ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব

ঊনবিংশ অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব)

রবীন্দ্ররচনাবলী সুলভ সংস্করণের শেষ খণ্ড অর্থাৎ অষ্টাদশ খণ্ড বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল ১৪০৭ সালে। সুলভ সংস্করণ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল খণ্ডে খণ্ডে শক্ত বাঁধাই রবীন্দ্ররচনাবলীর মহার্ঘ সংস্করণ। এই খণ্ডটির ৩২তম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছে ১৪১৯ সালে। এই পর্যায়ে আরো দুটি খণ্ড প্রকাশের পরিকল্পনা বিশ্বভারতীর রয়েছে (প্রকাশকের নিবেদন)। সুলভ সংস্করণে প্রকাশিত হয়নি এরকম অনেক রচনা এই গ্রন্থটিতে আছে। সেখানে রামায়ণ-মহাভারতের যেসব প্রসঙ্গ আছে সেগুলি এই অধ্যায়ে আলোচনা হবে।

আমাদের অল্পবয়সে স্কুলজীবনে ‘কুরুপাণ্ডব’ গ্রন্থখানি দ্রুতপঠন বা Rapid Reader হিসাবে পড়েছি। পরবর্তীকালে এই বইটি কোথাও চোখে পড়তো না। সম্প্রতি বিশ্বভারতীর একটি বিক্রয়কেন্দ্রে খোঁজ করে বইটি পেয়েছি—অত্যন্ত পুরানো, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত।

রবীন্দ্ররচনাবলী (৩২তম খণ্ড) :

অস্ত্রশক্তি বা বাহুবলই কি পৃথিবীতে Supreme বা শেষকথা—কবি এর উত্তর খুঁজছেন। শক্তিমানের আস্ফালনে যারা কষ্ট পেল, যারা বঞ্চিত হল, ‘তারাই পরক্ষণে সুযোগ পাওয়া মাত্র লোভের দস্যুতায় তাদের অস্ত্রেশস্ত্রে শান দিতে লাগল। তা হলে মনে এই প্রশ্ন জাগে বিরাট সৃষ্টিপ্রণালীর চরম তাৎপর্য কোথায়। রক্তাক্ত কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে মহাচিতানলের ভস্মরাশিতেই কি তার শক্তির অবসান?” (এতদিন পরে আমার দ্বারে, পৃ ১৯-২০)। এই প্রবন্ধে কবি অবশ্য আশাবাদী যে শক্তির মদমত্ততা পৃথিবীতে শেষ কথা হতে পারে না।

টীকাটিপ্পনী প্রবন্ধে (পৃ ১১০-১১২) রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের কথা কিছু আলোচনা করেছেন। ”রামায়ণ পড়ে দেখলে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত খাঁটি কবিকে দেখা যায়—উত্তরকাণ্ডে মেকি ধরা পড়ে। যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত রামচন্দ্র দশমুখকে ভয় করেন নি বলে সীতা উদ্ধার করতে পেরেছেন, আর উত্তরকাণ্ডে দুর্মুখকে ভয় করেছেন বলে সীতা হারিয়েছেন। যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত রামচন্দ্র গুহক, বানর, বিভীষণের মিতা; উত্তরকাণ্ডে তিনি শূদ্রক তপস্বীকে বধ করলেন; কেননা সেখানে তাঁর আদর্শ লোকধর্মের বন্ধনে, নিত্যধর্মের আনন্দে নয়। যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত রামচন্দ্র বীর, উত্তরকাণ্ডে রামচন্দ্র ভীরু।

উত্তরকাণ্ডের কবি লোকশিক্ষা দিতে বসেছিলেন—অর্থাৎ লোকে যেটাকে ভালো বলে, সেইটেই লোকের কানে ভালো বলা তাঁর কাজ হয়েছিল। ঋষিরা বাল্মীকির ছয়কাণ্ড রামায়ণে আনন্দ পেয়েছিলেন, আর লোকে বড়ো খুশি হয়েছিল বাল্মীকির উত্তরকাণ্ড রামায়ণে। রামায়ণের আনন্দই হচ্ছেন সীতা, তিনি সত্য, তাঁর সতীত্ব আমরা তাঁর জীবনে দেখেছি—সেই আনন্দকে বধ করেছেন উত্তরকাণ্ডের লেখক, কারণ সতীত্বকে তিনি লোকশ্রুতির মধ্যে দেখতে চেয়েছেন। …. আমাদের সীতা, যিনি আমাদের সত্য, আমাদের সুন্দর, তিনি কেঁদে বলছেন, ‘মা বসুন্ধরা, আমাকে গ্রহণ করো! ঐ লোকরঞ্জনকারী তাঁর ঘরের স্যাকরা দিয়ে গড়া বানানো-সীতাকে নিয়ে বাজার দরে তার দাম কষে খুশি থাকুন।”

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কবির মনে এই ক্ষোভ ছিল যে তাঁর লেখা দেশে বড়ো বেশি অকরুণ সমালোচনার মুখে পড়েছে। ‘তখন ও এখন’ প্রবন্ধে (রচনাকাল বৈশাখ ১৩২৩-অর্থাৎ এখন থেকে একশত বৎসর পূর্বে) তিনি মত প্রকাশ করেছেন যে তখনকার সময়ে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেই কঠোর সমালোচনা করা উচিৎ ছিল না। ‘আমার মতে বাংলা সাহিত্যে কঠোর সমালোচনার দিন আসে নাই। ….. অথচ দেখিতে পাই বালক বাংলা সাহিত্য যেন অভিমন্যুর মতো সপ্তরথীর হাতে চারদিক হইতে কেবলই বাণ খাইতেছে। না, সপ্তরথী বলাও ভুল—কেননা বীরের হাতের মারও নয়। ছোটো ছোটো সমালোচকের ছোটো ছোটো খোঁচা তাঁহাকে হয়রান করিয়া মারিতেছে।’

‘সাহিত্যবিচার’ প্রবন্ধে কবি এক জায়গায় লিখেছেন (পৃ-১৩৩)—’মহাকাব্যে নাটকে বা নভেলে যে আখ্যানবস্তু পাওয়া যায় ….সেই সমস্ত আখ্যানে একটি সাধারণ উপাদান দেখিতে পাই; সেটি ….. সংসারে ভালোমন্দের দ্বন্দ্ব। তাই রামায়ণে দেখিয়াছি রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহাভারতে দেখিয়াছি কুরু-পাণ্ডবের বিরোধ। কেবলই সমস্তই একটানা ভালো, কোথাও মন্দের কোনো আভাস মাত্র নাই, এমনতরো নিছক চিনির সরবত দিয়াই সাহিত্যের ভোজ সম্পন্ন করা অন্তত কোনো বড়ো যজ্ঞে দেখি নাই।’

এই কথাটাই বিশদে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি মহাভারতের একটি শ্লোকের অংশ—অহিংসা পরমো ধর্মঃ—উল্লেখ করেছেন (পৃ-১৩৪)। ”মানুষের গন্ধে গল্পের রাক্ষসের ভ্রাতৃপ্রেম যদি জাগিয়া উঠিত এবং সে যদি সুমধুর স্বরে বলিয়া উঠিত ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’ তবে সাহিত্যরসনীতি অনুসারে রাক্ষসের সে অপরাধ কিছুতে ক্ষমা করা চলিত না।”

এই ‘সাহিত্যবিচার’ প্রবন্ধেই কবি তাঁর ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস নিয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনার উল্লেখ করেছেন।

”সকল ভাষার সকল সাহিত্যেই ভালোমন্দ দুইরকম চরিত্রেরই মানুষ আসরে স্থান পায়। পুণ্যভূমি ভারতবর্ষেও সেইরূপ বরাবর চলিয়া আসিয়াছে। এইজন্যই ঘরে-বাইরে নভেলে যখন সন্দীপের অবতারণা করিয়াছিলাম তখন মুহূর্তের জন্যও আশঙ্কা করি নাই যে সেটা লইয়া আমাদের দেশের উপাধিধারী এত গণ্যমান্য লোকের কাছে আমাকে এমন জবাবদিহির দায়ে পড়িতে হইবে। ……জানি আমাকে প্রশ্ন করা হইবে, সন্দীপ যত বড়ো মন্দ লোকই হউক তাহাকে দিয়া সীতাকে অপমান কেন। আমি কৈফিয়ত-স্বরূপে বাল্মীকির দোহাই মানিব, তিনি কেন রাবণকে দিয়া সীতার অপমান ঘটাইলেন? তিনি তো অনায়াসেই রাবণকে দিয়া বলাইতে পারিতেন যে, মা লক্ষ্মী, আমি বিশ হাতে তোমার পায়ের ধুলা লইয়া দশ ললাটে তিলক কাটিতে আসিয়াছি। বেদব্যাস কেন দুঃশাসনকে দিয়া জয়দ্রথকে দিয়া দ্রৌপদীকে অপমানিত করিয়াছেন? রাবণ রাবণের যোগ্যই কাজ করিয়াছে; দুঃশাসন জয়দ্রথ যাহা করিয়াছে তাহা তাহাদিগকেই সাজে। তেমনি আমার মতে সন্দীপ সীতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছে তাহা সন্দীপেরই যোগ্য, অতএব সে কথা অন্যায় কথা বলিয়াই তাহা সংগত হইয়াছে। এবং সেই সংগতি সাহিত্যে নিন্দার বিষয় নহে।

যদি আধুনিক কালের কোনো উপাধিধারী এমন কথা গদ্যে বা পদ্যে বলিতে পারিতেন যে, রাবণের পক্ষে সীতাহরণ কাজটা অসংগত, মন্থরার পক্ষে রামের প্রতি ঈর্ষা অযথা, শূর্পণখার পক্ষে লক্ষ্মণের প্রতি অনুরাগের উদ্রেক অসম্ভব, তাহা হইলে নিশ্চয় কবিগুরু বিচারসভায় হাজির থাকিলেও নিরুত্তর থাকিতেন; কেননা এমন-সকল আলোচনা সাহিত্যসভায় চলিতে পারে। কিন্তু তাহা না বলিয়া ইঁহারা যদি বলিতেন এ-সকল বর্ণনা নিন্দনীয় কারণ ইহাতে সীতাকে রামকে লক্ষ্মণকে অপমানিত করা হইয়াছে এবং এই অপমান স্বয়ং কবিকৃত অপমান,ধর্মশাস্ত্র অনুসারে এই-সকল ভালোমানুষের প্রতি সকলেরই সাধু ব্যবহার করাই উচিত, তবে যে-কবি সর্বাঙ্গে কীটের উৎপাত স্তব্ধ হইয়া সহ্য করিয়াছিলেন তিনিও বোধ হয় বিচলিত হইয়া উঠিতেন।

কবি যাই বলুন, তাঁর মতের সঙ্গে সবাই যে সহমত হবেন সেটা মনে হয় না। সন্দীপের মন্দ চরিত্র পাঠকদের কাছে প্রকাশ করার জন্য তার মুখে সীতার প্রতি অশালীন উক্তি না বসিয়েও সেটা করা যেত। বস্তুতপক্ষে এই উক্তির আগেই উপন্যাসের মনোযোগী পাঠক সন্দীপ সম্বন্ধে ধারণা করে ফেলেছেন। সীতা, দ্রৌপদী—এঁরা হাজার হাজার বৎসর ধরে কোটি কোটি ভারতবাসীর মনে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিতা। এঁদের প্রতি সন্দীপের মুখে এরকম অশালীন উক্তি বসানো মেনে নেওয়া যায় না।

‘সংহতি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণ মহাভারতের কথার উল্লেখ করেছেন।—”মানুষের একলা হবার প্রবৃত্তিই হচ্ছে রিপু, সত্যভাবে মিলিত হবার সাধনই কল্যাণ। এই দুইয়ের বিরোধ নিয়ে কুরুক্ষেত্র লড়াই মানুষের ইতিহাসে চলে আসছে। এখনো মানুষ শান্তিপর্বে এসে পৌঁছয় নি। …..মানুষের ইতিহাসে এর আগে অনেক দুঃখ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। শক্তির লোভ ধনের লোভ চিরদিনই নররক্ত পিপাসার পরিচয় দেয়। তার স্বর্ণলঙ্কায় চিরদিনই দেবতাদের হাতে হাতকড়ি পড়েছে। তার দশমুণ্ড বিশহাত দশদিকে ধর্মকে উপেক্ষা করবার জন্য উদ্যত। তাই চিরদিনই তার স্বর্ণলঙ্কায় কোনো-না-কোনো সময়ে আগুনও লেগেছে।

কিন্তু বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের সহায়তায় এই রিপু যে-রকম কঠিন উপকরণে বিরাট আকারে আপনার গড় বেঁধেছে এমন কোনো দিন করে নি। এর তাড়কারাক্ষসীর দল জগৎসুদ্ধ লোককে তাড়না করে অনিষ্ট করে তুলেছে। অবশেষে আজ এই সংহতির চেলাদের মধ্যে কেউ কেউ কেঁদে বলছে, ‘শান্তি চাই, শান্তি চাই’। কেননা এবারকার লঙ্কাকাণ্ড ত্রেতাযুগকে হারিয়ে দিয়েছে।”

চন্দননগর পৌরসভার অভ্যর্থনা উপলক্ষে কবি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ‘সম্মান’ নামে এই গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। বালকবয়সে কবি চন্দননগরে গিয়েছিলেন এবং তার স্মৃতিচারণ করেছিলেন এই ভাষণে। তখন যে বাড়ীতে কবি থাকতেন ‘সে ঘর নেই, সে বাড়ী আজ লৌহদন্তদন্তুর কলের কবলে কবলিত। সে গঙ্গা আজ অবমাননায় সংকুচিত, বন্দী হয়েছে কলদানবের হাতে—ত্রেতাযুগে জানকী যেমন বন্দী হয়েছিলেন দশমুণ্ডের দুর্গে। দেবী আজ শৃঙ্খলিতা।’

ঐ একই প্রবন্ধে কবি উপস্থিত জনতাকে বলেছিলেন যে তাঁরা কবিকে যে সম্মান দিচ্ছেন সেটা যদি কবির সহযোগিতার আহ্বানে হয়, তবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ‘এর সঙ্গে যদি সহযোগিতা না থাকে তবে এই সম্মানের ভার দুর্বিষহ। বহুদূর থেকে নারদের পুষ্পমাল্য ইন্দুমতীকে সাংঘাতিক আঘাত করেছিল—বস্তুত সে মালারই ভার নয়, সে দূরত্বের ভার। দূরে থেকে যে সম্মান, সে সম্মানের ভার বহন করে সংসারে মুক্তচিত্তে বিচরণ করতে ক’জন পারে?’—ইন্দুমতী রামায়ণের চরিত্র, দশরথের মাতা।

আষাঢ় ১৩৪৩-এ লিখিত ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা প্রবেশিকা পাঠ্য’ প্রবন্ধটিতে কবি জানিয়েছেন যে জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা কবিকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করেছিল। তাঁর রচনাতে কবি পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন অনৈতিক আদর্শ প্রচার করেছেন—এইরকম সব অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই দীর্ঘ প্রবন্ধটিতে কবি দৃঢ়ভাবে এবং অকাট্য যুক্তিপ্রয়োগে সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। এই প্রবন্ধের উপসংহারে কবি আবার ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের কথা এনেছেন। ”সাহিত্যবিচার নিয়ে এইরকম অদ্ভুত বুদ্ধিবিকার আমার হিন্দু ভ্রাতাদের মধ্যেও উগ্র হয়ে উঠতে পারে ….. ঘরে-বাইরে নামে একখানা উপন্যাস অশুভলগ্নে লিখেছিলেম। তার মধ্যে বর্ণিত সন্দীপ নামক এক দুর্বৃত্তের মুখে সীতার প্রতি অসম্মানজনক কিছু আলোচনা ছিল। বলা বাহুল্য, সন্দীপের চরিত্রচিত্র পরিস্ফুট করা ছাড়া এই আলোচনার মধ্যে অন্য কোনো অসৎ অভিপ্রায় ছিল না। হঠাৎ আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কলরব উঠল সীতাকে স্বয়ং আমিই অপমান করেছি। কবি বাল্মীকি অযোধ্যার প্রজাদের মুখের দুর্বাক্যকে দুর্মুখের মুখ দিয়ে ব্যক্ত করিয়ে নিরপরাধ সীতার নির্বাসন সম্ভব করেছেন। কেউ তো ত্রেতাযুগের কবির প্রতি দোষারোপ করেননি। আর এই কলিযুগের কবির মাথায় হিন্দু-মুসলমান উভয়পক্ষই একই শ্রেণীর অপরাধ চাপিয়ে তার অখ্যাতিকে দুর্ভর করে তোলেন, তবে কি এই বাংলা দেশের পঙ্কিল মাটিকেই দায়ী করব?—এ প্রসঙ্গ আগে আলোচিত হয়েছে।

মৈত্রেয়ী দেবীর কাব্যগ্রন্থ ‘উদিতার’ আলোচনা প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন—’ষোলো বছর বয়সের অভিমন্যুকে যুধিষ্ঠির সপ্তরথীর ব্যূহের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন, এটি অবিবেচনার কাজ হয়েছিল তা সপ্রমাণ হয়েছে। আমার সেই কথাই মনে পড়ছে যখন দেখছি বাণবর্ষণমুখর সাহিত্যক্ষেত্রে বালিকার রচনাকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে রচনায় শক্তিলক্ষণ যতই থাক।’

শ্রীহরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, পদ্মভূষণ অকল্পনীয় পরিশ্রমে মূল সংস্কৃত মহাভারত সংকলন করেছিলেন। মূল সংস্কৃত শ্লোক বাংলা হরফে, প্রতিটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ, প্রতিটি শ্লোকের নীলকণ্ঠকৃত টীকা এবং তাঁর নিজের টীকা এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রবাসী, কার্তিক ১৩৩৮ সংখ্যায় কবি সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়ের গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কবিকৃত আলোচনার প্রধান অংশসমূহ নিম্নে উদ্ধৃত হলো—

”শ্রীযুক্ত পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় নীলকণ্ঠ-কৃত ও নিজ-কৃত টীকা ও বঙ্গীয় অনুবাদ সমেত মহাভারত প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ইহার সতেরো খণ্ড আমার হাতে আসিয়াছে। আদিপর্ব শেষ করিয়া সভাপর্ব আরম্ভ হইল।”

”এ কথা বলিতে পারি পণ্ডিত মহাশয়ের এই অধ্যবসায়ে আমি নিজে তাঁহার নিকট বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আমার অল্প বয়স হইতেই মহাভারত আমাকে বিস্মিত করিয়াছে। ইহা ভারতবর্ষের হিমালয়েরই মতো যেমন উত্তুঙ্গ তেমনি সুদূর প্রসারিত,

 পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য

 স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ডঃ।

পৃথিবীর মানদণ্ডই বটে। এই একখানি গ্রন্থ নানাদিক দিয়া বিরাট মানবচরিত্রের পরিমাপ করিয়াছে। একাধারে এমন বিপুল বিচিত্র সাহিত্য আর কোনো ভাষায় নাই। অন্য দেশের কথা বলিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু ইহা নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারি যে মহাভারত না পড়িলে আমাদের দেশের কাহারও শিক্ষা সম্পূর্ণ হইতে পারে না। জাভা দ্বীপে গিয়া যখন দেখিলাম, সেখানকার সমস্ত লোক এই মহাভারতকে কেবল মন দিয়া নয় সর্বাঙ্গ দিয়া আয়ত্ত করিয়াছে, এই কাব্য তাহাদের সর্বদেশব্যাপী চিরকালের উৎসবক্ষেত্র রচনা করিয়া দিয়াছে, তখন স্বদেশের কথা স্মরণ করিয়া মনে ঈর্ষা জন্মিল। আমাদের দেশেও এই কাব্যবনস্পতি আজও সতেজ আছে বটে, কিন্তু ইহার শাখায় প্রশাখায় ভারতের চিত্ত একদা যে নীড় বাঁধিয়াছিল সে যেন আজ শূন্য হইয়া আসিতেছে। মানবমনের এতবড়ো আশ্রয় আর কোনো দেশে আছে বলিয়া জানি না—তবু উদাসীনভাবে এই আবাস হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবার মতো দুর্ভাগ্য আর কিছুই হইতে পারে না। জাভায় এই যে দেখিলাম একটি সমগ্র জাতিকে এত দীর্ঘকাল ধরিয়া তাহার আনন্দভোজের আয়োজন পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছে, একমাত্র মহাভারতের দ্বারা ইহা সম্ভবপর হইতে পারিল। যে-দেশের বাণীতে ইহার জন্ম, সেই দেশেও যদি আমরা এই কাব্যকে বইয়ের শেলফে নির্বাসিত না করিয়া সর্বজনীন সম্পদরূপে চিত্তোৎকর্ষের ব্যবহারে গভীরভাবে গ্রহণ করিতে পারি, তবে আমাদের সাহিত্য এবং সেইসঙ্গে আমাদের চরিত্র বীর্যবল হইতে পারিবে।

সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়ের শুভ সংকল্প সিদ্ধ হউক একান্তমনে এই কামনা করি।”

কুরুপাণ্ডব : মা মৃণালিনীদেবীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন— ”বাবা মনে করতেন—রামায়ণ মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে পরিচয় শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ হওয়া উচিত। …. ভাষার বিশেষ পরিবর্তন করে, প্রক্ষিপ্ত ও অবান্তর ঘটনা বাদ দিয়ে মূল গল্প দুটি অটুট রেখে রামায়ণ ও মহাভারতের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করার আগ্রহ তাঁর এই সময়ে দেখা গেল। রামায়ণ সংক্ষিপ্ত করার ভার দিলেন মাকে আর মহাভারত সুরেনদাদাকে। তাঁকে বললেন কালীপ্রসন্ন সিংহের তর্জমা অবলম্বন করে সংক্ষিপ্ত করতে।’ (চিঠিপত্র ১ম খণ্ড; পৃ-১৫৭)। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কবি একটা চিঠিতে লিখেছিলেন—’মহাভারতের নিছক গল্প অংশটিকে চিহ্নিত করে দিয়েছি। ওর প্রথম অংশটা বাদ পড়বে। যেখান থেকে কৌরব পাণ্ডবদের বাল্যলীলা শুরু হয়েছে সেখান থেকে বই আরম্ভ হবে। …. সবশুদ্ধ বোধ হয় ১৫০/২০০ পাতার বেশী হবে না। খুব আঁট করে দিয়েছি—পড়তে বেশ ভালো লাগবে।’ (চিঠিপত্র ২য় খণ্ড; পৃ-১৫১)। বৌমা প্রতিমাদেবীকে কবি একটা চিঠিতে লিখেছিলেন—’গাড়ীতে আমার দুটি কাজ ছিল। ……সুরেনের মহাভারতখানা নিয়ে তার খাঁটি গল্পাংশটুকু চিহ্নিত করছিলুম। ….এই কাজটা খুব ভালো লাগছিল। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস মহাভারতের অতি বিপুলতা থেকে আমি তার যে সারভাগ উদ্ধার করেছি সেটা অতি উত্তম হয়েছে।’ (চিঠিপত্র ৩য় খণ্ড; পৃ-১৯২)। এইটিই পরে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘কুরুপাণ্ডব’ নামে প্রকাশিত হয় ২৫শে বৈশাখ, ১৩৩৮এ। গ্রন্থটির ভূমিকা হিসাবে কবি লিখেছিলেন—’আমার ভ্রাতুষ্পুত্র কল্যাণীয় শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথ মহাভারতের মূল আখ্যানভাগ বাংলায় সংকলন করেন। তাহাকেই সংহত করিয়া কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকাহিনী এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে। আধুনিক বাংলাসাহিত্যের উৎপত্তিকাল হইতেই সংস্কৃত ভাষার সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ঘটিয়াছে, ….। এই কারণে যে বাংলা রচনারীতি বিশেষভাবে সংস্কৃতভাষার প্রভাবান্বিত তাহাকে আয়ত্ত করিতে না পারিলে বাংলাভাষায় ছাত্রদের অধিকার সম্পূর্ণ হইতে পারিবে না, …..। এই কথা মনে রাখিয়া শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের উচ্চতরবর্গের জন্য গ্রন্থখানির প্রবর্তন হইল।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন