ইমানুল হক
ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পদধ্বনি৷ অথচ মধ্যবিত্ত মানুষ কেমন নির্বিচার৷ ‘সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর’ মনোভাব৷ মুড়ি ও মিছরি সমান দর৷ পাড়ার পেটো মস্তান আর সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনী, ইডি, সিবিআই, আয়কর—সব ক-টি দপ্তরকে নিজেদের মতো ইচ্ছেমতো চালনার অধিকারী—একও জন৷ সমান দর? এবং সমান বিপদ? গণতন্ত্রহীনতা খারাপ৷ কিন্তু ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর৷ এটা কবে যে বুঝবেন—অনেকে৷
কর্নাটকে বিধায়ক ৩০-৪০ কোটিতে কিনে সরকার ফেলে দেওয়া হল৷ খনি-দুর্নীতির খলনায়ক ইয়েদুরাপ্পা আবার ক্ষমতায় আসছেন৷ কর্নাটকে বিজেপি মাত্র ৩% ভোট পেয়েছিল৷ বিপক্ষে ৬%৷ তবু তারা সরকার গড়বে৷ কেননা, সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ বিচার করে বলেছে দলের বিধায়কদের বিধানসভায় হাজির হতে বাধ্য করতে পারবে না কংগ্রেস দল৷ বিধায়ক কেনা-বেচায় সিলমোহর দিয়ে দিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি৷ ভাবা যায়! ভারসাম্যের একটি খেলাও খেলা হল৷ বিধানসভায় অধ্যক্ষের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ—বলে৷ না বলে উপায়ই বা কী ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন, রাজ্যপাল নয়, বিধানসভায় অধ্যক্ষই শেষকথা৷
লোকসভার অবস্থা আরও ভয়ানক৷ সেখানে বিরোধীরা কথাই বলতে পারছেন না৷ ১২টি বিল প্রায় বিনা আলোচনায় সংখ্যাধিক্যে পাশ করানো হল৷ এনআইএ-র হাতে অধিক ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, যে এনআইএ প্রবল পক্ষপাতদুষ্ট৷ সন্ত্রাসবাদী সংঘ পরিবারের কেউ হলে বেকসুর ছাড়ের ব্যবস্থা, মুসলিম বা অন্য সম্প্রদায়ের হলে নির্বিচারে গ্রেপ্তার৷ বহুবছর জেল খেটে মুক্তি মিলছে৷ খাগরাগড়ে পাঁচ বছর ধরে এনআইএ কী করছে বোঝা মুশকিল৷ সাধ্বী প্রজ্ঞা ঘুরে বেড়াচ্ছেন জামিনে, অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে—এনআইএ আপত্তি করছে না৷ এই মামলার সরকারি আইনজীবী বলা হয়েছিল এনআইএ-র পক্ষ থেকে—সংঘী সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে নরম মনোভাব নিতে৷ বিচারপতি কুরেশি ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ায় তাঁকে প্রধান বিচারপতি হতে দেওয়া হল না৷ কলেজিয়ামের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও৷ মোদী-শাহকে ক্লিনচিট দেওয়া বিচারপতি সদাশিবম কেরলের রাজ্যপাল৷ একজন বিদেশে রাষ্ট্রদূত৷ ২৪২ জন কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক বিজেপি-র কথামতো না চলায় ছাঁটাই হয়েছেন৷ এর মধ্যে ১৩১ জন আইএএস অফিসার৷ ৬৪ জনকে যুগ্ম সচব পদে সরাসরি নিযুক্ত করা হয়েছে, এরা আরএসএস ক্যাডার৷ ১২ জন আয়কর কর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে৷ বিজেপি-র কথা অনুযায়ী তল্লাশি চালাতে ও মিথ্যা মামলায় রাজি না হওয়ায়৷
গুজরাতে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গা গণহত্যা হতে দিয়ে ক্ষমতায় আসেন মোদী৷ গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসে এস-৬ কামরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি আগুন লাগে৷ ওই কামরায় অযোধ্যা থেকে কোনো যাত্রী ওঠেননি৷ যাত্রী তালিকায় তিনজন মুসলিম ছিলেন৷ দুজন বাঙালি৷ তবু বলা হল ৫৮ জন করসেবক পুড়ে মারা গেছেন৷ বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশনের প্রতিবেদন পড়লেই সব পরিষ্কার হবে৷ রেলযাত্রীদের পোড়া দেহ আনা হল আমেদাবাদের৷ গান্ধীনগরে৷ পোড়া দেহ নিয়ে মিছিল করে লোককে উত্তেজিত করা হল৷ গণহিস্টিরিয়া জাগানো হল৷ এর প্রতিবাদ করলেন গুজরাতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারীণ পান্ডিয়া৷ এজন্য পরের মন্ত্রিসভায় তাঁকে ছোট পদ দেওয়া হল৷ তিনি পদত্যাগ করলেন৷ একটি পত্রিকাকে গোপন সাক্ষাৎকারে জানালেন, কীভাবে গুজরাতে গণহত্যার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ মদত ও নির্দেশে৷ এই রিপোর্ট বের হওয়ার সকালে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে খুন হয়ে গেলেন হারীণ পান্ডিয়। তাঁর স্ত্রী ও পরিবার থানায় অভিযোগ করতে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহের নামে৷ থানা অভিযোগ নিল না৷ আদালতে গেছেন৷ মামলা চলছে৷ হারীণ পান্ডিয়া খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সোহরাবুদ্দিনকে ভুয়ো সংঘর্ষে মেরে ফেলা হয়েছে৷ এই মামলার বিচারক সিবিআই আদালতের ব্রিজভূষণ লোয়া খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ৷ সে মামলা সুপ্রিম কোর্ট চলতে দেয়নি৷ নাকচ করে দিয়েছে পুনঃ তদন্তের আদেশ৷
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী পুলিশ আধিকারিকদের গণহত্যাকারীদের না থামাতে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা নানাবতী কমিশনে ফাঁস করে দেন সাহসী অফিসার সঞ্জীব ভাট৷ তার জন্য প্রথমে তাঁকে সাসপেন্ড, পরে ছাঁটাই করা হয়৷ এতেও দমেননি তিনি৷ ফেসবুক-টুইটারে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ পেশ করতে থাকেন৷ তাঁর মুখ বন্ধের জন্য ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের এক পুরোনো মামলা খুঁচিয়ে তোলা হয়৷ বাজপেয়ীর মৃত্যু-সংবাদ যে গোপন রাখা হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী হাসপাতালে দেখতে না যাওয়ায়—তাও ফাঁস করেন সঞ্জীব ভাট৷ এরপর ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০১৯-এ মোদী ক্ষমতায় ফেরার পর জামনগরের আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল সঞ্জীব ভাটকে৷ একজন মদ্যপ ব্যক্তি রাস্তা অবরোধ ও বাসে অগ্নিসংযোগের দায়ে ধরা পড়েন৷ ছাড়া পান৷ ছাড়া পাওয়ার ১৫ দিন পর হৃদ্রোগে হাসপাতালে মারা যান৷ ওই ব্যক্তিকে সঞ্জীব ভাট গ্রেপ্তার করেননি৷ কোনো জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেননি৷ মারধর দূরে থাক৷ সঞ্জীব ভাট ছিলেন তখন জেলার পুলিশ সুপারের অস্থায়ী দায়িত্বে৷
সঞ্জীব ভাট সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন আরো ৩০ জন সাক্ষীকে যাতে জেরা করা হয়৷ অনুমতি দেননি সুপ্রিম কোর্ট৷ জামিন চান৷ পাননি৷ ৮৬ জনকে রাস্তায় পিটিয়ে পুড়িয়ে মারার স্বীকারোক্তি করা বাবু বজরঙ্গি জামিন পেলেন সুপ্রিম কোর্টে৷ সঞ্জীব ভাট নন৷ একটাই দাবি—সঞ্জীব ভাটকে মুক্তি দাও৷
আসলে মোদীর বিরোধিতা করলে মাশুল গুনতে হবে৷ সুধা ভরদ্বাজদের মতন মানবাধিকার কর্মীরা জেলে পচছেন৷ ইন্দিরা জয়সিংহের মতন প্রতিবাদী আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ তবু প্রতিবাদ করতেই হবে৷ নয়তো ভারতের গণতন্ত্রকে বাঁচানো যাবে না৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন