বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ

ইমানুল হক

বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ

ইদ নয় দুর্গাপূজা নয়, বাঙালির জাতীয় উৎসব হোক পয়লা বৈশাখ৷ এখন যা দিনকাল তাতে রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তীও না লিখতে হয়! এই শ্লোগান দিয়ে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই বাংলায় প্রথম শুরু হয় বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ৷ সেদিন দগ্ধ বৈশাখ৷ পিচ রাস্তা৷ মাথার ওপর ছাউনি জোগাড় করা যায়নি৷ থাকার মধ্যে সম্বল শুধু একটি মেহগনি গাছ ও তার ছায়া৷ আজ আর ঠিক মনে পড়ে না মাথার ওপর একটা চট দেওয়া গিয়েছিল কিনা? সকালে গিয়ে দেখি মাত্র তিনটি চৌকি এসেছে৷ দরকার যে ছ’টি৷ এল না৷ মঞ্চ সজ্জা হল একটি তালাই, খেজুর পাতায় বোনা তালাই দিয়ে৷ তাতে সন্তু থার্মোকল কেটে লিখে দিল অ আ ক খ৷ পরে কাঁথিতে গিয়ে শুনি এক অতি কিশোর এসে বলছে, সে আমাকে দেখেছে অ আ ক খ অনুষ্ঠানে৷ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাতটায়৷ বিমান বসু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন, এসেছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়৷ দুজনে মিলে কোলাকুলি করলেন৷ তারপর এক সঙ্গে পান্তাভাত শুঁটকির স্বাদ নিলেন৷ ‘আজকাল’ ছাড়া কোনও কাগজ সংবাদ করেনি৷ তবু দিনভর অজস্র মানুষ৷ পীযূষকান্তি সরকার, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, অজিত পাণ্ডে, অমর পাল, বিমান মুখোপাধ্যায়, রাজেশ্বর ভট্টাচার্য, শুভেন্দু মাইতি, সুধীন ভট্টাচার্য, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, পল্লব কীর্তনীয়া, নাজমুল হক, পিলু ভট্টাচার্য, সুপান্থ বসু, ধীরেন বসু, সুকুমার মিত্র, প্রদীপ ঘোষ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শুভ দাশগুপ্ত, প্রণতি ঠাকুর, বিপুল তনুশ্রী, দেব চৌধুরী প্রমুখ গানে অংশ নেন। এসেছিলেন অশোক মিত্র, অমিয় বাগচী, পরমেশ আচার্য, মিহির ভট্টাচার্য, মালিনী ভট্টাচার্য, জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, মালবিকা চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, অরিজিৎ মিত্র, শোভা সেন, চন্দ্রা দস্তিদার, তরুণ সান্যাল, শতরূপা সান্যাল, চিত্রাঙ্গদা সান্যাল, ঋতাভরী সান্যাল প্রমুখ৷

দুপুরে মাছভাত আলুপোস্তর আয়োজন হয়েছিল৷ নিজেরাই সেবার রান্নার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল৷ ৩৫০ জন মানুষ খেয়েছিলেন৷ ঋচা সরকার প্রায় দিনভর সঞ্চালনা করেছিলেন৷ ভাষা ও চেতনা সমিতি তখন খুব পরিচিত নাম৷ বড় কাগজ গাল দেয় নাম করে এবং না করে৷ খাসখবর নিয়মিত দেখায়৷ ‘প্রতিদিন’ সমালোচনা করে৷ ‘আজকাল’ কিন্তু নিয়মিত পাশে থেকেছে৷

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন পয়লা বৈশাখ, পয়লা বৈশাখ কেন নয়? উত্তরটা হওয়া উচিত এমনই৷

পৃথিবীতে এখন ২৯ কোটি বাঙালি৷ এর মধ্যে ৮ কোটি জন্মসূত্রে হিন্দু৷ ২০ কোটির বেশি মুসলমান ১ কোটি খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি৷

৮ কোটির দুর্গাপূজা কখনও সব বাঙালির জাতীয় উৎসব হতে পারে না৷ বিশেষত মুসলিমদের এক বড় অংশ মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নন৷ আবার ২০ কোটির ইদও জাতীয় উৎসব হতে পারে না৷ বাদ থেকে যায় ৯ কোটি মানুষ৷

পয়লা বৈশাখ এমন একটা দিন, যেখানে হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জৈন সবাই মিলিতে পারেন৷ এই দিন এক সময় আকবরের আমলে ছিল কর দেওয়ার দিন৷ এখন এটা জাতিকে কর বা মূল্য দেওয়ার দিনে পরিণত হয়েছে৷

পয়লা বৈশাখ চাষী তার লাঙল ধুয়ে পরিষ্কার করেন৷ মুদি দোকানদার করেন হালখাতা। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ঠেকাতে পারে, একমাত্র বাংলা ও বাঙালিয়ানা৷

বাঙালিয়ানার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটতে পারে পয়লা বৈশাখে৷ নতুন পোশাক, পান্তাভাত শুঁটকি, আমপোড়া শরবত, মাছ ভাত আলুপোস্ত আর বাংলার মিষ্টির সম্ভারে কেটে যেতে পারে একটা অন্যরকম দিন৷

বাঙালি ব্রাহ্মণও মাছ মাংস খায়৷ যা উত্তর ভারত তথা গোবলয় ভাবতেই পারে না৷ বাঙালি শিব তথা নটরাজের উপাসক৷ নৃত্যে গানে তার জীবন বন্দনা৷

বাংলা ভাষা, সাহিত্যের দিন একসময় ছিল পয়লা বৈশাখ—আজ আবার তাকে জাগানোর সময় এসেছে৷ বাংলা ভাষা না বাঁচলে বাংলা সাহিত্য বাঁচবে না৷ পয়লা বৈশাখ বাঙালির শিকড়ের সন্ধান৷ বাঙালির অর্থনীতির শিকার যাত্রা৷ বাংলার তাঁত, বাংলার সূতি বস্ত্র বাংলার খাবার—বাঙালির বীজমন্ত্র৷ বাংলা ও বাঙালিকে বাঁচাতে হলে পয়লা বৈশাখ সবচেয়ে বড় অস্ত্র৷

বাঙালির মন প্রকৃত লালে, ফুলে ফুলেল হয়ে ওঠে রুদ্র পলাশে প্রখর গ্রীষ্মে৷ শীত তার আবরণ৷ গ্রীষ্ণ তার প্রবল পৌরুষ প্রকাশ৷

ঝড়ো সন্ধ্যায় বাঙালি জাগে৷

পয়লা বৈশাখে৷

পয়লা বৈশাখ মানে জাতীয় ভাষা ও জাতীয় সংস্কতির বিকাশ৷

জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ সম্ভব নয়৷

জাতীয় ভাষার বিকাশ না হলে বিজ্ঞান চিন্তারও বিকাশ হবে না৷

বিজ্ঞান চিন্তার বিকাশ ছাড়া প্রযুক্তির বিকাশ হবে না৷

বিজ্ঞান চিন্তার প্রসারের মধ্য দিয়েই আসবে যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বিকাশ সম্ভব৷

আর এজন্যই প্রয়োজন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় উৎসবের৷ পয়লা বৈশাখ তার প্রথম ও শেষ দিক চিহ্ন৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন