অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস

ইমানুল হক

প্রতিদিন দুঃসংবাদ নামে সংবাদপত্রের পাতা বেয়ে৷ খুন জখম ধর্ষণ শুধু নয়, আর্থিক অব্যবস্থা, মন্দা, হত্যা, গণপিটুনি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং আত্মহত্যা৷ আগে ছিল দারিদ্র্য, অভাব বা অভিমানে আত্মহত্যার খবর৷ সাম্প্রতিক সংযোজন, রাষ্ট্রহীন/নাগরিকত্বহীন হওয়ায় আত্মহত্যার খবর৷ তবু তো তাঁদের মনে শান্তি নেই৷ ৬ সেপ্টেম্বর আংশিক বন্ধ হল আসামে৷ ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ নাগরিকত্বহীন হয়েছে৷ আরও চাই৷ তাই ভিত্তিবর্ষ পালটাও৷ ১৯৫১ করো৷

দলবদলু মি. পলিটিক্স সারদাখ্যাত আসামের (তৎকালীন) স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা হুমকি দিয়েছেন : নাগরিকপঞ্জি দিয়ে হবে না৷ বিকল্প পথ নিতে হবে৷ বিকল্প পথ কী আসাম জানে৷ নেলি গণহত্যা, শিলাপাথর কাণ্ড৷ বহু গণহত্যা ও বাঙালি হত্যার সাক্ষী আসাম৷

সংসদীয় ব্যবস্থায় আইনের পথে চলার শপথ নেওয়া এক মন্ত্রীর ভাষা যদি এমন হয়, বাকিরা কী বলছেন—সহজেই অনুমেয়৷

দেশের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ধনী দলের সভাপতি নির্বাচনের আগে ‘উইপোকা’ তত্ত্ব এনেছিলেন৷ ১৯ লাখ ৬ হাজার ৫৩ জন ‘উইপোকা’ চিহ্নিত৷ কিন্তু তার বাক্যস্ফূর্তি হয়নি৷ তিনি ঘাড়ের চর্বি কমাতে আমেদাবাদে লিপোমা অপারেশন করিয়েছেন৷ তাঁর ঘাড়ে, গর্দানে হয়তো মস্তিষ্কেও চর্বি জমলেও, মানুষের খাবার নেই৷ ৫০ শতাংশ মানুষ খিদে পেটে ঘুমোতে যায়, খিদে পেটে জেগে ওঠে৷

যা কোনদিন হয়নি, তা হচ্ছে ১২টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন অনিয়মিত৷ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের তহবিল থেকে বেতন দিয়েছে৷ শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্র আর বেতনের দায়িত্ব নেবে না৷ ছাত্রদের বেতন থেকে নিতে হবে রোজগার করে৷ অর্থাৎ শিক্ষায় সরকার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে৷ গত চার মাস কোনো কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকরা বেতন পাননি৷ প্রসঙ্গত ২২০০০ চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক আছেন৷ ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক ছাঁটাই৷ অন্যত্র কী ঘটছে—জানা যাচ্ছে না৷ এক দিকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা৷ অন্যদিকে দেশের ৯৮ শতাংশ সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম নিজেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে৷ ভয়ে ভক্তিতে ভালো অর্থের আশ্বাসে বা প্রাপ্তিতে৷ এনডিটিভি-র মতো অত্যাচার সইতে পারাও কঠিন৷ প্রণয় রায়, রাধিকা রায়কে আমেরিকা যেতে দেওয়া হয়নি৷ বিমনাবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আমেরিকায় সদ্য নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য পুরস্কার নিতে যাচ্ছিলেন তাঁরা৷ প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা৷ কে আর হৃদয় খুঁড়ে যন্ত্রণা নিতে ভালোবাসে!

তাই জনগণের যন্ত্রণা সীমাহীন৷ দুর্বিষহ৷ সীমান্তে কাঁটাতার৷ আসামে বন্দি শিবির৷ আর দেশজুড়ে অজস্র অদৃশ্য কাঁটাতার৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ডাকঘর’ নাটক লেখার প্রেক্ষাপট হিসেবে বলেছিলেন, ‘গোটা দেশটাই আজ একটা জেলখানা’৷

অদৃশ্য জেলখানা উল্লাস করছে৷ আসামকে কাশ্মীরের মতো প্রোটেক্টেড ল্যান্ড করে ফেলা হয়েছে৷ এক বিদেশি মহিলা সাংবাদিককে ৩ সেপ্টেম্বর জোর করে বিমানে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কাশ্মীর নিয়ে কিছু সত্য প্রকাশ করছিল৷ আসামেও তাই হতে পারে৷ ভয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে সবক শেখানো হল৷

আসামে—এক দলের গোপন উল্লাস ছিল মিঞারা অর্থাৎ মুসলমানরাই বাদ পড়বে৷ পড়েনি, কারণ, তাঁদের অধিকাংশই দীর্ঘকাল আসামের বাসিন্দা৷ কিন্তু দেশভাগের বলি হয়ে, সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য নিপীড়নের কারণে যেসব বাঙালি হিন্দু পরিবার উদ্বাস্তু হয়েছিলেন তাদের একটা বড় অংশ নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়েছেন৷

সারা দেশে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ ভূমিহীন৷ ২০১৫-তে সংসদে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়েছেন, ৩০ কোটি মানুষ ভূমিহীন৷ ভুমিহীনরা দলিল কোথায় পাবেন? এছাড়া আসামে বন্যা ভূমিধস প্রায় নিয়মিত ঘটনা৷ মানুষ প্রাণ বাঁচাবেন না নথিপত্র বাঁচাবেন? পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসার সময় ধর্মীয় অত্যাচারের কাগজ আনাও সম্ভব নয়৷ ১৯৭১-এর পর উদ্বাস্তু ক্যাম্প উঠে গেছে৷ সেখানকার কাগজপত্রও বেশিরভাগ নষ্ট, উধাও—কী করে নথি মিলবে৷

নথি দেখালেও কাজ হয়নি৷ দেড় লাখের বেশি গোর্খার নাম বাদ পড়েছে৷ চার প্রজন্মের বেশি সেনাবাহিনীর সদস্য—এমন পরিবারের নাম বাদ৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে তাম্রপদক পেয়েছেন৷ নাম বাদ৷ সেনাবাহিনীর শৌর্য পুরস্কার প্রাপ্ত সানাউল্লাহ ক্যাম্পে বন্দি৷ ৬৮ বছর আগে জন্ম৷ কর্ম আসামে৷ তবু বাদ৷ বাদ পড়াদের অধিকাংশ জন্মসূত্রে হিন্দু৷ মুসলিমও আছেন৷ আছে প্রায় এক লাখের বেশি অসমিয়া জনজাতির মানুষ৷

১৯৬৭-তে ডেরাপাথরা, যাকে আসামের দণ্ডকারণ্য বলা হয় ২৪০০ পরিবারকে সরকার আশ্রয় দেয় ৭ বিঘা করে জমি দিয়ে৷ তাদের সবার নাম বাদ৷

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে—কেউ খুশি নয়৷ রঞ্জন গগৈ এবং প্রতীক হাজেলা আগে ছিলেন অসমিয়া জাতীয়তাবাদীর চোখে নায়ক৷ এখন খলনায়ক৷ তাঁদের গোব্যাক ধ্বনি দেওয়া হয়েছে৷ বিজেপি-র বিরুদ্ধেও স্লোগান উঠেছে৷ হিন্দুদের কোনো ক্ষতি হবে না—এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেছিলেন মানুষ৷ তার ফল ভুগছেন৷

অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ রুখতেই হবে৷ এটাই সময়ের দাবি৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন