ইমানুল হক
গণতন্ত্র? গণতন্ত্র তন্ত্র মাত্র, গণ শুধু শোভা
গতি দিতে পারে তাকে তোমারই নিজস্ব কোনো প্রভা
(শঙ্খ ঘোষ, গুরু শিষ্য-সংবাদ)
পূর্ণিমার চাঁদ এখন ঝলসানো রুটি নয়, এখন তাকে নুন দিয়ে দেখতে হয়৷ উত্তরপ্রদেশে৷ কেননা, মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার বিস্ট ওরফে যোগী আদিত্যনাথ বলে দিয়েছেন, রাম রাজ্যের লোকে নুন দিয়েই রুটি খেত৷
তিনি বলছেন, এ তো অমৃতভাষণ নয়, অমৃত বাণীরূপে অতএব সেবন করুন সর্বলোকে৷
সর্বলোকে তা খেয়ে স্বর্গ না নরকলোকে যাবে—সে তো বিধাতার সাপলুডো খেলার মতো ইচ্ছে৷ ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা অপুষ্টিতে ভুগবে, এনসেফেলাইটিসে বিনা চিকিৎসায় মরবে—একান্ত বাধ্য হলে গোমূত্র সেবন করবে—এ তো ভবিতব্য৷
মিড-ডে মিল—সে তো এক বিরোধী চক্রান্ত৷ কেন এসব থাকে? মাস্টারমশাইদের একাংশ তো চান না মোটেও৷ ফালতু ঝামেলা৷ মুখ্যমন্ত্রী যোগী বা মাস্টারমশাইদের ঘরের ছেলেরা তো এসব খায় না৷
যেসব স্কুলে এসব খাওয়ানো হয়—সেখানে তো আজকাল মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে-মেয়েরা যায় না৷ কারণ, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্লোগানেই শোনায় ভালো, উচ্চারণেও মাঝেমধ্যে, তাঁদের শিক্ষা ইংরেজি ভাষার মধ্যস্থতায় হওয়াই তো বাঞ্ছনীয়!
ভারতে প্রথম মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু হয় তামিলনাড়ুতে৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে৷ মুখ্যমন্ত্রী কামরাজের পরিকল্পনায়৷ পরে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রন এই প্রকল্পকে পুষ্টিকর খাদ্য প্রকল্পে রূপান্তরিত করে ৬ লাখ শিশুকে এই প্রকল্পের আওতায় আনেন৷ ১৯৮৪-তে গুজরাতও এটা শুরু করে৷ কিন্তু চালাতে পারে না৷ কেরালাতেও চালু হল একই বছরে৷ এরপর ১৯৯০-৯১ নাগাদ গোয়া, গুজরাত, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে অর্থ সাহায্য পেতে থাকে এই প্রকল্পের জন্য৷
প্রসঙ্গত, জ্যোতি বসু যখন মুখ্যমন্ত্রী এবং অশোক মিত্র অর্থমন্ত্রী তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে দুপুরে পাঁউরুটি বা কেক দেওয়া চালু হয়৷ অন্ধ্রপ্রদেশ এবং রাজস্থানে সম্পূর্ণ বিদেশি সাহায্যে মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু হয় ১৯৯০-৯১-এ৷
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট নরসিংহ রাওয়ের আমলে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ২৪০৮ টি ব্লকে শিশুদের পুষ্টি বাড়াতে প্রকল্প নেয়, তাতে অন্তত ৩০০ ক্যালরি খাবার দেওয়ার চেষ্টা হয়৷
২০০১-এর এপ্রিল মাসে পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ সুপ্রিম কোর্টে সারা দেশে মিড-ডে মিল চালুর জন্য মামলা করে৷ এই মামলা ‘রাইট টু ফুড’ বা ‘খাদ্যের অধিকার’ মামলা নামেও পরিচিত৷ পিইউসিএল বলে, দেশে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বা খাদ্য নিগমে প্রচুর খাদ্যশস্য নষ্ট হয়৷ এগুলো নষ্ট না হতে দিয়ে শিশু কিশোরদের দেওয়া হোক৷
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৮ নভেম্বর ২০০১ থেকে সারা দেশে চালু হয় মিড-ডে মিল প্রকল্প৷ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি৷ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বলা হল, কেন্দ্রীয় সরকারকে এর জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে হবে৷ কেন্দ্রীয় সরকার ৬০ শতাংশ এবং রাজ্য সরকার ৪০ শতাংশ৷
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা পাবে ৪৫০ ক্যালরিযুক্ত খাবার৷ প্রোটিন ১২ গ্রাম, চাল/গম ১০০ গ্রাম, ডাল ২০ গ্রাম, সবজি ৫০ গ্রাম৷ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি ক্যালরির পরিমাণ ৭০০৷ দিতে হবে ছাত্র পিছু ২০ গ্রাম প্রোটিন, ১৫০ গ্রাম চাল/আটা, ৩০ গ্রাম ডাল, সবজি ৭৫ গ্রাম৷
এর জন্য প্রাথমিকে বরাদ্দ ছাত্র-ছাত্রী পিছু ৪ টাকা ৪৮ পয়সা, এবং উচ্চপ্রাথমিকে ৬ টাকা ৭১ পয়সা৷ অনেক স্কুলেই সব ছেলে সব দিন আসে না বলে এই টাকায় টেনেটুনে চালানো হয়৷ ঝাড়খণ্ড তো ধর্মীয় কারণে ডিম দেওয়া যাবে না বলেই দিয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে মাঝে মাঝে ডিম দেওয়া হত৷ সম্প্রতি হুগলির একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের ভাতের সঙ্গে কেবল নুন দেওয়া হচ্ছিল৷ ডাল, ডিম বা সবজি নয়৷ এতে হইচই হয়৷ তারপর কয়েকটি জেলার শাসক একটি অবাস্তব সার্কুলার জারি করে বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের মাছ মাংস ডিম এমনকী পোস্ত দিতে হবে৷
এতে প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাথায় হাত পড়ে৷ শেষে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, ডাল ভাত ভালো করে খাওয়ালেই হবে৷ কারণ এত কম পয়সায় এত কিছু দেওয়া যায় না৷ ইতিমধ্যে বির্তক উঠেছে যে দেশে চাঁদে উপগ্রহ পাঠানোর বিলাসিতা দেখাতে পারে সে দেশে ৪৪.৫ শতাশ অপুষ্টিতে ভুগবে কেন? সে দেশের পঞ্চাশ শতাশ খিদে পেটে নিয়ে ঘুমোতে যাবে কেন? ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১৪৮ তম হবে কেন?
উত্তরপ্রদেশে রামমূর্তি নির্মাণে টাকা খরচ হয়, দীপাবলীতে ১২৮ কোটি টাকার প্রদীপ জ্বলে কিন্তু শিশুদের নুন রুটি খেতে বাধ্য করা হয়, আর সেই নুন রুটির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দেওয়ায়, খবর করায় পবন জয়সওয়াল নামে এক সাংবাদিকের নামে জেলা প্রশাসন মামলা করে৷ মির্জাপুরের জেলা শাসক/সমাহর্তা অনুরাগ প্যাটেল এক কাঠি উপরে গিয়ে বলেছেন, মুদ্রণ মাধ্যমের সাংবাদিকের উচিত লেখা বা ফটো তোলা৷ ভিডিও তুলে তিনি অন্যায় করেছেন৷ আর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেই দিয়েছেন, রামরাজ্যে লোকে নুন রুটি খেত৷
শিশুরা চাঁদে বিক্রমের বিক্রম পড়বে, কিন্তু তাদের পেটে খিদে দুরন্ত অমিত বিক্রমে রাজত্ব করে যাবে৷ কতকাল?—সেটাই প্রশ্ন৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন