আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট

ইমানুল হক

ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পদধ্বনি৷ অথচ মধ্যবিত্ত মানুষ কেমন নির্বিচার৷ ‘সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর’ মনোভাব৷ মুড়ি ও মিছরি সমান দর৷ পাড়ার পেটো মস্তান আর সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনী, ইডি, সিবিআই, আয়কর—সব ক-টি দপ্তরকে নিজেদের মতো ইচ্ছেমতো চালনার অধিকারী—একও জন৷ সমান দর? এবং সমান বিপদ? গণতন্ত্রহীনতা খারাপ৷ কিন্তু ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর৷ এটা কবে যে বুঝবেন—অনেকে৷

কর্নাটকে বিধায়ক ৩০-৪০ কোটিতে কিনে সরকার ফেলে দেওয়া হল৷ খনি-দুর্নীতির খলনায়ক ইয়েদুরাপ্পা আবার ক্ষমতায় আসছেন৷ কর্নাটকে বিজেপি মাত্র ৩% ভোট পেয়েছিল৷ বিপক্ষে ৬%৷ তবু তারা সরকার গড়বে৷ কেননা, সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ বিচার করে বলেছে দলের বিধায়কদের বিধানসভায় হাজির হতে বাধ্য করতে পারবে না কংগ্রেস দল৷ বিধায়ক কেনা-বেচায় সিলমোহর দিয়ে দিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি৷ ভাবা যায়! ভারসাম্যের একটি খেলাও খেলা হল৷ বিধানসভায় অধ্যক্ষের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ—বলে৷ না বলে উপায়ই বা কী ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন, রাজ্যপাল নয়, বিধানসভায় অধ্যক্ষই শেষকথা৷

লোকসভার অবস্থা আরও ভয়ানক৷ সেখানে বিরোধীরা কথাই বলতে পারছেন না৷ ১২টি বিল প্রায় বিনা আলোচনায় সংখ্যাধিক্যে পাশ করানো হল৷ এনআইএ-র হাতে অধিক ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, যে এনআইএ প্রবল পক্ষপাতদুষ্ট৷ সন্ত্রাসবাদী সংঘ পরিবারের কেউ হলে বেকসুর ছাড়ের ব্যবস্থা, মুসলিম বা অন্য সম্প্রদায়ের হলে নির্বিচারে গ্রেপ্তার৷ বহুবছর জেল খেটে মুক্তি মিলছে৷ খাগরাগড়ে পাঁচ বছর ধরে এনআইএ কী করছে বোঝা মুশকিল৷ সাধ্বী প্রজ্ঞা ঘুরে বেড়াচ্ছেন জামিনে, অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে—এনআইএ আপত্তি করছে না৷ এই মামলার সরকারি আইনজীবী বলা হয়েছিল এনআইএ-র পক্ষ থেকে—সংঘী সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে নরম মনোভাব নিতে৷ বিচারপতি কুরেশি ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ায় তাঁকে প্রধান বিচারপতি হতে দেওয়া হল না৷ কলেজিয়ামের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও৷ মোদী-শাহকে ক্লিনচিট দেওয়া বিচারপতি সদাশিবম কেরলের রাজ্যপাল৷ একজন বিদেশে রাষ্ট্রদূত৷ ২৪২ জন কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক বিজেপি-র কথামতো না চলায় ছাঁটাই হয়েছেন৷ এর মধ্যে ১৩১ জন আইএএস অফিসার৷ ৬৪ জনকে যুগ্ম সচব পদে সরাসরি নিযুক্ত করা হয়েছে, এরা আরএসএস ক্যাডার৷ ১২ জন আয়কর কর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে৷ বিজেপি-র কথা অনুযায়ী তল্লাশি চালাতে ও মিথ্যা মামলায় রাজি না হওয়ায়৷

গুজরাতে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গা গণহত্যা হতে দিয়ে ক্ষমতায় আসেন মোদী৷ গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসে এস-৬ কামরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি আগুন লাগে৷ ওই কামরায় অযোধ্যা থেকে কোনো যাত্রী ওঠেননি৷ যাত্রী তালিকায় তিনজন মুসলিম ছিলেন৷ দুজন বাঙালি৷ তবু বলা হল ৫৮ জন করসেবক পুড়ে মারা গেছেন৷ বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশনের প্রতিবেদন পড়লেই সব পরিষ্কার হবে৷ রেলযাত্রীদের পোড়া দেহ আনা হল আমেদাবাদের৷ গান্ধীনগরে৷ পোড়া দেহ নিয়ে মিছিল করে লোককে উত্তেজিত করা হল৷ গণহিস্টিরিয়া জাগানো হল৷ এর প্রতিবাদ করলেন গুজরাতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারীণ পান্ডিয়া৷ এজন্য পরের মন্ত্রিসভায় তাঁকে ছোট পদ দেওয়া হল৷ তিনি পদত্যাগ করলেন৷ একটি পত্রিকাকে গোপন সাক্ষাৎকারে জানালেন, কীভাবে গুজরাতে গণহত্যার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ মদত ও নির্দেশে৷ এই রিপোর্ট বের হওয়ার সকালে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে খুন হয়ে গেলেন হারীণ পান্ডিয়। তাঁর স্ত্রী ও পরিবার থানায় অভিযোগ করতে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহের নামে৷ থানা অভিযোগ নিল না৷ আদালতে গেছেন৷ মামলা চলছে৷ হারীণ পান্ডিয়া খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সোহরাবুদ্দিনকে ভুয়ো সংঘর্ষে মেরে ফেলা হয়েছে৷ এই মামলার বিচারক সিবিআই আদালতের ব্রিজভূষণ লোয়া খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ৷ সে মামলা সুপ্রিম কোর্ট চলতে দেয়নি৷ নাকচ করে দিয়েছে পুনঃ তদন্তের আদেশ৷

গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী পুলিশ আধিকারিকদের গণহত্যাকারীদের না থামাতে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা নানাবতী কমিশনে ফাঁস করে দেন সাহসী অফিসার সঞ্জীব ভাট৷ তার জন্য প্রথমে তাঁকে সাসপেন্ড, পরে ছাঁটাই করা হয়৷ এতেও দমেননি তিনি৷ ফেসবুক-টুইটারে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ পেশ করতে থাকেন৷ তাঁর মুখ বন্ধের জন্য ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের এক পুরোনো মামলা খুঁচিয়ে তোলা হয়৷ বাজপেয়ীর মৃত্যু-সংবাদ যে গোপন রাখা হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী হাসপাতালে দেখতে না যাওয়ায়—তাও ফাঁস করেন সঞ্জীব ভাট৷ এরপর ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০১৯-এ মোদী ক্ষমতায় ফেরার পর জামনগরের আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল সঞ্জীব ভাটকে৷ একজন মদ্যপ ব্যক্তি রাস্তা অবরোধ ও বাসে অগ্নিসংযোগের দায়ে ধরা পড়েন৷ ছাড়া পান৷ ছাড়া পাওয়ার ১৫ দিন পর হৃদ্‌রোগে হাসপাতালে মারা যান৷ ওই ব্যক্তিকে সঞ্জীব ভাট গ্রেপ্তার করেননি৷ কোনো জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেননি৷ মারধর দূরে থাক৷ সঞ্জীব ভাট ছিলেন তখন জেলার পুলিশ সুপারের অস্থায়ী দায়িত্বে৷

সঞ্জীব ভাট সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন আরো ৩০ জন সাক্ষীকে যাতে জেরা করা হয়৷ অনুমতি দেননি সুপ্রিম কোর্ট৷ জামিন চান৷ পাননি৷ ৮৬ জনকে রাস্তায় পিটিয়ে পুড়িয়ে মারার স্বীকারোক্তি করা বাবু বজরঙ্গি জামিন পেলেন সুপ্রিম কোর্টে৷ সঞ্জীব ভাট নন৷ একটাই দাবি—সঞ্জীব ভাটকে মুক্তি দাও৷

আসলে মোদীর বিরোধিতা করলে মাশুল গুনতে হবে৷ সুধা ভরদ্বাজদের মতন মানবাধিকার কর্মীরা জেলে পচছেন৷ ইন্দিরা জয়সিংহের মতন প্রতিবাদী আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ তবু প্রতিবাদ করতেই হবে৷ নয়তো ভারতের গণতন্ত্রকে বাঁচানো যাবে না৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন