ইমানুল হক
অলিভার ক্রমওয়েল-কে যখন জিগ্যেস করা হয়, ঈশ্বরের নির্বাচিত ব্যক্তিরূপে আপনাকে গর্বের সঙ্গে দেখার জন্য এত মানুষ যে ভিড় করেছে, তার জন্য কি আপনি গর্বিত বোধ করছেন না?
ক্রমওয়েলের উত্তর ছিল : এর চেয়ে তিন গুণ বেশি মানুষ আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে দেখার জন্য অপেক্ষা করবে৷
ফ্রয়েডকে তাঁর আকস্মিক জনপ্রিয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুনিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক রাজা অলিভার ক্রমওয়েল-এর বয়ান৷ নিজেদের সম্পর্কে এমন নির্মোহ মূল্যায়ন অন্তত ইতিহাসে থাকবে৷
জ্যোতি বসুকে এক বিশিষ্ট সম্পাদক প্রশ্ন করেছিলেন, ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা নিয়ে, তিনি বলেছিলেন, ইতিহাসের ফুটনোটেও জায়গা হবে না৷
আসলে অনেকে বোঝেন না তাঁর বা তাঁদের অবস্থান৷ মানুষ কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তিত্বকে নয়, ভালোবাসে এক আদর্শ, এক বিশেষ নৈতিক অবস্থান বা বিষয় বা ইস্যুতে এবং সেটা নিঃশর্ত আদপেই নয়৷ ব্যক্তি বা দল অবস্থান বদলালে মানুষও অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়৷ কষ্ট বুকে নিয়ে৷ ভুল বিশ্বাসের কষ্ট যত না, তার চেয়ে বেশি যাঁকে বা যে দলকে বিশ্বাস করেছিল, তিনি বা তাঁরা লক্ষ্যভ্রষ্ট বলে৷ তত্ত্ব ছাড়া মানুষ নয়৷ মানুষ ছাড়া তত্ত্ব নয়৷ এই সহজ সত্য কাথা অনেকেই মনে রাখেন না অথবা ক্ষমতার মদমত্ততায় ভুলে যান৷
একসময় হিটলার ভেবেছিলেন তিনি মানেই জার্মানি৷ ভৃত্যকুল বুঝিয়েছিল, তিনি মানেই দুনিয়া! হিটলারের সমান কোনোভাবেই নন, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীও একসময় ভেবেছিলেন, ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া৷ তল্পিবাহক এত বেশি ছিল৷ দলের সভাপতিও তাই ভেবেছিলেন৷ পরে তিনিই ইন্দিরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রবল প্রবলতর বিরোধী৷
এখন মোদীও তাই ভাবছেন৷ ভাবছেন দলের সভাপতি অমিত শাহ৷ প্রবল উচ্চাকাক্ষী৷ লোকে বলে, দেড় ব্যাটারি সরকার৷ কে হাফ কে ফুল—দুর্জনে জানে৷
এখন এমন অবস্থা ২০১৯-এর ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদশে যেতে পারেননি কাগুজে লৌহ (মরচে) মানুষ অমিত শাহ৷ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ঢুকতে পারেননি নিজের রাজ্য গুজরাট৷ মোদী দু-দুবার বাতিল করতে বাধ্য হলেন আসাম সর৷ ১৬ ডিসেম্বর ও ১০ জানুয়ারি৷
১১ জানুয়ারি ২০২০ আসতে সাহস করলেন পশ্চিমবঙ্গে৷ কেন? সে কি সেটিং? সে কি বিরোধী দলকে দুর্বল ভাবা? নাকি ভুল/সঠিক গোয়েন্দা রিপোর্ট৷ তেমন কিছুই হবে না!
বিক্ষোভ হয়৷ শহর জুড়ে৷ বাম ডান সব মোদী বিরোধীই পথে নামেন৷ কংগ্রেস তো নেতাজি ইন্ডোরের সামনে বিক্ষোভ দেখায়৷ আরএসএফের ছাত্রকর্মীরা বাগবাজার ঘাটে বিক্ষোভ দেখিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে পরে ছাড়া পান৷ ধর্মতলায় সারা রাত জাগেন কয়েক শত ছাত্রছাত্রী, দু-একজন অধ্যাপক, কিছু এনআরসি বিরোধী যুব ও প্রবীণ৷ টানা পঁচিশ ঘণ্টা চলে অবস্থান৷ বিমানবন্দরে বিক্ষোভ দেখানোর চেষ্টা রুখে দেয় পুলিশ৷ কারো বাড়িতেও গেছে আপত্তি ভয় দেখাতে৷ কৈখালিতে পথ অবরোধ হয়েছে৷ মোদীকে পথ ও স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে৷ আকাশ ও জলপথ ব্যবহার করেছেন৷
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ রানি রাসমণি রোডে অবস্থান মঞ্চ করে৷ সেখানে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসার আগে ও পরে যান৷ সেখানে গিয়ে নকশালপন্থী ও দলহীন কয়েকশো ছাত্র ছাত্রী বিক্ষোভ দেখায়৷ এটা নজিরবিহীন৷
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে নিষেধ করে তাঁর বক্তব্য জানান৷ বক্তব্যের নির্যাস এই যে, তিনি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যদিও তিনি এনআরসি এবং ক্যা-এর বিরোধিতা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে৷ শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার কথাও তিনি বলেন৷
যাই বলুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময় দিল্লিতে বিরোধী জোটের সভায় না গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পদক্ষেপ নিয়েছেন যা তাঁর ২০০৬ পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে ততটা মানানসই নয়৷
তিনি কি ভাবছেন, তিনি মানেই পশ্চিমবঙ্গ? যা বলবেন, তাই হবে? যা করবেন, তাকেই লোকে দু হাত তুলে সমর্থন করবে? ভুল৷ মহাভুল৷ হিমালয়ান ব্লান্ডার৷
বামফ্রন্টকে দু-হাত তুলে ভোট দিয়েছিলেন মানুষ ২০০৬-এ৷ কিন্তু জয়ের পরদিন টাটার সঙ্গে বামপন্থী দুই মন্ত্রীর সহাস্য মুখ আলিমুদ্দিনে, মানুষ কষ্ট পেয়েছিলেন৷
তারপর শপথের সাত দিন সিঙ্গুরে বের হল ঝাঁটা৷ তবু শিক্ষা হল না৷ নন্দীগ্রামে গুলি চলল৷ মানুষ সরলেন পাশ থেকে৷ আর এখন কমতে কমতে ৫৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ৷ সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে কোথাও কোথাও ২.৫ শতাংশ৷
মমতা ২০১৯-এ ৪২ এ ৪২ আশা করেছিলেন৷ মিলল ২২৷ লোকসভায়৷ প্রথম ছয় দফায় ৩৩ আসন৷ পান ১৩টি৷ শেষ দফায় ৯টি৷ সবকটি পেলেন৷ বিজেপি ০৷ ৬ দফায় ১৮ আসন৷ শেষ দফায় ০৷ কেন? বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙার পর উদার বাম (লেফট লিবারাল) এবং সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশ সমর্থন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে৷
যত না নীতিগত৷ তার চেয়ে বেশি বিজেপিকে হারানো৷ আসলে মানুষ ভোট দেয় যত না কাউকে জেতাতে তার থেকে বেশি কাউকে হারাতে৷ ২০১৯-এর লোকসভা পরবর্তী উপনির্বাচনে করিমপুর, খড়্গপুর, কালিয়াগঞ্জ তৃণমূল জিতেছে৷ তার কারণ বাম ভোটারদের একটা অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে তৃণমূলে দিয়েছেন এনআরসি আতঙ্কে৷ মূল্যবৃদ্ধি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে৷
এরপর ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ পাস হল ক্যা আইন৷ আসাম মণিপুর মেঘালয় অরুণাচল জ্বলল। দিল্লির জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রছাত্রীদের ওপর তীব্র অত্যাচার৷ প্রতিবাদ দেশ জুড়ে৷
পশ্চিমবঙ্গেও তীব্র প্রতিবাদ৷ আইন পাশের ৭দিন পর মমতা নামলেন পথে৷ পরপর ১০ মিছিল, পদযাত্রা রাজ্য জুড়ে৷
এরপর ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হল পরিবর্তন৷ বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের ডাকা বন্ধে সবাইকে আসতে হবে বললেন৷ বনধ্ ব্যর্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিনি সফল হলেন না৷
তারপর তাঁর আগ্রহে ডাকা সমস্ত বিরোধী দলের বৈঠক বয়কট করলেন৷ রাজ্যে সিপিএম এবং কংগ্রেস নাকি গুন্ডামি করেছে৷ এরপর নাটকীয় পালটি৷ মোদীর সঙ্গে বৈঠকে৷ ভাবা যায়৷ এতে তাঁর লাভ কতখানি তিনি জানেন৷ দেশের ও জনগণের স্বার্থে আঘাত৷ সর্বনাশ৷
এর মধ্যে নরেন্দ্র মোদী কলকাতা বন্দরের নাম পালটে ফেলেছেন৷ বিবেকানন্দের জন্মদিন ও বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির দিনে, ২০২০-তে কলকাতা বন্দরের নামকরণ করা হল, বাংলা ভাগের নায়ক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে৷ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরদার হওয়া উচিত৷ ব্যক্তির নামে কেন? কলকাতা বন্দর, কলকাতাই থাক৷
মোদী তো থামার পাত্র নন৷ গেছেন বেলুড়ে৷ বিক্ষোভের ভয়ে রাজভবনে রাত কাটাতে সাহস করেননি৷ বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে থেকে বিবেকানন্দের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক ভাষণ দিয়েছেন৷ বলেছেন, ক্যা ও এনআরসি নিয়ে কথা৷ সাধারণ দর্শকরা তাঁর জন্য দু-ঘণ্টা ঢুকতে পারেননি৷ সেজন্য মিশন কর্তৃপক্ষ কোনো দুঃখপ্রকাশ করেননি৷ উলটে মোদীকে পাওনার লোভে শংসাপত্র দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী সুবীরানন্দ বলেছেন, দেশের অন্যতম সেরা প্রধানমন্ত্রী মোদী৷
লজ্জার কথা৷ যেন মোদী, মোদীর জমানায় গোধরা ঘটেনি, ২০০০ নারী গণধর্ষিতা ও ৩০০০ জন মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খুন করা হয়নি; মাসাধিককাল ধরে বিনা বাধায়, খাদ্যাভাসের জন্য পিটিয়ে মারা হয়নি ৫৩ জনকে, কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করার চেষ্টা হয়নি, ডিটেনশন ক্যাম্পে ২৯ জনকে খুন করা হয়নি, আসামে ১০২ বছরের কাউকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলা হয়নি, প্রতিদিন ৯১ জন ধর্ষিতা হননি, ২৭টি সরকারি ব্যাঙ্ক ১২টি হয়ে যায়নি৷ ব্যাঙ্ক প্রায় দেউলিয়া হতে হয়নি, লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে দোস্তদের দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়নি, লাভদায়ক সরকারি সংস্থাগুলোকে পেটোয়া করপোরেট আদানি আম্বানিদের কাছে বেচে দেওয়া হয়নি, ৫ কোটি মানুষ নোটবন্দি জিএসটির কারণে কাজ হারাননি, ৬৪ হাজার সাধারণ পদের জন্য ১ কোটি ৯০ লক্ষ সুশিক্ষিত বেকার আবেদন করেননি৷ ১২৮টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বন্ধ হয়ে যায়নি৷ আরো বেদনার কথা, এক সন্ন্যাসী (!) বলেছেন, মোদী আমাদের ঘরের ছেলে। রামকৃষ্ণ মিশনের ঘরের ছেলেরা বুঝি এমন হন?
এখন মনে পড়ে উনিশ শতকের কথা৷
গাইব, মা, বীররসে ভাসি
মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া
(মেঘনাদবধ কাব্যে)
এই উচ্চারণের পাশাপাশি মধুসূদন বাঙালি জাতিসত্তা জাগরণ প্রকল্প হিসেবেই যেন মকরাক্ষের বয়ানে উপস্থাপিত করছেন : পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা৷
পিঠে অস্ত্রের দাগ বহন আর করবে না বাঙালি৷ লড়বে সে যে যেমন ভাবে পারে তাই৷ তাই কিছু দাস মনোভাব থেকে ইংরেজি ভজনায় ব্যস্ত, আর কিছু লেখক সাহিত্যিক শারীরিক অস্ত্র ধরতে না পারলেও হাতে তুলে নিচ্ছেন কলম, তরবারির চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সে অস্ত্র৷
আজকের লেখক শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী সমাজকর্মী সাংবাদিকদের সেই দায়৷ পথে এবং লেখায় ধ্বনিত হোক সংগ্রামী রণধ্বনি : কিছু না পারেন—অন্তত ‘ছি’ বলুন৷
পুনশ্চ : বিপদ, মহাবিপদ সামনে৷ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তিনটি আসনে উপনির্বাচনে হেরেছে৷ কিছু তাদেরই ভোট শতাংশ কমেনি, কমেছে বামপন্থীদের৷ ভোট কাটাকুটিতে বিজেপির লাভ হচ্ছে৷ বিজেপির ভোট কমছে না৷ ওরা ঘরে ঘরে যাচ্ছে৷ হোয়াটস্যাপে নিরন্তর প্রচার চালাচ্ছে৷ এবং মনে রাখবেন, ১১ এবং ১২ জানুয়ারি মোদী বিরোধী বিক্ষোভে জনজোয়ার কিন্তু নামেনি ১৯ ডিসেম্বরের মতো৷
শুধু লিখে সভা সমিতিতে হবে না৷ নিরন্তর সতর্ক প্রচার জরুরি৷ না হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন