রবীন্দ্ররচনাবলীর এই খণ্ডে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি সন্নিবেশিত হয়েছে—
কবিতা ও গান : সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, কড়ি ও কোমল এবং মানসী;
নাটক ও প্রহসন : প্রকৃতির প্রতিশোধ, বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা, রাজা ও রাণী এবং বিসর্জন;
উপন্যাস ও গল্প : বউ-ঠাকুরাণীর হাট এবং রাজর্ষি;
প্রবন্ধ : য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র, য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারী, চিঠিপত্র ও পঞ্চভূত; এবং গ্রন্থ-পরিচয়। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে সন্ধ্যাসংগীত, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, মায়ার খেলা এবং য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রতে রামায়ণ-মহাভারতের কোনো প্রসঙ্গ আমার চোখে পড়েনি। বাকি সব গ্রন্থগুলিতেই রামায়ণ-মহাভারতের প্রসঙ্গ অল্পবিস্তর আছে।
প্রথম খণ্ডের অবতরণিকা অংশে (কবি তাঁর সপ্ততিতম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে ছাত্রছাত্রীগণের সংবর্ধনার উত্তরে এই প্রতিভাষণটি পাঠ করেছিলেন) ত্যাগের দ্বারা ভোগ, লোভহীনতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কবির মতে, লোভহীনতা কাব্যসাধনার পক্ষে মহা মূল্যবান। তিনি বলেছেন—”মহৎ সাহিত্য ভোগকে লোভ থেকে উদ্ধার করে, সৌন্দর্যকে আসক্তি থেকে, চিত্তকে উপস্থিত গরজের দণ্ডধারীদের কাছ থেকে।” কথাটি ব্যাখ্যা করেছেন রামায়ণ থেকে উদাহরণ নিয়ে—”রাবণের ঘরে সীতা লোভের দ্বারা বন্দী; রামের ঘরে সীতা প্রেমের দ্বারা মুক্ত, সেখানেই তাঁর সত্য প্রকাশ। প্রেমের কাছে দেহের অপরূপ রূপ প্রকাশ পায়, লোভের কাছে তার স্থূল মাংস।”
‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যগ্রন্থখানি ১২৮৮ সালে প্রকাশিত—তখন কবির বয়স প্রায় কুড়ি বছর। কবির মতে, সন্ধ্যাসংগীতের আগে রচিত কোনো গ্রন্থই সংরক্ষণযোগ্য নয়—’সন্ধ্যাসংগীতের পূর্ববর্তী আমার সমস্ত কবিতা আমার কাব্যগ্রন্থাবলী হইতে বাদ দিয়াছি’—১৯১৫ সালে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (সুলভ সংস্করণ, ১ম খণ্ড; পৃ.-৯৫১)। এই গ্রন্থে অবশ্য রামায়ণ মহাভারতের কোন প্রসঙ্গ নেই।
‘প্রভাতসংগীত’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা ‘মহাস্বপ্ন’। কবি লিখেছেন—জগৎসংসারে অনেক কিছুই চক্রাকারে পরিবর্তিত হচ্ছে। ফুলের থেকে ফল হয়, ফল বীজে পরিণত হয়—বীজ থেকে নতুন গাছ হয়। জলের থেকে বাষ্প হয়, তা’ থেকে মেঘ হয়, মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা পতিত হয়ে ঝরণা বা নদীর সৃষ্টি হয়। বরষা এসে গরমের শান্তি করে। বরষার পর আসে শীত—সে যেন বৃদ্ধ সাদাচুলের মানুষ। কিন্তু শীতের পরেই বসন্ত এসে নবযৌবনের আগমনী রচনা করে—গাছে গাছে নতুন পাতা ও ফুলের সমারোহ দেখা দেয়। কবি স্মরণ করেছেন মহাভারতের যযাতির কাহিনী—’যযাতির মতো পুন বসন্তযৌবন ফিরে পায়।’ মহাভারত অনুসারে নহুষের পুত্র যযাতির দুই স্ত্রী—দেবাযানী ও শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর দুই ও শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র। যযাতি যখন বৃদ্ধ হলেন তখন তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল পুত্রদেরকে রাজ্যভার দিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করা। কিন্তু তাঁর ভোগপিপাসা তখনো দূর হয়নি। তাই কনিষ্ঠপুত্র পুরুর সঙ্গে তিনি নিজের বয়স বদল করলেন—পুরুর যৌবন তিনি নিলেন আর পুরুকে দিলেন নিজের বার্ধক্য। কবি বলছেন যযাতির পুনর্যেïবন লাভের মতো প্রকৃতিও বসন্তসমাগমে নবযৌবন প্রাপ্ত হচ্ছে।
প্রভাতসংগীতেরই ‘সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়’ কবিতায় তিনি মহাভারতের রচনাকার মহর্ষি বেদব্যাসের নাম এনেছেন—
‘জগতের মহা বেদব্যাস
গঠিলা নিখিল উপন্যাস
বিশৃঙ্খল বিশ্বগীতি লয়ে
মহাকাব্য করিলা রচন।’
এই ‘মহা বেদব্যাস’ বলতে কবি অবশ্য কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস নন—স্বয়ং জগদীশ্বরকে বুঝিয়েছেন।
‘ছবি ও গান’ কাব্যগ্রন্থখানি ১২৯০ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের ‘আর্তস্বর’ কবিতায় কুম্ভকর্ণের নাম বলা হয়েছে—
‘জ্বলন্ত বিদ্যুৎ-অহি ক্ষণে ক্ষণে রহি রহি
অন্ধকারে করিছে দংশন।
কুম্ভকর্ণ অন্ধকার নিদ্রা টুটি বার বার
উঠিতেছে করিয়া গর্জন।’
কুম্ভকর্ণ রামায়ণের চরিত্র—লঙ্কার রাজা রাবণের ভাই তিনি। রামায়ণের কোন কাহিনী এখানে বলা হয়নি—শুধু কুম্ভকর্ণের নামটিই এখানে নেওয়া হয়েছে। কুম্ভকর্ণের সঙ্গে নিদ্রার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। ব্রহ্মার বরে কুম্ভকর্ণ ছয়মাস একনাগাড়ে ঘুমোতেন, তারপরে একদিনের জন্য জাগরিত হতেন।
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালে অর্থাৎ কবির ২৩ বৎসর বয়সে। বৈষ্ণব কবিদের রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রেম-মিলন-বিরহের কবিতা বিশেষত ব্রজবুলি ভাষায় বিরচিত বিদ্যাপতির কবিতা বালককবি রবীন্দ্রনাথের মনোহরণ করেছিল; তারই ফলশ্রুতি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী। এর গানগুলি রাধাকৃষ্ণকে নিয়েই তবে এই কৃষ্ণ মহাভারতের কৃষ্ণ হয়ে ওঠেননি— মহাভারতের কোন কাহিনীও এখানে নেই।
কড়ি ও কোমল প্রকাশিত হয় ১২৯৩ সালে। এই গ্রন্থে ‘মথুরায়’ নামে একটি কবিতা আছে।
কৃষ্ণ মথুরাতে এসেছেন। সম্ভবত কংসবধ হয়ে গেছে। কৃষ্ণ অরাজক অবস্থা একটু গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছেন, মহাভারতের কৃষ্ণ হয়ে ওঠার পথে একধাপ এগিয়েছেন। মথুরাতে বৃন্দাবনের রাধার কথা তাঁর মনে পড়ছে। মহাভারতের কোন কাহিনী অবশ্য এই কবিতায় নেই।
সন্ধ্যাসঙ্গীত থেকে কড়ি ও কোমল—সময়কাল ১২৮৮ থেকে ১২৯৩ অর্থাৎ কবির ২০ বছর থেকে ২৫ বৎসর বয়সের মধ্যে। সন্ধ্যাসঙ্গীত-এর আগের কোন রচনা কবি সংরক্ষণের যোগ্য মনে করেননি এবং সেজন্য রচনাবলীতে সংকলিতও হয়নি। এই গ্রন্থগুলির সব কবিতাই যে উৎকৃষ্ট একথা বলা যাবে না, তবে এগুলির মধ্যে ক্রমপরিণতির চিহ্ন স্পষ্ট। তাঁর কবিতা সত্যিকারের কবিতা হয়ে উঠেছে ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থ (১২৯৭ সালে প্রকাশিত) থেকে। এতে একটি কবিতা রয়েছে ‘কুহুধ্বনি’। প্রখর গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে মানুষ যখন নিজ কর্মে রত তখন কোথা থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহুধ্বনি (শুধু বসন্তেই নয়; গ্রীষ্মকালেও কোকিলের ডাক শোনা যায়)। কবির মনে হয়েছে এই ধ্বনি চিরকালই ধ্বনিত হয়ে চলেছে—কেউ শোনে, কেউ শোনে না। এইরকম এক মায়াবী মধ্যাহ্নে কবির মনে পড়েছে তমসা নদীতীরে ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে স্বামী-পরিত্যক্তা নির্বাসিতা সীতার কথা—
প্রচ্ছায় তমসাতীরে শিশু কুশলব ফিরে,
সীতা হেরে বিষাদে হরিষে—
ঘন সহকার শাখে মাঝে মাঝে পিক ডাকে,
কুহুতানে করুণা বরিষে।
লতাকুঞ্জে তপোবনে বিজনে দুষ্মন্তসনে
শকুন্তলা লাজে থরথর,
তখনো সে কুহুভাষা রমণীর ভালোবাসা
করেছিল সুমধুরতর।
শুধু সীতার কথাই নয়, শকুন্তলার কথাও কবির মনে পড়েছিল। দ্বিপ্রহরের নির্জন আশ্রমে দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুরব দুষ্মন্ত-শকুন্তলার ভালোবাসাকে মধুরতর করেছিল।
মানসী কাব্যগ্রন্থে দুটো কবিতা রয়েছে— ‘দেশের উন্নতি’ এবং ‘বঙ্গবীর’। এই দুটো কবিতাতেই যাদের ‘মুখেন মারিতং জগৎ’ বা যারা বক্তৃতা ও পিটিশনের মাধ্যমে দেশের কাজ করে তাদের প্রতি ব্যঙ্গ বর্ষিত হয়েছে। এই দুটো কবিতায় মহাভারত থেকে কয়েকটা নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তবে তার মধ্যে গভীরতা নেই।
”অন্ধকারে ওই রে শোন
ভারতমাতা করেন ‘গ্রোন’
এ হেন কালে ভীষ্ম দ্রোণ
গেলেন কোনখানে!” (দেশের উন্নতি)
”কে বলিতে চায় মোরা নহি বীর,
প্রমাণ যে তার রয়েছে গভীর,
পূর্বপুরুষ ছুঁড়িতেন তীর
সাক্ষী বেদব্যাস।”
মানসী কাব্যগ্রন্থে ‘অহল্যার প্রতি’ নামে একটি কবিতা আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে অহল্যার যে কাহিনী আছে সেটি এইরকম—
গৌতম ঋষির পত্নী সুন্দরী অহল্যা। গৌতমের কাছে পাঠ নিতে আসেন দেবরাজ ইন্দ্র। অহল্যার রূপে তিনি মুগ্ধ হন। একদিন গৌতম কুটির থেকে তপস্যায় নির্গত হলে, ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধারণ করে অহল্যার কাছে আসেন এবং তাকে কামনা করেন। অহল্যার সান্নিধ্যে তিনি তৃপ্ত হন। গৌতম আশ্রমে ফিরে এসে সব জানতে পারেন। ইন্দ্রকে তিনি অভিশাপ দিলেন যে কামুকতার জন্য তার শরীরে সহস্র স্ত্রী-চিহ্ন প্রকটিত হবে। অহল্যাকেও তিনি অভিশাপ দিলেন—সে প্রস্তরে পরিণত হবে। অহল্যা কাতর হয়ে শাপমোচনের প্রার্থনা করলে গৌতম বললেন ত্রেতাযুগে শ্রীভগবান ‘রাম’ রূপে মর্ত্যে অবতীর্ণ হবেন। তাঁর পাদস্পর্শে অহল্যার শাপমোচন হবে।
রামায়ণের এই কাহিনী রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় গ্রহণ করেননি—তিনি শুধু অহল্যার নামটাই নিয়েছেন। দীর্ঘদিন প্রস্তুরীভূতা অবস্থায় থেকে অহল্যা শাপমুক্তা হলেন এবং নারীদেহ ফিরে পেলেন, সেই অহল্যার কাছে রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন—
”কী স্বপ্নে কাটালে তুমি দীর্ঘ দিবানিশি,
অহল্যা, পাষাণরূপে ধরাতলে মিশি,
নির্বাপিত-হোম-অগ্নি-তাপবিহীন
শূন্য তপোবনচ্ছায়ে?”
তখন তো তুমি ধরণীর সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলে। তখন কি তোমার কোন অনুভূতি ছিল, তুমি কি অনুভব করতে পেয়েছিলে মাতা বসুন্ধরার মহাস্নেহ?
”ছিল কি পাষাণতলে অস্পষ্টচেতনা?
জীবধাত্রী জননীর বিপুল বেদনা,
মাতৃধৈর্যো মৌন মূক সুখ দুঃখ যত
অনুভব করেছিলে স্বপনের মতো
সুপ্ত আত্মা মাঝে?”
এখন তো তুমি অভিশাপমুক্ত হয়ে
”বিস্মৃতিসাগর নীল নীরে
প্রথম ঊষার মতো উঠিয়াছ ধীরে।
তুমি বিশ্ব-পানে চেয়ে মানিছ বিস্ময়,
বিশ্ব তোমা-পানে চেয়ে কথা নাহি কয়;
দোঁহে মুখোমুখি। অপার রহস্যতীরে
চির পরিচয়-মাঝে নবপরিচয়।”
প্রকৃতির প্রতিশোধ (১২৯১)—এটিও কবির অল্পবয়সের রচনা। জগৎসংসারকে অস্বীকার করে গুহার মধ্যে তপস্যায় রত ছিল এক সন্ন্যাসী। একদিন তার মনে হলো সে সিদ্ধিলাভ করেছে—তাকে আর কেউ মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারবে না। সে গুহার বাইরে এলো। এক অনাথিনী বালিকা পিতৃসম্বোধনে সন্ন্যাসীর আশ্রয় ও স্নেহ ভিক্ষা করেছিল। কিন্তু সন্ন্যাসীর মনে হলো এই বালিকা তাকে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলবে, তাই তাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। কিন্তু থাকতে পারলো না—সবসময় মনে পড়ছিল অনাথিনী বালিকার কথা। সন্ন্যাসী ফিরে এলো কিন্তু তখন সেই নিরাশ্রয়া অনাথিনী বালিকা ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে—দেহে আর তার প্রাণ নেই। সন্ন্যাসী মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিকে অস্বীকার করেছিল, আর তাই প্রকৃতিও তার উপর প্রতিশোধ নিল। এটা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রিয় ভাব। অন্যত্র তিনি লিখেছেন ‘বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।’ ‘ইন্দ্রিয়ের দ্বার, রুদ্ধ করি যোগাসন সে নহে আমার।’
এখানেও রামায়ণের কথা একটুখানি আছে। সন্ন্যাসীর যখন অনুশোচনা হয়েছে, বালিকার কাছে ফিরে আসতে চাইছে, তখন সে মনে করছে—
‘একটি কুটীরে মোরা রহিব দুজনে,
রামায়ণ হতে তারে শুনাব কাহিনী—
সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বেলে, শাস্ত্রকথা শুনে,
বালিকা কোলেতে মোর পড়িবে ঘুমায়ে।’
কিন্তু বালিকা আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে আর রামায়ণ কথা শোনানো যাবে না।
বাল্মীকি প্রতিভা (১২৮৭ ফাল্গুন)—১৯৬৫ সালে বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর সপ্তদশ খণ্ডে গ্রন্থপরিচয় অংশে (পৃষ্ঠা ৪৭১) বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যের রচনা সম্বন্ধে এইরকম লেখা হয়েছে—”বৎসরে একবার দেশের সমস্ত সাহিত্যিকগণকে একত্র করিবার অভিপ্রায়ে আমাদের বাড়ীতে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ নামক এক সভা স্থাপিত হইয়াছিল। সেই সম্মিলন উপলক্ষে গান বাজনা আবৃত্তি ও আহারাদি হইত।
দ্বিতীয় বৎসরে দাদারা এই সম্মিলনে একটি নাট্যাভিনয় করিবার ইচ্ছা করিলেন। কোন বিষয় অবলম্বন করিয়া নাটক লিখিলে এই সভার উপযুক্ত হইবে তাহারই আলোচনা কালে দস্যুরত্নাকরের কবি হইবার কাহিনীই সকলের চেয়ে সংগত বলিয়া বোধ হইল। ইহার কিছু পূর্বেই আর্যদর্শনে বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাশয়ের ‘সারদামঙ্গলসংগীত’ বাহির হইয়া আমাদের সকলকেই মাতাইয়া তুলিয়াছিল। এই কাব্যে বাল্মীকির কাহিনী যেরূপ বর্ণিত হইয়াছে তাহারই সঙ্গে দস্যু রত্নাকরের বিবরণ জড়াইয়া দিয়া এই নাটকের গল্পটা একরূপ খাড়া হইল।……
তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাঁধিয়া বাল্মীকি প্রতিভার অভিনয় হইল। আমি সাজিয়াছিলাম বাল্মীকি।”
রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা বাল্মীকি প্রথম জীবনে যে একজন নৃশংস দস্যু ছিলেন—এইরকম কাহিনীই প্রচলিত। পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। তিনি মহর্ষিরূপে পরিগণিত হন এবং রামায়ণ মহাগ্রন্থ রচনা করে তিনি আদিকবির অভিধায় ভূষিত হন। রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকিকে দস্যুরা রাজা বলে (রবীন্দ্রনাথ দস্যু জীবনেও তার নাম বাল্মীকিই রেখেছেন)। দস্যুরা ডাকাতি ইত্যাদি করে বহু লুণ্ঠিত সামগ্রী নিয়ে এসেছে। এখন তারা তাদের সর্দারের (বাল্মীকির) নির্দেশ চাইছে তাদের পরবর্তী কর্মের ব্যাপারে। বাল্মীকি তাদের ‘বলি’ নিয়ে আসতে বলছেন—
‘শোন্ তোরা তবে শোন।
অমানিশা আজিকে, পূজা দেব কালীকে—
ত্বরা করি যা তবে, সবে মিলি যা তোরা,
বলি নিয়ে আয়।’
এই ‘বলি’ যে কি ‘বলি’ সেটা একটু পরেই পাঠকদের কাছে প্রকাশ পাবে আর বাল্মীকি যে শুধু দস্যুই নয়, একজন নৃশংস দস্যু, সেটাও জানা হয়ে যাবে।
দস্যুরা বনের মধ্যে পথহারা এক বালিকাকে পেয়ে তাকেই নিয়ে এলো তাদের সর্দারের কাছে মন্দিরে বলি দেবার জন্য। বাল্মীকি তাঁর অধীনস্থ দস্যুদের বাধা দিলেন—
‘নিয়ে আয় কৃপাণ, রয়েছে তৃষিতা শ্যামা মা,
শোণিত পিয়াও—যা ত্বরায়।
লোল জিহ্বা লকলকে, তড়িৎ খেলে চোখে,
করিয়ে খণ্ড দিগ্দিগন্ত ঘোর দন্ত তায়।’
বন্ধনের কষ্টে বালিকা কাতর হয়ে মুক্তি প্রার্থনা করছে। বাল্মীকির হঠাৎ কি যে হলো! তিনি বললেন—
‘এ কেমন মন হলো আমার!
কি ভাব এ যে কিছুই বুঝিতে যে পারিনে—
পাষাণ হৃদয়ও গলিল কেন রে,
কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে!
কী মায়া এ জানে গো,
পাষাণের বাঁধ এ যে টুটিল,
সব ভেসে গেল গো, সব ভেসে গেল গো—
মরুভূমি ডুবে গেল করুণার প্লাবনে!
তার পরে তিনি বললেন—
‘না না হবে না, এ বলি হবে না—
অন্য বলির তরে যা রে যা!
শোন, তোরা শোন্ এ আদেশ!
কৃপাণ খর্পর ফেলে দে দে!
বাঁধন কর ছিন্ন, মুক্ত কর, এখনি রে!’
বাল্মীকির আদেশে দস্যুরা তো বালিকাকে তখনকার মত মুক্ত করে দিল কিন্তু তারা তো নরবলি দিয়ে পুজো করবে! এত রাত্রে অন্য মানুষ আর পাবে কোথায়! তাই বাল্মীকি একটু অন্যত্র গেলেই তারা বালিকাকে আবার ধরলো এবং কালীপ্রতিমার কাছে আবার নিয়ে এসে বলি দেবার তোড়জোড় শুরু করলো। ঘটনাচক্রে বাল্মীকি আবার সেখানে ফিরে এলেন এবং দস্যুদেরকে তিরস্কার করলেন—
‘অহো আস্পর্ধা এ কী তোদের নরাধম!
তোদের কারও চাহি নে আর, আর, আর না রে—
দূর দূর দূর, আমারে আর ছুঁস নে।
এ-সব কাজ আর না, এ পাপ আর না,
আর না, আর না—ত্রাহি, সব ছাড়িনু।’
তার পরে বালিকাকে বাল্মীকি বললেন—
‘আয় মা, আমার সাথে, কোনো ভয় নাহি আর।
কত দুঃখ পেলি বনে আহা মা আমার।
নয়নে ঝরিছে বারি, এ কি মা সহিতে পারি!
কোমল কাতর তনু কাঁপিতেছে বার বার।’
রবীন্দ্ররচনায় দস্যু বাল্মীকির এই যে রূপান্তর হলো এর পিছনে আপাতগ্রাহ্য জোরালো কারণ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তার মনের মধ্যে একটা বিকার উপস্থিত হলো। আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে ভীত এক পথহারা বালিকার আকুল ক্রন্দন বাল্মীকির পাষাণ হৃদয় হঠাৎই দ্রব করে দিল, আর তাতেই তাঁর এই পরিবর্তন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে অবশ্য বাল্মীকির মনের পরিবর্তন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। রামায়ণের কাহিনীটি এইরকম—
চ্যবনের পুত্র রত্নাকর। দস্যুবৃত্তিই তার পেশা। একদিন দেব-পিতামহ ব্রহ্মা এবং দেবর্ষি নারদ, রত্নাকর যে বনে থাকে সেই বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। রত্নাকর তাদের দেখতে পেয়ে ভাবলো যে সে এই সন্ন্যাসীদুটোকে মেরে তাদের গাত্রবস্ত্র কেড়ে নেবে। কিন্তু ব্রহ্মার মায়াতে তার হাতের মুগুর চললো না। ব্রহ্মা বললেন—’বাপু! তুমি আমাদের মারবে কেন? আমরা সন্ন্যাসী, মারার জন্য তোমার পাপ হবে প্রচুর। তা’ তুমি যে এত পাপ করছো, সে পাপ কি কেউ তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেবে?” রত্নাকর বললো যে এই সমস্ত কথা তাদের ভাবতে হবে না।
‘রত্নাকর বলে, যত লয়ে যাই ধন।
মাতা পিতা পত্নী আমি খাই চারিজন।।
যাহা কিছু বেচি কিনি খাই চারিজনে।
আমার পাপের ভাগী সকলে এক্ষণে।”
ব্রহ্মা হেসে বললেন যে রত্নাকরের এই ধারণা ঠিক নয়—কেউ তার পাপের ভাগ নেবে না। রত্নাকর বরং বাড়ী গিয়ে সকলকে জিজ্ঞাসা করে আসুক। সেই কথা শুনে রত্নাকর বাড়ীতে গেল এবং প্রথমে পিতাকে বললো যে সে তো দস্যুবৃত্তি করে যে ধনার্জন করে তাই দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করে। দস্যুবৃত্তি করে রত্নাকরের যে পাপ হচ্ছে সেই পাপের অংশ পিতা কি কিছু নেবেন? পিতা চ্যবন খুব ভালো কথা বললেন—
‘অজ্ঞান বালক তোরে কি কহিব কথা। কভু পিতাপুত্র হয়, পুত্র হয় পিতা।।
যখন বালক ছিলে পিতা ছিনু আমি। এখন বালক আমি পিতা হৈলে তুমি।।
যখন বালক ছিলে, না ছিল যৌবন। বহু দুঃখ করি তোমা করিনু পালন।।
যত পাপ করিয়াছি আপনি সংসারে। যে সব পাপের ভাগ না লাগে তোমারে।।
এবে পিতা হইয়াছ, পুত্রতুল্য আমি। কোনরূপে আমাকে পুষিবে নিত্য তুমি।।
মনুষ্য মারিতে তোমা বলে কোন জন। তোমার পাপের ভাগী হব কি কারণ।।’
রত্নাকর এবার মায়ের কাছে গেল। মা সব শুনে ক্রুদ্ধা হয়ে বললেন যে তিনি অনেক কষ্ট করে দশমাস তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং পোষণ করেছিলেন। তিনি কেন রত্নাকরের পাপের ভাগ নিতে যাবেন? এইসব শুনে রত্নাকরের একটু জ্ঞান হচ্ছে। সে
‘শুনিয়া মায়ের বাক্য হেঁট কৈল মাথা।
পত্নীর নিকটে গিয়া কহে সব কথা।।’
পত্নীও শুনে বললেন যে স্ত্রীকে প্রতিপালন করা স্বামীর কর্তব্য। আর
‘মনুষ্য মারিতে কেবা বলিল তোমায়।
এইমাত্র জানি, তুমি পালিবে আমায়।’
এইসব শুনে রত্নাকরের জ্ঞানচক্ষু পরিপূর্ণরূপে উন্মীলিত হলো। ব্রহ্মার কাছে ফিরে গিয়ে তাঁর পায়ে সে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লো। বললো, সন্ন্যাসীর কৃপায় তার চোখ খুলে গেছে। তার পাপের ভাগ তো কেউ নেবে না—সন্ন্যাসী যেন কৃপা করে তাকে পরিত্রাণ করেন। ব্রহ্মা তাকে সরোবরে স্নান করে আসতে বললেন—কিন্তু সে এত পাপ করেছে যে সরোবরের কাছে যাবামাত্র সরোবরের জল শুকিয়ে গেল। ব্রহ্মা তখন কৃপাপরবশ হয়ে তার মাথায় কমণ্ডলুর জল দিলেন আর তাকে ‘রাম নাম’ করতে বললেন। কিন্তু তার জিহ্বাতে রাম নামের উচ্চারণ হয় না। ব্রহ্মার কথায় সে তখন ‘মরা, মরা’, বলতে লাগলো এবং ‘মরা—মরা’ বলতে বলতেই এক সময় তার মুখ দিয়ে ‘রাম’ নাম উচ্চারিত হলো। ‘রাম’ নামে তার পাপেরও স্খালন হলো।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিনাট্যে বাল্মীকির মুখে সেই বিখ্যাত শ্লোক উচ্চারণ করিয়েছেন (শোকের থেকে উৎপত্তি, তাই নাম হলো শ্লোক)। রবীন্দ্রগীতিনাট্যের কাহিনীটি এইরকম—
বালিকাকে পরিত্রাণ করেও বাল্মীকির মনের অস্থিরতা যাচ্ছেনা। তিনি ভাবলেন যে শিকারে গেলে হয়তো তাঁর মনের অস্থিরতা দূর হবে। তিনি তার সঙ্গীদেরকে ডাকলেন তারপর দলবল নিয়ে চললেন শিকারে। কিন্তু দুটো হরিণশাবক দেখে তাঁর সঙ্গীরা যখন তীর ছুঁড়তে যাবে তখন তাঁর মনের মধ্যে আবার কেমন যেন হলো। তিনি সঙ্গীদেরকে বললেন—
‘রাখ্ রাখ্ ফেল ধনু, ছাড়িস নে বাণ।
হরিণশাবক দুটি প্রাণভয়ে ধায় ছুটি,
চাহিতেছে ফিরে ফিরে করুণ নয়ান।
কোনো দোষ করেনি তো, সুকুমার কলেবর—
কেমনে কোমল দেহে বিঁধিবি কঠিন শর!
থাক্ থাক্ ওরে থাক্, এ দারুণ খেলা রাখ্,
আজ হতে বিসর্জিনু এ ছার ধনুক বাণ।’
বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে বাল্মীকির মন চিন্তায় উথালপাতাল হচ্ছে। কোনো দিকে তাঁর নজর নেই। এমন সময়ে সেখানে ব্যাধেরা এলো—গাছের ডালে দুটো পাখিকে দেখে তারা তীর সন্ধান করলো—বিদ্ধ হলো একটা ক্রৌঞ্চ পাখি। দুঃখে অভিভূত অশিক্ষিত দস্যু বাল্মীকির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো
‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।’
আশ্চর্য হয়ে গেলেন বাল্মীকি নিজেই—এই সুন্দর সুললিত ছন্দোবদ্ধ শব্দসমূহ কী করে তাঁর মুখে উচ্চারিত হলো। দেবী সরস্বতী তাঁকে দর্শন দিলেন—বললেন যে বালিকার ছদ্মবেশে তিনিই এসেছিলেন বাল্মীকির পাষাণহৃদয় গলাবার জন্য। দেবী তাঁর নিজের বীণাখানি বাল্মীকিকে উপহার দিলেন এবং বর দিলেন যে একদিন বাল্মীকির কবিতা-গানে জগৎ প্লাবিত হবে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণেও এই কাহিনীটি কিছুটা একই রকম। সেখানেও ব্যাধকর্তৃক ক্রৌঞ্চ নিধনে বাল্মীকির মুখে এই শ্লোকের উচ্চারণ, তবে প্রেক্ষিত আলাদা।
ব্রহ্মার কথায় রত্নাকর একমনে রামনাম জপ করে চলেছে—দিনরাত্রির হুঁশ নেই। একাসনেই কেটে গেছে অনেকদিন—উইপোকা বা বল্মীক তাকে ঘিরে ঢিবি রচনা করেছে। তাকে আর দেখাই যাচ্ছে না। অনেকদিন পরে ব্রহ্মা আবার এসেছেন সেখানে। রত্নাকরকে সেখানে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু ঢিবির মধ্য থেকে ‘রামনাম’ শোনা যাচ্ছে। ঢিবি পরিষ্কার করে যখন তাকে বের করা হলো তখন সে অস্থিচর্ম্মসার কিন্তু মুখে অবিরাম ‘রাম নাম’! যেহেতু সে বল্মীকের মধ্যে ছিল তাই ব্রহ্মা তার নতুন নামকরণ করলেন ‘বাল্মীকি।’ ব্রহ্মা আরো বললেন, যে ‘রাম নাম’ করে রত্নাকরের শরীর পবিত্র হয়েছে সেই রামের চরিতকথা তাঁকে রচনা করতে হবে। বাল্মীকি বললেন যে তিনি তো কবিতা, ছন্দ, ঘটনা ইত্যাদি কিছুই জানেন না—তা’হলে তিনি কী করে রচনা করবেন রামকথা! ব্রহ্মা বললেন যে দেবী সরস্বতীর প্রসাদে সবই জানতে পারবে বাল্মীকি; আর
”শ্লোকছন্দে পুরাণ করিবে তুমি যাহা।
জন্মিয়া শ্রীরামচন্দ্র করিবেন তাহা।”
একদিন বাল্মীকি এক সরোবরের তীরে বসে রামনাম জপ করছেন তখন ব্যাধের শরে বিদ্ধ হয়ে একটি ক্রৌঞ্চপক্ষী বাল্মীকির কোলে পতিত হলো। মৃত পক্ষীর শোকে কাতর বাল্মীকির মুখ দিয়ে নিঃসরিত হলো সেই অবিস্মরণীয় শ্লোক। বিস্মিত বাল্মীকির কাছে তখন উপস্থিত হলেন দেবর্ষি নারদ। বুঝিয়ে দিলেন সবকিছু আর উপদেশ দিলেন সেই শ্লোকচ্ছন্দে বাল্মীকি যেন ‘রামকথা’ রচনা করেন।
কালমৃগয়া—১৯৬৫ সালে বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর সপ্তদশ খণ্ডে (পৃ. ৪৭০) গ্রন্থপরিচয় অংশে রবীন্দ্রনাথের লেখা উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন—”ইহার পরে (বাল্মীকি প্রতিভার পর) ‘দশরথকর্তৃক মৃগভ্রমে মুনিবালকবধ’ ঘটনা অবলম্বন করিয়া গীতিনাট্য লিখিয়াছিলাম। তাহাও অভিনীত হইয়াছিল। আমি তাহাতে অন্ধমুনি সাজিয়াছিলাম। এই গীতিনাট্যের অনেকগুলি গান পরে বাল্মীকি প্রতিভার অন্তর্গত হইয়া তাহারই পুষ্টিসাধন করিয়াছে।” বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর সুলভ সংস্করণ প্রথম খণ্ড পৃ. ৯৫৮-তে লেখা হয়েছে যে ‘কালমৃগয়ার অনেকটা অংশ বাল্মীকি প্রতিভায় গৃহীত হইয়াছে বলিয়া কালমৃগয়া পরে আর ছাপানো হয় নাই।’
(এই পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে যে অভিনয়ের জন্য গীতিনাটক লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণেরই শরণাপন্ন হচ্ছেন—এই সময় বয়স তাঁর ২০ বছরের নীচে)।
রাজারাণী নাটকটি ১২৯৬ সালে অর্থাৎ কবির ২৮ বৎসর বয়সে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই নাটকেও অতি সামান্য রামায়ণ এবং মহাভারতের কথার উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সেগুলো নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হচ্ছে—
‘কোমল হৃদয়তলে তীক্ষ্ন কথা বিঁধে
প্রেম উৎস ছুটে—অর্জুনের শরাঘাতে
মর্মাহত ধরণীর ভোগবতী সম।’
(বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণ প্রথম খণ্ড; পৃ. ৪৬৯)
জালন্ধরের রাজা বিক্রমদেব। তাঁর রানী কাশ্মীর রাজকন্যা সুমিত্রা। সুমিত্রার প্রেমেই রাজা দিবানিশি মগ্ন থাকতে চান। রাজকার্যো তাঁর কোন মনোযোগ নেই—ফলে রাজ্যে একটা অরাজক অবস্থা। রানীর এটা পছন্দ নয়। রানী চান রাজা রাজকার্য্য করে রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন। রানী এই নিয়ে অনেক সময়ই রাজাকে তিরস্কার করেন, তাঁকে তীক্ষ্ন কথা বলেন। রানীর এই তীক্ষ্ন বাক্যের উত্তরে রাজাও কখনো তীক্ষ্ন কথা বলেন। বিক্রমদেব বলছেন এই তীক্ষ্ন কথার চালাচালিতে প্রেমের উৎসমুখ খুলে যাবে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকালে ভীষ্ম যখন শরশয্যায় পতিত ছিলেন তখন তিনি সেই সময়ের উপযোগী পানীয় চেয়েছিলেন। মূল্যবান ভৃঙ্গার করে আনা সুবাসিত পানীয় তিনি গ্রহণ করেননি। অর্জুন তখন অস্ত্র দিয়ে পৃথ্বী বিদারণ করে পাতালস্থিত ভোগবতীর পুণ্য সুস্নিগ্ধ শীতল জল ভীষ্মের পানের জন্য এনে দিয়েছিলেন। অর্জুনের অস্ত্রাঘাতে ধরণী মর্মাহত হলেও ভোগবতীর জলের উৎসমুখ খুলে গিয়েছিল।
”পিতৃসত্য পালনের তরে রামচন্দ্র
গিয়াছেন বনে, পতিসত্য পালনের
লাগি আমি যাবো। যে সত্যে আছেন বাঁধা
মহারাজ রাজ্যলক্ষ্মী কাছে, কভু তাহা
সামান্য নারীর তরে ব্যর্থ হইবে না।”
(সুলভ সংস্করণ; ১ম খণ্ড-পৃ. ৪৭২)
রানী সুমিত্রা যখন কোনভাবেই রাজা বিক্রমদেবকে উদ্বোধিত করতে পারলেন না তাঁর কাজে, তখন রানী ঠিক করলেন যে তিনি রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন। রাজ্যের কাছে রাজা সত্যবদ্ধ সুশাসনের জন্য। রাজার সেই সত্যরক্ষার জন্য রানী চলে যাবেন রাজ্য ছেড়ে যেমন গিয়েছিলেন রামচন্দ্র পিতৃসত্য রক্ষার জন্য।
রাজারানী নাটকে (সুলভ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৭৭) লেখা হয়েছে—
”যেন ভরতের রাজত্বে রামচন্দ্রের জুতো জোড়াটার মতো পড়ে আছে,”
কাশ্মীরের রাজপুত্র কুমারসেন আর রাজকন্যা সুমিত্রা। তাঁদের ছোটবেলায় কোলেপিঠে করে বড় করেছিল শংকর। সেই শংকরের কথাই এখানে বলা হয়েছে।
সুলভ সংস্করণ – ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৯০—’তুমি যুদ্ধু করবে নাকি? দ্রোণাচার্য্য হয়ে উঠেছ?’
‘তুমি না গেলে কি রাজার যুদ্ধু চলবে না? তুমি কি মহাবীর ধূম্রলোচন হয়েছ?”
একথা জালন্ধর রাজ্যের রাজপুরোহিত দেবদত্তের ব্রাহ্মণীর। দেবদত্ত রাজার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, রাজ্যেরও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। রানী সুমিত্রার রাজ্যত্যাগে ক্রুদ্ধ রাজা বিক্রমদেব যখন সৈন্য নিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতেছে তখন দেবদত্তের মনে হলো তার রাজার কাছে যাওয়া উচিত। দেবদত্ত হয়তো কথা বলে রাজাকে সামলাতে পারবেন। যাওয়ার আগে তিনি ব্রাহ্মণীর সম্মতি চাইলেন। ব্রাহ্মণী তখন এই কথাগুলো বলেছেন। দ্রোণাচার্য্য মহাভারতের দুর্ধর্ষ বীর, কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষক। ধূম্রলোচন সম্বন্ধে অভিধানে এই কথাগুলো লেখা আছে ‘জনৈক অসুর দৈত্যরাজ শুম্ভের সেনাপতি। শুম্ভের দূত অম্বিকাকে আনিতে অকৃতকার্য্য হইয়া ফিরিয়া আসিলে, দৈত্যরাজ ধূম্রলোচনকে সসৈন্য দেবীর নিকট, প্রেরণ করেন। অতঃপর অসুর দেবীর সহিত যুদ্ধে রণশয্যায় শয়ন করে।”
”তাঁরে মনে করে
মনে পড়ে পুণ্যবতী জানকীর কথা।”
(সুলভ সংস্করণ; ১ম খণ্ড, পৃ.—৫১৮)
দেবদত্ত এসেছেন রাজার কাছে। রাজা এতদিনে সুমিত্রার greatness বুঝতে পেরেছেন—রানীকে ফিরে পেতে এখন উদগ্রীব তিনি। দেবদত্তের সঙ্গে রাজার আলাপচারিতার সময় দেবদত্তের উক্তি এটি। মা-সীতা যেমন চিরজীবন দুঃখই পেয়েছেন, সতী-সাধ্বী সুমিত্রাও সেইরকম দুঃখ পাচ্ছেন।
বিসর্জন (১২৯৭)—বিসর্জন নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৯৭ সালে। কবি গ্রন্থখানি উৎসর্গ করেছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। উৎসর্গ অংশে লেখক রামায়ণের রচয়িতা আদিকবি বাল্মীকিকে স্মরণ করেছেন।
”লিখিতে লিখিতে মাঝে পাখী-গান কানে বাজে,
মনে আনে কাল পুরাতন—
ওই গান, ওই ছবি, তরুশিরে রাঙা রবি
ওরা প্রকৃতির নিত্যধন।
আদিকবি বাল্মীকিরে এই সমীরণ ধীরে
ভক্তিভরে করেছে বীজন,
ওই মায়া চিত্রবৎ তরুলতা ছায়াপথ
ছিল তাঁর পুন্য তপোবন।”
এ ছাড়া বিসর্জন নাটকে রামায়ণ-মহাভারতের আর কোন প্রসঙ্গের উল্লেখ নেই। তবে রাজর্ষি উপন্যাসে, যার নাট্যরূপ এই বিসর্জন নাটক, সেখানে কিছু কিছু উল্লেখ আছে।
শাজাহানের পর দিল্লীর সিংহাসন কার হবে এইরকম একটা টালমাটাল পরিস্থিতির আঁচ এই উপন্যাসের কোন কোন জায়গায় আছে। ত্রিপুরার নির্বাসিত রাজপুরোহিত রঘুপতি বিজয়গড়ের দুর্গে এসেছেন। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের বিরুদ্ধতা করাই তাঁর উদ্দেশ্য। এই বিজয়গড় দুর্গের অবস্থান রাজমহলের কাছাকাছি কোন জায়গায় এবং এই দুর্গের অধিপতি ছিলেন বিক্রমসিংহ। এই দুর্গে একজন বৃদ্ধ ছিলেন—খড়্গ সিংহ। লোকে তাঁকে ‘খুড়াসাহেব’ বলে। বিজয়গড় দুর্গের শ্রেষ্ঠত্বে খুড়াসাহেবের অগাধ বিশ্বাস। তাঁর মতে অতীতকালে কার্তবীর্য্যার্জুন নাকি এই দুর্গে বন্দী ছিলেন। এই কার্তবীর্য্যার্জুন দুর্ধর্ষ পৌরাণিক বীর। লংকার রাজা রাবণও একবার তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন।
এই উপন্যাসের একত্রিংশ পরিচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে যে ত্রিপুরার নির্বাসিত রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের সঙ্গে রঘুপতির সাক্ষাৎ হয়েছে। রঘুপতি নক্ষত্ররায়কে কিছু মোগল সৈন্য যোগাড় করে দিয়েছেন যাতে নক্ষত্ররায় ত্রিপুরার সিংহাসন দখল করতে পারেন। এই সৈন্যদের সঙ্গে যেতে যেতে নক্ষত্ররায়ের দিগ্বিজয়ী পাণ্ডবদের কথা মনে পড়ে।
এই উপন্যাসে দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদেও মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্য অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ, ন্যায়ের জন্য তিনি নিজের ভাই নক্ষত্ররায়কেও নির্বাসনদণ্ড দিয়েছেন। অপর নির্বাসিত, রাজপুরোহিত রঘুপতি গোবিন্দমাণিক্যের উপর প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়সংকল্প। রঘুপতি নক্ষত্ররায়কে সঙ্গে নিয়ে সৈন্যসহ ত্রিপুরা রাজ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন গোবিন্দমাণিক্যকে উৎখাত করার জন্য। এই সংবাদ শুনে গোবিন্দমাণিক্য ঠিক করেছেন তিনি ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না—রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন। ভাই যে সৈন্য নিয়ে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছে, এটা গোবিন্দমাণিক্য মনে করছেন তাঁর পাপের শাস্তি। নতুন রাজপুরোহিত বিল্বনঠাকুর এটা মানতে চান না।
”বিল্বন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন—মহারাজ, এই সকল কথা শুনিলে আমার ধৈর্য্য থাকে না। দুঃখ যে পাপেরই ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে। কত ধর্মাত্মা আজীবন দুঃখে কাটাইয়া গিয়াছেন।
রাজা নিরুত্তর হইয়া রহিলেন।
বিল্বন জিজ্ঞাসা করিলেন,—মহারাজ কি পাপ করিয়াছিলেন যাহার ফলে এই ঘটনা ঘটিল?
রাজা কহিলেন—আপন ভাইকে নির্বাসিত করিয়াছিলাম।
বিল্বন কহিলেন—আপনি ভাইকে নির্বাসিত করেন নাই। দোষীকে নির্বাসিত করিয়াছেন।
রাজা কহিলেন—দোষী হইলেও ভাইকে নির্বাসনের পাপ আছেই। তাহার ফল হইতে নিস্তার পাওয়া যায় না। কৌরবেরা দুরাচার হইলেও পাণ্ডবেরা তাহাদিগকে বধ করিয়া প্রসন্নচিত্তে রাজ্যসুখ ভোগ করিতে পারিলেন না। যজ্ঞ করিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিলেন। পাণ্ডবেরা কৌরবদের নিকট হইতে রাজ্য লইলেন, কৌরবেরা মরিয়া গিয়া পাণ্ডবদের রাজ্য হরণ করিলেন। আমি নক্ষত্রকে নির্বাসিত করিয়াছি, নক্ষত্র আমাকে নির্বাসিত করিতে আসিতেছে।
বিল্বন কহিলেন—পাণ্ডবেরা পাপের শাস্তি দিবার জন্য কৌরবদের সহিত যুদ্ধ করেন নাই, তাহারা রাজ্য লাভের জন্য করিয়াছিলেন। কিন্তু মহারাজ পাপের শাস্তি দিয়া নিজের সুখ-দুঃখ উপেক্ষা করিয়া ধর্ম পালন করিয়াছিলেন।”
পরের পরিচ্ছেদেই বিল্বন ঠাকুর রাজাকে বলছেন—”কর্তব্যের কাছে ভাই বন্ধু কেহই নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কী উপদেশ দিয়াছিলেন স্মরণ করিয়া দেখুন।”
বউ ঠাকুরাণীর হাট : এই উপন্যাসটি ১২৮৯ সালের পৌষমাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এখানে মহাভারত প্রসঙ্গের অত্যন্ত সামান্য উল্লেখ আছে।
এই উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদের প্রথমেই বলা হয়েছে চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র রায়ের (যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের জামাতা) বসিবার ঘরের কুলঙ্গিতে গণেশের ও শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন প্রতিমূর্ত্তি স্থাপিত আছে। এই পরিচ্ছেদের শেষের দিকে রামচন্দ্র রায়ের কর্মচারী রামমোহন মালকে পরাক্রমে ভীমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদের শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে যে প্রতাপাদিত্যের বন্দীপুত্র উদয়াদিত্য তাঁর বোন বিভাকে মহাভারত পড়ে শোনাচ্ছেন।
য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারী (১২৯৮, ১৩০০)—এটি দুই খণ্ডে ১২৯৮ ও ১৩০০ সালে প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর সুলভ সংস্করণের প্রথম খণ্ডের ৮৩৭ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”আমি তাঁকে (জাহাজ যাত্রার সঙ্গী) বারংবার সতর্ক করে দিয়েছি যে, যদি তার মুক্তির কোনো ব্যাঘাত থাকে সে তাঁর চুরুট। মহর্ষি ভরত মৃত্যুকালেও হরিণশিশুর প্রতি চিত্তনিবেশ করেছিলেন বলে পরজন্মে হরিণশাবক হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন। আমার সর্বদাই আশংকা হয়, আমার বন্ধু জন্মান্তরে ব্রহ্মদেশীয় কোন এক কৃষকের কুটীরের সম্মুখে মস্ত একটা তামাকের ক্ষেত হয়ে উদভূত হবেন। বিনা প্রমাণে তিনি শাস্ত্রের এ-সকল কথা বিশ্বাস করেন না, বরঞ্চ তর্ক করে আমারও সরল বিশ্বাস নষ্ট করতে চান…।”
মহাভারতে দুষ্মন্তপুত্র ভরতের কথা আছে। কিন্তু এখানে উল্লিখিত ভরত দুষ্মন্তপুত্র ভরত নন। এই ভরত শ্রীমদ্ভাগবতের ভরত এবং তিনি ঋষভদেবের পুত্র। হিন্দুরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন এবং মনে করেন যে মৃত্যুর সময়ে মানুষের যে কামনা থাকে পরবর্তী জীবনে সেটা প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে শ্রীভগবান বলেছেন—
”যং যং বাপি স্মরণ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্।
তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ।।”
অনেকে ভাবতে পারেন যে তাহলে আর চিন্তার কি আছে। এখন যেমন খুশি জীবনটা চালানো যাক—মৃত্যুর সময় একটা ভালো কিছু ভাবলেই হবে। —না, মশাই! সেটা হবে না। মানুষ তার আজীবনের সংস্কার ত্যাগ করতে পারে না। জ্ঞানী মানুষেরা বলেন, যার যেমন সংস্কার মৃত্যুর সময় তার সেইরকমই ভাব হয়।
এই পৃষ্ঠাতেই রবীন্দ্রনাথ Sea-Sickness নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন—”দেবাসুরগণ সমুদ্র মন্থন করে সমুদ্রের মধ্যে যা কিছু ছিল সমস্ত বাহির করেছিলেন। সমুদ্রদেবেরও কিছু করতে পারলেন না, অসুরেরও কিছু করতে পারলেন না, হতভাগ্য দুর্বল মানুষের উপর তার প্রতিশোধ তুলছেন। মন্দরপর্বত কোথায় জানিনে এবং শেষনাগ তদবধি পাতালে বিশ্রাম করছেন, কিন্তু সেই সনাতন মন্থনের ঘূর্ণিবেগ যে এখনো সমুদ্রের মধ্যে রয়ে গেছে তা নরজঠরধারী মাত্রেই অনুভব করেন।”
সমুদ্র মন্থনের কথা মহাভারতে আছে।
চিঠিপত্র ১২৯৪ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
মহাভারত-রামায়ণের প্রসঙ্গ এই গ্রন্থে অল্পস্বল্প আছে। সুলভ সংস্করণ, ১ম খণ্ড, পৃ ৮৬১তে আছে—”আমরা মনে করিতাম নামে মানুষকে বড় করে না। মানুষই নামকে জাঁকাইয়া তোলে। মন্দ কাজ করিলেই মানুষের বদনাম হয়, ভালো কাজ করিলেই মানুষের সুনাম হয়। বাবা কেবল একটা নামই দিতে পারে, কিন্তু ভালো নাম কিম্বা মন্দ নাম সে ছেলে নিজেই দেয়। ভাবিয়া দেখো, আমাদের প্রাচীন কালের বড়ো বড়ো নাম শুনিতে নিতান্ত মধুর নয়—যুধিষ্ঠির, রামচন্দ্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, ভরদ্বাজ, শাণ্ডিল্য, জন্মেঞ্জয়, বৈশম্পায়ন ইত্যাদি। কিন্তু ঐ সকল নাম অক্ষয়বটের মতো আজ পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের হৃদয়ে সহস্র শিকড়ে বিরাজ করিতেছে।”
উক্ত গ্রন্থের ৮৬৭ পৃষ্ঠাতে রয়েছে—”তুমি লিখিয়াছ আমাদের সেকালে ব্যক্তির প্রতিই ভক্তি-প্রীতি প্রভৃতি বদ্ধ ছিল, ভাবের প্রতি ভক্তি-প্রীতি ছিল না। ব্যক্তির প্রতি ভক্তি প্রীতি কিছু মন্দ নহে, সে খুব ভালোই। সুতরাং আমাদের কালে যে সেটা খুব বলবান ছিল সেজন্য আমরা লজ্জিত নহি। কিন্তু তাই বলিয়া যদি বলো যে, ভাবের প্রতি আমাদের কালের লোকের ভক্তি-প্রীতি ছিল না তবে সে কথাটা আমাকে অস্বীকার করিতে হয়। আমাদের কালে দুই-ই ছিল।
কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেন, অন্যান্য বিষয় দেখো-না। আমাদের ব্রাহ্মণেরা কি সমাজের হিতার্থ সমাজ ত্যাগ করেন নাই? রাজারা কি ধর্মের জন্য বৃদ্ধ বয়সে রাজ্য ত্যাগ করেন নাই? (য়ুরোপের রাজারা তাড়া না খাইলে কখনো এমন কাজ করেন?) ঋষিরা কি জ্ঞানের জন্য, অমরতার জন্য সংসারের সমস্ত সুখ, ত্যাগ করেন নাই? পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্র যৌবরাজ্য ত্যাগ, সত্যরক্ষার জন্য হরিশচন্দ্র স্বর্গত্যাগ, পরিহিতের জন্য দধীচি দেহত্যাগ করেন নাই? কর্তব্য অর্থাৎ ভাবমাত্রের জন্য আত্মত্যাগ আমাদের দেশে ছিল না কে বলে? কুকুর যেমন অন্ধ আসক্তিতে মনিবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যায়, সীতা কি সেইভাবে রামের সঙ্গে সঙ্গে বনে গিয়াছিলেন, না মহৎ ভাবের পশ্চাতে মনুষ্য যেরূপ অকাতরে বিপদ ও মৃত্যুর মুখে ছুটিয়া যায় সীতা সেইরূপ ভাবে গিয়াছিলেন?”
উক্ত গ্রন্থের ৮৭০ পৃষ্ঠাতে আছে—”আমাদের এককালে গৌরবের দিন ছিল, আমাদের দেশে এককালে বড়ো বড়ো বীরসকল জন্মিয়াছিলেন—কিন্তু বাঙালীর কাছে ইহার কোন ফল হইল না। তাহারা কেবল ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীমার্জুনকে পুরাতত্ত্বের কুলঙ্গি হইতে পাড়িয়া, ধূলা ঝাড়িয়া, সভাস্থলে পুতুলনাচ দেখায়। আসল কথা, ভীষ্ম প্রভৃতি বীরগণ আমাদের দেশে মরিয়া গিয়াছেন।…. নাম মনে করিয়া রাখা তো স্মৃতি নহে, প্রাণ ধরিয়া রাখাই স্মৃতি। …আমাদের হৃদয়ের তপ্ত রক্ত সেই স্মৃতির শিরার মধ্যে প্রবাহিত হওয়া চাই। মনুষ্যত্বের মধ্যেই ভীষ্ম-দ্রোণ বাঁচিয়া আছেন। …আমরা যতই মহত্ত্ব উপার্জন করিতে থাকিব, আমাদের হৃদয়ের বল যতই বাড়িয়া উঠিবে, আমাদের দেশের বীরগণ ততই পুনর্জীবন লাভ করিবেন। পিতামহ ভীষ্ম আমাদের মধ্যে বাঁচিয়া উঠিবেন।”
এর পরে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন—”বৃহৎ ভাবের নিকটে আত্মবিসর্জন করাকে যদি পাগলামি বলে, তবে সেই পাগলামি এককালে প্রচুর পরিমাণে আমাদের ছিল। ইহাই প্রকৃত বীরত্ব। কর্তব্যের অনুরোধে রাম যে রাজ্য ছাড়িয়া বনে গেলেন তাহাই বীরত্ব, এবং সীতা ও লক্ষ্মণ যে তাঁহাকে অনুসরণ করিলেন তাহাও বীরত্ব। ভরত যে রামকে ফিরাইয়া আনিতে গেলেন তাহা বীরত্ব, এবং হনুমান যে প্রাণপণে রামের সেবা করিয়াছিলেন তাহাও বীরত্ব। হিংসা অপেক্ষা ক্ষমায় যে অধিক বীরত্ব, গ্রহণের অপেক্ষা ত্যাগ অধিক বীরত্ব, এই কথাই আমাদের কাব্যে ও শাস্ত্রে বলিতেছে। পালোয়ানিকে আমাদের দেশে সর্বাপেক্ষা বড় জ্ঞান করিত না। এইজন্য বাল্মীকির রাম রাবণকে পরাজিত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, রাবণকে ক্ষমা করিয়াছেন। রাম রাবণকে দুইবার জয় করিয়াছেন। একবার বাণ মারিয়া, একবার ক্ষমা করিয়া। কবি বলেন তন্মধ্যে শেষের জয়ই শ্রেষ্ঠ। হোমরের একিলিস পরাভূত হেক্টরের মৃতদেহ ঘোড়ার লেজে বাঁধিয়া শহর প্রদক্ষিণ করিয়াছিলেন—রামে একিলিসে তুলনা করো। য়ুরোপীয় মহাকবি হইলে পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়েই মহাভারত শেষ করিতেন। কিন্তু আমাদের ব্যাস বলিলেন রাজ্য গ্রহণ করায় শেষ নহে, রাজ্য ত্যাগ করায় শেষ। যেখানে সব শেষ তাহাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। কেবল তাহাই নহে, আমাদের কবিরা পুরস্কারের লোভ দেখান নাই। ইংরাজেরা য়ুটিলিটেরিয়ান, কতকটা দোকানদার; তাই তাহাদের শাস্ত্রে পোয়েটিক্যাল জাস্টিস-নামক একটি শব্দ আছে, তাহার অর্থ দেনাপাওনা, সৎকাজের দর-দাম করা। আমাদের সীতা চিরদুঃখিনী, রাম-লক্ষণের জীবন দুঃখে কষ্টে শেষ হইল। এতবড়ো অর্জুনের বীরত্ব কোথায় গেল? অবশেষে দস্যুদল আসিয়া তাঁহার নিকট হইতে যাদব রমণীদের কাড়িয়া লইয়া গেল, তিনি গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। পঞ্চপাণ্ডবের সমস্ত জীবন দারিদ্রে দুঃখে শোকে অরণ্যে কাটিয়া গেল, শেষেই বা কী সুখ পাইলেন! হরিশ্চন্দ্র যে এত কষ্ট পাইলেন, এত ত্যাগ করিলেন, অবশেষে কবি তাঁহার কাছ হইতে পুণ্যের শেষ পুরস্কার স্বর্গও কাড়িয়া লইলেন। ভীষ্ম যে রাজপুত্র হইয়া সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাইলেন, তাঁহার সমস্ত জীবনে সুখ কোথায়! সমস্ত জীবন যিনি আত্মত্যাগের কঠিন শয্যায় শুইয়াছিলেন, মৃত্যুকালে তিনি শরশয্যায় বিশ্রাম লাভ করিলেন।
এককালে মহৎ ভাবের প্রতি আমাদের দেশের লোকের এত বিশ্বাস এত নিষ্ঠা ছিল। তাঁহারা মহত্ত্বকেই মহত্ত্বের পরিণাম বলিয়া জানিতেন, ধর্মকেই ধর্মের পুরস্কার জ্ঞান করিতেন।”
এই যে ‘ধর্মকেই ধর্মের পুরস্কার জ্ঞান করা’, ধর্ম যে দরকষাকষি বা বেচাকেনার কোন সামগ্রী নয়—এটা রবীন্দ্রনাথের একটা প্রিয় ভাব। ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতাতেও তিনি লিখেছিলেন—
‘ধর্ম নহে সম্পদের হেতু
মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু;
ধর্মেই ধর্মের শেষ।”
তবে এটা নতুন কোন কথা নয়। মূল মহাভারতে বনপর্বে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বলছেন—”আমি সাধুজনাচরিত ব্যবহারদৃষ্টে ও শাস্ত্রানুসারে ধর্ম্মাচরণ করি; কোন প্রকার ফল প্রত্যাশা করি না; …। যে ব্যক্তি স্বর্গাদি ফললাভ লোভে ধর্ম্মাচরণ করে, সে ব্যক্তি ধর্ম্মবণিক।” (কালীপ্রসন্ন সিংহকৃত অনুবাদ)
পঞ্চভূত (১৩০৪)— পঞ্চভূতের লেখাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩০৪ সালে। পঞ্চভূত হচ্ছেন ক্ষিতি, স্রোতস্বিনী (অপ) দীপ্তি (তেজ), সমীর (মরুৎ) ও ব্যোম। আর আছেন মধ্যমণি বা সভাপতি ভূতনাথবাবু। এদের আলোচনার মধ্যে কখনো কখনো রামায়ণ-মহাভারতের কথা বা কোনো কোনো চরিত্রের নাম এসেছে।
”নির্জনের মধ্যে, অবসরের মধ্যে জ্ঞানের প্রকাশ, ভাবের আবির্ভাব। যথার্থ পুরুষ সর্বদাই সেই নির্লিপ্ত নির্জনতার মধ্যে থাকে। কার্যবীর নেপোলিয়ানও কখনোই আপনার কার্যোর মধ্যে সংক্ষিপ্ত হইয়া থাকিতেন না; তিনি যখন যেখানেই থাকুন একটা মহানির্জনে আপন ভাবাকাশের দ্বারা বেষ্টিত থাকিতেন—তিনি সর্বদাই আপনার একটা মস্ত আইডিয়ার দ্বারা পরিরক্ষিত হইয়া তুমুল কার্যক্ষেত্রের মাঝখানেও বিজনবাস যাপন করিতেন। ভীষ্ম তো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের একজন নায়ক কিন্তু সেই ভীষণ জনসংঘাতের মধ্যেও তাঁহার মতো একক প্রাণী আর কে ছিল? তিনি কি কাজ করিতেছিলেন, না, ধ্যান করিতেছিলেন?”
আলোচনাটা হচ্ছিল স্ত্রীলোকের কাজ ও পুরুষের কাজ নিয়ে। উপরোক্ত কথাগুলি ব্যোমের। তাঁর মতে যথার্থ পুরুষ যোগী, উদাসীন, নির্জনবাসী। স্রোতস্বিনী সামঞ্জস্যবিধান করে দিলেন এই বলে—’হৃদয়মাহাত্ম্যে যদি আমরা শ্রেষ্ঠ হই, মনোমাহাত্ম্যে তো তোমরা বড়ো।’
এই গ্রন্থে ‘কাব্যের তাৎপর্য্য’ নামে একটি আলোচনা আছে। সেখানেও কিছু রামায়ণকথা, প্রসঙ্গক্রমে এসেছে—
”স্রোতস্বিনী কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া কহিল—আমার তো মনে হয় সেই সকল সাধারণ কথাই কবিতার কথা। রাজগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াও, সর্বপ্রকার সুখের সম্ভাবনাসত্ত্বেও, আমৃত্যুকাল অসীম দুঃখ রাম সীতাকে সংকট হইতে সংকটান্তরে ব্যাধের ন্যায় অনুসরণ করিয়া ফিরিয়াছে; সংসারের এই অত্যন্ত সম্ভবপর, মানবাদৃষ্টের এই অত্যন্ত পুরাতন দুঃখকাহিনীতেই পাঠকের চিত্ত আকৃষ্ট এবং আর্দ্র হইয়াছে। শকুন্তলার প্রেমদৃশ্যের মধ্যে বাস্তবিকই কোনো নূতন শিক্ষা বা বিশেষ বার্তা নাই, কেবল এই নিরতিশয় প্রাচীন এবং সাধারণ কথাটি আছে যে, শুভ অথবা অশুভ পরিসরে প্রেম অলক্ষিতে অনিবার্য্য বেগে আসিয়া দৃঢ়বন্ধনে স্ত্রীপুরুষের হৃদয় এক করিয়া দেয়; এই অত্যন্ত সাধারণ কথা থাকাতেই সর্বসাধারণে উহার রসভোগ করিয়া আসিতেছে। কেহ কেহ বলিতে পারেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের বিশেষ অর্থ এই যে, মৃত্যু এই জীবজন্তু-তরুলতা-তৃণাচ্ছাদিত বসুমতীর বস্ত্র আকর্ষণ করিতেছে, কিন্তু বিধাতার আশীর্ব্বাদে কোনোকালে তাহার বসনের অন্ত হইতেছে না, চিরদিনই সে প্রাণময় সৌন্দর্য্যময় নববস্ত্রে ভূষিত থাকিতেছে। কিন্তু সভাপর্বে যেখানে আমাদের হৃৎপিণ্ডের রক্ত তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল এবং অবশেষে সংকটাপন্ন ভক্তের প্রতি দেবতার কৃপায় দুই চক্ষু অশ্রুজলে প্লাবিত হইয়াছিল, সে কি এই নূতন এবং বিশেষ অর্থ গ্রহণ করিয়া? না, অত্যাচার পীড়িত রমণীর লজ্জা ও সেই লজ্জা-নিবারণ-নামক অত্যন্ত সাধারণ স্বাভাবিক এবং পুরাতন কথায়? কচ-দেবযানী-সংবাদেও মানবহৃদয়ের এক অতি চিরন্তন এবং সাধারণ বিষাদকাহিনী বিবৃত আছে। সেটাকে যাঁহারা অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করেন এবং বিশেষ তত্ত্বকেই প্রাধান্য দেন, তাঁহারা কাব্যরসের অধিকারী নহেন।”
শ্রীমতী স্রোতস্বিনীকে ধন্যবাদ। তিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে কাব্যের রসবিচারের মূল কথাটি আমাদের সামনে ধরে দিয়েছেন, বহুদিন থেকেই এটা আমি বিশ্বাস করে এসেছি যে কাব্যশাস্ত্রাদি পাঠ করার সময়ে যাঁরা তার শব্দার্থ, বাচ্যার্থ, উৎপত্তি, ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামান, তাঁরা যত বড় পণ্ডিতই হোন না কেন কাব্যের রসগ্রহণে তাঁরা অসমর্থ। আমাদের দেশে বেশ কিছু পণ্ডিত আছেন যাঁরা মনে করেন রামায়ণ, মহাভারতের মতো গ্রন্থসমূহ যা মহাকবিরা রচনা করেছেন তা নাকি সব রূপক। এর মধ্যে নাকি জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব বা অন্য তত্ত্বকথা লুকিয়ে আছে। বাল্মীকি, ব্যাস—এঁরা নাকি এইসব তত্ত্বকথাই লিখে রেখে গেছেন। এই লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সব কবিরই মনে কথা বলেছেন। একটু উদ্ধৃত করছি— ”এই পর্য্যন্ত বলিতে পারি, যখন কবিতাটি লিখিতে বসিয়াছিলাম, তখন কোনো অর্থই মাথায় ছিল না, তোমাদের কল্যাণে এখন দেখিতেছি লেখাটি বড় নিরর্থক হয় নাই—অর্থ অভিধানে কুলাইয়া উঠিতেছে না।)”
এই গ্রন্থের ৯৩৭ পৃষ্ঠাতে সীতা এবং রামচন্দ্রের কথা আছে, তবে রামায়ণের কোন কাহিনী সেখানে আলোচনা করা হয়নি। কমেডি এবং ট্রাজেডির পার্থক্য বোঝাতে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। পঞ্চভূতের এক ভূতের কথায়— ”কমেডি এবং ট্রাজেডি কেবল পীড়নের মাত্রাভেদ মাত্র। কমেডিতে যতটুকু নিষ্ঠুরতা প্রকাশ হয় তাহাতে আমাদের হাসি পায় এবং ট্রাজেডিতে যতদূর পর্য্যন্ত যায় তাহাতে আমাদের চোখে জল আসে। ‘ফলস্টাফ উইন্ডসর-বাসিনী রঙ্গিণীর প্রেমলালসায় বিশ্বস্তচিত্তে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু দুর্গতির একশেষ লাভ করিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। রামচন্দ্র যখন রাবণবধ করিয়া, বনবাসপ্রতিজ্ঞা পূরণ করিয়া, রাজ্যে ফিরিয়া আসিয়া, দাম্পত্যসুখের চরমশিখরে আরোহণ করিয়াছেন, এমন সময় অকস্মাৎ, বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হইল, গর্ভবতী সীতাকে অরণ্যে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইলেন।” উভয়ক্ষেত্রেই আশার সঙ্গে ফলের অসঙ্গতি হয়েছে, প্রথমটিতে আমরা হাসি, দ্বিতীয়টিতে আমাদের চক্ষু অশ্রুসজল হয়।
গ্রন্থের ৯৪১ পৃষ্ঠাতে শ্রীকৃষ্ণের কথা একটু আছে তবে তার সঙ্গে মহাভারতের কোন কাহিনী বর্ণিত হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থ এবং সেখানে কৃষ্ণ কিভাবে চিত্রিত হয়েছেন তা-ই বলা হয়েছে।
এই গ্রন্থের ৯৪৫ পৃষ্ঠাতে ‘অপূর্ব রামায়ণ’ নামে একটি লেখা আছে। পাঁচভূতের এক ভূত ক্ষিতি, রামায়ণ নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা ব্যক্ত করেছেন।
”রাজা রামচন্দ্র—অর্থাৎ মানুষ—প্রেম নামক সীতাকে নানা রাক্ষসের হাত হইতে রক্ষা করিয়া আনিয়া নিজের অযোধ্যাপুরীতে পরমসুখে বাস করিতেছিলেন। এমন সময় কতকগুলি ধর্মশাস্ত্র দল বাঁধিয়া এই প্রেমের নামে কলঙ্ক রটনা করিয়া দিল। বলিল, উনি অনিত্য পদার্থের সহিত একত্র বাস করিয়াছেন, উঁহাকে পরিত্যাগ করিতে হইবে। বাস্তবিক অনিত্যের দ্বারে রুদ্ধ থাকিয়াও এই দেবাংশজাত রাজকুমারীকে যে কলঙ্ক স্পর্শ করিতে পারে নাই, সে কথা এখন কে প্রমাণ করিবে? এক, অগ্নিপরীক্ষা আছে, সে তো দেখা হইয়াছে—অগ্নিতে ইহাকে নষ্ট না করিয়া আরো উজ্জ্বল করিয়া দিয়াছে। তবু শাস্ত্রের কানাকানিতে অবশেষে এই রাজা প্রেমকে একদিন মৃত্যু-তমসার তীরে নির্বাসিত করিয়া দিলেন। ইতিমধ্যে মহাকবি এবং তাঁহার শিষ্যবৃন্দের আশ্রয়ে থাকিয়া এই অনাথিনী কুশ এবং লব, কাব্য এবং ললিতকলা—নামক যুগল-সন্তান প্রসব করিয়াছেন। সেই দুটি শিশুই কবির কাছে রাগিনী শিক্ষা করিয়া রাজসভায় আজ তাহাদের পরিত্যক্তা জননীর যশোগান করিতে আসিয়াছে। এই নবীন গায়কের গানে বিরহী রাজার চিত্ত চঞ্চল এবং তাঁহার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। এখনো উত্তরকাণ্ড সম্পূর্ণ শেষ হয় নাই। এখনো দেখিবার আছে—জয় হয় ত্যাগপ্রচারক প্রবীণ বৈরাগ্যধর্মের, না, প্রেমমঙ্গল-গায়ক দুটি অমর শিশুর।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন