ইমানুল হক
ভাবুন, যদি হিটলারের অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট শক্তি স্তালিনের নেতৃত্বে লালফৌজের কাজে পরাজিত না হত, তবে গোটা দুনিয়াতে হিটলার এবং অর্ধশিক্ষিত অর্ধ-উন্মাদ ট্রাম্প-মোদিরা অধিকতর নৃশংস উপায়ে অসহনীয় উল্লাসে রাজত্ব করত, গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতায় থাকত ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী আর নাজি বাহিনী—যার পোশাকি নাম কোথাও আর এস এস, কোথাও আইসিস কোথাও বোকো হারাম৷
কল্পনা করুন, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত বিপ্লব হয়নি—দুনিয়া কী জানত কাকে বলে বীমা, রেল, ইস্পাত, কয়লাখনি, বিদ্যুৎক্ষেত্র জাতীয়করণ? শিখত সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অসহনীয় দুর্দশার মুক্তি সন্ধান? মানসচক্ষে দেখুন, ১৮৪৮-এ কমিউনিস্ট ইস্তেহার বলে কোনও বই লেখা হয়নি—জানতেন, শুনতেন— প্যারি কমিউন, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ফরাসি শ্লোগান, আট ঘণ্টা কাজ আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আট ঘণ্টা ঘুমের জন্য বিপুল কণ্ঠস্বর শোনা যেত দুনিয়ায়?
কমিউনিস্ট ইস্তেহার একটা নতুন স্বপ্ন—১৯১৭-র সোভিয়েত বিপ্লব সেই স্বপ্নসৌধের সার্থক নির্মাণ৷ নারী কি পেত ভোটাধিকার? নিষিদ্ধ পল্লীর নির্যাতিতা নারী দেখতে পেতেন আলোর দিশা? জাতি-বিদ্বেষ, ধর্ম-বিদ্বেষ থামত? দেশে দেশে দুনিয়ায়? বিদেশি আতঙ্ক আর বিদ্বেষ নয়—আন্তর্জাতিক—মেহনতি মানুষের কোনও দেশ নেই, সীমান্ত নেই—আছে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ৷ কেউ খাবে আর কেউ খাবে না—এ শ্লোগানের জন্মদাতা সাম্যবাদ৷ সাম্যবাদের সার্থক ও অভ্রংলিহ স্মারক সোভিয়েত বিপ্লব৷ সেই বিপ্লবের ১০০ বছরে আমরা দেখতে পারি, কবে কী করেছিল, সোভিয়েত মানব মুক্তির কল্যাণে, মানুষ গড়ার ইস্পাত কারিগর হিসেবে৷
অনেকেই বলেন, জনগণের কল্যাণ করেছি৷ করছি, করব৷ জনগণের কল্যাণ বলতে কী বোঝায় তার আদর্শ দৃষ্টান্ত সোভিয়েত৷ আজও পৃথিবীতে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ নেই৷ আর কোথাও ছিল না৷ কিউবা ছাড়া আর কোথাও আপাতত নেই৷
২
গরবাচভকেও সোভিয়েত রাশিয়ার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব সম্পর্কে বলতে হয়েছিল, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে—
‘সত্তর বছর আগে ঘটেছিল এক মহাবিপ্লব যে দেশে সেই রাশিয়া এক প্রাচীন দেশ যার অনুপম ইতিহাস ভরে আছে অনুসন্ধান, সাফল্য আর করুণ কাহিনিতে৷ পৃথিবীকে এই দেশ দিয়েছে অনেক আবিষ্কার আর বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে৷’
সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি নবীন রাষ্ট্র যার তুলনা ইতিহাসে বা আধুনিক বিশ্বে নেই৷ তবে মানুষের ইতিহাসে যা সামান্য সময়, সেই গত সাত দশকে আমাদের দেশ যে পথ অতিক্রম করেছে তা বহু শতাব্দীর সমান৷ বিশ্বের অন্যতম শক্তি তৈরি হয়েছে পশ্চাদপদ আধা-ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক রুশি সাম্রাজ্যের পরিবর্তে৷ বিপুল উৎপাদিকা শক্তি, শতাধিক জাতি ও জাতি বৈশিষ্ট্য সমন্বিত অদ্বিতীয় এক জাতিগোষ্ঠী, এবং বিশ্বের এক ষষ্ঠাংশ এলাকা জুড়ে আঠাশ কোটি লোকের সুদৃঢ় সামাজিক নিরাপত্তা—এই হল আমাদের মহান এবং তর্কাতীত সাফল্য, সোভিয়েত জনগণ এর জন্য যথার্থই গঠিত৷’
(মিখাইল সের্গেইভচ গোর্বাচেভ, পেরেস্ত্রাইকা ও নতুন ভাবনা, পৃ. ৭-৮, মণীষা, ১৯৮৮)
গড়ে তুলেছিল উন্নত কারখানা—যা দিয়ে খাঁটি ইস্পাত, সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক আর বিমানপোত শুধু তৈরি হয়নি, মানুষকে দিয়েছিল এক উন্নত জীবনব্যবস্থা৷
নতুন আদর্শে উজ্জীবিত এক শিক্ষাদর্শ ও শিক্ষাব্যবস্থা৷
আধুনিক ক্রীড়ানীতি ও ক্রীড়া ব্যবস্থা৷ অলিম্পিকে অজস্র পুরস্কার প্রাপ্তি তার অন্যতম প্রমাণ৷
স্পষ্টত উন্নত স্বাস্থ্যনীতি৷ স্বাস্থ্যের দায়িত্ব রাষ্ট্রের জাতি সমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার৷
দরিদ্র ভিখারি ও বেকারদের সংকটের সমাধান৷
নৃত্য, নাটক চলচ্চিত্রে—বিপুল বৈপ্লবিক পরিবর্তন৷ আইজেনস্টাইন জন্ম দিলেন নতুন চলচ্চিত্র ভাষার, মন্তাজ।
কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি৷ যৌথ খামারের স্বপ্ন বাস্তবায়ন৷ গরবাচভকেও তা বলতে হয়েছে—যৌথ খামার ব্যবস্থা কৃষকের সমগ্র জীবনধারা বদলে দিয়েছে৷ কৃষককে করে তুলেছে সমাজের এক আধুনিক, বাকি অংশ। যদিও এই বদল রাতারাতি হয়নি, সহজেও হয়নি৷
হয়নি যে, তার দুটি সাহিত্যিক প্রমাণ, শলোকভের ‘অ্যান্ড কোয়াইট ফ্লজ দ্য ডন’ এবং নিকালাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ উপন্যাস৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চারদিকে কেবল ধ্বংস ধ্বংস আর ধ্বংসের হাহাকারই দৃশ্য৷ পশ্চিমি দুনিয়া মনে করেছিল, ১০০ বছরেও উঠে দাঁড়াতে পারবে না সোভিয়েত৷ কিন্তু উঠে শুধু দাঁড়ায় না, হয়ে দাঁড়ায় মহাশক্তিধর৷
লেনিন বলেছিলেন, ‘ইতিহাসে এমন কোনও বিপ্লব হয়নি যেখানে বিজয়ের পর অস্ত্র নামিয়ে রেখে জয়মাল্য নিয়ে বিশ্রাম করা গিয়েছে৷’ বুর্জোয়া বিপ্লবের দেশ ফ্রান্সেও মহাবিপ্লবের (১৭৮৯-৯৩) পরে লক্ষ্যে পৌঁছাতে ১৮৩০, ১৮৪৮, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছিল৷ ব্রিটেনে অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে বিপ্লব হয়—১৬৪৯-র বিপ্লবের পরে হয় ১৬৮৮-৮৯-র ‘গৌরবময় বিপ্লব’৷ নতুন বুর্জোয়া ক্ষমতায় আসে। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে হয় সংস্কার৷ জার্মানিতে হয় দুটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব৷ ১৮৪৮ এবং ১৯১৮৷ ইতিমধ্যে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক তীব্র সংস্কারবাদী নীতি নেন৷
বিপ্লব সঙ্গে নির্মাণ আর সৃষ্টি৷
১৯১৮-এর অশান্ত সময়ে লেনিন বাধ্য হয়েছিলেন জার্মানির সঙ্গে অপমানজনক ব্রেস্ট শান্তি চুক্তি করতে৷ নাহলে বিপ্লব এবং বিপ্লবের সন্তান সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করা যেত না৷ সোভিয়েত বিপ্লব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক—সব ক্ষেত্রেই বিপুল পরিবর্তন এনেছিল৷ তথাকথিত বহুত্ববাদী গণতন্ত্র যা পারেনি, কোথাও পারবে বলে মনেও হয় না৷ কারণ, তথাকথিত গণতন্ত্রে ‘সকলেই সমান, কিন্তু কেউ কেউ বেশি সমান’—নীতি প্রবলভাবে কার্যকর৷ ৩১% ভোট পেয়েও বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে ক্ষমতায় আসীন হতে পারে ফ্যাসিবাদী শক্তি। দুর্নীতি, বশ্যতা, সারমেয়বৃত্তি, পা চাটা মনোভাব, লাল-ফিতের বাঁধা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, উচ্চবর্গীয় উচ্চম্মন্যতা এবং ক্ষমতার আতঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়েছিল সোভিয়েত বিপ্লব৷ বাড়াবাড়ি হয়নি, একথা না বলা, অত্যুক্তি, কিন্তু বিপ্লব কোনও সূচিকর্ম নয়, যে তাতে কোনও ভুলচুক হবে না৷
কারণ নির্মাণ সব সময়ই কঠিন, আর রাজনৈতিক নর্দমা পরিষ্কার করে, বুর্জোয়া মনোভাব, বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আত্যন্তিক আসক্তি, কথা আর কাজে ফারাক—তীব্র ভোগবাদী মানসিকতাকে দূর করা কঠিন কাজ ছিল৷ সবাই বিপ্লবী বা কমিউনিস্ট ছিলেন না৷ অনেকেই ছিলেন রাজতন্ত্রের ভক্ত৷ রাজতন্ত্রী৷ তাঁরা তো আর দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাননি৷ তারা ছিলেন সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে প্রভাবশালী৷ তাদের প্রচারে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ভোট দিতেও পারে৷ তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই৷ বলশেভিকদের নির্বাচনী পরাজয়ে উল্লসিত হওয়ার কারণে বিকৃতি থাকতে পারে, সমাজতান্ত্রিক বা বামপন্থী মতাদর্শ নেই৷
আমাদের দেশে ২০১৬-র ৮ নভেম্বরের পর ১০ নভেম্বর যদি গণভোট হত তবে নরেন্দ্র মোদি বিমুদ্রাকরণ নীতির জয় ঘোষিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল৷ কিন্তু আজ আর তা কি বলা যাবে? জনগণ সামায়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়৷ ভুলও করে৷ ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক বা হিটলারি জার্মানির প্রথম পর্ব কিংবা মোদিজির গুজরাত মডেলে বিভ্রান্ত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে৷
৩
সোভিয়েত রাশিয়া আয়তনে ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ৷ পৃথিবীর ভূখণ্ডের ১/৬ ভাগ অংশ সোভিয়েত রাশিয়া৷ ২২,৪০০,০০০ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত৷ ভারতের সাতগুণ বেশি৷ সোভিয়েতের পূর্বপ্রান্তের মানুষ যখন ঊষার সাক্ষাৎ পেত, তখন রাজধানী মস্কোর বাসিন্দা ব্যস্ত থাকত নৈশভোজে৷ পৃথিবীর মোট ২৪টি টাইম জোন আছে৷ এর মধ্যে ১২ টাইম জোনের অবস্থান ছিল সোভিয়েত রাশিয়ায়৷ পৃথিবীর দীর্ঘতম সীমান্ত ছিল সোভিয়েতের৷ বহুরাষ্ট্র তার চারপাশে৷ পশ্চিমে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, পূর্বতন চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া৷ দক্ষিণে তুরস্ক ইরান, আফগানিস্তান, চীন, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া৷ পূর্ব এবং উত্তর সীমান্ত সমুদ্র৷ সোভিয়েত রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক পত্তন ৩০ ডিসেম্বর ১৯২২৷ ছিল ১৫টি কেন্দ্রীয় প্রজাতন্ত্র, ২০টি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র, ৮টি স্বশাসিত অঞ্চল, ১০টি স্বশাসিত জেলা, ৬টি শাসিত অঞ্চল৷ এবং ১২৩টি আঞ্চলিক ক্ষেত্র৷
৪
সোভিয়েত রাশিয়ায় অর্থনৈতিক শ্লোগান ছিল উৎপাদনের উপায়ের ওপর সমাজতান্ত্রিক মালিকানা৷ রাশিয়া ছিল প্রভূত কাঁচামাল, জ্বালানি এবং শক্তির উৎস৷ কিন্তু সেগুলি সেভাবে জনগণের স্বার্থে কাজে লাগায়নি জার বা কলিনভ কিংবা কেরেনাস্কি সরকার৷
সোভিয়েত নদ-নদী ১,৫০,০০০৷ হ্রদ ২,৭০,০০০৷ এর মধ্যে পাঁচটি পৃথিবীর বৃহত্তম৷ এই নদীগুলি শীতে জমে যেত৷ যাতায়াত পরিবহণ ছিল কঠিন৷ বরফ গলিয়ে বিদ্যুতের সম্ভাবনা উন্মোচন করেন লেনিন৷ বলেন, বিদ্যুতের অপর নাম সমাজতন্ত্র৷ ‘ক্রেমলিন কাইমস’ বা ‘ক্রেমলিনের ঘড়ি’ নাটকে এ-নিয়ে চমৎকার বিবরণ আছে। সোভিয়েত রাশিয়ায় ৬% মানুষ ছিলেন শহরবাসী৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুই-তৃতীয়াংশ সোভিয়েত নাগরিক ছিলেন গ্রামবাসী৷ ধ্বংস, মৃত্যু, হত্যা পেরিয়ে এই উল্লম্ফন এমনি এমনি হয়নি৷ মার্কসীয় বীক্ষা, সমাজতান্ত্রিক দিশা, আর বিপ্লবী সংকল্প তার হাতিয়ার৷ সোভিয়েত রাশিয়ায় ছিল ১০০টি জাতি গোষ্ঠী৷ সোভিয়েত সেই দেশ যারা মাতৃভাষার ভিত্তিতে জাতীয়তা ঠিক করেনি৷ ১৯১৯-র জনগণনার কথা ধরা যাক৷ দেখা যায় ৬.৯% মানুষ জানিয়েছিলেন, তাদের মাতৃভাষা অন্য জাতীয়তার৷ দ্বিতীয় কোনও ভাষা স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন তাও জানান তাঁরা৷
৫
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে সোভিয়েত রাশিয়া৷ ১৮৬০ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালীন সময় জারতন্ত্রী রাশিয়া কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নতি করেছিল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তা ধ্বংস হয়ে যায়৷ অর্থনৈতিকভাবে প্রবল পিছিয়ে পড়ে রাশিয়া৷ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লব৷ আর এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পর্যন্ত জানাতে বাধ্য হয়েছে—
১৯২০-থেকেই আমেরিকার পর পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠে সোভিয়েত রাশিয়া৷ (পৃ. ৯৫৬, খণ্ড ২৮, পঞ্চদশ সংস্করণ, শিকাগো)৷
১৯২৮ থেকে নেওয়া হয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা৷ যা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ খনিজ এবং শিল্পজাত পণ্যে রাশিয়া হয়ে ওঠে বিপুল শক্তিধর, আমেরিকার পরই শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনে রাশিয়া হয়ে যায় বৃহত্তম উৎপাদক৷
কৃষিতে ছিল যৌথখামার৷ প্রত্যেক কর্মী প্রয়োজন অনুযায়ী বেতন পেতেন৷ কর্ম অনুযায়ী নয়৷ কৃষিতে কৃত্রিম সার ব্যবহার নয়, জোর দিল জৈব ও খনিজ দ্রব্যে৷ আজ সারা পৃথিবী যে দিকে ঝুঁকছে৷ মোট কৃষিক্ষেত্রের ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হতো খাদ্য শস্য—(মূলত গম) ৩০ শতাংশ জমিতে উৎপন্ন হতো পশুখাদ্য৷ সাত শতাংশ জমিতে উৎপাদিত হত শিল্প পণ্য—তুলা, আখ, সূর্যমুখী তৈলবীজ৷ আর পৃথিবীর মোট ১৪ শতাংশ মাছ আসত রাশিয়ায়—
মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ, শিল্প উৎপাদক ছিল সোভিয়েত রাশিয়া৷ এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ব্রিটানিকা (পৃ. ৯৫৭) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভাবনীয় উন্নতি করেছিল সোভিয়েত রাশিয়া৷
রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত পিছিয়ে ছিল সোভিয়েত রাশিয়া৷ ১৯৫০-পর থেকেই শুরু হয় উল্লম্ফন৷
বিদ্যুৎ ব্যবহারে সোভিয়েত রাশিয়া ছিল বিশ্বের দৃষ্টান্ত৷ লেনিন বলেছিলেন, কমিউনিজম বা সাম্যবাদ মানে সোভিয়েত শক্তি আর এর সঙ্গে যুক্ত হবে সারা দেশের বৈদ্যুতিকরণ৷ বাস্তবায়িত সারা দেশে বৈদ্যুতিকরণ ঘটিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া৷
সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন৷ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এনেছিল তার দৃষ্টান্ত কেবল রাশিয়া৷ রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে জনসাধারণকে শেক্সপিয়রের নাটক দেখার জন্য বিনামূল্যে টিকিট দেওয়া হত৷ অপেরা, ব্যালে, সার্কাস, চলচ্চিত্র, অপেশাদার নাটক, জনসাধারণের বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারা সংগঠিত হত নানা কর্মকাণ্ড৷ গ্রন্থাগার, যাদুঘর, সংগ্রহশালা, উদ্যানরচনা কত কী হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে৷
৬
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বই ছাপা হত ২৮ কোটি জনসংখ্যার রাশিয়ায়৷ সবচেয়ে বেশি বই ছাড়াও সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হত সোভিয়েত রাশিয়াতেই৷ সোভিয়েত জনগণ প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁদের পাঠাভ্যাসের জন্য৷
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় শুরু হয় দূরদর্শন প্রদর্শন৷ ১৯২৮-এর পর সারা দেশ আসে টিভির আওতায়৷ প্রাক্-বিদ্যালয় শিশু, যৌথখামারি কৃষক এবং সৈন্যদের জন্য ছিল আলাদা অনুষ্ঠান৷ দেশে বেতার এবং দূরদর্শন সম্প্রচারিত হত ৭০টি ভাষায়৷ এবং বিদেশি ৬০টি ভাষায় নিয়মিত অনুষ্ঠান পরিবেশন করত সোভিয়েত বেতার ও দূরদর্শন৷ সোভিয়েত রাশিয়াই প্রথম দেশ যারা মহাকাশে কুকুর এবং মানুষ দুই পাঠিয়েছিল৷ অলিম্পিকে সোভিয়েতের সাফল্য ছিল বিস্ময়কর৷
নদী পরিকল্পনা, বাঁধ নির্মাণ, সেচ, শস্য বিপণন, শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের যত্ন নেওয়া, শিশু পাঠাগার, ইচ্ছেমত পড়া ও জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার৷
পেটের দায়ে কাউকে ভিক্ষা করতে হয়নি, কিংবা বনতে হয়নি আজকের মতো যৌনদাসী বা যৌনকর্মী৷ পতিতালয় বলে কিছু ছিল না রাশিয়ায়৷
পয়সার অভাবে কাউকে পড়া ছাড়তে হয়নি, জীবিকার অভাবে কাউকে ভোগ করতে হয়নি বেকারত্বের জ্বালা, কোনও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে পরিচর্যার অভাবে মরতে হয়নি, ইঁদুর বেড়ালের মতো গন্ধ ছাড়েনি পাড়ায়৷
মানুষের দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷
আর পার্টি সদস্যের কাছে বিপ্লবের স্বার্থ মুখ্য৷ ব্যক্তির স্বার্থ গৌণ৷
সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তির স্বার্থ বড় হওয়াটাই সর্বনাশা ঘটালো সোভিয়েত রাশিয়ার৷
সোভিয়েত বিপ্লবে আরও যা হয়েছিল।
ব্যক্তিমালিকানার বদলে জনগণের মালিকানা প্রবর্তন।
কমিউন প্রথায় চাষবাস কারখানা পরিচালনা—একচেটিয়া পুঁজির অবসান।
পুঁজিপতিদের লুণ্ঠন ও শোষণ থেকে জনগণকে রক্ষা৷
বিশ্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের জন্ম৷ ইচ্ছে করলেই অন্য দেশ দখল করা যায় না৷
সোভিয়েত অনুপ্রেরণায় চীন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া জার্মানি সহ পূর্ব ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম৷
মুসলিম বিশ্বেও মুক্তির নতুন সন্ধান—আলজেরিয়া, আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা শুরু৷
সোভিয়েত শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন৷
দেশে দেশে সস্তায় ধ্রুপদী, সাহিত্য বিজ্ঞান ও শিশু কিশোরদের জন্য বই পাঠানো৷
নারী স্বাধীনতার নতুন দিশা ছিল সোভিয়েত৷
মুক্তি মিলেছিল অনার্য, অথর্ব ও পথশিশুদের৷
সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত দাঙ্গাহীন বর্ণবৈষম্যহীন এক পৃথিবীর স্বপ্ন৷
নারী ও পুরুষের সমান বেতন প্রথম চালু হয় সোভিয়েত দেশে৷
অবাঞ্ছিত মাতৃত্বকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন৷
জারজ বা অবৈধ সন্তান বলে কিছু ধারণা ছিল না৷
বাবা-মা-কে দেখতে ছেলে-মেয়েরা বাধ্য ছিল৷
গর্ভপাত আইন সম্মত হয় সোভিয়েত দেশে।
গর্ভনিরোধও আইনি স্বীকৃতি পায়৷ মনে রাখতে হবে আজও আমেরিকার খ্রিস্টান যাজকরা গর্ভপাতের অধিকারের বিরুদ্ধে৷
কারখানায় শিশুঘর বা ক্রেশ রাখা বাধ্যতামূলক হয় প্রথম সোভিয়েত দেশে৷
মায়েদের প্রতি তিনঘণ্টা অন্তর শিশুদের স্তন্যপানের বাধ্যতামূলক ছুটি প্রথম চালু হয় সোভিয়েত দেশে৷
শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ হয় প্রথম সোভিয়েত দেশে।
শ্রমিকের স্বেচ্ছাবদলির নিয়ম প্রথম চালু হয় সোভিয়েত দেশে৷ আজও যা অকল্পনীয় পৃথিবীতে।
কারখানা পরিচালনার অধিকার শ্রমিকরা পায় প্রথম সোভিয়েত দেশে৷
রাষ্ট্রকে চার্চ বা ধর্ম থেকে প্রথম পৃথকীকরণ হয় সোভিয়েত৷
শাসক ও শাসিতের ধারণার পরিবর্তন ঘটায় সোভিয়েত ব্যবস্থা৷
লেনিন, স্তালিন—এরা খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন৷ রাষ্ট্রের দায়িত্বে মানেই ভোগবিলাস নয়—এই ধারণা এল সমাজে৷
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ প্রচেষ্টা অনেকটাই ব্যাহত হয় সোভিয়েত রাশিয়া শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হওয়ার পর৷
সোভিয়েত রাশিয়া এক স্বপ্নের নাম৷
যে স্বপ্ন পূরণ হলে ভারতবর্ষ শোষণ, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য অনাচার, বিভেদপন্থা থেকে মুক্তি পাবে৷
যে মুক্তির লক্ষ্যেই অনেকের আজও পথ হাঁটা৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন