দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড

দ্বাদশ অধ্যায় – (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড)

রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলি হল—

কবিতা ও গান : প্রহাসিনী ও সংযোজন, আকাশ প্রদীপ, নবজাতক এবং সানাই;

নাটক ও প্রহসন : চণ্ডালিকা, তাসের দেশ এবং বাঁশরী;

উপন্যাস ও গল্প : গল্পগুচ্ছ;

প্রবন্ধ : সাহিত্যের পথে ও পরিশিষ্ট, কালান্তর ও সংযোজন; এবং গ্রন্থপরিচয়।

এই গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘নবজাতক’-এ রামায়ণ-মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ নেই। ‘তাসের দেশ’ নাটকে ব্যাঙ্গার্থে লোকপিতামহ ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্মের বিষয়ে একটুখানি উল্লেখ আছে। প্রহাসিনী, আকাশপ্রদীপ, সানাই ও চণ্ডালিকা গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ খুব অল্প। বাঁশরী নাটক, গল্পগুচ্ছের গল্পসমূহ, সাহিত্যের পথে এবং কালান্তর—এইগুলিতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ মোটামুটি আছে।

প্রহাসিনী ও সংযোজন : ‘আধুনিকা’ কবিতাটি অপরাজিতা দেবীকে উদ্দেশ্য করে লিখিত। কবি যে আধুনিক যুগের মানুষ, খুব প্রাচীন কেউ নন, এটা বোঝাতে তিনি লিখেছেন—

‘মনে রেখো, তবু আমি জন্মেছি অধুনাই।

সাড়ে আঠারো শতক এ. ডি., সে যে বি. সি. নয়;

মোর যারা মেয়ে-বোন নারদের পিসি নয়।’

নারদ হচ্ছেন দেবর্ষি— রামায়ণ মহাভারতের বহু জায়গাতেই তিনি আছেন। ‘পরিণয়মঙ্গল’ কবিতাটি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা জয়শ্রী দেবীর বিবাহ উপলক্ষে রচিত হয়। এই কবিতাটিতে ‘গীতা’ শব্দটি আছে।

‘বই কেনা শখটারে দিয়ো নাকো প্রশ্রয়;

ধার নিয়ে ফিরিয়ো না, তাতে নাহি দোষ রয়।

বোঝ আর না-ই বোঝ কাছে রেখো গীতাটি,

মাঝে মাঝে উলটিয়ো মনুসংহিতাটি’;

‘অনাদৃতা লেখনী’ কবিতাতে কবির কলম কবিকে বলছে—

‘নীলকণ্ঠ হয়েছি যে তোমার সেবার তরে,

নীল কালিমার তীব্ররসে কণ্ঠ আমার ভরে।

 …………………………………………

ভগীরথকে দেশ বিদেশে নিয়েছে লোকে চিনে,

গোমুখী সে রইল নীরব খ্যাতিভাগের দিনে।’

সমুদ্রমন্থনের তীব্র হলাহল কণ্ঠে ধারণ করে শিব হয়েছিলেন নীলকণ্ঠ। কলমে নীল তরল কালি ভর্তি করাতে সেটিও হয়েছে নীলকণ্ঠ। ভগীরথের কাহিনী আগে বর্ণনা করা হয়েছে।

এই গ্রন্থের ‘সংযোজন’ অংশে ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় দক্ষের কথা আছে—

 ‘সত্যযুগে দেবদেবীদের

 ডেকেছিলেন দক্ষ

 অনাহূত পড়ল এসে

 মেলাই যক্ষ রক্ষ’,

ব্রহ্মার পুত্র এই দক্ষ। বিশ্বে জীবসৃষ্টিতে দক্ষের অবদান প্রচুর। এঁরই এক কন্যা সতী শিবের পত্নী ছিলেন।

‘নারীর কর্তব্য’ কবিতায় মনু এবং পরাশরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মনুসংহিতা গ্রন্থের রচয়িতা মনুর কথাই এখানে বলা হয়েছে। পরাশর ব্যাসদেবের পিতা। তিনিও একটি সংহিতা গ্রন্থের রচয়িতা।

‘আকাশ প্রদীপ’ গ্রন্থে ‘যাত্রাপথ’ কবিতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রসঙ্গ আছে—

 ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা,

 দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা।

 আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগি তাহার মলাট

 দিদিমায়ের মতোই যেন বলিপাড়া ললাট।

 মায়ের ঘরের চৌকাঠেতে বারান্দার এক কোণে

 দিন-ফুরানো ক্ষীণ আলোতে পড়েছি একমনে।

 অনেক কথা হয়নি তখন বোঝা,

 যেটুকু তার বুঝেছিলাম মোট কথাটা সোজা

 ভালোমন্দে লড়াই অনিঃশেষ,

 প্রকাণ্ড তার ভালোবাসা, প্রচণ্ড তার দ্বেষ।’

কবিতাটি আমাদের জীবনস্মৃতিতে বর্ণিত বালক কবির রামায়ণ পাঠের কথা মনে করিয়ে দেয়।

‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থে জ্যোতির্বাষ্প কবিতায় ‘সমুদ্রমন্থনে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের সঙ্গে এর যোগ নেই বলেই মনে হয়।

‘চণ্ডালিকা’ নাটকের একজায়গায় রামায়ণের প্রসঙ্গ আছে। বৌদ্ধভিক্ষু আনন্দ চণ্ডালকন্যা প্রকৃতির কাছে জল চেয়েছিলেন। প্রকৃতি তার মাকে বলছে—”সমস্ত শ্রাবস্তীনগরে আর কি কোথাও জল ছিল না, মা। এলেন কেন এই কুয়োরই ধারে।…যে জলে ব্রত হল পূর্ণ সে জল তো আর কোথাও পেতেন না, কোনো তীর্থেই না। তিনি বললেন, বনবাসের গোড়াতেই জানকী এই জলেই স্নান করেছিলেন, সে-জল তুলে এনেছিল গুহক চণ্ডাল।”—বনবাসে গমনকালে সীতাদেবী যে গুহকের তুলে দেওয়া জলে স্নান করেছিলেন, এরকম কোন বর্ণনা কৃত্তিবাসী রামায়ণে আমার চোখে পড়েনি।

তাসের দেশ : পূর্বে উল্লেখ করেছি যে সম্ভবত ব্যঙ্গার্থেই, লোকপিতামহ ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটু বর্ণনা আছে এই নাটকে। রাজপুত্র আর সদাগরপুত্র এসে পড়েছেন তাসের দেশে। সদাগরপুত্র তাস-দেশীয়দের জিজ্ঞাসা করলেন—

 ”সদাগর : তোমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে।

 ছক্কা : ব্রহ্মা হয়রান হয়ে পড়লেন সৃষ্টির কাজে। তখন বিকেল বেলাটায় প্রথম যে হাই তুললেন, পবিত্র

সেই হাই থেকে আমাদের উদ্ভব।….শুভ গোধূলি লগ্নে পিতামহ চারমুখে একসঙ্গে তুললেন চার হাই।

 সদাগর : বাস রে। ফল হল কী?

 ছক্কা : বেরিয়ে পড়ল ফস ফস করে ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, চিড়েতন। এরা সকলেই প্রণম্য।

(প্রণাম)”

এবারে তাসবংশীয়েরা রাজপুত্রদের উৎপত্তির কথা জিজ্ঞাসা করছে।

 ”পঞ্জা : ওহে বিদেশী, শাস্ত্রমতে তোমাদেরও তো একটা উৎপত্তি ঘটেছিল?

 সদাগর : নিশ্চিত। পিতামহ ব্রহ্মা সৃষ্টির গোড়াতেই সূর্যকে যেই শানে চড়িয়েছেন অমনি তাঁর নাকের

মধ্যে ঢুকে পড়লো একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ। তিনি কামানের মতো আওয়াজ করে হেঁচে ফেললেন—সেই বিশ্ব-কাঁপানি হাঁচি থেকেই আমাদের উৎপত্তি।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে রবীন্দ্রনাথ ভীষণভাবে অপৌত্তলিক এবং তিনি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। তাছাড়া, আচার সর্বস্ব বিধিনিয়মকে তিনি কোনদিন পছন্দ করেন নি।

বাঁশরি : ‘বিলিতি য়ুনিভার্সিটি’র পাশ করা মেয়ে বাঁশরি সাহিত্যিক ক্ষিতীশকে বলছে— ”অশ্বত্থামার ছেলেবেলার গল্প পড়েছ। ধনীর ছেলেকে দুধ খেতে দেখে যখন সে কান্না ধরল, তাকে পিটুলি গুলে খেতে দেওয়া হল, দু হাত তুলে নাচতে লাগল দুধ খেয়েছি বলে।” মহাভারতের দ্রোণাচার্য্য কুরু রাজপুত্রদের শস্ত্রগুরু হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। নিজের শিশুপুত্রকে দুধ কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তাঁর।

সোমশংকর এবং সুষমার এনগেজমেন্ট পার্টিতে বাঁশরির সঙ্গে ক্ষিতীশের কথা হচ্ছে। ক্ষিতীশ বলছে—”দুজন মানুষের ঠিকানা পাওয়া গেল।…তিন সংখ্যাটা নারদ, পাকিয়ে তোলে জটা, ঘটিয়ে তোলে তাপজনক নাট্য।”—নারদ পরম জ্ঞানী এবং নারায়ণের একনিষ্ঠ ভক্ত। কিন্তু সাধারণ্যে তাঁর একটু বদনাম আছে, তিনি কলহপ্রিয় এবং লোকের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে মজা দেখতে তিনি নাকি ভারি ভালোবাসেন।

বাঁশরীর বান্ধবী-বন্ধুরা তার অসাক্ষাতে তাকে নিয়ে আলোচনা করছে। লীলা বলছে— ”যা বলিস ভাই শৈল, বাঁশি কোথা থেকে কথা আনে জুটিয়ে, ভগীরথের গঙ্গার মতো, হাঁপ ধরিয়ে দিতে পারে ঐরাবত হাতিটিকে পর্য্যন্ত।”—ভগীরথ, ঐরাবত কাহিনী আগে আলোচনা করা হয়েছে।

ঐ পার্টিতে সাহিত্যিক ক্ষিতীশের সঙ্গে কথা বলছে অর্চনা ক্ষিতীশের লেখা একটা বই নিয়ে। ”ঐ যে মেয়েটা কি তার নাম— কথায় কথায় হাঁপিয়ে উঠে বলে, মাই আইজ, ও গড লাজুক ছেলে স্যাণ্ডেলের সংকোচ ভাঙবার জন্যে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইচ্ছে করে গাড়িটা ফেললে খাদে, মতলব ছিল স্যাণ্ডেলকে দুই হাতে তুলে পতিতোদ্ধার করবে। হবি তো হ স্যাণ্ডেলের হাতে হল কম্পাউণ্ড-ফ্রাকচার। কী ড্রামাটিক, রিয়ালিজমের চূড়ান্ত। ভালোবাসার এতবড়ো আধুনিক পদ্ধতি বেদব্যাসের জানা ছিল না। ভেবে দেখুন, সুভদ্রার কত বড়ো চান্স মারা গেল, আর অর্জুনেরও কব্জি গেল বেঁচে।”—বেদব্যাস, অর্জুন, সুভদ্রা মহাভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত। এঁদেরকে নতুন করে পরিচয় করানোর কোন প্রয়োজন নেই।

সুষমা এবং সোমশংকরের বিবাহের হোতা হচ্ছেন সন্ন্যাসী পুরন্দর। তিনি সোমশংকর ও সুষমাকে বলছেন— ”তোমাদের মিলনের শেষ কথাটা ঘরের দেয়ালের মধ্যে নয়, বাইরে, বড়ো বাস্তার সামনে। সুষমা বৎসে, যে সম্বন্ধ মুক্তির দিকে নিয়ে চলে তাকেই শ্রদ্ধা করি। যা বেঁধে রাখে পশুর মতো প্রকৃতির গড়া প্রবৃত্তির বন্ধনে বা মানুষের-গড়া দাসত্বের শৃঙ্খলে ধিক তাকে। পুরুষ কর্ম করে, স্ত্রী শক্তি দেয়। মুক্তির রথ কর্ম, মুক্তির বাহন শক্তি। সুষমা, ধনে তোমার লোভ নেই, তাই ধনে তোমার অধিকার। তুমি সন্ন্যাসীর শিষ্যা, তাই রাজার গৃহিনী পদে তোমার পূর্ণতা। (ডান হাতে সোমশংকরের ডান হাত ধরে)

 তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশোলভস্ব

 জিত্বা শত্রুন ভুঙ্ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম।

ওঠো তুমি যশোলাভ করো। শত্রুদের জয় করো— যে রাজ্য অসীম সমৃদ্ধিবান তাকে ভোগ করো। বৎস, আমার সঙ্গে আবৃত্তি করো প্রণামের মন্ত্র।

 নমঃ পুরস্তাদ অথ পৃষ্ঠতস্তে

 নমোস্তুতে সর্বত এব সর্ব।

 অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্ত্বং

 সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ।।

তোমাকে নমস্কার সম্মুখ থেকে, তোমাকে নমস্কার পশ্চাৎ থেকে, হে সর্ব, তোমাকে নমস্কার সর্বদিক থেকে। অনন্তবীর্য তুমি, অমিতবিক্রম তুমি, তোমাতেই সর্ব, তুমিই সর্ব।”

উপরে উল্লিখিত সংস্কৃত উদ্ধৃতি দুটোই শ্রীশ্রীগীতার থেকে নেওয়া— একাদশ অধ্যায়, বিশ্বরূপদর্শনযোগঃ। প্রথম উদ্ধৃতিটি ৩৩ সংখ্যক শ্লোকের অর্ধাংশ। শ্লোকের অপর অর্ধাংশ হচ্ছে—

 ‘ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব

 নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন।।’

দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি ৪০ সংখ্যক শ্লোক।

সুষমা পুরন্দরকে বলছে— ”প্রভু দুর্বল আমি। মনের গোপনে যদি পাপ থাকে ধুয়ে দাও, মুছে দাও। আসক্তি দূর হোক, জয়যুক্ত হোক তোমার বাণী।

পুরন্দর বলছেন— ‘বৎসে, নিজেকে নিন্দা করো না, অবিশ্বাস করো না, ‘নাত্মানমবসাদয়েৎ।’ —এই সংস্কৃত কথাটি গীতার শ্লোকের একটুখানি অংশ গীতার ষষ্ঠ অধ্যায় (ধ্যানযোগঃ) ৫ সংখ্যক শ্লোক নিম্নরূপ—

 ”উদ্ধারেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।

 আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুবাত্মনঃ।।”

(নিজের বুদ্ধি দ্বারা নিজেকে উদ্ধার করিবে, আত্মাকে কখনও অধঃপাতিত করিও না। ক্ষেত্র বিশেষে মনই আত্মার বন্ধু, আবার কখনও বা মন আত্মার শত্রু।)

বাঁশরি ক্ষিতীশকে লেখাসম্বন্ধে, উপদেশ দিচ্ছে। ”ভবিতব্যের চেহারাটা জোর কলমে দেখিয়ে দাও। বড়ো নিষ্ঠুর। সীতা ভাবলেন, দেবচরিত্র রামচন্দ্র উদ্ধার করবেন রাবণের হাত থেকে; শেষকালে মানব প্রকৃতি রামচন্দ্র চাইলেন তাঁকে আগুনে পোড়াতে। একেই বলে রিয়ালিজম, নোঙরামিকে নয়।”

‘প্রহাসিনী’ কাব্যগ্রন্থের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটি কবি এই নাটকের মধ্যেও লাগিয়ে দিয়েছেন। (সুলভ ১২শ খণ্ড; পৃ-২৮৫)। সেখানেও প্রজাপতি দক্ষের কথা আছে।

গল্পগুচ্ছ : সুলভ সংস্করণের এই খণ্ডে গল্পগুচ্ছের ১৫টি গল্প স্থান পেয়েছে। তার অনেকগুলোতেই রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে। ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পে মনোহরলাল একজন জমিদার এবং বিষয়রক্ষার ব্যাপারে তিনি তাঁর কর্মচারী নীলকণ্ঠের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করতেন। মনোহরলালের পুত্র বনোয়ারী নীলকণ্ঠকে পছন্দ করে না। মনোহরলালেরও ধারণা নীলকণ্ঠ সুযোগ পেলে চুরি করে। এতে অবশ্য মনোহর কিছু মনে করেন না, কারণ তিনি জানেন— ”ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়া তো জমিদারির কাজ চলে না।”

‘হৈমন্তী’ গল্পের কথক হৈমন্তীর স্বামী। হৈমন্তী তার ঋষিকল্প পিতার কাছে পশ্চিমে থাকতো। পিতার চরিত্রের সদগুণসমূহ তার মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের যে প্রচলিত বয়স সে সেটা পেরিয়ে গিয়েছিল। তার বিবাহ হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে। হৈমন্তীর পিতা অত্যন্ত ধনী মানুষ হবেন এরকমই অনুমান করে পাত্রপক্ষ বেশী বয়সের মেয়েকে ঘরে এনেছিল। কিন্তু বিবাহের পর যখন জানা গেল যে হৈমন্তীর পিতা মোটেই ধনী মানুষ নন, তখন শ্বশুরবাড়ীতে হৈমন্তীর লাঞ্ছনা বেড়েছিল। সে অসুস্থা হলে তার চিকিৎসা করানো হল না এবং সে মারা গেল। হৈমন্তীর স্বামীও কিছুই করলো না। তার মধ্যে হয়তো একটু অনুশোচনা হয়েছিল পরে। সে বলছে— ”বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা করিলাম না কেন। স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত। গেলাম না কেন? কেন! যদি লোকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কি করিতে আছে। জান তোমরা? যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবী করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম। আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন। আর, আমিই তো সেদিন লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রীপরিত্যাগের গুণবর্ণনা করিয়া মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি। বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতাবিসর্জনের কাহিনী লিখিতে হইবে, সে কথা কে জানিত।”

‘বোষ্টমী’ গল্পে কবি একজায়গায় ‘গীতা’র উল্লেখ করেছেন। ”আমি গীতা পড়িয়া থাকি এবং বিদ্বান লোকদের দ্বারস্থ হইয়া তাহাদের কাছে ধর্মতত্ত্বের অনেক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা শুনিয়াছি। কেবল শুনিয়া শুনিয়াই বয়স বহিয়া যাইবার জো হইল, কোথাও তো কিছু প্রত্যক্ষ দেখিলাম না।”

‘অপরিচিতা’ গল্পের কথক বিবাহার্থী যুবক, মাতুল তার অভিভাবক। বিবাহ শুরু হওয়ার পূর্বে মাতুল কন্যার পিতা কন্যাকে যে সমস্ত গহনা দেবেন, সেগুলো স্যাকরা দিয়ে যাচাই করার দাবী করেছিলেন। কন্যার পিতা কন্যাকে অনেক বেশি গহনা দিতেই প্রস্তুত ছিলেন তবুও সেগুলো যখন যাচাই করার কথা উঠলো, তিনি আর সে অপমান সহ্য করলেন না, বিয়ে ভেঙে দিলেন। এই ঘটনাতে যুবকটির মনের মধ্যে দু’রকমের প্রতিক্রিয়া হলো। তার মন কখনো কখনো কন্যার পিতার এই ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে চাইতো; কিন্তু আবার কখনো ”যে ধারাটি চোখের জলের মতো শুভ্র সে রাজহংসের রূপ ধরিয়া বলিল, যেমন করিয়া আমি একদিন দময়ন্তীর পুষ্পবনে গিয়েছিলাম তেমনি করিয়া আমাকে একবার উড়িয়া যাইতে দাও আমি বিরহিণীর কানে কানে একবার সুখের খবরটা দিয়ে আসি গে।”—রাজহংস এবং দময়ন্তীর বৃত্তান্ত পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

‘তপস্বিনী’ গল্পে মাখনবাবু পুত্র বরদার বিবাহ দিয়াছেন কিন্তু বলেছেন যে যতদিন বরদা বি.এ. পাশ না করবে ততদিন সে বধূর কাছে ঘেঁষতে পারবে না। লেখা পড়াটা আবার বরদার তেমন আসে না। ”বি.এ. পাশ না করিয়াও বরদা জন্মিয়াছে, বি.এ. পাশ না করিলেও সে মরিবে, অথচ জন্মমৃত্যুর মাঝখানটাতে কোথাকার এই বি.এ. পাশ বিন্ধ্যপর্বতের মতো খাড়া হইয়া দাঁড়াইল;…কলিকালে অগস্ত্য মুনি করিতেছেন কী। তিনিও কি জটা মুড়াইয়া বি.এ. পাশে লাগিয়াছেন।”

আর এদিকে বধূ ষোড়শী ”প্রতিদিন ভোর চারটের সময় উঠিয়া স্নান সারিয়া … ঠাকুরঘরে গিয়া বসে। আহ্নিক করিতে বেলা হইয়া যায়। তার পরে বিদ্যারত্নমশায় আসেন; সেই ঘরে বসিয়াই তাঁর কাছে সে গীতা পড়ে।”

বি.এ. পাশ করা তার পক্ষে অসম্ভব মনে করে বরদা গৃহত্যাগ করেছে, সে সন্ন্যাসী হবে। ষোড়শী পড়াশোনা করে সময় কাটায়, তবে কখনো কখনো তার মন উদাস হয়ে যায়। ”এক-একদিন তার সমস্ত মন যেন অতিচেতন হইয়া ওঠে, রৌদ্রে নারিকেলের পাতাগুলো ঝিলমিল করে, সে যেন তার বুকের মধ্যে কথা কহিতে থাকে। পণ্ডিতমশায় গীতা পড়িয়া ব্যাখ্যা করিতেছেন, সেটা ব্যর্থ হইয়া যায়;”

‘পয়লা নম্বর’ গল্পের একজায়গায় কবি লিখেছেন— ”পুরাণের বাসুকী যে পৌরাণিক পৃথিবীকে ধরে আছে যে পৃথিবী স্থির, কিন্তু সংসারে যে মেয়েকে বেদনার পৃথিবী বহন করতে হয় তার সে পৃথিবী মুহূর্তে মুহূর্তে নূতন নূতন আঘাতে তৈরী হয়ে উঠছে।”—বাসুকীর কথা মহাভারতে আছে। কাশীরামদাসের মহাভারতে দেখা যাচ্ছে যে রাজসূয় যজ্ঞের প্রাক্কালে অর্জুন বাসুকীকে নিমন্ত্রণ করার জন্য পাতালপুরীতে গিয়েছিলেন।

এই গল্পেরই অন্যত্র কথা প্রসঙ্গে মহাভারতের কর্ণের নাম উল্লিখিত হয়েছে। ”কর্ণ যেমন একটি সহজ কবচ গায়ে দিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন আমারও তেমনি একটি বিধিদত্ত সহজ কবচ ছিল। সেটি হচ্ছে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা।”—পাণ্ডবজননী কুন্তীর কানীনপুত্র হচ্ছেন কর্ণ। কবচ-কুণ্ডল তাঁর সহজাত এবং এগুলো তাঁর শরীরকে যুদ্ধে দুর্ভেদ্য করেছিল। কর্ণর দানশীলতার খ্যাতি ছিল প্রবাদপ্রতিম। দেবরাজ ইন্দ্র এই সুযোগ গ্রহণ করেন এবং পুত্র অর্জুনের হিতার্থে ব্রাহ্মণবেশে কর্ণর কাছ থেকে এই কবচ-কুণ্ডল চেয়ে নেন।

গল্পটির আর-এক জায়গায় রামায়ণের রাবণ রাজার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ”নিজের কুড়িটা নাসারন্ধ্রে নাক ডাকবার সময় রাবণের হয়তো ঘুমের ব্যাঘাত হতো না, কিন্তু তার প্রতিবেশীর কথাটা চিন্তা করে দেখো।”

‘নামঞ্জুর গল্প’র নায়ক এবং কথক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক কারণে জেল খেটেছিলেন। তাঁর কারাবাসের মধ্যেই মায়ের মৃত্যু ঘটেছিল। বাবা যেহেতু ছিলেন সরকারী উকিল, তাই তিনি পুত্রের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী করে নিয়েছিলেন। যাঁকে পিসিমা বলা হয়েছে তিনি নায়কের নিকট সম্পর্কের কেউ নন, যদিও তিনি অত্যন্ত স্নেহশীলা। তিনি থাকতেন পশ্চিমে কিন্তু গল্পের নায়কের স্নেহের টানে তিনি চলে এলেন কলকাতায়। ”পিসিমা তাঁর এতকালের পশ্চিমের ঘর-সংসার তুলে দিয়ে আমার সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন। আমি হেসে বললেম— তোমার স্নেহগঙ্গার ধারাকে পশ্চিম থেকে পূর্বে বহন করে এনেছি, আমি কলির ভগীরথ।”

এই গল্পের নায়ক মজা করে বলছেন যে তিনি যদি বিয়ে করতেন তবে শ্বশুরের কাছ থেকে পণ হিসাবে বিশ—পঁচিশ হাজার টাকা আদায় করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেন নি। ”আমার ভাবী চরিতলেখক এ কথা যেন স্মরণ রাখেন যে, স্বদেশসেবার সংকল্পের কাছে এককালীন আমার এই বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার ত্যাগ।…পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে আমার মহৎ চরিত্রের এইখানে মিল আছে।”—ভীষ্ম মহাভারতের চরিত্র। তাঁর ত্যাগ জগৎবিখ্যাত। পিতার সুখের জন্য সিংহাসনের অধিকার ত্যাগ এবং বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞা তিনি করেছিলেন।

পিসিমার স্নেহের কল্যাণহস্ত জেলখানায় পৌঁছাতে পারে না। দ্বিতীয়বার জেলে গিয়ে গল্পকথক সেটা টের পেলেন। ”মনে মনে কেবলই গীতা আওড়াতে লাগলেম, ‘নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন’। হায় রে তপস্বী, কখন যে পিসিমার নানা গুণ নানা উপকরণ-সংযোগে হৃদয়দেশ পেরিয়ে একেবারে পাকযন্ত্রে প্রবেশ করেছে, তা জানতেও পারিনি। জেলখানায় এসে সেই জায়গাটাতে বিপাক ঘটতে লাগল।”

উপরে যে সংস্কৃত শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো শ্রীশ্রীগীতার একটা শ্লোকের অংশবিশেষ। (দ্বিতীয় অধ্যায়—সাংখ্যযোগঃ, ৪৫ সংখ্যক মন্ত্র বা শ্লোক)। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল—

 ”ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন।

 নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান।।”

(শ্রীভগবান অর্জুনকে বলছেন যে কর্মকাণ্ড ও বেদের ক্রিয়াসকল ত্রিগুণাত্মক। অর্জুন সকল প্রকার কর্মফলের আশা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বসম্পন্ন হোন; সুখ ও দুঃখ যেন তাঁকে বিচলিত না করে। বস্তুসমূহের প্রাপ্তি ও রক্ষার চিন্তা ত্যাগ করে তাঁকে আত্মবান হতে হবে।)

পিসিমার পালিতা কন্যা অমিয়া বিভিন্ন কাজে ও অকাজে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ”আমি যে তার এতবড়ো জেল খাটা দাদা-উল্লাসকর, কানাই, বারীন, উপেন্দ্র প্রভৃতির সঙ্গে এক জ্যোতিষ্কমণ্ডলীতে যার স্থান, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পার হয়ে তার যে-দাদা গীতার শেষ দিকের অধ্যায়ের মুখে অগ্রসর হয়েছে, তাকেও যথোচিত পরিমাণে দেখবার সে সময় পায় না।”

গল্পকথক অসুস্থ হয়ে আছেন। তাঁকে দেখাশোনা করার লোকজন সবসময় থাকে না। পিসিমা তীর্থে গেছেন। এই অবস্থায় গীতা ভরসা। ”জীবলোকের উপর সব দাবি একেবারে পরিত্যাগ করব মনে করে গীতা খুলে বসলেম। প্রায় যখন স্থিতধী অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, মনটা রোগ-অরোগ্যের দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে গেছে, এমন সময় অনুভব করলেম, কে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলে। গীতা থেকে চোখ নামিয়ে দেখি, পিসিমার পোষ্যমণ্ডলীভুক্ত একটি মেয়ে।”

যে এসেছিল তার নাম হরিমতি। অমিয়া তাকে পছন্দ করে না। হরিমতি যে অসুস্থ মানুষটির একটু সেবা করবে, সেটাও অমিয়া allow করবে না। ”পরদিন দুপুরবেলায় আমার জলধর যখন দিবানিদ্রায় রত, দেউড়িতে দরোয়ানজি তুলসীদাসের রামায়ণ পড়ছে, …এমন সময় দরজার বাইরে নির্জন বারান্দায় একটি ভীরু ছায়া দেখা দিলে।” এই ভীরু ছায়া হরিমতির। সেদিনও অমিয়া এসে তাকে হঠিয়ে দিল। ”আমার ক্ষাত্রস্বভাব, মাঝে মাঝে ভুলে যাই ‘অক্রোধেন জয়েৎ ক্রোধম’। ফল হল এই যে অমিয়া পিসিমারই সদস্যদের মধ্য থেকে আর-একটি মেয়েকে এনে হাজির করলে— তার নাম প্রসন্ন।”

উপরে উল্লিখিত সংস্কৃত শব্দ তিনটি মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের একটি শ্লোকের অংশ। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল—

 ”অক্রোধেন জয়েৎ ক্রোধমসাধুং সাধুনা জয়েৎ।

 জয়েৎ কদর্যং দানেন জয়েৎ সত্যেন চানৃতম্।।’

(৩৯ অধ্যায়ের ৭২ সংখ্যক শ্লোক)

হরিমতি চলে গেল। প্রসন্নর রোগীসেবা রোগীর কাছে প্রায় যন্ত্রণার মতো। ”আবার আমাকে গীতা খুলতে হল। তবুও শ্লোকের ফাঁকে ফাঁকে দরজার ফাঁকের দিকে চেয়ে দেখি— কিন্তু সেই একটুখানি ছায়া আর কোথাও দেখা গেল না।”

‘সংস্কার’ গল্পে কবি একজায়গা লিখেছেন—”তখনকার পুলিশ কারও বাড়ীতে গীতা দেখলেই সিডিশনের প্রমাণ পেত।”

‘চোরাই ধন’ গল্পে গল্পকথকের স্ত্রী সুনেত্রা ও কন্যা অরুণা। অরুণার পছন্দের মানুষ শৈলেন। সুনেত্রার এই সম্পর্ক অপছন্দ কারণ তার মতে শৈলেন আর অরুণার ঠিকুজিতে মিল হবে না। বহুবছর আগে গল্পকথকের সঙ্গে সুনেত্রার বিয়েটা আটকে যেতে পারতো ঠিকুজির গরমিলে কিন্তু সেটা কায়দা করে Manage করা হয়েছিল। গল্পকথক তাই অরুণা-শৈলেনকে কিছুটা প্রশ্রয় দেন। সুনেত্রাকে তিনি বললেন সাবিত্রী সত্যবানের কথা—”সাবিত্রীর কাছে সত্যবানের সঙ্গে একদিনের মিলনও যে চিরবিচ্ছেদের চেয়ে বড়ো ছিল, তিনি তো ভয় করেন নি মৃত্যুগ্রহকে।”—বিবাহের পূর্বেই সাবিত্রী জানতে পেরেছিলেন যে সত্যবানের আয়ু মাত্র একবৎসর, তবুও তিনি সত্যবানকে বিবাহ করেছিলেন।

সাহিত্যের পথে : এই গ্রন্থখানি অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসর্গপত্রে একজায়গায় তিনি লিখেছেন— ”মানুষ শিশুকাল থেকেই নানা ভাবে আপন উপলব্ধির ক্ষুধায় ক্ষুধিত; রূপকথার উদ্ভব তারই থেকে। কল্পনার জগতে চায় সে হতে নানাখানা; রামও হয়, হনুমানও হয়, ঠিকমতো হতে পারলেই খুশী।”

এই গ্রন্থের ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে কবি সাহিত্যে রস জিনিষটা ব্যাখ্যা করেছেন। ”রস জিনিসটা রসিকের অপেক্ষা রাখে, …সংসারে বিদ্বান, বুদ্ধিমান, দেশহিতৈষী, লোকহিতৈষী প্রভৃতি নানা প্রকারের ভালো ভালো লোক আছেন, কিন্তু দময়ন্তী যেমন সকল দেবতাকে ছাড়িয়া নলের গলায় মালা দিয়াছিলেন, তেমনি রসভারতী স্বয়ম্বরসভায় আর সকলকেই বাদ দিয়া কেবল রসিকের সন্ধান করিয়া থাকেন।” ”রসের মধ্যে একটা নিত্যতা আছে। মান্ধাতার আমলে মানুষ যে রসটি উপভোগ করিয়াছে আজও তাহা বাতিল হয় নাই।”—মান্ধাতা রামায়ণের চরিত্র। ‘মান্ধাতার আমল’ কথাটির অর্থ হল অতি প্রাচীনকাল।

সাহিত্য ও লোকশিক্ষার কথা বলতে গিয়ে কবি রামায়ণ মহাভারতের কথা এনেছেন। ”লোক যদি সাহিত্য হইতে শিক্ষা পাইতে চেষ্টা করে তবে পাইতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য লোককে শিক্ষা দিবার জন্য কোনো চিন্তাই করে না। কোনো দেশেই সাহিত্য ইস্কুল-মাষ্টারির ভার লয় নাই। রামায়ণ-মহাভারত দেশের লোকে পড়ে তাহার কারণ এ নয় যে, তাহা কৃষাণের ভাষায় লেখা বা তাহাতে দুঃখী-কাঙালের ঘরকরনার কথা বর্ণিত। তাহাতে বড়ো বড়ো রাজা, বড়ো বড়ো রাক্ষস, বড়ো বড়ো বীর এবং বড়ো বড়ো বানরের বড়ো বড়ো লেজের কথাই আছে। আগাগোড়া সমস্তই অসাধারণ। সাধারণ লোক আপনার গরজে এই সাহিত্যকে পড়িতে শিখিয়াছে।”

‘কবির কৈফিয়ৎ’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন— ”আমরা যে ব্যাপারটাকে বলি জীবলীলা পশ্চিম সমুদ্রের ওপারে তাকেই বলে জীবনসংগ্রাম। ইহাতে ক্ষতি ছিল না। একটা জিনিষকে আমি যদি বলি নৌকা-চালানো আর তুমি যদি বল দাঁড় টানা, একটি কাব্যকে আমি যদি বলি রামায়ণ আর তুমি যদি বল রাম-রাবণের লড়াই, তাহা লইয়া আদালত করিবার দরকার ছিল না।”

এই প্রবন্ধে কবি ভগবান শিবের বিষপানের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন— ”গুণী যেখানে গুণী সেখানে তার কাজ যতই কঠিন হোক, সেখানেই তার আনন্দ; মা যেখানে মা সেখানে তার ঝঞ্ঝাট যত বেশীই হোক-না, সেখানেই তার আনন্দ। …যথার্থ আনন্দই সমস্ত দুঃখকে শিবের বিষপানের মতো অনায়াসে আত্মসাৎ করিতে পারে।”—শিবের বিষপানের কাহিনী মহাভারতে আছে। সমুদ্রমন্থনে তীব্র হলাহল উৎপন্ন হয়েছিল। তখন সৃষ্টি রক্ষা করবার জন্য শিব সেই তীব্র বিষ পান করে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন।

মানুষ যখন সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে অসাধারণত্বে উন্নীত হয়।

 ‘সৃষ্টি’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন ”সেই সত্যে যদি তিলমাত্র ব্যত্যয় ঘটে, অথচ নায়ক নায়িকা দোঁহে মিলে যদি দশাবতারের সুনিপুণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা গীতার শ্লোক থেকে দেশাত্মবোধের আশ্চর্য অর্থ উদঘাটন করতে পারে, তবু তাদের কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

ইন্দ্র হচ্ছেন স্বর্গের রাজা। তাঁর আর একটা নাম হল শতক্রতু। অর্থাৎ তিনি একশোটা যজ্ঞ করেছেন। তবুও ইন্দ্রের সবসময় একটা ভয়— কেউ বুঝি তাঁকে স্বর্গের সিংহাসন থেকে হঠিয়ে দিল। তাই যদি কেউ কোনো কঠিন যজ্ঞ করে বা কঠোর তপস্যা করে ইন্দ্র সেই যজ্ঞ পণ্ড করতে চান, তপস্যা ভঙ্গ করতে চান। তপস্যা ভঙ্গ করানোর জন্য ইন্দ্রের প্রধান অস্ত্র স্বর্গের অতি সুন্দরী অপ্সরারা। উর্ব্বশী, মেনকা, রম্ভা প্রভৃতি। ইন্দ্রের নিয়োগানুসারে এই অপ্সরীরা তপস্বীর কাছে গিয়ে ছলা-কলায় তাকে মোহিত করেন এবং বহুক্ষেত্রেই তপস্বী তাঁর তপস্যা থেকে ভ্রষ্ট হন। ইন্দ্র এবং অপ্সরাদের সম্বন্ধে এটাই হচ্ছে সাধারণ ধারণা এবং এইরকম অনেক উদাহরণ রামায়ণ-মহাভারতে আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি প্রবন্ধে এই বিষয়ে অন্য একটি মত উপস্থিত করেছেন। ”ধর্মশাস্ত্রে বলে, ইন্দ্রদেব কঠোর সাধনার ফল নষ্ট করবার জন্যেই মধুরকে পাঠিয়ে দেন। আমি দেবতার এই ঈর্ষা, এই প্রবঞ্চনা বিশ্বাস করি নে। সিদ্ধির পরিপূর্ণ অখণ্ড মূর্তিটি যে কিরকম তাই দেখিয়ে দেবার জন্যেই ইন্দ্র মধুরকে পাঠিয়ে দেন। বলেন, এ জিনিষ লড়াই করে তৈরী করে তোলবার জিনিষ নয়; এ ক্রমে ক্রমে থাকে থাকে গড়ে ওঠে না। সত্য সুরে গানটিকে যদি সম্পূর্ণ করে তুলতে চাও, তা হলে রাতদিন বাঁও-কষাকষি করে তা হবে না। তম্বুরার এই খাঁটি মধ্যম-পঞ্চম সুরটিকে প্রত্যক্ষ গ্রহণ করো এবং অখণ্ড সম্পূর্ণতাটিকে অন্তরে লাভ করো, তা হলে সমগ্র গানের ঐক্যটি সত্য হবে। মেনকা উর্বশী এরা হল ঐ তম্বুরার মধ্যম-পঞ্চম সুর-পরিপূর্ণতার অখণ্ড প্রতিমা। সন্ন্যাসীকে মনে করিয়ে দেয় সিদ্ধির ফল জিনিষটা কী রকমের। স্বর্গকামী, তুমি স্বর্গ চাও! তাই তোমার তপস্যা! কিন্তু স্বর্গ তো পরিশ্রম করে মিস্ত্রি দিয়ে তৈরী হয় নি। স্বর্গ যে সৃষ্টি। উর্বশীর ওষ্ঠপ্রান্তে যে হাসিটুকু লেগে আছে তার দিকে চেয়ে দেখো, স্বর্গের সহজ সুরটুকুর স্বাদ পাবে। তুমি মুক্তিকামী, মুক্তি চাও! একটু একটু ক’রে অস্তিত্বের জাল ছিঁড়ে ফেলাকে তো মুক্তি বলে না। মুক্তি তো বন্ধনহীন শূন্যতা নয়। মুক্তি যে সৃষ্টি। মেনকার কবরীতে যে পারিজাত ফুলটি রয়েছে তার দিকে চেয়ে দেখো, মুক্তির পূর্ণরূপের মূর্তিটি দেখতে পাবে।”

‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”ইংরেজীতে যাকে real বলে, বাংলায় তাকে বলি যথার্থ, অথবা সার্থক। সাধারণ সত্য হল এক, আর সার্থক সত্য হল আর। সাধারণ সত্য একেবারে বাছ-বিচার নেই, সার্থক সত্য আমাদের বাছাই করা। মানুষ মাত্রেই সাধারণ সত্যের কোঠায়, কিন্তু যথার্থ মানুষ ‘লাখে না মিলল এক’। করুণার আবেগে বাল্মীকির মুখে যখন ছন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল তখন সেই ছন্দকে ধন্য করবার জন্যে নারদ ঋষির কাছ থেকে তিনি একজন যথার্থ মানুষের সন্ধান করেছিলেন। (ভাষা ও ছন্দ কবিতা দ্রষ্টব্য)। কেননা, ছন্দ অলংকার।”

বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের বিরোধ আছে। সাহিত্যধর্ম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”বংশরক্ষাঘটিত পশুধর্ম মানুষের মনস্তত্ত্বে ব্যাপক ও গভীর, বৈজ্ঞানিক এমন কথা বলেন। কিন্তু, সে হল বিজ্ঞানের কথা; মানুষের জ্ঞানে ও ব্যবহারে এর মূল্য আছে। কিন্তু, রসবোধ নিয়ে যে সাহিত্য ও কলা সেখানে এই সিদ্ধান্ত স্থান পায় না। অশোক বনে সীতার দুরারোগ্য ম্যালেরিয়া হওয়া উচিত ছিল, এ কথাও বিজ্ঞানের; সংসারে এ কথার জোর আছে, কিন্তু কাব্যে নেই।”

এই গ্রন্থে ‘সাহিত্যবিচার’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। গ্রন্থ পরিচয় অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রবন্ধটি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে রবীন্দ্র পরিষৎ-সভায় প্রদত্ত মৌখিক ভাষণের কবির স্বকৃত স্মৃতিলিখন। বক্তৃতার পরে কবির ভাষণ হিসাবে প্রবাসী পত্রিকায় যেটা বেরিয়েছিল তার কিছু কিছু অংশ লিখিত প্রবন্ধে বাদ গেছে। গ্রন্থপরিচয়ে এই বাদ যাওয়া অংশগুলো প্রবাসী পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে। সেখানে বাল্মীকি ও রামচন্দ্রকে নিয়ে কিছু কথা আছে। নীচের উদ্ধৃতিটুকু লক্ষ্য করুন—

”উৎসাহী হোমিওপ্যাথ বাল্মীকিকে প্রশ্ন করে যে, বনবাসকালে নিঃসন্দেহে মাঝে মাঝে রামচন্দ্রের ম্যালেরিয়া হয়েছে, তখন তিনি নিজের কিরকম চিকিৎসা করতেন। বাল্মীকি তাঁর জটাশ্মশ্রু নিয়ে চুপ করে থাকেন, কোনো উত্তর দেন না। ঐতিহাসিক রামচরিতে রামচন্দ্রের সমর্থিত চিকিৎসাপদ্ধতি মূল্যবান তথ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু সাহিত্যিক রামচরিতে ওকে স্থান দেওয়া অসম্ভব। এমনতরো বহু সহস্র অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই রামায়ণ সম্ভবপর হয়েছে, তথাপি সেটা সপ্ত কাণ্ডর কম হল না।”

এই গ্রন্থের অন্তর্গত ‘সাহিত্য বিচার’ প্রবন্ধের অন্য জায়গায় কবি বলেছেন— ”জাতি নির্ণয় বিজ্ঞানে, জাতির বিবরণ ইতিহাসে, কিন্তু সাহিত্যে জাতিবিচার নেই, সেখানে আর সমস্তই ভুলে ব্যক্তির প্রাধান্য স্বীকার করে নিতে হবে। …ব্যক্তির প্রতি … সমাজে অবিচার ঘটে, …কিন্তু সাহিত্যে জগন্নাথের ক্ষেত্র; এখানে জাতির খাতিরে ব্যক্তির অপমান চলবে না। এমন-কি, এখানে বর্ণসংকর দোষও দোষ নয়; মহাভারতের মতোই উদারতা। কৃষ্ণদ্বৈপায়নের জন্ম-ইতিহাস নিয়ে এখানে কেউ তাঁর সম্মান অপহরণ করে না; তিনি তাঁর নিজের মহিমাতেই মহীয়ান।” (ব্যাসদেবের মাতা ধীবর কন্যা, পিতা ব্রাহ্মণ; কিন্তু ব্যাসদেব ঋষিশ্রেষ্ঠ)।

‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে আধুনিক দুঃশাসন জনসভায় বিশ্বদ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে লেগেছে; ও দৃশ্যটা আমাদের অভ্যস্ত নয়।”—সমগ্র মহাভারতে দুর্যোধনের অধীনস্থ কৌরবেরা যে সর্বাপেক্ষা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে প্রকাশ্য রাজসভায় কুলবধূ এবং ক্ষণপূর্বের ভারতসম্রাজ্ঞী দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। এই ঘটনার প্রধান তিন চক্রী হলেন দুর্যোধন, দুঃশাসন ও কর্ণ।

‘সাহিত্যতত্ব’ প্রবন্ধের এক জায়গায় কবি ‘দুঃখ’, ‘ট্রাজেডি’—এইসব নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার মধ্যে রামায়ণের কথা এসেছে। ”দুঃখের অভিজ্ঞতায় আমাদের চেতনা আলোড়িত হয়ে ওঠে। দুঃখের কটুস্বাদে দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকলেও তা উপাদেয়। দুঃখের অনুভূতি সহজ আরামবোধের চেয়ে প্রবলতর। কৈকেয়ীর প্ররোচনায় রামচন্দ্রের নির্বাসন, মন্থরার উল্লাস, দশরথের মৃত্যু, এর মধ্যে ভালো কিছুই নেই। সহজ ভাষায় যাকে আমরা সুন্দর বলি এ ঘটনা তার সমশ্রেণীর নয়, এ কথা মানতেই হবে। তবু এই ঘটনা নিয়ে কত কাব্য নাটক ছবি গান পাঁচালি বহুকাল থেকে চলে আসছে; ভিড় জমছে কত; আনন্দ পাচ্ছে সবাই।”

ঐ একই প্রবন্ধে কবি সাহিত্যে চরিত্রসৃষ্টির বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার মধ্যে তিনি রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের উল্লেখ করেছেন। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন— ”সন্তানস্নেহে কর্তব্যবিস্মৃত মানুষ অনেক দেখা যায়, মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র আছেন সেই অতি সাধারণ বিশেষণ নিয়ে। কিন্তু রাজ্যাধিকারবঞ্চিত এই অন্ধ রাজা কবি লেখনীর নানা সূক্ষ্মস্পর্শে দেখা দিয়েছেন সম্পূর্ণ একক হয়ে। মোটা গুণটা নিয়ে তাঁর সমজাতীয় লোক অনেক আছে, কিন্তু জগতে ধৃতরাষ্ট্র অদ্বিতীয়; এই মানুষের একান্ততা তাঁর বিশেষ ব্যবহারে নয়, কোনো আংশিক পরিচয়ে নয়, সমগ্রভাবে। কবির সৃষ্টিমন্ত্রে প্রকাশিত এই তাঁর অনন্যসদৃশ স্বকীয় রূপ প্রতিভার কোন সহজ নৈপুণ্যে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে, ক্ষুদ্র সমালোচকের বিশ্লেষণী লেখনী তার অন্ত পাবে না।”

আরো কয়েকটি চরিত্রের কথা রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধেরই অন্যত্র বলেছেন। নীচের উদ্ধৃতিটি লক্ষ করুন।

”ক্লাসঘরের দেয়ালে মাধব আর-এক ছেলের নামে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে রেখেছে ‘রাখালটা বাঁদর’। খুবই রাগ হয়েছে। এই রাগের বিষয়ের তুলনায় অন্য-সকল ছেলেই তার কাছে অপেক্ষাকৃত অগোচর। অস্তিত্ব হিসাবে রাখাল যে কত বড়ো হয়েছে তা অক্ষরের ছাঁদ দেখলেই বোঝা যাবে। মাধব আপন স্বল্প শক্তি-অনুসারে আপন রাগের অনুভূতিকে আপনার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেইটে দিয়ে দেয়ালের উপর এমন একটা কালো অক্ষরের রূপ সৃষ্টি করেছে যা খুব বড়ো করে জানাচ্ছে, মাধব রাগ করেছে; যা মাধব চাচ্ছে সমস্ত জগতের কাছে গোচর করতে। ঐটেকে একটা গীতিকবিতার বামন অবতার বলা যেতে পারে। মাধবের অন্তরে যে অপরিণত পঙ্গু কবি আছে, রাখালের সঙ্গে বানরের উপমার বেশি তার কলমে আর এগোল না। বেদব্যাস ঐ কথাটাই লিখেছিলেন মহাভারতের পাতায় শকুনির নামে। তার ভাষা স্বতন্ত্র, তা ছাড়া তার কয়লার অক্ষর মুছবে না যতই চুনকাম করা যাক। পুরাতত্ত্ববিদ নানা সাক্ষ্যের জোরে প্রমাণ করে দিতে পারেন, শকুনি নামে কোনো ব্যক্তি কোনো কালেই ছিল না। আমাদের বুদ্ধিও সে কথা মানবে, কিন্তু আমাদের প্রত্যক্ষ অনুভূতি সাক্ষ্য দেবে, সে নিশ্চিত আছে। ভাঁড়ুদত্তও বাঁদর বৈকি। কবিকঙ্কণ সেটা কালো অক্ষরে ঘোষণা করে দিয়েছেন। কিন্তু, এই বাঁদরগুলোর উপরে আমাদের যে অবজ্ঞার ভাব আসে সেই ভাবটাই উপভোগ্য।

আমাদের দেশে একপ্রকারের সাহিত্যবিচার দেখি যাতে নানা অবান্তর কারণ দেখিয়ে সাহিত্যের এই প্রত্যক্ষগোচরতার মূল্য লাঘব করা হয়। হয়তো কোনো মানবচরিত্রজ্ঞ বলেন, শকুনির মতো অমন অবিমিশ্র দুর্বৃত্ততা স্বাভাবিক নয়, ইয়াগোর অহৈতুক বিদ্বেষবুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মহদগুণ থাকা উচিত ছিল; বলেন, যেহেতু কৈকেয়ী বা লেডি ম্যাকবেথ, হিড়িম্বা বা শূর্পণখা, নারী, ‘মায়ের জাত’, এইজন্যে এদের চরিত্রে ঈর্ষা বা কদাশয়তার অতি নিবিড় কালিমা আরোপ করা অশ্রদ্ধেয়। সাহিত্যের তরফ থেকে বলবার কথা এই যে, এখানে আর কোনো তর্কই গ্রাহ্য নয়; কেবল এই জবাবটা পেলেই হল, যে-চরিত্রের অবতারণা হয়েছে তা সৃষ্টির কোঠায় উঠেছে, তা প্রত্যক্ষ।”

মূল মহাভারতে হিড়িম্বার চরিত্রে কদর্যতা বিন্দুমাত্রও নেই। তিনি সাধ্বী, মর্যাদাসম্পন্না। আমি তো তাঁকে এক শ্রদ্ধেয়া রমনী বলে মনে করি। কাশীরাম দাসের মহাভারতে অবশ্য দ্রৌপদীর সঙ্গে হিড়িম্বার ঝগড়ার বিবরণ আছে তবে সেখানে ঝগড়াটা শুরু করেছিলেন দ্রৌপদী।

‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ”নানা অবস্থার ঘাত প্রতিঘাতে বিশ্ব জুড়ে মানবলোকে হৃদয়াবেগের ঢেউখেলা চলছে।…মানবসংসারের বাস্তব ঘটনাবলীর সঙ্গে আমাদের মনের যে সম্পর্ক ঘটে সেটা সক্রিয়। দুঃশাসনের হাতে কৌরবসভায় দ্রৌপদীর যে অসম্মান ঘটেছিল তদনুরূপ ঘটনা যদি পাড়ায় ঘটে তা হলে তাকে আমরা মানবভাগ্যের বিরাট শোকাবহ লীলার অঙ্গরূপে বড়ো করে দেখতে পারি নে। নিত্য ঘটনাবলীর ক্ষুদ্র সীমায় বিচ্ছিন্ন একটা অন্যায় ব্যাপার ব’লেই তাকে জানি, সে একটা পুলিস-কেস রূপেই আমাদের চোখে পড়ে—ঘৃণার সঙ্গে ধিক্কারের সঙ্গে প্রাত্যহিক সংবাদ-আবর্জনার মধ্যে তাকে ঝেঁটিয়ে ফেলি। মহাভারতের খাণ্ডববন-দাহ বাস্তবতার একান্ত নৈকট্য থেকে বহু দূরে গেছে—সেই দূরত্ববশত সে অকর্তৃক হয়ে উঠেছে।”

এই প্রবন্ধের অন্যত্র কবি লিখেছেন— ”যে শকুন্তলার ঘটনা মানবসংসারে ঘটতে পারে তাকেই কবি আমাদের মনের কাছে নিবিড়তর সত্য ক’রে দেখিয়ে দেন। রামায়ণ রচিত হল, রচিত হল মহাভারত। রামকে পেলুম; সে তো একটিমাত্র মানুষের রূপ নয়, অনেক কাল থেকে অনেক মানুষের মধ্যে যে—সকল বিশেষ গুণের ক্ষণে ক্ষণে কিছু কিছু স্বাদ পাওয়া গেছে কবির মনে সে-সমস্তই দানা বেঁধে উঠল রামচন্দ্রের মূর্তিতে। রামচন্দ্র হয়ে উঠলেন আমাদের মনের মানুষ। বাস্তব সংসারে অনেক বিক্ষিপ্ত ভালো লোকের চেয়ে রামচন্দ্র আমাদের মনের কাছে সত্যমানুষ হয়ে ওঠেন। মন তাঁকে যেমন করে স্বীকার করে প্রত্যক্ষ হাজার হাজার লোককে তেমন ক’রে স্বীকার করে না।”

এই প্রবন্ধের শেষে কবি আবার বাল্মীকির কথা স্মরণ করেছেন। ”একবার সেকালের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। সাহিত্যসাধনা সম্বন্ধে তখনকার দিনের মনোভাবের পরিচয় আছে একটি কাহিনীতে; সেটি আলোচনার যোগ্য। ক্রৌঞ্চ মিথুনের মধ্যে একটিকে ব্যাধ যখন হত্যা করলে তখন ঘৃণার আবেগে কবির কণ্ঠ থেকে অনুষ্টুভ ছন্দ সহসা উচ্চারিত হল। …কবিঋষির মনে যখন সহসা সেই বেগবান শক্তিবান ছন্দের আবির্ভাব হল তখন স্বতই প্রশ্ন জাগল, এরই উপযুক্ত সৃষ্টি হওয়া চাই। তারই উত্তরে রচিত হল রামচরিত। অর্থাৎ এমন-কিছু যা নিত্যতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবার যোগ্য। যার সান্নিধ্য অর্থাৎ যার সাহিত্য মানুষের কাছে আদরণীয়।”

‘সাহিত্যের পথে’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে আটটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ‘সভাপতির অভিভাষণ’ প্রবন্ধের এক জায়গায় কবি লিখেছেন—”মানুষ নিজের জগতে বিহার করতে না পারলে, পরান্নভোজী পরাবসথশায়ী হলে তার আর দুঃখের অন্ত থাকে না। তাই তো কথা আছে, ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ’। আমার যা ধর্ম তাই আমার সৃষ্টির মূলশক্তি, আমিই স্বয়ং আমার আশ্রয়স্থল তৈরী করে তার মধ্যে বিরাজ করব।”—উল্লিখিত সংস্কৃত শব্দগুলি গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের (কর্মযোগঃ) ৩৫ সংখ্যক শ্লোকের অংশ। সম্পূর্ণ শ্লোক এবং তার অর্থ এই পুস্তকের অন্যত্র দেওয়া হয়েছে। তাই পুনরুল্লেখ করলাম না। গীতার এই শ্লোকাংশটি কবি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করেছেন।

এই প্রবন্ধের শেষ দিকে কবি মত প্রকাশ করেছেন যে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে একটা জোয়ার এসেছে। ”বসন্ত বাংলার চিত্ত-উপবনে প্রাণদেবতার দাক্ষিণ্য নিয়ে এসে পৌঁচেছে, …এর ঘোষণার ভার কবিদের উপর। আমি আজ সেই কবির কর্তব্য করতে এসেছি; আমি বলতে এসেছি, অহল্যাপাষাণীর উপর রামচন্দ্রের পদস্পর্শ হয়েছে— এই দৃশ্য দেখা গেছে বাংলাসাহিত্যে”,—অহল্যার কথা আগে বলা হয়েছে।

‘সাহিত্যসম্মিলন’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন যে বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতা ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ”বাংলাসাহিত্য আমাদের সৃষ্টি। এমন-কি, ইহা আমাদের নূতন সৃষ্টি বলিলেও হয়। অর্থাৎ, ইহা আমাদের দেশের পুরাতন সাহিত্যের অনুবৃত্তি নয়। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ধারা যে-খাতে বহিত বর্তমান সাহিত্য সেই খাতে বহে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ আচার-বিচার পুরাতনের নির্জীব পুনরাবৃত্তি। বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তাহার অসংগতির সীমা নাই। …কেবল আমাদের সাহিত্যই নূতন রূপ লইয়া নূতন প্রাণে নূতন কালের সঙ্গে আপন যোগসাধন করিতে প্রবৃত্ত। …সে (বাঙালী) যদি একমাত্র কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়াই আবহমান কাল সুর করিয়া পড়িয়া যাইত—মনের উদার সঞ্চরণের জন্য যদি তাহার মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আলো, মুক্ত ক্ষেত্র না থাকিত— তবে তাহার মনের অসাড়তাই তাহার পক্ষে সকলের চেয়ে প্রবল বেড়ি হইয়া তাহাকে চিন্তায় ও কর্মে সমান অচল করিয়া রাখিত।”

‘সাহিত্যসমালোচনা’ প্রবন্ধে আমাদের সাহিত্য ও মহাকাব্য নিয়ে বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন— ”মানুষ যে সকল মনের সৃষ্টিকে চিরন্তন মূল্য দিয়ে থাকে, চিরকাল রক্ষা করবার যোগ্য ও গৌরবের বিষয় বলে মনে করে, তাকে সাহিত্যে এবং আর্টে চিরকালের ভাষায়, চিরকালের চিত্রে চিত্রিত করে। আমাদের সব সাহিত্যের গোড়াতেই যে-মহাকাব্য, স্পষ্টই দেখি, তার লক্ষ্য মানুষের দৈন্য প্রচার, মানুষের লজ্জা ঘোষণা করা নয়—তার মাহাত্ম্য স্বীকার করা।

সংসারধর্মে মানবচরিত্রে সত্যের সেই-সব প্রকাশকে তাঁরা চিরকালের মূল্য দিয়েছেন, যাকে তাঁরা সর্বকাল ও সর্বজনের কাছে ব্যক্ত করবার ও রক্ষা করবার যোগ্য মনে করেছেন। …বাল্মীকি যেদিন ছন্দ পেলেন সেদিন অনুভব করলেন, এ ছন্দ কোনো মহৎ চরিত্র, কোনো পরম অনুভূতি প্রকাশ করবার জন্যে, এমন কিছু যাতে মানবজীবনের পূর্ণতা, যাতে তার গৌরব।”

মানুষের অনুপলব্ধ কামনা অনেক সময় সাহিত্যে রূপ নেয়। কবি লিখেছেন ”সাহিত্যে মানুষের ইচ্ছারূপ এমন ক’রে প্রকাশ পায় যাতে সে মনোহর হয়ে ওঠে, এমন পরিস্ফূট মূর্তি ধরে যাতে সে ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ের চেয়ে প্রত্যয়গম্য হয়। সেই কারণেই সমাজকে সাহিত্য একটি সজীব শক্তি দান করে; যে ইচ্ছা তার শ্রেষ্ঠ ইচ্ছা সাহিত্যযোগে তা শ্রেষ্ঠ ভাষায় ও ভঙ্গীতে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনে কাজ করতে থাকে এবং সমাজের আত্মসৃষ্টিকে বিশিষ্টতা দান করে। রামায়ণ মহাভারত ভারতবাসী হিন্দুকে বহুযুগ থেকে মানুষ করে এসেছে। একদা ভারতবর্ষ যে আদর্শ কামনা করেছে তা ঐ দুই কাব্যে চিরজীবি হয়ে গেল।”

কালান্তর : কালান্তর এবং তার সংযোজন মিলিয়ে মোট ২৫টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এখানে এবং তার অনেকগুলিতেই রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ রয়েছে।

‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন যে পুরানো দিনের বাংলাদেশে সমাজ গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপকে ঘিরে আবর্তিত হতো। সেখানে আলোচনার বিষয় ছিল গ্রামের সীমার মধ্যেই বদ্ধ। ”তার বাইরে মাঝে মাঝে চিত্তানুশীলনের যে আয়োজন হত সে ছিল যাত্রা সংকীর্তন কথকতা রামায়ণপাঠ, পাঁচালি কবিগান নিয়ে। তার বিষয়বস্তু ছিল পুরাকাহিনীভাণ্ডারে চিরসঞ্চিত।”

মধ্যযুগে এবং তার পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় সমাজে জড়ত্বের চিহ্ন বিশেষভাবেই প্রকাশিত ছিল। কবি লিখেছেন— ”চারি দিক এমনি নিস্তব্ধ নিশ্চল যে মনে ভ্রম হয় ইহাই সনাতন। কখনোই নহে, ইহাই নূতন। এই মরুভূমি সনাতন নহে, ইহার বহুপূর্বে এখানে প্রাণের নব নব লীলা চলিত— সেই লীলায় কত বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প সাহিত্য, রাজ্য সাম্রাজ্য, কত ধর্ম ও সমাজবিপ্লব তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছে। কিছু না করিয়া একবার মহাভারতটা পড়িয়া দেখিলেই দেখা যাইবে, সমাজটা কোনো সংহিতার কারখানাঘরের ঢালাই-পেটাই করা ও কারিগরের ছাপমারা সামগ্রী ছিল না—তাহাতে বিধাতার নিজের সৃষ্টির সমস্ত লক্ষণ ছিল, কেননা তাহাতে প্রাণ ছিল। তাহা নিখুঁত নয়, নিটোল নয়; তাহা সজীব, তাহা প্রবল, তাহা কৌতূহলী, তাহা দুঃসাহসিক।”

”যাহা কিছু চলিতেছে তাহারই সঙ্গে জগতের চিরন্তন চলার যোগ আছে— যাহা থামিয়া বসিয়াছে তাহার সঙ্গে সনাতন প্রাণের বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে আজ ক্ষুদ্র ভারতের প্রাণ একেবারে ঠাণ্ডা হইয়া স্থির হইয়া গেছে, তাহর মধ্যে সাহস নাই, সৃষ্টির কোনো উদ্যম নাই, এইজন্যই মহাভারতের সনাতন প্রাণের সঙ্গে তাহার যোগই নাই। যে-যুগ দর্শন চিন্তা করিয়াছিল, যে যুগ শিল্প সৃষ্টি করিয়াছিল, যে-রাজ্য বিস্তার করিয়াছিল তাহার সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন।”

কবি বলেছেন পৃথিবীর বড়ো বড়ো সভ্যতা দুঃসাহসের সৃষ্টি। আমাদের দেশেও দুঃসাহসিক তরুণদল আছে কিন্তু বিভিন্ন বিধিনিষেধের গণ্ডিতে তারা বদ্ধ হয়ে গেছে। তাতেও তাদের প্রাণের প্রাচূর্য সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়নি। আর কোন কাজ না পেয়ে তারা সমাজের বাধাগুলোকেই আরো জোরদার করছে। ”ইহারা কুন্তীসুত কর্ণের মতো। পাণ্ডবের দলে কর্ণের যথার্থ স্থান ছিল কিন্তু সেখানে অদৃষ্টক্রমে কোনো অধিকার না পাওয়াতে পাণ্ডবদিগকে উচ্ছেদ করাই তাঁহার জীবনের ব্রত হইয়া উঠিয়াছিল।”

‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”এ কথা অনেক সময়েই শোনা যায় যে, মানুষ স্বভাবতই অকৃতজ্ঞ—যাহার কাছে সে ঋণী তাহাকে পরিহার করিবার জন্য তাহার চেষ্টা। মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ—এ উপদেশ পারতপক্ষে কেউ মানে না। তাহার মহাজনটি যে রাস্তা দিয়া চলে মানুষ সে-রাস্তায় চলা একেবারে ছাড়িয়া দেয়।”—সংস্কৃত শব্দ কয়টি মহাভারতের একটি শ্লোকের অংশ। সম্পূর্ণ শ্লোকটি এবং তার অর্থ এই গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে।

‘লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে বর্তমান যুগে চতুর্বর্ণের প্রধান বর্ণ ব্রাহ্মণ তার স্বধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় বর্ণ ক্ষত্রিয়—তাদেরও আর সে রমরমা নেই। এখন সব দেশেই বৈশ্য বা বণিকরাই হচ্ছে চালিকাশক্তি। ক্ষত্রিয়রা দুর্বল হয়ে পড়লেও অনেক সময়েই বৈশ্যের প্রাধান্য মানতে চায় না। ”এখন সেই ক্ষত্রিয়ে বৈশ্যে—অদ্য যুদ্ধ ত্বয়া ময়া। দ্বাপর যুগে আমাদের হলধর বলরামদাদা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগ দেন নাই। কলিযুগে তার পরিপূর্ণ মদের ভাঁড়টিতে হাত পড়িবামাত্র তিনি হুংকার দিয়া ছুটিয়াছেন। এবারকার কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের প্রধান সর্দার কৃষ্ণ নহেন, বলরাম। রক্তপাতে তাঁর রুচি নাই—রজতফেনোচ্ছল মদের ঢোঁক গিলিয়া এতকাল ধরিয়া তাঁর নেশা কেবলই চড়িয়া উঠিতেছিল; এবারকার আচমকা উৎপাতে সেই নেশা কিছু ছুটিতে পারে কিন্তু আবার সময়কালে দ্বিগুণবেগে মৌতাত জমিবে সে আশঙ্কা আছে।”

আগে ”ঝগড়া ছিল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ে। কেননা তখন ব্রাহ্মণ তো কেবলমাত্র যজন-যাজন অধ্যয়ন-অধ্যাপন লইয়া ছিল না— মানুষের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করিয়াছিল। তাই ক্ষত্রিয়-প্রভু ও ব্রাহ্মণ-প্রভুতে সর্বদাই ঠেলাঠেলি চলিত; বশিষ্ঠে বিশ্বামিত্রে আপস করিয়া থাকা শক্ত। য়ুরোপেও রাজায় পোপে বাঁও কষাকষির অন্ত ছিল না।”

বশিষ্ঠ ব্রহ্মার মানসপুত্র এবং সূর্যবশীয় রাজগণের কুলপুরোহিত। রামায়ণের রামচন্দ্র এঁর কাছেই বিদ্যাশিক্ষাদি প্রাপ্ত হন। বশিষ্ঠ সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিদের মধ্যে একজন। তাঁর পত্নীর নাম অরুন্ধতী। বিশ্বামিত্র প্রথমে ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং রাজপুত্র। পিতার মৃত্যুর পর ইনি রাজত্ব প্রাপ্ত হন। বিশ্বামিত্র ঋষি বশিষ্ঠের কামধেনুকে বলপূর্বক গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সক্ষম হননি। বশিষ্ঠের সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দীর্ঘমেয়াদী শত্রুতার সম্পর্ক তৈরী হয়। কৌশলে তিনি বশিষ্ঠের শত পুত্রের বিনাশ সাধন করান। ব্রাহ্মণের ক্ষমতা দেখে বিশ্বামিত্রও ব্রাহ্মণ হতে চেয়েছিলেন এবং বহুকালব্যাপী কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে তিনি ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

‘বাতায়নিকের পত্র’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”প্রাচীন ভারতে একটা জিনিস প্রচুর ছিল, সেটাকে আমরা খুব মহামূল্য বলেই জানি, সে হচ্ছে সত্যকে খুব বড়ো করে ধ্যান করবার এবং উপলব্ধি করবার মতো মনের উদার অবকাশ। ভারতবর্ষ একদিন সুখ এবং দুঃখ, লাভ এবং অলাভের উপকার সব চেয়ে বড়ো ফাঁকায় দাঁড়িয়ে সেই সত্যকেই সুস্পষ্ট করে দেখেছিল, যং লবধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।

কিন্তু আজকের দিনে ভারতবর্ষের সেই ধ্যানের বড়ো অবকাশটি নষ্ট হল। আজকের দিনের ভারতবাসীর আর ছুটি নেই; তার মনের অন্তরতম ছুটির উৎসটি শুকিয়ে শুকিয়ে মরে গেল, বেদনায় তার সমস্ত চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে।”

উপরে উল্লিখিত সংস্কৃত শব্দ কয়টি গীতার একটি শ্লোকের অংশ। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়টি ধ্যানযোগঃ। এই অধ্যায়ের ২২ সংখ্যক শ্লোকটিতে রয়েছে শব্দগুলো।

 ”যং লব্ধবা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।

 যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচালতে।।”

(যে অবস্থা লাভ করলে অন্য সব লাভকেই তুচ্ছ বলে মনে হয় এবং কোনো কর্মই বিচলিত করতে পারে না, সেই অবস্থা হল যোগ।)

‘শক্তি পূজা’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন— ”শক্তিপূজার সঙ্গে একটি উলঙ্গ নিদারুণতার ভাব, নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বলপূর্বক দুর্বলকে বলি দেবার ভাব সংগত হয়ে আছে—…কিন্তু তবু একথা স্বীকার করা উচিত যে, কোনো ধর্মসাধনার উচ্চ অর্থ যদি দেশের কোনো বিশেষ শাস্ত্র বা সাধকের মধ্যে কথিত বা জীবিত থাকে তবে তাকে সম্মান করা কর্তব্য। এমন-কি ভূরিপরিমিত প্রচলিত ব্যবহারের চেয়েও তাকে বড়ো বলে জানা চাই। ধর্মকে পরিমাণের দ্বারা বিচার না করে তার উৎকর্ষের দ্বারা বিচার করাই শ্রেয়।

 স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।”

উপরের সংস্কৃত শব্দগুলো গীতার একটি শ্লোকের অংশ—গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪০ সংখ্যক শ্লোক। সম্পূর্ণ শ্লোকটি এবং তার অর্থ পূর্বে দেওয়া হয়েছে।

গীতার এই আংশিক শ্লোকটিই কবি আবার ‘সত্যের আহ্বান’ প্রবন্ধে ব্যবহার করেছেন। ”সত্য আলোর মতো, তার শিখাটা জ্বলবামাত্র দেখা যায় মায়া নেই। এইজন্যেই শাস্ত্রে বলেছেন, স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ। ভয় হচ্ছে মনের নাস্তিকতা, তাকে না’এর দিক থেকে নিকেশ করা যায় না, উপস্থিতমত তার একটা কারণ গেলেও রক্তবীজের মতো আর একটা কারণরূপে সে জন্ম নেয়। ধর্ম হচ্ছে সত্য, সে মনের আস্তিকতা, তার অল্পমাত্র আবির্ভাবে হাঁ প্রকাণ্ড না’কে একেবারে মূলে গিয়ে অভিভূত করে।”

এই প্রবন্ধের অন্য এক জায়গায় কবি মহাভারতের অজ্ঞাতবাসের কথা বলেছেন। ”একটি কথা আমাদের মনে ভাববার দিন এসেছে, সে হচ্ছে এই— ভারতের আজকের এই উদবোধন সমস্ত পৃথিবীর উদবোধনের অঙ্গ। একটি মহাযুদ্ধের তূর্যধ্বনিতে আজ যুগারম্ভের দ্বার খুলেছে। মহাভারতে পড়েছি আত্মপ্রকাশের পূর্ববর্তী কাল হচ্ছে অজ্ঞাতবাসের কাল। কিছুকাল থেকে পৃথিবীতে মানুষ যে পরস্পর কীরকম ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে সে কথাটা স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত ছিল।”—অজ্ঞাতবাসের বিষয়টা মহাভারতে আছে। শকুনি—দুর্যোধন—কর্ণ সমন্বিত কৌরবদের কাছে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির পাশাখেলায় হেরে গিয়েছিলেন। খেলার শর্ত অনুসারে পরাজিত পক্ষ পাণ্ডবদেরকে বারো বৎসর বনবাসে এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাতে হয়েছিল। অজ্ঞাতবাসের শর্ত ছিল অত্যন্ত কঠিন। ওই একবৎসরকালের মধ্যে যদি তাঁদের কেউ চিনতে পারতো বা কোনোভাবে তাঁদের পরিচয় প্রকাশ পেত তবে তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল আবার একইরকম বারো প্লাস এক তেরো বৎসর।

এই কালান্তর গ্রন্থের বহু প্রবন্ধ প্রথমে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল; পরে গ্রন্থে সংকলিত হবার সময় মনে হয় একটু আধটু পরিবর্তন করা হয়েছিল। গ্রন্থপরিচয় অংশে ‘সমাধান’ প্রবন্ধটির ব্যাপারে লেখা হয়েছে— ”সমাধান প্রবন্ধটির উপসংহার প্রবাসীতে অন্যরূপ ছিল। বর্তমান খণ্ডে ৬১১ পৃ. ২৫ ছত্রের অনুক্রমে ছিল—

এইখানে গীতার উপদেশ আমাদের মনে করিয়ে দিতে হয় যে, কাজেরই অধিকার আমাদের, ফলের অধিকার নয়। আশুফলের প্রতি অতিশয় লোভ করেই আমরা জাদুকরের শরণাপন্ন হই; ফলের বদলে ফলের মরীচিকা দেখে নৃত্য করতে থাকি।”—এইখানে গীতার প্রাসঙ্গিক শ্লোকটি হচ্ছে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ সংখ্যক শ্লোক।

 ”কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

 মা কর্মফলহেতুভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্ব কর্মণি।।”

গীতার একটা বিখ্যাত শ্লোক হল তৃতীয় অধ্যায়ের (কর্ম্মযোগঃ) ৩৫ সখ্যক শ্লোক যেখানে বলা হয়েছে—

 ”শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।

 স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।।”

স্বধর্ম, পরধর্মো—এগুলো নিয়ে অনেকজায়গাতেই আলোচনা হয় এবং বক্তারা নিজের মতো করে তার ব্যাখ্যা দেন। এই স্বধর্ম, পরধর্ম বলতে যে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম ইত্যাদি বোঝানো হচ্ছে না, সেটা খুব পরিষ্কার। গীতা যখন উদগীত হয়েছিল তখন এইসব ধর্মমতের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সমগ্র গীতার কোথাও ‘হিন্দু’ কথাটি ব্যবহৃত হয়নি। মনে হয় মানুষের মধ্যে যে বৃত্তিগত বিভাগ ছিল, সেইটাই বলা হয়েছে। গীতার উৎপত্তির সময় আমাদের সমাজ যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চার বর্ণে বিভক্ত ছিল, সে-ও এখনকার দিনে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শূদ্রধর্ম’ প্রবন্ধে নিজের মতো করে স্বধর্ম, পরধর্মো ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছেন—

”ভারতবর্ষ এই সমস্যার মীমাংসা করেছিল বৃত্তিভেদকে পুরুষানুক্রমে পাকা করে দিয়ে। রাজশাসনে যদি পাকা করা হত তা হলে তার মধ্যে দাসত্বের অবমাননা থাকত এবং ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের চেষ্টা কখনোই থামত না। পাকা হল ধর্মের শাসন। বলা হল, এক-একটা জাতির এক-একটা কাজ তার ধর্মেরই অঙ্গ।

ধর্ম আমাদের কাছে ত্যাগ দাবি করে। সেই ত্যাগে আমাদের দৈন্য নয়, আমাদের গৌরব। ধর্ম আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ শূদ্র সকলকেই কিছু-না-কিছু ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছে। ব্রাহ্মণকেও অনেক ভোগ বিলাস ও প্রলোভন পরিত্যাগ করবার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তার সঙ্গে ব্রাহ্মণ প্রচুর সম্মান পেয়েছিল। না পেলে সমাজে সে নিজের কাজ করতেই পারত না। শূদ্রও যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে, কিন্তু সমাদর পায়নি। তবুও সে কিছু পাক আর না পাক, ধর্মের খাতিরে হীনতা স্বীকার করার মধ্যেও তার একটা আত্মপ্রসাদ আছে।

বস্তুত জীবিকানির্বাহকে ধর্মের শ্রেণীতে ভুক্ত করা তখনই চলে যখন নিজের প্রয়োজনের উপরেও সমাজের প্রয়োজন লক্ষ্য থাকে। ব্রাহ্মণ ভাতে-ভাত খেয়ে বাহ্য দৈন্য স্বীকার করে নিয়ে সমাজের আধ্যাত্মিক আদর্শকে সমাজের মধ্যে বিশুদ্ধ যদি রাখে তবে তার দ্বারা তার জীবিকানির্বাহ হলেও সেটা জীবিকানির্বাহের চেয়ে বড়ো, সেটা ধর্ম। চাষী যদি চাষ না করে তবে একদিনও সমাজ টেঁকে না। অতএব চাষী আপন জীবিকাকে যদি ধর্ম বলে স্বীকার করে তবে কথাটাকে মিথ্যা বলা যায় না। অথচ এমন মিথ্যা সান্ত্বনা তাকে কেউ দেয় নি যে, চাষ করার কাজ ব্রাহ্মণের কাজের সঙ্গে সম্মানে সমান। যে-সব কাজে মানুষের উচ্চতর বৃত্তি খাটে, মানবসমাজে স্বভাবতই তার সম্মান শারীরিক কাজের চেয়ে বেশি, এ কথা সুস্পষ্ট।

যে দেশে জীবিকা-অর্জনকে ধর্মকর্মের সামিল করে দেখে না সে দেশেও নিম্নশ্রেণির কাজ বন্ধ হলে সমাজের সর্বনাশ ঘটে। অতএব সেখানেও অধিকাংশ লোককেই সেই কাজ করতেই হবে। সুযোগের সংকীর্ণতাবশত সেরকম কাজ করবার লোকের অভাব ঘটে না, তাই সমাজ টিঁকে আছে। আজকাল মাঝে-মাঝে যখন সেখানকার শ্রমজীবীরা সমাজের সেই গরজের কথাটা মাথা নাড়া দিয়ে সমাজের নিষ্কর্মা বা পরাসক্ত বা বুদ্ধিজীবীদের জানান দেয় তখন সমাজে একটা ভূমিকম্প উপস্থিত হয়। তখন কোথাও-বা কড়া রাজশাসন, কোথাও-বা তাদের আর্জি-মঞ্জুরির দ্বারা সমাজরক্ষার চেষ্টা হয়।

আমাদের দেশে বৃত্তিভেদকে ধর্মশাসনের অন্তর্গত করে দেওয়াতে এরকম অসন্তোষ ও বিপ্লবচেষ্টার গোড়া নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে করে জাতিগত কর্মধারাগুলির উৎকর্ষ সাধন হয়েছে কি না ভেবে দেখবার বিষয়।

যে-সকল কাজ বাহ্য অভ্যাসের নয়, যা বুদ্ধিমূলক বিশেষ ক্ষমতার দ্বারাই সাধিত হতে পারে, তা ব্যক্তিগত না হয়ে বংশগত হতেই পারে না। যদি তাকে বংশে আবদ্ধ করা হয় তা হলে ক্রমেই তার প্রাণ মরে গিয়ে বাইরের ঠাটটাই বড়ো হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণের যে সাধনা আন্তরিক তার জন্যে ব্যক্তিগত শক্তি ও সাধনার দরকার, যেটা কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক সেটা সহজ। আনুষ্ঠানিক আচার বংশানুক্রমে চলতে চলতে তার অভ্যাসটা পাকা ও দম্ভটা প্রবল হতে পারে, কিন্তু তার আসল জিনিসটি মরে যাওয়াতে আচারগুলি অর্থহীন বোঝা হয়ে উঠে জীবনপথের বিঘ্ন ঘটায়। উপনয়নপ্রথা এক সময়ে আর্যদ্বিজদের পক্ষে সত্য পদার্থ ছিল— তার শিক্ষা, দীক্ষা, ব্রহ্মচর্য, গুরুগৃহবাস, সমস্তই তখনকার কালের ভারতবর্ষীয় আর্যদের মধ্যে প্রচলিত শ্রেষ্ঠ আদর্শগুলিকে গ্রহণ করবার পক্ষে উপযোগী ছিল। কিন্তু যে-সকল উচ্চ আদর্শ আধ্যাত্মিক, যার জন্যে নিয়তজাগরূক চিৎশক্তির দরকার, সে তো মৃত পদার্থের মতো কঠিন আচারের পৈতৃক সিন্দুকের মধ্যে বন্ধ করে রাখবার নয়, সেইজন্যেই স্বভাবতই উপনয়নপ্রথা এখন প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কারণ, উপনয়ন যে আদর্শের বাহন ও চিহ্ন সেই আদর্শই গেছে সরে। ক্ষত্রিয়েরও সেই দশা; কোথায় যে সে, তাকে খুঁজে পাওয়া শক্ত। যারা ক্ষত্রিয়বর্ণ বলে পরিচিত, জাতকর্ম বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের সময়েই তারা ক্ষত্রিয়ের কতকগুলি পুরাতন আচার পালন করে মাত্র।

এ দিকে শাস্ত্র বলছেন : স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ। এ কথাটার প্রচলিত অর্থ এই দাঁড়িয়েছে যে, যে বর্ণের শাস্ত্রবিহিত যে ধর্ম তাকে তাই পালন করতে হবে। এ কথা বললেই তার তাৎপর্য এই দাঁড়ায় যে, ধর্ম-অনুশাসনের যে অংশটুকু অন্ধভাবে পালন করা চলে তাই প্রাণপণে পালন করতে হবে, তার কোনো প্রয়োজন থাক আর নাই থাক, তাতে অকারণে মানুষের স্বাধীনতার খর্বতা ঘটে ঘটুক, তার ক্ষতি হয় হোক। অন্ধ আচারের অত্যাচার অত্যন্ত বেশি, তার কাছে ভালোমন্দর আন্তরিক মূল্যবোধ নেই। তাই যে শুচিবায়ুগ্রস্ত মেয়ে কথায় কথায় স্নান করতে ছোটে সে নিজের চেয়ে অনেক ভালো লোককে বাহ্যশুচিতার ওজনে ঘৃণাভাজন মনে করতে দ্বিধা বোধ করে না। বস্তুত তার পক্ষে আন্তরিক সাধনার কঠিনতর প্রয়াস অনাবশ্যক। এইজন্যে অহংকার ও অন্যের প্রতি অবজ্ঞায় তার চিত্তের অশুচিতা ঘটে। এই কারণে আধুনিক কালে যারা বুদ্ধিবিচার জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজকর্তাদের মতে স্বধর্ম পালন করে তাদের ঔদ্ধত্য এতই দুঃসহ, অথচ এত নিরর্থক।

অথচ জাতিগত স্বধর্ম পালন করা খুবই সহজ যেখানে সেই স্বধর্মের মধ্যে চিত্তবৃত্তির স্থান নেই। বংশানুক্রমে হাঁড়ি তৈরি করা, বা ঘানির থেকে তেল বের করা, বা উচ্চতর বর্ণের দাস্যবৃত্তি করা কঠিন নয়— বরং তাতে মন যতই মরে যায় কাজ ততই সহজ হয়ে আসে। এই-সকল হারে কাজেরও নূতনতর উৎকর্ষ সাধন করতে গেলে চিত্ত চাই। বংশানুক্রমে স্বধর্ম পালন করতে গিয়ে তার উপযুক্ত চিত্তও বাকি থাকে না, মানুষ কেবল যন্ত্র হয়ে একই কর্মের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। যাই হোক, আজ ভারতে বিশুদ্ধভাবে স্বধর্মে টিকে আছে কেবল শূদ্রেরা। শূদ্রত্বে তাদের অসন্তাোষ নেই। এইজন্যেই ভারতবর্ষের-নিমকে-জীর্ণ দেশে-ফেরা ইংরেজ-গৃহিণীর মুখে অনেকবার শুনেছি, স্বদেশে এসে ভারতবর্ষের চাকরের অভাব তারা বড়ো বেশি অনুভব করে। ধর্মশাসনে পুরুষানুক্রমে যাদের চাকর বানিয়েছে তাদের মতো চাকর পৃথিবীতে কোথায় পাওয়া যাবে। লাথিঝাঁটা-বর্ষণের মধ্যেও তারা ধর্মরক্ষা করতে কুণ্ঠিত হয়না। তারা তো কোনোকালে সম্মানের দাবি করে নি, পায়ও নি, তারা কেবল শূদ্রধর্ম অত্যন্ত বিশুদ্ধভাবে রক্ষা করেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করেছে। আজ যদি তারা বিদেশী শিক্ষায় মাঝে মাঝে আত্মবিস্মৃত হয় তবে সমাজপতি তাদের স্পর্ধা সম্বন্ধে আক্রোশ প্রকাশ করে।

স্বধর্মরত শূদ্রের সংখ্যাই ভারতবর্ষে সব চেয়ে বেশি, তাই এক দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষ শূদ্রধর্মের দেশ। তার নানা প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া গেছে। এই অতি প্রকাণ্ড শূদ্রধর্মের জড়ত্বের ভারাকর্ষণে ভারতের সমস্ত হিন্দুসম্প্রদায়ের মাথা হেঁট হয়ে আছে। বুদ্ধিসাধ্য জ্ঞানসাধ্য চারিত্রশক্তিসাধ্য যে-কোনো মহাসম্পদলাভের সাধনা আমরা আজ করতে চাই তা এই প্রবল শূদ্রত্বভার ঠেলে তবে করতে হবে— তার পরে সেই সম্পদকে রক্ষা করবার ভারও এই অসীম অন্ধতার হাতে সমর্পণ করা ছাড়া আর উপায় নেই। এই কথাই আমাদের ভাববার কথা।”

”মানববিশ্বের আকাশে আজ যুদ্ধের কালো মেঘ চারদিকে ঘনিয়ে এসেছে।”

”তখন এসিয়ার মধ্যে এই শূদ্র ভারতবর্ষের কী কাজ। তখন সে য়ুরোপের কামারশালায় তৈরি লোহার শিকল কাঁধে করে নির্বিচারে তার প্রাচীন বন্ধুকে বাঁধতে যাবে। সে মারবে, সে মরবে। কেন মারবে, কেন মরবে, এ কথা প্রশ্ন করতে তার ধর্মে নিষেধ। সে বলবে; ‘স্বধর্মে হননং শ্রেয়ঃ, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’। ইংরেজ-সাম্রাজ্যের কোথাও সে সম্মান চায়ও না, পায়ও না—ইংরেজের হয়ে সে কুলিগিরির বোঝা বয়ে মরে, যে বোঝার মধ্যে তার অর্থ নেই, পরমার্থ নেই; ইংরেজের হয়ে পরকে সে তেড়ে মারতে যায়, যে পর তার শত্রু নয়; কাজ সিদ্ধ হবা মাত্র আবার তাড়া খেয়ে তোষাখানার মধ্যে ঢোকে। শূদ্রের এই তো বহু যুগের দীক্ষা। তার কাজে স্বার্থও নেই, সম্মানও নেই, আছে কেবল ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’ এই বাণী। নিধনের অভাব হচ্ছে না; কিন্তু তার চেয়েও মানুষের বড়ো দুর্গতি আছে যখন সে পরের স্বার্থের বাহন হয়ে পরের সর্বনাশ করাকেই অনায়াসে কর্তব্য বলে মনে করে।”

‘বৃহত্তর ভারত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”আমাদের শাস্ত্রে বার বার বলেছে, যিনি নিজের মধ্যে সর্বভূতকে এবং সর্বভূতের মধ্যে নিজেকে জানেন তিনিই সত্যকে জানেন। অর্থাৎ অহংসীমার মধ্যে আত্মার নিরুদ্ধ অবস্থা আত্মার সত্য অবস্থা নয়।” এই কথাগুলির সঙ্গে মিল রয়েছে গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের (ধ্যানযোগঃ) ২৯ সংখ্যক শ্লোকটির—

 ”সর্বভূতস্থমাত্মনং সর্বভূতানি চাত্মনি।

 ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।”

(উপনিষদের শ্লোকটিও দেখতে হবে। নবম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।)

ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”রামচন্দ্র যখন সেতুবন্ধন করেছিলেন, তখন কাঠবেড়ালিরও স্থান হয়েছিল সেই কাজে। সে তখন শুধু গাছের কোটরে নিজের খাদ্যান্বেষণে না থেকে আপনার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েই দুই তটভূমির বিচ্ছেদসমুদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজে যোগ দিয়েছিল। সীতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করাই পৃথিবীতে সকল মহৎ সাধনার রূপক। সেই সীতাই ধর্ম; সেই সীতা জ্ঞান, স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি; সেই সীতা সুন্দরী; সেই সীতা সর্বমানবের কল্যাণী। নিজের কোটরের মধ্যে প্রভূত খাদ্যসঞ্চয়ের ঐশ্বর্য নিয়ে এই কাঠবেড়ালির সার্থকতা ছিল না, কিন্তু সীতা উদ্ধারের মহৎকাজে সে যে নিজেকে নিবেদন করেছিল এইজন্যেই মানবদেবতা তার পিঠে আশীর্বাদরেখা চিহ্নিত করেছিলেন। প্রত্যেক মহাজাতির পিঠে আমরা সেই চিহ্ন দেখতে চাই, সেই চিহ্নের দ্বারাই সে আপন কোটরকোণের অতীত নিত্যলোকে স্থান লাভ করে।”—সমুদ্রবন্ধনে কাঠবেড়ালি যে সাহায্য করেছিল সে কথা কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে।

‘কর্মযজ্ঞ’ প্রবন্ধে এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রমন্থনের কথা বলেছেন। ”দেবদানবকে সমুদ্র মন্থন করতে হয়েছিল তবে অমৃত জেগেছিল যে অমৃত সমস্তের মধ্যে ছড়ানো ছিল। কর্মের মন্থনদণ্ডের নিয়ত তাড়নায় তবেই আমাদের সকলের মধ্যে যে শক্তি ছড়িয়ে আছে তাকে আমরা ব্যক্ত আকারে পাব; তাতেই আমাদের জাতীয় ব্যক্তিত্ব অমর হয়ে উঠবে, আমাদের চিন্তা বাক্য এবং কর্ম সুনির্দিষ্টতা পেতে থাকবে।”

‘স্বরাজসাধন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ গীতার থেকে আংশিক শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। ”দেশসৃষ্টির সাধনা কাছের থেকে আরম্ভ করে ক্রমে দূরে প্রসারিত করলে তবেই আমরা ফল পাব। যদি এইরকম উদযোগকে আমরা আয়তনে ছোট বলে অবজ্ঞা করি তবে গীতার সেই কথাটা যেন মনে করি—স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।”—এই শ্লোকটি নিয়ে আগে আলোচনা করা হয়েছে।

‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”আমাদের শাস্ত্রে বলে, সংসারটা ঊর্ধমূল অবাক শাখ। উপরের দিক থেকে এর শুরু, নীচে এসে ডালপালা ছড়িয়েছে; অর্থাৎ নিজের জোরে দাঁড়িয়ে নেই, উপরের থেকে ঝুলছে।”—এই কথাগুলোর সঙ্গে মিল আছে গীতার একটি শ্লোকের। গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে (পুরুষোত্তমযোগঃ) এক সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে—

 ”ঊর্দ্ধমূলমধঃশাখামশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।

 ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ।।”

(পণ্ডিতেরা বলেন যে সংসাররূপ অশ্বত্থ বৃক্ষের মূল ঊর্দ্ধে রয়েছে আর শাখাসমূহ রয়েছে নীচের দিকে। এই বৃক্ষের পাতা হলো চার বেদ। এই বৃক্ষের তত্ত্ব যিনি জানেন তিনি বেদবিৎ।)

ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ”তখন য়ুরোপীয় যে সাহিত্য আমাদের মন দখল করেছে তার মধ্যে মাটসিনি গারিবালডির সুরটাই ছিল প্রধান। এখন সেখানে নাট্যের পালা বদল হয়েছে। লঙ্কাকাণ্ডে ছিল রাজবীরের জয়, ছিল দানবের হাত থেকে সীতার মুক্তির কথা। উত্তরকাণ্ডে আছে দুর্ম্মুখের, রাজার মাথা হেঁট, প্রজার মন জোগাবার তাগিদে রাজরাণীকে বিসর্জন।”— রামায়ণ মহাগ্রন্থ সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত। সাত কাণ্ডের ষষ্ঠ লঙ্কাকাণ্ড এবং সপ্তমকাণ্ডটি হচ্ছে উত্তরকাণ্ড। এই উত্তরকাণ্ডে প্রজাদের দেওয়া মিথ্যা অপবাদে রামচন্দ্র সীতাকে পরিত্যাগ করেন। অনেকেই বলেন এই উত্তরকাণ্ড পরবর্তীকালের রচনা।

‘নবযুগ’ প্রবন্ধে রামায়ণের কথা আছে, গীতার কথা আছে। কবি বলেছেন— ”ভারতবর্ষে এক সময়ে আর্য ও অনার্যের সংগ্রামে মানুষের সত্য পীড়িত হয়েছিল; ভারতবর্ষ তখনো প্রতিষ্ঠালাভ করেনি। তারপরে আর একটা যুগ এলো। রামায়ণে আমরা তার আভাস পাই, তখন আর্য-অনার্যের যুদ্ধের অবসান হয়ে মিলনের কাল এসেছে। শ্রীরামচন্দ্র সেই মিলনের সত্যকে প্রকাশ করেছিলেন; এমন অনুমান করবার হেতু আছে। আমরা আরো আগে দেখেছি, এক সময় যে আনুষ্ঠানিক ধর্ম কর্মকাণ্ড আকারে প্রধান হয়ে উঠেছিল অন্য সময়ে সে জ্ঞানের প্রাধান্য স্বীকার করে বিশ্বভৌমিকতাকে বরণ করেছে।… সত্যকার যোগী সকলের সঙ্গে যোগে যিনি বিশ্বাত্মার সঙ্গে যুক্ত; তিনি বললেন, যা-কিছু মঙ্গল, যা সকলের ভালোর জন্য, তাই তপস্যা। তখন বন্ধ দুয়ার খুলে গেল। দ্রব্যময় যজ্ঞে মানুষ শুধু নিজের সিদ্ধি খোঁজে; জ্ঞানযজ্ঞে সকলেরই আসন পাতা হল, সমস্ত মানুষের মুক্তির আয়োজন সেইখানে। এই কথা স্বীকার করবামাত্র সভ্যতার নূতন অধ্যায় আরম্ভ হয়। ভগবদগীতায় আমরা এই নূতনের আভাস পাই, যেখানে ত্যাগের দ্বারা কর্মকে বিশুদ্ধ করবার কথা বলা হয়েছে, নিরর্থক অনুষ্ঠানের মধ্যে তাকে আবদ্ধ রাখতে বলেনি।” (দ্রব্যময় যজ্ঞ ও জ্ঞানময় যজ্ঞের কথা ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে—সেখানে জ্ঞানযজ্ঞকে দ্রব্যময় যজ্ঞ অপেক্ষা শ্রেয় বলা হয়েছে।)

”আশা করি দুর্গতির রাত্রি-অবসানে দুর্গতির শেষ সীমা আজ পেরোবার সময় এসেছে। আর্যে-অনার্যে একদা যেমন মিলন ঘটেছিল, শ্রীরামচন্দ্র যেমন চণ্ডালকে বুকে বেঁধেছিলেন সেই যুগ আজ সমাগত।”—রামায়ণে আছে যে চণ্ডালরাজ গুহক শ্রীরামচন্দ্রের মিত্র ছিলেন।

‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে রয়েছে যে ‘প্রহাসিনী-সংযোজন’ গ্রন্থের ‘মিলনের কাব্য’ কবিতাটি একটা ভূমিকাসহ ‘কবিতা’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ভূমিকার মধ্যে নিম্নলিখিত অংশটিও ছিল— ”সংস্কৃত শ্লোকে প্রশ্ন আছে, রঘুপতির অযোধ্যাপুরী গেল কোথায়। রঘুপতির অযোধ্যা বহু লোকের বহুকালের নানাবিধ সুস্পষ্ট অনুভূতিতেই প্রতিষ্ঠিত, সেই বিপুল অনুভূতি গেল শূন্য হয়ে। তা হলে যা ছিল সে কী ছিল। মস্ত একটা ‘না’ প্রকাণ্ড একটা ‘হাঁ’য়ের আকার ধরেছিল। নাস্তিত্ব সে অস্তিত্বের জাল গেঁথেই চলেছে, আবার সে জাল গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের মধ্যে। এই দুর্বোধ রহস্যকে বাস্তব বলব কেমন করে।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড
৩. তৃতীয় অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড
৪. চতুর্থ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড
৫. পঞ্চম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড
৭. সপ্তম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড
৮. অষ্টম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড
৯. নবম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, নবম খণ্ড
১০. দশম অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড
১১. একাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, একাদশ খণ্ড
১২. দ্বাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, দ্বাদশ খণ্ড
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, চতুর্দশ খণ্ড
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড
১৬. ষোড়শ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, ষোড়শ খণ্ড
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, সপ্তদশ খণ্ড
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় : রবীন্দ্ররচনাবলী—সুলভ সংস্করণ, অষ্টাদশ খণ্ড
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় : বিশ্বভারতী প্রকাশিত মূল রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাত্রিংশ খণ্ড এবং কুরুপাণ্ডব
২০. বিংশ অধ্যায় : চিঠিপত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন