এই খন্ডে স্থান পাওয়া গ্রন্থগুলি হলো —
কবিতা ও গান : গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি ও বলাকা;
নাটক ও প্রহসন : অচলায়তন, ডাকঘর ও ফাল্গুনী;
উপন্যাস ও গল্প : দুই বোন ও মালঞ্চ;
প্রবন্ধ : স্বদেশ, সমাজ, শিক্ষা ও শব্দতত্ত্ব;
পরিশিষ্ট : সমাজ, শিক্ষা ও শব্দতত্ত্ব ; এবং
গ্রন্থ পরিচয় অংশ।
গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি— এগুলি প্রধানতঃ সঙ্গীতের সংকলন যদিও কবিতা হিসাবেও এগুলি ফেলনা নয়। এই গ্রন্থগুলিতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ আমার চোখে পড়েনি। ‘বলাকা’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গ অতি সামান্য আছে।
‘ডাকঘর’ নাটকে রামায়ণ মহাভারত প্রসঙ্গ অতি সামান্যই আছে। ফাল্গুনী ও অচলায়তন নাটকে রামায়ণ মহাভারতের কোন উল্লেখ আমার চোখে পড়েনি। দুই বোন-এ কিছু চোখে না পড়লেও মালঞ্চতে অতি সামান্য রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে।
প্রবন্ধ গ্রন্থ স্বদেশ, সমাজ ও শিক্ষাতে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে। ‘শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থে প্রধানত ব্যাকরণের বিষয় সমূহ আলোচিত হয়েছে।
পরিশিষ্ট অংশে সন্নিবেশিত প্রবন্ধসমূহে রামায়ণ মহাভারতের প্রসঙ্গ অনেক জায়গাতেই আছে, ব্যতিক্রম শব্দতত্ত্ব প্রবন্ধ।
বলাকা কাব্যগ্রন্থের কবিতা নিয়ে গ্রন্থপরিচয় বিভাগে ( সুলভ ৬ষ্ঠ; পৃ-৭৭৯, ৭৮১) একটু আলোচনা আছে। ৭ নং কবিতা ( এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান) আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”বেগমমন্ডলী বাদশার-পরিবৃত্ত যে প্রেম, কালিদাস হংসপদিকার মুখ থেকে তাকে লাঞ্ছিত করেছেন। সে প্রেম চলিত পথের। ধুলোর উপরে তার খেলাঘর। মমতাজ যথাসময়ে মারা গিয়েছিল বলেই বিরহের একটি সজীব বীজ সেই খেলাঘরের ধুলির উপরে প’ড়ে ধুলি হয়ে যায় নি, ক্লান্তিপ্রবণ বিলাসের ক্ষণভঙ্গুরতা অতিক্রম করে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তার ভিতরকার অমরতা ক্ষণকালে পরমা স্মৃতিকে বহন করে রয়ে গেল। যে-বেদনাকে সেই স্মৃতি ঘোষণা করছে, তারই সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ঘোষণা আছে, তার বাণী হচ্ছে এই যে, সেই শাজাহানও নেই সেই মমতাজও নেই, কেবল তাদের যাত্রাপথের এক অংশের ধূলির উপরে জীবনের ক্রন্দনধ্বনি বহন করে রয়ে গেছে তাজমহল। দুষ্যন্ত শকুন্তলার প্রেমের মধ্যে একটা মহিমা আছে, দুই তপোবনের মাঝখান দিয়ে সে গেছে অমরাবতীর দিকে — তার সংকীর্ণ খেলাঘরের বেড়া ভেঙে গিয়েছিল, তাই প্রথম বিলাসবিভ্রমের বিস্মৃতিকে উত্তীর্ণ হয়ে সে তপঃপূত চিরস্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করছে, ………..
সম্ভোগের মধ্যে তার সমাপ্তি নয়।”
বলাকার ৪ নং কবিতা (তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে, কেমন করে সইব) সম্বন্ধে কবি লিখেছেন—”এই কবিতা (৪) যে-সময়কার লেখা তখনো যুদ্ধ শুরু হতে দু মাস বাকি আছে। তারপর শঙ্খ বেজে উঠেছে; ঔদ্ধত্যে হোক, ভয়ে হোক, নির্ভয়ে হোক তাকে বাজানো হয়েছে। যে যুদ্ধ হয়ে গেল তা নূতন যুগে পৌঁছবার সিংহদ্বারস্বরূপ। এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে একটি সার্বজাতিক যজ্ঞে নিমন্ত্রণ রক্ষা করবার হুকুম এসেছে। তা শেষ হয়ে স্বর্গারোহণ পর্ব এখনো আরম্ভ হয়নি।” স্বর্গারোহণ পর্ব মহাভারতের কথা।
২৩ নম্বর কবিতাতে লক্ষ্মী এবং উর্বশীর কথা বলা হয়েছে —
”কোন ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্র মন্থনে
উঠেছিল দুই নারী
অতলের শয্যাতল ছাড়ি।
একজনা উর্বশী, সুন্দরী
বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
বিশ্বের জননী তাঁরে জানি,
স্বর্গের ঈশ্বরী।”
এই কবিতায় বলা হয়েছে যে সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মী এবং উর্বশী দু’জনেই সমুদ্রতল থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। এই গ্রন্থেরই অন্যত্র আলোচনা করেছি যে সমুদ্র মন্থনে লক্ষ্মী উত্থিতা হয়েছিলেন, উর্বশীর উৎপত্তি অন্যভাবে।
অচলায়তন নাটকে এক ত্রিশিরা রাক্ষসীর কথা বলা হয়েছে যার মাথা মুড়োনো চুলের জটা দিয়ে নাকি পৃথিবীটা তৈরী। রামায়ণে এক ত্রিশিরা রাক্ষসের কথা আছে। লঙ্কেশ্বর রাবণের পুত্র রামচন্দ্রের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মহাবীর হনুমানের হাতে তার মৃত্যু হয়। অচলায়তনের ত্রিশিরা রাক্ষসী খুব সম্ভব কবি-কল্পনা। নাটকটি অর্থহীন আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাণিত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। ডাকঘর নাটকের অন্তত দুটো জায়গায় বলা হয়েছে যে অমলের পিসিমা রামায়ণ পড়েন। দুপুরে বাড়ীতে সকলের খাওয়া হয়ে গেলে পিসিমা রামায়ণ বইটা নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন।
দুইবোন উপন্যাসের ব্যাপারে গ্রন্থপরিচয় অংশে (পৃ-৭৯৮-৭৯৯) দেখা যাচ্ছে যে ‘বিচিত্রা’ মাসিক পত্রিকায় শ্রাবণ ১৩৪০ সংখ্যাতে দুই বোন উপন্যাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা চিঠি ছাপা হয়েছিল। দুই বোন উপন্যাসে প্রধান চরিত্র তিনটি—তার কোনটাই পছন্দ হয়নি এক পাঠিকার। রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন যে সেটা হতেই পারে। ” ম্যাকবেথ নাটকে দুটি মাত্র প্রধান পাত্র, ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথ। বলাবাহুল্য দুজনের কাউকেই সুকুমার মতি পাঠকদের চরিত্র গঠন যোগ্য দৃষ্টান্ত রূপে ব্যবহার করা চলবে না। ……. মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রকে তুচ্ছ করতে পারিনে কিন্তু মহত্ত্বে তাঁর ন্যূনতা ছিল। কারই বা না ছিল? স্বয়ম্বর সভার ব্যাপারে ভীষ্মই কি ক্ষমার যোগ্য? এমনকি কবির প্রিয়পাত্র পান্ডবদের আচরণে কলঙ্ক খুঁজে বের করবার জন্যে অধিক তীক্ষ্ম দৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। আধুনিক বাংলাদেশে বেদব্যাস জন্মাননি, সে তাঁর পুণ্যফলে।”
কোন স্বয়ম্বর সভাতে ভীষ্মের আচরণ গর্হিত ছিল এটা কবি কিছু লেখেন নি। মূল মহাভারত অনুসারে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভাতে ভীষ্ম যাননি তবে কাশীরাম দাসের মহাভারত অনুসারে ভীষ্ম দুর্যোধনদের সঙ্গে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভাতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর আচরণ গর্হিত ছিল না। কাশীরাজের কন্যাদের তিনি স্বয়ম্বরসভা থেকে হরণ করে এনেছিলেন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যোর জন্য। তখনকার দিনে ক্ষত্রিয়ের এই আচরণ গর্হিত ছিল না। কবি এখানে কৌরব রাজসভায় দ্যূতক্রীড়ার সময়ের কথা বলতে চেয়েছিলেন কি? সেখানে কিন্তু ভীষ্মের আচরণ সমর্থনীয় ছিল না। সেখানে দ্রৌপদীর অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে কোন প্রতিবাদ করেন নি।
মালঞ্চ উপন্যাসে আদিত্য ও নীরজা স্বামী-স্ত্রী। নীরজা অসুস্থা হয়ে পড়ার পর থেকে স্বামীর কর্মক্ষেত্রের সহকারিণী সরলার প্রতি সে অত্যন্ত ঈর্ষ্যপরায়ণা। তার ধারণা আদিত্যের সঙ্গে সরলার একটা সম্পর্ক আগের থেকেই গড়ে উঠেছিল। সে জিজ্ঞাসা করেছিল আদিত্য কেন সরলাকে বিয়ে করেনি। আদিত্যের উত্তর হলো যে বিয়ের কথা তার কখনোই মনে হয়নি কারণ এরকম কোনো রোমান্সের ব্যাপার তাদের মধ্যে ঘটেনি। তবে আদিত্য যদি হাল আমলের সভ্যতায় মানুষ হতো তাহলে কি হতো বলা যায় না। নীরজা জানতে চাইল — সভ্যতার অপরাধটা কি? আদিত্য উত্তর দিচ্ছে— ”এখনকার সভ্যতাটা দুঃশাসনের মতো হৃদয়ের বস্ত্রহরণ করতে চায়। অনুভব করবার পূর্বেই সেয়ানা করে তোলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে। গন্ধের ইশারা ওর পক্ষে বেশী সূক্ষ্ম, খবর নেয় পাপড়ি ছিঁড়ে।” — মহাভারতের সর্বাপেক্ষা ন্যক্কারজনক ঘটনা বলে যদি কোন ঘটনাকে চিহ্নিত করতে হয়, তবে সেটি নিঃসন্দেহে কৌরব দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর প্রতি দুঃশাসনের আচরণ।
নীরজা মনে করে রমেনের সঙ্গে সরলার বিয়ে হলে ভালো হয়। তা’ হলে আদিত্যকে নিয়ে সরলার সম্বন্ধে তার আর কোন ভয় থাকবে না। এক দোলের দিনে রমেন একটুখানি আবির দিয়েছে সরলার কপালে। কারণ জানতে চাইলে রমেন বলছে— ”জান না আজ দোলপূর্ণিমা? তোমাদের গাছে গাছে ডালে ডালে রঙের ছড়াছড়ি। বসন্তে মানুষের গায়ে তো রঙ লাগে না, লাগে তার মনে। সেই রঙটাকে বাইরে প্রকাশ করতে হবে, নইলে, বনলক্ষ্মী, অশোকবনে তুমি নির্বাসিত হয়ে থাকবে।” — রাবণের অশোকবনে বন্দিনী হয়ে ছিলেন সীতা। চারিদিকে গাছে গাছে পাতায় পাতায় ফুল আর সবুজের সমারোহ। কিন্তু পতি—বিরহে খিন্না সীতার মনে কোনো রঙ ছিল না। তাই প্রকৃতির রাজ্যে রঙের সমারোহ তাঁর মনে কোন ছাপ ফেলেনি।
স্বদেশ — এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘নূতন ও পুরাতন’। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন — ‘মনোযোগপূর্বক যখন অন্তরের মধ্যে নিরীক্ষণ করে দেখি তখন দেখতে পাই, সেখানে কেবল চিন্তা এবং বিশ্রাম এবং বৈরাগ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা জড়ত্বের গ্রাসে পড়ে আছি। অজুহাত হিসাবে আমরা বড় বড় কথা বলি যে আমরা আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন, আমরা যোগী—ঋষিদের উত্তরাধিকার বহন করছি।’ তিনি লিখেছেন — ” ….. যারা তপস্যাও করি নে, হবিষ্যও খাই নে, জুতো মোজা পরে ট্রামে চড়ে পান চিবোতে চিবোতে নিয়মিত আপিসে ইস্কুলে যাই; যাদের আদ্যোপান্ত তন্ন তন্ন করে দেখে কিছুতেই প্রতীতি হয় না এরা দ্বিতীয় যাজ্ঞবল্ক্য বশিষ্ঠ গৌতম জরৎকারু বৈশম্পায়ন কিংবা ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন; ছাত্রবৃন্দ — ….. একদিন তিন সন্ধ্যা স্নান করে একটা হরীতকী মুখে দিলে .. যাদের আপিস কিংবা কলেজ কামাই করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে, তাদের পক্ষে এরকম ব্রহ্মচর্যোর বাহ্যাড়ম্বর করা ….. কেবলমাত্র যে অদ্ভুত, অসংগত, হাস্যকর তা নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ ক্ষতিজনক।” — যে সমস্ত ঋষিদের নাম এখানে বলা হয়েছে তাঁরা সবাই পৌরাণিক ঋষি, রামায়ণ মহাভারতে নাম আছে। যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি, যাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ী যিনি ধনসম্পদ নিতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, যা তাকে অমৃতত্ব দেবে না, তাতে তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। বশিষ্ঠ সপ্তঋষির একজন, রামচন্দ্র এঁর কাছেই বিদ্যাশিক্ষা এবং অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন। বিশ্বামিত্র এঁর প্রচুর ক্ষতি করলেও ইনি তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন। গৌতম নামে সম্ভবত একাধিক ঋষি ছিলেন। অহল্যা যাঁর পত্নী ছিলেন সেই গৌতম দেবরাজ ইন্দ্রকে অভিশপ্ত করেছিলেন। জরৎকারু—এঁর পুত্র আস্তীক জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ নিবারণ করেছিলেন। বৈশম্পায়ণ ছিলেন মহর্ষি ব্যাসদেবের একজন প্রধান শিষ্য। বেদ বিভাজন করে ব্যাসদেব এঁকে যজুর্বেদ সংরক্ষণ ও প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে তো ঋষিশ্রেষ্ঠ বলা-ই যায়। তিনি মহাগ্রন্থ মহাভারত এবং আরো বহু গ্রন্থের রচয়িতা।
এই প্রবন্ধের অন্য এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কথা বলেছেন।
” আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহু দিন হল পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতযোনি মাত্র। …….. এক মহাভারত পড়লেই দেখতে পাওয়া যায় আমাদের তখনকার সভ্যতার মধ্যে জীবনের আবেগ কত বলবান ছিল। তার মধ্যে কত পরিবর্তন, কত সমাজবিপ্লব, কত বিরোধী-শক্তির সংঘর্ষ দেখতে পাওয়া যায়। সে সমাজ কোনো-একজন পরম বুদ্ধিমান শিল্পচতুর লোকের স্বহস্ত রচিত অতি সুচারু পরিপাটি সমভাব বিশিষ্ট কলের সমাজ ছিল না। সে সমাজে একদিকে লোভ হিংসা ভয় দ্বেষ অসংযত অহংকার, অন্য দিকে বিনয় বীরত্ব আত্মবিসর্জন উদার মহত্ত্ব এবং অপূর্ব সাধুভাব মনুষ্য চরিত্রকে সর্বদা মথিত করে জাগ্রত করে রেখেছিল। সে সমাজে সকল পুরুষ সাধু, সকল স্ত্রী সতী, সকল ব্রাহ্মণ তপঃপরায়ণ ছিলেন না। সে সমাজে বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় ছিলেন, দ্রোণ কৃপ পরশুরাম ব্রাহ্মণ ছিলেন, কুন্তী সতী ছিলেন, ক্ষমাপরায়ণ যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় পুরুষ ছিলেন এবং শত্রুরক্তলোলুপা দ্রৌপদী রমণী ছিলেন। তখনকার সমাজ ভালোয়-মন্দয় আলোকে-অন্ধকারে জীবন লক্ষণাক্রান্ত ছিল; মানবসমাজ চিহ্নিত বিভক্ত সংযত সমাহিত কারুকার্যোর মতো ছিল না। এবং সেই বিপ্লব সংক্ষুব্ধ বিচিত্র মানব বৃত্তির সংঘাত দ্বারা সর্বদা জাগ্রত শক্তিপূর্ণ সমাজের মধ্যে আমাদের প্রাচীন ব্যূঢ়োরস্ক শালপ্রাংশু সভ্যতা উন্নত মস্তকে বিহার করত । ”
উপরে যে নামগুলো বলা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে পাঠকের নতুন করে পরিচয় করে দেবার প্রয়োজন নেই— মহাভারত যাঁরা পড়েন, তারা সবাই এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত। একটা কথা বলা যায় — এঁরা প্রায় সবাই এঁদের শ্রেণীচরিত্রের একটু বাইরে ছিলেন। যেমন ধরুন ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, অধ্যাপনা, যাগ-যজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্ম, ইত্যাদি। দ্রোণ, কৃপ, পরশুরাম—এরা সবাই ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্ত এঁরা শ্রেণী-নির্দিষ্ট কর্ম না করে ক্ষত্রিয়ের মতো ধনুর্বিদ্যাকে অবলম্বন করেছিলেন।
স্বদেশ গ্রন্থে ‘ সমাজভেদ’ প্রবন্ধের শেষে ‘রাবণ’ নামের একটু উল্লেখ আছে। ” সম্প্রতি য়ুরোপে এই অন্ধ বিদ্বেষ সভ্যতার শক্তিকে কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। রাবণ যখন স্বার্থান্ধ হইয়া অধর্মে প্রবৃত্ত হইল তখন লক্ষ্মী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন। আধুনিক য়ুরোপের দেবমন্ডপ হইতে লক্ষ্মী যেন বাহির হইয়া আসিয়াছেন। ”
স্বদেশ গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ ‘ ধর্ম বোধের দৃষ্টান্ত’। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ” আমাদের দেশে ধর্মের যে আদর্শ আছে তাহা অন্তরের সামগ্রী, তাহা বাহিরের গন্ডীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিবার নহে। ……………….. আমাদের দেশে বলে যুদ্ধে ধর্মরক্ষা করিতে হইবে! নিরস্ত্র, পলাতক, শরণাগত শত্রুর প্রতি আমাদের ক্ষত্রিয়দের যেরূপ ব্যবহার ধর্মবিহিত বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে য়ুরোপে তাহা হাস্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। তাহার একমাত্র কারণ, ধর্মকে আমরা অন্তরের ধন করিতে চাহিয়াছিলাম।
এইখানে মহাভারতের কথা একটু স্বরণ করা যাক। কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধে কৌরবপক্ষের প্রথম প্রধান সেনাপতি হয়েছিলেন মানবশ্রেষ্ঠ এবং জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ মহাবীর ভীষ্ম। তাঁর সৈনাপত্যের সময়ে কুরু-পান্ডবদের যুদ্ধে যে নিয়ম সংস্থাপন করা হয়েছিল তার বিবরণ মূল মহাভারত এবং কাশীরাম দাসের মহাভারত উভয় জায়গাতেই আছে।
কাশীরাম দাস লিখেছেন —
”ন্যায়যুদ্ধ করিবে অন্যায় না করিবে। ভীত জনে কদাপি অস্ত্র না মারিবে।
পলায়িত জনে না করিবে অস্ত্রাঘাত। যে জন বর্জিত -অস্ত্র না মারিবে তাত।।
শ্রমযুক্তে না মারিবে দূতে কদাচন। অস্ত্রহীন জন সঙ্গে বর্জিবেক রণ।।
না মারিবে যে জন বিমুখ-পলায়ন। এক সঙ্গে যুঝি অন্যে না মারিবে বাণ।।
শক্তিহীন জনে অস্ত্র করিবে বর্জিত। শরণাগতে অস্ত্র না মারিবে কদাচিত।।”
রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কথাগুলো লিখেছিলেন, নিশ্চিতভাবেই তখন তাঁর মহাভারতের বর্ণনা স্মরণে ছিল।
‘সমাজ’ গ্রন্থে ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য নামে একটা প্রবন্ধ আছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ‘স্ত্রীশক্তি’ নিয়ে একটু আলোচনা করেছেন। ‘অতএব সবশুদ্ধ দেখা যাচ্ছে, য়ুরোপীয় সভ্যতার সর্ববিষয়েই প্রবলতা এমনই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে যে, অসমর্থ পুরুষই বল আর অবলা রমনীই বল, দুর্বলদের আশ্রয়স্থান এ সমাজে, যেন ক্রমশই লোপ হয়ে যাচ্ছে। ……………….. তারা (স্ত্রীলোকেরা) বিধিমতে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে যে, আমাদের কেবল যে হৃদয় আছে তা নয়, আমাদের বলও আছে। অতএব ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে”। — রাঘব হচ্ছেন রঘুপতি রাম। এই ছত্রটি নেওয়া হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য থেকে । ইন্দ্রজিত পত্নী প্রমীলার উক্তি এটি। মেঘনাদবধের মূল কাহিনী রামায়ণ থেকেই নেওয়া, যদিও মধুসূদন চরিত্রগুলিকে অন্যভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
ঐ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ অবিবাহিতা রমনীদের সঙ্গে আমাদের দেশীয় বালবিধবাদের কথা আলোচনা করেছেন। কথা প্রসঙ্গে রামায়ণ মহাভারতের কথাও এসেছে। আমাদের দেশীয় বালবিধবাদের কথা বলতে গিয়েতিনি লিখেছেন —’ বাড়ীর অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তার বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ব বন্ধন, …………. গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তার অভাব নেই। এবং ওরই মধ্যে রামায়ণ মহাভারত দুটো-একটা পুরাণ পড়বার কিংবা শোনবার সময় থাকে, …….।”
সমাজ গ্রন্থেরই আর একটি প্রবন্ধ -অযোগ্য ভক্তি। সেখানেও একজায়গায় রামচন্দ্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ”অভিমান সহজে নত হইতে দেয় না। যখন সে আত্মসমর্পণ করে তখন ভক্তিভাজনের পরীক্ষা হইয়া গেছে, রামচন্দ্র তখন ধনুক ভাঙিয়া তবে তাঁহার বলের প্রমাণ দিয়াছেন।” — রামচন্দ্রের ধনুক ভাঙার কাহিনী রামায়ণে আছে। মিথিলার রাজা জনক অযোনিসম্ভবা কন্যা লক্ষ্মীস্বরূপীনি সীতাকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কোনো অযোগ্য লোকের সঙ্গে সীতার যেন বিবাহ না হয়ে, এটা নিশ্চিত করার জন্য ভগবান শিব রাজা জনকের কাছে একখানা বিরাট ধনুক পাঠিয়েছিলেন। সেই ধনুক তুলে যে তাতে গুণ লাগাতে পারবে, তার সঙ্গে সীতার বিবাহ দেওয়া হবে —এ রকম শর্ত দিয়েছিলেন জনকরাজা। কোনো রাজা বা রাজপুত্র এমন কি লঙ্কার রাজা রাবণও এই ধনুক তুলতে সমর্থ হননি। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এই ধনুক ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করেছিলেন।
‘অযোগ্য ভক্তি’ প্রবন্ধেই অন্য একটি জায়গায় বলা হয়েছে (সুলভ-৬ষ্ঠ, পৃ- ৫৫১) ” কিন্তু আমাদের দেবভক্তি সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষিত অনেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম তর্ক করেন। তাঁহারা বলেন, ঈশ্বর যখন সর্বজ্ঞ সর্বব্যাপী তখন ঈশ্বর বলিয়া আমরা যাহাকেই পূজা করি, ঈশ্বরই সে পূজা গ্রহণ করেন।
অতএব এরুপ ভক্তি নিষ্ফল নহে। ” — এখানে বলা কথাগুলোর সঙ্গে শ্রীশ্রীগীতার একটা মন্ত্র বা শ্লোকের একটু মিল আছে মনে হয়। নবম অধ্যায়ে শ্রীভগবান বলছেন —
”যেহপ্যন্যদেবতা ভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়াহন্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্।। ”
(হে অর্জুন! যাঁহারা শ্রদ্ধা সহকারে অন্য দেবতার অর্চনা করেন, তাঁহারাও না জানিয়া আমাকেই ভজনা করেন।)
অধ্যাপিকা পম্পা মজুমদারের লেখা একটা সুন্দর বই আছে— ‘ রবীন্দ্রসংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস’। এই গ্রন্থে গীতা ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ আলোচনার পর তিনি এই রকম উপসংহারে পৌঁছেছেন যে গীতার প্রতি রবীন্দ্রনাথ বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্ন থাকলেও তিনি গীতার সবকিছুকে অভ্রান্তভাবে মেনে নেননি। হতে পারে শ্রীশ্রীগীতার এই শ্লোকটি তার মনের সমর্থন পায়নি।
হিন্দুধর্মের কিছু গোঁড়ামির প্রতি রবীন্দ্রনাথ অনেক জায়গাতেই আঘাত হেনেছেন। তখনকার দিনে রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যে সমুদ্রযাত্রা নিয়ে কিছু আপত্তি ছিল। এ ব্যাপারে তাঁর তির্য্যক মন্তব্য ‘অযোগ্য ভক্তি’ প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে। ”সমুদ্র যাত্রা উচিত কিনা তাহা নির্ণয় করিতে ইহাই দেখা কর্তব্য যে, নূতন দেশ ও নূতন আচার ব্যবহার দেখিয়া আমাদের জ্ঞানের বিস্তার হয় কি না, আমাদের সংকীর্ণতা দূর হয় কিনা,
……….। কিন্তু তাহা না দেখিয়া আমরা দেখিব, পরাশর সমুদ্র পার হইতে বলিয়াছেন কি না এবং অত্রি কি বলিয়া তাহার সমর্থন করিয়াছেন। ”
— পরাশর মহাতপস্বী এবং মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসেরপিতা। অত্রি ঋষির নাম মহাভারতের বহু জায়গায় উল্লেখ আছে। তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র এবং সপ্তঋষির অন্যতম। তাঁর স্ত্রীর নাম অনসূয়া।
‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধের এক জায়গায় বলা হয়েছে (সুলভ-ষষ্ঠ, পৃ-৫৫৭) ”আমাদের দেশে ভক্তিতত্ত্বে বিরোধকেও মিলনসাধনার একটা অঙ্গ বলা হয়। লোকে প্রসিদ্ধি আছে যে, রাবণ ভগবানের শত্রুতা করিয়া মুক্তিলাভ করিয়াছিল।”
‘শত্রুভাবে সাধনায় মুক্তিলাভ’ বিষয়টি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে ।
শিক্ষা গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ — ‘শিক্ষার হেরফের’। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পাঠোপযোগী বই বাংলাভাষায় তখনকার দিনে বেশি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ”শখের বই জুটিবেই বা কোথা হইতে। বাংলায় সেরূপ গ্রন্থ নাই। এক রামায়ণ মহাভারত আছে, কিন্তু ছেলেদের এমন করিয়া বাংলা শেখানো হয় না যাহাতে তাহারা আপন ইচ্ছায় ঘরে বসিয়া কোনো বাংলা কাব্যের যথার্থ স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে।”
ঐ একই প্রবন্ধে বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রভাব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কবি শ্রী কৃষ্ণের কথা নিয়ে এসেছেন। ”এতদিন মথুরায় কৃষ্ণ রাজত্ব করিতেছিলেন, বিশ-পঁচিশ বৎসরকাল দ্বারীর সাধ্যসাধন করিয়া তাঁহার সুদূর সাক্ষাৎলাভ হইত, বঙ্গদর্শন দৌত্য করিয়া তাঁহাকে আমাদের বৃন্দাবনধামে আনিয়া দিল।” (শ্রীকৃষ্ণ যাদবদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসকে বধ করে তিনি নিজে সিংহাসনে বসেননি। সিংহাসনে বসেছিলেন কংসেরই পিতা উগ্রসেন। )
আমাদের বিদ্যালয়সমূহে উপযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যাল্পতা নিয়ে কবি আলোচনা করেছেন ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে। ”অত্যন্ত প্রয়োজন হইলেও সহসা আমাদের পাঠশালায় গুরুমহাশয়ের আসনে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির আমদানি করা কাহারও আয়ত্তাধীন নহে।” — যাজ্ঞবল্ক্য অতি বিখ্যাত ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি। তাঁর কথা আগেও আলোচনা করা হয়েছে।
পরিশিষ্ট অংশে ‘সমাজ’ পর্যায়ের প্রবন্ধসমূহ — এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘হিং টিং ছট’ কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সামাজিক মত নিয়ে চন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতবিরোধ হয়েছিল। ‘হিন্দুবিবাহ’ প্রবন্ধে ( সুলভ ষষ্ঠ, পৃ-৬৫৬-৬৭৮) দেখা যাচ্ছে দু’জনের মধ্যে লেখনীর যুদ্ধ ভাল রকমই হয়েছিল। ঘড়ির পেন্ডুলাম কাঁটা বাঁদিকে যতখানি যাবে, ডান দিকেও ততখানিই যাবে। তখনকার দিনের নব্যপন্থীরা যা কিছু প্রাচীন সে সবই নস্যাৎ করে দিতে চাইছিল। ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইউরোপের বাইরে তাদের চোখ আর কিছুই দেখছিল না। এই প্রবণতাকে Counter করার জন্য রক্ষণপন্থীরাও মাথাচড়া দিয়ে উঠছিলেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের আচার ব্যবহার বা শাস্ত্রীয় বিধানসমূহ সবকিছুই শ্রেষ্ঠ এগুলোই তারা বলতে লাগলেন। চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় এই মতের অবলম্বী হয়ে বিভিন্ন জায়গায় লেখালেখি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন, কিন্তু অবাস্তব বা অযৌক্তিক কিছু প্রাচীন বলেই তিনি বিনা বিচারে মেনে নেন না। হিন্দুদের বিবাহ ব্যাপারাদি নিয়ে তখন চারিদিকে আলোচনা চলছিল। এই ‘হিন্দুবিবাহ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীনদের মতের সমালোচনা করেছেন এবং নিজের মত প্রকাশ করেছেন। আমাদের অবশ্য রবীন্দ্রনাথকৃত সমস্ত আলোচনাটির কোনো প্রয়োজন নেই— তাঁর আলোচনার মধ্যে রামায়ণ মহাভারত থেকে যে সমস্ত উদ্ধৃতি তিনি দিয়েছেন বা রামায়ণ মহাভারতের উদাহরণ দিয়ে যে সমস্ত জায়গায় তিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠা বা বিরুদ্ধ মত খন্ডণ করার চেষ্টা করেছেন, আমরা শুধু সেগুলোই নেবো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন — ”আমাদের দেশে কিছুকাল হইল হিন্দু বিবাহ লইয়া আলোচনা পড়িয়াছে। যাঁহারা এই আলোচনা তুলিয়াছেন তাঁহারা অনেকেই সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র এবং আমাদের বঙ্গসাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় বলিয়া গণ্য। ……………. হিন্দুবিবাহের পবিত্রতা সম্বন্ধে যদি কেহ বৈদিক বচন উদ্ধৃত করেন তাঁহার জানা উচিত যে বৈদিককালে স্ত্রী পুরুষের সামাজিক ও গার্হস্থ্য অবস্থা আমাদের বর্তমান কালের ন্যায় ছিল না। যিনি হিন্দুবিবাহের পক্ষে পুরাণ ইতিহাস উদ্ধৃত করেন, তিনি এক মহাভারত সমস্ত পড়িয়া দেখিলে অকূল সমুদ্রে পড়িবেন। মহাভারতের নানা কাহিনীতে বিবাহ সম্বন্ধীয় নানা বিশৃঙ্খলা বর্ণিত হইয়াছে; ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসারে তাহার ভালোরূপ সমালোচনা ও কালাকাল নির্ণয় না করিয়া কোনো কথা বলা উচিত হয় না।”
”শ্রদ্ধাস্পদ শ্রী যুক্ত চন্দ্রনাথ বসু পরম ভাবুক জ্ঞানবান ও সহৃদয়। ……. বাংলার পাঠক সাধারণে চন্দ্রনাথ বাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। এই জন্য কিছুকাল হইল তিনি ‘হিন্দুপত্নী’ এবং ‘হিন্দুবিবাহের বয়স ও উদ্দেশ্য’ নামে যে-দুই প্রবন্ধ প্রচার করেন তাহা সাধারন্যে অতিশয় আদৃত হইয়াছে। ……চন্দ্রনাথ বাবু তাঁহার প্রবন্ধের একস্থলে হিন্দুবিবাহের সহিত কোমতের মতের তুলনা করিয়াছেন। …… মহাভারতে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরও মুক্তকন্ঠে কোমতের মত সমর্থন করেন নাই। অনুশাসন পর্বে অষ্টত্রিংশতম অধ্যায়ে স্ত্রী চরিত্র সম্বন্ধে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরের যে কথোপকথন হইয়াছে, বর্তমান সমাজে তাহার সমগ্র ব্যক্ত করিবার যোগ্য নহে। অতএব তাহার স্থানে স্থানে পাঠ করি। কালী সিংহ কর্তৃক অনুবাদিত মহাভারত আমার অবলম্বন।
‘কামিনীগণ সৎকুলসম্ভূত রূপসম্পন্ন ও সধবা হইলেও স্বধর্ম পরিত্যাগ করে। উহাদের অপেক্ষা পাপপরায়ণ আর কেহই নাই। উহারা সকল দোষের আকর।
উহাদের অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ধর্মভয় নাই।
তূলাদন্ডের একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার, বিষ, সর্প, ও বহ্নি এবং অপরদিকে স্ত্রীজাতির সংস্থাপন করিলে স্ত্রীজাতি কখনোই ভয়ানকত্বে উহাদের অপেক্ষা ন্যূন হইবে না। বিধাতা যে-সময় সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হইয়া মহাভূতসমূদয় ও স্ত্রী পুরুষের সৃষ্টি করেন, সেই সময়ই স্ত্রীদিগের দোষের সৃষ্টি করিয়াছেন।”
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলিতেছেন :
‘পুরুষে রোদন করিলে উহারা কপট রোদন এবং হাস্য করিলে উহারা কপট হাস্য করিয়া থাকে।
কামিনীরা সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যারে সত্য বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।”
”চন্দ্রনাথ বাবু শাস্ত্র উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন —প্রাচীন সমাজে স্ত্রীলোকের সবিশেষ সম্মান ছিল, কিন্তু আমি দেখিতেছি, শাস্ত্রে স্ত্রীলোকের অসম্মানেরও প্রমাণ আছে। অতএব এ বিষয়ে এখনো নিঃসংশয়ে কিছু বলিবার সময় হয় নাই।
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধর্মপত্নী দ্রৌপদীকে দ্যূতক্রীড়ায় পণ স্বরূপে দান করিয়াছেন। কেহ কেহ বলিবেন, তৎপূর্বে তিনি আপনাকে দান করিয়াছিলেন। তাহার উত্তর এই যে, আপনাকে সম্মান করিতে কেহ বাধ্য নহে, কিন্তু মান্য ব্যক্তিকে সম্মান করিতে সকলে বাধ্য। দ্রৌপদী যদি সত্যই যুধিষ্ঠিরের মান্যা হইতেন, দেবতা হইতেন তবে যুধিষ্ঠির কখনই তাঁহাকে দ্যূতের পণ্যস্বরূপ দান করিতে পারিতেন না। প্রকাশ্য সভায় যখন দ্রৌপদী যৎপরোনাস্তি অপমানিত হইয়াছিলেন তখন ভীষ্ম দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রপ্রমুখ সভাস্থগণকে স্ত্রীসম্মান রক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন। ঐ দ্রৌপদীই যখন প্রকাশ্যভাবে বিরাট সভায় কীচকের পদাঘাত সহ্য করেন তখন সমস্ত সভাস্থলে কেহই স্ত্রীসম্মান রক্ষা করে নাই।”
”চন্দ্রনাথবাবু বলেন, হিন্দু বিবাহে যেরকম একীকরণ দেখা যায় এরূপ অন্য কোনো জাতির বিবাহে দেখা যায় না। …… এক স্বামী ও এক স্ত্রীর একীকরণ বিবাহের উচ্চতম আদর্শ। সে আদর্শ আমাদের দেশে যদি জাজ্বল্যমান থাকিত তবে এ দেশে বহুবিবাহ কীরূপে সম্ভব হইত। মহাভারত পাঠে জানা যায় শ্রীকৃষ্ণের ষোড়শসহস্র মহিষী ছিল। ….. ব্রাহ্মণ ঋষিদিগেরও একাধিক পত্নী দেখা যাইত। অন্য ঋষির কথা দূরে যাউক, বশিষ্ঠের দৃষ্টান্ত দেখো। অরুন্ধতীই যে তাঁহার একমাত্র স্ত্রী তাহা নহে, অক্ষমালা নামে এক অধম জাতীয়া নারী তাঁহার অপর স্ত্রী ছিলেন।”
”বিবাহ ‘আধ্যাত্মিক’ বলিতে কি বুঝায়। যদি কেহ বলেন যে, সাংসারিক কার্য সুশৃঙ্খলে নির্বাহ করিবার অভিপ্রায়ে বিবাহ করিবার নামই আধ্যাত্মিক বিবাহ, কেবল মাত্র নিজের সুখ নহে সংসারের সুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া বিবাহ করাই আধ্যাত্মিকতা, তবে বোধ হয় আধ্যাত্মিক শব্দের প্রতি অত্যাচার করা হয়। ……. সন্মুখ যুদ্ধে নিহত হওয়া ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ও পুণ্যের কারণ বলিয়া উক্ত হইয়াছে, এমন-কি ক্রুরকর্মা দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠির স্বর্গস্থ দেখিয়া যখন বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করিলেন তখন দেবগণ তাহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা করেন যে, ক্ষত্রিয় সম্মুখযুদ্ধে নিহত হইয়া যে-ধর্ম উপার্জন করেন তাহারই প্রভাবে স্বর্গ প্রাপ্ত হন। এক্ষণে জিজ্ঞাসা এই, ক্ষত্রিয় দুর্যোধন যে-যুদ্ধ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন তাহাকে আধ্যাত্মিক যুদ্ধ বলিবে কী না।”
”কুমারী যখন স্বামী প্রার্থনা করে তখন সে বলে, যেন রামের মতো বা মহাদেবের মতো স্বামী পাই। পূর্বজন্মের স্বামী এ জন্মেও আধ্যাত্মিক মিলনে বদ্ধ হইয়া তাহার অনুসরণ করিবে এ বিশ্বাস যদি কুমারীর থাকিত, তবে এ প্রার্থনা সে করিত না। বাল্মীকির রামায়ণে কী আছে স্মরণ নাই, কিন্তু সাধারণে প্রচলিত গান এবং উপাখ্যানে শুনা যায় সীতা রামকে বলিতেছেন, পরজন্মে যেন তোমার মতো স্বামী পাই—কিন্তু তোমাকেই পাই একথা কেন বলা হয় নাই।”
হিন্দু বিবাহ যে আধ্যাত্মিক একথা রবীন্দ্রনাথ মানতে চাননি ।
বিবাহের বয়স প্রসঙ্গ আলোচনাতে রবীন্দ্রনাথ একজায়গায় লিখেছেন (সুলভ ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠা ৬৬৬) ”যখন একটা কথা বলিতেছি তখন কেন যে সে-কথাটা ছাড়িয়া দিয়া আর-একটা কথা বলিব তাহার কারণ খুঁজিয়া পাই না। মানুষের চিন্তা এবং কথায় যে সংযম দরকার একথাটা বলতে গিয়ে তিনি রামায়ণের হনুমান প্রসঙ্গ এনেছেন। ”মহাবীর হনুমান যদি অতিরিক্তমাত্রায় লম্ফনশক্তি প্রয়োগ করিতেন তবে তিনি সমুদ্র ডিঙাইয়া লঙ্কায় না পড়িয়া লঙ্কা ডিঙাইয়া সমুদ্রে পড়িতেও পারিতেন। ইহা হইতে এই প্রমাণ হইতেছে, অন্যান্য সকল শক্তির ন্যায় চিন্তাশক্তিরও সংযম আবশ্যক।”
ছেলেমেয়ের বিয়ের বয়স প্রসঙ্গে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ”এইখানে চন্দ্রনাথবাবুর কথা ভালো করিয়া সমালোচনা করা যাক। কেন কন্যার বয়স অল্প হওয়া আবশ্যক, তাহার কারণ দেখাইয়া চন্দ্রনাথ বাবু বলেন—
‘ইংরেজ আত্মপ্রিয় বলিয়া তাহার বিবাহের প্রকৃতপক্ষে মহৎ উদ্দেশ্য নাই। মহৎ উদ্দেশ্য নাই বলিয়া তাহার বিবাহ বিবাহই নয়। মহৎ উদ্দেশ্য থাকিলেই মানুষের সহিত প্রকৃত বিবাহ হয়। যেমন হারমোদিয়াসের সহিত এরিস্টজিটনের বিবাহ; যীশুখ্রীষ্টের সহিত সেন্ট পলের বিবাহ; চৈতন্যের সহিত নিত্যানন্দের বিবাহ; রামের সহিত লক্ষ্মণের বিবাহ।’
……………
হার্মোদিয়াস এবং এরিস্টজিটন, যীশুখ্রীষ্ট এবং সেন্টপল চৈতন্য এবং নিত্যানন্দ, রাম এবং লক্ষ্মণের যে মহৎ উদ্দেশ্যজাত বিবাহ তাহা জাঁতায় পেষা বিবাহ নহে, তাহা স্বতঃসিদ্ধ বিবাহ।”
‘আহার সম্বন্ধে চন্দ্রবাবুর মত’ প্রবন্ধে (সুলভ-৬ষ্ঠ, পৃ ৬৮৬) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—”এক হিসাবে শঙ্করাচার্যোর আধুনিক ভারতবর্ষকেই প্রাচীন ভারতবর্ষ বলা যাইতে পারে; কারণ, ভারতবর্ষ তখন এমনই জরাগ্রস্ত হইয়াছে যে, তাহার জীবনের লক্ষণ আর বড়ো নাই। সেই মৃতপ্রায় সমাজকে শুভ্র আধ্যাত্মিক বিশেষণে সজ্জিত করিয়া তাহাকেই আমাদের আদর্শস্থল বলিয়া প্রচার করিতেছি, তাহার কারণ, আমাদের সহিত তাহার তেমন অনৈক্য নাই। কিন্তু মহাভারতের মহাভারতবর্ষকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে যে প্রচণ্ড বীর্য, বিপুল উদ্যমের আবশ্যক তাহা কেবলমাত্র নিরামিষ ও সাত্ত্বিক নহে, অর্থাৎ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ অধ্যাপকের আবাদ করিলে সে ভারতবর্ষ উৎপন্ন হইবে না।
এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ গীতার কথা বলেছেন—”গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কর্মকে মনুষ্যের শ্রেষ্ঠপথ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছেন তাহার কারণ কী। তাহার কারণ এই যে, কর্মেই মানুষের কর্তৃশক্তি বা আধ্যাত্মিকতার বলবৃদ্ধি হয়। কর্মেই মানুষ্যের সমুদয় প্রবৃত্তি পরিচালনা করতে হয় এবং সংযত করতেও হয়। কর্ম যতই বিচিত্র, বৃহৎ এবং প্রবল, আত্মনিয়োগ এবং আত্মসংযমের চর্চা ততই অধিক। এঞ্জিনের পক্ষে বাষ্প যেমন, কর্মানুষ্ঠানের পক্ষে প্রবৃত্তি সেইরূপ। এঞ্জিনে যেমন একদিকে ক্রমাগত কয়লার খোরাক দিয়ে আগ্নেয় শক্তি উত্তেজিত করিয়া তোলা হইতেছে আর একদিকে তেমনি দুর্ভেদ্য লৌহবল তাহাকে গ্রহণ ও ধারণ করিয়া স্বকার্যে নিয়োগ করিতেছে, মনুষ্যের জীবনযাত্রাও সেইরূপ। সমস্ত আগুন নিবাইয়া দিয়া সাত্ত্বিক ঠাণ্ডা জলের মধ্যে শীতকালের সরীসৃপের মতো নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকাকেই যদি মুক্তির উপায় বল তবে সে এক স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের সে উপদেশ নহে। প্রবৃত্তির সাহায্যে কর্মের সাধন এবং কর্মের দ্বারা প্রবৃত্তির দমনই সর্বোৎকৃষ্ট।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন