নামের ফেরে

ইমানুল হক

নামের ফেরে মানুষ ফেরে এমন দেখি নাই৷ উনিশ শতকের দার্শনিক সংগীতকার লালন ফকির একথা লিখলেও, আজও মানুষ নামের ফেরেই ভুগছে৷ নাম একটা পরিচিতি, সত্তা, সংস্কৃতি৷

শেক্সপিয়র যদিও বলেছেন, নামে কী আসে যায়! আসে বইকি! বাঙালির নামের মধ্যে ‘স’, ‘শ’-এর আধিক্য ছিল৷ সুন্দর শুভ চিন্তক সেসব ভাবনা৷

নাম পরিবর্তন করেন বহু মানুষ৷ লেনিন ছদ্মনাম৷ স্তালিনও৷ স্তালিন মানে ইস্পাত৷ ম্যাক্সিম গোর্কিও আসল নাম নয়—ছদ্মনাম৷ রুশ ভাষায় ম্যাক্সিম মানে তিক্ত৷ মার্ক টোয়েনের আসল নাম ছিল স্যামুয়েল লংহর্ন ক্লিমেন্স৷ ব্যক্তির নাম বদলের পিছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সত্তাগত কারণ থাকে৷

স্থাননামের পিছনেও থাকে ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং পরিবেশ৷

সুকুমার সেনদের মতে, ‘ড়া’ যেসব গ্রামের নামের শেষে আছে সেগুলি দ্রাবিড়যুগের৷ ‘পুর’ মানে নগর৷ আর্যরা নগর গড়তে জানতেন না৷ তাঁদের নেতা হতেন ইন্দ্র৷ ইন্দ্র মানে কোনো একক ব্যক্তি নন, ইন্দ্র—রাজা৷ কৃষ্ণ মানে যেমন শুধু কালো বা মহাভারতের চরিত্র নয়, কৃষ্ণ মানে বীর৷ গো-ভক্ষক বা গো-নিধনকারী ইন্দ্রের সঙ্গে গো-রক্ষক কৃষ্ণের লড়াইয়ের বহু কাহিনি পুরাণে আছে৷ ইন্দ্রের অপর নাম ‘পুরন্দর’৷ মানে যিনি ‘পুর’ অনুসন্ধান করে ধ্বংস করেন৷

আর্যরা তো নগর গড়তে জানতেন না৷ পাণ্ডবদের নগর ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করে ময়দানব৷ দানব—দৈত্য৷ সুর নয়—অসুর৷ আর্য নয়, অন-আর্য৷

ভারতবর্ষে যাঁরা নয়া নাম পরিবর্তনের কারিগর তাঁরা ইতিহাস, পুরাণ, শাস্ত্র কিছুই জানেন না৷ বহু শহর অতীতে ছিল না৷ আর্যরা যাযাবর জাতি৷ অরণ্য, পর্বত, কন্দরে তাঁদের বাস৷ জলাধার নির্মাণ পর্যন্ত জানতেন না৷ ‘বৃত্র’ কোনো অসুর নন—‘বৃত্র’ শব্দের অর্থ জালাধার৷ অনার্য সভ্যতা সংস্কৃতি ও মানব সম্পদে নষ্ট করার জন্য জলাধার ধ্বংস—নগর ধ্বংস৷

ভারতের নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি একটি সম্পূর্ণত অ-ভারতীয় দল৷ ভারতীয়ত্ব-র সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই৷ ভারতীয়ত্ব মানে পরধর্ম সহিষ্ণুতা, পরমত সহিষ্ণুতা৷ বিজেপি-র মধ্যে সেসব গুণের একটিও নাই৷ বিজেপি মানেই অসহিষ্ণুতা৷

ভারতে বেশিরভাগ শহর গড়েছেন অন-আর্য বা জন্মসূত্রে ‘মুসলিম’ শাসক বা ইউরোপীয়রা৷ আর্যদের গড়া শহর তেমন নাই৷ আজ নাম পরিবর্তনের ধুম জেগেছে বিজেপি-র হৃদকমলে৷

সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব এবং প্রাক্‌-বিপ্লব পর্বে নাম পরিবর্তন হয়েছিল৷ ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গে ফিরে যাওয়া৷

সেন্ট পিটার্সবার্গ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হয় পেট্রোগ্রাদ। আবার নয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেন্ট পিটার্সবার্গ হয়েছে৷ ‘আরেক রকম’ পত্রিকায় সেন্ট পিটার্সবার্গ লেখা হওয়ায় প্রয়াত ড. অশোক মিত্র অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, মর্মাহত ও বিচলিত হয়েছিলেন৷

যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহরা নাকি প্রাচীনযুগে ফিরতে চান! সবকিছুতে হিন্দুত্ববাদ আনতে চান! খুব ভালো৷ ইরফান হাবিব বলেছেন, তাহলে প্রথমেই ‘শাহ’ পদবি বিসর্জন দিতে হবে৷ কারণ ওটি ‘ফার্সি’ শব্দ৷ ইরফান হাবিব যেটি বলেননি, সেটিও অবগত ও উদ্ধৃত হওয়া দরকার—‘হিন্দু’ শব্দটিই আরবিয় ও ফার্সি অবদান৷ ‘হিন্দু’ শব্দ কোনো বেদে নাই৷ পুরাণে নাই৷ রামায়ণ মহাভারতেও নাই৷

যোগী আদিত্যনাথকেও ফিরতে হবে পূর্ব নামে৷ তাঁর জন্ম ৫ জুন ১৯৭২৷ আদি নাম অজয় মোহন বিস্ট৷ যোগী সাধকরা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল বিরোধী ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে ‘হিন্দু’, ‘মুসলিম’ সব ধরনের সাধকই ছিলেন৷ ক্ষমতা ভোগী মুখ্যমন্ত্রীর গুরুও ছিলেন জন্মসূত্রে একজন ‘মুসলিম’ যোগী৷ গোরক্ষপুর মঠের জমিদাতাও একজন ‘মুসলিম’ শাসক৷

আপাতত ফৈজাবাদের নাম পাল্টে অযোধ্যা করা হয়েছে৷ ইতিহাসের অযোধ্যা আর ফৈজাবাদ এক স্থান নয়৷ পুরাণের অযোধ্যার কোনো অস্তিত্ব নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাননি৷ যোগী আদিত্যনাথ মূল রামায়ণটি পড়লে জানতেন, রামের পূর্বপুরুষ প্রবুদ্ধ ছিলেন রাক্ষস৷ তাঁর নাম ছিল কল্মাষপাদ৷ সংস্কৃতে রাম ও সীতা উভয়েই বহু মাংস খেতেন৷ তার মধ্যে গো-মাংস ছিল৷ সংস্কৃতে ‘অতিথি’ শব্দের প্রতিশব্দই হচ্ছে ‘গোঘ্ন’—অর্থ গো-হত্যা করা হয় যার জন্য।

(প্রসঙ্গত, রামায়ণে অযোধ্যাকাণ্ডে চতুঃপঞ্চাশ সর্গে ৮৯ সংখ্যক শ্লোকে আছে৷ ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে পৌঁছলে মুনি তাঁদের গো-মাংস খেতে দিলেন৷

‘উপানায়ত ধর্মাত্মা গামর্ঘ্যমুদকং ততঃ৷’)

আপাতত ফৈজাবাদ হয়েছে অযোধ্যা৷ লক্ষ্মৌ নাকি হবে লক্ষ্মণপুর৷ লক্ষ্মণকে তো রাম নিজেই বিসর্জন দিয়েছিলেন, জানেন কি না জানি না, বিজেপি নেতারা৷ ভূপাল হবে ভোজপাল, নতুন দিল্লি হবে ইন্দ্রপ্রস্থ৷ আহমেদাবাদ—আনন্দনগর, সুলতানপুর—খুসভবনপুর, মুজফ্‌ফরপুর—লক্ষ্মীনগর, আকবরপুর—সূর্যপুরম, আগ্রা—আগরওয়াল বা অগস্ত্যপুর৷

সব ভালো যার শেষ ভালো তার৷

বরং নিজেদের দলের নামটা যেন পালটে নেন—বিদেশি জনতা পার্টি৷

ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মারা তো জানিয়ে দিয়েছেন, ভরত নামে এক জনজাতি বা উপজাতির নামে দেশের নাম ভারত৷ এ দেশের আদি বাসিন্দা তো মনুবাদীরা নন৷ এ দেশের আদি বাসিন্দা তথা আদিবাসীরা যদি সবকিছু ফেরত চান—তাহলে সংঘ-সেবকরা কোথায় যাবেন? এই যা, সংঘ শব্দটাই তো পালি ভাষার! বৌদ্ধদের প্রিয় শব্দ৷

বিজেপি-র নাম পরিবর্তনের কারণ—নাকি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক৷ তা মুসলিম দেশের পেট্রোল কেন? বিদেশি বিমান কেন? পুষ্পক রথ চাই৷ মিসাইল কেন? ব্রহ্মাস্ত্র হলেই চলে৷ সেলাই করা পোশাক কেন? এগুলো তো আরবি-ফার্সি অবদান৷

আর লালকেল্লায় ভাষণ কেন? ভাষণে মাইক কেন? বাণী—দেববাণী তো আকাশে উচ্চারিত৷ টিভি কেন? মায়াদর্পণ তো যথেষ্ট৷ অর্ণব গোস্বামীদের কী দরকার—সঞ্জয়কে আনলেই হয়—ঘরে বসে সব বলে দেবে৷

এবং আপাতত, এইটুকু ভাবা যাক, মোদী, যোগী, শাহরা একদিন নোটবন্দির মতো ঘর বা অফিসবন্দি হবে—কিংবা আর্জেন্টিনীয় শাসকদের ধাঁচে দেশ ছেড়ে পালাবে৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন