গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?

ইমানুল হক

পেটের কাছে উঁচিয়ে আছ ছুরি
কাজেই এখন স্বাধীনভাবে ঘুরি
এখন সবই শান্ত, সবই ভালো৷
তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
যে কথাটাই বলাতে চাও বলি
সত্য এবার হয়েছে জমকালো৷
পেহলু খানকে কেউ খুন করেনি

(শঙ্খ ঘোষ)

মানুষ সবচেয়ে যা বেশি অপচয় করে, তা জল৷ জল পয়সা দিয়ে এখনও বেশিরভাগ সময় কিনতে হয় না—অন্তত প্রাত্যহিক কাজে—তাই মূল্য বোঝে না৷ বোতলবন্দি জল যেন ভিন্ন গ্রহের বিষয়৷ তার মূল্য বোঝে৷ কেনা বোতল থেকে এক ঢোক জল অন্য কেউ চেয়ে খেলে অনেকেরই প্রাণ বাজে৷

পেট্রোল-ডিজেল পয়সা ছাড়া পাওয়াই যায় না—অতএব তার কদর খুব বেশি৷ আগুন জ্বলতে পারে এসব থেকে—তাই সতর্কতাও জোর৷

জল ক্ষতি করে না—তাই কদরহীন৷

বন্যার জলকে ভয় পায়৷ তবে তা সাময়িক৷

মানুষের বিশেষত, কৃষিজীবী মানুষের সবচেয়ে আদরের ধন ছিল জল এবং গোরু৷ এই দুই ছাড়া চাষ করা কঠিন৷ বীজ ঘরেই থাকত৷ কিন্তু মাটি না চষলে, জল হয়ে মাটি কাদা না হলে—তা কোন কাজে লাগবে! বেশি জল হলেও মুশকিল, বীজ পচে যাবে৷

অথচ মানুষের উদাহরণ দেওয়া দেখুন—জলের মতো সস্তা জল ছাড়া বাঁচা যাবে না, জেনেও গরুর মতো বুদ্ধি৷

তবে গরু এখন আর প্রাণদাতা নয় প্রাণহন্তা৷

তার ভিন্ন ভিন্ন রূপে পূজা৷ উত্তর ভারতে গরু, মাম্মি—উত্তর-পূর্ব ভারতে, কেরলে, গোয়ায় ইয়াম্মি৷

গরু কিনে কোথাও নিয়ে যাওয়া আজকাল ভারি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ গরু যে শুধু জবাই করার জন্য লোকে কেনে না—দুধের জন্য, চাষের জন্য, গাড়ি টানার জন্যও কেনে—তা গো-সন্ত্রাসীরা বোঝে না!

এদের তো আবার গো-ভক্ত, গো-রক্ষক বলার চল হয়েছে সংবাদমাধ্যমে৷

আমরা গো-সন্ত্রাসীই বলব৷ কারণ, তাই বলা ঠিক৷

এই গো-সন্ত্রাসীরা এ-পর্যন্ত ৪৮ জনকে হত্যা করেছে৷ এদের প্রথম শিকার উত্তরপ্রদেশের দাদরির মহম্মদ আখলাক৷ তথাকথিত গো-মাংস আছে ফ্রিজে বলে হামলা চালানো হল এক বায়ুসেনা কর্মীর বাড়িতে৷ এয়ারফোর্স সেনানি মহম্মদ সরতাজের বাবা সৈয়দ মহম্মদ আখলাখকে হত্যা করা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫৷

পিঙ্ক রেভোলিউশনের বিরুদ্ধে একদা বহু গরমাগরম বক্তৃতা দিতেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ৷ অথচ তাঁদের আমলেই দেশে পিঙ্ক রেভোলিউশন৷ এই গো-মাংস রপ্তানির ওপর নির্ভর করে চামড়া উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয়৷ চর্মরপ্তানি ব্যবসাতেও৷

দুগ্ধ ব্যবসায়ী পেহলু খান রাজস্থানের আলওয়ারের বাসিন্দা৷ ১ এপ্রিল, ২০১৭ তিনি তাঁর ডেয়ারি ফার্মের জন্য গাড়ি করে ২২টি গরু নিয়ে আসছিলেন৷ তাঁকে রাস্তায় আটকানো হয়৷ তাঁর গরু কেড়ে নেওয়া হয় (সেগুলি কোথায় গেল, কারা কাকে বেচল, কেউ জানে না)৷ গরু কেনার জন্য বৈধ কাগজ তাঁর কাছে ছিল৷ তিনি সেগুলো কসাইখানার জন্য নয়, নিজের ডেয়ারি ফার্মের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন, তা বার বার গো-সন্ত্রাসীদের বলেন৷ তারা কর্ণপাত করে না৷ পেহলু খানকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারে৷ পেহলু তাদের হাতে-পায়ে ধরেন৷ তবু নির্দয় প্রহার৷ প্রহারের দু-দিন পর কৈলাশ হাসপাতালে মারা যান পেহলু খান৷ পেহলু খানের ক্ষেত্রে প্রথমে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার অভিযোগ দায়ের হয়৷ মৃত্যুর পর খুনের অভিযোগ আনা হয় আততায়ী ওম যাদব, হুকুম চাঁদ যাদব, সুধীর যাদব, জগমল যাদব, নবীন শর্মা এবং রাহুল সৈনিকের বিরুদ্ধে৷ এই ছয় জনের নাম করে যান পেহলু খান৷ পুলিশ গ্রেপ্তার করে অন্য তিন ব্যক্তিকে—বিপিন যাদব, বীরেন্দ্র যাদব, কালু রাম যাদবকে৷ শুধু খুন করেননি, খুন করার ভিডিয়ো ফুটেজ পর্যন্ত প্রচার করে সামাজিক মাধ্যমে খুনিরা৷ খুনিরা যে বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তা পেহলু খান জানিয়ে যান৷ এতেও খুব লাভ হয় না৷ ৮ এপ্রিল ঘটনাটি মিথ্যা বলে বিবৃতি দেন দেশের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নকভি (আজ তিনি কোথায়?)৷ পরদিন তিনিই জানান, ঘটনাটি সত্য৷ পুলিশ এফআইআর করেছে৷ ৯ এপ্রিল আর দুজন ব্যক্তি, দয়ানন্দ যাদব এব নীরজ যাদব গ্রেপ্তার হল৷

১৬ এপ্রিল ২০১৭ বিজেপি চালিত রাজস্থান সরকারের পুলিশ জানাল, পেহলু খানের নাম করে ছ-জনকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, জিজ্ঞাসাবাদ না করে৷

২০ এপ্রিল গোরক্ষা বাহিনীর প্রধান সাধ্বী কমল দাবি করলেন, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামী৷ ভগৎ সিং এবং চন্দ্রশেখর আজাদের মতো বিপ্লবী৷

২৫ এপ্রিল এই সুরেই বিজেপি সরকারের অধীন রাজস্থান পুলিশ জানিয়ে দিল, মামলা স্থগিত, কারণ মৃত ব্যক্তি এজাহার দিতে পারবেন না৷

২৬ এপ্রিল হিন্দুস্থান টাইমস জানায়, দুটি স্থানীয় আদালত রায় দিয়েছে পেহলু খান কোনো গোরু চুরি করেননি৷ গরু চুরির অভিযোগ এনেছিলেন রাজস্থানের তৎকালীন ‘সংঘী’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷

১৭ মে মূল তদন্তকারী সরকারি অফিসারকে সরানো হল তদন্তে গাফিলতির দায়ে৷

৩০ মে রাজস্থানের তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে স্বীকার করলেন সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ বেড়েছে৷

১২ জুন রাজস্থানের বারমেরে গরু বয়ে নিয়ে যাওয়া পাঁচটি ট্রাক জ্বালিয়ে দিল গো-সন্ত্রাসীরা৷ বৈধ কাগজ নিয়ে তামিলনাড়ু যাচ্ছিল ট্রাকগুলি৷

২০১৭-র জুলাই মাসে মামলা গেল সিআইডি-র হাতে৷

৩১ আগস্ট বিপিন যাদবকে জমিন দিল রাজস্থান হাইকোর্ট৷ বিপিন যাদব ছিল সংঘী ছাত্রনেতা৷

১৩ সেপ্টেম্বর পেহলু খানের অভিযোগ করা ছয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করা বন্ধই করে দিল রাজস্থান পুলিশ৷ তারা নাকি তখন গোশালায় ছিল৷

ইতিমধ্যে রাজস্থানে সরকার বদল ঘটে৷ কিন্তু তাতে পুলিশের মনোভাব বদলায় না৷ ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন ঘটনার দু-বছর দু-মাস পর রাজস্থান পুলিশ মৃত পেহলু খানের বিরুদ্ধ গরু পাচারের মামলা রুজু করল৷ অথচ ২০১৭ খ্রিস্টাব্দেই রাজস্থানের দুটি আদালত জানিয়েছিল, পেহলু খানের কাছে বৈধ কাগজপত্র ছিল৷ নাটকের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটল ১৪ আগস্ট ২০১৯৷ রাজস্থানের আলোয়ারের সেশন জজ জানিয়ে দিলেন, প্রমাণের অভাবে বিপিন যাদব, রবীন্দ্র কুমার, কালু রাম, দয়ানন্দ এবং ভীম সিং রাঠীকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে৷

পেহলু খান হত্যা মামলার রায় প্রমাণ করল, পেহলু খানকে কেউ খুন করেনি৷

১৯৭৫-এ এদেশে এমন বিচারপতি ছিলেন, যিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী জয় অবৈধ বলতে পারতেন, এমন বিচারপতি ছিলেন এই দেশেই, যিনি পুলিশকে দেশের ‘সবচেয়ে সংগঠিত গুন্ডাবাহিনী’ বলতে দ্বিধা করতেন না, এদেশেই এমন বিচারপতি ছিলেন, যিনি সিবিআই-কে ‘খাঁচায়-বন্দি তোতাপাখি’ বলে মন্তব্য করতে সাহস দেখাতেন, এ দেশেই জন্মেছেন বিচারপতি লোয়া, যিনি ১০০ কোটি টাকার ঘুষ প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুকে বেছে নেন—সেই দেশে এখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ২১টি দলের আনা ইভিএম মামলা শুনতেও চান না, কাশ্মীরে বাক্‌স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের মামলা জরুরি ভিত্তিতে শোনা হয়নি, কেরল হাইকোর্টের বিচারপতি ব্রাহ্মণদের বিশেষ অধিকার দেখেন, আরেক হাইকোর্টের বিচারপতি ময়ূরের চোখের জলে সন্তান জন্মাতে দেখেন৷

বিচার বিভাগের ইতিহাসে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ক্লিনচিট দিয়ে রাজ্যপাল (সদাশিবম, কেরলে) এবং রাষ্ট্রদূত হওয়া যায়৷ এবং বিরুদ্ধে রায় দিয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদও মেলে না৷ কলেজিয়াম একাধিকবার সুপারিশ করা সত্ত্বেও৷

পুনশ্চ: নতুন ভারতে গণশিকার (পিটুনি) গণহত্যার শাস্তি নয়, পুরস্কার মেলে৷ গণহত্যায় প্রধানমন্ত্রী, গণশিকারে চাকরি! পেহলু খানের হত্যাকারীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, ঝাড়খণ্ডে খুনিদের গলায় মালা পরিয়েছেন খোদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা, ওড়িশার গ্রাহাম স্টাইনস হত্যার ষড়যন্ত্রী হন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, নাম জোটে সমাজসেবকের৷ আখলাক দিয়ে এই সম্পাদকীয় শুরু৷ আখলাকের ফ্রিজে গো-মাংস নেই—একথা প্রমাণ করার জন্য যে পুলিশ অফিসার সুবোধ সিং ফরেনসিক তদন্তে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে তদন্ত থেকে অব্যাহতি দিয়ে বুলন্দশহর পাঠানো হয় ৩ ডিসেম্বর ২০১৮৷ সোনে পরিকল্পনা করে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ হত্যাকারীরা এখন জামিনে মুক্ত৷ নিহত পুলিশ অফিসারের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিরাপত্তা চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তথা অজয় বিস্টের কাছে৷ বিস্তারিত জানতে অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন