কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি

ইমানুল হক

কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি

ক্লিনচিট (Cheat) কোম্পানি ‘সি’ বাদ পড়ে যাচ্ছে৷ কমিশন এখন ‘অমিশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মোদীর বক্তৃতাকে শুদ্ধ করে দিচ্ছে৷ বিজেপি দল যেমন এখন ওয়াশিং মেশিন৷ দুর্নীতির ওয়াশিং মেশিন৷ তৃণমূলে থাকলে চোর, গুন্ডা, দুর্নীতিগ্রস্ত৷ বিজেপিতে গেলেই সাচ্চা নেতা৷ তেমন নির্বাচন কমিশন তার সমস্ত অতীত গৌরব ধুলোয় লুটিয়ে দিচ্ছে৷ টি এন শেষন নির্বাচন কমিশনকে এক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন৷ যতই তাঁকে আমরা ‘ম্যাগালোম্যানিয়াক’ বলে গাল দিই না কেন! সুনীল অরোরারা তাকে শেষ করছেন৷

আগে লোকে বলত কোর্ট বা আদালত আছে৷ কোথাও না কোর্টে দেখে নেব৷ পরে, নির্বাচন এলে বলত, দাঁড়া নির্বাচন কমিশনে দিচ্ছি কেস ঠুকে৷ কিন্তু কী অবস্থা?

ছোটখাটো কিছু সমস্যা মেটায়নি, এমন বলা যাবে না৷ মায়াবতীকে ৪৮, যোগী ভোগীকে ৭২, সাধ্বী প্রজ্ঞাকে ৭২ ঘণ্টা নির্বাচনী প্রচার করতে দেয়নি৷ দেয়নি আজম খানকে—কুকথার জন্য৷ কিন্তু কুকথার শিরোমণি, কুকথার নর্দমাস্রোতের উৎসভূমি নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের ব্যাপারে ক্লিন চিট দিয়েই চলেছে৷ এখন ক্লিন চিট না বলে ‘ক্লিন চিট’ (clean cheat) বলা যেতে পারে৷ পরিষ্কার প্রতারণা৷ প্রতারণা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংবিধান ও নির্বাচনী বিধির প্রতি৷

সন্ত্রাসে অভিযুক্ত প্রজ্ঞাকে ৭২ ঘণ্টা নির্বাচনী প্রচার করতে ২০১৯-এ নিষেধ করেছিল নির্বাচন কমিশন৷ সে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ঘুরছে৷ প্রার্থী পদ বাতিল করা দরকার৷ কিন্তু করবে কে? ১০ মার্চ নির্বাচন ঘোষিত হল৷ ১৯ মার্চ নির্বাচন কমিশন বলল, সেনাবাহিনীকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা যাবে না৷ এর আগে রাস্তাঘাট, দেওয়াল সেনাবাহিনী আর অভিনন্দনের দাবিতে ভর্তি ছিল—সেনাবাহিনীর নামে ভোট চাইছিল মোদী বাহিনী৷ অভিনন্দনকে নিয়ে মোদী বন্দি অবস্থায় একটা টুইট পর্যন্ত করেননি—তাঁকে ভোটে ব্যবহারের চেষ্টা৷

পুলওয়ামায় ৪২ জন সেনা মৃত্যুর একটা তদন্ত কমিশন পর্যন্ত হয়নি৷ অথচ তাকে নিয়েই ভোট প্রচার৷ অবশ্য পুলওয়ামা নিয়ে কথা কম—বালাকোট নিয়ে বেশি৷ যে বালাকোট নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য—১২টি পাইন গাছ আর একটি কাক মরেছে৷

১ এপ্রিল ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত বহু বার বিধিভঙ্গ করেছেন মোদী এবং অমিত শাহ৷ প্রতিটি জনসভায় বলছেন সেনার কথা৷ ছড়াচ্ছেন তীব্র ধর্মীয় বিদ্বেষ৷ ভোট মেরুকরণ করছেন সরাসরি ধর্ম তুলে৷ আর সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনে ধর্ম ব্যবহার করা যাবে না বলা সত্ত্বেও স্লোগান। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয় কী করে? ‘জয় শ্রীরাম’ তো ধর্মীয় দলীয় শ্লোগান৷ অবশ্য জয় শ্রীরাম নয়, ছিল ‘জয় সিয়ারাম’৷ মানে ‘জয় সীতা রাম’। কিন্তু বিজেপির পিতা আরএসএস তো নারীবিরোধী, নারীবিদ্বেষী—তাই সীতা বাদ৷ (নরেন্দ্র মোদীর স্ত্রীও বিনাদোষে নির্বাসিতা)৷

মোদী, অমিত শাহ—সবাই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছেন৷ অবস্থা এত ভয়ংকর—এ নিয়ে কমিশনে আপত্তি জানিয়ে কেউ চিঠি পর্যন্ত দেননি৷ আমরা অনেকে শুধু মেনে নয়, মনেও নিচ্ছি৷ ভাবুন, ‘আল্লা হো আকবর’ বলে কোনো নির্বাচনী সভায় স্লোগান উঠল—তাহলে সমস্ত প্রচার মাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়বে না? কোনো মুসলিম সংগঠনের নেতা বলবেন, ইউপি থেকে ১০০০ ছেলে এনে ঢুকিয়ে দেব৷ তারপর কী হবে?

তরোয়াল, গদা, তির-ধনুক নিয়ে মিছিল করছে, কল্পনা করুন, আসামের বদরুদ্দিন আজমল বা পশ্চিমবঙ্গের সিদ্দিকুল্লাহ বলছেন—বুক লক্ষ্য করে গুলি চালান৷ কিংবা বলছেন—ঘরে ঘরে ঢুকে মারব৷ নির্বাচন কমিশন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করত না? পুলিশ গ্রেপ্তার করত না?

গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদ চলছে৷ আর সেই ফ্যাসিবাদকে বৈধতা দিচ্ছে সাংবাদিক একটি সংস্থা৷ বিহারে ভোটের পর হোটেলের ঘরে ইভিএম পাওয়া যাচ্ছে৷ কোনো কোনো কেন্দ্রে ৩০০-র বেশি ইভিএম খারাপ হচ্ছে৷ অভিযোগ, যেখানেই বোতাম টিপুন—ভোট পড়ছে পদ্মফুলে৷ যোগী বলেছিলেন, ইভিএম মানে এভরি ভোট মোদী৷ তাকে যেন প্রমাণ করেই ছাড়বে সুনীল অরোরার পুতুল কমিশন৷

সুনীল অরোরা আইএএস৷ নীরা রাডিয়া টেপে প্রথম শোনা যায় তাঁর নাম৷ ‘আউট লুক’ পত্রিকার খবর : সুনীল অরোরা নীরা রাডিয়ার সঙ্গে চ্যাটে জানিয়েছিলেন, কীভাবে মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে এক বিচারপতি বিজেন্দর জৈনকে নয় কোটি টাকায় কেনা গেছে৷ রায় নাকি দেওয়ার একমাস আগে লেখা হয়ে গিয়েছিল এবং সে রায়ের অগ্রিম কপি পৌঁছে গিয়েছিল৷

‘আউট লুক’ থেকে সামান্য সংলাপ তুলে দেওয়া যেতে পারে—

সুনীল অরোরা : হায়ার জুড়িসিয়ারি মে করাপশন বহুত হো গয়ি না…

নীরা রাডিয়া : বহুত জ্যায়দা, ইটস লাইক এ ক্রেজি সিচুয়েশন…

সুনীল অরোরা : ইন দি সিলিং কেসেস, ওয়ান চ্যাট হ্যাড টোল্ড মি দ্যাট হি উইল গেট দিস জাজমেন্ট আফটার ওয়ান মান্‌থ৷

নীরা রাডিয়া : হাঁ৷

সুনীল অরোরা : আই সেড ইয়ার, তুম মজাক কর রহে হো, হি সেড, ম্যায় আপকো বাতা রাহা হুঁ ইয়ে জাজমেন্ট হ্যায়, অ্যান্ড হি ব্রডলি আউটলাইনড দি জাজমেন্ট…কি দিস ইজ টু বি প্রোনাউন্সড আফটার ওয়ান মান্‌থ৷

একটা জমি মামলার ঘটনা এটা৷ সেই মামলার রায় পুরোপুরি মিলে যায়৷ সুনীল অরোরা নীরাকে সেই বিচারপতির নাম জানিয়ে দেন, তিনি পাঞ্জাব/হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও হন৷ এই ঘুষখোর বিচারপতি বিজেন্দ্রর জৈন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাভারওয়ালের খাস আদমি ছিলেন বলেও জানান সুনীল অরোরা৷

সাংবাদিক, আমলা, জমি দালাল, প্রোমোটার, বিচারপতিদের মধ্যে অবৈধ লেনদেন ও পক্ষে রায়দানের ঘটনা বুঝিয়ে দেয় অবস্থা কত গুরুতর৷ এবং সেখানে সুনীল অরোরার ভূমিকা কী?

(আউট লুক, ২৭ ডিসেম্বর ২০১০ সংখ্যা)।

সুনীল অরোরার সঙ্গে যখন নীরা রাডিয়ার কথা হয়, তখন তিনি এয়ার ইন্ডিয়ার প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং আমলা হিসেবে কাজ করে চলেছেন৷

এই যাঁর অবস্থান তিনি কোনও নীতিসম্মত সিদ্ধান্ত নেবেন এই আশাই করা যায় না৷ তাঁকে কংগ্রেস আমলে রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ রাজস্থানে৷ বাজপেয়ী জমানায় তাঁর কেন্দ্রে আসা৷ বিজেপি আমলেই তাঁর যত প্রাইজ পোস্টিং৷ অনেকের অনুমান, তিনি কৃতজ্ঞতার জন্য মূল্য ঢোকাচ্ছেন৷ এবং মোদী ভাবছেন, নির্বাচন কমিশন তাঁর অধস্তন কর্মচারী৷ যা বলব তাই শুনবে৷ দেশটাও যেন মোদী অমিত শাহের সম্পত্তি৷ যা খুশি করছেন৷ যা খুশি বলছেন৷ কমিশনের একটাই কাজ একটা টাইপ করা বিবৃতি কপি পেস্ট করা৷

একই কথা৷ একই উত্তর৷ বিষয় ক্লিন চিট৷ রেকর্ড করেছে নির্বাচন কমিশন৷ আটবার ক্লিন চিট দিয়ে৷

একটু ঘটনাক্রম দেখা যাক :

১৯ মার্চ ২০১৯ : নির্বাচন কমিশন বললেন সেনা নিয়ে কোনো দল কিছু বলবেন না৷ কার্যত মোদী অমিত শাহ এমন কোনো সভা নেই যেখানে সেনাদের নামে ভোট চাননি৷ আর মুসলিমবিরোধী মন্তব্য, ভোটকে হিন্দু-মুসলিম-পাকিস্তানে পরিণত করা জলভাত৷

১ এপ্রিল : মোদী উবাচ : তারা বাধ্য হয়েছে আশ্রয় নিতে এমন জায়গায় যেখানে সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরু৷ প্রসঙ্গ রাহুলের ওয়েনাডে ভোটে লড়া৷

৪ এপ্রিল : আমার প্রথম ভোটদাতারা তোমরা বালাকোটের অভিযান চালানো বীর সেনাদের নামে ভোট দেবে না?

৫ এপ্রিল : আবার টানলেন কেরালার ওয়েনাডে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু বিষয়৷

২১ এপ্রিল : আমরা কি পরমাণু বোমা দেওয়ালির জন্য সাজিয়ে রেখেছি?

২১ এপ্রিল : পাকিস্তান পাইলটকে ফেরানোর ঘোষণা করেছে…নাহলে ওই রাত হত কোতল কি রাত?

(কার্যত পাকিস্তানে বন্দি পাইলট অভিনন্দন নিয়ে কোনো পদক্ষেপ করেনি মোদী সরকার৷ একটা টুইট পর্যন্ত না৷)

২৫ এপ্রিল : আবার বালাকোট প্রসঙ্গ৷

আর আমাদের নির্বাচন কমিশন কতটা সক্রিয়? কতটা কার্যকর? দেখুন :

১ এপ্রিল-অভিযোগ—ক্লিন চিট-৩০ এপ্রিল তাও সুপ্রিম কোর্ট বলার পর

৪ এপ্রিল-অভিযোগ—ক্লিন চিট ১ মে

৫ এপ্রিল-অভিযোগ—ক্লিন চিট ৩ মে

১২ এপ্রিল-অভিযোগ—ক্লিন চিট ৭ মে

২১ এপ্রিল-অভিযোগ—ক্লিন চিট ২ মে

২৫ এপ্রিল-অভিযোগ—ক্লিন চিট ৩ মে

আরও তিনটি অভিযোগের ক্লিন চিট দিয়েছে ৭ মে ২০১৯ : এটা দেখে ‘দি টেলিগ্রাফ’ শিরোনাম করেছে ক্লিন চিট কান্ট্রি৷ উপশিরোনাম : ই ই সি ই ই : বোল্ট স্টেন রিমুভার ফর লিলি—হোয়াইট লিডার্স৷

নির্বাচন কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে৷ তারা কাজ করছে মোদীর হয়ে৷ ব্যালটে নির্বাচনে রাজি তো নয়ই, ভিভি প্যাটের ৫%-ও গুনতে রাজি নয়৷ সুপ্রিম কোর্টও বিব্রত প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে৷ তিনি তো এই মামলা শুনতেই চাননি৷ এক মিনিটে রায়৷ ‘শুনব না’৷

দি টেলিগ্রাফ যথাযথভাবে নির্বাচন কমিশনের তিন কমিশনারের বদলে তিন বানরের মুখ ছেপেছে৷ গান্ধীর বানর : যারা খারাপ দেখে না, খারাপ শোনে না, এবং খারাপ কথা বলে না৷ জাপানিতে এদের নাম ছিল মিজারু, কিকাজারু এবং ইয়াজারু৷ গান্ধীজি নাম দিয়েছিলেন : বাপু, কেতন এবং বান্দর৷

তবে আমাদের ‘কেতন’ ভিন্ন সুরে গেয়েছেন৷ শোনা যাচ্ছে আরেক নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা ক্লিন চিট দেওয়ার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন৷ কিন্তু দু-জনের মত গ্রাহ্য হয়েছে, আপত্তির কথা নোটে লেখাও হয়নি৷

লাভাসার পরবর্তী মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার কথা৷ (শেষ পর্যন্ত হননি। পালিয়ে বাঁচেন। ইডি আয়কর তদন্ত করেছিল তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে।)

শেষ সংবাদ : রাজীব গান্ধীও ক্লিন চিট পেয়েছিলেন আদালত থেকে৷ তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলাও ঠিক কাজ, জানিয়ে দিয়েছে নয়া ক্লিন চিট কোম্পানি৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন