথা ছোটোগল্পে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কথা আছে। ”পৌরাণিক একটা ছোটো গল্প মনে পড়ছে—ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আখ্যান। দুঃসাধ্য তাঁর তপস্যা। নিষ্কলক ব্রহ্মচর্যের দুরহ সাধনায়। অধিরোহণ করেছিলেন বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-যাজ্ঞবল্ক্যের দুর্গম উচ্চতায়। হঠাৎ দেখা দিল সামান্য রমণী, সে শুচি নয়, সাধ্বী নয়, সে বহন করেনি তত্ত্ব বা মন্ত্র বা মুক্তি; এমন-কি ইন্দ্রলোক থেকে পাঠানো অপ্সরীও সে নয়। সমস্ত যাগযজ্ঞ ধ্যানধারণা সমস্ত অতীত ভবিষ্যৎ আঁট বেঁধে গেল এক ছোটো গল্পে।”

ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাহিনী রামায়ণে আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে বলা আছে যে অঙ্গদেশের রাজা ছিলেন লোমপাদ। সেই রাজ্যে দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টি চলছিল। পণ্ডিতেরা রাজাকে বলেছিলেন যে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ— তাঁকে যদি লোমপাদের রাজ্যে নিয়ে আসা যায় তবে অনাবৃষ্টির দেশে বৃষ্টি হবে।

ঋষ্যশৃঙ্গ পিতার সঙ্গে তপোবন আশ্রমে থাকেন। তিনি কোনোদিন রমণী দেখেন নি। স্ত্রী-পুরুষের ভেদ তিনি জানেন না। তাকে আনবার জন্য রাজা বারবণিতাদের নৌকা করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারা মুনিকে মায়ায় ভুলিয়ে লোমপাদের রাজ্যে নিয়ে এসেছিল।

লিপিকা— এই গ্রন্থের ‘বাঁশী’ নামক লেখাটিতে বলা হয়েছে ‘বাঁশীর বাণী চিরদিনের বাণী—শিবের জটা থেকে গঙ্গার ধারা, প্রতিদিনের মাটির বুক বেয়ে চলেছে।”— গঙ্গার মর্তে অবতরণ রামায়ণের কাহিনী। অবরতরণের পথে শিব গঙ্গাকে তাঁর মস্তকে ধারণ করেছিলেন।

এই গ্রন্থের ‘গল্প’ লেখাটিতে ছোটো ছেলেটিকে হিতৈষীবা লেখা-পড়া শেখাতে চান— গল্প শুনতে দেবেন না। দিদিমা পর্য্যন্ত গুরুমশাইয়ের ভাবগতিক দেখে চুপ করে গেলেন। তখন ”কথক এসে আসন জুড়ে বসলেন। তিনি শুরু করে দিলেন এক রাজপুত্রের বনবাসের কথা। যখন রাক্ষসীর নাক কাটা চলছে তখন হিতৈষী বললেন —’ইতিহাসে এর কোনো প্রমাণ নেই; যার প্রমাণ পথে ঘাটে সে হচ্চে তিন-চারে বারো’। ততক্ষণে হনুমান লাফ দিয়েছে আকাশে, অত ঊর্ধে তার সঙ্গে ইতিহাস কিছুতেই পাল্লা দিতে পারে না।”— এখানে রাজপুত্রের বনবাস বলতে অযোধ্যার রাজপুত্র রামচন্দ্রের বনবাসের কথা বোঝানো হচ্ছে। বিরক্ত করার জন্য রাক্ষসী শূর্পনখার নাক-কান কেটে দিয়েছিলেন তাঁরা।

”বিধাতার রচা ইতিহাস আর মানুষের রচা কাহিনী, এই দুইয়ে মিলে মানুষের সংসার। মানুষের পক্ষে কেবল—যে অশোকের গল্প, আকবরের গল্পই সত্য তা নয়; যে রাজপুত্র সাত-সমুদ্র-পারে সাত-রাজার-ধন মাণিকের সন্ধানে চলে সেও সত্য; আর সেই ভক্তিবিমুগ্ধ হনুমানের সরল বীরত্বের কথাও সত্য যে হনুমান গন্ধমাদনকে উৎপাটিত করে আনতে সংশয় বোধ করে না। এই মানুষের পক্ষে আরঞ্জেব যেমন সত্য দুর্যোধনও তেমনি সত্য।”

‘পুনরাবৃত্তি’ গল্পে রাজার একটু মন খারাপ। বাগানে বেড়াতে এসে তিনি দেখলেন দু’টি ছেলেমেয়ে। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন— ”তোমরা কি খেলছ।” তারা বললে, ”আমাদের আজকের খেলা রামসীতার বনবাস।” রাজা সেখানে বসে গেলেন। ছেলেটি বললে, ”এই আমাদের দণ্ডকারণ্য, এখানে কুটীর বাঁধছি।” মেয়েটি শাক পাতা নিয়ে খেলার হাঁড়িতে বিনা আগুনে রাঁধছে; রাম খাবেন, তারই আয়োজন। সীতার একদণ্ড সময় নেই। রাজা বললেন, ”আর তো সব দেখছি, কিন্তু রাক্ষস কোথায়।” ছেলেটিকে মানতে হল, তাদের দণ্ডকারণ্যে কিছু কিছু ত্রুটি আছে। রাজা তখন রাক্ষস হতে চাইলেন। ছেলেটি বললে, ”তোমাকে কিন্তু হেরে যেতে হবে।”

”ত্রেতাযুগে পঞ্চবটীতে যেমন পাখী ডেকেছিল সেদিন সেখানে ঠিক তেমন করেই ডাকতে লাগল। ত্রেতাযুগে সবুজ পাতার পর্দায় পর্দায় প্রভাত-আলো যেমন কোমল ঠাটে আপন সুর বেঁধে নিয়েছিল আজও ঠিক সেই সুরই বাঁধলে।”

ছেলে মেয়ে দুটিরই বয়স বেড়েছে। মেয়েটি মন্ত্রীকন্যা, রুচিরা, ছেলেটি সাধারণ, কৌশিক। দু’জনেই কৃতবিদ্য। আভিজাত্যগর্বে এবং সঙ্গদোষে রুচিরা কৌশিকের প্রতি একটু বিমুখ হয়েছিল, কিন্তু সেটা সাময়িক। রাজা ডেকে পাঠানোতে রুচিরা এসেছে। রাজা বললেন, ”বৎসে সেই রামের বনবাসের খেলা মনে আছে?” রুচিরা স্মিতমুখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রাজা বললেন, ”আজ সেই রামের বনবাস খেলা আর-একবার দেখতে আমার বড়ো সাধ।” রুচিরা মুখের একপাশে আঁচল টেনে চুপ করে রইল। রাজা বললেন, ”বনও আছে, রামও আছে, কিন্তু শুনেছি বৎসে, এবার সীতার অভাব ঘটেছে। তুমি মনে করলেই সে অভাব পূর্ণ হয়।” রূচিরা কোনো কথা না বলে রাজার পায়ের কাছে নত হয়ে প্রণাম করলে।

এই গ্রন্থের ‘স্বর্গ-মর্ত’ গল্পে ইন্দ্র, বৃহস্পতি, কার্তিকেয়, (স্বর্গের দেবতা) আছেন। রামায়ণ মহাভারতে এঁদের মাঝে-মধ্যেই দেখা পাওয়া যায়, তবে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীর সঙ্গে এই গল্পের কাহিনীর কোন যোগ নেই। তাই আর কোনো বিশদ আলোচনা এখানে করা হচ্ছে না।

সে— এই গ্রন্থের একেবারে প্রথমেই কবি বলতে চেয়েছেন, গল্প শোনার নেশা সব মানুষের মধ্যেই বর্তমান। রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সুয়োরানী, দুয়োরানী প্রভৃতি নিয়ে কত গল্প তৈরী হল; ”হল আঠারো পর্ব মহাভারত প্রস্তুত।”

এই গ্রন্থে ছোটোদের জন্য (আমরা বড়োরাও একইরকম ভাবে উপভোগ করছি) আজগুবি গল্পের সম্ভার তৈরী করেছেন কবি। হুঁহাউ দ্বীপে একদল বৈজ্ঞানিক নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। ”ওঁরা বলেন, কথা কওয়াটা মানুষের বানানো। ওটা প্রকৃতিদত্ত নয়। ওতে প্রতিদিন শ্বাসের ক্ষয় হতে থাকে, সেই শ্বাসক্ষয়েই আয়ুক্ষয়। স্বাভাবিক প্রতিভায় একথাটা গোড়াতেই আবিষ্কার করেছে বানর। ত্রেতাযুগের হনুমান আজও বেঁচে আছে।”— রামায়ণের মহাবীর হনুমান একজন ‘চিরজীবি’ বলে গণ্য।

‘সে’ নামক মানুষটি কবির আজগুবি গল্পের একটু প্রতিবাদ করেছে। ”এ তোমার আগাগোড়াই বানানো। ….. ঠিক করেছিলে, তোমার এই অভাগা সে—নামওয়ালাকেই বৈজ্ঞানিক সাজিয়ে সারা দ্বীপময় হাঁচিয়ে হাঁচিয়ে মারবে। বর্ণনা করবে আমি ঘাড়-নাড়ানাড়ির ঘটা করে ঘটোৎকচ-বধ পাঁচালির আসর জমাচ্ছি কি করে।”— ঘটোৎকচ মহাভারতের চরিত্র, মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেনের পুত্র।

কবি পুপু দিদিকে তার ছেলেবেলার গল্প শোনাচ্ছেন, সেখানে এসেছে রামায়ণের কথা। ”বোধ হচ্ছে, ফাল্গুন মাস পড়েছে। তার আগেই ক’দিন ধরে রামায়ণের গল্প শুনেছিলে সেই চিকচিকে-টাক-ওয়ালা কিশোরী চট্টোর কাছে। আমি সকালবেলায় চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছি, তুমি এতখানি চোখ করে এসে উপস্থিত। আমি বললেম, হয়েছে কী। হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, আমাকে হরণ করে নিয়েছে।

কী সর্বনাশ! কে এমন কাজ করলে।

এ প্রশ্নের উত্তরটা তখনো তোমার মাথায় তৈরী হয়নি। বলতে পারতে রাবণ, কিন্তু কথাটা সত্য হত না বলে তোমার সংকোচ ছিল। কেননা, আগের সন্ধেবেলাতেই রাবণ যুদ্ধে মারা গিয়েছে, তার একটা মুণ্ডুও বাকি ছিল না।”

‘সে’ কবিকে বেসুর-এর তত্ব বোঝাচ্ছে। কথাপ্রসঙ্গে দক্ষযজ্ঞের কথা এসেছে। ব্রহ্মার একপুত্র এই দক্ষ। দক্ষ বা দক্ষযজ্ঞের কথা মহাভারত কাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, তবুও মূল মহাভারতের শান্তিপর্বে দক্ষযজ্ঞের কথা আছে। দক্ষ প্রথমে দেবাদিদেব শিবকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর সেই অহংকার টেঁকেনি।

পুপুদিদির সঙ্গে কবির কথা হচ্ছে। পুপু বলছে—”অত্যাচারের আক্রমণ পছন্দসই তা বলতে পারি নে— কিন্তু বীভৎসমূর্তিতে যে পৌরুষ ঘুষি উঁচিয়ে দাঁড়ায় তাকে মনে হয় সাব্লাইম।

কবির উত্তর— ”আমার মতটা বলি। দুঃশাসনের আস্ফালনটা পৌরুষ নয়, একেবারে উল্টো। আজ পর্যন্ত পুরুষই সৃষ্টি করেছে সুন্দর, লড়াই করেছে বেসুরের সঙ্গে।”— দুঃশাসন মহাভারতের চরিত্র। সে দুর্যোধনের ভাই এবং দুর্যোধনের দুষ্ট সঙ্গীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।

দাদামশাইয়ের সঙ্গে গল্প, কথার্বাতা হয়ে যাওয়ার পর পুপু বলছে—

”সেই আলোর যুগে তোমার নাতনি হয়েই জন্মাব। এবারকার মতো দেহধারিণীর ‘পরে ধৈর্য রক্ষা কোরো। এখন চলুলম সিনেমায়।”

”কিসের পালা।”

”বৈদেহীর বনবাস।” — বৈদেহী অর্থাৎ রামায়ণের সীতা।

এই অধ্যায়ের প্রথমেই উল্লেখ করেছি যে গল্প সল্প গ্রন্থে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ নেই বললেই চলে। শুধু প্রথমেই নারদমুনির কথা একটুখানি আছে —

 ”আমাদের কাল থেকে ভাই,

 এ কালটা আছে বহু দূরে—

 মোটা মোটা কথাগুলো তাই

 ব’লে থাকি খুব মোটা সুরে।

 পিছনেতে লাগে নাকো ফেউ

 বৃদ্ধের প্রতি সম্মানে,

 মারতে আসে না ছুটে কেউ

 কথা যদি নাও লয় কানে।

 বিধাতা পরিয়ে দিল আজ

 নারদমুনির এই সাজ।”

বাংলা ভাষা-পরিচয়— ভারতবর্ষে প্রচলিত অতি প্রাচীনকালের মাগধী ভাষার মধ্যে বাংলাভাষার আদি বীজ খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বিচিত্র বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আজকের এই রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই বাংলা ভাষার কথা বলতে গিয়েও কবি মাঝে মধ্যে রামায়ণ মহাভারতের কথা ব্যবহার করেছেন, আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থের ৫ম অংশে কবি বলেছেন— ”ভাষায় মানুষের সবচেয়ে বড়ো সৃষ্টি সাহিত্য। এই সৃষ্টিতে যেটি প্রকাশ পেয়েছে তাকে যখন চরম বলেই মেনে নিই তখন সে হয় আমার কাছে তেমনি সত্য যেমন সত্য ঐ বটগাছ। …. মহাভারতের অনেক কিছু আমার কাছে সত্য; তার সত্যতা সম্বন্ধে ঐতিহাসিক, এমন-কি, প্রাকৃতিক কোনো প্রমাণ না থাকতে পারে, এবং কোনো প্রমাণ আমি তলব করতেই চাই নে, তাকে সত্য বলে অনুভব করেছি এই যথেষ্ট।”

এই আলোচনায় কবি প্রহ্লাদ চরিত্রের কথা বলেছেন। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ। তাঁর কথা শ্রীমদ্ভাগবতে আছে, কাশীরামদাসের মহাভারতেও আছে। কবির কথায় মঙ্গলকাব্যের ”দেবতা নিষ্ঠুর, ন্যায়ধর্মের দোহাই মানে না, নিজের পুজা-প্রচারের অহংকারে সব দুষ্কর্মই সে করতে পারে। নির্মম দেবতার কাছে নিজেকে হীন করে, ধর্মকে অস্বীকার করে, তবেই ভীরুর পরিত্রাণ, বিশ্বের এই বিধানই কবির কাছে ছিল প্রবলভাবে বাস্তব।

অপরদিকে আমাদের পুরাণকথা সাহিত্যে দেখো প্রহ্লাদচরিত্র। যাঁরা এই চরিত্রকে রূপ দিয়েছেন তাঁরা উৎপীড়নের কাছে মানুষের আত্মপরাভবকেই বাস্তব বলে মানেননি। সংসারে সচরাচর ঘটে সেই দীনতাই, কিন্তু সংখ্যা গণনা করে তাঁরা মানবসত্যকে বিচার করেননি। মানুষের চরিত্রে যেটা সত্য হওয়া উচিত তাঁদের কাছে সেইটেই হয়েছে প্রত্যক্ষ বাস্তব, যেটা সর্বদাই ঘটে এর কাছে সেটা ছায়া। যে কালের মন থেকে এ রচনা জেগেছিল, সে কালের কাছে বীর্যবান দৃঢ়চিত্ততার মূল্য যে কতখানি এই সাহিত্য থেকে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।”

কবির মতে সাহিত্যরচনায় প্রাধান্য পায় সেইসব ঘটনা যা লেখকের মনে ছাপ ফেলে। ”সে আমাদের অনুভূতিকে অধিকার করেছে বিশেষ করে, ছিনিয়ে নিয়ে চেতনার ক্ষীণতা থেকে। সে হয়তো অবজ্ঞা বা ক্রোধ উদ্রেক করে, কিন্তু সে স্পষ্ট। যেমন মন্থরা বা ভাঁড়ুদত্ত। দৈনিক ব্যবহারে তার সঙ্গ আমরা বর্জন করে থাকি। কিন্তু সাহিত্যে যখন তার ছবি দেখি তখন হেসে কিংবা কোনো রকমে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠি, ‘ঠিক বটে’।”—মন্থরা রামায়ণের চরিত্র। অযোধ্যার রাজা দশরথের পত্নী কৈকেয়ীর দাসী সে। তারই পরামর্শে কৈকেয়ী রাজার কাছ থেকে রামচন্দ্রের নির্বাসনের বর চেয়ে নিয়েছিলেন।

কবি লিখেছেন, ”জাভাতে দেখে এলুম আশ্চর্য নৃত্যকৌশলের সঙ্গে হনুমানে ইন্দ্রজিতে লড়াইয়ের নাট্যাভিনয়। এই দুই পৌরাণিক চরিত্র এমন অন্তরঙ্গভাবে তাদের অভিজ্ঞতার জিনিষ হয়ে উঠেছে যে, চার দিকের অনেক পরিচিত মানুষের এবং প্রত্যক্ষ ব্যাপারের চেয়ে এদের সত্তা এবং আচরণ তাদের কাছে প্রবলতরভাবে সুনিশ্চিত হয়ে গেছে।” হনুমান এবং ইন্দ্রজিৎ রামায়ণের চরিত্র। ইন্দ্রজিৎ রাবণের মহাবীর পুত্র। (অংশ-৫)

কবি বলেছেন বাংলাদেশের বা ভারতবর্ষের মাতৃভূমি নাম আমাদের দেওয়া নয়। ঐ শব্দটাকে আমরা তর্জমা করে নিয়েছি ইংরেজী Motherland শব্দ থেকে। ”ভারতবর্ষ যথার্থই পিতৃভূমি। তাই ভারতবর্ষের দেশ জুড়ে ব্যাপ্ত ঋষিদের নাম, আর রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধ প্রভৃতি মহাপুরুষদের চরিত্র-বৃত্তান্ত। …. এ কথা মনে রাখা উচিত যে, দেশবাসী সকলকে আমরা এক নাম দিয়ে পরিচিত করিনি। মহাভারতে আমরা কাশী, কাঞ্চি, মগধ, কোশল প্রভৃতি প্রদেশের কথা শুনেছি কিন্তু তাদের সমস্তকে নিয়ে এক দেশের কথা শুনিনি।” (অংশ-৭)

সংস্কৃত বহুল সাধুভাষার চাইতে রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত চলতি ভাষার প্রতি। সেই আলোচনাতেও মহাভারতের কথা আছে—

”সাধু ভাষার সঙ্গে চলতি ভাষার প্রধান তফাতটা ক্রিয়াপদের চেহারার তফাত নিয়ে। ‘হচ্ছে ‘করছে’কে যদি জলচল করে নেওয়া যায় তা হলে জাতঠেলাঠেলি অনেকটা পরিমাণে ঘোচে। উতঙ্কের গুরুদক্ষিণা আনবার সময় তক্ষক বিঘ্ন ঘটিয়েছিল, এইটে থেকেই সর্পবংশধ্বংসের উৎপত্তি। এর ক্রিয়াক’টাকে অল্প একটু মোচড় দিয়ে সাধু ভাষার ভঙ্গী দিলেই কালীসিংহের মহাভারতের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। তাঁর কাজে ও কথায় অসংগতি। মুখের ভাষাতেও এটা বলা চলে, আবার এও বলা যায় ‘তাঁর কাজে কথায় মিল নেই’। ‘বাসুকি ভীমকে আলিঙ্গন করলেন’ এ কথাটা মুখের ভাষায় অশুচি হয় না, আবার ‘বাসুকি ভীমের সঙ্গে কোলকুলি করলেন’ এটাতে বোধ হয় নিন্দের কারণ ঘটে না।”

এর পর কবি ছন্দের কথা বলেছেন। প্রাচীন সাহিত্যে ছিল পয়ার ছন্দের প্রাধান্য।

”দুই মাত্রার ছড়ার ছন্দ পরিণত রূপ নিয়েছে পয়ারে। বাঙালি বহুকাল ধরে এই ছন্দে গেয়ে এসেছে রামায়ণ মহাভারত একটানা সুরে। এই ছন্দে প্রবাহিত প্রাদেশিক পুরাণকাহিনী রাঙিয়েছে বাঙালির হৃদয়কে। দারিদ্র্য ছিল তার জীবনযাত্রায়, তার ভাগ্যদেবতা ছিল অত্যাচারপরায়ণ। এরা ছড়া বাঁধেনি নিজের কোনো স্মরণীয় ইতিহাস নিয়ে। এরা গান বাঁধেনি ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখবেদনায়। এরা নিঃসন্দেহেই ভালোবেসেছে, কিন্তু নিজের জবানিতে প্রকাশ করেনি তার হাসিকান্না। দেবতার চরিত-বৃত্তান্তে এরা ঢেলেছে এদের অন্তরের আবেগ। হরপার্বতীর লীলায় এরা নিজের গৃহস্থালীর রূপ ফুটিয়েছে, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গানে এরা সে প্রেমের কল্পনাকে মনের মধ্যে ঢেউ লাগিয়েছে যে প্রেম সমাজবন্ধনে বন্দী নয়, যে প্রেম শ্রেয়োবুদ্ধি-বিচারের বাইরে। একমাত্র কাহিনী ছিল রামায়ণ-মহাভারতকে অবলম্বন করে যা মানবচরিত্রের নতোন্নতকে নিয়ে হিমালয়ের মতো ছিল দিক থেকে দিগন্তরে প্রসারিত। কিন্তু সে হিমালয় বাংলাদেশের উত্তরতম সীমার দূর গিরিমালার মতোই; তার অভ্রভেদী মহত্ত্বের কঠিন মূর্তি সমতল বাংলার রসাতিশয্যের সঙ্গে মেলে না। তা বিশেষভাবে বাংলার নয়, তা সনাতন ভারতের। অন্নদামঙ্গলের সঙ্গে, কবিকঙ্কণের সঙ্গে রামায়ণ-মহাভারতের তুলনা করলে উভয়ের পার্থক্য বোঝা যাবে। অন্নদামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল বাংলার; তাতে মনুষ্যত্বের বীর্য প্রকাশ পায় নি, প্রকাশ পেয়েছে অকিঞ্চিৎকর প্রাত্যহিকতার অনুজ্জ্বল জীবনযাত্রা।”

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর বেশ কিছু উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন। উদাহরণগুলির মধ্যে অনেকগুলোই কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে নেওয়া। কবি লিখেছেন যে বাংলাভাষায় উত্তমপুরুষে ‘আম’—প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহার চলে। ”কৃত্তিবাসের পুরাতন রামায়ণে দেখেছি ‘রাখিলাম প্রাণ’। তেমনি পাওয়া যায় ‘তুমি’র জায়গায় ‘তোমি’। বাংলাভাষায় উকারে ওকারে দেনাপাওনা চলে এ তার প্রমাণ।

প্রথমপুরুষের মহলে আছে ‘সে’ আর ‘তিনি’। ….. প্রাচীন রামায়ণে ‘তাঁর’ ‘তাঁহার’ শব্দ নেই বললেই হয়, তার বদলে আছে ‘তান’ ‘তাহান’। …. প্রাচীন রামায়ণে … প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় ‘পড়েন্ত’ ‘দেখিলেন্ত’ প্রভৃতি ন্ত-বিশিষ্ট ক্রিয়াপদ একবচনে এবং বহুবচনে প্রথমপুরুষে”।

”প্রাচীন রামায়ণে দেখা গেছে প্রথম পুরুষের সদ্যঅতীত ক্রিয়াপদে প্রায় সর্বত্রই ক-প্রত্যয়-সমেত এ কার, যেমন— দিলেক, লইলেক। আবার একারের সম্পর্ক নেই দৃষ্টান্তও অনেক আছে, যেমন— চলিল সত্বর, পাঠাইল ত্বরিত। আধুনিক বাংলায় এইরূপ ক্রিয়াপদে কোথাও ‘এ’ লাগে কোথাও লাগে না, কিন্তু অন্তস্থিত ক-প্রত্যয়টা খসে গেছে।”

”এক কালে মুই’ ভদ্রসমাজে ত্যাজ্য ছিল না। প্রাচীন রামায়ণে পাওয়া যায় ‘মুঞি নরপতি’। কর্মকারক ‘মোকে’, কোথাও বা ‘মোখে’। বহুবচনে ‘মোরা’।

সম্মানবাচক, অসম্মানবাচক শব্দ নিয়েও কবি আলোচনা করেছেন। ‘হাঁদারাম, ভোঁদারাম, বোকারাম, ভ্যাবাগঙ্গারাম শব্দগুলোর ব্যবহার চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশের জন্য। কিন্তু ‘সুবুদ্ধিরাম’ ‘সুপটুরাম’ বলবার প্রয়োজনমাত্র ভাষা অনুভব করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত এই যে ‘রাম’ শব্দের সঙ্গেই যত বোকা বিশেষণের যোগ, ‘বোকা লক্ষ্মণ’ বলতে কারও রুচিই হয় না।” (অংশ-১৪)

এর পরে কবি তির্যকরূপ প্রয়োগের উদাহরণ দিয়েছেন। ”এযেন শব্দকে ত্যাড়চা করে দেওয়া। সব গৌড়ীয় ভাষায় এই তির্যকরূপ পাওয়া যায়, যেমন— দেবে জনে ঘোড়ে। বাংলায় বলি দেবে মানবে লেগেছে, পাঁচজনে যা বলে। …. প্রাচীন রামায়ণে দেখা যায় নামসংজ্ঞায় প্রায় সর্বত্রই এই তির্যকরূপ, যেমন সুমিত্রায়ে কৌশল্যায়ে মন্থরায়ে লোমপাদে। …. শ্রেণীবাচক কর্তৃপদে তির্যকরূপ দেখা যায়, অন্যত্র যায় না। ‘বাঘে গোরুটাকে খেয়েছে’ বললে বোঝায় বাঘজাতীয় জন্তুতে গোরুকে খেয়েছে, ভালুকে খায়নি। যখন বলি ‘রামে মারলে মরব, রাবণে মারলেও মরব; তখন ব্যক্তিগত রাম রাবণের কথা বলিনে; তখন রামশ্রেণীয় আঘাতকারী ও রাবণশ্রেণীয় আঘাতকারীর কথা বলা হয়।” ”বাংলা রামায়ণ মহাভারতে কর্মকারকে কে বিভক্তি অল্প।” (অংশ-১৬)

‘হতে’ আর ‘থেকে’ এই দুটো শব্দ বাংলা অপাদানের সম্বল। প্রাচীন হিন্দিতে ‘হতে’ শব্দের জুড়ি পাওয়া যায় ‘হুন্তাো’, নেপালীতে ‘ভন্দা’, সংস্কৃত ‘ভবন্ত’। প্রাচীন রামায়ণে দেখেছি ঘরে হনে, ভূমি হনে।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। ‘পশুর থেকে মানুষের উৎপত্তি’ একথা বলা চলে। কিন্তু ‘মানুষ’ থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে’ বলি নে, বলি ‘মানুষের গা থেকে’ কিংবা ‘কাপড় থেকে’। … কেবল ‘থেকে’ নয়, ‘হতে’ শব্দ প্রয়োগেও ঐ একই কথা। ‘অযোধ্যা হতে’ রাম নির্বাসিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন ‘রাবণের কাছ হতে’। (অংশ-১৭)

পথের সঞ্চয়-যাত্রার পূর্বপত্র প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”সম্প্রতি London Police Courts-নামক একটি আশ্চর্য বই পড়িতেছিলাম। সেই গ্রন্থে লংডন-রাজধানীর নীচের অন্ধকার তলায় দারিদ্রের মালিন্য ও পাপের পঙ্কিলতা উদ্ঘাটিত হইয়া বর্ণিত হইয়াছে। এই চিত্র যতই নিদারুণ হউক, খ্রিষ্টান তাপসের অদ্ভুত ধৈর্য বীর্য ও করুণাপরায়ণ প্রেম সমস্ত বীভৎসতাকে ছাড়াইয়া উঠিয়া উজ্জ্বল দীপ্তিতে প্রকাশ পাইয়াছে। গীতায় একটি আশার বাণী আছে, স্বল্পপরিমাণ ধর্মও মহৎ ভয় হইতে ত্রাণ করে। কোনো সমাজে সেই ধর্মকে যতক্ষণ সজীব দেখা যায় ততক্ষণ সেখানকার ভূরিপরিমাণ দুর্গতির অপেক্ষাও তাহাকে বড়ো করিয়া জানিতে হইবে।”

প্রাসঙ্গিক গীতার শ্লোকটি আছে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে (সাংখ্যযোগঃ)—

”নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।

স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।”

(৪০ সংখ্যক শ্লোক)

(নিষ্কাম কর্মের ধ্বংস নেই, তাহাতে কোনো পাপও হয় না; আর এই ধর্মের অল্পতা দ্বারাও মহাভয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।)

ইউরোপিয়ানদের সব কিছু খারাপ নয়, তাদের মধ্যেও অনেক ভালো আছে। এই আলোচনার মধ্যে কবি সমুদ্রমন্থনের কথা এনেছেন। তিনি লিখেছেন—”য়ুরোপ বীরের ন্যায় সত্যব্রত গ্রহণ করিয়াছে; বীরের ন্যায় সত্যের জন্য ধনপ্রাণ উৎসর্গ করিতেছে; এবং যতই ভুল করিতেছে, যতই ব্যর্থ হইতেছে, ততই দ্বিগুণতর উৎসাহের সহিত নূতন করিয়া উদ্যোগ আরম্ভ করিতেছে— কিছুতেই হাল ছাড়িয়া দিতেছেনা। মাঝে মাঝে অমঙ্গল দেখা দিতেছে, সংঘাতে সংঘর্ষে বহ্নি জ্বলিয়া উঠিতেছে, সমুদ্রমন্থনে মাঝে মাঝে বিষও উদগীর্ণ হইতেছে, কিন্তু মন্দকে তাহারা কোনোমতেই মানিয়া লইতেছে না।”

‘জলস্থল’ প্রবন্ধে লক্ষ্মীর সমুদ্রমন্থনে উত্থিত হওয়ার কথা আছে। ”বিঘ্নের কাছে যে মাথা হেঁট করিয়াছে, ভয়ের কাছে যে পাশ কাটাইয়া চলিয়াছে, লক্ষ্মীকে সে পাইল না। এজন্য আমাদের পুরাণকথায় আছে, চঞ্চলা লক্ষ্মী চঞ্চল সমুদ্র হইতে উঠিয়াছেন, তিনি আমাদের স্থির মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন নাই।”

রবীন্দ্রনাথ অনেক জায়গাতেই মহাভারতের অভিমন্যুর কথা বলেছেন; ‘সমুদ্রপাড়ি’ প্রবন্ধেও তিনি অভিমন্যুর কথা এনেছেন। ”যে কর্মে আমরা জীবনকে নিয়োগ করিয়াছি তাহার প্রতি যদি আমাদের জীবনগত নিষ্ঠা না থাকে, তাহার প্রতি যদি আমাদের একটা বেহিসাবি আকর্ষণ না থাকে, তাহার প্রতি অপরাহত শ্রদ্ধা লইয়া আমরা যদি পরাভবের দলেও দাঁড়াইতে না পারি, যদি মৃত্যুর মুখেও তাহার জয়পতাকাকে সর্বোচ্চে তুলিয়া ধরিবার বল না পাই, যদি অভিমন্যুর মতো ব্যূহের মধ্য হইতে বাহির হইবার বিদ্যাটাকে আমরা একেবারে অগ্রাহ্য না করি, তাহা হইলে আমরা কিছুই সৃষ্টি করিতে পারিব না, রক্ষা করিতেও পারিব না।”

সমুদ্রমন্থনে যে তীব্র হলাহল উত্থিত হয়েছিল, সৃষ্টি রক্ষার্থে শিব সেই হলাহল পান করে নিজ কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। ‘দুই ইচ্ছা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সেই কথা স্মরণ করেছেন। ”শিব যেমন করিয়া হলাহল পান করিয়াছিলেন, আনন্দ তেমনি করিয়া দুঃখকে অনায়াসেই গ্রহণ করে।”

ঐ একই প্রবন্ধে তিনি ‘রাবণ’ ‘স্বর্ণলঙ্কা’ ইত্যাদি কথা বলেছেন। ”ইচ্ছাকে বল্গাবদ্ধ করিবার প্রধান কারণ এই যে, দুটো ইচ্ছার অধিকার নির্ণয় লইয়া মানুষকে বিষম সংকটে পড়িতে হইয়াছে। …. আমাদের বাসনাকে তাহার সহজ সীমার চেয়ে জোর করিয়া টানিয়া বাড়াইতে গেলেই বিপদ ঘটিবে। …. দুঃসাহসে ভর করিয়া সেই টান কেবলই বাড়াইতে গেলে রাবণের স্বর্ণলঙ্কা ধ্বংস হয়, ব্যাবিলনের সৌধচূড়া ভাঙিয়া পড়ে;”

‘অন্তর বাহির’ প্রবন্ধে কবি দেবর্ষি নারদের কথা উল্লেখ করেছেন। ”আমাদের দেশে যে-সকল ছাত্র বিলাতি আর্টের নকল করিতে যায় তাহারা এই প্রকার ভঙ্গিমার পন্থায় ছুটিয়াছে। তাহারা মনে করে, বাস্তবের উপর জোরের সঙ্গে ঝোঁক দিলেই যেন আর্টের কাজ সুসিদ্ধ হয়। এইজন্য নারদকে আঁকিতে গেলে তাহারা যাত্রার দলের নারদকে আঁকিয়া বসে — কারণ ধ্যানের দৃষ্টিতে দেখা তাহাদের সাধনা নহে; যাত্রার দলে ছাড়া আর তো কোথাও তাহারা নারদকে দেখে নাই।”

‘স্টপ্ফোর্ড ব্রুক’-এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে কবি লিখেছেন— ”তাঁহার দেহের আয়তন বিপুল, তাঁহার মুখশ্রী সুন্দর; কেবল তাঁহার পীড়িত পায়ের দিকে তাকাইয়া মনে হইল, অর্জুন যখন দ্রোণাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তখন প্রণাম নিবেদনের স্বরূপ প্রথম তীর তাঁহার পায়ের তলায় ফেলিয়াছিলেন, তেমনি বার্ধক্য তাহার যুদ্ধ আরম্ভে প্রথম তীরটা ইঁহার পায়ের কাছে নিক্ষেপ করিয়াছে।” — অর্জুন এবং দ্রোণাচার্যের পরিচয় দেবার কোন প্রয়োজন নেই।

‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে আশা করিবার ক্ষেত্র বড়ো হইলেই মানুষের শক্তি বড়ো হইয়া বাড়িয়া ওঠে। কোনো সমাজ সকলের চেয়ে বড় জিনিষ যাহা মানুষকে দিতে পারে তাহা সকলের চেয়ে বড়ো আশা। যার মনে আশা আছে সে সেই আশা পূরণের জন্য সাধ্যের শেষ সীমা পর্য্যন্ত চেষ্টা করবে। ”এই পাশ্চাত্ত্যদেশে ….. সকলেই জানে সে কী চায়; এই জন্য সকলেই আপনার ধনুক বাণ লইয়া প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছে। যজ্ঞসম্ভবা যাজ্ঞসেনীকে পাইবে, এই আশায় যে বহু উচ্চে ঝুলিতেছে তাহাকে বিদ্ধ করিতে সকলেই পণ করিয়াছে।” — যাজ্ঞসেনী হচ্ছেন দ্রৌপদী; পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা। রাজা দ্রুপদ তাঁর এই অলোকসামান্যা অযোনিসম্ভবা কন্যার বিবাহের জন্য অত্যন্ত কঠিন লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। যিনি সেই লক্ষ্যভেদে সফল হবেন, তার সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হবে।

ছেলেবেলা— গ্রন্থটি কবির মৃত্যুর বছরখানেক আগে প্রকাশিত হয়। জীবনস্মৃতিতে যে সমস্ত বিষয় বর্ণিত হয়েছে তার কয়েকটা এখানে আছে। রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ এই গ্রন্থেও অল্পস্বল্প আছে। ‘বালক’ কবিতাটিতে ‘কিশোরী চাটুজ্জ্যের কথা বলা হয়েছে। পাঁচালি গানে তাঁর দক্ষতা ছিল।

”কিশোরী চাটুজ্জ্যে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে,

বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে।

দ্রুতলয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া,

থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া;”

লবকুশ রামায়ণের চরিত্র-রামচন্দ্র ও সীতার দুই পুত্রসন্তান।

রামায়ণের কাহিনী অত্যন্ত বাল্যকালেই কবির জানা হয়ে গিয়েছিল। তিনি লিখেছেন— ”ব্রজেশ্বরের কাছে সন্ধ্যোবেলায় দিনে দিনে শুনেছি কৃত্তিবাসের সাতকাণ্ড রামায়ণটা। সেই পড়ার মাঝে মাঝে এসে পড়ত কিশোরী চাটুজ্যে। সমস্ত রামায়ণের পাঁচালী ছিল সুর-সমেত তার মুখস্থ। সে হঠাৎ আসন দখল করে কৃত্তিবাসকে ছাপিয়ে দিয়ে হু হু করে আউড়িয়ে যেত তার পাঁচালির পালা। ‘ওরে রে লক্ষণ, এ কী অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ।”

ঠাকুরবাড়ীতে সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা বিশেষরূপেই প্রবহমান ছিল। কবির মেজকাকা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা শখের যাত্রাদলের দলপতি ছিলেন। ঠাকুরবাড়ীতে যাত্রা-গান মাঝে মধ্যে হতো, ছোটদের সে সব শোনা হতো না। কিন্তু একবার বড়োদের মন কি কারণে নরম হয়েছিল। ”হুকুম বেরল, ছেলেরাও যাত্রা শুনতে পাবে। ছিল নলদময়ন্তীর পালা।”

বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের কথাও কবি বলেছেন— ”ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ থেকে স্বয়ং বাল্মীকি—রামায়ণের টুকরো আউড়ে দিয়েছি অনুস্বার-বিসর্গ-সুদ্ধ; মা জানতেন না তাঁর ছেলের উচ্চারণ কত খাঁটি, তবু তার বিদ্যের পাল্লা সূর্যের ন কোটি মাইল রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে তাঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ সব শ্লোক স্বয়ং নারদমুনি ছাড়া আর কারও মুখে শোনা যেতে পারে, এ কথা কে জানত বলো।”

তাঁর বই পড়ার কথা প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন—”বই পড়ার কথা প্রথম যা মনে পড়ে সে ষণ্ডামার্ক মুনির পাঠশালার বিষম ব্যাপার নিয়ে, আর হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ অবতার-বোধ করি সীসের ফলকে খোদাই করা তার একখানা ছবিও দেখেছি সেই বইয়ে আর মনে পড়ছে কিছু কিছু চাণক্যের শ্লোক।”

হিরণ্যকশিপু, নৃসিংহঅবতার প্রভৃতি নিয়ে শ্রীমদ্ভাগবতে বিস্তৃত বর্ণনা আছে। কাশীরামদাসের মহাভারতেও এই প্রসঙ্গ আছে। বৈকুণ্ঠে নারায়ণের দ্বাররক্ষক জয় এবং বিজয় ব্রহ্মশাপগ্রস্ত হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল। তারা পছন্দ করেছিল নারায়ণের শত্রু হয়ে জন্মাতে, কারণ এতে তাদের মাত্র তিনজন্মেই মুক্তি ঘটার কথা। তাদের প্রথম জন্ম হিরণ্যাক্ষ-হিরণ্যকশিপু নামে। হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ কিন্তু হরিভক্ত যেটা দৈত্যদের Culture-এর সঙ্গে মেলে না। প্রহ্লাদের স্বভাব পাল্টানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল, তাকে ষণ্ড ও অমর্ক নামে দুই গুরুর কাছে পড়তে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি, প্রহ্লাদের মন থেকে হরিভক্তির বীজ উৎপাটিত করা যায়নি। শেষে পিতা হয়েও হিরণ্যকশিপু নিজপুত্রকে হত্যার আদেশ দিয়েছে। এই অত্যাচারী, অধর্মপরায়ণ হিরণ্যকশিপুকে শ্রীভগবান নৃহিংহ অবতারে বধ করেন।

‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে কবি মনু মহারাজের অণুসরণ করে সদাচারের কথা বলেছেন এবং সে ব্যাপারে তাঁর নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। ”সিভিলিজেশন, যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি, তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়। এই সভ্যতার যে রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার। অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন। সেই নিয়মগুলির সম্বন্ধে প্রাচীন সমাজে যে ধারণা ছিল সেও একটি সংকীর্ণ ভূগোলখণ্ডের মধ্যে বদ্ধ। সরস্বতী ও দৃশদবতী নদীর মধ্যবর্তী যে দেশ ব্রহ্মাবর্ত নামে বিখ্যাত ছিল সেই দেশে যে আচার পারম্পর্যক্রমে চলে এসেছে তাকেই বলে সদাচার। অর্থাৎ এই আচারের ভিত্তি প্রথার উপরেই প্রতিষ্ঠিত—তার মধ্যে যত নিষ্ঠুরতা, যত অবিচারই থাক। এই কারণে প্রচলিত সংস্কার আমাদের আচার-ব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে চিত্তের স্বাধীনতা নির্বিচারে অপহরণ করেছিল। সদাচারের যে আদর্শ একদা মনু ব্রহ্মাবর্তে প্রতিষ্ঠিত দেখেছিলেন সেই আদর্শ ক্রমশ লোকাচারকে আশ্রয় করলে।”

সদাচারের কথা মহাভারতেও আছে। মহাভারতের বিশালবুদ্ধি মহাকবি ধর্মকে শুধুমাত্র এবং স্মৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি। তিনি সদাচারকেও ধর্মের অংশ রূপে নির্দেশ করেছেন। যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—

”ইমে বৈ মানবাঃ সর্বে ধর্মম্প্রতি বিশঙ্কিতাঃ।

কোহয়ং ধর্ম কুতো ধর্মস্তন্মে ব্রূহি পিতামহ!।।

ধর্মস্তয়মিহার্থঃ কিমমুত্রার্থোহপি বা ভবেৎ।

উভয়ার্থো হি বা ধর্মস্তন্মে ব্রূহি পিতামহ।।”

ধর্ম কী এবং কী নিমিত্তই বা ধর্ম; ধর্মের ফল কোথায় হয়—ইহলোকে, পরলোকে বা উভয়লোকে? ভীষ্মের উত্তর —

”সদাচারঃ স্মৃতির্বেদস্ত্রিবিধং ধর্মলক্ষণম্।

চতুর্থমর্থমিত্যাহুঃ কবয়ো ধর্মলক্ষণম্।।”

মনু মহারাজের মতে ধর্মের মূলে হচ্ছে বেদ, যদিও সদাচার এবং স্মৃতির বিধান এগুলোও ধর্ম। আর মানুষের আত্মসন্তুষ্টি—সেটাও ধর্মের মধ্যে এসে যাচ্ছে। মনুর এই যে চতুর্থ বিষয় এবং ভীষ্মের বলা ‘মানুষের প্রয়োজন’ প্রায় একই পর্যায়ভুক্ত।

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন