ইমানুল হক
আমার যা হয় হোক, তুই তো বাঁচবি না—৷ বাংলা চলচ্চিত্রে একসময় এই সংলাপ খুব শোনা যেত৷ এখন যেন সেই দশা৷ অর্থব্যবস্থা চৌপাট, রেলে তিন লাখ কর্মচারীর সামনে স্বেচ্ছাবসরের নামে কার্যত ছাঁটাই বিজ্ঞপ্তি৷ ইতিমধ্যেই ‘তেজ্স’ নামে একটি ট্রেনকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে৷ রেল লাইন সরকারের৷ রেলের লাভ বেসরকারি সংস্থার৷ কাটমানি খেয়ে বেচে দেওয়া হচ্ছে এসব৷ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৫০টি রেলস্টেশন বিক্রির সিদ্ধান্তও হয়েছে৷ কেনার লোক পাওয়া যায়নি তাই রক্ষা৷ সরকারি বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া, বিক্রির চেষ্টা৷ জেট এয়ারওয়েজ বন্ধ৷ মোবাইল সংস্থাগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ৷ বিএসএনএল কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না৷ ঠিকা কর্মীদের বেতন ছ-মাস নেই৷ বড় শহরগুলিতে ২৫টি বিএসএনএল সম্পত্তি তথা জমি বিক্রির তোড়জোড়৷ মহাসমারোহ বিক্রিতে, ধ্বংসে৷ গত ১০ বছরে একটিও নতুন প্রতিষ্ঠান গড়েনি বিজেপি সরকার৷ বরং নীতি আয়োগ জানিয়েছে, ৪৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেওয়া হবে৷
এইসব চলছে—তাতে জনগণ যাতে খেপে না তাই গেলানো হচ্ছে ধর্মের আফিম—বিদ্বেষ বিষ৷ রামমন্দির, মসজিদ, হিন্দু মুসলমান৷ এখন নতুন হাতে গরম ইস্যু কাশ্মীর৷
আর কী চাই?
ভোলাতে চাওয়া হচ্ছে অনেক কিছুই৷ কিন্তু ভোলানো খুব কঠিন৷
রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির৷ উষ্ণ৷ আর পৃথিবীতে ভূ-পরিবেশেও চরম উষ্ণতা বাড়ছে৷ আমেরিকায় আওয়াজ উঠছে—গড সেভ আস৷ খরাক্লিষ্ট ফুটিফাটা মাঠের ছবি ছাপা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ ফ্রান্সে নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন মানুষ গরম এড়াতে৷ ইংল্যান্ড, জার্মানি—সব দেশেই উষ্ণ আবহাওয়া৷ ভারতের অবস্থা করুণ৷ চেন্নাইয়ে জলের ট্যাঙ্কার যাচ্ছে ট্রেনে করে। বলা হচ্ছে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৪১টি বড় শহর জলশূন্য হয়ে যাবে৷ কলকাতার নাম এখনও তাতে ঢোকেনি৷ কলকাতার পাশে গঙ্গা আছে—সরকারের টাকা আছে—টালা পার্কের জল আছে—তাই—তেমন সরবতা অনুপস্থিত৷ শ্রাবণে আবহাওয়া এমন—কেউ তুলনা করছেন বৈশাখের সঙ্গে, কারও মুখে ভাদ্র মাসে৷ ৮-৯ আগস্ট একটু বৃষ্টি হল৷ কিন্তু তা পরিবেশ ও চাষের জন্য যথেষ্ট নয়, একদিকে উত্তরবঙ্গে বন্যা অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গে প্রায় খরা পরিস্থিতি৷ বেশিরভাগ জমিতে চাষ হয়নি৷ আষাঢ়ের অনেক চাষি গভীর নলকূপ বা অগভীর নলকূপের সাহায্যে জল তুলে বীজধান রুয়েছিলেন৷ তা জ্বলে গেছে৷ নতুন করে ধানের চারা তৈরির কাজ চলছে৷ কিন্তু যা বৃষ্টি হয়েছে তাতে ধান চাষ হওয়া দক্ষিণবঙ্গে কঠিন৷
তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী জানা গেছে দেশে এক কোটি পাঁচ লাখ গাছ কাটা হয়েছে৷ বুলেট ট্রেনের জন্য এক লাখ গাছ কাটা পড়বে৷ এ-রাজ্যেও যশোর রোডে রাস্তা সম্প্রসারণের নামে বহু গাছের মেয়াদ শেষ৷ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি দিন দিন কমছে৷ এসি বাড়ছে, বাড়ছে শপিং মল৷ ভোগবিলাসের আয়োজনে ঘাটতি নেই, কিন্তু পৃথিবীর মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগে মানুষ কম৷
আগে ৫ জুন পরিবেশ দিবসের কর্মসূচি পালিত হত ব্যাপকভাবে, ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকি দিবসে কলকাতা ও ভারতের রাজপথ উত্তাল হত৷ পয়লা সেপ্টেম্বর শান্তি মিছিলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা উচ্চারিত হত৷ এখন যুদ্ধের দামামা সিরিয়ায়, প্যালেস্টাইনে, গাজায়৷ কাশ্মীরকেও প্যালেস্টাইন বনানানোর উদ্যোগ প্রায় সম্পূর্ণ৷
দূষণের কারণ হিসেবে এতকাল বায়ু, শব্দ, জল, মাটি, তাপ, তেজষ্ক্রিয়তা, আলোক দূষণের কথা বলার রেওয়াজ৷ এখন যুক্ত হয়েছে বৈদ্যুতিন দূষণ৷ ঘরে বাইরে এত বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম৷ রাখবেন কোথায়৷
মোবাইল পরিষেবাও পরিবেশ দূষণের কারণ৷ এটা কমাতে হবে৷ ফোর জি-র জায়গায় আসছে ফাইভ-জি৷ সেটা খুব ক্ষতিকর৷ নেদারল্যান্ডে ফাইভ-জি-র বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে৷ পাখি মরে যাচ্ছে৷ আমাদের দেশও চড়ুই, তিতির, ঘুঘু, ময়না, প্রায় দেখাই যায় না৷ টিয়া, পায়রাও অদৃশ্য প্রায়৷
বিদ্যুৎক্ষেত্রগুলিও দূষিত করছে৷ জল, বায়ু-বিদ্যুতে জোর দেওয়া ছাড়া রাস্তা নেই৷ দেশে ২০২৫-এর পর পেট্রোল বা ডিজেলচালিত গাড়ি আর চলবে না৷ এত বিদ্যুৎ আসবে কোথা থেকে? তাহলে কি পরমাণু বিদ্যুতের মতো সর্বনাশা প্রকল্প? গবেষণা প্রকল্পে বরাদ্দ নেই৷ বৈজ্ঞানিকদের ছাঁটাই চলছে৷ টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে গবেষকদের বেতন অনিয়মিত৷ নেহেরুর আমলে তৈরি ইসরোর চন্দ্রযান প্রকল্পই তো সব নয়৷ দেহের মানুষকে চাঁদ আর যুদ্ধ দেখিয়ে কতদিন ভুলিয়ে রাখা যাবে৷
মনে রাখা জরুরি পরিবেশের আন্দোলন নিছক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ ও বিজ্ঞানীদের আন্দোলন নয়—একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলন৷
দেশের অর্থব্যবস্থার স্বার্থে মানুষের বেঁচে থাকার সুবিধা ও সুখের জন্য—এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের জীবনের জন্যও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে৷
গণপরিবহন চালু করতে হবে৷
দূষণ কমাতে হবে৷
একইসঙ্গে মন ও মননের দূষণ দূর করাও জরুরি৷
শুধু ওরা জব্দ হবে বলে বসে থাকলে সাড়ে সর্বনাশ৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন