কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?

ইমানুল হক

ভোর পাঁচটা৷ ১৫ জুন ২০১৯৷ ঘুম ভেঙে গেল কবুত্রী দেবীর৷ তাঁর সাত বছরের মেয়ের তীব্র খিঁচুনি হচ্ছে৷ গোঙাচ্ছে৷ সন্ধ্যায় কবুত্রী দেবী জানলেন তাঁর মেয়ে সুগান্তি আর ফিরবে না৷ এনসেফেলাইটিস কেড়ে নিয়েছে তাকে৷ গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরে এক জলঝোরার কাছে কবর দিয়ে ফিরলেন৷ পরদিন সকালে কবুত্রী দেবী দেখলেন তাঁর পাঁচ বছর বয়সি মেয়ে রূপান্তির একইরকম খিঁচুনি হচ্ছে৷ একই রোগে মারা গেল সেই সন্ধ্যাতেই৷ দিদির পাশে শুইয়ে দিয়ে আসতে হল বোনকে৷ কবুত্রী দেবী আজ মুখে অন্ন তুলতে পারেন না৷ অন্ন পাবেনই-বা কোথায়?

লোকে বলছে, বিহারে যে প্রায় দুই শতাধিক শিশু মারা গেছে তার কারণ এনসেফালাইটিস৷ সমাজবিজ্ঞানীরা বলবেন, এটা মৃত্যু নয়, হত্যা৷ পরিকল্পিত হত্যা৷ ওদের মৃত্যুর আসল কারণ দারিদ্র্য৷ তীব্র দারিদ্র্য৷ বলা হচ্ছে অপুষ্টিতে ভোগার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম৷ অপুষ্টি পোশাকি শব্দ৷ আসল কথা অনাহার৷ সব কিছু নরম পেলব মেদুর করে দেখা হচ্ছে৷ অনাহারকে ডাকা হচ্ছে অপুষ্টি নামে৷ নব সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্বায়ন নামে৷ খুনি গুন্ডাদের দলকে রাজনৈতিক দল হিসেবে৷

আজকাল রাজনীতি কম৷ ক্ষমতানীতি বেশি৷ ডাক্তার নর্মান বেথুনের কথা উচ্চারিতই হয় না৷ যিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর প্রধানতম অসুখের নাম দারিদ্র্য৷

সুগান্তি বা রূপান্তির মতো ২০০-র বেশি শিশু মারা গেছে দারিদ্র্যের কারণে৷ যে দেশে এক বছরে ১১০০০ লোক কোটিপতি হয়, সে দেশে অনাহারে-অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ভুগে মারা যাওয়াই যেন স্বাভাবিক। এদেশে শতাধিক রোগীর মৃত্যু বড় খবর নয়৷ এদেশে পানীয় জলের জন্য বিরাট বিরাট লাইন সংবাদ নয়৷ এদেশে ঋণের জ্বালায় আত্মহত্যা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা৷

বিহারে এনসেফেলাইটিসে মৃত্যু প্রতিবছর ঘটে, ঘটছে৷ উত্তরপ্রদেশে ২০১৮-য় ১১০০-র বেশি শিশু বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে এনসেফেলাইটিসে৷ ডাক্তার কাফিল খান এই রোগীদের জন্য পকেট থেকে অক্সিজেন কিনে দিয়ে সাসপেন্ড হয়ে যান ২০১৭-তে৷ যেতে হয় জেলেও৷ সেই কাফিল খান বিহারে এসেছেন৷ চিকিৎসা করতে৷ বিনা পয়সায় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ওষুধ৷ পাশে পেয়েছেন ভোটে জেতা নয়, ভোটে হারা দেশদ্রোহী কানহাইয়া কুমারকে৷ পশ্চিমবঙ্গ ৭ দিন ধরে ‘রোগীদের স্বার্থে’ নিরাপত্তার নামে হাসপাতালের গেট আটকে রাখা ডাক্তাররা কেউ বিহার গেছেন বলে খবর নেই৷ আইএমএ-র কোনো প্রতিনিধি দল যায়নি৷ এইমসও নীরব৷

স্বাস্থ্য এখন পণ্য৷ অধিকার নয়৷ আর গরিব দলিত সংখ্যালঘুর জন্য এগুলো শোনাও গর্হিত অপরাধ৷ খেয়াল করবেন যাঁরা মারা যাচ্ছেন তাঁরা অধিকাংশই দলিত৷ এবং এঁদের বেশিরভাগ মেয়ে৷ মেয়ে হলে খাবার কম পায়৷ কম দেওয়া হয় তাঁদের৷ যে দেশে শিক্ষিত সমাজ অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, মিড ডে মিলের বিরোধিতা করে, যে দেশে সব কিছু ডিজিট্যাল করার স্বপ্নে মাতানো হয়—সে দেশে ২০০ শিশুর মৃত্যু নিয়ে কোনো আওয়াজ নেই৷

এনসেফেলাইটিসকে প্রথমে বলা হত জাপানি এনকেফালাইটিস৷ এখন বলা হয় শুধু এনসেফেলাইটিস৷ বিশ শতকে আশির দশকে এই রোগ পশ্চিমবঙ্গ দেখা দেয়৷ বহুজন মারাও যায়৷ পরে এই রোগের প্রকোপ কমে৷ কমে, কারণ সচেতনতা এবং গ্রামে অপুষ্টি অনাহার দারিদ্র্য কমা৷ বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কার, খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, জেনারেল রিলিফ ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে না-খেতে-পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমায়৷ ফলের রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়ে শরীরে৷

বিহারে হাসপাতালের অবস্থা ভয়ংকর৷ মুজফ্‌ফরপুর দেখিয়ে দিয়েছে বিহারের আসল ছবি৷ পশ্চিমবঙ্গে তুলনায় অনাহারী মানুষ কম৷ অনাহার কম, ফলে অপুষ্টিও কম৷ এখানে ডাক্তার আন্দোলন নিয়ে বিজেপি সরব, বিহারের শিশুমৃত্যু নিয়ে চুপ৷ বিহার তো শেখাচ্ছে, শুধু রোগের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, রোগীর আর্থিক সংকট মোচনের লড়াইও লড়তে হবে৷ নাহলে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে শিশুমৃত্যু মিছিল চলবেই৷ সুগান্তি রূপান্তিরা মরবে৷ সন্তানহারা বাবা-মা প্রতিবাদ করলে, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা নিয়ে প্রশ্ন তুললে পুলিশ মামলা ঠুকে জেলে ভরবে৷ আর চলবে ধর্মের নামে মানুষের মন বিষিয়ে মানুষ খুন৷ ‘নয়া ভারত’-এর এটাই এখন দস্তুর৷

আসল সমস্যা আড়াল করতে অপধর্মের রঙিন বাহারি পর্দা ঝুলতেই থাকবে৷ বিজ্ঞান কংগ্রেসে বক্তৃতায় আয়ুষ্মান ভারতের গপ্পো শোনা গেছে৷ পাঁচ লাখ করে নাকি পাবেন মানুষ৷ কোথায় গেল সেসব টাকা? পয়লা জুলাই চিকিৎসা দিবস৷ সেদিনে এসব নিয়ে কিছু কথা হবে তো?

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন