‘সব খেলার সেরা…’

ইমানুল হক

‘মানুষের ক্ষমতা লাভ হয় বস্তুজগৎ সম্বন্ধে তার জ্ঞানের থেকে; যা আবার সে ততখানিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যতখানি সে বস্তুজগতে নিয়মগুলি বুঝতে পারে৷ এটিই আধুনিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ’৷

জর্জ টমসন৷ দি হিউম্যান এসেন্স : দি সোর্স অফ সায়েন্স অ্যান্ড আর্ট৷

১৯৩৬, স্পেনে আগ্রাসন ঘটছে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর৷ সামরিক বাহিনী আর ফ্যাসিবাদী হিটলারের মদতে প্রগতিশীল বামপন্থীদের সরকার ভেঙে চলছে নির্মম অত্যাচার, দমন পীড়ন৷ অত্যাচারী ফ্রাঙ্কো ব্যবহার করলেন ফুটবলকে৷ জনপ্রিয় ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদকে সমর্থন ও মদত দিতে শুরু করলেন স্বৈরাচারী ফ্রাঙ্কো৷ তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ালেন মানুষ৷ আরেক ফুটবল ক্লাব রেয়ো ভ্যালক্যানো হাতিয়ার হল বামপন্থী প্রতিবাদের৷ অস্ট্রিয়ার হয়ে দারুণ খেললেন ম্যাথিয়ুস সিন্ডেলার৷ হিটলার তাঁকে বললেন ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে খেলতে৷ রাজি হলেন না৷ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গ্যাস দিয়ে মেরে ফেলা হল তাঁকে৷ আবার একদা অত্যাচারিত এখন অত্যাচারী ইসরায়েলের মাটিতেই ইহুদি সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে এক বামপন্থী ফুটবল ক্লাব হ্যাপোয়েল৷ তেল আভিভের এই ক্লাব ফ্যাসিবাদবিরোধী৷ চে গুয়েভারার ছবি থাকে ক্লাবে৷ ব্যানারে৷ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব লিভারপুল৷ প্রগতিশীলতার পক্ষে৷ ১৯৯০-এ ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমর্থনে জার্সি উড়িয়ে দেন এক খেলোয়াড়৷ আর লিভারপুল সরাসরি সমর্থন জানায় শ্রমিকদের ধর্মঘটকে৷

১৯৭৮-এ আর্জেন্টিনার সামরিক শাসক শ্রেণি ফুটবল বিশ্বকাপকে ব্যবহার করতে চায় জনপ্রিয়তার জন্য৷ যদিও তাঁদের প্রিয় খেলা ছিল রাগবি৷ ধনীরা খেলত রাগবি৷ গরিবের ফুটবল৷ আর্জেন্টিনার শাসকদের অত্যাচারের বিরোধিতায় বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ ছেড়ে দেন জোহান ক্রুয়েফ৷ আর্জেন্টিনার সামরিক শাসকদের হাতে খুন হন বহু মানুষ৷ ত্রিশ হাজার আজও নিখোঁজ৷ ২০১০-এ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে মারাদোনা, ফিদেলিস্তা মারাদোনা প্রিয় ফুটবলার মেসিকে নিয়ে যান ‘ত্রিশ হাজার মানুষকে ফিরিয়ে দাও’ আন্দোলনের নেত্রীর বাড়ি৷ এই মেসিই ২০১৮-তে অস্বীকার করেছেন বর্ণবিদ্বেষী ইজরায়েলে খেলতে যেতে৷ আর আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্লাবের বোকা জুনিয়ার্স ধনীদের ক্লাব রিভারপ্লেটের বিরোধী, বামপন্থী অবস্থান থেকে৷ তুরস্কের তিন নম্বর ক্লাব বেকিতাসের আছে নিজস্ব ইস্তাহার৷ তাতে বলা হয়েছে, জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গভেদের বিরোধী আমরা৷

ফুটবল খেলার শুরু কবে? কোথায়? সাধারণ্যে ধারণা, ইংল্যান্ডে উনিশ শতকে৷ সন্দেহ নেই আধুনিক ফুটবলের নিয়মকানুনের গোড়াপত্তন ইংল্যান্ডের সরকারি বিদ্যালয়ে৷ নিয়ম সূত্রায়িত হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে৷ তবে ফুটবল ধরনের খেলা বিশ্বে বহু দেশেই প্রচলিত ছিল গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের মধ্যে৷ বাতাবি লেবু বা কোনো একটা পাকিয়ে তোলা মোটামুটি গড়াতে সক্ষম বস্তু তৈরির ক্রিয়া-কৌশলে৷ বিশ্ব ফুটবল নিয়ামক সংস্থা ফিফা মেনেছে চিনই এই খেলার আদি বাসভূমি৷ চীনা নাম ৎসু৷ সময়কাল খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০২৷ হান রাজবংশের আমলে (খ্রি. পূ. ২০২—খ্রি. ২২০)৷ সাধারণ মানুষ শুরু করলেও পরে রাজারা যুক্ত হন লড়াকু এই খেলায়৷ জাপানে এর নাম হয় কেমারি (৬০০ খ্রিস্টাব্দ)৷ এখানে চিনের মতো বস্তুপূর্ণ চর্মগোলক নয়, হাওয়া ভরে খেলা৷ খেলা হত রাজ ক্রীড়াঙ্গনে৷ ফুটবলের আদি পর্বে গ্রিক নাম এপিসকিরোস৷ এই খেলার সঙ্গে রাগবির বেশি মিল৷ রোমে এর নাম হয় হারপাস্তুম৷ গ্রিক অনুসরণে৷

১৯৪২ এবং ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে বন্ধ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা৷ ইউরোপে ১১ বার হয়েছে বিশ্বকাপ৷ পূর্ব-ইউরোপে এই প্রথম বার৷ সোভিয়েত রাশিয়া অতীতে লেভ ইয়াসিনের মতো অনবদ্য গোলকিপার উপহার দিলেও এ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতেনি৷

২০১৪ বিশ্বকাপের খেলা দেখেছিলেন ২৬০ কোটির বেশি মানুষ৷ শুধু ফাইনাল খেলা দেখেন ৭১ কোটি ৫১ লাখ জন। ২০২২-এর বিশ্বকাপের খরচ ১৪.২ বিলিয়ন ডলার৷ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা৷ স্থানীয় সংগঠনের খরচ ৬২৭ মিলিয়ন ডলার৷ পুরস্কারের খরচ ৪০০ মিলিয়ন ডলার৷ টিভি স্বত্ব আয় ২৪১ মিলিয়ন ডলার৷ তথ্য প্রযুক্তি ব্যয় ৭৮ মিলিয়ন ডলার৷ টিকিট বাবদ আয় ৭৮ মিলিয়ন ডলার৷ প্রস্তুতি বরাদ্দ ৬২ মিলিয়ন ডলার৷ থাকা-খাওয়ার খরচ ৪৮ মিলিয়ন ডলার৷ বিমা খরচ একই পরিমাণ৷ অন্যান্য খাতে খরচ ২১১ মিলিয়ন ডলার৷ এবং উল্লেখ করা বাহুল্য হবে না যে, ২০১৮-র বিশ্বকাপ সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপ৷ (কাতার তাকে ছাপিয়ে গেছে।)

বিশ্বকাপের মূল প্রযোজক ৫টি সংস্থা৷ একটি ব্রাজিল-বেলজিয়াম যৌথ উদ্যোগ—আনহিউসের বুশ৷ তিনটি সংস্থা চিন দেশীয়৷ একটি হিসেনসে৷ বৈদ্যুতিন নির্মাণ সামগ্রী বেচেন তারা৷ অন্যটি ভিভো৷ মোবাইল প্রস্তুতকারক৷ আর আছে দুগ্ধজাত সামগ্রীর প্রতিষ্ঠান—মেঙ্গিনো৷ এটিও চিনা৷ আমেরিকার সংস্থা আছে একটি৷ খাবার বেচছে৷ ম্যাকডোনাল্ড৷ চিন যে অর্থনীতিতে এগোচ্ছে তার প্রমাণ পাঁচটার মধ্যে তিনটে চিনা সংস্থা৷ ফিফার সঙ্গে এবারও সহযোগী হিসেবে জুড়ে আছে জার্মান সংস্থা অ্যাডিডাস, দুটি মার্কিন কোম্পানি কোকাকোলা, ভিসা; দক্ষিণ কোরিয়ার হুয়ানডাই, কাতার বিমান৷ এবং আবারও চিনা ওয়ান্ডা৷ দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ বাড়ি ও ভবন নির্মাণ সংগঠন৷

এবার বিশ্বকাপের আসর চমকের আসর৷ সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যার আইসল্যান্ড প্রথম বিশ্বকাপ খেলছে৷ এবং কাঁপিয়ে দিয়েছে নামি তথাকথিত ফেভারিট দলের বুক৷ পানামাও এবার প্রথম৷ তবে পানামা পেপারের মতো হাঁকডাক নেই৷ খুব দামি তারকারা এবার অনেকেই নিষ্প্রভ৷ নতুন তারকার জন্ম হচ্ছে৷ আগামীতেও হবে৷ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো খানিকটা সুবিচার করেছেন হ্যাটট্রিক করে৷ মেসির ভক্তরা কিছুটা হতাশ৷ মানবিক হৃদয়ের এই ফুটবলার সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি৷ তবে বর্ণ ও ধর্মবিদ্বেষী ইজরায়েলে খেলতে না যাওয়ার কারণে তিনি এখন বিশ্বাসের প্রগতিশীলতার এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর মানসগুরু মারাদোনার মতোই৷

খেলোয়াড়দের বাজারদর এখন আকাশছোঁয়া৷ হিটলারের কথা না শুনে প্রাণ দেওয়া ফুটবলার অবাক হতেন জেনে মেসি, রোনাল্ড, নেইমার, রুমি, সুয়ারেজরা যথাক্রমে ১১১, ১০৮, ৯০, ২৭, ২৬.৯ মিলিয়ন ডলার বছরে পাচ্ছেন জেনে৷

প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ্বকাপ ফুটবল কি নিছক বিনোদন? অর্থ রোজগারের হাতিয়ার? বিজ্ঞাপনী সমারোহ? নাকি একটা সংকল্প, প্রতিজ্ঞা ও আদর্শের নাম?

আজকাল ফুটবল এদেশে কম৷ খেলা দেখা সার৷ অনেকের তাও শুধু বিশ্বকাপে৷ ক্রিকেটময় ভারত৷ ১৪টি দেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়৷ আহ্লাদে বিগলিত৷ অথচ বিশ্বকাপের প্রাথমিক বাছাই পর্বেই খেলে ২১১টি দেশ৷ সেখানে ভারত নেই৷ অথচ এ দেশেই লক্ষ লক্ষ আদিবাসী বস্তিবাসী তরুণ আছে যারা পান্তাভাত খেয়ে ফুটবল খেলে৷ তাঁদের রাজ্য বা জাতীয় আঙ্গিনায় তুলে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ শুধু খেয়োখেয়ি মারামারি৷ সন্তোষ ট্রফি আকর্ষণহীন৷ ছাত্র প্রতিভা তুলে আনার সুব্রত কাপের কথা আর শুনি না৷ ব্লক স্তর থেকে জেলা, জেলা থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে দেশ স্তরের প্রতিযোগিতা চাই৷ ব্লক স্তরেই চাই স্টেডিয়াম ও প্রশিক্ষণ শিবির৷ ১৩০ কোটির দেশ কেন নেই তেমন স্টেডিয়াম ও প্রশিক্ষণ শিবির? ১৩০ কোটির দেশ কেন পারবে না? এদেশেই জন্মেছেন বাইচুং, সুনীল ছেত্রী, থঙ্গরাজ, বাঘা সোম, পিকে, অমল দত্ত, জুম্মা খান, নইমুদ্দিনরা৷ তাহলে?

নাকি আমরা শুধু মজার নামে পরস্পরকে ঠুকে যাব ফেসবুকে, হোয়াটসঅপে? বিদ্বেষ বাড়বে৷ তবে ভালো দিক একটা আছে—বিভিন্ন দেশের মানুষ অন্য দেশের পতাকা ওড়ায়, আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে৷ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে৷

যে আন্তর্জাতিকতা থেকে ইতালিয়ান লেভারনো ক্লাবের দরজায় লেখা থাকে, আমরা গর্বিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, গাওয়া হয় আন্তর্জাতিক সংগীত, পালিত হয় কেবল স্তালিনের জন্মদিন, স্কটল্যান্ডের কেল্টিক ক্লাবের সদস্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে খেলার সময় ওড়ায় প্যালেস্টাইনের পতাকা, ইতালির নামজাদা ক্লাব ইন্টার মিলান রুখে দাঁড়ায় ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির বিরুদ্ধে৷ মেক্সিকোর সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনে অর্থ সাহায্য পাঠায় বামপন্থী অধিনায়ক জেনেত্তির নেতৃত্বে৷

লিভারটনের এক সংগঠক ধরেছেন, ফুটবলের মূল সুরটিকে—ফুটবলে কেউ একক নয়, একা সব নয়, প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য কাজ করে, প্রত্যেকে ভাগ পায় পুরস্কারের সমানভাবে, শ্রম পায় মর্যাদা, প্রতিভার সঙ্গে শ্রমও সম্মানিত হয়, ধনী আর দরিদ্রের বিভেদ যায় ঘুচে, বলে সমতার কথা, একাত্মতার কথা, যা ছাড়া কোনো দল সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, দেশ জাতি বাঁচতে পারে না৷ ২০১৮-র বিশ্বকাপ সেটাই আরেকবার প্রমাণ করেছে৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন