নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম

ইমানুল হক

স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং দেশের সার্বিক বিকাশ৷ কার্যত তা হয়নি৷ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্রবলভাবে অবহেলিত হয়েছে৷ ফলে মানুষের মধ্যে বেড়েছে ক্ষোভ৷ যে ক্ষোভ পরিচালিত হওয়ার কথা রাষ্ট্র শাসকশ্রেণি ও শোষক ধনীদের বিরুদ্ধে তার অভিমুখ সচেতনভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিন্ন জাতি বা ধর্ম বা ভাষাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ এ কারণে দেশভাগের পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আসামে অসমিয়া বাঙালি দাঙ্গা হয়েছে৷ বহু বাঙালি এলাকা ছেড়েছেন৷ ঘর ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েছেন৷ পরে কেউ কেউ ফিরেছেন৷ অসমিয়া জনগোষ্ঠীর চাপে এর পরিণতিতে ১৯৫১-তে প্রথম এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জিকরণ৷ কিন্তু তার পরেও সমস্যা মেটেনি৷ অসমিয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়৷ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন অসম-নিবাসী বাঙালিরা৷

আসামে বাংলাভাষীদের বাস দীর্ঘকাল৷ ১৮৩৮ থেকে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলে আসামের শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা ভাষা৷

১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান হোসেন শাহ্ আসাম দখল করেন৷ তখন থেকেই আসামে বাংলাভাষীদের বসবাস শুরু৷ ষোড়শ শতকের কোচ রাজা বিশ্ব সিংহের নেতৃত্বে কোচ রাজবংশের পত্তন৷ এই বংশের রাজা নরনারায়ণ বাংলায় চিঠি লিখেছেন৷ পরে আসামে উনিশ শতকের শুরুতে বর্মীদের আধিপত্য হয়৷ বর্মীদের দেশ আরাকান৷ সেখানেও সরকারি কাজের ভাষা ছিল বাংলা, সপ্তদশ শতক থেকেই৷

উনিশ শতকে ১৮২৪-এ বর্মীদের হটিয়ে এল ইংরেজ, ১৮৩২-৩৩-এ কাছারি রাজ্যকে জুড়ে দেওয়া হল আসামের সঙ্গে৷ ১৮২৬ থেকে ব্রিটিশ শাসনাধীন আসাম ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সঙ্গে, ১৮৭৪-এ আসামকে বাংলা থেকে আলাদা করা হল৷ চিফ কমিশনার্স প্রভিন্স নামে একটা নতুন শাসনক্ষেত্র তৈরি করে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল শ্রীহট্ট তথা সিলেটকেও৷

এই সময় শ্রীহট্ট/সিলেটের মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করেন৷ বাংলার বদলে অসমিয়াকে করা হল রাজভাষা বা অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ৷

১৯০৬ থেকে ১৯১১ বঙ্গভঙ্গের শিকার হলেন আসামের বাঙালিরা৷ পূর্ববঙ্গ জুড়ে দেওয়া হল চিফ কমিশনার্স প্রভিন্সের সঙ্গে৷ পরে তীব্র আন্দোলনের ফলে ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়৷ কলকাতা রাজধানী থাকল না৷ দিল্লিতে রাজধানী চলে গেল৷ আর শ্রীহট্টের মানুষ পড়লেন নতুন সংকটে৷

১৯২৬ থেকে নিয়ে আসা হতে লাগল মুসলিম কৃষকদের দু-টাকা করে রাহা খরচ দিয়ে৷ আসামে ঝুম প্রথার চাষ৷ ফসল কম৷ রাজস্বও৷ তাকে পরিবর্তন করার জন্য৷ দেশভাগের আগে পর্যন্ত চলল এই ধারা৷ অমানুষিক পরিশ্রম করে ঝুম নয় পূর্ববঙ্গে প্রচলিত প্রথার চাষ শুরু হল আসামে৷ বহু জমি সমতল করা হল চাষের স্বার্থে৷ আসামে নতুন কৃষিবিদ্যার পত্তন করলেন এই চাষি সমাজ৷

দেশভাগের আগে হল গণভোট৷ শ্রীহট্ট যাবে কোনদিকে? ১৯৪৭-এর ৭ জুলাই গণভোটে৷ ৫৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে শ্রীহট্ট গেল পাকিস্তানের দিকে৷ এই শ্রীহট্ট সুরমা উপত্যকা৷ যে-উপত্যকার সন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা৷

দেশভাগের পর বাধল বাংলাভাষী-বিরোধী দাঙ্গা৷ ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) মানুষ পালালেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে৷ ৯০,০০০ (নব্বই হাজার) মানুষ পালালেন আশ্রয়হীন হয়ে বরাক উপত্যকায়৷

এইসময় আসাম সরকার উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালেন৷ ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা অসমিয়াকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব করেন৷ উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাসের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি ২৪ অক্টোবর বিধানসভায় গৃহীত হয়৷ এর প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন৷ বরাক ভাষা আন্দোলনে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে শহিদ হন—কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরুণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য৷ এছাড়াও আসামেই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট আরো একজন শহিদ হন : বিজন চক্রবর্তী এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই শহিদ হন দুজন : জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস৷

এখন এসেছে নতুন সমস্যা৷ নাগরিক পঞ্জিকরণের নামে ৪১ লাখ মানুষের নাম ছিল না৷ এর মধ্যে, অনুমান করা হচ্ছে, প্রায় ৩২ লাখ মানুষ জন্মসূত্রে ‘হিন্দু’৷ ৬ লাখ জন্মসূত্রে ‘মুসলিম’, দেড় লাখ হিন্দিভাষী, এক লাখের বেশি গোর্খা, এছাড়া আছেন চিনা, রাজবংশী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ৷

তাঁরা বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন৷ কয়েক লাখ মানুষ ডি ভোটার তথা ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ভোটার চিহ্নিত হয়ে আটক ছ’টি বন্দিশিবিরে৷ জার্মানির হিটলারি কায়দায় অত্যাচার সেখানে৷ এখানে হিন্দু-মুসলমান—সব ধরনের মানুষই বন্দি৷ আরো ১০টি তৈরি হচ্ছে৷

একদা বামপন্থীদের ভোটার এখন বিজেপি ভক্ত একদল ভেবেছিলেন—মুসলিমরা জব্দ হবে নাগরিকপঞ্জির ফলে৷ এখন দেখা যাচ্ছে, ৮% হিন্দুর নাগরিকত্ব ঝুলে৷

ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড—কোনো কিছুই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়৷ বলছে, দলিল চাই৷ তাও ১৯৭১-এর আগের৷ বেশিরভাগ উদ্বাস্তুদের তা নেই৷ থাকা সম্ভবও নয়৷ পেট ভরাবেন, না জমি কিনবেন?

এছাড়া অছে প্রতিহিংসার খেলা৷ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্যের নাম ছিল না৷ খসড়া তালিকায় বিজেপির মতে, উদ্বাস্তুদের জমির দলিল নেই৷ থাকা সম্ভবও নয়৷ পেট ভরাবেন, না জমি কিনবেন?

বিজেপির এক এমএলএ কিশলয়বাবুর পরিবারকেও বলা হয়েছে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে৷ তাঁরা পরিচিত হওয়ায় বেঁচেছেন৷ ১৯৬৭-র আগে নিজের নামে জমি কিনতে পেরেছেন কতজন উদ্বাস্তু? ১৯৬৭-র আগের জমির দলিল চেয়েছে আসামে। অনেকেই পারেনি দিতে।

এখন প্রবল বিক্ষোভ৷ তা ঠেকাতে বিজেপিপন্থীরা দেখাচ্ছেন নাগরিকত্ব বিল ২০১৬৷ আর বিজেপি তো ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে নাগরিকত্ব আইন এনেছে৷ যাতে ১৯৭১-এর পর আসা সবাইকে বেআইনি বসবাসকারী বলা হয়েছে৷ সেই আইন তো বাতিল করেনি৷ করবে বলে মনেও হয় না৷

নতুন ক্যা আইনে সার্ক দেশ থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলা হয়েছে ২০১৯-এ৷ এই আইন আদালতে টিকতে পারবে না৷ কারণ ধর্ম বেছে নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না৷ বিজেপি নিজেও এটা জানে৷ আর জানে বলেই, আসামের মুখ্যমন্ত্রী সোনোয়াল হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এই বিল মানব না৷

আসলে নাগরিকপঞ্জি-বিরোধী যে-আন্দোলন সেই হিন্দু মুসলমানের যৌথ আন্দোলন ভাঙতেই এই নাগরিকত্ব বিলের গল্প৷ দু-বছর পার৷ কেন আইন করেনি? কেন নাগরিকপঞ্জির নামে মানুষকে হয়রানি৷

ইতিমধ্যেই একাধিক ব্যক্তি আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন৷ এখন চেষ্টা—হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া৷

পশ্চিমবঙ্গের মানুষের শেখা দরকার৷ উলুবেড়িয়াতে এক জনসভায় বাংলার নতুন বর্গী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক পঞ্জিকরণ করব৷ লোকসভায় অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হুংকার দিয়েছেন—সারা দেশে এনআরসি হবে৷

ভাবছেন, মুসলিমরা জব্দ হবে৷ মুসলিমদের ৯৯% ভূমিপুত্র৷ দেখেছেন চোখের সামনে বাংলাদেশি মুসলিম এখানে বাস ব্যবসা বা চাকরি করতে? উদ্বাস্তুদের বেঁচে থাকাই দায় ছিল৷ জমি কিনবে কী করে, ১৯৭১-এর আগে?

আওয়াজ তোলা দরকার :

• আসামে বসবাসকারী ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষকে বিদেশি বানানোর চক্রান্ত মানছি না মানব না৷

• ২০১৪-এর ভোটার তালিকা মেনে সকলকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে হবে৷

• নাগরিক পঞ্জীকরণের নামে ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চক্রান্ত মানছি না মানব না৷

• আসামের ভাষিক ও জনগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্য মানতে হবে৷

আসামে প্রকাশিত এনআরসি-র তালিকায় প্রথমে ৪১ লক্ষ লোকের, পরে ১৯ লাখের নাম বাদ দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন৷ রাজ্যের উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদী ও চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক শক্তির যৌথ প্রচেষ্টায় তা বাস্তবায়িত হয়েছে৷ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে যাঁরা এতদিন বলেছিল সকল প্রকৃত ভারতীয়দের নাম চূড়ান্ত খসড়ায় উঠবে তা যে চরম মিথ্যাচার ও প্রতারণা ছিল তা আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের নাম খুশিমতো যে ছেঁটে ফেলা হয়েছে তাও প্রকাশিত তালিকায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে৷ এই তালিকায় ঠাঁই হয়নি বহু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক, শিক্ষক, কর্মচারী-সহ অসংখ্য প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের নাম৷ বহু পরিবারের লিগ্যাসি ডাটা থাকা ব্যক্তিদের নাম তালিকায় সন্নিবিষ্ট না হলেও তাঁদের সন্তানসন্ততিদের নাম তালিকায় উঠেছে৷ অন্যদিকে অনেক পরিবারের পিতা-মাতার নাম তালিকায় এলেও তাঁদের সন্তানদের নাম আসেনি৷ তা কী করে সম্ভব হল কারও বোধগম্য হচ্ছে না৷ রাজ্যের জনগণের ভবিষ্যকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ছাড়া কিছু নয়৷

কয়েকটি তথ্য দেওয়া যাক৷ আসামের মানুষরা এটি লিখেছেন—

‘স্ন্যাপশট : ১

গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে আবদ্ধ আজবর আলি, আইনি মামলা চালাতে না পেরে আত্মহত্যা তাঁর স্ত্রীর! ধ্বংস আজবরের পরিবার৷ আবদ্ধ আজবর এখনও মৃত্যুসম জীবন কাটাচ্ছে হিটলারি ক্যাম্পে৷

কে দেবে ন্যায়?

স্ন্যাপশট : ২

কোকরাঝোড় ক্যাম্পে আবদ্ধ নিরক্ষর মধুবালা মণ্ডল, যাঁর ডি-ভোটারের নোটিশটা পর্যন্ত নিজের নামে নয়৷ কেসটা প্রতিবেশী মৃত মধুবালা নমঃ দাসের! ভুক্তভোগী মধুবালা মণ্ডলের একমাত্র মূক কন্যা ছিল একা!

সংবাদের শিরোনামা দখল করা মধুবালা অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন৷

স্ন্যাপশট : ৩

এদিকে খুনি-ধর্ষণকারী, দাগী অপরাধীর মতোই শর্ত সাপেক্ষে জরিমনা-সহ জামিন লাভ অন্যদিকে বর্ডার পুলিশে কর্মরত অথচ বিদেশি মামলায় অভিযুক্ত এক সময়ের অসম গৌরব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মহম্মদ সানাউল্লা!

স্ন্যাপশট : ৪

ভিক্ষা করে পরিবারের পেট চালানো সুরজ আলিকে ৭৫ বছর বয়সে তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে আবদ্ধ করে রেখে ২ বছর পর অর্থাৎ ৭৭ বছর বয়সে তার মৃতদেহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল! বেঁচে থাকতে বিদেশি, মৃত হলে স্বদেশি৷

এটাই নাকি আমার মহান ভারত?

স্ন্যাপশট : ৫

মাত্র ৭ মাসের দুধের শিশু অভিনন্দার কী হবে সে চিন্তা করার লোক নেই আসামে৷ গুণের শেষ না থাকা দেশে দুধের শিশুকে রেখে মা চন্দ্ররানিকে ডবকা থেকে বন্দি করা হয় তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে!

কোথায় মানব অধিকার?

স্ন্যাপশট : ৬

মৃত মধুবালা নমঃ দাসের জায়গায় মধুবালা মণ্ডল, অজ্ঞাত সানাউল্লার জায়গায় রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত ৩০ বছর ভারতীয় সেনবাহিনীতে কর্মরত মহম্মদ সানাউল্লতে শেষ নয়!

১৯৫১ সালে বাবার লিগ্যাসি আছে৷ তবু বিদেশি ঘোষণা করার আগেই ডলি রায়ের ঠিকানা জোড়হাট ডিটেনশন ক্যাম্প!

একইভাবে ১৯৫১-র এনআরসি লিঙ্ক থাকা বিহারি অনিলা শাহুর নতুন ঠিকানা হিটলারি ক্যাম্প! কোথায় আইন? কোথায় সাংবিধানিক অধিকার?

স্ন্যাপশট : ৭

তেজপুর ক্যাম্পে জব্বার আলির মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার অচল অবস্থায় পড়েছেন আইনি লড়াই করতে গিয়ে৷

ধ্বংসের মুখে গোয়ালপাড়ার দুর্যোধন দাসের পরিবারও! ৩ বছর অতিক্রম করা ডিটেনশন ক্যাম্পে আবদ্ধ দুর্যোধনের ১২ বছরের কন্যা বুদ্ধেশ্বরী দাস ও ৮ বছরের পুত্র নীরেন দাসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷

কে নেবে ভুক্তভোগী পরিবারের দায়িত্ব?

অবুঝ নীরেনের এক অসম্ভব বেদনাদায়ক প্রশ্ন, ‘বাবা কবে আসবে?’

স্ন্যাপশট : ৮

চিরাং-এর পার্বতী দাস প্রায় ৩ বছর ধরে আবদ্ধ কোকরাঝাড় ডিটেনশন ক্যাম্পে। আইনি মামলা চালাতে ভিটেমাটি বিক্রি করেও মাকে ঘরে আনতে পারেননি তাঁর দুর্ভাগা টোটোওয়ালা ছেলে!

আরেক ছেলে মানসিক বিকারগ্রস্ত!

আইনের নামে কীভাবে এই পরিবারটিকে হেনস্থা করা হয়েছে, তা বাড়িটিতে না গেলে কেউ বুঝতে পারবেন না৷

ছেলের কথা, ‘সব শেষ হয়েছে কিন্তু মাকে জীবিত অবস্থায় না পেলে মৃতদেহটা লাগবে না!’

স্ন্যাপশট : ৯

মধুবালার পাশের গ্রামের দৈলংঝার-নিবাসী দিনমজুরি করে পরিবার চালানো ক্ষিতিনাথ সিহি প্রায় ৩ বছর ধরে আবদ্ধ! আইনি মামলা চালাতে ঘরের ভিটামাটি বিক্রি করে পরিবার আজ গৃহহীন! নামের সামান্য ভুলের জন্য সর্বস্বান্ত হওয়া পরিবার আজও পেল না ন্যায়!

ক্ষিতিনাথ এখনও আবদ্ধ হিটলারি ক্যাম্পে এবং তার অসহায় স্ত্রী ও সন্তানেরা অন্যের বাড়িতে আশ্রিত!

স্ন্যাপশট : ১০

নাগরিকত্বের নামে অন্যায় ব্যাভিচার যখন সিলিং ছুঁয়ে যাচ্ছে!

প্রত্যক্ষ পরোক্ষ হত্যা এখন ৫৫ পার!

ডিটেনশন ক্যাম্পে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া সর্বশেষ সংযোজিত প্রাণী ক্যান্স্যার রোগে আক্রান্ত ৭০ বছরের আদিবাসী চা-বাগানিয়া বৃদ্ধ রংজুলির সোনা মুন্ডা!

মানবতার বদ্ধভূমিতে পরিণত হওয়া এই অসম রাজ্যের স্ন্যাপশট লিখে শেষ করা যাবে না!

বিদেশির নামে স্বদেশিকে যন্ত্রণা দিয়ে বিশ্বের বুকে আসাম তথা ভারতকে লজ্জাবনত করা এই কালো ইতিহাসে হত্যার তালিকায় তিনসুকিয়ার ছোটকি প্রজাপতি ও অন্যকে আইনের পরামর্শ দেওয়া শিক্ষক—অধিবক্তা নীরদবরণ দাসের ঘটনা অবশ্যই উল্লেখনীয় থাকবে!

বাদ পড়বে না এক সময় ডিটেনশন ক্যাম্পে আবদ্ধ শতায়ু অন্নদাবালা রায়, শিলচরের ১০২ বছরের বৃদ্ধ চন্দ্রধর দাস অথবা ভবেন দাসদের দুই পুরুষ হত্যার বাস্তব কাহিনি! কালো ইতিহাসে সংযুক্ত হবে গত সপ্তাহে বৃদ্ধ হিকমত ও বৃদ্ধ শরাফত আলির হত্যার কাহিনিও…৷

আরও কত প্রাণ গেলে বিবেক জাগবে কে জানে…! কিন্তু এই সমস্ত কিছুই যে কালো ইতিহাসের সাক্ষী হবে এটা নিশ্চিত…!’

(ঋণ : পারিজাত নন্দ ঘোষ)

আসামের আরেকটি চিঠি পড়া যাক :

‘আসামে একসময় দুটো বাঙালি-প্রধান অঞ্চল ছিল অবিভক্ত কাছাড় জেলা ও গোয়ালপাড়া জেলা৷ গোয়ালপাড়া জেলার অসমীয়াকরণ অনেক আগেই হয়ে গেছে৷ এখন বরাক উপত্যকার অসমীয়াকরণ জাতীয়তাবাদীদের কাছে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে৷ কারণ বাঙালিদের এই শেষ দুর্গ দখল না করলে অসমিয়া সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না৷ তাই এ উদ্দেশ্যে তিনভাবে আক্রমণ শুরু হল—রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন৷ রাজনৈতিকভাবে সুকৌশলে শিল্প উদ্যোগ বা অন্য কর্মসংস্থানের উপায় থেকে বঞ্চিত করা৷ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের ধীরে ধীরে অপসারণ করা৷ তাই দেখা যায় যে বরাক উপত্যকায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর নিয়োগ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়াদের হচ্ছে৷ পুলিশ ও গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের ক্ষেত্র সম্পূর্ণভাবে বাঙালিমুক্ত করা হল৷

অন্যদিকে খুব সন্তর্পণে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু হল৷ এক্ষেত্রে ‘ফ্রগ ইন হট ওয়াটার’ নীতি অবলম্বন করা হল৷ একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে যে একটা ব্যাঙকে যদি হঠাৎ গরম জলে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাঙটা লাফিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করবে৷ আর যদি ঠান্ডা জলে ব্যাঙটাকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং পরে আস্তে আস্তে গরম জল মেশানো হয় তখন ব্যাঙ বুঝতেই পারবে না যে সে ক্রমশ গরম জলে ডুবে যাচ্ছে৷

একইভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু হয় বরাক উপত্যকায়। আজ থেকে দশ বছর আগেও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আমলারা বরাকের সরকারি ভাষার বাংলার কথা মনে রেখে বাংলায় কথাবার্তা বলতেন৷ আস্তে আস্তে সেটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে আমাদের বাঙালিদেরও দোষ আছে৷ তাঁরা অসমীয়া অফিসারদের অনুগ্রহ লাভ করার জন্য তারা নিজেরাই অসমীয়ায় কথা বলে প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করলেন৷ অসমীয়া অফিসাররা বাংলা কথায় বলতে চাইলেও এই ধরনের বাঙালিরা অসমীয়া বলতে থাকলেন৷ অসমীয়া ভাষাতে কথা বলতে কারও কোনো আপত্তি নেই৷ রাজ্যের প্রধান ভাষা শেখা জরুরি৷ কিন্তু যখন সেটা দাসত্ব মনোভাব প্রকাশ করে, তখনই তা আপত্তির কারণ হয়ে ওঠে৷

ফলে দেখা গেল যে বরাক উপত্যকায় সরকারি নির্দেশাবলি অসমীয়া ভাষায় আসতে শুরু হল—যদিও বরাকের সরকারি ভাষা বাংলা৷ বিজ্ঞাপন, সরকারি যানবাহন, জেলা গ্রন্থাগারে পাঠানো বই—সব কিছুতেই এ ধরনের অনুপ্রবেশ লক্ষ করা গেল৷ উদ্দেশ্য হল যে বরাক উপত্যকায় সরকারি ভাষা বাংলার অপ্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা যাতে আগামী দিনে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে রাখা না হয়৷

কিন্তু এ ধরনের আগ্রাসনের বিরোধিতা প্রধানত হিন্দু বাঙালিদের থেকে উঠতে থাকায় তখন বাঙালি হিন্দুদের বরাকের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র করা হল৷ নাগরিকত্ব বিধি সংশোধনী বিল ২০১৬ উত্থাপিত হওয়ার পর এই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার জন্য জোরদার প্রচেষ্টা শুরু হল৷

বরাকের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার করা হল যে, তারাই এই উপত্যকার আদি বাসিন্দা এবং বাঙালি হিন্দুরা দেশভাগের পর এখানে এসে তাদের জমি দখল করে নিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, এই হিন্দুরা শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হওয়ায় চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে এই জনগোষ্ঠীর লোকেদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে৷ তাই হিন্দু বাঙালিদের অধিকার হরণ করতে পারলে এইসব জনগোষ্ঠীর লোকেরা দারুণভাবে লাভবান হবেন৷ এই কথাগুলি এদের মধ্যে সত্য বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক৷ তাই জনগোষ্ঠীগুলোর বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম হল যাঁরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গী হলেন৷

শিলচর রেলস্টেশনের নাম ভাষা শহিদ রেলস্টেশন করার বিরোধিতা তাই প্রমাণ করে৷ বরাকের চা-শ্রমিকদের বেশিরভাগই বর্ধমান-বাঁকুড়া-বীরভূম জেলা বা সাঁওতাল পরগনা থেকে আগত৷ এদের কথা ভাষা বাংলার সমতুল্য এবং তাঁরা এতদিন বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা করেছেন৷ ইদানীং এঁদের হিন্দি ভাষাভাষী হিসেবে পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে৷ এই অপচেষ্টার পিছনে যাঁরা আছেন তাঁরা মূলত কেউই চা-বাগানের লোক নন৷ তাই এসবের পেছনে ন্যস্ত স্বার্থ যে কাজ করেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়৷

হিন্দু বাঙালিদের বিচ্ছিন্নকরণের শেষ ধাপে শুরু হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের এদের থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে দেওয়া৷ শুধু তাই নয়, বরাকের আদি হিন্দু বাঙালিদের থেকেও আলাদা করা৷ আর এজন্যই তাদের মধ্যে প্রচার করা হচ্ছে ‘ভূমিপুত্র’, ‘খিলঞ্জিয়া’, ‘থলুয়া’ ইত্যাদি৷ বলা হচ্ছে বাঙালি মুসলমান ও আদি হিন্দু বাসিন্দারা ভূমিপুত্র আর দেশভাগের পরে আসা হিন্দু বাঙালি বহিরাগত এবং এই বহিরাগতরা ভূমিপুত্রের ন্যায্য প্রাপ্তিতে বঞ্চিত করছে৷ কথাটা সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে গেল কারণ বহিরাগত হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতায় অনেক পিছনে৷

মজার ব্যাপার হল যে ভূমিপুত্র বা খিলঞ্জিয়ার বা ‘ইন্ডিজিনিয়াস পিপল’ বলে কোনো শব্দ ভারতের সংবিধানে নেই৷ ‘ভূমিপুত্র’ শব্দের জন্ম হয়েছে সত্তরের দশকে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার অ-মারাঠি-বিরোধী আন্দোলনের সময়৷ আর ‘খিলঞ্জিয়া’ শব্দটা জনপ্রিয়তা লাভ করছে আসাম আন্দোলনের সময়৷ দুই শব্দেরই ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা নেই৷ কারণ ভুমিপুত্র বা খিলঞ্জিয়া কে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি৷ সত্যিকারের অর্থে আদি বাসিন্দারা হলেন খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর এই অঞ্চলে আসা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষ অর্থাৎ খাসিয়া জয়ন্তিয়া৷ ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসেছে মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর মানুষ নাগা কুকিরা৷ আহোমরা তো অনেক অনেক পরে আসা৷ তাহলে কী করে দাবি করা হয় ভূমিপুত্র বলে?

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন বিভোর, আসামে যাঁরা বাংলাভাষী মানুষের ওপর তীব্র অত্যাচার করছে—তাঁদের ক্ষমতায় আনো৷ ‘ঘটি’ বা পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দারা ভাবছেন—ও ‘বাঙাল’রা জব্দ হবে৷ আমরা এবার চাকরি পাব বেশি করে৷ আর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তানরা ভাবছেন—আমাদের কিছু হবে না৷ আমাদের নাগরিত্ব ঠিক দিয়ে দেবে৷ আর অনেকে ভাবছেন, পাসপোর্ট আছে ভোটার কার্ড আছে বার্থ সার্টিফিকেট আছে৷ কিন্তু এদেশে আসার রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ১৯৬৬-র আগের জমির দলিল? ১৯৫১-র ভোটার তালিকায় নাম?

শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ভিত্তি হবে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট৷ তাহলে কী হবে?

মুখে যাই বলুক, বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুর চেয়ে মুসলিম বেশি এসেছে প্রমাণ করা খুব কঠিন৷ কতজন বাংলাদেশি ‘মুসলিম’-এর সঙ্গে আপনার দেখা হয়? আর কতজন পূর্ববঙ্গের শিকড় থাকা জন্মসূত্রে ‘হিন্দু’রা৷

২০১৬-এর নাগরিক বিল ও ক্যা আইন এক খুড়োর কল৷ যা কোনওদিন সহজে বাস্তবায়িত করা যাবে না অ-বাংলাভাষীদের চাপে৷

বাংলাকে আরেক কাশ্মীর বানাবে ফ্যাসিবাদীরা৷ ওরা বাংলার মাটি ও সম্পদ চায়—বাঙালিকে নয়৷ যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন—ততই মঙ্গল৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন